আবছা ছায়ামূর্তি দুটি খানিকটা দূরে। কথা বলছেন আবাথনট।
মেরী…
লক্ষ্মীটি এখন না না সব শেষ হয়ে যাবে।
ত্রস্তপায়ে পিছু হঠলেন মঁসিয়ে পোয়ারো। তারপর স্বগতোক্তি করলেন আশ্চর্য।
কেউই প্রায় কারোর সঙ্গে কথা বলছে না, রীতিমতো সন্দেহ হতে লাগলো। রীতিমতো চিন্তিত মেয়েটি। তার চোখের কোণে কালি পড়েছে। হঠাৎ থেমে গেল ট্রেনটা দুপুর আড়াইটার সময়। লাইনের ধারে জটলা বিভিন্ন কামরা থেকে লোকজন উঁকি মারছে। মুখ বাড়িয়ে পোয়ারো কণ্ডাক্টর-এর সঙ্গে কথা বললেন। মেরী ডেবেনহ্যামের সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লাগল পোয়ারোর, মাথাটা ভেতরে গলাতে গিয়ে।
ট্রেনটা থামল কেন? মেরী শঙ্কিত গলায় ফরাসী ভাষায় বললেন।
কিছু না একটু আগুন লেগেছিল কিচেন কোচের নিচে, ভয়ের কিছু নেয় তেমন। আগুনটা নিভিয়ে ফেলা হয়েছে টুকিটাকি কাজ চলছে মেরামতির।
হাতের অদ্ভুত ভঙ্গি করলেন মেরী।
হা, হ্যাঁ, তা তো বুঝলাম, কিন্তু এই সময়টা?
কিসের সময়?
এতে তো আমাদের পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে।
হ্যাঁ তা অবশ্য হতে পারে।
ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ধরতে হবে কনফোরাস পেরিয়ে আমাদের ছটা পঞ্চান্নয় পৌঁছে। কিন্তু দেরি হলে তো চলবে না। দেড় দুই ঘণ্টা দেরি হলে তো ঐ ট্রেনটা ধরতে পারব না।
হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক।
হাত ও ঠোঁট কাঁপছে মেরী ডেবেনহ্যামের। জানালার ফ্রেমটা ধরে রয়েছেন।
আপনার কি খুবই ক্ষতি হয়ে যাবে দেরি হলে? পোয়ারো নরম সুরে বললেন।
হা, হা, ওই ট্রেনটা আমার ধরতেই হবে।
করিডর ধরে কর্নেলের কামরার দিকে এগিয়ে গেলেন মেরী জানালার ধার থেকে সরে এসে।
ট্রেন চলতে শুরু করল মিনিট দশেক পরেই, মেরীর অবশ্য আশঙ্কা অমূলক। মিনিট পাঁচেক দেরিতে ট্রেনটা গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছালো।
স্টীমারে কনফোরাস পার হতে হয়। জল জিনিসটা আবার ধাতে সয় না মঁসিয়ে পোয়ারোর। স্টিমারে অবশ্য মঁসিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে মেরী বা কর্নেলের দেখা হল না।
.
০২.
তোকাতালিয়ান হোটেল
এরকুল পোয়ারো হোটেলে এসে স্নানাগার সমেত ঘর চাইলেন। আগেভাগেই কোনো চিঠিপত্র এসে অপেক্ষা করছে কি-না তার জন্য খোঁজ নিলেন তারপর।
একটা টেলিগ্রাম আর তিনটে চিঠি। টেলিগ্রামটা কিন্তু আসার কথা ছিল না। কাগজটা খুললেন ধীরেসুস্থে পোয়ারো। আপনার চিন্তাভাবনা অনুযায়ী প্রতিফলন ঘটেছে কাসনার ক্ষেত্রে, তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন।
দেখো তো কি কাণ্ড। পোয়ারো বিড়বিড় করে বললেন। কপালে বিশ্রাম নেই।
একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ তুলে তাকালেন। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ছাড়ে কটায়? হোটেলের ম্যানেজারকে বললেন, আজ রাতেই আমাকে রওনা হতে হবে।
রাত নটায় মঁসিয়ে।
একটা শোবার বার্থ নিতে হবে।
নিশ্চয়ই মঁসিয়ে কোনো অসুবিধাই হবে না। এই সময়টা ট্রেন প্রায় খালিই যায়, তেমন ভিড় তো থাকে না। ফার্স্ট ক্লাস না সেকেন্ড?
ফার্স্ট ক্লাস।
খুব ভালো কথা, কতদূর যাবেন মঁসিয়ে?
লন্ডন।
বেশ আপনার টিকিটের ব্যবস্থা আমি করে দেব।
ইস্তাম্বুল শ্যালে কোচে।
আটটা বাজতে দশ পোয়ারো আবার ঘড়ি দেখলেন।
এখন কি রাতের খাবার পাওয়া যাবে?
হা হা নিশ্চয়।
ছোটখাটো বেলজিয়ান ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন। ঘরটা নিয়েছিলেন থাকবার জন্য সেটা বাতিল করে খাবার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
সবেমাত্র বেয়ারাকে ডেকে খাবার আনতে দিচ্ছে একজন তার কাঁধে হাত রাখলেন।
আপনি এখানে? বন্ধু কি কাণ্ড। আমি আশাই করিনি কিন্তু।
বক্তা ভদ্রলোক একজন বেঁটে, মোটা বয়স্ক। ছোট করে ছাঁটা চুলগুলো, তিনি একগাল হাসি নিয়ে কথা বলছিলেন।
পোয়ারো লাফিয়ে উঠলেন।
মঁসিয়ে কুক!
মঁসিয়ে পোয়ারো!
মঁসিয়ে কুকও বেলজিয়ান। পদস্থ কর্মচারী রেল কোম্পানির। যখন বেলজিয়ান পুলিশে চাকরী করতেন মঁসিয়ে পোয়ারো তখন থেকেই দুজনের আলাপ।
কি খবর? বাড়ি ছেড়ে এতদূরে? মন খারাপ লাগছে না? মঁসিয়ে কুক বললেন।
একটা–কাজ ছিল সিরিয়ায়।
ফিরছেন কবে?
আজ রাতেই।
চমৎকার! আজ রাতের গাড়িতে আমিও ফিরব। যাবো লম্যান পর্যন্ত, কাজ আছে ওখানে। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে আপনি নিশ্চয় যাচ্ছেন?
হ্যাঁ, এই তো এক্ষুনি একটা বার্থ জোগাড় করতে বললাম। কটা দিন এখানে থেকে যাব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বিধিবাম। তাড়াতাড়ি ফিরে যাবার তলব এসেছে; এইমাত্র লন্ডন থেকে জরুরী তার পেলাম।
আঃ কাজ আর কাজ। কিন্তু এখন তো আপনি মশাই ওপরতলার মানুষ।
তা কয়েকটা ঘটনার সাফল্যে পেয়েছি।
কুক হাসলেন। পোয়ারো বিনীত হবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন।
আবার দেখা হবে খানিকপর।
গরম স্যুপের পাত্রে পোয়ারো সন্তর্পণে চুমুক দিলেন। আবার না গোঁফটা ভেজে। জনা ছয়েক মাত্র লোক ঘরে। কিন্তু দুজন পোয়ারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। একটা টেবিলে তারা বসে আছেন খানিক দূরেই। যুবক কজন বছর ত্রিশেক বয়স, বেশ হাসিখুশি। কিন্তু পোয়ারোকে আকর্ষণ করেছিলেন বয়স্ক মানুষটি, নির্ঘাত আমেরিকান। ষাট থেকে সত্তরের মধ্যে বয়স তার, দেখেই মনে হয় তার পায়ের তলায় জগতটা। সামান্য টাক মাথায়, দু সারি নকল দাঁত। উঁচু কপাল হাসি মুখ। কিন্তু দুটো চোখ কুতকুতে গর্তে ঢোকা শয়তানি মাখানো। যেন সবসময় বজ্জাতির ফন্দি আঁটছে। এক মুহূর্তের জন্য পোয়ারোর চোখে চোখ পড়ল, যুবকটির সাথে কথা বলতে বলতেই তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণতর হলো পলকেই। তারপর হেক্টর দামটা মিটিয়ে দাও, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন।