হেক্টর ম্যাককুইন ভাবলো দু এক মুহূর্ত উত্তর দেবার আগে। তারপর দ্বিধাহীন গলায় বলল, আমি ওঁকে একেবারেই পছন্দ করতাম না।
কেন?
তা ঠিক বলতে পারব না। উনি আমার সঙ্গে মোটামুটি সহৃদয় ব্যবহারই করতেন কিন্তু আমি ওঁকে সত্যি কথা বলতে–ঠিক বিশ্বাস করতে পারতাম না। উনি একজন নৃশংস ভয়ঙ্কর লোক মনে হত। অবশ্য আমার এই ধারণার কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না এটা স্বীকার করতেই হবে।
ধন্যবাদ মিঃ ম্যাককুইন। আর একটা কথা, আপনি শেষ কখন জীবিত অবস্থায় দেখেন মিঃ রাশেটকে।
কাল রাতে। এই ধরুন দশটা হবে। কয়েকটা জরুরী কাগজে সই করতে আমি ওঁর কামরায় গিয়েছিলাম।
কাগজ? কি সংক্রান্ত?
কিছু পুরানো কাঁচের জিনিস পারস্যে উনি কিনেছিলেন। তারই রসিদ, যে জিনিসগুলি আসলে উনি কেনেন, ভুল করে অন্য মাল পাঠানো হয়েছিল তার বদলে। আমরা বেশ খানিকক্ষণ কথা বলি সেই বিষয়ে।
এবং তখনই মিঃ রাশেটকে শেষবারের মতো জীবিত অবস্থায় আপনি দেখেছিলেন?
হ্যাঁ।
শেষ উড়ো চিঠিটা কবে নাগাদ পান মিঃ রাশেট আপনি কি জানেন?
কনস্তান্তিনোপোল আমরা যেদিন ছাড়ি সেইদিন সকালবেলায়।
আর একটা কথা, আপনার মনিব মিঃ রাশেটের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল মিঃ ম্যাককুইন? চোখ দুটো ঝিকিয়ে উঠল ম্যাককুইনের।
চমৎকার স্যার। এককথায় চমৎকার। বিন্দুমাত্র তিক্ততা ছিল না আমাদের সম্পর্কের মধ্যে।
একটু লিখে দিন আপনার নাম আর ঠিকানাটা।
ম্যাককুইন লিখে দিল। হেক্টর উইলার্ড ম্যাককুইন।
ঠিকানা : নিউইয়র্কের এক জায়গা।
মিঃ ম্যাককুইন আজ এই পর্যন্তই।
আপনার সঙ্গে আজ যে সমস্ত কথাবার্তা হল, এই মুহূর্তে দয়া করে প্রকাশ করবেন না বাইরে এমনকি অপনার মনিব যে নিহত হয়েছেন তাও।
ওঁর পরিচারক ম্যান্টার ম্যান তো জানবেই।
এতক্ষণে সে হয়তো জেনেও গেছে। নরম গলায় পোয়ারো বললেন, তাই যদি হয় তবে তাকেও মুখ বন্ধ করে থাকতে দয়া করে অনুরোধ জানাবেন।
কোনো অসুবিধা নেই তাতে। খাঁটি ইংরেজ তত মিশুকে নয় মোটেই কারুর সাতে পাঁচে থাকে না দিব্যি আপন মনে থাকে। তাছাড়া ওর ধারণা আমেরিকানদের সম্পর্কে বেশ নিচুমানের আর অন্য জাতের লোকেদের তো মনিষ্যি বলেই মনে করেন না।
ধন্যবাদ মিঃ ম্যাককুইন।
কি মনে হয় সবই বিশ্বাসযোগ্য, মঁসিয়ে কুক বললেন। ম্যাককুইন বাইরে বেরিয়ে যাওয়া মাত্র।
ও মোটেই পছন্দ করত না মনিবটিকে সেটা স্পষ্টই বলে গেল। রাশেট যে সাহায্য চেয়েছিলেন আমার কাছে তাও ওর কাছে অজানা ছিল অবশ্য অবাক হবার কিছুই নেই এর মধ্যে কারণ রাশেট গোপনীয়তা পছন্দ করতেন।
কিছুটা উৎফুল্ল হলেন মঁসিয়ে কুক।
তাহলে আমরা অন্ততঃ একজনকে সন্দেহের তালিকার বাইরে রাখতে পারি।
আমি কিন্তু সেরকম কিছুই বলিনি।
আমার পেশা সবাইকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সন্দেহ করা।
আমার বিশ্বাস এই ভদ্র সুন্দর সুদর্শন ব্যক্তিটি তার মনিব মিঃ রাশেটকে রাগের মাথায় এলোপাথাড়ি বারো চোদ্দবার ছোরা চালিয়ে নিশ্চয় খুন করেনি।
তা ঠিক। মনে হয় নির্ঘাত পাগল খুনিটা। কোনো মহিলা নয়তো কোনো লাতিন মনোবৃত্তির মানুষ ঘৃণায়, আক্রোশে হয়তো সে স্বাভাবিক মানুষ ছিল না।
.
০৭.
মৃতদেহ
পোয়ারো ডাঃ কনস্টাইনের পিছু পিছু নিহত মিঃ রাশেটের কামরায় এসে প্রবেশ করলেন। একটু আগেই কণ্ডাক্টর দরজা খুলে দিয়েছিল চাবি দিয়ে।
জিনিসপত্র কি খুব বেশি নাড়াচাড়া করা হয়েছে এ কামরার, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন।
না। সাবধানেই মৃতদেহ যথাসম্ভব পরীক্ষা করেছি।
কিছুই ছোঁয়া হয়নি।
পোয়ারো চারধারে চোখ বুলিয়ে নিলেন।
অসম্ভব ঠান্ডা কামরার ভেতরটা, হু হু করে হাওয়া ঢুকছে শার্সির ফাঁক দিয়ে। ডাক্তার হেসে বললেন, জানালাটা বন্ধ করিনি আমি ইচ্ছে করেই যেমন ছিল তেমনই আছে।
জানালাটা পরীক্ষা করলেন পোয়ারো।
জানালাটা বিভ্রান্ত করবার জন্যেই খোলা রয়েছে। কেউ বাইরেও বেরোয়নি এই পথে। যদি হত্যাকারী পালাতেও কিন্তু তুষার ঝড়ই সে আশায় বাধ সেধেছে।
জানালার ধারে পোয়ারো কিছুটা সাদা রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে দিলেন।
না। কোনো কিছুই পাওয়া গেল না, আঙুলের ছাপটাও নেই। অবশ্য আঙুলের ছাপ কারই বা পাওয়া যেতো।
আজকাল খুনীরা এই সব কাঁচা কাজ করেই না। জানালাটা বন্ধই করাই ভালো।
পোয়ারো জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে রাশেটের মৃতদেহের দিকে ঘুরে তাকালেন।
রাশেটের পরনে পায়জামা আর কুর্তা। জামার বোতামগুলো খোলা আর জায়গায় জায়গায় রক্তের কালচে ছোপ। আমি বোতামগুলো খুলেছিলাম মৃতদেহ পরীক্ষা করবার সময়, ব্যাখ্যা করলেন ডাক্তার।
সামনের দিকে ঝুঁকে পোয়ারো নীরস গলায় বললেন, ওঁকে কেউ এখানে দাঁড়িয়ে বারম্বার আঘাত করেছে, গুণে দেখেছেন কি ক্ষতস্থানের সংখ্যা কটা?
গোটা বার তো হবেই–কয়েকটা সামান্য আঁচড়ের মতো তার মধ্যে তিনটে ক্ষত সাংঘাতিক, এগুলোর মধ্যে যে কোনো একটাই মৃত্যু ঘটাবার পক্ষে যথেষ্ট। পোয়ারো ফিরে তাকালেন কারণ তার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল।
মৃতদেহের দিকে স্থির দৃষ্টিতে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছেন ডাক্তার।
নতুনত্ব কিছু চোখে পড়ছে ডাক্তার?
ঠিকই ধরেছেন।
ব্যাপারটা কি?
এই যে এখানে লক্ষ্য করুন ক্ষতস্থানগুলো যতটা গভীর রক্তপাত কিন্তু হয়নি ঠিক এই দুটি ক্ষতস্থানে।