খানাকামরায় থাকাকালীন কণ্ডাক্টরকে বিছানা ঠিকঠাক করে রাখতে বলেছিলাম এবং খাওয়ার পরই শুতে চলে যাই।
এগারটা পর্যন্ত বইপত্র পড়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বাতের ব্যথায় কষ্ট পাবার জন্য রাত পৌনে একটা নাগাদ পরিচারিকাকে ডাকতে পাঠাই, সে এসে মালিশ করে এবং বই পড়ে শোনায়। তারপর ঘুম এসে যাবার ফলে ও যে কখন চলে গিয়েছিল আমার মনে নেই তবে মনে হয় আধ ঘন্টা মত ছিল।
ট্রেন কি তখন চলছিল?
না।
কোনো অস্বাভাবিক শব্দ কি পেয়েছিলেন যতক্ষণ জেগে ছিলেন?
না।
আপনার পরিচারিকার নাম?
ইল্ডগ্রেদ স্মিট।
আপনার কাছে উনি আছেন কতদিন?
পনেরো বছর।
বিশ্বাসভাজন?
সন্দেহাতীত ভাবে। আমার স্বামীর খাস তালুকের প্রজা ছিল ওর বাবা।
আপনি নিশ্চয় আমেরিকায় গেছেন মাদাম।
রাজকুমারী একটু অবাক হলেন হঠাৎ বিষয়ের পরিবর্তনের ফলে।
হ্যাঁ, অনেকবার।
আচ্ছা ওখানে আর্মষ্ট্রং পরিবারকে চিনতেন? যাঁদের পরিণতি অত্যন্ত করুণ ও দুঃখজনক…।
বেদনা বিধূর হয়ে উঠল রাজকুমারীর গলার স্বর।
মঁসিয়ে ওঁরা আমার বন্ধুস্থানীয় ছিলেন।
কর্নেল আর্মষ্ট্রংকে তাহলে ভালোভাবেই চিনতেন আপনি?
ওঁকে তেমন নয় তবে ওঁর স্ত্রী সোনিয়া আমার মেয়ের মতো ছিল। ওঁর মা লিণ্ডা আর্ডেন আমার পুরনো বান্ধবী।
উনি কি মারা গেছেন?
না না, শোকে পাথর হয়ে যাবার ফলে একাকীত্ব নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন এবং আজকাল চলাফেরাও বেশি করতে পারেন না।
আর একটা মেয়ে ছিল তো ওঁর?
হা। সে অবশ্য অনেক ছোট সোনিয়ার থেকে।
মেয়েটি নিশ্চয় জীবিত?
নিশ্চয়ই।
বলতে পারেন কোথায় আছে?
রাজকুমারী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকালেন।
আচ্ছা এসব জিজ্ঞাসার কারণ, এর সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের কি সম্পর্ক?
সম্পর্ক থাকার ফলেই জিজ্ঞাস্য কারণ যিনি খুন হয়েছেন তিনি ডেইজির হত্যাকারী।
আমাকে ক্ষমা করবেন। সত্যিই এ খবরটা আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দদায়ক।
আর লজ্জা দেবেন না সত্যি এটা স্বাভাবিক কারণ ওঁরা আপনার পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। আচ্ছা লিণ্ডা আর্ডেনের ছোট মেয়েটা কোথায় এখন?
আমি এ ব্যাপারে সঠিক জানি না, তবে শুনেছিলাম একজন ইংরেজ বিয়ে করে ইংল্যাণ্ডের বাসিন্দা। আর কিছু জানতে চান?
একটাই প্রশ্ন মাদাম। আপনার ড্রেসিং গাউনের রঙ কি?
অদ্ভুত প্রশ্ন। নীল রেশমের।
ধন্যবাদ আপনার সহযোগিতার জন্য।
রাজকুমারী হাত নাড়লেন।
ও কিছু নয়। আমার অপরাধ যদি না নেন তবে আপনার নামটা আমার খুব চেনা লাগছে।
এরকুল পোয়ারো।
মিনিট খানেক চুপ থাকার পর অস্ফুট স্বরে বললেন এরকুল পোয়ারো। হ্যাঁ এইবার মনে পড়েছে ভবিতব্য।
বেরিয়ে গেলেন দ্রাগোমিরফ।
আহা চমৎকার মহিলা।
মোহিত হয়ে গেলেন মঁসিয়ে কুক।
চিন্তিতভাবে পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন, আমাকে একটু ভাবিয়ে দিয়ে গেলেন বন্ধু। ভবিতব্য কথার মানে কি?
.
০৬.
কাউন্ট আর কাউন্টেস আন্দ্রেনীর সাক্ষ্য
ডেকে পাঠানো হল কাউন্ট আর কাউন্টেস আন্দ্ৰেনীকে। একাই এলেন কাউন্ট। দেখলে ইংরেজ বলে মনে হবে। ছ ফুট লম্বা, চওড়া কাঁধ। সুবেশ মার্জিত এক চমৎকার দেখতে।
কাউন্ট এসে বললেন, আমি কি করতে পারি আপনাদের জন্য বলুন? এবং কেন ডেকে পাঠিয়েছেন?
একটু জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আপনাকে এখানে ডাকা হয়েছে যাত্রী এবং রেল কর্তৃপক্ষের তরফে কারণ মাঝ রাতে একটা ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড হবার ফলে।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। তবে এ ব্যাপারে আমি হয়ত কোনো সাহায্যই করতে পারব না, কেননা কাল রাতে আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই ঘুমিয়েছিলাম।
আপনি কি ওই মৃত ব্যক্তির পরিচয় জানেন?
ওই টেবিলে রুক্ষ চেহারার আমেরিকান ভদ্রলোকটির!
হা। ঠিকই ধরেছেন।
নাতো। তবে ওর নামটাম নিশ্চয় পাসপোর্টে আছে।
পাসপোর্টে নাম আছে রাশেট কিন্তু ওটা ওর নাম নয়। ওঁর প্রকৃত নাম কাসেট্টি, আমেরিকান, কুখ্যাত খুনে ও ছেলেধরা।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পোয়ারো নিরীক্ষণ করছিলেন কাউন্টকে তবে ভাবলেশহীনভাবে।
কাউন্ট বললেন, তাই নাকি। তাহলে রহস্যের কিছু আলোকপাত হবে। সত্যিই আমেরিকা–আজব দেশ।
আপনি আমেরিকায় গেছেন কোনোদিন?
এক বছর ওয়াশিংটনে ছিলাম।
আর্মষ্ট্রং পরিবারকে চিনতেন?
এই নামে অনেকেই আছেন ঠিক বুঝতে পারছি না।
ওঁরা পাশাপাশি বারো এবং তেরো নম্বর কামরায় আছেন।
কখন শুতে গিয়েছিলেন কাল রাতে?
কাল রাতে খাচ্ছিলাম যখন তখন কণ্ডাক্টর আমাদের বিছানা পেতে দেয় ওখান থেকে ফিরে অন্য কামরায় কিছুক্ষণ তাস খেলি।
কোনো কামরায়?
তেরো নম্বরে। আমার স্ত্রী রাত এগারটায় শুয়ে পড়ে, আমি অন্য কামরায় শুতে যাই, আজ সকালের আগে ঘুম ভাঙেনি।
আপনার স্ত্রীর?
ওতো ঘুমের বড়ি খেয়ে শোয় ট্রেনে। আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারলাম না বলে দুঃখিত।
আপনার নাম ঠিকানাটা?
কাউন্ট নাম ঠিকানা লিখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
আমার মনে হয় না আমার স্ত্রীর এখানে আসার দরকার আছে কেননা ও কিছুই বলতে পারবে না।
তা ঠিক তবে দু একটা কথা বলা দরকার।
না না দরকার নেই।
দেখুন এটা আমাদের তদন্তের অপরিহার্য অঙ্গ।
যা ইচ্ছে আপনাদের, বলে বেরিয়ে গেলেন।
পোয়ারো স্বামী-স্ত্রীর পাসপোর্টটা দেখলেন।
ভদ্রমহিলার নাম এলেনা মারিয়া প্রাকৃবিবাহ পর্বে গোল্ডেনবার্গ। বয়স : কুড়ি। পাসপোর্টে একটু দাগ আছে।
কুক বললেন, দেখবেন, আমাদের চাকরী আর সম্মান যেন না যায়; কেননা এঁরা সব উপর তলার মানুষ।