পেছন থেকে তাকে ডেকে উঠলেন ক্রোড়পতি কার্লে, দাঁড়ান একটু, সেই চিঠিটা আমি ফেরৎ পেতে চাই। আপনার সেক্রেটারীর লেখা সেই চিঠিটাতো! হ্যাঁ, সেটাই আমি ফেরৎ চাই।
পোয়ারো বিস্মিত হলেন। আর বাক্যব্যয় না করে পকেট থেকে ভাঁজ করা চিঠিটা বার করে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের হাতে তুলে দিলেন।
চিঠিটা হাতে নিয়ে কার্লে উল্টে পাল্টে দেখলেন সেটা, তারপর বেশ যত্ন সহকারে রেখে দিলেন টেবিলের উপর।
পোয়ারো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, ধীর, মন্থর গতিতে। সত্যিই তিনি বেশ বিভ্রান্ত হয়েছেন। এখন তার সমগ্র চিন্তা জুড়ে রয়েছে, যে কাহিনিটা তিনি কিছুক্ষণ পূর্বে শুনলেন। চোখ বুজে তিনি যেন এখন সমস্ত দৃশ্যপট কল্পনা করে নিতে পারছেন। কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছেন তিনি এসব কিছুকে সরিয়ে রাখলেও। অবশ্য তিনি নিজেই এই অস্বস্তির কারণ, বেনেডিক্ট কার্লে নন। এরকুল পোয়ারোর মনে হল কোথাও যেন একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে যাচ্ছে, এর মধ্যেই প্রোথিত আছে ভুলটা এরকম মনে হল তার। দরজার হাতলে, হাত দেবার পরেও আবার দ্বিতীয়বার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। এবার তার সবকিছু স্পষ্ট মনে পড়েছে। একটা সাংঘাতিক ভুলের জন্য দায়ী সে, এরকুল পোয়ারো। আবার সে ফিরে গেল ঘরের দিকে। বিনীতভাবে বলল পোয়ারো। একটা মারাত্মক ভুলের জন্য আমি আপনার কাছে সহস্রবার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি মিঃ কার্লে। আমি একটা বাজে কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছি আপনার সমস্যার কথা ভাবতে গিয়ে। যখন আপনি চিঠিটা ফেরৎ চাইলেন। অন্যমনস্কভাবে আমি ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছিলাম। বাঁ পকেটে ছিল আপনার চিঠিটা।
কি এসব বলছেন, মানেটা কি?
আপনার হাতে আমি অন্য একটা চিঠি তুলে দিয়েছি। লন্ড্রী কর্তৃপক্ষ আমার টাই-এর রঙটা জ্বলিয়ে দেবার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে একটা চিঠি দিয়েছিল, সেটাই আপনাকে দিয়েছি। পোয়ারো বিব্রত ভাবে ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে আসল চিঠিটা বার করল। প্রায় ছোঁ মেরে তুলে নিলেন চিঠিটা, বৃদ্ধ কার্লে।
মুখে বিশেষ বিরক্তি ফুটে উঠতে দেখা গেল। তার চোখে : কি যে আপনারা করেন ভেবে পাই না। সব অপদার্থের দল। আর একবার মার্জনা চেয়ে নিল পোয়ারো লন্ড্রীর মালিকের চিঠিটা পকেটস্থ করার সময়। এক মুহূর্ত থেমে দাঁড়াল সে সিঁড়ির মুখে এসে। নীচের হলঘরের দিকে সরাসরি নেমে গেছে মার্বেল পাথরের সিঁড়িটা। ওর কাঠের ভারী টেবিল হলঘরের মাঝখানে। একরাশ মাসিক পত্র-পত্রিকা টেবিলের ওপর পড়েছিল। কুশান আঁটা দুটি শৌখীন চেয়ার ছিল টেবিলের পাশেই। আর একটা অপেক্ষাকৃত ছোট টেবিল ছিল পাশেই। গোটাকয়েক ফুলদানী সাজানো রয়েছে তার ওপর। মনে হচ্ছে এটা কোনো বিলাস বাহুল ডেন্টিস্টের চেম্বার, ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে। সেই খানসামাটিকে অপেক্ষা করে থাকতে দেখলো হলঘরে নেমে এসে। মনে হয় তাকে বিদায় দেবার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল সে। স্যার আপনার জন্যে কি ট্যাক্সি ডেকে দেবো? বলল লোকটি। লাগবে না ধন্যবাদ এমন সুন্দর মনোরম রাতে হেঁটে যেতেই ভালো লাগবে। রাস্তায় পা দিয়ে, গেট পেরিয়ে আসার পর বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হল পোয়ারোকে। গাড়ির ভিড় রাস্তায়, এধার ওধার ছোটাছুটি করছে গাড়িগুলো। তার চিরদিনের অভ্যাস, ধীরে সুস্থে রাস্তা পার হওয়াটা। পথ চলতে লাগলো পোয়ারো ধীরে পদব্রজে। কপালে তার চিন্তার ভাঁজ। স্বগতোক্তি করল সে না! আদৌ আমি এর এক বর্ণও বুঝতে পারলাম না। সবকিছুই যেন অবাস্তব স্বার্থহীন আমার কাছে মনে হয়। খুবই অনুশোচনার ব্যাপার, তবুও আমি এরকুল পোয়ারো স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে–আমি কেমন যেন অসহায় হয়ে পড়েছি।
এই নাটকের প্রথম অঙ্কের এখানেই যবনিকাপাত। সপ্তাহ খানেক পরে শুরু হবে দ্বিতীয় অঙ্ক। ফোনটা বেজে উঠল ঠিক সেই সময় যখন পোয়ারো তার সুসজ্জিত ড্রয়িং রুমে বসেছিল। সরকারী ডাক্তার স্টীলিং ক্লীট ফোন করেছিল। আমি ডাক্তার স্টীলিং ক্লীট কথা বলছি, কি হে, পোয়ারো নাকি, সেই পুরানো ঘোড়া! ঠিক তাই বন্ধু! এবার বলুন তো কি ব্যাপার। শুনুন, আমি কথা বলছি, নর্থ ওয়ে হাউস এ বেনেডিক্ট কালের বাড়ির থেকে বললেন ডাক্তার।
খুব সচেতন কণ্ঠে পোয়ারো বলল, তাই নাকি? ব্যাপার কি মিঃ কার্লের?
মারা গেছেন কার্লে, আজ বিকালে তিনি নিজেকে গুলিবিদ্ধ করেছেন। খানিক নীরবতার পর আবার কথা বললো পোয়ারো।
হু, অর্থাৎ বুঝতে পারলাম।
খুব একটা সবাক হননি আপনি আপনার ছোট্ট উত্তর শুনে মনে হচ্ছে, কিছু জানেন নাকি আপনি এ ব্যাপারে?
পোয়ারো জানতে চাইলেন, কেন আপনার একথা মনে হল বলুন তো?
আমি কোনো সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ, অথবা টেলিপ্যাথি বা অন্য কিছুর সাহায্যে এই সিদ্ধান্তে আসিনি মিঃ পোয়ারো। সপ্তাহখানেক আগের একটা চিঠি এখানে পাওয়া গেছে এটাই হল আসল খবর। মিঃ কার্লে আপনাকে তার সঙ্গে দেখা করবার জন্য সেই চিঠিতে অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন।
আচ্ছা তাই নাকি পোয়ারো বললেন। একজন শান্ত ভদ্র পুলিশ অফিসার এখানে উপস্থিত রয়েছেন। সুতরাং ক্রোড়পতি মারা গেলে আমাদের কি রকম সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় সেটা বুঝতেই পারছেন। সেজন্য ভাবলাম, আপনার দ্বারা যদি সম্ভব হয় নতুন কোনোভাবে আলোকপাত করতে। আসুন না এখানে একবার যদি সম্ভব হয়, ডঃ বললেন।