এই তো আপনি এসে গেছেন, চেঁচিয়ে উঠলেন মঁসিয়ে কুক। আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার আপনাকেই।
পোয়ারো বন্ধুর মুখোমুখি বসলেন। একটু সরে গিয়ে জানলার ধারে মানুষটি পোয়ারোকে বসবার জায়গা করে দিলেন। বেশ গুরুতর কোনো কিছু ঘটেছে তা কুকের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ব্যাপার কি বলুন তো?
আর বলবেন না এই বরফের ঝড়ে ট্রেনআর চলছে না তার উপর…।
একটু থামলেন মঁসিয়ে কুক, একটা অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে এল কন্ডাক্টরের গলা থেকে।
আবার কি হল?
একজন যাত্রীকে খুন করা হয়েছে ছোরা দিয়ে। তাকে তার কামরায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।
কাকে?
দাঁড়ান নামটা হল গিয়ে। হ্যাঁ, রাশেট-এই যে কাগজে লেখা আছে উনি একজন আমেরিকান।
মাথা নেড়ে যায় দিল কন্ডাক্টর।
ইস, চোখ মুখ সাদা হয়ে গেছে ভয়ে বেচারীর। পোয়ারো মুখের দিকে তাকালেন কন্ডাক্টর।
এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে বেচারীর যা অবস্থা দেখছি, ওঁকে একটু বসতে বলুন মঁসিয়ে
কন্ডাক্টর গার্ড সসঙ্কোচে একটা কোণে বসল নীল ইউনিফর্ম পরা লোকটি সরে দাঁড়াতেই। তার মুখ দু হাত দিয়ে ঢাকা।
তাহলে তো সাংঘাতিক কাণ্ড মশাই। গম্ভীর গলায় পোয়ারো বললেন।
তাছাড়া আবার কি! খুন যেভাবে হল, ঝামেলা প্রচণ্ড বেড়ে গেল তার উপর আবার ট্রেন যেভাবে আটকে আছে। কতক্ষণ যে এই দুর্দশা চলবে কে জানে?
এখন যে আমরা যুগোশ্লাভিয়ায় আটকে পড়লাম। ট্রেনে এই মুহূর্তে এখানকার কোনো পুলিশও নেই যে তার সাহায্য আমরা নিতে পারি।
এতো ভীষণ মুশকিল হল।
ওঃ হো। ইনিই ডাক্তার কনস্টানটাইন, আর ডাক্তার ইনি মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো। আপনার সঙ্গে কথায় কথায় আলাপ করিয়ে দিতে একেবারে ভুলেই গেছি।
ডাক্তার ঈষৎ ঝুঁকে অভিবাদন জানালেন। ওঁর চেহারাটি খুবই ছোটোখাটো।
ডাক্তার বললেন, আমি কিন্তু মোটামুটি নিঃসন্দেহ যে খুনটা রাত বারোটা থেকে দু-টোর মধ্যে হয়েছে। এই রকম পরিস্থিতিতে কিছুই বলা যায় না অত হিসেব করে।
মিঃ রাশেটকে জীবিত অবস্থায় সবার শেষে কে দেখেছে? পোয়ারো জানতে চাইলেন।
উনি জীবিত ছিলেন খবর যা আছে আমাদের কাছে তাতে মনে হয় রাত একটা বাজতে কুড়ি মিনিট উনি কন্ডাক্টর গার্ডের সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
এ কথা পোয়ারো সমর্থন করলেন।
আমার ঠিক পাশের কামরাতেই তো। হ্যাঁ আমি নিজের কানে তা শুনেছি। আমিও জানি কোনও খবর আর মেলেনি তারপর।
ডাক্তার বললেন, জানালাটা হাট করে খোলা ছিল রাশেটের। ঐ পথেই মনে হয় আততায়ী পালিয়েছে। কিন্তু বরফের উপর তো ছাপ থাকত তাহলে। আমাদের সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত করবার জন্যই জানালাটা খোলা ছিল আমার মনে হয়।
আর কখন এই হত্যাকাণ্ডের খবরটা জানতে পারা গেল? গম্ভীর গলায় কুক বললেন, মিশেল, যা যা জানতে চান মঁসিয়ে পোয়ারো তার উত্তর দাও।
পূর্ব পরিচিত মিশেল নামের কন্ডাক্টর গার্ডটি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো।
স্যার আজ সকালে মিঃ রাশেটের পরিচারকটি মনিবের কামরার দরজায় ধাক্কা দেয়। কোনো সাড়া শব্দ ভেতরে থেকে পাওয়া যায়নি। মিঃ রাশেট প্রাতঃরাশ করবেন কি না তা জানতে খানাকামরার লোক আসে আধঘন্টা আগে তাও প্রায় ধরুন বেলা এগারোটা নাগাদ। বাধ্য হয়ে ওঁর কামরার দরজা আমি আমার চাবি দিয়ে খুলি, ভিতরে কিন্তু শেকল দেওয়া ছিল। হু হু করে বরফ কুচি ভেতরে ঢুকছে জানালাটা খোলা থাকার জন্যে সঙ্গে একরাশ ঠান্ডা হাওয়া। ভদ্রলোক বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেছেন ভাবলাম। আমি তাড়াতাড়ি এই ট্রেনেরই একজন কর্মচারীকে ডেকে দরজার শেকল ভেঙ্গে দুজনে ভেতরে ঢুকে দেখি উনি মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন।
ওঃ সে কি ভয়ানক দৃশ্য।
শিউরে উঠে মিশেল আবার দু হাতে মুখ ঢাকলো।
আচ্ছা আত্মহত্যা নয় তো? চিন্তিত গলায় পোয়ারো বললেন, শেকল তুলে কুলুপ দেওয়া ছিল ভেতর থেকে, গ্রীক ডাক্তার মৃদু হাসলেন।
না মশাই। একটা সুস্থ বুদ্ধির লোক নিজের দেহে বারো চোদ্দবার ছোরার আঘাত করবে আত্মহত্যা করতে চাইলে?
পোয়ারোর চোখ কপালে উঠল।
সেকি! এ তো নৃশংস-কাণ্ড।
এই প্রথম মুখ খুলল নীল ইউনিফর্ম পরা লোকটি। নির্ঘাত কোনো মেয়ের কাণ্ড। এরকম ওরাই করতে পারে।
তাহলে তো বলতে হবে শরীরে যথেষ্ট শক্তি রাখেন সেই মহিলাটি। ডাক্তার বললেন, ডাক্তারী শাস্ত্রমতে যথেষ্ট গায়ের জোর দরকার ওইরকমভাবে ছোরা চালাতে গেলে। দু-তিনটি কোপ তো মাংস ভেদ করে হাড়ে গিয়ে ঠেকেছে মশাই।
কি বলেন? পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত বা কেতাদুরস্ত নয় পোয়ারো বললেন।
যা বলেছেন। দেখলে মনে হবে নির্ঘাত কোনো পাগলের কাণ্ড, যেমন তেমন ভাবে যত্রতত্র আঘাত করা হয়েছে আবার মৃদু আঁচড়ের মতো আঘাতও আছে কোনো কোনো জায়গায়। যেমন হয় কেউ এলোমেলো ভাবে ছোরা চালায় চোখ বন্ধ করে। রাগলে তো মেয়েদের আর জ্ঞান থাকে না। দেখবেন এ কোনো মেয়ের কাণ্ড না হয়েই যায় না নীল ইউনিফর্ম পরা লোকটি বলল।
আমার একটা কথা বলবার ছিল। বললেন পোয়ারো, মিঃ রাশেটের মৃত্যুভয় ও জীবনহানির আশঙ্কা ছিল সে কথাই মিঃ রাশেট আমাকে বলেছিলেন গতকাল। একটু রসিকতা করলেন এতক্ষণ পর মঁসিয়ে কুক। কোনো মহিলা নিশ্চয়ই নয়। এই ট্রেনেই একজন জাঁদরেল চেহারার আমেরিকান আছে চকচকে জামাকাপড় পরে আর চুইংগাম খায়। আমি যার কথা বলছি বুঝতে পারছেন তো, বেশ সন্দেহজনক লোকটার হাবভাব।