ঘড়িটা একটা বেজে পনের মিনিটে বন্ধ হয়ে গেছে এবং নিশ্চয় আঘাতের ফলে কাঁচটাও ভেঙে গেছে।
একটা মোটামুটি আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে যে খুন হবার সঠিক সময়ের। রাত বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে যে কোনো সময় ঘটনাটা ঘটেছে অবশ্য আমিও বলেছিলাম।
হা হা সে তো হতেই পারে।
বোধহয় পোয়ারোর স্বরে সূক্ষ্ম বক্রোক্তি ছিল।
ফিরে তাকালেন ডাক্তার।
আমি বুঝি না মশাই আপনি কি এত ভাবেন সময় সময়।
আমিও নিজেও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।
আর সেজন্যই বেশি করে ভাবাচ্ছে আমায়।
তীক্ষ দৃষ্টিতে পোয়ারো জরীপ করতে লাগলেন। এক টুকরো আধপোড়া কাগজ দেখালেন ডাক্তার।
সেটাকে খুব যত্ন করে তাকের উপর রেখে শুকনো কাপ চাপা দিয়ে রাখলেন পোয়ারো, যাতে উড়ে না যায়।
যে কোনো মহিলার একটা টুপি রাখার বাক্স খুবই প্রয়োজন বুঝলেন ডাক্তার। দাঁড়ান কণ্ডাক্টরকে ডাকি। পোয়ারো কামরার দরজা খুলে মুখ বাড়ালেন কণ্ডাক্টর গার্ড দৌড়ে এল।
এই বগিতে মহিলা কজন আছেন? জিজ্ঞাসা করলেন।
মঁসিয়ে ছজন। ঐ আমেরিকান প্রৌঢ়া, সুইডিস মহিলা। ইংরেজ তরুণী। কাউন্টেস আন্দ্ৰেসি, রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ, আর তাঁর পরিচারিকা।
টুপি রাখবার বাক্স কি সবার কাছে আছে এঁদের?
হা মঁসিয়ে।
বেশ তুমি বরং … আচ্ছা ঐ সুইডিস মহিলাটির আর রাজকুমারীর পরিচারিকাটির কামরা থেকে বাক্স দুটো হাতিয়ে নিয়ে এস। যদি ধরা পড়ে যাও কিছু একটা বানিয়ে বলে দেবে।
কোনো অসুবিধেই হবে না মঁসিয়ে, কেউ ওঁদের কামরায় নেই।
তাহলে চটপট যাও।
কণ্ডাক্টর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গিয়ে বাক্স দুটো নিয়ে এল। পরিচারিকাটির বাক্সটি খুলে আবার বন্ধ করে সরিয়ে রাখলেন পোয়ারো। সুইডিস মহিলার বাক্সটি থেকে কোনো ঈঙ্গিত বস্তুর বোধহয় সাক্ষাত মিলল। ধাতব তৈরি তারের ছোট ছোট টুকরো জাল বের করলেন টুপিগুলো সাবধানে সরিয়ে।
এই দেখুন পেয়েছি। এই টুপি রাখার বাক্সগুলো পনের বছর আগে চালু ছিল। একটা পিন দিয়ে টুপিগুলো জালের উপর আটকে রাখা যায়।
দু টুকরো জাল নিপুণভাবে খুলে নিয়ে কণ্ডাক্টরের হাতে বাক্সগুলো ফেরত দিলেন।
এবার জায়গা মতো এটা রেখে এস।
আপনি বোধহয় অবাক হচ্ছেন আমার কাজের পদ্ধতি দেখে, ডাক্তারকে পোয়ারো বললেন কণ্ডাক্টর চলে যাবার পর। আসলে আমি বিশ্বাসী নই চিরাচরিত ধারায়-তাই যে কোনো অপরাধের পেছনে আমি খুঁজি মনস্তত্ব। দু-চারটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দরকার মনস্তাত্বিক জটিলতা সমাধানের জন্য। অনেক সূত্র তো সারা কামরায় আছে কোনোগুলি আসল আর কোনোগুলি জাল তা আগে জানা উচিত।
বুঝলাম না ঠিক।
আপনাকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমরা একটা মহিলার রুমাল পেয়েছি। তিনিই কি এই রুমালটা ফেলে গেছেন? নাকি কোনো পুরুষ আমাদের বিভ্রান্ত করবার জন্য একাজ করেছেন তা জানা জরুরী। আবার এও হতে পারে মহিলাটিই অপরাধী তিনি আমাদের বিভ্রান্ত করবার জন্য পাইপ ক্লিনারটা ফেলে গেছেন অর্থাৎ যাতে আমরা ভাবি এ নিশ্চয় কোনো পুরুষের কাজ। আবার এও অবাস্তব নয় যে দুজনেই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তারা একটা করে সূত্র দুজনেই ফেলে রেখে যাবার মতো কি ভুল করতে পারে?
কিন্তু ঐ টুপি রাখার জালের ব্যাপারটা
ওটার কথায় পরে আসছি। রাত একটা বেজে পনেরো মিনিটে ঘড়িটি বন্ধ হয়ে গেছে দেখা যাচ্ছে। সূত্র হিসাবে এই তিনটেই যেমন একদিকে খাঁটিও হতে পারে অথবা জাল হওয়াও অসম্ভব নয়। তবে এর মধ্যে একটা সূত্র অবশ্য সঠিক, কাগজের তৈরি চ্যাপটা দেশলাই কাঠিটা কিন্তু রাশেটের নয়। বোঝাই যাচ্ছে ওটা হত্যাকারীর, এটা আবার বিশ্বাস্য। কারণ ওই টুকরো কাগজটা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল যা ছিল হত্যাকারীর পক্ষে বিপজ্জনক কোনো চিঠি। আমি আসছি দাঁড়ান।
কামরা থেকে পোয়ারো বেরিয়ে গেলেন।
একটা স্পিরিট ল্যাম্প, আর এক জোড়া সরু চিমটে নিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন।
এই বুদ্ধিমান বেলজিয়ান ছোটোখাটো ফিটফাট চেহারার গোয়েন্দাটিকে ডাক্তার অবাক হয়ে দেখছিলেন।
পোয়ারো এক টুকরো জালের উপর আধপোড়া কাগজটিকে বিছিয়ে দিয়ে অন্য জালের টুকরোটা চাপা দিলেন, এরপর সাবধানে পুরো জিনিষটা চিমটে দিয়ে ধরে স্পিরিট ল্যাম্পের শিখায় ধরলেন, তারের জালগুলো লালচে হয়ে উঠল এবং একটু পরেই কয়েকটি অস্ফুট কথা ফুটে উঠল কাগজে।
মনে রেখো ছোট্ট ডেইজি আর্মষ্ট্রংয়ের কথা।
তিনি সমস্ত জিনিষগুলো টেবিলের উপর নামিয়ে রাখার পর তাকে খুব পরিতৃপ্ত দেখাল।
কিছু পেলেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
নিশ্চয়ই।
পোয়ারোর চোখ দুটো উত্তেজনায় চকচক করছিল।
মৃত ব্যক্তির পরিচয় আমি জানি ডাক্তার। সে কেন আমেরিকা থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিল তাও।
মিঃ রাশেটের আসল নাম কি?
কাসেট্টি।
কাসেট্টি? আমেরিকার কোনো ঘটনা কি? দাঁড়ান দাঁড়ান একটু একটু যেন মনে পড়ছে..।
হ্যাঁ।
ডাক্তার দেখছিলেন যে মিঃ রাশেটকে এই প্রথম সে বলে সম্বোধন করলেন পোয়ারো, শুধু তাই নয় আমেরিকা থেকে সে কেন পালাতে বাধ্য হয়েছিল তাও বা কেন বললেন।
মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন কিন্তু পোয়ারো।
ডাক্তার বললেন, আমায় একটা জিনিষ বুঝিয়ে দেন যদি পোয়ারো। হত্যাকারী জানালা দিয়ে না পালিয়ে পালালো তাহলে কোনো পথে? কেননা এই কামরা আর পাশের কামরা তো বন্ধ ছিল। অন্য দিক থেকে আবার করিডোর থেকে যে বেরোবার দরজা সেটাও তো ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।