বিদায় ভাষণটা আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন লেফটেন্যান্ট দুবো। পরিষ্কার মার্জিত ভাষায় শেষ মুহূর্তের স্তুতি শুরু করলেন। যথেষ্ট বিনয়ীও মঁসিয়ে পোয়ারো।
গাড়ি ছাড়বার সময় হয়েছে মঁসিয়ে, কন্ডাক্টর বলল। পোয়ারো গাড়িতে উঠলেন অনিচ্ছুক পায়ে তার পিছু পিছু কণ্ডাক্টর। লেফটেন্যান্ট দুবো লম্বা স্যালুট ঠুকলেন। হাত নাড়লেন মঁসিয়ে পোয়ারো, প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটি চলতে শুরু করল।
কণ্ডাক্টর তার স্লিপার কোচ দেখাচ্ছিল পোয়ারোকে। এই যে, আপনার ব্যাগটা এখানে রাখলাম, দেখুন মঁসিয়ে কেমন চমৎকার ব্যবস্থা।
বকশিশ দিলেন কণ্ডাক্টর গার্ডকে এরকূল পোয়ারো। আপনি বোধহয় ইস্তাম্বুলে যাবেন? আপনার পাসপোর্ট আর টিকিট আমার কাছেই থাকবে ধন্যবাদ স্যার।
বেশি লোক তো যাচ্ছে না, না?
হা। না। ওখানে নামবেন দুজনেই ইংরেজ। ভারতবর্ষ থেকে এসেছেন একজন-কর্নেল বাগদাদ থেকে আসছেন আর একজন তরুণী। আর কিছু কি লাগবে আপনার?
এক বোতল পেরিয়ার চাইলেন মঁসিয়ে পোয়ারো। সূর্য উঠতে এখনও ঘণ্টা দুয়েক দেরি এই ভোর পাঁচটায় ট্রেনে উঠা বিরক্তিকর। কটা দিন যা খাটুনি গেছে এই যা ভালো। যাক শেষ রক্ষা হয়েছে। গুটি সুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
তার যখন ঘুম ভাঙলো তখন বেলা সাড়ে নটা। তড়িঘড়ি গরম কফি খেতে তিনি পা বাড়ালেন কিচেন কোচের দিকে।
সেই সময় সেখানে একজন মাত্র উপস্থিত, অবশ্যই কন্ডাক্টর বর্ণিত ইংরেজ তরুণী। লম্বা, রোগা, তামাটে গায়ের রঙ আঠাশ-বছর বয়স। আত্মবিশ্বাস বোধও প্রবল, খুব চালাক চতুর আর চটপটে। অন্তত নিপুণভাবে খাওয়ার ধরন দেখে সেটাই মনে হয়। কফির জন্য কণ্ডাক্টরকে যেভাবে আদেশ করলেন, তাতে মনে হয় তরুণীটির ভ্রমণের অভ্যেস আছে। বেশ গরম ট্রেনের ভেতরটা, সেইমতো পাতলা সূতির জামা পরেছেন।
কোনো কাজ নেই পোয়ারোর হাতে, কাজেই তিনি তরুণীর প্রতি মনোনিবেশ করলেন। এই যুবতীটি সেই ধরনের যারা সবরকম অবস্থায় নিজেদের বাঁচিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে। নরম ধূসর রঙের চোখ। কালো কুচকুচে ঢেউ খেলানো চুল, গায়ের চামড়া নরম মসৃণ। এক কথায় যথেষ্ট আকর্ষণীয়া। তাঁর নিঃশব্দ পর্যবেক্ষণ শুরু হল।
চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বয়স একজন আগন্তুকের প্রবেশ ঘটল তার খানিকপর। সুগঠিত মেদহীন তামাটে চেহারা।
পোয়ারো স্বগোক্তি করলেন এই সেই কর্নেল। আগন্তুক তরুণীর দিকে ইষৎ ঝুঁকে অভিবাদন জানালেন।
সুপ্রভাত নিন ডেবেনহ্যাম।
সুপ্রভাত কর্নেল আবাথনট।
আপনার টেবিলে বসতে পারি?
নিশ্চয়ই। বসুন।
অসুবিধা নেই তো কোনো?
কিছুমাত্র না।
পোয়ারোর দিকেও একবার তাকালেন তিনি। বেয়ারাকে হাতের ভঙ্গিতে ডেকে ডিম আর কফির অর্ডার দিলেন কর্নেল আবাথনট। আমি বাজি ফেলে বলতে পারি কর্নেল ভাবছে ব্যাটা ভিনদেশী উড়ে এসে জুড়ে বসেছে পোয়ারো ভাবলেন।
ঐ ভদ্রমহিলা আর কর্নেল দুজনেই ইংরেজ কাজেই গল্প টল্প করতে পারেন না কেউই। টুকটাক কথা চলছিল। মেরী উঠে তার কামরার দিকে চলে গেলেন একটু পরেই।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দুপুরের খাবার সময়ও। দায়সারাভাবে কথাবার্তা চালাতে লাগলেন কর্নেল আর মেরী একই টেবিলে বসে। ঘরে তৃতীয় ব্যক্তি অর্থাৎ পোয়ারার উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাঞ্জাবের গল্প করছিলেন কর্নেল। তিনি বাগদাদে এক পরিবারে গভর্নেস ছিলেন, তরুণীর কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল। কিছু পরিচিত লোকজনের কথা উঠল দুজনেরই কথায় কথায়। সুতরাং দুজনেই স্বাভাবিক অল্পবিস্তর এখন। আপনি কি সোজা লন্ডনেই যাচ্ছেন না কি ইস্তাম্বুলে নামবার ইচ্ছে আছে, কর্নেল জিজ্ঞাসা করলেন।
না সোজা লন্ডনে যাব।
ইস, ইস্তাম্বুল শহরটা দেখা হবে না।
না না আমি দু বছর আগে তিনদিন থেকে ইস্তাম্বুলে সব ঘুরে বেড়িয়ে গেছি।
আমি সোজা লন্ডনেই যাব। তাহলে তো ভালোই হল, অকারণেই একটু লাল হলেন কর্নেল।
বেচারা। মনে মনে মুচকি হাসলেন পোয়ারো। সায় দিলেন মিস ডেবেনহ্যাম।
এক সঙ্গে যাওয়া যাবে ভালোই হল।
তাঁর কামরা পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন। এবার কর্নেল মেরীর সঙ্গে। এরপর অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য টরাসের। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সকলে। মেরীর দীর্ঘশ্বাস শুনে চমকে উঠলেন হঠাৎ।
মেরী খুব মৃদুস্বরে বললেন, এত সুন্দর আমি যদি–ঘাড় ফেরালেন আবাথনট।
কি?
সব কিছু যদি উপভোগ করতে পারতাম।
কোনো উত্তর দিলেন না আবাথনট। তার দৃঢ় চোয়াল দৃঢ়তর হল।
তুমি এসব ঝামেলা থেকে দূরে থাক আমি প্রার্থনা করি ঈশ্বরের কাছে।
ভ্রূ বাঁকালেন মিস ডেবেনহ্যাম।
তুমি চুপ কর।
কর্নেল পোয়রোর দিকে বিরক্তি মাখানো চোখে এক ঝলক তাকালেন। কিন্তু ঠিক আছে–তোমার এই চাকরিটা আমার পছন্দ নয়। সর্বক্ষণ মায়েদের আর বাচ্চাদের তাবেদারী করা।
ইস এভাবে বোলো না। আমাদের মতো গভর্নেসদের আজকাল আর কেউ চোখ রাঙিয়ে কথা বলে না বরং মায়েরাই আমাদের ভয় পায়। চুপ করে রইলেন আবাথনট।
বাঃ দিব্যি জুটিটি, আপনমনেই ভাবলেন পোয়ারো। ট্রেন কেনিয়াতে এসে পৌঁছলো রাত সাড়ে এগারোটায়। হাত পা টান করতে স্টেশনে নামলেন দুজন ইংরেজ। হালকা পায়ে পায়চারি করতে ব্যস্ত দুজনেই। দুজনকে জানালা দিয়ে দেখছেন পোয়ারো। তিনি গরম জামা কাপড় পরে মিনিট দশেক পর সাহস সঞ্চয় করে হাত-পায়ের খিল ছাড়িয়ে নিতে নিচে নামলেন।