ভানুমতির খেল দেখেছেন কি ডাক্তার? সেই যে একটা লোককে হাত পা বেঁধে সিন্দুকে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দেওয়া তালা চাবি এঁটে। অথচ কিছুক্ষণ পর লোকটিকে আর দেখা গেল না।
এখানেও কি সেই একই ব্যাপার।
হা। অনেকটা সেই। হত্যাকারী অন্যদের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। সে যেন জানালা দিয়েই পালিয়েছে এবং অন্য পথ তার বন্ধই ছিল। একটা বুদ্ধির খেলা আছে সেটা খুব কৌশলেই আমায় ধরতে হবে। ওধার থেকে তো পাশের কামরা বন্ধই ছিল। এদিক থেকে সেটাও বন্ধ করে দিলেন পোয়ারো।
মিসেস হার্বাডের যা কৌতূহল, বুঝলেন ডাক্তার। বলা তো যায় না গোপনে অকুস্থল দেখার লোভ উনি সামলাতে পারবেন না হয়তো সেই মেয়েকে চিঠি লেখবার আগে। এবং আমি সেই হেতু ও পথ বন্ধ করে দিলাম।
আরো একবার ভালো করে দেখে নিলাম। বললেন চলুন মঁসিয়ে কুকের ওখানে যাওয়া যাক কেননা এখানে আপাতত আর কোনো কাজ নেই।
.
০৮.
আর্মষ্ট্রং পরিবারের কথা
তারপর তদন্তের কাজ কতদুর এগোল মঁসিয়ে পোয়ারো। মঁসিয়ে কুক জিজ্ঞাসা করলেন।
কুক, পোয়ারো আর ডাক্তার এই তিনজন কামরায় ছিলেন। যাত্রীদের সবাইয়ের খাওয়া দাওয়ার পর খানা কামরায় বসে সাক্ষ্য প্রমাণের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করবেন মঁসিয়ে পোয়ারো সেই রকমই বলেছেন মঁসিয়ে কুক।
মিঃ রাশেটের প্রকৃত পরিচয় জানা গেছে এবং সে কেন আমেরিকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল তাও।
একটু প্রাঞ্জল করে বলবেন ব্যাপারটা।
আপনারা কাসেট্টির নাম শুনেছেন নিশ্চয়। যে আর্মষ্ট্রং নামের ফুলের মতো একটি শিশুকে হত্যা করেছিল।
দাঁড়ান দাঁড়ান। নামটা খুবই চেনা লাগছে, একটু খুলে বলুন তো।
নিহত মিঃ রাশেটের আসল নাম কাসেট্টি। কর্নেল আর্মষ্ট্রং ছিলেন ইংরাজ। তিনি ভিক্টোরিয়া ক্রস পান প্রথম মহাযুদ্ধের সময়। জন্ম সূত্রে তাকে অবশ্য আধা আমেরিকানও বলা চলে। ওঁর মা ছিলেন একজন নামজাদা মার্কিন কোটিপতির মেয়ে। বিখ্যাত অভিনেত্রী লিণ্ডা আর্ডেনের মেয়েকে উনি বিয়ে করেন। ট্রাজিক চরিত্র অভিনয়ে শ্রীমতী আর্ডেনের তুলনা মেলা ভার ছিল। আমেরিকায় থাকতেন কর্নেল আর্মস্ট্রং। ডেইজি নামের একটা ফুটফুটে মেয়ে ছিল। যখন তার বয়স তিন তখন তাকে অপহরণ করা হয়। কাসেট্টি তখন দুবৃত্ত দলের নেতা ছিলেন। মোটা টাকা মুক্তিপণ হিসাবে নেওয়ার পরও ডেইজিকে আগে মারা হয়েছিল। রাশেট এরকম নৃশংস কাজ আগেও করেছে। সমাজবিরোধী কাজকর্ম করেও সে কোটিপতি হয়ে উঠে তারপর কাগজেও হৈ চৈ হয়। পরে সে আমেরিকা ছেড়ে পালায়। এখানেই কিন্তু ঘটনার শেষ নয়। মিসেস আর্মষ্ট্রং সেই সময় সন্তান সম্ভবা ছিলেন। এই আকস্মিক আঘাত সহ্য করতে না পারার দরুণ তিনি মারা যান একটি মৃত শিশুর জন্ম দিয়ে এবং কর্নেল আর্মস্ট্রং আত্মহত্যা করেন।
কুক বললেন, ওঃ কি ভয়ানক। আমারও এবার মনে পড়েছে ঐ পরিবারের বোধ হয় আরও একটা মৃত্যু…।
হ্যাঁ ডেইজির দেখাশোনা করত এক হতভাগিনী ফরাসী পুলিশ। তাকে অহেতুক সন্দেহ করার ফলে সে লজ্জায় ক্ষোভে আত্মহত্যা করেছিল খোলা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে। কিন্তু সে ছিল সম্পূর্ণ নিরাপরাধ।
আর্মষ্ট্রং পরিবারের মৃত্যু যজ্ঞের মূল হোতা কাসেট্টি ছ মাস পরে ধরা পড়ে। এবং পুলিশের আওতা থেকে কোনোরকমে বেরিয়ে এসে আমেরিকা ছেড়ে পালায়, সেই হেতু তার প্রকৃত পরিচয় কেউ জানতে পারেনি।
তাহলে দেখছি খুন হয়ে উচিত শাস্তিই সে পেয়েছে। একটা ঘৃণ্য জন্তুরও অধম, কুক বললেন।
আপনার সঙ্গে আমি একমত এ বিষয়ে। কিন্তু এত জায়গা থাকতে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে কেন?
পোয়ারো একটু হাসলেন।
এটা আমারও প্রশ্ন বন্ধু।
তবে কি অন্যদলের কেউ রেষারেষি করে ওকে খুন করল? নাকি পুরোপুরি ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার ফসল?
অনুমান যদি সত্য হয় হত্যাকারী এই কাগজটা কেন পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল, আর্মষ্ট্রং পরিবারের উল্লেখ ছিল বলে।
কেউ কি জীবিত আছেন আর্মস্ট্রং পরিবারের?
দুঃখের বিষয় আমার তা জানা নেই। তবে কাগজে পড়েছিলাম মিসেস আর্মষ্ট্রং-এর এক বোন ছিল।
ভাঙা ঘড়িটার কথা উঠতেই কুক বললেন, তাহলে তো খুনের সঠিক সময়টা জানা হয়ে গেল।
হা। সময়টা সঠিক বলেই মনে হচ্ছে। একটু চিন্তান্বিত গলায় পোয়ারো বললেন।
তার কথা বলার ভঙ্গিতে একটা এমন কিছু ছিল, যে অন্য দুজন চমকে তাকালেন।
রাত একটা বাজতে কুড়ি মিনিটে রাশেট ওরফে কাসেট্টি জীবিত ছিলেন আপনি বলেছেন কারণ তার সঙ্গে কণ্ডাক্টর কথা বলছিল।
একটা বাজতে তেইশ মিনিট তখন।
অর্থাৎ বারোটা সাঁইত্রিশেও জীবিত ছিল। এটা তো আর উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পোয়ারো কোনো উত্তর দিলেন না। দরজায় মৃদু টোকা পড়ল, একজন রেল কর্মচারী খবর দিল যে পোয়ারো ইচ্ছে করলে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন যাত্রীদের। মঁসিয়ে কুক উঠে দাঁড়ালেন।
চলুন যাওয়া যাক।
আমিও আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি, বললেন ডাক্তার।
নিশ্চয়। অবশ্য মঁসিয়ে পোয়ারো যদি আপত্তি না করেন।
কিছুমাত্র না আপনিও চলুন।
তিনজন এগিয়ে গেলেন খানাকামরার দিকে।
২. দ্বিতীয় পর্ব: যাত্রীদের জবানবন্দী
দ্বিতীয় পর্ব: যাত্রীদের জবানবন্দী
০১.
কণ্ডাক্টর গার্ডের সাক্ষী
তদন্ত শুরু হলো।
একটা টেবিলের ধারে মঁসিয়ে পোয়ারো আর কুক বসলেন।
একটু দূরে ডাক্তার। পোয়ারোর সামনে ইস্তাম্বুল কাল কোচের যাত্রীদের নামের তালিকা, কোচের নকশা, লাল কালি দিয়ে কে কোথায় কোনো কামরায় চিহ্নিত করা আছে। টেবিলের উপর স্তূপাকৃতি পাসপোর্ট আর টিকিট। এছাড়াও লেখবার কাগজ। কালির দোয়াত, কলম আর পেন্সিল।