- বইয়ের নামঃ পেরিল অ্যাট এন্ড হাউস
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ সমতট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
পেরিল অ্যাট এন্ড হাউস
০১. ম্যাজিস্টিক হোটেল
০১. ম্যাজিস্টিক হোটেল
আমার মনে হয়, ইংল্যান্ডের কোন সমুদ্রতীরবর্তী শহরই অন্তত দক্ষিণে সেন্ট লু-র মত আকর্ষণীয়ভাবে সুন্দর নয়। জলজ সম্রাজ্ঞী। একেবারে ঠিক নামেই ডাকা হয় অঞ্চলটাকে। আর সেন্ট লু আপনাকে অনিবার্যভাবেই মনে করাবে ফরাসি রিভিয়েরার কথা। দুধসাদা বালির চকচকে ভাব আপনাকে মুগ্ধ করবেই। আমার প্রিয় বন্ধু এরকুল পোয়ারো-র কাছে আমি এতটাই উচ্ছ্বসিত জায়গাটাকে যে ও সাহাস্যে বলে বলে–ডঃ প্রাণবন্ত বর্ণনা। পর্যটকের আকর্ষণ বাড়াবে তোমার বর্ণনা মনে হয় না। ঠাট্টাকে গায়ে না মেখে আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে সহমত নও কি? বন্ধুবর কোন উত্তর দেয় না, তবে ওর ঠোঁটের কোণায় ঝুলতে থাকে একচিলতে মুচকি হাসি। আমি আবার প্রশ্নটা করি। মাপ কোরো হেস্টিংস, আসলে আমার মনটা এখন রয়েছে তোমার তুলনা করা অঞ্চলটাতেই। সর্বত্রগামী মানবমন সেখানেই বিরাজমান এখন।আমি সামান্য চমকিত হই দক্ষিণ ফ্রান্সে?মুচকি হেসে প্রিয়বন্ধু জানায়–হ্যাঁ, গত শীতে আমি সেখানেই ছিলাম। আর কি কাণ্ডটাই যে ঘটেছিল, সেটা ভাবছিলাম।
আমার মনে পড়ল দা ব্লু ট্রেন মার্ডার। অত্যন্ত জটিল মামলা। পোয়ারো যা তার অতুলনীয় প্রতিভা আর অসাধারণ বুদ্ধি দিয়ে কিস্তিমাত করেছিল। আহ ওই মামলাটায় তোমার সঙ্গী হতে না পারার আক্ষেপ আমার আজও যায়নি। সখেতে বলি–আমারও এইরকম একটা রোমাঞ্চকর কেসে তোমার অভিজ্ঞতার সাহায্য পাওয়াটা আমার পক্ষে মহামূল্যবান হত। আমি চোখের কোণা দিয়ে তাকালাম। পুরানো অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সবসময় বন্ধুবরের প্রশংসা সিরিয়াসলি নেওয়াটা বোকামোর কাজ হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে পোয়ারো অবশ্য যথেষ্ট সিরিয়াস মনে হচ্ছে মন্তব্যটার ব্যাপারে। অবশ্য কেনই বা নয়? সত্যিই তো আমার দীর্ঘতর অভিজ্ঞতা রয়েছে, সত্যিই যা মহামূল্যবান যে কারও পক্ষে। তাছাড়া আমার কাজের একটা বিশেষতর মেথড আছে যা প্রায়শই কাজ হয়ে ওঠে দুর্দান্তভাবে।
আসলে আমি সেটা ওইসময় দারুণভাবে মিস করেছিলাম প্রিয়তম বন্ধু হেস্টিংস, তোমার প্রবল ইমাজিনেশান সে স্বপ্নাতুর গলায় বলে চলে। আসলে, সত্যি ওরকম পরিস্থিতিগুলোয় কিছু হালকা মুহূর্তের প্রয়োজন হয় বৈকি। তোমার মত এক বন্ধু, যার কল্পনাশক্তি অতীব প্রখর, তার অভাব স্বাভাবিকভাবেই বোধ করেছি। তোমার পরিবর্তন হিসাবে আমার পাঁচক যে ছিল, তার সঙ্গে কোন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম বটে।কিন্তু দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে! জার্জের কল্পনাশক্তি মোটেও তোমার মত প্রখরতর হতে পারে না, ছিলও না। পোয়ারোর মন্তব্যে আমি বেশ ধন্দে পড়ে গেলাম। ব্যাপারটা প্রশংসা? নাকি চিরাচরিত পোয়ারো মার্কা এক অনাবিল ঠাট্টা।
আমরা বসেছিলাম সেন্ট লু-র অন্যতম সেরা ম্যাজিস্টিক হোটেলের একটা বারমুখী বারান্দায়। সমুদ্রের মুখোমুখি। পোয়ারো আরাম কেদারায় এলিয়ে বসে নির্বিকারভাবে গোঁফ মুচড়ে চলেছে। মাসটা আগস্ট। রোদ ঝকঝকে এক সকাল। গতকাল রাতেই আমরা এই শহরে এসে পৌঁছেছি। নেহাতই এক সপ্তাহের ছুটি উপভোগ করতেই আসা। মনে তো হচ্ছে যা পরিবেশ, আবহাওয়া, একটা দুর্দান্ত আদর্শ ছুটি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
আমি আবার খবরের কাগজে মন দেবার চেষ্টা করলাম। যদিও সেখানে রোমাঞ্চকর বা উৎসাহ জানানোর মত কোনও খবরই পাচ্ছিলাম না, ছিলও না কিছু।
অলস হাতে পাতা ওলটাতে ওলটাতে আমি বললাম-এক আশ্চর্য অসুখ দেখছি এই টিয়াসড়ক সত্যিই, আশ্চর্যজনক–সিভম-য়ে আরও দুজন মারা গেছে। আমি পরের পাতায় যেতে যেতে বলি–নাহ, সেটনের এখনও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ব্যাপারটা সত্যি রহস্যময়। দুঃখজনক। নিজের আবিষ্কার করা, তৈরি করা উড়ানান। অ্যালবাট্রস নিয়ে তিনি পৃথিবী পরিভ্রমণে বেরিয়েছিলেন।
পশ্চিমের দিকে যাবার কথা শেষ জানতে পারা গিয়েছিল। তারপর থেকেই আর কোনও খোঁজ নেই সেটনের। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
সত্যি! ব্যাপারটা খুব রহস্যজনক। একটু থেমে আমি আবার সহানুভূতির গলায় বলি, ব্যাপারটা নিশ্চয়ই হোম সেক্রেটারিকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ফেলেছে?
সে তো নিশ্চয়ই। যে কারণে তাকে এক অযোগ্য ব্যক্তির কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠাতেই হয়।
কথাটা শুনে প্রখর চোখে তাকালাম পোয়ারোর দিকে। একটা মুচকি হাসি ঝুলছে এখন ওর বুদ্ধিদীপ্ত ঠোঁটের কোণায়।
পকেট থেকে একটা একটা চিঠি বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-কাল আমরা এসে পৌঁছানোর আগেই এটা চলে এসেছিল।
আমি চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে পড়লাম, দারুণ ব্যাপার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের চিঠি : তোমার ক্ষমতা, দক্ষতার ওপর প্রচণ্ড ভরসা আছে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ব্যক্তিগতভাবে তোমার সাহায্য প্রার্থনা করেছেন এই মামলায়।
পোয়ারো সমর্থনসূচক হেসে বলল-তাহলে ছুটির এখানেই বারোটা বাজল।
আমি হতাশ গলায় বলি–না, না, তার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু হোম সেক্রেটারি চিঠিতে লিখেছেন বিষয়টা খুব জরুরি।
হ্যাঁ, তিনি হয়তো ঠিক, আবার হতে পারেন ভুলও। এই রাজনীতিকরা খুব সহজে তাড়াতাড়ি নিজের চোখে দেখা…. প্যারিস, চেম্বার দ্যা ডিপোটিজ…..
পোয়ারো আবার গল্প ফেঁদে বসবার আগেই আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিই, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে। পোয়ারো আমাদের কিন্তু তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। লন্ডনের এক্সপ্রেসটা ঠিক বারোটায় ছাড়ে। পরের….
শান্ত, শান্ত হও হেস্টিংস। সেই একই রোগ।অল্পে উত্তেজিত হয়ে পড়া। আমরা আজ লন্ডনে যাচ্ছি না। এমনকি আগামিকালও নয়।
কিন্তু এই জরুরী তলব?
তাতে আমার কিছু এসে যায় না। আমি তো পুলিস বাহিনীর গোয়েন্দা নই। আমাকে গোপনে তদন্ত করতে বলা হয়েছিল। আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। নিশ্চিতভাবে। অত্যন্ত সবিনয়, যথোচিত সৌজন্যের সঙ্গে আমি ওনাকে আমার অপরাগত জানিয়ে দিয়েছি। ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি।
কিন্তু কেন? আমি অবাক গলায় প্রশ্ন করি।
হোম সেক্রেটারির অনুরোধ রাখা সম্ভব নয়, কারণ আমি মনে করি আমি শেষ হয়ে যেতে বসেছি। এরকুল পোয়ারোর সুবিখ্যাত গ্রে সেল-এর কর্মক্ষমতা ম্লান হয়ে আসছে। তাই আমি ঠিক করেছি অবসর নেব। এরকুল পোয়ারো তার শেষ মামলার সমাধান করে দিয়েছে। একটানা কথা বলে বন্ধুবর থামল।
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। যা শুনলাম সেটাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, বা হয়তো বিশ্বাস করতেই পারিছ না যা শুনলাম। তবু ওর সিদ্ধান্তকে কখনও অসম্মান করিনি, আজও করতে পারলাম না। অথচ তখনি বিদ্যুৎ ঝলকের মত প্রশ্নটা আমার মাথায় এল।
পোয়ারো, পরে তোমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে না তো? সেক্ষেত্রে এরকম একটা মামলার কাজ হাতে না নেওয়া, যা অত্যন্ত সম্মানজনক-রহস্যটা সমাধান করতে পারলে সারা পৃথিবী জুড়ে সুখ্যাতি আরও ছড়িয়ে পড়ত। খুব বড়সড় ভুল হবে।
না, না। পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা এরকুল পোয়ারোর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করাতে পারে। অসম্ভব, অসম্ভব।
পোয়ারো? সত্যি সত্যি এবার বন্ধুবর আমার মুখের দিকে তাকায়। কি যেন ভাবে, কি যেন বোঝবার চেষ্টা করে। সামান্য বিচলিতও দেখায় তাকে। তারপর সে বলে, তুমি ঠিকই বলেছ, কারও এরকম ভাবে কথা বলা উচিত নয়। কাল যদি আমার দিকে একটা গুলি ছুটে আসে, যদি তাতে আমি মারা না যাই, আমি তাহলে খোঁজ বা তদন্ত করে দেখব, কে আমাকে গুলিটা ছুঁড়েছে? আলবাত করব। সে মাথা নাড়ে। কিন্তু ওকে কিছুটা অন্যমনস্ক দেখায়।
বন্ধুবর এরপর চেয়ারে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। অর্থাৎ, ও গভীর কোনও চিন্তায় আচ্ছন্ন। তারপরই, আচমকা সে উঠে দাঁড়াল। এবং হঠাৎ দরজাটা খুলে অন্য মনস্কের মত ঘরের বাইরে পা রাখে। পোয়ারো দরজাটা টেনে খোলা মাত্র আমি দেখেছিলাম এক যুবতী–প্রথম দর্শনেই বেশ নজর কেড়ে নেবার মত সুন্দরী, দ্রুত পায়ে তরতর করে হেঁটে এদিকেই আসছে।
পোয়ারো ধড়াম করে আছড়ে পড়ল। আমি দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি এবং আমি ধরাধরি করে বন্ধুকে তুললাম। বলাবাহুল্য, আমার নজর ছিল বন্ধুর দিকে, মনোযোগও। তারই মধ্যে আমার চোখে ধরা পড়ে একগুচ্ছ কালো চুল, দিঘল গভীর নীল চোখ আর ছিপছিপে তন্বী আদল।
উফ, ধন্যবাদ মাদাম জোয়েল।
আ-উচ, আমার পা….. আমি সত্যি সত্যি হাজারবার ক্ষমা চাইছি।
ধরাধরি করে আমি ও যুবতীটি পোয়ারোকে আবার বাইরের বারান্দায় চেয়ারে এনে বসালাম। আমি একজন ডাক্তার ডেকে আনার প্রস্তাব দিলাম।
বন্ধুবর দৃঢ়ভাবে আপত্তি জানাল, না, না, হেস্টিংস, সামান্য একটু গোড়ালিটা…….. কয়েকমিনিট বিশ্রাম নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখে নিও।
একটু থেমে বন্ধু এবার যুবতীর দিকে তাকায়, ওহ, দেখেছেন? আমি একেবারে ভুলে গেছি। মাদাম জোয়েল, বসুন, আমার বিনীত অনুরোধ।
মেয়েটি একটা চেয়ারে বসে। হয়তো চোটটা সামান্য, তবু আমার মনে হয় একবার পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত ডাক্তারকে দিয়ে। সাবধানের মার নেই।
আমার মনে হয় না তার কোন প্রয়োজন আছে। আপনার সান্নিধ্যে যন্ত্রণা অনেক কমে গেছে। বন্ধুবরের কথায় যুবতী হেসে ওঠে বাচ্চা মেয়ের মত।
বাহ, তাহলে তো চমৎকার।
তাহলে একপাত্র পান করলে কেমন হয়? আমার তো মনে হয় এটা একেবারে যথার্থ উপযুক্ত সময়।
পোয়ানোর প্রস্তাবে যুবতী সামান্য ইতস্তত করার পর বলে, বেশ।
মার্টিনি?
হ্যাঁ, ড্রাই মার্টিনি।
আমি উঠে যাই, পানীয়ের অর্ডার দিয়ে ফিরে এসে দেখতে পাই যুবতীর সঙ্গে পোয়ারো গভীর-অন্তরঙ্গ আলোচনায় মগ্ন।
ভাবতে পারো হেস্টিংস, ওই যে কোণের দিকে অসাধারণ সুন্দর বাড়িটা নিয়ে আমরা এতক্ষণ আলোচনা করছিলাম, সেটার বাসিন্দা এই ইনি!
পোয়ারোর এসব ভনিতার সঙ্গে আমি বিলক্ষণ পরিচিত। তাই অবাক হবার ভান করি।
সত্যি? কি আশ্চর্য যোগাযোগ। অথচ পোয়ারো হঠাৎ এই আনকোরা যুবতীটিকে নিয়ে কেন পড়ল কিছুই মাথায় ঢুকছিল না আমার।
আশ্চর্য, বাড়িটিকে দেখলে মনে হয় যেন আলাদাভাবে এখানে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্য সব কিছুর চেয়ে যেন আলাদা ওটি।
এটাকে বলা হয় এন্ড হাউস। বাড়িটাকে আমিও খুব ভালবাসি, তবে ওটা খুবই পুরানো হয়ে পড়েছে। ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে।
পোয়ারো উচ্ছ্বাসের গলায় বলে, তার অর্থ আপনি একটা প্রাচীন পরিবারের সদস্য?
মেয়েটি কেমন যেন নিস্পৃহ গলায় বলে।
সেরকমভাবে বলার মত কিছু নয়। তবে আমাদের বার্কলি পরিবারের গ্রাম তিনশো বছরের পুরানো! আমার ভাই চারবছর আগে মারা গেছে, সে অর্থে বলতে গেলে আমিই এই পরিবারের শেষতম সদস্য।
ওহ, খুবই দুঃখের ঘটনা। ওই বাড়িতে আপনি একাই থাকেন মাদাম জোয়েল?
বেশির ভাগ সময়ই আমি বাইরে থাকি। তবে যখন এখানে এসে বাস করি, পরিবারের নানান আত্মীয়-স্বজন আসেন–আমার সঙ্গে থাকেন, যাতায়াত করেন।
পোয়ারো শব্দ করে হেসে ওঠে, আর আমি নিজের কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম অন্ধকার, পুরানো ওই রহস্যময়, ভুতুড়ে বাড়িতে আপনি একা থাকেন আর আপনাকে তাড়া করে বেড়ায় এক বহু পুরানো পারিবারিক অভিশাপ।
যুবতীটি যেন চমকে ওঠে, কি আশ্চর্য, আমাকে বলতেই হবে আপনার মধ্যে অনুমান করার, ছবির মত ভেবে নেবার অসাধারণ এক ক্ষমতা রয়েছে।
না, ওটা ভুতুড়ে বাড়ি নয়। আর তা যদি হয়ও, তারা খুবই উপকারী ভূত। আমি অন্তত তিনবার আশ্চর্যজনকভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছি।
পোয়ারো আচমকা উঠে দাঁড়ায়, মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছেন? হুম, বেশ উত্তেজক কাহিনী বলে মনে হচ্ছে।
না, না, সেরকম চমকপ্রদ কোনও ব্যাপার নয়। নিছক দুর্ঘটনা বলেই আমার বিশ্বাস।
ইতিমধ্যে আমাদের জন্য পানীয় এসে পৌঁছাল। আমরা যে যার গ্লাস তুলে নিলাম।
এই হোটেলের ককটেল সত্যি উপাদেয়। পোয়ারো গ্লাসে একটা চুমুক দেয়, সে কথা মেনে নিতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমরা আবার নানা প্রসঙ্গে কথা বলতে থাকি ককটেল চুমুকসহ।
আমরা যে বাইরের ঝুল বারান্দায় বসেছিলাম তার ঠিক নিচেই গাঢ় সবুজ ঘাসের রাস্তাটা ক্রমশ ঢাল হয়ে নেমে গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। আর এই মুহূর্তে সেই ঢাল বেয়ে উঠে আসছে একজন পুরুষ। লাল মুখ, একজন টিপিক্যাল নাবিকের চেহারা।
ওহ্ কোথায় যে গেল মেয়েটা। তার তীক্ষ্ণ গলা শোনা গেল, ভেসে এল সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে। …
নিক, নিক। আবার তার গলা ভেসে এল।
মিস বার্কলি উঠে দাঁড়ালেন, এই যে জর্জ, আমি এখানে।
আহ, তুমি ওখানে কি করছ মেয়ে?
ফ্রেডি পানীয়ের জন্য ক্ষেপে উঠেছে একেবারে চলে এস, চলে এস। তাড়াতাড়ি।
নিচের থেকে পোয়ারোর দিকে সন্দিহান চোখে তাকাল জর্জ।
স্বাভাবিক! নিকের অন্যসব বন্ধুদের তুলনায় পোয়ারো নিঃসন্দেহে চেহারা, গরিত্রে একেবারে ভিন্নতর। ..
যুবতীটি ততক্ষণে আলাপ করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলে–ইনি হলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর কমান্ডার শ্যালিঙ্গার।
আমি থতমত হয়ে পোয়ারোর মুখের দিকে তাকাই। কিন্তু সে নির্বিকার মুখে মাথা ঝাঁকিয়ে জর্জকে অভিবাদন জানায়।
মেয়েটি এবার বন্ধুর পরিচয়ের জন্যে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
পোয়ারোর সঙ্গে পরিচয় দেবার কোন আগ্রহ বা উৎসাহ দেখা যায় না!
বাধ্য হয়ে নিক বলে–আজ তাহলে চলি। ককটেলের জন্য ধন্যবাদ। আশাকরি আপনার পা খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে। ধীর পায়ে সে চলে যায় একসময় শ্যালিঙ্গার আরমিকের চেহারা দুরে সরে যেতে যেতে মিলিয়ে যায়।
সুতরাং, এই তাহলে মাদাম জোয়েলের সঙ্গে এন্ড হাউসের বসূবাসকারী বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের একজন। চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে কিড়বিড় করে পোয়ারো।
তোমার কি মনে হয় হেস্টিংস? তোমাকে বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে হলে তুমি কি বলবে? মানুষটি ভাল?
মানুষটি ভাল? এই কথাটির দ্বারা পোয়ারো ঠিক কি বোঝাতে চায়?
আমি ওর চিন্তার খেই ধরতে পারি না। তবে, একঝলকঃচিন্তকরে বলি–হ্যাঁ, আমার তো মনে হয় ভালই। অবশ্যই ওপর ওপর দেখে যতটা বোঝা যায়।
আর তখনই পোয়ারোর নজরে পড়ে তাড়াহুড়োয় নিক তার টুপিটা ফেলে রেখে গেছে।
পোয়ারো টুপিটা তুলে নিয়ে তাতে আঙ্গুল বুলোতে থাকে। গভীর চিন্তাক্লিষ্ট দেখায় তাকে।
লোকটার কি নিকের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে?
সেটা আমি কি করে বলতে পারি পোয়ারো?
কথাটা বলেই আমি হাত বাড়াই, দাও, টুপিটা আমাকে নও; মিঙ্গ বার্কলির হয় এটা দরকার হতে পারে। আমি দিয়ে আসি।
নিশ্চয়ই। গভীর চিন্তায় ডুবে থাকা অন্যমনস্ক জায়গায় পোয়ারো বলো টুপিটা একইভাবে আঙ্গুল বুলিয়ে চলে। টুপিটা ফেরত দিতে এন্ড হাউসে তুমি একা যাবে না মেটেই। আমরা দুজনে যাব। একটু থেমে আবার অদ্ভুত গলায়রুলেআবার ওই সুন্দরী, চার্মিং মহিলাটিকে দেখবার জন্যে আমি উদগ্রীব হয়ে উঠেছি এরই মধ্যে।
আমি কটাক্ষ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার গলায় কুলি-ওই বুড়ো বয়সে শেষপর্যন্ত প্রেমে পড়লে নাকি হে?
মেয়েটি সুন্দরী। তাই নয় কি?
কারণ, হেস্টিংস তার নিজের বোধ, বিচার-বুদ্ধির ওপর আর তেমন কোনও আস্থা নেই। মেয়েটি বিপরীত লিঙ্গের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয় বলে তোমার মনে হয় না কি? : আমি কিছুটা বিরক্ত-ভঙ্গিতে বলি–উত্তরটা নিঃসন্দেহে সদর্থক। কিন্তু পোয়ারো, আমি কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না মহিলার প্রতি তুমি এতটা ইন্টারেস্ট কেন দেখাচ্ছ?
আমি মহিলার প্রতি ইন্টারেস্টেড?
তোমার কথাবার্তা কি সেটাই প্রমাণ করছে না? পোয়ারো টুপিটাকে তার চোখের সামনে তুলে ধরে গম্ভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
সত্যি কথা বলতে কি বন্ধু হেস্টিংস, মেয়েটির থেকেও আমি ওর টুপিটার প্রতি বেশি উৎসাহি। আমি আবার মোয়রোর দিকে তাকাই। কিন্তু ওর মুখ চোখ যথেষ্ট সিরিয়াস।
হ্যাঁ হেস্টিংস, এই টুপিটা।
সে টুপিটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়–দেখ তো কেন আমি টুপিটার প্রতি এত বিশেষভাবে উৎসাহি বুঝতে পারো কি না।
সুন্দর টুপি! আমি টুপিটা হাতে নেবার আগ্রহ পর্যন্ত দেখাই না।
তবে, খুবই সাধারণ না বলে থাকতে পারি না। বহু মেয়েই এই ধরনের টুপি ব্যবহার করে। শেষ মন্তব্য করার মত করে বলি।
নাহ, এটার মত মোটেই নয়। আমি তীব্র চোখে আবার তাকাই।
দেখতে পাচ্ছো?
–এটা একটা সুন্দর টুপি ঠিকই। সুন্দর স্টাইল। অথচ খুবই সাধারণ।
ওহঃ হেস্টিংস, প্রিয় হেস্টিংস কেন বলত–আমি যা দেখতে পাই তুমি তা দেখতে পাও না? পোয়ারো টুপিটাকে হাতের আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে ঘোরাতে থাকে। সেটা বনবন করে ঘুরতে থাকে।
সবসময় যে মস্তিষ্কের ধূসর কোষগুলোকেই গাৈয়েন্দাগিরির জন্য ব্যবহার করতে হবে, তা নয় হেস্টিংস। চোখ…… কখনও কখনও চোখকেও তীক্ষ্ণভাবে চতুরতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়।
কথা শেষ হয় না পোয়ারোর, এবার আমার নজরে পড়ে টুপিটার শীর্ষভাগে নিখুঁত গোল একটা ফুটো। সামান্য একটা ফুটো
চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের মধ্যে একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে যায়। আমি প্রায় হতবাক, স্তব্ধ চোখে পোয়ারোর দিকে তাকাই। বন্ধুবরের মুখে সম্মতিসূচক মৃদু হাসি। মাথা নেড়ে সায় দেবার ভঙ্গিতে সে বলে-তুমি ঠিকই ভেবেছ হেস্টিংস, ঠিক তাই। বুলেট।
বুলেট?
আমার গলায় অদ্ভুত লাগে কথাটা। মানে তুমি বলতে চাও……..
আমি বলতে চাই এক ইঞ্চির তফাতে হলেই বুলেটটা টুপি নয় মাথা গর্ত করে দিত।
একটু থেমে তির্যক হেসে আমার দিকে তাকিয়ে সহাস্যে বলে-এখন কি বুঝতে পারছ প্রিয় বন্ধু, কেন আমি এত ইন্টারেস্টেড?
একটু থেমে সে আবার বলে–অবশ্য তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কারণ তুমিই তো বলেছিলে অসম্ভব বলে কিছুই নেই, হয় না তাই না?
.
০২.
এন্ড হাউস
পোয়ারো, আমি ভাবছি খুবই আদরনীয় অভ্যাস, প্রশংসনীয়ও, চালিয়ে যাও। জানালার পাশে একটা টেবিলে মুখোমুখি বসেছিলাম। দুপুরের খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। গুলিটা খুব কাছ থেকে আমাদের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। অথচ আমরা কেউ তা শুনতে পেলাম না।
না হেস্টিংস-সোঁ সোঁ তীব্র হাওয়া, উতাল সমুদ্রের ঢেউ-এর গর্জন তার মধ্যে তা সম্ভবই নয়। একেবারেই নয়।
একটু ভেবে নিয়েই পোয়ারো আবার বলে-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের মাদাম জোয়েলের সঙ্গে একবার দেখা করতেই হবে। তিন দিনের মধ্যে তিনটে মৃত্যুর হাতছানি এড়িয়ে যাওয়া, না–ব্যাপারটা…….
আমরা এরপর নীরবে খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আচমকা জানালার বাইরে তাকিয়ে পোয়ারো খুশির গলায় বলে ওঠে–ওহ কি চমৎকার সংযোগ।
আমি তাকালাম। সদলবলে মাদাম জোয়েল বার্কলি এই বেঁস্তোরার দিকেই আসছেন।
পোয়ারো দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় এবং সহাস্যে অভিবাদন জানিয়ে টুপিটা মিস বার্কলির দিকে এগিয়ে দেয়।
মেয়েটি হেসে টুপিটা গ্রহণ করে। ওরা এসে টেবিলে বসে।
ওদের দলটা ছিল চার জনের–মিস বার্কলি, কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার, একজন যুবক এবং একজন যুবতী।
আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে ওদের দলটাকে লক্ষ্য করাটা বেশ অসুবিধাজনক ব্যাপার। তারই মধ্যে বারবার আড়চোখে দেখছিলাম আর আড়ি পাতছিলাম। নৌ অফিসারটির উচ্চস্বরে হাসির শব্দ ভেসে আসছিল বারবার। আপাতদৃষ্টিতে মানুষটি আমুদে, প্রাণখোলা এবং সরল প্রকৃতির বলে মনে হয়।
বন্ধুবরকে বেশ কিছুটা মনোযোগাচ্ছিন্ন দেখাচ্ছিল। খাওয়ার প্রতি তার যেন কোনও মনোযোগই ছিল না। নীরবে এলোমেলো ভঙ্গিতে টুকটুক করে খেয়ে চলেছে। আমি বারকয়েক কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ওর কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে বাধ্য হয়ে চুপ করে গেলাম। খাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরও পোয়ারো টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে লাগল কখন ওদের মুখোমুখি হবে।
ভাবতে ভাবতে ওরা খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে লাউঞ্জের দিকে এগোচ্ছে।
পোয়ারো ঝটপট টেবিল থেকে উঠে পড়ল।
ওরা সবে গিয়ে লাউঞ্জে দাঁড়িয়েছে, পিছন থেকে পোয়ারো ডাকল–মাদাম, আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা ছিল।
মেয়েটি পিছন ফিরে তাকাল। ওর চোখে চাপা অস্বস্তি।
আমি ওর মনের অবস্থাটা তখন পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম। রোগা চেহারার এই বিদেশিনীর খোঁজখবর না জানি কি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করবে কে জানে।
মাদাম কয়েক পা সরে দাঁড়ায়। পোয়ারো তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে কি যেন বলে।
কয়েকমুহূর্ত পরই আমি ওর চোখে মুখে পরম বিস্ময় ভেসে উঠতে দেখি।
আমি এই পরিস্থিতিতে যথার্থ অপ্রস্তুত বোধ করছিলাম। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার আমার উদ্ধারে এগিয়ে এলেন। একটা সিগারেট এগিয়ে এলেন। একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে এলোমেলো কথা জুড়ে দিলেন। আমি কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে ছিলাম যে আমি মোটেই আমার কৌতূহলপ্রবণ সঙ্গীটির মত নই। আর সেই ফাঁকে আমি আমার নিজস্ব পদ্ধতিতে মানুষটিকে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে গেলাম। লম্বা, পাতলা, ফর্সা সপ্রতিভও এক যুবক। কিছুটা মাংসল নাক। নিজের সম্বন্ধে একটা উন্মাসিকতা রয়েছে। সেটা আমার খুব একটা পছন্দ হচ্ছিল না। তারপর আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। ওর মধ্যে একটা অসাধারণত্ব রয়েছে। চূড়ান্ত অসাধারণ এক প্রতিচ্ছবি, ম্যাডোনার মত-ফর্সা রঙ, ধারালো চেহারা। প্রায় রঙহীন চুল। বড় বড় চোখের তারা। ধূসর তার রঙ। যুবকটি আমার দিকে তাকায়।
আপনার বন্ধু নিক-এর সঙ্গে যতক্ষণ না কথা সেরে নিচ্ছেন ততক্ষণ অন্তত আপনি বসুন।
আমি একবার শ্যালিঙ্গার-এর মুখের দিকে তাকাই, তারপর বলি-মিস বার্কলি খুবই দয়ালু মনের মহিলা। সকালে আমার বন্ধুর গোড়ালিতে চোট লেগেছিল। তখন উনি খুব সাহায্য করেছিলেন।
হুম, নিকও সেকথাই বলেছে।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন খোঁজখবর চেষ্টা করে শ্যালিঙ্গার। তারপর বলে–যাক, এখন তো উনি পুরোপুরি সুস্থ আছেন?
কথাটা শুনে আমি কেমন যেন একটু লজ্জিত হলাম, বললাম-হ্যাঁ, সামান্য একটু মচকে গিয়েছিল।
যাক, আমার জেনে ভাল লাগল যে পুরো ব্যাপারটা নিজের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত নয়।
আমি কথাটা শুনে কেমন যেন চমকে উঠি। মানে?
শ্যালিঙ্গার মাথা নাড়েন। মুচকি হেসে বলেন-এসব ব্যাপারে নিক একেবারে তুখোড়, চরম পটু। প্রায় ভগবান প্রদত্ত ক্ষমতা বলা চলে। নিক একজন মিথ্যাবাদী।
কথাটা আমি হজম করতে পারছিলাম না; ওরকম মিষ্টি একটা মেয়ে।
ও যা সব সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে। কেন, আপনাদের কিছু শোনায়নি? হত্যার চেষ্টা, গাড়ির ব্রেক খুলে রাখা……… শেষের দিকে তীব্র ব্যাঙ্গের মত শোনায় শ্যালিঙ্গারের কথাগুলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে পোয়ারো ফিরে আসে। আমি উঠে দাঁড়াই।
পোয়ারো আমার কব্জি চেপে ধরে, ওনাদের অভিবাদন জানিয়ে দ্রুতপায়ে আমাকে প্রায় টেনে নিয়ে সেখান থেকে চলে এলেন। যেতে যেতে শুধু বললেন-সব ঠিক হয়ে গেছে। মাদাম সাড়ে ছ’টায় এন্ড হাউসে আমাদের দেখা করতে বললেন। আপাততঃ উনি এখন মোটর যাত্রায় যাচ্ছেন, আমাদের এখন ওনার ফেরার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
তুমি ওনাকে কি বললে?
আমি ওনার সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিস্তারিত কথা বলতে চাইলাম। প্রথমটায় উনি ঠিক রাজি হতে চাইছিলেন না। শেষে অবশ্য আমার কয়েকটা কু শুনে কিছুটা অবাক হয়েই রাজি হলেন আমার সঙ্গে আলোচনায় বসতে।
বিকেল হতে না হতেই পোয়ারোর মনে এক প্রবল অস্থিরতা দেখা দিল। ঘরময় কেমন অস্থিরভাবে সে হেঁটে বেড়াতে লাগল।
ছ’টা বাজতে না বাজতেই আমরা রওনা দিলাম এন্ড হাউস-এর উদ্দেশ্যে।
অবিশ্বাস্য! তাই না হোটেলের বাগান। পাগল না হলে কেউ এরকম জায়গায় গুলি চালাবার ঝুঁকি নেয়?
না, তোমার কথা মোটেই মানতে পারছি না হেস্টিংস।
আবার একটু ভেবে দেখলে, এর থেকে নিরাপদ জায়গা আর হতে পারে না। প্রথমতঃ বাগান একেবারে নির্জন। দ্বিতীয়তঃ হোটেলে যারা আসে তারা বারান্দায় বসে সমুদ্র এবং বেলাভূমির সৌন্দর্যে আপ্লুত হয়ে ওঠে। সেইসময় বাগান থেকে কেউ যদি সেই সৌন্দর্যপিপাসুটিকে গুলির শিকার করতে চায় খুবই সহজ ব্যাপার।
আমি অবাক হয়ে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ঠিক, পোয়ারো ঠিকই বলছে। লম্বা লম্বা গাছ, উঁচু উঁচু ঝোপ, ফুলের ঝাড়। আততায়ীর লুকিয়ে থাকাটা কোনও ব্যাপারই নয়। এখান থেকে আততায়ী নির্বিঘ্নে কাজটা সারতে পারবে।
সত্যি, ব্যাপারটা খুবই সহজ। আততায়ী জানত যে নিক বার্কলি ওই রাস্তাটা ধরে বাড়ি ফিরবে, তবু ব্যাপারটা কেন যেন বেশ ঝুঁকির মনে হচ্ছে আমার। গুলি করে খুন করাকে তো আর দুর্ঘটনা বলে চালানো যাবে না।
আমরা পৌঁছে গেলাম এন্ড হাউসে। আমাদের সামনে পাহাড়ের বাঁকে। শীর্ষদেশে ভেসে উঠল একটা ফটক; যার মাথায় ছোট্ট অক্ষরে লেখা এন্ড হাউস। ফটকের ভিতর প্রবেশ করে সরু গলি ধরে আমরা এসে হাজির হলাম ছোট্ট একটা বাগানে। বিভিন্ন ধরনের ফুলের ঝাড় আর ঘাসে ছাওয়া সুদৃশ্য বাগান সংলগ্ন ছবির মত সুন্দর একটা বাড়ি, যার জানালাগুলো সুন্দর পর্দায় ঢাকা। আমাদের পায়ের শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন প্রায় ষাটের কাছাকাছি বয়সী এক বৃদ্ধ। ফুলের ঝাড় পরীক্ষা করছিলেন তিনি। প্রায় ছ’ফুট লম্বা, পরনে রংচটা জ্যাকেট, মাথা প্রায় ফাঁকা, তবে দু’চোখের চাউনি আশ্চর্য ধরনের।
শুভ সন্ধ্যা। আমাদের দিকে তাকিয়ে অভিবাদন জানালেন।
আমি প্রত্যুতরে অভিবাদন জ্ঞাপন করে ভেতরের দিকে এগোতে লাগলাম। যদিও বুঝতে পারছিলাম আমাকে কেউ যেন অনুসরণ করছে।
আশ্চর্য। পোয়ারো চিন্তান্বিত গলায় বলল।
আমরা বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বেশ পুরানো আমলের বাড়ি। দুর্গের আকারে এই বাড়ি। তবে প্রায় ভগ্ন দশা। মেরামত হয়ই না।
মধ্যবয়সী এক মহিলা দরজা খুলে দিলেন। সেই জানাল যে, মিস নিক বার্কলি এখনও ফেরেননি।
পোয়ারো জানাল মিস বার্কলির সঙ্গে তার আগে থেকেই সময় স্থির করা আছে এবং সে ওনার জন্যে অপেক্ষাও করবে।
আমরা ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। পর্দাগুলো সুদৃশ্য–দামী ব্রোকেডের, কিন্তু পুরানো। ঘরের আসবাবপত্রগুলোও সবই পুরানো দিনের। দেওয়ালে বহু বছর নতুন রঙ পড়েনি। তবে সোফা এবং টেবিলের ঢাকনাগুলো সবই ঝকমক করছে, যেন নতুন। ঘরের দেওয়ালগুলো জুড়ে বালি পরিবারের পূর্বপুরুষদের তৈলচিত্রা ঘরে একটা তারবিহীন ফোনও রয়েছে। সোফার কোণে দরকরচা মেরে পড়ে আছে একটা খবরের কাগজ। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ঘরের দরজা হাট করে খুলে গেল। মিস বার্কলি ঘরে ঢুকলেন। ঠান্ডা বরফ নিয়ে এস এলিন। বেশ চড়া গলায় বললেন তিনি। তারপর আমাদের দিকে ওনার নজর পড়ল।
ওহ, আপনারা! আমি এসে পড়েছি। তবে আপনার প্রবল কৌতূহল দেখে আমি অবাক হচ্ছি বটে।
নিক থামলেন। কাঁধ ঝাঁকালেন, তারপর আবার বলতে লাগলেন বেশ কিছুটা কৌতুক মিশিয়ে–নিশ্চয়ই বলবেন–আপনি ছবি আঁকেন, আর আমার কাছ সেই ছবি বিক্রি করতে চান?
না, তা হতে পারে না। ওই গোঁফ, তারপর ম্যাজিস্টিকের মত দামি হোটেলে যিনি উঠেছেন–তিনি তো যেরকম কিছু হতে পারেন না।
এরই মধ্যে সেই আগের পরিচারিকা মহিলাটি ককটেলের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢোকে। নিপুন হাতে ককটেল বানায় নিক। আমাদের হাতে গ্লাস তুলে দিয়ে নিজেও একটা গ্লাস তুলে নিয়ে সোফায় গুছিয়ে বসে। তারপর তীক্ষ্ণ চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায়। তাহলে………?
পোয়ারো শান্ত ভঙ্গিতে গ্লাসে চুমুক দেয়–আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে, তার আগে গ্লাস সহ হাত উঁচু করে বলে। মেয়েটি মোটেই বোকা নয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝা যায় তার গলার আওয়াজে-কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার?
অবশ্যই মাদাম জোয়েল। পোয়ারো কয়েকমুহূর্ত থামে, প্রখর চোখে নিককে নিরীক্ষণ করে। তারপর হাতটা মুঠো করে এগোয় হাতটা খুলতেই, তালুর মধ্যে ধরা বুলেটটা।
এটা কি আপনি জানেন?
নিক বিস্ফারিত চোখে বস্তুটার দিকে তাকায়।অবশ্যই। আমি জানি। এটা বুলেট।
ঠিক। সকালে আপনি যেটাকে মৌমাছি বা ভোমরা বলে মনে করেছিলেন–আপনার মুখের পাশ দিয়ে যেটা ছুটে গিয়েছিল, যেটা মোটেই এই ধরনের কিছু ছিল না। বরং ছিল এটা।
নিক বিস্ফারিত চোখে তাকিয়েই থাকে, তারপর আতঙ্কিত গলায় বলে–তার মানে আপনি বলতে চান হোটেলের বাগান থেকে সকালে আমাকে লক্ষ্য করে কেউ গুলি চালিয়েছিল?
তাই তো মনে হচ্ছে।
নিক কয়েকমুহূর্ত থম মেরে বসে থাকে, তারপর থতমত গলায় আতঙ্ক মেশা ভঙ্গিতে বলে,-কয়েক দিনের মধ্যে আমাকে খুনের চতুর্থ চেষ্টা।
আমি বাকি তিনটের ব্যাপারে জানতে চাই আপনার কাছে।
মৃদু হেসে যোগ করে দুঘর্টনা। নিক সোজা স্পষ্ট চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায়। বন্ধুবর নিকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে–আমি নিশ্চিত হতে চাই যে ওগুলো কোন দুর্ঘটনা নয়, নিশ্চিতভাবেই খুনের চেষ্টা।
নিশ্চয়ই তাই-ই। অন্য কিছু হতে যাবে কেন? পোয়ারো তার গোঁফে মোচড় দেয়–তাহলে মাদাম জোয়েল, আমার মনে হয় মানসিকভাবে আপনার আরও বেশি বিপদের জন্য তৈরি থাকতে হবে। কে আপনার প্রাণহানি ঘটাতে চাইছে?
এবারে নিক হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে–হে ভগবান, আমাকে কে খুন করতে চাইবে? আমি তো কোটিপতির উত্তরাধিকারী নই যে আমার মৃত্যুতে কারও আর্থিক লাভ হতে পারে। না, আমার মনে হয় ব্যাপারটায় কোন বাস্তবতা বা সত্যতা নেই।
পোয়ারো মৃদু হাসে। আপনার কথাই হয়তো সত্যি মাদাম জোয়েল। তবু সব শুনতে চাই।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। নিক একটু থামে, কি যেন ভাবে–প্রথমটায়, একরাতে আমি যে বিছানায় ঘুমোচ্ছিলাম তার মাথার দিকের দেওয়াল থেকে ভারি একটা ছবি ভেঙ্গে পড়ে। ভাগ্যবশত আমি সে সময় সেটা বন্ধ করতে উঠেছিলাম। বিছানায় থাকলে নিঃসন্দেহে আমার মাথা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেত।
পোয়ারো চুপচাপ শুনে যায়। ওর মুখ গম্ভীর। তারপর? অন্য দুর্ঘটনাগুলো?
আমাদের এই বাড়ি থেকে সমুদ্রে যাবার একটা পাহাড়ি পথ আছে। খুবই তীক্ষ্ণ, আতঙ্কজনক খাদময় সেই পথ। আমি স্নান করতে গিয়েছিলাম। ওখানে সমুদ্রে ঝাঁপ দেবার জন্যে একটা পাথরের চাতাল মত আছে। সেই জায়গায় একদিন আমার মাথার ওপর থেকে একটা বড় পাথরের চাঙড়…….. মনে হয় কাকতালীয়, তাই না?
হুম, তারপর? চালিয়ে যান।
সেই তুলনায় তৃতীয় ঘটনাটা কিন্তু একেবারে ভিন্নতর। আমার গাড়ির ব্রেকটা কেটে গিয়েছিল সদর দরজা পার হয়ে পাহাড়ি পথে বুঝতে পারি। তবে, গাড়িটার ভাগ্য ভাল একটা পাথরের খাঁজে চাকাটা আটকে যায়। গাড়ি তাই থেমে যায়। তা না হলে গাড়িসহ পাহাড়ের যেকোনও বাঁকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে আছড়ে পড়া আমার নিশ্চিত ছিল।
কিন্তু কেন গাড়ির ব্রেক ফেল হয়েছিল?
সেটা আপনাকে মট-এর গ্যারেজ থেকে জেনে নিতে হবে।
আপনার সেই গ্যারেজটা কোথায়? রেডমন্ড রোডে। পাহাড়ের ঠিক নিচেই।
এবার পোয়ারো কি যেন ভেবে নেয়, তারপর বলে–আপনার গাড়িটাকে একটু দেখা যাক মাদাম জোয়েল?
নিজের দু’চোখ প্রসারিত করে বিস্ময়চকিত গলায় বলে নিক।
ওহ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বাড়ির অন্যদিকেই আমাদের গ্যারেজ ঘর।
সেটা কি সবসময় তালা দিয়ে বন্ধ করা থাকে?
পোয়ারো চিন্তামগ্ন ভঙ্গিতে বলে–তার মানে কেউ যদি গাড়িতে কোনও কারসাজি করার চেষ্টা করে, খুব সহজেই সেটা করতে পারবে?
পোয়ারোর কথায় এতক্ষণে সে বুঝতে পারে–হ্যাঁ, তা নিশ্চয়ই পারে।
কিন্তু আমার যথেষ্ট বোকা বোকা লাগছে চিন্তাটা। নিক অবিশ্বাসের গলায় বলে।
পোয়ারো মাথা নাড়ে, না মাদাম জোয়েল, এর মধ্যে কোন বোকা বোকা ব্যাপার নেই। পুরোটাই বাস্তব আর সত্যি। আর সেই সত্যিটা হল অতি ভয়ঙ্কর। আপনার প্রাণের ওপর হামলা হয়েছে। একবার নয়, বেশ কয়েকবার। আপনি ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে রয়েছেন মাদাম। আপনি জানেন আমি কে?
নিক অবাক চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়ে না।
আমি এরকুল পোয়ারো।
মুহূর্তে নিকের দু’চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে–হে ভগবান, সত্যি?
পোয়ারো মৃদু হাসে-আপনি আমার নাম শুনেছিলেন, তাই না?
বিস্ময় ভরা চোখে হাসি চেপে নিক বলে-ওহ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কিন্তু ওর কথা বলার মধ্যে একটা অপ্রস্তুত ভাব পোয়ারোর চোখ এড়ায় না।
.
০৩.
দুর্ঘটনা?
নিঃসন্দেহে, নিকের এই ভঙ্গিটা পোয়ারোর ইগোকে আঘাত করে। সারা পৃথিবী যাকে একডাকে চেনে, অথচ এই মেয়েটি তাকে আদৌ চেনে বলে মনে হচ্ছে না। সে দাবি করলেও সেটা আমাদের কারও কাছেই মোটেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না। সবচেয়ে বড় যেটা, মেয়েটা পোয়ারোর সাবধানবাণীকে আদৌ গুরুত্ব দিচ্ছে না। বয়ষ্ক বিদেশীটি যেন কোনও ভয়ানক মজা-কৌতুকের কথা বলছে। ভঙ্গিটা সেইরকম। নিকের এই অসন্তুষ্ট হওয়া, সেটা সত্যিই পোয়ারোর মত ব্যক্তিত্বের ইগোর পক্ষে মারাত্মক রকমের অস্বাস্থ্যকর।
পোয়ারোর গলাটা বজ্রনির্ঘোষের মত শোনায়।
আপনি কি একটু সিরিয়াস হবেন? আপনারা, এই অল্পবয়সীরা–কেন কোনও কথাতেই গুরুত্ব দেন না? একটু থেমে আগুনঝরা চোখে নিকের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো আবার বলে-মাদাম, আমার কথা শুনে আপনার নিশ্চয়ই খুব হাসি পাচ্ছে? অথচ মাথায় ছোট্ট একটা ফুটো নিয়ে আপনি যদি শুয়ে থাকতেন, তাহলে কিন্তু হাসতে পারতেন না। কারণ মৃতদেহ হাসে না।
নিক পোয়ারোর দিকে সংশয়ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। মিঃ পোয়ারো, আমাকে সাবধান করে দেবার জন্য ধন্যবাদ। তবে আমার সত্যি সত্যিই মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা নিছকই একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
পোয়ারো হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকায়, সামান্য থমকে নিককে নিরীক্ষণ করে–আহ, আবার সেই কথা, এক কথা। সামান্য থেমে পোয়ারো এবার তীব্র গলায় ঝাঝালো ভঙ্গিতে বলে-মাদাম জোয়েল, দয়া করে আমার কথায় আপনাকে মনোযোগ দিতে অনুরোধ করছি। আপনি ভীষণ রকম বিপদের মুখোমুখি, সকালে কেউ আপনাকে মাউজার পিস্তর দিয়ে গুলি করেছিল।
নিমেষে নিকের চেহারায় ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায়। পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকিয়ে সে অবাক গলায় বলে-মাউজার পিস্তল?
ওকে বিভ্রান্ত দেখায়।
হ্যাঁ, কেন? আপনি কি এরকম কাউকে চেনেন, জানেন, যার কাছে মাউজার পিস্তল রয়েছে?
নিক হাসে, আমার কাছেই আছে। হ্যাঁ, বাবা যুদ্ধ থেকে ফিরে আসায় দিয়েছিলেন।
একবার সেই বস্তুটা দেখতে পারি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
নিক উঠে যায়, বরাবর এটা এখানেই থাকে। সে একটা পুরানো আমলের দেরাজের বিশেষ একটা খোপের দিকে ইঙ্গিত করে। তারপর সেটা টেনে খুলতেই ওর মুখের ভাব সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়। বিস্ফারিত চোখে চমকিত গলায় সে বলে-ও-ওটা নেই।
নিক (আমরা এতক্ষণে কথা প্রসঙ্গে জেনে ফেলেছি এটা ওর দাদুর দেওয়া নাম, ওর আসল নাম ম্যাগদালা) আবার চেয়ারে ফিরে এসে বসে। ওর মুখে ঘন চিন্তার রেখা। আশ্চর্য ছোট্ট শব্দটায় মনের ভাব প্রকাশ করে সে।
তোমার মনে আছে হিস্টেংস, আমি যে সম্ভাবনাটার কথা আগেই তোমায় বলেছিলাম। মনে পড়ছে?
আমি নিরাপদ থাকাই বাঞ্ছনীয় মনে করি। প্রিয় বন্ধু আবার একটা নিজস্ব চাল দিয়েছে।
সামান্য বিরতি, পোয়ারো নিকের অভিব্যক্তিটা দ্রুত চোখে নিরীক্ষণ করে, তারপর আবার বলতে শুরু করে–আমার ধারণাটাই সত্যি হল। মাদাম জোয়েলের গুলিবিদ্ধ শরীরটা হোটেলের বাগানে নিথর হয়ে পড়ে থাকত। অনেকক্ষণ যা কারোর নজরে পড়ত না। সেই ফাঁকে, কাজটা খুবই সহজ পিস্তলটা ওর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত। পরে মাদাম এলিন যা সনাক্ত করতেন ওটা অবশ্যই মাদাম জোয়েল এরই পিস্তল এবং তিনি এও জানাতেন, সম্প্রতি মাদম জোয়েল খুব নার্ভাস, মৃত্যু ভয়ে ভীত ছিলেন।
নিক অস্বস্তির ভঙ্গিতে নড়ে। ওর মুখে-চোখে স্পষ্টতই সংশয়। পোয়ারো আবার বলতে শুরু করে। সুতরাং আবার বলতে ঘটনাটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। খুব সহজ হবে ব্যাপারটা।
কি ভয়ঙ্কর! নিকের গলায় স্পষ্ট আতঙ্ক।
পোয়ারো আমার দিকে তাকায়, ওর চোখে বিজয়ীর হাসি। মাথা নেড়ে নিজের আতঙ্ককে সমর্থন করেই যেন পোয়ারো বলে–আর একটা ব্যাপার, চার চারটে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে … পঞ্চমবার হয়তো সেটা হবে না।
নিক পোয়ারোর দিকে তাকায়। দুষ্টিতে সংশয়।
পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন-না, না, মিস বার্কলি, চিন্তা করবেন না। আমরা আছি। আপনাকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করব।
মিস বার্কলি সামান্য হাসেন-ধন্যবাদ। আপনি ভয় দেখান সুন্দরভাবে। ঘটনাগুলোর মতই বিপজ্জনক ধরনের, আবার রোমহর্ষক। আমি লক্ষ্য করছিলাম নিক তার নির্দয় অভিজ্ঞতাটাকে ধরে রাখলেও, বজায় রাখবার চেষ্টা করে চললেও-ওর দৃষ্টিতে স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে সমস্যার প্রতিচ্ছবি, বিপদের আঁচ।…
পোয়ারো মৃদু কাশে। তারপর বিনীত ভঙ্গিতে একটু ঝুঁকে বলে-তাহলে প্রথমেই যেটা করতে হবে, প্রথাগত আলোচনা। নিকের চোখে চোখ রাখে সে-তাহলে…..শুরু করা যাক মাদাম জোয়েল? প্রথমে যে প্রশ্নটা অবশ্যম্ভাবী এসে পড়ে, আপনার কোন শত্রু আছে?
নিক মাথা নেড়ে নেতিবাচক উত্তর দেয়, না।
পোয়ারো সমর্থনসূচক ভঙ্গি করে–বেশ। তাহলে আমরা সিনেমা বা গোয়েন্দা কাহিনীতে গোয়েন্দাকে এরপর যে প্রশ্নটা করতে শুনি-আপনার মৃত্যু হলে কার সবচেয়ে লাভ?
এবার নিককে দৃশ্যতই বিভ্রান্ত দেখায়।
সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না। যে কারণে আমার গোটা ব্যাপারটাকে আজব, দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। আমার সেরকম কোনও সম্পত্তি নেই, যার কারণে আমাকে খুন করার চেষ্টা করা হতে পারে। হ্যাঁ, এই বাড়িটা আছে বটে কিন্তু পুরানো এই বাড়িটাও তো বন্ধক রাখা।
বাড়িটা বন্ধক রাখা আছে?
নিক এবার কিছুটা বিমর্ষ গলায় বলে–আমি বাধ্য হয়েছিলাম। পরপর কয়েকটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গেল। একটার পর একটা। প্রথমে আমার ঠাকুর্দা। সেটা ছ’বছর আগের ঘটনা। তারপর আমার ভাই। অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম ভীষণভাবে।
পোয়ারো গভীর মনোযোগ দিয়ে নিকের প্রত্যেকটা কথা শুনছিল। মেয়েটা থামতেই আড্ডা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে-আর আপনার বাবা?
উনি যুদ্ধে আহত প্রতিবন্ধী অবস্থায় ফিরে এসেছিলেন। কয়েকবছর পরই নিউমোনিয়াতে মারা যান।
একটু থেমে নিক আবার যোগ করে–আমার শিশু বয়সেই মা মারা গিয়েছিলেন। মায়ের অকাল মৃত্যুর শোক বাবা সহ্য করতে পারেননি। তারপর থেকেই ভবঘুরে জীবনযাপন করতেন তিনি। যুদ্ধ শুরু হতেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। আমি বা আমার ভাই জেরাল্ড কেউই বাবার সঙ্গ পাইনি। ঠাকুর্দার কাছেই মানুষ হয়েছি। আমার ঠাকুর্দা ছিলেন একজন অতুলনীয় মানুষ। লোকে বলত তিনি যাতে হাত দিতেন তাই নাকি সোনা হয়ে উঠত। তিন তার ভাগ্য পরীক্ষা করতেন জুয়ায়। যার মাধ্যমে প্রচুর রোজগার করেছিলেন তিনি। আমার যখন ষোল বছর বয়স, তিনি মারা যান। তারপর এই বাড়ির মালিকানা পায় আমার ভাই জেরাল্ড। মাত্র বছর তিনেক আগে এক মোটর দুর্ঘটনায় জেরাল্ড মারা যায়।
আপনার পর এ বাড়ির মালিকানা পাবেন সেরকম নিকটাত্মীয় কি কেউ আছেন মাদাম জোয়েল? পোয়ারো প্রশ্ন করল।
নিক দ্রুত কয়েকমুহূর্ত ভেবে বলে–আমার সম্পর্কে এক ভাই চার্লস। চার্লস ভাইস। পেশায় ও একজন দক্ষ আইনজীবী। সব ব্যাপারে আমায় সে খুব সাহায্য করে।
আপনার বিষয় সম্পত্তির দেখাশোনা কি ইনিই করেন?
উফ, সেভাবে দেখতে গেলে দেখাশোনা করার মত বিষয় সম্পত্তি আমার সেরকম নেই। তবে হ্যাঁ, আমার বাড়িটা বন্ধক রাখতে চার্লসই সবরকম ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। লজটা ভাড়া দেবার ব্যবস্থাও সেই করে দিয়েছিল। উফ, লজ, আমি এক্ষুনি এ প্রসঙ্গে আসছিলাম।
ওটাও কি ভাড়া দেওয়া ম্যাদাম?
নিক সায় দেয়,– হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়ান এক পরিবারকে। খুবই আন্তরিক এবং মিশুকে পরিবার।
পোয়ারো কি যেন চিন্তা করে। তারপর বলে–এখানে ওরা কতদিন ধরে রয়েছেন?
বেশিদিন নয়। মাত্র মাসছয়েক।
আচ্ছা ম্যাদাম, আপনার ওই ভাইটি, চার্লস–সে কি আপনার বাবার দিকের আত্মীয় না মায়ের?
ওহ, চার্লস আমার মায়ের দিকের সম্পর্কিত। আমার মাসতুতো ভাই।
পোয়ারো আবার ঘনঘন দু’পাশে মাথা নাড়ে সমর্থনের ভঙ্গিতে।
বেশ। এছাড়া আর অন্য আত্মীয়-স্বজন?
খুব কম। ইয়র্কশায়ারে কয়েকজন দূর সম্পর্কের ভাইবোন আছে।
হুম, তাহলে আপনার তো যথেষ্ট নিঃসঙ্গ জীবন কাটে তাই না?
পোয়ারোর কথায় মিস বার্কলি মৃদু হাসেন–নিঃসঙ্গ? না মিঃ পোয়ারো। আসলে সম্পর্ক তৈরি বা বজায় রাখার সময়ই আমার থাকে না। দেশে তো বলতে গেলে আমি প্রায় থাকিই না।
যাক, এবার আপনার বন্ধুদের বিষয়ে একটু জানব। দুপুরে আপনাকে যাদের সঙ্গে দেখলাম।
ওরা, একজন ফ্রেডি রাইস। আমার অন্যতম প্রিয় এবং ঘনিষ্ট বান্ধবী। ওর জীবনটা বলতে গেলে ধ্বংস হয়ে গেছে। একটা জানোয়ারের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছিল। মদ আর মাদকই তার জীবন ছিল। বছর খানেকের মধ্যে ফ্রেডি তাকে ছেড়ে চলে আসে। আমি চাই আইনত বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেলে ফ্রেডি জিম লাজরুমকে বিয়ে করুক।
জিম লাজরুম? বন্ড স্ট্রিটের আর্ট ডিলার?
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। জিম তার একমাত্র সন্তান। সুপুরুষ। সৎ। অত্যন্ত ভদ্র। সবচেয়ে বড় কথা, ফ্রেডি নিবেদিত প্রাণ। ওরা হোটেল ম্যাজেস্টিকেই রয়েছে গত একসপ্তাহ ধরে। আগামি সোমবার আমি একটা পার্টি দিচ্ছি। সেদিন ওরা এখানে আসবে।
পোয়ায়োর কপালে ভাঁজটা ক্রমে গম্ভীর হচ্ছে। আমি ওর এই চেহারা খুব ভালভাবেই চিনি। চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে পোয়ারো নিককে উদ্দেশ্য করে বলে–আর মিসেস রাইমের স্বামী?
সেই নেশাখোর হতচ্ছাড়ার তো কোন খোঁজই নেই। সে যে কোথায় কেউ জানে না। ফ্রেডিও সে কারণে ডিভোর্সটা পাচ্ছে না।
হুম। এবার মাদাম জোয়েল আপনার অন্য বন্ধুদের প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। কমান্ডার শ্যালিঙ্গার?
জর্জ?–গত পাঁচ বছর ধরে আমি ওকে চিনি।
পোয়ারো এবার নিককে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে। এবার বন্ধুর মত প্রশ্ন করে–যদি কিছু মনে না করেন, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি আপনাকে–উনি কি আপনাকে বিয়ে করতে চান?
নিক সপ্রতিভ ভঙ্গিতেই ব্যক্তিগত প্রশ্নটার জবাব দেয়–হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই কথাটা তোলে।
এ বিষয়ে আপনার কি মত?
না, জর্জকে বিয়ে করার বাসনা আমার কোন মতেই নেই। কারণ ওর বিত্তসম্পদও নেই, বয়সও চল্লিশ পার হয়ে গেছে। তাছাড়া চরিত্রের দিক দিয়ে একটু একঘেয়ে স্বভাবের।
পোয়ারো মৃদু হাসে-সঠিক যুক্তি। আপনার মত একজন প্রাণোচ্ছল যুবতীর সঙ্গে উনি মোটেই মানানসই নন।
একটু থেমে পোয়ারো আবার বলে–আচ্ছা মাদাম যে ছবিটা আপনার বিছানার ওপর ছিঁড়ে পড়েছিল, সেটা কি একবার দেখা যায়?
নিক একঝলক পোয়ারোর মুখের দিকে তাকায় তারপর বলে–হ্যাঁ, কেন নয়?
নিকের পেছন পেছন আমরা ওর শোবার ঘরে এসে হাজির হলাম।
মাথার দিকে ওপরে ফ্রেমে বাঁধানো একটা তেলচিত্র। পোয়ারো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল–আগের দড়িটাও কি একইরকম পোক্ত ছিল?
হ্যাঁ, প্রায়? মিস বার্কলি অন্যমনস্ক গলায় উত্তর দেয়।
পোয়ারো দড়িটা দেখতে দেখতে বলে–আগের দড়িটা আছে কি?
নিক অবাক গলায় বলে–একটা ছেঁড়া তার, সেটা রেখে দেওয়া হবে কেন?
পোয়ারো গভীর আক্ষেপের মাথা নাড়ে–মাদাম জোয়েল, তারটা দেখলে বোঝ যেত সেটা সত্যিই ছিঁড়ে গিয়েছিল না কি সেটা কেটে দেওয়া হয়েছিল?
নিক খুবই তাচ্ছিল্যের গলায় বলে-না, না, সেরকম কিছুই নয়। ওটা নিছকই একটা দুর্ঘটনা ছিল। আর কিছুই হতে পারে না।
হ্যাঁ, মাদাম জোয়েল জোর গলায় বলা যায় না যে এটা দুর্ঘটনা নয়। কিন্তু আপনার গাড়ির ব্রেক নট করে দেওয়া বা পিস্তলের গুলি ছোঁড়া, এগুলো কোনভাবেই দুর্ঘটনা হতে পারে না। এমন কি পাথরের চাতাল থেকে পাথরের চাঁই গড়িয়ে পড়া, সেটাও খুবই সন্দেহজনক।
পোয়ারো এবার বাড়িটা ভাল করে ঘুরে ঘুরে দেখল। সারা বাড়িতে আশ্চর্য এক নিঃশব্দ বিরাজমান।
মাদাম, আপনার বন্ধুদের মধ্যে এমন কেউ আছেন যাকে আপনি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেন?
বলতে গেলে ফ্রেডি। কেন বলুন তো?
এখন থেকে আপনার সঙ্গে কারও সর্বক্ষণ থাকা উচিত, পোয়ারো গম্ভীর গলায় বলে।-তবে মিসেস রাইসনয়। অন্য কেউ।
কথাগুলো শুনে নিক এবার যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারপর কি যেন ভাবে কিছুক্ষণ–এবার বলে ম্যাগি, ওর ওপর ভরসা করা যায় অবশ্যই।
ম্যাগি? তিনি কে?
আমার ইয়র্কশায়ারের তুতোদের একজন। একটু থামে নিক। পোয়ারোর মুখের দিকে তাকায়–আমারই সমবয়সী। ওকে দিয়ে আপনার কাজ চলবে?
নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। আপনার তুতো বোন যখন তিনি নিশ্চয়ই ভরসাযোগ্য।
নিক একটা গভীর শ্বাস ছাড়ে।–বেশ–আমি তাহলে ম্যাগিকে তার পাঠাচ্ছি, কিন্তু ওকে আপনি ঠিক কি করতে বলছেন?
মাদাম জোয়েল বার্কলি, সম্ভব হলে, না না সম্ভব হলে নয়, নিশ্চিত করবেন যেন উনি রাতে আপনার সঙ্গে ঘুমোন।
ঠিক আছে।
কিন্তু এরকম একটা আবদার করলে উনি কিছু মনে করবেন না তো?
না না, ম্যাগি সেরকম মেয়ে নয়। তাছাড়া আমরা খুবই ঘনিষ্ট।
আমরা আবার বসবার ঘরে এসে বসলাম। নিক কিছুটা বিভ্রান্ত গলায় বলে–আপনি কি সব ঘটনা ম্যাগিকে জানাবেন?
না, না, আপনি নিশ্চিত থাকুন ম্যাদাম। আর যাই ঘটুক, সব কিছু সাহসের সঙ্গে মুখোমুখি হবেন। একটু থেমে পোয়ারোর যেন হঠাৎ মনে পড়ল–ওহ, ভাল কথা, আপনি কি কখনও সম্পত্তির ইচ্ছাপত্র করেছিলেন?
হ্যাঁ, অপারেশনের আগে আমি একটা ইচ্ছাপত্র করেছিলাম।
অপারেশন?
হ্যাঁ, মিঃ পোয়ারো আমার অ্যাপেনডিক্স অপারেশন হয়েছিল মাসছয়েক আগে। তখন আমার মনে হয়েছিল তার আগে একটা উইল করে যাওয়া উচিত।
পোয়ারো আমার দিকে তাকায়। ওর চোখের ভাষা আমার চেনা। তাই অপ্রিয় প্রশ্নটা আমাকেই করতে হল।
মিস বার্কলি যদি কিছু মনে না করেন, সেই উইলের ব্যবস্থাটা কিরকম ছিল?
নিক একটা শ্বাস নেয়। একটু ভেবে নিয়ে বলে–এন্ড হাউসটা চার্লসের নামে লিখে দিয়েছিলাম আমি। এছাড়া আর আমার তেমন কিছু সম্পত্তি নেই।
পোয়ারো অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। তারপর নিকের দিকে তাকিয়ে বলে–মাদাম জোয়েল এবার আমরা আসব।
একটু থেমে নিকের দিকে তাকায়–মাদাম একটু সাবধানে থাকবেন।
নিক আশঙ্কিত চোখে তাকায়–কি থেকে?
পোয়ারো উদাস গলায় বলে–সেটা এই মুহূর্তে আমি বলতে পারছি না। আশাকরি দিন কয়েকের মধ্যে আসল সত্যটা আমি আবিষ্কার করতে পারব। আপাতত নিজের বিচার বুদ্ধিকে ব্যবহার করে সতর্ক থাকবেন–কোথায় আপনি নিরাপদ, কোন দিক থেকে বিপদ আসতে পারে।
.
০৪.
কিছু ঘটবে, ঘটবেই
পোয়ারো রাস্তায় এসে দাঁড়ানো মাত্র আমি বললাম-একটা কথা তোমার অতি অবশ্যই জেনে রাখা উচিত।
সেটা কি?
আমি আজ দুপুরে কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গারের মুখ থেকে শোনা নিকের দুর্ঘটনাগুলো বর্ণনা করলাম।
বেশ মনযোগ দিয়ে পোয়ারো কথাগুলো শুনল। তারপর হাসিমুখে বলে–হ্যাঁ, অবশ্যই এরকম কিছু চরিত্র থাকে যারা এধরনের ভয়ঙ্কর গল্প নিজের সম্পর্কে প্রচার করে সবার কাছে, অন্যদের কাছে নিজের গুরুত্ব বাড়াতে চায়।
আমি সরাসরি পোয়ারোর মুখের দিকে তাকাই। ওর মনের ভাব পড়বার চেষ্টা করি।
তোমার কি মনে হয় মিস বার্কলি……
পোয়ারো আমার কথা শেষ করতে দেয় না, বাধা দিয়ে বলে ওঠে–না, না, হেস্টিংস, অবশ্যই নয়–তুমি লক্ষ্য করনি, উনি সত্যি সত্যি চরম বিপদের মধ্যে রয়েছেন সেটা ওনাকে বোঝাতে আমার কেমন ঘাম ছুটে গেল?–যদিও বা বোঝানো গেল, তবু মনে হয় না নিজের বিপদের ব্যাপারটা উনি পুরোপুরি বিশ্বাস করেছেন।
তাহলে? অকারণে কেন শ্যালিঙ্কার আমাকে ওইসব কথাগুলো বলল?
নিছক মিথ্যেবাদী প্রতিপন্ন করতে চাইল কেন? সবচেয়ে যেটা বড় হয়ে আমার চোখে এখন ধরা পড়েছে, কম্যান্ডার শ্যালিঙ্কার দুপুরে গায়ে পড়ে আমার সঙ্গে ভাব জমিয়েছিলেন এই কথাগুলো বলবার জন্যেই। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে টেনে এনেছিলেন ব্যাপারটাকে, কিন্তু কেন? মিস বার্কলিকে মিথ্যেবাদী বানিয়ে ওনার কি লাভ?
পোয়ারোকে কথাগুলো বলতে সেও মৃদু রহস্যময় হাসি হাসল।
তুমি সত্যি খুব ভাল জায়গায় আঙুল ছুঁইয়েছ বন্ধু। কিন্তু সত্যি কথাটা হল আমরা এখনও উত্তরটার দরজায় পা রাখিনি।
কিন্তু পোয়ারো আমি প্রশ্ন করি–তুমি এত তাড়াহুড়ো করে মাদাম জোয়েলের তুত বোনকে ওনার সঙ্গে থাকবার ব্যবস্থা করলে কেন?
পোয়ারো শূন্যে হাত দোলায়, ওর আঙ্গুলগুলোয় ঢেউ তোলে। প্রিয় হেস্টিংস, এক্ষেত্রে আমার যে প্রতিদ্বন্দ্বী তুমি কি বুঝতে পারছ না। আমাদের দু’হাত শক্ত করে বাঁধা। কোনও অপরাধ ঘটে যাওয়ার পর যেটার সমাধান করা এরকুল পোয়ারোর কাছে কোনও সমস্যার ব্যাপার নয়। অপরাধী তো অপরাধের শরীরে তার নাম সই করে যায়। আমি সেটার পাঠোদ্ধার করি মাত্র। কিন্তু এক্ষেত্রে তো কোনও অপরাধ ঘটেই নি, এবং আমরা চাইও না–কোনও অপরাধ ঘটুক। কোনও অপরাধ ঘটবার আগেই তাকে নির্ণয় করা দুর্লভতম কঠিন কাজ।
পোয়ারো একটু থামে–আমাদের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হল মাদাম জোয়েলের নিরাপত্তা। তাই তো? এবং সেটি মোটেও সহজ কাজ নয়। না, একেবারেই সহজ কাজ নয় হেস্টিংস। আমাদের পক্ষে দিন এবং রাত সর্বক্ষণ তার ওপর নজর রাখা সম্ভব নয়। আমরা কোনও পুলিশকেও নজরদারি করতে পাঠাতে পারি না। একজন যুবতীর শোবার ঘরে তো আমরা রাত কাটাতে পারি না।
পোয়ারো থামে, যেন দম নেয়–কিন্তু আমাদের সম্ভাব্য খুনির কাজটাকে আরও কঠিন করে তুলতে আমরা একটা কাজ করতে পারতাম। পোয়ারো থামে, এর বেশি কিছু বলবার দরকারও ছিল না। আমি তখন বেশ খুশি হয়ে উঠলাম এবং নিকের নিরাপত্তা কথা ভেবে নিশ্চিতবোধ করতে লাগলাম, ঠিক তখনই পোয়ারো কথা বলল আবার। এবং একেবারে ভিন্ন গলার স্বরে। আমি চমকিতবোধ করলাম কথাটা শুনে।
কিন্তু হেস্টিংস, আমার যথেষ্ট ভয় করছে।
সবিস্ময়ে আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলি-ভয়?
হ্যাঁ, হেস্টিংস। ভয়! কারণ, লোকটা একেবারে শয়তান ধূর্ত। না হে, আমি একেবারে স্বস্তি পাচ্ছি না বন্ধু।
পোয়ারো, আমি তীক্ষ্ণ গলায় বললাম–তুমি আমাকে বেশ উদ্বিগ্ন করে তুলছ হে বন্ধু।
আমিও তোমার মত উদ্বিগ্ন হেস্টিংস, কেন জানো? স্থানীয় খবরের কাগজটিতে ছোট্ট একটা খবর বের হয়েছে। মাদাম জোয়েলের বাড়িতে বিখ্যাত গোয়েন্দা। এরকুল পোয়ারো ম্যাজিস্টিক হোটেলে উঠেছেন। হেস্টিংস, সবাই আমার নাম জানে আর ওতো ঝানু অপরাধী, সে তো আমার নাম জানবেই। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি আমার উপস্থিতি জানবার পরে তার কি করা উচিত?
অবশ্যই আত্মগোপন করা উচিত। পোয়ারোর আত্মগর্বকে উসকে দিয়ে আমি বলি–অযথা সে বৃথা সময় নষ্ট করবে না। পোয়ারো তদন্ত শুরু করার আগেই আমাকে যা করার করে ফেলতে হবে, ভেবে নিয়ে দ্রুত চরম আঘাত হানতে চাইবে–তাই নয় কি?
একটু থেমে পোয়ারো আবার যোগ করে–আর খবরের কাগজটা যেভাবে ভাঁজ করা ছিল, কেউ সেটা পড়েছিল। আর শুনলে তো হেস্টিংস, মিস বার্কলি বললেন–তিনি আজ খবরের কাগজ পড়েননি। তাহলে? কে পড়েছিল খবরের কাগজটা?
এবার আমিও বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম–তার মানে বাড়িরই কেউ………
নিঃসন্দেহে-হেস্টিংস, নিঃসন্দেহে।
তোমার কাউকে সন্দেহ হয়?
পোয়ারো হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে শূন্যে ছোঁড়ে।
না, এই অপরাধের মোটিভ যাইহোক না কেন–সেটা দ্রষ্টব্য নয়। নিছক খুন করার কারণ কি হতে পারে? পুরানো বন্ধক রাখা এই বাড়ি? সম্পত্তি? হাস্যকর। তাহলে? তাহলে? তাহলে?
কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার? একমাত্র সন্দেহের তালিকায় ওকেই রাখা যায়।
পোয়ারো দৃঢ়ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে–নাহ, আমি জানি কেন তুমি একথা বলছ, তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস-কম্যান্ডারের সঙ্গে এই মামলার কোনও যোগাযোগ নেই। উনি একজন পাক্কা সাহেব।
কিন্তু পোয়ারো উনি মিস বার্কলি সম্পর্কে……..
আমায় শেষ করতে না দিয়েই পোয়ারো হাত তুলে বাধা দেয়। বন্ধু, আমার মনে হচ্ছে, এক্ষেত্রে উনি অন্যের মুখে শোনা কথা সত্যি বলে বিশ্বাস করে তোমার কাছে উগড়ে দিয়েছেন।
অন্যের মুখের কথা? সেটা কার হতে পারে?
পোয়ারো দুই আঙুলে গোঁফের একটা প্রান্তকে মোচড়াতে মোচড়াতে কৌতুকের গলায় বলে–সঠিক বলতে পারব না–হয়তো মিসেস রাইস।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলাম সেই গ্যারাজটিতে, যার কথা মিস বার্কলি উল্লেখ করেছিলেন।
পোয়ারো গ্যারেজ মালিককে নিজের পরিচয় দেয় মিস বার্কলির পরিচিত বলে, সঙ্গে একথাও বলে–মিস বার্কলির পরামর্শেই তিনি সেখান থেকে লঙ ড্রাইভেও যাবার জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করতে এসেছেন। এসব কাজে কথাবার্তা চালাতে চালাতেই, সুচতুরভাবে কখন যেন ঢুকে পড়ে মিস বার্কলির গাড়ির গণ্ডগোলের প্রসঙ্গে।
গ্যারাজ মালিক যা বলল সেটা পুরোটাই যাত্রিক কথাবার্তা, কৌশলগত গাড়ির বিষয়। আমি সেই মোটর যানের নির্মাণ কৌশলের বিষয়ে পুরোপুরিই অন্ধ। পোয়ারো নিজেও এ বিষেয়ে খুব একটা বিজ্ঞ নয়। তবে তারই মধ্যে আমরা যা চাইছিলাম সেটা পেয়ে গেলাম। মোটর মেকানিক ও গ্যারাজ মালিকের কথার ভেতর থেকেই তা বেরিয়ে এল। নিকের গাড়িটা ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ বিগড়িয়েছিলেন এবং খুব সহজেই তা করা সম্ভব।
আমরা যখন রাস্তা ধরে হোটেলের দিকে ফিরছিলাম তখন পোয়ারো মন্তব্য করল–তাহলে, এই ব্যাপার?
একটু থেমে ভুরু কুঁচকে সে আবার বলে–নিক তাহলে ঠিক সন্দেহেই করেছিল।
তাহলে, এখন আমাদের কর্তব্য কি?
একটা টেলিগ্রাম করা। যদি না খুব বেশি দেরি হয়ে গিয়ে থাকে।
টেলিগ্রাম? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি।
হ্যাঁ, টেলিগ্রাম।
আমরা পোষ্ট অফিসে এসে হাজির হলাম। পোয়ারো টেলিগ্রামের বয়ান লিখল, সেটা পাঠিয়েও দিল কাকে, কোথায় কিছুই বলল না। ও হয়তো চেয়েছিল আমি প্রশ্ন করে জানতে চাইব। আমি সযত্নে যে পথ পরিহার করলাম।
সোমবারের আগে মিঃ ভাইসের সাথে কথা বলা যাবে না। কাল তো আবার রবিবার। মুশকিল। পোষ্ট অফিস থেকে ফেরার পথে পোয়ারো মন্তব্য করল।
কিন্তু মিঃ ভাইসের থেকে তোমার জানবার মত এমন কি জরুরি বিষয় আছে?
খুব সহজ। পেশাদারি ভঙ্গিতে আমাকে জেনে নিতে হবে যে আজ দুপুর ১২-৩০ মিনিট নাগাদ তিনি কি নিজের বাড়িতে ছিলেন? পোয়ারো গভীর চিন্তায় ডুবে থাকা অন্যমনস্ক গলায় বলে।যে ক্ষেত্রে গুলিটা উনি নিশ্চিতভাবে ছোড়েননি সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে।
আমি পাদটীকা জুড়ি–আচ্ছা পোয়ারো, ম্যাজেস্টিক হোটেলে নিকের যে তিনজন বন্ধু-বান্ধবী রয়েছেন তাদের অ্যালিবাই যাচাই করে দেখবে না?
সেটা খুব সহজ কাজ নয়। ওদের মধ্যে কেউ একজন কয়েক মিনিটের জন্যে অন্যদের থেকে আলাদা হতেই পারে।
লাউঞ্জ, ধুমপানের ঘর, কাপড় ধোবার ঘর, নিচের বসবার ঘর, বাহানা অনেক হতে পারে। তারপর বাগানে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করা, মেয়েটা কখন সে জায়গাটা দিয়ে যাবে। সবই ঠিক আছে হেস্টিংস। কিন্তু সেটা আমরা প্রমাণ করব কিভাবে?
হাতের তালুতে সজোরে একটা ঘুষি মারে পোয়ারো, তারপর বলে–ভেবে দেখ হেস্টিংস, আমরা তো মাত্র কয়েকজনের কথা জেনেছি নিকের মুখে। আরও কতজন রয়ে গেছেন, নিক যাদের আদৌ সন্দেহের যোগ্য বিবেচিত না করায় তাদের প্রসঙ্গ তোলেই নি। যেমন লজের ভাড়াটে অচেনা অস্ট্রেলিয়রা। আরও অন্যেরা–যারা নিকের কাছের, ঘনিষ্ট, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন। হেস্টিংস–আমার বোধ, অনুভূতি বলছে কিছু একটা আছে। নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে, যা এখনও আলোয় আসেনি।
পোয়ারো হাসে, গভীর একটা শ্বাস ছাড়ে।
পোয়ারো তুমি বলতে চাইছে, নিক আমাদের কাছে কিছু একটা আড়াল করছে?
আমার কথায় পোয়ারো সজোরে মাথা নাড়ে।
না, ঠিক তা নয়। আসলে তিনি হয়তো কথাগুলো বলার প্রয়োজনই মনে করেননি। কারণ–তিনি ভেবেছেন এই মামলার সঙ্গে ওইসব কথার কোনও রকম সম্পর্ক থাকতে পারে না। আর আমি সেটাই ঠিক কি জানতে চাই। আত্মগর্ব নয়, তবে, খুব গর্বের সঙ্গে বলব–সাধারণ মানুষের থেকে আমার বুদ্ধিটা একটু বেশি। আমি, এরকুল পোয়ারো–সেই যোগাযোগটা দেখতে পেতাম, যেটা উনি পারছেন না। হয়তো সেই দরজাটা খুঁজে পেতাম যেটা এই রহস্যের অন্দরমহলে পৌঁছে দিত আমাকে। পোয়ারোকে এভাবে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হত না।
আমার বিশ্বাস তুমি সেটা খুঁজে পাবে। তার আগেই না খুব বেশি দেরি হয়ে যায়।
৫. মিঃ ও মিসেস ক্রফট
০৫. মিঃ ও মিসেস ক্রফট
সে রাতে হোটেলে নাচের আসর বসেছিল। নিক তার বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে রাতের খাওয়া সারতে এসেছিল। আমাদের দেখে আন্তরিক উষ্ণ ভঙ্গিতে হাত নাড়ল।
কাঁধখোলা বেগুনি রঙের পোষাক পরেছে সে। এক উজ্জ্বল, উচ্ছল মহিলা। আমি পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে মন্তব্য না করে পারি না। পোয়ারো আমার কথায় সমর্থনসূচক মাথা নাড়ে। সঙ্গীদের থেকে একেবারে বৈপরীত্যমূলক উদাহরণ। ফ্রেডেরিকা রাইস পরেছেন সাদা রঙের পোষাক। ওরা সবাই মহা উৎসাহে নাচানাচি করল। বেশ সুন্দরী মহিলা। পোয়ারোর কথায় আমি সোৎসাহে বলি–আমাদের নিক তো?
না হে, আমি অন্য মহিলাটির কথা বলছি।
একটু থেমে পোয়ারো কয়েকমুহূর্ত পর আবার বলে–উনি কি বিষণ্ণ? অসুখী? কেউ জানে না। আমি তোমায় বলতে পারি হেস্টিংস, উনি একটা চলমান রহস্যের খনি।
তুমি কি ঠিক বলতে চাইছ?
পোয়ারো মৃদু হাসে। তারপর এক সময়ে বলে-তুমি নিজেই এক সময় সব বুঝতে পারবে, শুধু আমার কথাটা মাথায় গেঁথে রাখ।
আমাকে অবাক করে দিয়ে পোয়ারো হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়।
নিক আর শ্যালিঙ্গার তখনও নাচছে। ফ্রেডেরিকা এবং লাজারুম নাচ শেষ করে চেয়ারে এসে বসেছে। লাজারুম তারপর উঠে দাঁড়ায় এবং বাইরে বের হয়ে যায়। মিসেস রাইস তখন একা।
পোয়ারো তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আমিও তাকে অনুসরণ করি। ওর পদ্ধতিটাই হচ্ছে সরাসরি এবং মূল লক্ষ্যভিত্তিক।
মাদাম, যদি অনুমতি দেন, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চাই।
মিসেস রাইস আঙুল দিয়ে তার সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বলেন–নিশ্চয়ই। বসুন।
শীতল, অনুত্তেজিত কণ্ঠস্বর।
মাদাম আমি জানি না আপনার প্রিয় বান্ধবী আপনাকে জানিয়েছেন কি না, আজ আবার ওর ওপর একটা প্রাণঘাতি হামলা হয়েছিল।
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ধূসর চোখ দুটোয় আতঙ্ক ভরে উঠল–তার মানে?
মাদাম জোয়েল বার্কলিকে আজ সকালে গুলি করে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভাব পাল্টে যায়। মৃদু হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোণে–নিক বলেছে নিশ্চয়ই আপনাকে।
না মাদাম, আমি নিজের চোখে ঘটনাটা ঘটতে দেখেছি। এই যে বুলেটটা। পোয়ারোর মেলে ধরা হাতের তালুতে বুলেটটা।
বিস্ফারিত চোখে বুলেটটার দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে থাকে ফ্রেডেরিকা, কিন্তু…. কিন্তু…… তার মানে………
মানেটা হচ্ছে খুবই সহজ। ওটা মাদাম জোয়েল বার্কলির কল্পনা নয়। বাস্তবে গত কয়েকদিন ধরেই ওনাকে খুন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে পোয়ারো বলে–আচ্ছা মাদাম, এখানে আসবার আগে আপনি কোথায় ছিলেন?
টাকিস্টকে। বন্ধুদের সঙ্গে।
বেশ, আমি কি আপনার সেই বন্ধুদের নামগুলো জানতে পারি? নিমেষের মধ্যে মহিলার যুগল কুঞ্চিত হয়ে উঠল–সেকথা আপনাকে বলব এরকম কোনও কারণ আছে কি?
না না, সেরকম কিছু নয়। টাকিস্টকে আমারও বেশ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব আছে। তাই জানতে চাইছিলাম আপনি তাদের চেনেন নাকি। যেমন, বুকানন, আমার একজন বন্ধু। চেনেন আপনি?
মিসেস রাইস উদাস ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন–না, আমি চিনি না। আচ্ছা আমরা অবান্তর প্রসঙ্গে সময় কেন নষ্ট করছি? আপনি বরং নিকের কথা বলুন। কে ওকে গুলি করেছে? কেন?
আমি তা জানি না, এখনও কিন্তু নিশ্চিত থাকতে পারেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমি সেটা খুঁজে বের করে ফেলব। আমার নাম এরকুল পোয়ারো। আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ।
অতি বিখ্যাত মানুষ। সে আপনার মহানুভবতা। এবার মিসেস রাইস খুব ধীরে ধীরে কেটে কেটে বললেন-আপনি আমাকে কি করতে বলেন এখন?
সত্যি কথা বলতে কি এবার আমরা দুজনেই যথেষ্ট অবাক হই। আমরা কেউই এমুহূর্তে ওনার মুখ থেকে এধরনের কথা আশা করি না।
আমি আপনাকে অনুরোধ করব আপনার বন্ধুর ওপর একটু নজর রাখতে। পোয়ারো শান্ত গলায় বলল।
ঠিক আছে। সেটাই যথেষ্ট।
পোয়ারো কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ায়।
পোয়ারো আমি একটু দূরে সরে আসবার পর বললাম-তুমি কি আস্তিনের তাসগুলো সরাসরি দেখিয়ে দিলে না?
আবার আমরা আমাদের টেবিলে ফিরে এলাম।
পোয়ারো তার চেয়ারে বসতে বসতে বলল–তাছাড়া আমি আর কি করতে পারতাম। আমার কাছে প্রথম কাজ হল সবার আগে মিস বার্কলির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। আমি কোনও ঝুঁকি নিতে চাই না। তবে একটা কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে।
কি? আমি সোৎসাহে প্রশ্ন করি।
মিসেস রাইস টাকিস্টকে ছিলেন না।
কোথায় ছিলেন তাহলে?
আঃ, এরকুল পোয়ারো ঠিকই সঠিক তথ্য খুঁজে বার করবে।
হান্ডসাম লাজারুম এতক্ষণে ফিরে এসেছেন। মহিলা তাকে সব বলছেন।
আহ–চমৎকার, লোকটা অতীব ধূর্ত হে। আমাদের দিকে সে তাকাচ্ছেই না।
আহ-হা, যদি আমার এখন জানা থাকত।
আমি অবাক গলায় প্রশ্ন করি কি?
সেটা সোমবারই জানতে পারবে।
একটু পরেই নিক ওর নাচের সঙ্গীর থেকে আলাদা হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। আমার উল্টো দিকের চেয়ারটায় আমার মুখোমুখি এসে বসল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল–এ যেন মৃত্যুর কিনারায় দাঁড়িয়ে নেচে চলা।
প্রসঙ্গ বদল করার জন্য পোয়ারো বলে–আপনি খুব সুন্দর নাচেন মাদাম জোয়েল।
লাজুক মুখে পোয়ারোর প্রশংসাটা গ্রহণ করে সে বলে–ধন্যবাদ।
এরপর আরও কিছু কথাবার্তার পর নিক উঠে চলে যায়।
কথাটা আমার মোটেই ভাল লাগল না। নিকের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে আমি পোয়ারোকে উদ্দেশ্য করে বলি–কিন্তু কথাটা সত্যের খুব কাছাকাছি। সেটা মানতেই হবে। আর গোটা ব্যাপারটা মেয়েটা যে খুব সাহসভাবে গ্রহণ করেছে সেটাও মানতেই হবে। পোয়ারো দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলে।
পরের দিন ছিল রবিবার। আমরা হোটেলের টেরেসে বসেছিলাম। সাড়ে এগারোটা। হঠাৎ পোয়ারো উঠে দাঁড়ায়। চল হেস্টিংস, আমরা এক্ষুনি একটা পরীক্ষা করব।
কি?
মাদাম ও তার দুই বন্ধু গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। রাস্তা পরিষ্কার। চল, চল উঠে পড়।
আমি অবাক গলায় বলি–কিসের রাস্তা……..
পোয়ারো আমার জামা ধরে টানে–গেলেই দেখতে পাবে। কথা বলে সময় নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই।
আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। ঘাস বিছানো সরু পথটা একেবারে সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে। সেখানে এখন কয়েকজন স্নানার্থী দেখা যাচ্ছে। আমরা সরু পথটা ধরে এবার ডাইনে মোড় নিলাম। কিছুটা হাঁটবার পরই আমরা সেই লোহার মরচে ধরা দরজাটার সামনে এসে পড়লাম যার মাথার ওপর লেখা আছে এন্ড হাউস, (ব্যক্তিগত সম্পত্তি)।
পোয়ারো সতর্ক চোখে চারপাশে তাকিয়ে দেখে। না, ধারে কাছে কেউই নেই। আমরা নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম। অবশেষে বাগান পেরিয়ে আমরা এসে দাঁড়ালাম ভোলা ফ্রেঞ্চ (গরাদহীন) জানালাগুলোর সামনে।
পোয়ারো আবার সতর্ক চোখে চারপাশ দেখে নেয় একবার।
না, আমাদের দেখার মত কেউ নেই এখানে। অনায়াসে জানালা টপকে আমরা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ি। সোজা এসে হাজির হলাম বাইরের বসার ঘরে। সময় নষ্ট না করে পোয়ারো ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। আমিও এর পিছু নিলাম। পোয়ারো সোজা নিকের ঘরে ঢুকে পড়ল এবং নিকের বিছানার উপর বসে পড়ল। আমাকেও ইশারায় বসতে বলল।
দেখলে তো, কিরকম সহজ কাজ? কেউ বাধা দেওয়া দূরে থাক, কেউ টের পর্যন্ত পেল না। আমরা এখন নিরাপদে যা খুশি করতে পারি। পোয়ারো চাপা গলায় বলল।
পোয়ারো তুমি বলছ যে কোনও অচেনা মানুষ ঘটনাগুলোর পেছনে আছে, সেই তত্ত্বটাকে বাদ দিতে চাইছ?
অবশ্যই হেস্টিংস, অবশ্যই। কোনও পাগল বা অচেনা ব্যক্তির কাজ এটা মোটেই নয়। এখানে কাজগুলো যে করছে সে অবশ্যই নিকের ঘনিষ্ট বৃত্তের মানুষ।
আমরা সিঁড়ি বেয়ে আবার নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম, আর তখনই থমকে গেলাম।
যাকে দেখে আমরা থমকে গেলাম সেও আমাদের দেখে প্রথমটায় থতমত খেয়ে যায়, চড়া গলায় প্রশ্ন করে–কে আপনারা? এখানে কি করছেন?
আহ-হ, পোয়ারো হাসিমুখে বলে–আপনি মসিয় ক্রফট, তাই তো?
হ্যাঁ, কিন্তু এখানে আপনারা…….
পোয়ারো বিনীত ভঙ্গিতে বলে, নিচে গিয়ে বসে কথা বলা যায় না?
বেশ। আমরা দুজন ভদ্রলোকের পেছন আবার একতলায় নেমে এলাম।
আমি এরকুল পোয়ারো।
লোকটির মুখের কালো মেঘ এবার দ্রুত পরিষ্কার হয়ে যায়।
ওহ, আপনিই সেই বিখ্যাত গোয়েন্দা।
এবার পোয়ারো আমারও পরিচয় করিয়ে দেয়।
আমি এবং পোয়ারো দু’জনে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ভদ্রতাসূচক হাসি।
কিন্তু আপনি এখানে কেন? কোনও গণ্ডগোল ঘটেছে নাকি?
পোয়ারো গম্ভীর গলায় বলে-গণ্ডগোল? সেটা নির্ভর করে ঘটনাকে আপনি কোন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখবেন।
অস্ট্রেলীয় ভদ্রলোক টাক মাথা সত্ত্বেও বেশ সুপুরুষ। তার চেহারার গড়ন, মুখশ্রী বেশ আকর্ষক। সবচেয়ে বেশি যেটা নজর কাড়ে-ওর লাল চোখের তীক্ষ্ণ, হৃদয়ভেদী দৃষ্টিকা।
আসলে আমি বাগানের টমেটো আর নারকেল দিতে এসেছিলাম মিস বার্কলিকে। মাঝে মাঝেই এভাবে জানালা টপকে এ বাড়িতে ঢুকি আমি। ফলের ঝুড়িটা নামিয়ে রেখে ফিরে যাবার সময়ে ওপরের ঘরে পায়ের শব্দ এবং পুরুষের আওয়াজ পাই। যেহেতু এখানে চোর বা ডাকাতের উৎপাত নেই, তাই আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম। দেখতে আসছিলাম ব্যাপারটা কি।
একটু থেমে মিঃ ক্রফট আবার বললেন–কিন্তু আপনি এখানে কেন? ব্যাপারটা কি?
খুব সামান্য ব্যাপার। মাদাম বার্কলির শোবার ঘরের একটা ভারি তৈলচিত্র তারের বাঁধন ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিল, উনি আপনাকে নিশ্চয়ই বলেছেন?
হ্যাঁ, ভাগ্যের জোরে উনি খুব বেঁচে গেছেন।
আমি মাদামকে কথা দিয়েছিলাম যে ছবিটা আটকাবার জন্যে একটা মোটা শিকল এনে দেব। হাতে এরকম বিপত্তি আর না ঘটে। মাদাম আমায় বলেছিলেন, আজ সকালে তিনি বন্ধুদের নিয়ে বেরোবেন। আমি এসেছিলাম কতটা শেকল ঠিক লাগবে প্রয়োজন যতটুকু সেই মাপটা নিতে। বালক সুলভ সরল মুখে পোয়ারো বলে।
ওহ, তাহলে এই ব্যাপার।ক্রফট একটা গভীর শ্বাস ছাড়ে। আবার পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে চকচকে চোখে বলে–আমার সৌভাগ্য যে বিখ্যাত এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে আমার আলাপ হল। মিঃ পোয়ারো, আপনি কি এখন ব্যস্ত? যদি তা না হয় তাহলে আমার বাড়িতে এক কাপ চা খেয়ে যেতে অনুরোধ করব।
নিশ্চয়ই। আমার হাতে এখন সেরকম কোনও কাজ নেই।
বাহ, চমৎকার, পোয়ারো আমার দিকে তাকায়–তুমি মাপ ঠিকমত নিয়েছ তো হেস্টিংস? আমি পোয়ারোকে আশ্বস্থ করার ভান করি।
ক্রফট মানুষটি যে কথা বলতে ভালবাসেন অল্পক্ষণেই বুঝে যাই আমরা। ওর বাড়ি যে মেলবোর্নের কাছে ছোট্ট এক শহরে, ওর প্রথম জীবনের সংগ্রাম–সবই ওই সামান্য আলাপের মধ্যে জমিয়ে দেয়। এমন কি তার স্ত্রীর সঙ্গে তার আলাপ পরিচয় সবিস্তারে জানাতে ভুল করে না। আমরা বরাবরই ভেবেছি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াব, আর এই দেশটাতে বেড়াতে আসা আমাদের সবসময়ই তীব্র ইচ্ছা দিল।ইতালিতে থাকার সময়েই ওর স্ত্রী মারাত্মকভাবে আহত হন ট্রেন দুর্ঘটনায়। মেরুদণ্ডে মারাত্মক আঘাত পেয়ে তিনি প্রায় পঙ্গু। ডাক্তারেরা সবাই একটা কথা বলেছেনবিশ্রাম, সময়ই ধীরে ধীরে সারিয়ে তুলবে চোটটা। কথা বলতে বলতেই আমরা ক্রফটের বাড়ি এসে পৌঁছলাম। বাড়িতে পা দিয়েই মিঃ ক্রফট উচ্চস্বরে ডাক দিলেন–কোয়ি, কোয়ি, দেখ কারা এসেছেন। তারপর আমাদের দিকে ফিরে বললেন-ভেতরে আসুন।
আমরা বাড়ির ভেতর ঢুকে এলাম। মিঃ ক্রফট আমাদের নিয়ে সোজা ওর শোবার ঘরে এসে হাজির হলেন। সোফা, বিছানা, আলমারি দিয়ে সাজানো সুন্দর একটা ঘর। রোগা ফ্যাকাশে চেহারার মাঝবয়সী এক মহিলা বিছানায় শুয়েছিলেন। মিঃ ক্রফট আমাদের সাথে ওর আলাপ করিয়ে দিলেন। পোয়ারোর নাম শুনে মহিলার দু’চোখ খুশিতে ঝিলিক মেরে উঠল। দেখা গেল তিনি পোয়ারোর কীর্তিগুলোর প্রায় সব খবরই রাখেন। পোয়ারো (এবং আমিও) সসম্ভ্রমে তাঁর সঙ্গে করমর্দন করলাম। মিসেস ক্রফট পোয়ারোর সঙ্গে তার কয়েকটা পূর্বতন সমাধান হওয়া মামলার বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। এমন কি তিনি এও জানালেন পোয়ারো যে গোয়েন্দাগিরি থেকে অবসর নিয়েছেন কাগজ পড়ে সেটাও জানেন। মিসেস ক্রফটের সঙ্গে কথায় কথায় এসে পড়ল নিকের প্রসঙ্গ। মিসেস মিলি ক্রফট দেখা গেল আমাদের বন্ধুর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত। মেয়েটি সত্যিই প্রাণবন্ত। আমাদের বাড়িতে যখন আসে যেন আনন্দে মাতিয়ে দিয়ে যায়। দুর্ভাগ্য নিক এখানে বেশিদিন এসে থাকে না। হয়তো ও সেটা করত যদি না ওর সব বিষয়ে নাক গলানো ওই তুতো ভাইটি তাতে সবসময় বাগড়া দিত। নিকের ইচ্ছে মত কোনও কাজ ও করতে দেয় না। ক্রমে মিলি ক্রফটের কথায় একটা আদল যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। শেষপর্যন্ত পোয়ারো প্রশ্নটা না করে থাকতে পারল না।
মাদাম, আহ-হ, তাহলে এম. চার্লস ভ্যাইস আমাদের সুন্দরী বন্ধুটিকে ভালবাসেন? বার্ট ক্রফট মৃদু আপত্তির গলায় বলেন–কি দরকার মিলি ওসব পরচর্চায়? তাতে অবশ্য কান দিলেন না মিলি।
আহ, আমাদের নিক এত বোকা নয়। একটা সামান্য উকিল। চালচুলো নেই। কোন দুঃখে ওকে বিয়ে করতে যাবে বলন তো? আমার মনে হয় কি ওই নাবিক ভদ্রলোক, শ্যালিঙ্গারকেই শেষপর্যন্ত বিয়ে করবে। আমি তাহলে খুশি হব। যদিও, ভদ্রলোকের বয়স নিকের তুলনায় একটু বেশি। আর নিকের বান্ধবী, রাইস। ওকেও আমার বেশ ভাললাগে। যদিও, সম্প্রতি ওকে খুবই দুঃখী দেখায়। বিষণ্ণ দেখায়। তবে মেয়েটার প্রতি আমার বিশেষ রকম আগ্রহ হবার কারণ আছে। তাই না বার্ট? আচমকাই মিঃ ক্রফট উঠে দাঁড়ালেন-ওসব কথা এখন থাকুক। মিলি ওসবে জড়াবার দরকার নেই। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে তারপর তিনি বলেন–আপনি কি অস্ট্রেলিয়ার নানা রকম সুন্দর সুন্দর ছবি দেখা পছন্দ করবেন? পোয়ারো এক কথায় রাজি হয়ে গেল।
এর মিনিটদশ পর আমরা ক্রফটের থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম। খুবই ভাল মানুষ। আমি রাস্তায় বের হয়ে বললাম। হুস, তোমার ওদের খুব পছন্দ হয়েছে তাই না।
পোয়ারোর কথায় আমি অবাক ভঙ্গিতে বললাম, কেন? তোমার পছন্দ হয়নি? পোয়ারো গভীর চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। শুধু কয়েকটা খটকা………
খটকা? আমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলি–পোয়ারো দিনে দিনেই তুমি সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ হয়ে উঠছ।
তুমি কি বলছ হেস্টিংস। একেবারে ঠিক। আমি সবাইকে সন্দেহ করি হেস্টিংস। সব কিছুকে সন্দেহ করি।
.
০৬.
মিঃ ভাইস
সোমবার, সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই দেখলাম, পোয়ারো একটা সুন্দর ড্রেসিং গাউন পরে বিছানায় বসে আছে।
হেস্টিংস। তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ সেরে নিয়ে তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।
বেশ খানিকটা বিস্ময় নিয়ে আমি বলি–কি কাজ?
আমি একটা ছোট্ট চিরকুট লিখে রেখেছি। সেটা মাদাম জোয়েলের হাতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। আমি তৈরি হয়ে এসে যখন পোয়ারোর হাত থেকে চিরকুট নিতে যাব, ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে–হেস্টিংস, প্রিয় হেস্টিংস, কতদিন ধরে বলছি চেহারাটায় একটু গোয়েন্দাসুলভ গাম্ভীর্য যোগ কর। চুলের সিঁথিটা মাঝখান দিয়ে কর। একটুকরো দাড়ি রাখ থুতনিতে। আমার মত। একটু গোয়েন্দা সুলভ বানাও তোমার মধ্যবিত্ত চেহারাটাকে। আমার কথায় তো তুমি কান দেবার প্রয়োজনই মনে করও না। আমি গম্ভীর মুখে চিরকুটটা পোয়ারোর হাত থেকে নিলাম।
মিস বার্কলি এক তলায় বসবার ঘরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন। অন্য দিনের তুলনায় আজ তার চোখের কালি কিছুটা গাঢ় মনে হল। আমি পোয়ারোর চিরকুটটা তার হাতে তুলে দিলাম।
সকাল ১০টা নাগাদ মিস বার্কলি আমাদের হোটেলে এলেন। ওনার হাতে একটা টেলিগ্রাম। সেটা পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দেন-আশাকরি আপনি সন্তুষ্ট হবেন।
পোয়ারো টেলিগ্রামটা পড়ে। আমিও। পৌঁছচ্ছি। আজ ৫.৩০ বিকেলে। ম্যাগি। কিন্তু আপনি ভুল করছেন। ম্যাগির মস্তিষ্ক বলে কোনও বস্তুই নেই। কাজকর্মে খুব পটু ঠিকই। কিন্তু কোনও গুপ্তঘাতককে চিহ্নিত করতে পারবে, আমায় রক্ষা করবে, এটা ম্যাগির কাছে খুবই বেশি রকম দাবি করা হচ্ছে।
পোয়ারো উদাস ভঙ্গিতে বলে–আর কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার?
জর্জ?
এবার তীব্র বিদ্রূপ ভেসে ওঠে নিকের গলায়–জর্জ ওর নাকের ডগায় কিছু বসে থাকলেও তাকে দেখতে পায় না।
মিস বার্কলি এবার টুপিটাকে খুলে সোফার ওপরে ছুঁড়ে ফেলেন, আপনি যাকে ঢুকতে দেবার কথা চিরকুটে লিখেছেন, আমি বাড়িতে বলে এসেছি তাকে বিনা দ্বিধায় যেন ঢুকতে দেওয়া হয়। ব্যাপারটা কিন্তু বেশ রহস্যময় লাগছে আমার কাছে। আপনি কি গোপন মাইক্রোফোন জাতীয় কিছু বসাতে চাইছেন?
না, না, মাদাম, অত প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কোন ব্যাপার নয়। আমি খুব সামান্য একটা ব্যাপার শুধু জানতে চাই–ব্যাপারটা, বেশ মজার আর উত্তেজক।
হ্যাঁ, নিশ্চিতভাবে। মিস বার্কলি উদাস ভঙ্গিতে বলে। আমাদের দিকে পিঠ করে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর যখন সে ঘুরে দাঁড়ায়, ওর মুখের বেপরোয়া ভাবটা সম্পূর্ণ উবে গেছে। অনেক কষ্টে চোখের জল ধরে রেখেছিল।
না, তা না। নিশ্চিতভাবেই নয়। আমার ভয় করছে। ভীষণ রকম ভয় করেছে। ওর মুখে এখন এক শিশুসুলভ অসহায়তা।
না, না, মাদাম, আপনি ভয় পাবার মতো মেয়েই নন। আমি এবং হেস্টিংস দুজনেই জানি সেটা।
না, এটা সাহস নয়। নিক সজোরে তার মাথা নাড়ে-বলতে পারেন এটা এক ধরনের শ্বাসরোধ অপেক্ষা কখন সেই অনিবার্যতাই ঘটবে তার প্রতীক্ষা করা এবং কিভাবে সেটা ঘটবে?
এটা পরিস্থিতির চাপ মাদাম। এসব নিয়ে অকারণ উত্তেজিত না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
ছোট্ট চেয়ারটায় প্রায় ঢুকে বসেছিল নিক। ওর সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট হাতের আঙুলগুলো প্রবলতর নার্ভাসভাবে উদ্দেশ্যহীন নড়ে বেড়াচ্ছিল। পোয়ারো কয়েক পলক ঠান্ডা চোখ ওর সেই অস্থিরতা লক্ষ্য করে। তারপর শান্ত গলায় বলে–মাদাম, আমার মনে হয় আপনি কিছু বলতে চাইছেন। দয়া করে আমাকে সব কথা খুলে বলুন।
না, তেমন কিছু নয়, সেরকম কিছু নেই।
পোয়ারো নিরুত্তেজক শান্ত গলায় বলে-আপনি আমাকে কিছু একটা বলেননি। তাই না?
নিক সন্ত্রস্থ চোখে তাকায়। আমি আপনাকে ছোটখাট সব ব্যাপারটাই বলেছি।
দুর্ঘটনাগুলো, আপনার ওপর হামলার ব্যাপারে নিশ্চয়ই বলেছেন।
নিক বিভ্রান্ত চোখে তাকায়।
কিন্তু আপনি আমায় আপনার হৃদয়ের-মনের সব কথা বলেননি। আপনার জীবনের সবকিছু………
সেক্ষেত্রে কেউ তাহলে এটা করতে পারে?
আহ আপনি তাহলে সেকথা মেনে নিচ্ছেন? পোয়ারো সোৎসাহে বলে।
মেয়েটি সম্মতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। পোয়ারো খুব গভীর মনযোগের সঙ্গে ওর অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করার পর বলে-হয়তো তাই।
তাহলে? আমাকে বলবার মত আপনার কোনও কথা আছে–গোপন কিছু?
আমি খুঁটিয়ে ওকে লক্ষ্য করছিলাম। এক পলকের জন্য ওর চোখের পাতায় বিদ্যুতের ঝলক খেলে যেতে লক্ষ্য করলাম। তারপর দ্রুতই আবার স্বাভাবিকতায় ফিরে এল নিক।
বিশ্বাস করুন, সত্যি সত্যি আমি আপনাকে সব কিছুই বলেছি–এই স্টুপিড় বিজনেসের সঙ্গে যা জড়িত। যদি আপনার মনে হয় আমি অন্য কারও বিষয়ে অন্য আরও কিছু জানি, তাহলে ভুল করছেন আপনি। আমার মনে কোন সন্দেহ নেই যা আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি বোকা নই। আমি অবশ্যই বুঝতে পারছি, ওই দুর্ঘটনাগুলোর কোনটাই আসলে দুর্ঘটনা নয়। সেগুলো কারও দ্বারা ঘটানো হত্যার চেষ্টা এবং সেটা আমারই ঘনিষ্ঠতম কারও দ্বারা ঘটানো। আর সেটাই আমাকে কাঁটার মত বিধছে। কারণ আমার সামান্যতম ধারণাও নেই এটা কে হতে পারে অন্তত কে হওয়া সম্ভব, সেই ধারণাটুকুও নেই আমার।
মেয়েটি আবার একবার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে একভাবে। পোয়ারো ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ইঙ্গিত করে আমাকে চুপ করে থাকতে বলে। আমার মনে হয় ও আশা করছে কিছু একটা প্রতিক্রিয়া ঘটবে মেয়েটির মধ্যে। মেয়েটির আত্মনিয়ন্ত্রণ এবার হয়তো ভেঙে যাবে এবং সে এবার সত্যি কথা বলবে। কিন্তু তখনকার স্বর ও কথার ভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। যেন দূর থেকে স্বপ্নজড়ানো কোনও কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।
আপনি জানেন, সবসময় চিরদিন আমি কি ভাবতাম? এন্ড হাউসকে খুব ভালবাসতাম আমি। সেখানকার পারিপার্শ্বিকে আমি একটা নাটক করব ভেবে এসেছি চিরদিন। নানারকম বিষয়ও ভাবতাম। অবশেষে, যেখানে সত্যিই এক নাটক ঘটছে, যা নাকি আমি পরিচালনা করছি না। যদিও সেই নাটকের মুখ্য চরিত্রে আমি। অথচ প্রথম অঙ্কেই আমার মৃত্যু লেখা রয়েছে। বলতে বলতে ওর গলা ভেঙে যায়।
না, না, মাদাম জোয়েল…….. পোয়ারো ব্যস্ত গলায় বলে–এভাবে বলবেন না। এটা এক ধরনের হিস্টিরিয়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নিমেষে, চকিতে ঘুরে ধারাল চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায় সে–ফ্রেডি নিশ্চয়ই আপনাকে বলেছে, আমি হিস্টিরিয়াগ্রস্থ? তীক্ষ্ণ চোখে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে গলায় কাঠিন্য এনে বলে, ফ্রেডি যা বলে সবসময় তা সত্যি বলে বিশ্বাস করে নেবার কোনও কারণ নেই।
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর পোয়ারো যে প্রশ্নটা করে সেটা সম্পূর্ণই অপ্রাসঙ্গিক। আমাকে একটা কথা বলুন তো মাদাম, আপনি কি কখনও এন্ড হাউস বিক্রি করার প্রস্তাব পেয়েছিলেন?
না।
আপনি যদি ভাল দাম পান, বাড়িটা কি বিক্রি করে দেবার চিন্তাভাবনা করেছেন?
কয়েকমুহূর্ত নীরবতা……… তারপর নিক আবার কথা বলে-না, কখনও না। অবশ্য প্রস্তাবটা যদি অবিশ্বাস্য রকমের আকর্ষণীয় হয়, সেক্ষেত্রে বিক্রি না করাটা তো চরম বোকামি হবে, তাই না?
যদিও, আমি এই বাড়িটাকে এত ভালবাসি সেহেতু এটাকে বিক্রি করার কথা ভাবিই না।
আমি বুঝতে পারছি। নিক দরজার দিকে এগোতে থাকে–আজ রাতে বাজি পোড়ানোর উৎসব হবে। আপনারাও আসুন না। তারপর আমাদের সঙ্গেই ডিনার করবেন।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। এত খুব আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা হবে। পোয়ারো এক কথায় রাজি হয়ে যায়। সামান্য হেসে নিক ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
পোয়ারো এবার ওর টুপির দিকে হাত বাড়ায়। আয়নায় নিজেকে দেখে ঠিকঠাক মত টুপিটাকে মাথায় বসায়। কোটের ওপর হাত বুলিয়ে সেটা যথাযথ নিভাজ আছে কিনা পরীক্ষা করে নেয়।
আমি কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করি–কি ব্যাপার হে? আমরা কি কোথাও বের হচ্ছি?
অবশ্যই।
কোথায়?
কিছু আইনগত ব্যাপার………
আমি মাথা নাড়ি–ওহ, তাই তো, বুঝেছি।
মেসার্স ভ্যাইস, ট্রেভরনিয়ন অ্যান্ড উইনার্ডের অফিসটা শহরের প্রধান রাস্তায় অবস্থিত। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে আমরা অফিসে প্রবেশ করলাম। তিনজন কেরানি সেই ঘরে কাজ ছিল। পোয়ারো তাদের একজনকে বলল যে মিঃ চার্লস ভ্যাইস-এর সঙ্গে দেখা করতে চায়। কেরানিটি পাশের একটা ফোন তুলে নিয়ে দু-চারটে কথা বলল, তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল-আমার সঙ্গে আসুন। তিনি আমাদের একটা দরজা পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। তারপর দরজাটা বাইরে থেকে টেনে খুলে এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে আমাদের ঢোকবার পথ করে দিলেন।
আমি সত্যিই আপনাকে ধন্যবাদ দেবার, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আমার মত এক বিদেশী আপনার পরামর্শ এবং মূল্যবান সাহায্য না পেলে সত্যি সমস্যায় পড়ে যেতাম। আইনি জটিলতা সত্যি এক বিরাট সমস্যা আমাদের মত সাধারণ মানুষদের কাছে।
মিঃ চালর্স ভ্যাইস এই সময়েই জানতে চাইলেন তার কাছে আমাদের কে পাঠিয়েছেন?
মিস বার্কলি, পোয়ারো সময় নষ্ট না করে উত্তর দেয়–তিনি আপনার সম্পর্কিত তাই না? সামান্য থেমে পোয়ারো আবার যোগ করে–সত্যি, অসাধারণ সুন্দর, চার্মিং মহিলা উনি। উনিই আপনার কথা আমাকে বলেছেন। আমি শনিবার ১২.০০–১২.৩০ নাগাদ আপনার কাছে দেখা করার জন্য এসেছিলাম। কিন্তু শুনলাম আপনি বেরিয়ে গেছেন।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে, শনিবার আমি একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিলাম।
আপনার বোন একা থাকেন। তিনি এতবড় বাড়িতে নিশ্চয়ই নিঃসঙ্গ বোধ করেন?
খুবই স্বাভাবিক।
যদি কিছু মনে না করেন মিঃ ভ্যাইস, একটা কথা জানাবেন? বাড়িটা কি বিক্রি হবার কথা আছে?
আমি তো অন্তত সেরকম কিছু জানি না। পোয়ারো দু’হাতের আঙুলগুলো জড়ো করে কিছু একটা ভাববার ভান করে, তারপর বলে–আসলে, আমি একটা এই ধরনের সম্পতি কেনার খোঁজে রয়েছি। পারিবারিক সম্পত্তি। ভ্যাইস মাথা ঝাঁকায়–আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু ……… একটু থেমে সামান্য চিন্তা করে সে আবার বলে–আমার বোন তার এই পারিবারিক সম্পত্তির ওপর নিবেদিতপ্রাণ।
এর কয়েকমিনিট পর আমরা আবার রাস্তায় নেমে এলাম। তাহলে? প্রিয় বন্ধু, চার্লস ভ্যাইসকে দেখে তোমার কি মনে হল?
খুবই নেতিবাচক চরিত্র। তবে যথেষ্ট কৌতূহলজনক– আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বললাম। সেরকম শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বের মানুষ নয়, বলছো?
পোয়ারো প্রশ্রয়ের গলায় প্রশ্ন করে–না, অবশ্যই নয়। উনি হচ্ছেন সেই ধরনের মধ্যমেধার মানুষ, যার সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের ইচ্ছে হবে না কারও।
হুম। পোয়ারো গম্ভীর গলায় বলে–আমাদের কথপোকথনের মধ্যে তোমার ওনার কোন বিষয় অস্বাভাবিক বা মিথ্যাচার বলে মনে হয় নি? পোয়ারো আবার প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, অবশ্যই। এন্ড হাউস বিক্রির ব্যাপারটা।
একেবারে ঠিক ধরেছ। পোয়ারো সমর্থনের গলায় বলে–তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে-মাদাম জোয়েল বার্কলি-র এন্ড হাউসের ব্যাপারে মনোভাবটা তোমার ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর নিবেদিতপ্রাণ বলে মনে হয়েছে?
না, কখনওই ওনাকে এ বিষয়ে অতখানি অনড় মনে হয়নি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রীমান ভাইটি এভাবে বাড়িয়ে ব্যাপারটাকে বলছেন কেন? এর সহজ ব্যাখ্যা-ব্যাপারটা নিয়ে এদের দু’জনের কেউ একজন মিথ্যা বলছেন। এখন আমাদের যথাসম্ভব দ্রুত জানতে, খুঁজে বের করতে হবে সেটা কে? এবং কেন?
পোয়ারো আবার আমার দিকে কৌতুকের চোখে তাকায়–আরও একটা ব্যাপার তুমি লক্ষ্য করেছ কি হেস্টিংস?
সেটা কি?
শনিবার ১২.০০ টার পর উনি অফিসে হাজির ছিলেন না।
.
০৭.
ট্রাজেডি
সন্ধ্যাবেলা আমরা এন্ড হাউসে হাজির হলাম। নিক আমাদের দেখে বিস্ময়ের গলায় বলে–ওহ আপনারা?
পোয়ারো বিনীত গলায় প্রশ্ন করে-আপনি কি কারও অপেক্ষায় রয়েছেন মাদাম জোয়েল?
নিক একটা ড্রাগন-ছাপ সাদা কিমানো পরেছিল। কিছুটা বিরক্ত গলায় ও বলে–আসলে বিকেলের মধ্যে আমার পোষাকটা পৌঁছে দেবার কথা ছিল। সেটা এখনও এল না। কিছুক্ষণ পরই বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। নিক দরজা খুলে দিল। এই যে ম্যাগি তুমি এসে গেছ তাহলে। আলাপ করিয়ে দিই, ইনি হলেন সেই গোয়েন্দা এবং ওই ভদ্রলোক ওনার সহকারী। গোপন ঘাতকের হাত থেকে ওনারাই আমাকে সুরক্ষা দিচ্ছেন। চল, আমরা সবাই বসবার ঘরে গিয়ে বসি। তারপর ওনারাই পুরো ব্যাপারটা তোমাকে বলবেন।
ম্যাগি বার্কলি আমাদের দুজনের সঙ্গে করমর্দন করলেন। আমরা সবাই বাইরের ঘরে এসে বসলাম। প্রথম দর্শনেই মেয়েটির প্রতি আমার একটা বেশ ভাল মনোভাব জন্মাল। মেয়েটির চেহারায় ব্যক্তিত্ব এবং চালচলনে শান্ত ঠান্ডা আত্মবিশ্বাসের ছায়া আছে। এগুলোই আমাকে আকর্ষণ করল সম্ভবত। পুরানো সময়ের চোখে দেখলে নিঃসন্দেহে সুন্দরী বলা যায়। তবে–যদি আধুনিক সংজ্ঞা নিয়ে বিচার করা হয় তবে–না, মোটেই স্মার্ট বলা যাবে না মেয়েটিকে। কোনরকমে সাজসজ্জা, প্রসাধনের চড়া প্রলেপবিহীন একটি সরলতর মুখ। পোষাকও খুবই সাধারণ মানের। একটা কালো সান্ধ্য পোক।
গভীর নীল চোখ তুলে শান্ত গলায় ম্যাগি বলে–নিকের কাছে ঘটনার কথা সব জেনে আমি তো স্তম্ভিত হয়ে গেছি। একটু থেমে সে আবার বলে–সত্যি বলতে কি, ব্যাপারটা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। কেউ কেন নিকের ক্ষতি করতে চাইবে? নিকের মত মেয়ের তো কোনও শত্রু থাকতে পারে না। মেয়েটির গলায় সত্যি সত্যি অবিশ্বাস ঝরে পড়ে। সেই অবিশ্বাস প্রতিফলিত হচ্ছিল পোয়ারোর দিকে মেয়েটির দৃষ্টিতেও স্বাভাবিক হয়তো। ম্যাগি বার্কলির মত সেকেলে ধারনার মেয়েদের কাছে। বিদেশী মানুষেরা সবসময়ই সন্দেহের বস্তু।
আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি মিস বার্কলি, ঘটনাগুলো সবই সত্যি বাস্তব। কোনও ভুল নেই–পোয়ারো শান্ত গলায় বলে। ম্যাগি কোন উত্তর দিল না বটে, কিন্তু ওর মুখের রেখায় অবিশ্বাসের ভাঁজগুলো সামান্যও পরিবর্তন হল না।
পোয়ারো এবার একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে–মিস বার্কলি, আপনি কি স্কটিশ?
আমার মা ছিলেন স্কটল্যান্ডে।
আপনার বোন সত্যিই খুব সাহসের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটাকে সামলাচ্ছেন। উনি আমাদের কথা দিয়েছেন, একদম স্বাভাবিক থাকবেন।
এবার আমি বলি,–সেটাই তো একমাত্র পথ।
তাই নাকি? ম্যাগি তার শান্ত অথচ ধারাল গলায় বলে।
মানে আমি বলতে চাইছি–মনের ভেতর যাই হয়ে চলুক, ঘটুক, বাইরের লোকেদের কাছে সেটা প্রকাশ করে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সবার জন্যেই সেটা অস্বস্তিকর।
আমাদের কথা আরও কিছুটা এগোবার সময় ফ্রেডরিকা রাইস ঘরে ঢুকলেন এবং ওকে অনুসরণ করে একটু পরেই লাজারুমও চলে এল। এরপর নিকও সেজেগুজে এসে হাজির হল। কৃষ্ণকালো একটা হাঁটুঝুল দুর্দান্ত ফ্রক পরেছে সে। কাঁধে জড়িয়েছে চীনা মাল। ভারি চমৎকার দেখাচ্ছিল ওকে।
শুভ সন্ধ্যা এবং স্বাগতম কটেল। সহাস্যে, খুশির ভঙ্গিতে বলল নিক।
আমরা সবাই গ্লাস হাতে নিলাম। নিকের স্বাস্থ্য কামনা করে চুমুক দিলাম। লাজারুম তার হাতের গ্লাসটা উঁচিয়ে ধরল–নিক, চমৎকার শাল। নিশ্চয়ই খুব পুরানো জিনিসটা?
হ্যাঁ, এটা আমার প্রপিতামহের তম্য প্রপিতামহ ওদেশে ভ্রমণ সেরে ফেরার সময়ে নিয়ে এসেছিলেন।
জিনিসটা সত্যি চমৎকার। এরকম জিনিস আজকাল আর পাওয়া যায় না।
জিনিসটা খুবই গরম। যদিও কালো রং আমার একেবারেই পছন্দ নয়।
ঠিকই তো। তোমাকে আগে কখনও কালো রং পরতে দেখিনি। আজ হঠাৎ কেন এটা পরলে?
জানি না। নিক কাঁধ ঝাঁকায়। ব্যাপারটাকে কিছুটা উড়িয়ে দেবার বেপরোয়া ভঙ্গি করে।
কিন্তু আমি ওর দু’ঠোঁটের ভাঁজে, তীক্ষ্ণতর অভিব্যক্তিতে দেখলাম স্পষ্ট বেদনা, হতাশার ছায়া। মানুষ কেন কি করছে সবসময় কি তা বুঝতে পারে? দার্শনিকতা ছুঁয়ে যায় নিকের পরের কথাগুলোতে।
এরপর আমরা রাতের খাবার খেতে গেলাম। লক্ষ্য করলাম একটি পুরুষ চাকরকে এই অনুষ্ঠানের জন্যে ভাড়া করা হয়েছে। লোকটার চেহারাটা আমার কাছে বেশ রহস্যজনক মনে হল। খাবার তেমন আহামরি কিছু নয়। শ্যাম্পেনটি সে তুলনায় বেশ ভাল।
জর্জ এখনও এল না। চিন্তিত স্বরে কথাগুলো বলে আমাদের দিকে তাকায়–কাল রাতে ও প্লাইমাউথ গেছে। আজ সন্ধ্যাতে ফিরে আসবার কথা। যে কোনও সময় সে চলে আসবে। নাচ শুরু হবার আগেই সে এসে পড়বে আশা করা যায়।
ঠিক সেসময় জানালার বাইরে একটা টানা, তীক্ষ্ণ গর্জন শোনা গেল। টানা, চাপা গর্জন।
ওহ এই স্পিডবোটগুলো……. জ্বালিয়ে মারল– লাজারুম বিরক্তির গলায় বলে।
ওগুলো স্পিডবোটের শব্দ নয়। সি প্লেন-নিক ওর স্বভাবোচিত শান্ত গলায় বলে।
হ্যাঁ, আমার মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ– লাজারুম জবাব দেয়।
কথার প্রসঙ্গ এবার ধীরে ধীরে ক্রমে সেই দিকে ঘুরে যায়। কথা প্রসঙ্গেই লাজারুম একসময় বলে–মাইকেল স্যাটন যদি তার বিশ্ব পরিক্রমায় সফল হন, তাহলে সত্যি সেটা আমাদের দেশের পক্ষে ও স্যাটনের জন্যে তো অবশ্যই গৌরবজনক ঘটনা হবে। খুবই দুঃখের ব্যাপার যে ওনার সঙ্গে কি কি ঘটেছে তাই এখনও পর্যন্ত জানা গেল না।
আমার মনে হয় উনি এখনও ভাল আছেন, ঠিক আছেন। নিকের কথার জবাবে লাজারুম অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। ভগবান যেন তাই করেন। তোমার কথাই যেন সত্যি হয়।
সবাই ওনাকে পাগল স্যাটন বলে, তাই না?–এবার ফ্রেডরিকা রাইস বলে।
হ্যাঁ, ওদের বংশটাই একটু পাগলাটে। ওর এক কাকা গত সপ্তাহে মারা গেলেন। তিনি কোটিপতি ছিলেন। একটা বার্ড স্যাংচুয়ারি চালাতেন। তারও পাগলাটে বলে দুর্নাম ছিল।
লাজারুমের কথার প্রত্যুত্তরে ফ্রেডরিকা বলে–নারীবিদ্বেষী হিসাবেও উনি যথেষ্ট কুখ্যাত ছিলেন। আমার মনে হয়, তোমরা মিথ্যে ভয় পাচ্ছ, মাইকেল স্যাটন মোটেই মারা যাননি। ওনার কিছু হয়নি।
নিক এবার যেন কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে কথাটা বলে।
তোমার সাথে ওনার পরিচয় ছিল। তাই না?–লাজারুম প্রশ্ন করে।
গত বছর আমার আর ফেড্রির সঙ্গে লা টকিউটয়ে ওনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। চমৎকার মানুষ উনি। তাই না ফ্রেডি?।
নিকের প্রশ্নে মিসেস রাইস কটাক্ষ হানলেন, আমাকে জিজ্ঞাসা কর না প্রিয়তমা। ওনার আগ্রহ তোমার বিষয়েই শুধুমাত্র ছিল। উনি তত একবার তোমাকে বাইরেও নিয়ে গিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, স্কারবরো। অসাধারণ অভিজ্ঞতা-কথা শেষ করে, সবার থেকে অনুমতি নিয়ে নিক উঠে দাঁড়াল নাহ, আর দেরি করার মানে হয় না। আমি ফোনটা করেই আসি। দেখি জর্জের আসতে আর কত দেরি হবে।
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। ন’টা বেজে গেছে। ভেজাট এবং রাম দেওয়া হয়েছে যার যার পছন্দ মত। পোয়ারো লাজারুমের সঙ্গে শিল্প বিষয়ে কথাবার্তা বলতে লাগল। ফ্রেডরিকা রাইস দু’হাতের ওপর থুতনি ভর দিয়ে নিঃশব্দে, স্বাস্নালু ভঙ্গিতে বসে রইলেন। আমি ম্যাগি বার্কলির সঙ্গে নানা বিষয়ে গল্পগুজব করতে লাগলাম। এভাবে কেটে গেল বেশ কয়েকমিনিট। নটা বেজে কুড়ি মিনিট নাগাদ দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে নিক বার্কলি।
সবাই এবার বাইরে এস।
সবাই বাধ্য অনুগতভাবে উঠে দাঁড়াই। ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন অতিথি এসে হাজির হয়েছেন। সব মিলিয়ে বারো জনের মত। নিক খুবই ভাল গৃহকর্ত্রী দেখা গেল। সবাইকে একই রকম উষ্ণতার সঙ্গে স্বাগত জানাল। অতিথিরা প্রায় কেউই তেমন আগ্রহী হবার মত নয়। তবে অতিথিরা একজন ছিলেন চার্লস ভ্যাইস।
আমরা সবাই বাইরে এসে দাঁড়ালাম। দূরে সমুদ্র ও বন্দর আবছাভাবে দেখা যাচ্ছিল। উপভোগ্য-এর মনোরম দৃশ্য। যেন একটা হীরের নেকলেশ, মনে হচ্ছে দূর থেকে বিদ্যুতের আলোয় সজ্জিত সেই জায়গাটাকে। বয়স্কদের জন্যে বাগানে কয়েকটা চেয়ারও পাতা রয়েছে। এবার বাজি পোড়ানো শুরু হল। প্রথমটা একটা রঙিন হাউস। নানা রঙের আগুনের তারা ছড়াতে ছড়াতে আকাশমুখী হয়ে ছুটতে ছুটতে একসময় সে বিস্ফোরিত হল।
রাতটা ছিল ঘন অন্ধকারে ঘেরা। নতুন চাঁদ দেখা দিতে আরও তিন দিন বাকি এবং এক আপাদমস্তক গ্রীষ্মরাতের আদর্শ উদাহরণ আজকের রাতটা। খুবই শীতলতম রাত। সমুদ্রের ঝড়ো হিমেল হাওয়ায় আমার পাশে দাঁড়ানো ম্যাগি বার্কলি কঁপছিল। একটা কোট গায়ে চড়িয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। এই সময় ফ্রেডরিকাও বলে উঠলেন–ম্যাগি, আমার ঘর থেকে আমার একটা কোট নিয়ে এস না।
ও শুনতে পাবে না। দাঁড়াও, আমি এনে দিচ্ছি।
নিক বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। আমার নিজের জন্যও দরকার গরম জামার। এই শালে এত ঠান্ডা মানছে না–হালকা গলায় বলে সে। ঠিক সেই মুহূর্তে তীক্ষ্ণ শিষ দিয়ে সমুদ্রের বুক থেকে একটা ঝোড়ো হাওয়া উঠে এল। বাজি পুড়েই চলেছে। চোখ ভরিয়ে দেবার মত দৃশ্য। দেখতে দেখতে আমি আমার পাশেই দাঁড়ানো এক বয়ষ্ক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে গল্প শুরু করে দিয়েছিলাম।
বুম বুম বুম আকাশে একের পর এক বাজি বিস্ফোরিত হয়েই চলেছে এবং তারপর কোনটা সোনালি রাশি হয়ে ঝরে পড়ছে, কোনটা থেকে নীল হাউস আরও উপরের দিকে ছুটে যাচ্ছে। আবার কোনটা সবুজ বলের সারি হয়ে হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম এসব।
পোয়ারো এতক্ষণ কোথায় যেন উঠে গিয়েছিল। এবার আবির্ভাব ঘটল তার। আমার কানের কাছে মুখটা এনে বলল–বড্ড, একঘেঁয়ে ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত। আমি সবিস্ময়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। পায়ের তলায় মাটিটা পর্যন্ত সাতাত করছে। শীতে পা’দুটো অবশ হয়ে যাচ্ছে।
আমার বিস্ময় উত্তোরোত্তর বেড়ে চলে–শীত? এমন চমৎকার রাতে তোমার শীত লাগছে?
চমৎকার রাত? পোয়ারো গোঁফে হাত বুলোত বুলোতে বলে–হ্যাঁ, তা তুমি বলতে পারও বটে। যতক্ষণ না তোমার চাঁদিতে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে, তুমি কি বুঝতে পারও যে সত্যি বৃষ্টি পড়ছে? এখানেও যদি একটা থার্মোমিটার থাকত তুমি বুঝতে পারতে আমি কতটা সত্যি বলছি।
আমি প্রখর চোখে এবার পোয়ারোর দিকে তাকাই। তোমার মতলবটা কি বলত? আসল কথাটা এবার বল দেখি।
পোয়ারো এবার পরম মমতায় আমার কাঁধে হাত রাখে। প্রিয় বন্ধুবর, আমি বলতে চাইছি তুমি একটা গ্রীষ্মপ্রধান দেশ থেকে এসেছ। এদেশের শীত নিয়ে তোমার এভাবে ছেলেখেলা করা উচিত নয়।
আমি এবার মুচকি হেসে (কম দিন ওর সঙ্গে তো নেই। ওর ইশারা কোন দিকে চলেছে বুঝতে এখন আর দেরি হয় না, অসুবিধা হয় না) বলি–ঠিক আছে। আমার মত পা তুলে হাঁটতে হাঁটতে (মাটির ভিজে ভাব থেকে পা বাঁচানোর নাটক) আসতে থাকে সে।
আমরা বাড়ির একশো গজের মধ্যে চলে এসেছিলাম। বুঝলে হেস্টিংস, আমাদের সবারই হৃদয়ের মধ্যে একটা শিশু লুকিয়ে আছে।
আমি আচমকা পোয়ারোর হাতটাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। পোয়ারোর হাত আঁকড়ে ধরে মৃদু টান মারলাম। পোয়ারো মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি আঙুল দেখালাম। আমার অঙ্গুলি নির্দেশ লক্ষ্য করে পোয়ারো তাকায় সেদিকে। আমাদের সামনেই….. আমাদের আর ফ্রেঞ্চ উইন্ডোটার মাঝখানে…… আবছা একটা শরীর। কালো চীনা শাল জড়ান।
মন দেউই ডাই, স্পেনিশ ভাষায় পোয়ারো ফিস ফিস করে বলে ওঠে–হে ভগবান।
.
০৮.
ভয়ঙ্কর শাল
বোধহয় খুব বেশি হলে ৪০ সেকেন্ডের মত থমকে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। আতঙ্কহত। স্থানুবৎ। কিন্তু আমাদের কাছে সেটুকু সময়ই যেন দীর্ঘ এক যুগ মনে হল। তারপর, প্রায় যন্ত্রচালিতের মত পোয়ারো সেদিকে এগিয়ে গেল। শেষপর্যন্ত, ব্যাপারটা ঘটল।
পোয়ারো বলল, ওর স্বরে ঝরে পড়া রাগমেশানো তিক্ত হতাশার পরিমাপ করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
আহ-হ, সবকিছু সত্ত্বেও, আমার সবরকম সতর্কতা সত্ত্বেও, ব্যাপারটা ঘটলই, সখেদে বলে পোয়ারো।
আমি একজন উৎকৃষ্ট অপরাধী। আমি কেন ওকে আরও ভাল ভাবে পাহারা দিলাম না? আমার এক মুহূর্তের জন্যেও ওর পাশ থেকে সরে যাওয়া উচিত হয়নি।
তোমার নিজেকে এভাবে দোষী ভাববার কারণ নেই। আমি বলতে চাইলাম। কিন্তু আমার জিভে মুখের ওপরের অংশে আটকে গেল। শুকনো জিভ, গলা দিয়ে একরাশ ঘড়ঘড়ে শব্দ ছাড়া আর কিছু বের হল না।
পোয়ারো প্রত্যুত্তরে সখেদে, প্রবল তিক্ততাময় দুঃখিত ভঙ্গিতে আরও একবার সজোরে মাথা নাড়ল।
মৃতদেহের পাশে বসে পড়ে সে। আর তখনি আমাদের মধ্যে দ্বিতীয় ঝটকাটা এসে হাজির হল। বাড়ির ভেতর থেকে নিক বার্কলির গলা ভেসে এল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, ঘরের আলোকিত দরজায় আবছা ছায়া দেখা গেল।
ওহ, দুঃখিত ম্যাগি, আমি বোধহয় একটু বেশি সময় নিয়ে ফেললাম। দ্রুতপায় এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় নিক। তীব্র চোখে পরিস্থিতি নজর করে। তীক্ষ্ণ এক বিস্ময়ের অভিঘাতে পোয়ারো দ্রুত হাতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মৃত দেহটাকে দু’হাতে চিৎ করে শুইয়ে দেয়।
নিক ততক্ষণে আমাদের পাশে চলে এসেছে। নিমেষে চেরা গলায় আতঙ্ক ও শোকমহিত তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ওঠে নিক–ম্যাগি, হে ভগবান….. ম্যাগি, না এ হতে পারে না…….. পোয়ারো তখনও মেয়েটিকে পরীক্ষা করছিল হাঁটু মুড়ে বসে।
ও….. ও কি…..?–নিকের গলা ভেঙ্গে যায়
পোয়ারো দুঃখিত ভঙ্গিতে মাথা হেলায়–হ্যাঁ মাদাম জোয়েল, উনি মারা গিয়েছেন।
কিন্তু কেন? ম্যাগিকে কেন কেউ খুন করবে?
পোয়ারো চটজলদি উত্তর দেয়, দৃঢ় গলায় বলে–ওনাকে খুন করাটা উদ্দেশ্য ছিল না মাদাম জোয়েল। খুনীর লক্ষ্য ছিলেন আপনি, হ্যাঁ, আপনি ওই কালো শালটাই প্রধান লক্ষ্য নিশানা ছিল খুনীর। ভুলের কারণ ওই কালো শালটাই।
একটা তীব্রতর, বুক ফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নিক–কেন, কেন আমার সঙ্গে এটা ঘটল না। তীক্ষ্ণ কান্নামাখা গলায় চিৎকার করে ওঠে সে–আমার সঙ্গে কেন এটা ঘটল না? হে ভগবান, আমি আর বাঁচতে চাই না। এখন, আমি মরতে পারলে খুশি হতাম।
পোয়ারো সান্ত্বনার ভঙ্গিতে নিকের কাঁধে হাত রাখে–মাদাম জোয়েল, শান্ত হন।
হেস্টিংস, তুমি পুলিসকে একটা ফোন করে দিও।
আমি নিকের হাত ধরে দাঁড় করাই। ওকে যখন বাড়ির ভিতর নিয়ে যাচ্ছি পোয়ারো তখন আমাকে প্রায় আদেশের সুরে বলে–সবসময় মাদাম জোয়েলের সঙ্গে থাকবে। হেস্টিংস, মনে রেখো, এক মুহূর্তের জন্যেও ওকে চোখের বাইরে যেতে দেবে না, ওর পাশ থেকে নড়বে না।
আমি পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সায় দিই। প্রায় অচেতন নিককে ঘরে এনে একটা সোফায় শুইয়ে দিলাম। মাথার নিচে একটা কুশন দিয়ে দিলাম। তারপর একটা টেলিফোনের খোঁজ করতে লাগলাম। ঠিক তখনই এলিন ঘরে ঢুকল প্রায় ছুটতে ছুটতে। আর একটু হলে আমার সাথে ওর ধাক্কা লাগছিল। আমাকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। আমি লক্ষ্য করি, ওর চোখে-মুখে আশ্চর্য রকমের একটা অভিব্যক্তির ছাপ। দু’চোখ যেন জ্বল জ্বল করছে কিছুর প্রত্যাশায়! বারবার দুই শুকনো ঠোঁটের ওপর সে জিভ বোলাচ্ছিল। ওর দু’হাত কাঁপছিল থরথর করে। মনে হচ্ছে সে যেন কোনও উত্তেজনা বা উদ্বেগে ভুগছে।
কিছু কি ঘটেছে? আমাকে দেখামাত্র সে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ–আমি এড়িয়ে যাওয়া গলায় উত্তর দিলাম। ফোনটা কোথায়?
খারাপ টারাপ কিছু ঘটেছে কি?
একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। একজন আহত হয়েছে। আমাকে ফোন করতেই হবে।
কে? কে আঘাত পেয়েছেন স্যার?
সেসময় আমি দেখি তার মুখে একটা তীব্র ব্যগ্রতা। সেটা খেয়াল করে আমি জবাব দিই–মিস ম্যাগি বার্কলি।
মিস ম্যাগি? মিস ম্যাগি কি আপনি নিশ্চিত স্যার? মানে, ইয়ে–আপনি কি নিশ্চিত যে মিস ম্যাগিই আহত হয়েছেন?
একশো ভাগ নিশ্চিত–কেন?
ওহ, না–না, সেরকম কিছু না। আমি ভাবলাম অন্য মেয়েদের কেউ……. হয়তো মিসেস রাইস আহত হয়েছেন।
দেখ এলিন যথেষ্ট হয়েছে। আমি এবার কড়া গলায় বলি–এবার টেলিফোনটা কোথায় আছে বলবে?
এবার মেয়েটা কিছুটা থমমত খেয়ে যায়-হা, হা, দুঃখিত স্যার, এই তো এই ঘরে।
সে পাশের ঘরটার দরজাটা খুলে ধরতেই যন্ত্রটার উপর আমার নজর পড়ে। আমি এগিয়ে যাই তার দিকে। এলিন তখনও সেখানে সটান দাঁড়িয়ে।
আপনি যদি ডাঃ গ্রাহামের নম্বর…….
ধন্যবাদ, আমার আপাতত আর কোন সাহায্য চাই না তোমার কাছে।
এবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রায় বাধ্য হয়েই ওকে ওখান থেকে চলে যেতে হয়। ওকে এত ধীরে ধীরে পা ফেলতে দেখে আমার সন্দেহ হয় সে নিশ্চয়ই আমার কথাগুলো আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমাকে সেটা হতে দিলে চলবে না, কারণ ও হয়তো এমন কিছু জেনে যাবে যেটা ওর পক্ষে এই মুহূর্তে না জানাই বাঞ্ছনীয়–যদিও একটু পরেই তো সবাই এমন কি এলিনও সব কিছুই জানতে পারবে।
আমি প্রথমে পুলিস থানায় ফোন করে পুরো ঘটনাটা জানাই। তারপর আমি নিজ উদ্যোগে, এলিন যার নাম উল্লেখ করেছিল সেই ডাঃ গ্রাহামের নম্বরটা ফোনের ডাইরি থেকে খুঁজে বের করে তাকেও ফোন করে সব জানাই। উনি কয়েক মিনিটের মধ্যেই এখানে আসছেন বলে আমাকে জানালেন। আমি ফোন রেখে সেই ঘর থেকে বের হয়ে আবার নিকের ঘরে ফিরে এলাম। এলিনকে তখন কোথাও দেখতে পেলাম না। ভাবলাম দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে আমার সব কথাগুলো যদি সে শুনেও থাকে, আমার ঘর থেকে ফেরার মুহূর্তে খুব দ্রুততার সঙ্গে সেখান থেকে সরে পড়েছে সে।
ততক্ষণে নিক অনেকটা শক্ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। সোফায় উঠে বসেছে। আমাকে একটু ব্র্যান্ডি দিতে পারেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি দ্রুত পায়ে ডাইনিং রুমে হাজির হই। সঙ্গে সঙ্গে ব্রান্ডিও পেয়ে যাই। নিককে এনে দিতে ও দু’ এক চুমুক পান করেই অনেকটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ওর মুখের রঙ আস্তে আস্তে ফিরে আসে।
ওহ, কি ভয়ঙ্কর।
হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে।
না, আপনি বুঝতে পারছেন না। এটা আমি হতে পারতাম। আমারই তো হবার কথা ছিল। সব শেষ হয়ে যেত।
আমি ওকে সাহস জোগানোর জন্য বলি–দয়া করে এভাবে বলবেন না। মনে সাহস আনুন।
সে বারবার মাথা বাঁকাতে বাঁকাতে বিড়বিড় করে বলে চলে–আপনি জানেন না–আপনি জানেন না। তারপর আচমকাই সে কাঁদতে শুরু করে। প্রায় নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে শিশুর মত।
আমার মনে হল এটাই এখন ওর জন্যে সবচেয়ে ভাল হবে। এতে মনের গ্লানি অনেকটাই হাল্কা হয়ে যাবে, তাই ওকে আর থামানোর কোনও চেষ্টাই করলাম না। কান্নার প্রথম তীব্রতা নিক সামলে ওঠার পর আমি ওর পাশ থেকে সরে গিয়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়ালাম, বাইরে নজর দিলাম, অনেকক্ষণ থেকেই সেখানে মানুষের গল্পর স্বর, হৈ-চৈ আওয়াজ, উত্তেজিতভাবে কথাবার্তা, চাপা আতঙ্কের চিৎকার সব শুনতে পাচ্ছিলাম। মৃতদেহটা ঘিরে ঘটনাস্থলে একটা ভিড় জমেছে। প্রায় সকালেই সেখানে জড়ো হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম উর্দি পরা দু’জন অবয়বধারী ঘাস মাড়িয়ে এগিয়ে এল। পুলিস এসে পৌঁছেছে।
আমি আবার পুরানো জায়গায় সোফায় গিয়ে বসলাম। কান্না ক্লিষ্ট মুখ তুলে তাকাল নিক আমার দিকে।
আমার কি এখন কিছু করা উচিত নয়?
না, একদম নয়। পোয়ারোর কড়া নির্দেশ রয়েছে এটা পুরোপুরি ওর ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তোমার বাড়ির বাইরে যাওয়া চলবে না।
দু’হাতের তালুতে মুখ ঢেকে কয়েকমুহূর্ত চুপ করে বসে থাকে নিক, তারপর আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে–বেচারা ম্যাগি, অভাগা ম্যাগি, এত ভাল মেয়ে ছিল যে জীবনে কারও কোনও ক্ষতি করেনি আর ওর ভাগ্যে কিনা এরকম একটা ঘটনা ঘটল। নিজেকেই আমার খুনী মনে হচ্ছে। ওকে এখানে ডেকে এনে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য আমিই ওর খুনের জন্য দায়ী।
আমি নীরবে মাথা ঝাঁকালাম। নিয়তির বিধান কেউ খণ্ডাতে পারে? যখন পোয়ারো নিককে বোঝাচ্ছিল, বুঝিয়ে রাজি করাল তার কোনও বন্ধু অথবা আত্মীয়কে এনে ওর সঙ্গে থাকবার জন্যে, তখন কি পোয়ারো জানতে, বুঝতে পেরেছিল, একটি নিষ্পাপ নিরপরাধ মেয়ের মৃত্যু পরোয়ানা সই করেছে সে।
আমরা নিঃশব্দে বসে রইলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম অনুমান করতে পারছিলাম, বাইরে কি ঘটে চলেছে। কিন্তু আমি অনুগতভাবে পোয়ারোর নির্দেশ মান্য করেই নিজের কর্তব্য দায়িত্বে বদ্ধ হয়ে রইলাম। হয়তো আধ ঘন্টা কি মিনিট কুড়ি পর হবে অথচ আমার মনে হল বেশ কয়েকঘণ্টা পর দরজা ঠেলে পোয়ারো ঘরে ঢুকল। সঙ্গে দু’জন পুলিশ কর্মীর একজন এবং আরও একজন। আমার বুঝতে অসুবিধা হল না অপর ব্যক্তি হলেন ডাঃ গ্রাহাম। ঘরে ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে নিকের কাছে চলে এলেন ওরা।
এখন আপনি কেমন বোধ করেছেন মিস বার্কলি?–নিকের নাড়ি চেক করতে করতে প্রশ্ন করলেন ডাঃ গ্রাহাম। অবশ্য এটা একটা খুব মর্মান্তিক আঘাত, সইতে একটু সময় লাগবে।
এখন ঠিকই আছি। মৃদু গলায় জবাব দেয় নিক।
ডাক্তার এবার আমার দিকে ফিরে বললেন-উনি কিছু খেয়েছেন?
অল্প একটু ব্রান্ডি।
আমি এখন ভাল আছি, ঠিক আছি। নিক জোর দিয়ে বলবার চেষ্টা করে।
কয়েকটা সামান্য উত্তর দিতে পারবেন ম্যাডাম?
পুলিস ইন্সপেক্টরের প্রশ্নে নিক দৃঢ় গলায় বলে-অবশ্যই পারব।
পুলিস অফিসারটি নিকের কাছে এগিয়ে আসেন, কথা শুরু করার আগে একটু কেশে নিয়ে কথা শুরু করলেন আর নিক সেই কাশির আপ্যায়নমূলক যে হাসিটা দিল, সেটা আমার কাছে মনে হল কোনও অশরীরী আত্মার অট্টহাসি বা ভৌতিক কোনও রহস্যে ঘেরা হাসি।
আমি দুঃখিত মিস বার্কলি, এই অবস্থায় আপনাকে বিরক্ত করবার জন্য। এটা একটা সত্যি এক ভয়ঙ্কর, মর্মান্তিক ঘটনা।
পুলিস ইন্সপেক্টর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করেন–আমাদের সত্যিই পরম সৌভাগ্য যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা মিঃ এরকুল পোয়ারো আপনার এখানে হাজির হয়েছেন। উনি আমাকে সবকিছু বলেছেন, তবু আমি আপনার মুখ থেকে ঘটনাটি শুনতে চাই। আশাকরি ঘটনার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটনা ঘটেছে কোনও কিছু গোপন না করে তার সবটাই আমাকে বলেন তাহলে তদন্তের ক্ষেত্রে আমাদের খুবই সুবিধা হবে।
নিক এবার শুরু থেকে ঘটনাগুলো একের পর এক বিস্তারিতভাবে পুলিস ইন্সপেক্টরকে বলে শোনাল।
বেশ, আপনার সব কথা শুনলাম, কিন্তু মাদাম একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছে না যে, আপনার গায়ে দেওয়া শালটা ওই মুহূর্তে আপনার দিদির গায়ে গেল কি করে?
আমরা দুজনে কোট নিতে এসেছিলাম বাড়িতে। আমি শালটাকে সোফার উপর খুলে রেখে দোতলার ঘরে যাই। আমার কোটটা বের করি, তারপর ম্যাগি আর আমার বান্ধবী মিসেস রাইসের জন্যে আরও একটা কোট নিয়ে বাড়ির বাইরে আসতেই মিঃ পোয়ারো আর মিঃ হেস্টিংসকে দেখতে পাই। ম্যাগি মাটিতে উপুড় হয়ে পড়েছিল। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে নিক। বেশ কয়েকটা মিনিট পর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সে আবার বলতে শুরু করে, ম্যাগি কখন আমার শালটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল বলতে পারব না। হয়তো ওর খুব শীত করছিল। আমার কোট নিয়ে ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে হয়তো হাতের কাছে শালটাকে পেয়ে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল। আবার কান্নায় নিকের গলা বুঁজে আসে।
কিন্তু, আপনি কোনও গুলির শব্দ শুনতে পাননি?
সে সজোরে মাথা নাড়ে–না, বাজির শব্দ ছাড়া আমি আর কিছু শুনিনি। শুনলেও বোঝা সম্ভব ছিল না, বাজির শব্দের সঙ্গে সেটা মিশে যেত।
হ্যাঁ, সেটা অবশ্যই সত্যি। ইন্সপেক্টর সায় দেয়। তারপর হঠাৎ কি যেন ভেবে নিয়ে প্রশ্ন করে–কে আপনার ওপর আঘাত হানার চেষ্টা করছে সে ব্যাপারে আপনার কোনও ধারণা আছে? কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?
না, এ ব্যাপারে আমার সামান্যতম ধারণাও নেই।
হুম,–গম্ভীর চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলেন ইন্সপেক্টর। যাক, এখন এ মুহূর্তে আপনাকে আর কোনও প্রশ্ন করার নেই আমার।
এবার পুলিস সাহেব সরে যেতেই ডাঃ গ্রাহাম এগিয়ে আসেন–মিস বার্কলি, আমার একটা কথা ছিল। আমার মনে হয় আপনার এখানে থাকাটা উচিত হবে না। মিঃ পোয়ারোর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমার জানা একটা ভাল নার্সিংহোম রয়েছে। আপনি যথেষ্ট শ পেয়েছেন। আপনার পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন এবং তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন একজন চিকিৎসকের নজরদারি।
নিক ডাক্তারের দিকে তাকায়ও না। ওর নজর তখন পোয়ারোর দিকে।
আপনি কি আমার শক পাওয়ার কথা ভেবে এ ব্যবস্থা করছেন?
পোয়ারো কয়েক পা এগিয়ে আসে–মাদাম জোয়েল আমি চাই আপনি নিরাপদে থাকুন, ওখানে থাকলে আপনি নিরাপদে থাকবেন এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত, কারণ ওখানে সবসময় একজন করে নার্স মজুত থাকবে সে সারাক্ষণ আপনার কাছে কাছে থাকবে। আপনি আমার বক্তব্য বুঝতে পারছেন আশা করি।
হ্যাঁ, আমি পারছি। কিন্তু আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না কারণ আমি আর ভয় পাচ্ছি না। আমি আর কোনও কিছুকেই পরোয়া করি না। যদি কেউ আমাকে খুন করতে চায় করুক।
আহ, তুমি এত মনোবল দেখাচ্ছ কেন?–আমি না বলে পারলাম না।
না, আপনারাও বুঝতে পারছেন না, আপনারা কেউই কিছু বুঝতে পারছেন না।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে মিঃ পোয়ারোর পরিকল্পনাটা ভুল নয়- ডাক্তার এবার মুখ খুললেন। আমি আমার গাড়িতেই আপনাকে নিয়ে যাব। আপনার এক রাত অন্তত ঠিকমত বিশ্রামের প্রয়োজন আছে এবং আমি সেইমত ব্যবস্থা করতে চাই। এখন আপনি কি বলেন?
ঠিক আছে, আপনারা যা ভাল বোঝেন তাই করুন, আমি আর আপত্তি করব না।
পোয়ারো নিকের হাতটা নিজের হাতের ওপর রাখে–আমি জানি মাদাম জোয়েল, এই মুহূর্তে আপনার অনুভূতিটা আমি বুঝতে পারছি। আমি বুঝতে পারি আপনি এই ঘটনার জন্যে নিজেকে অপরাধী ভাবছেন, লজ্জিত বোধ করছেন। আপনার এই অনুভূতিটাকে আমি শ্রদ্ধা করছি। আমারও একইরকম অনুভূতি হচ্ছে, যেহেতু আমি তো আপনাকে কথা দিয়েছিলাম যে আপনাদের সুরক্ষা দেব, আপনার এবং আপনার যিনি সঙ্গী হবেন। কিন্তু আমি তা পারলাম না। আমার মনের অবস্থা ব্যাখ্যা করতে পারব না। তবে আপনার মনের যা অবস্থা, তার থেকে আমার মন কোনও অংশে কম বিচলিত নয়। এবারে আপনাকে নিশ্চিত করতে পারি।
ঠিক আছে, বুঝেছি। সেই প্রাণহীনতাই এখনও বেজে চলেছে ওর গলায়।
আপনার নিজেকে দোষী ভাববার কোনও কারণ নেই। আমার মনে হয় আপনার পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল, সবকিছুই আপনি করেছেন। আমি নিশ্চিত। অন্য কেউ এর থেকে বেশি কিছু করতে পারত না। সুতরাং বিনা কারণে মন খারাপ করবেন না।
আপনি খুব সহৃদয় মাদাম জোয়েল। পোয়ারো বিনীত গলায় বলে।
না, আমি….. কথা শেষ হতে না হতেই দরজাটা প্রায় দড়াম করে খুলে যায়। শ্যালিঙ্গার ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢোকে–আমি এই মাত্র এসে পৌঁছলাম। সদর দরজায় একজন পুলিস কর্মীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার কাছ থেকেই পুরো ঘটনাটা জানতে পারি। নিক…….. নিক…….. তুমি এখন পুরোপুরি সুস্থ তো, তুমি ঠিক আছে তো?
ওর গলায় আতঙ্ক, রাগ মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছিল তার কণ্ঠস্বর। নিকের কোনও ক্ষতি হয়নি তো?
পোয়ারো এবং ডাক্তার কম্যান্ডার-এর দৃষ্টিপথ আটকে রেখেছিল। এবার তারা সরে যেতেই শ্যালিঙ্গার-এর নজর পড়ল মিস বার্কলির দিকে। কেমন একটা অদ্ভুত ঘঘারলাগা চোখে তিনি তাকিয়ে রইলেন কয়েকমুহূর্ত। আমার মনে হয় কেমন যেন নেশাতুর মদ্যপের দৃষ্টি। তারপর প্রায় ছুটে গিয়ে নিকের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন। হঠাৎ, আচমকা নিকের মুখটাকে নিজের দুহাতের মধ্যে তুলে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন কম্যাণ্ডার শ্যালিঙ্গার, নিক…. নিক…….. প্রিয়তমা আমার, আমি…… আমি ভেবেছিলাম তুমি মারা গেছ।
মিস বার্কলি ধীরে ধীরে সোফার ওপর উঠে বসলেন–সব ঠিক আছে জর্জ। বোকামি কর না। দেখছ আমি তো সুস্থ, ঠিক আছি।
শ্যালিঙ্গার মাথা তোলেন, উদভ্রান্তের মতো চারপাশে তাকান–কিন্তু, কেউ একজন মারা গেছে, কে? কে সে? পুলিশ কর্মীটি তো বলল-।
নিক এবার বিষণ্ণ, নিচু গলায় বলে–হ্যাঁ, ম্যাগি। বেচারা ম্যাগি…
ওঃ……… এক তীব্র দুঃখে, যন্ত্রণায় ওর মুখের রেখায় ভাঙ্গাচুর ঘটায়। ডাক্তার এবং পোয়ারো এগিয়ে আসেন। ডাক্তার ওর হাত ধরেন, ওকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেন। তারপর পোয়ারো এবং ডাক্তার দুপাশ থেকে দু’জনে ধরাধরি করে ওকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
আপনি ডাক্তারের গাড়িতে গিয়ে বসুন, আমি মিসেস রাইসকে বলছি আপনার জরুরী কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে দিতে।–পোয়ারো শান্ত গলায় বলে।
ওরা বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। শ্যালিঙ্গার এবার আমার কব্জি চেপে ধরেন হেস্টিংস, ওরা ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমি সংক্ষেপে পুরো ব্যাপারটা ওকে বললাম।
ওঃ, কি ভয়ঙ্কর ঘটনা। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। কি ভয়ঙ্কর।
আসুন কম্যান্ডার একটা ড্রিঙ্ক নিন, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার মনে তখন আর কোনও দ্বিধা বা সংশয় নেই, থাকার কথাও নয়। নিক সম্পর্কে কম্যান্ডার জর্জ শ্যালিঙ্গারের মনোভাব বিষয়ে, ব্যাপারটা তখন জলের মত স্বচ্ছ।
.
০৯.
এ থেকে জে
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়েছিল–যদি আমি সেই রাতটাকে ভুলে যেতে পারতাম, তারপর সেই রাতে যা ঘটেছিল। পোয়ারো অত্যন্ত দুঃখে কাতর হয়ে পড়েছিল–এই শাস্তিটা বোধহয় আমার প্রাপ্য ছিল। আমি অত্যন্ত বেশি মাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলাম–আমি এরকুল পোয়ারো, নিজের সম্পর্কে অত্যন্ত নিশ্চিত হয়ে পড়েছিলাম।
না, না, ওরকম ভাবে কেন ভাবছো? আমি বাধা দিয়ে বলি।
কিন্তু কেউ কি করে ভাবতে পারে, একজন কি করে ভাবতে পারে–অকল্পনীয়, অতুলনীয় স্পর্ধা। আমি ভেবে নিয়েছিলাম, নিশ্চিত হয়েছিলাম যে আমি যত রকমভাবে সম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করেছি। আমি খুনীকে পর্যন্ত সতর্ক করে দিয়েছিলাম।
সতর্ক করে দিয়েছিলে? কি ভাবে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করি আমি।
পোয়ারো সশব্দে নিজের হাতের তালুতে জোরাল চাপড় মারে–সমস্ত নজর আমি নিজের দিকে এনে নিয়েছিলাম এবং আমি বুঝিয়ে দিয়েছিলাম কাউকে, কোনও একজনকে সন্দেহ করছি এবং আমি নিজেও বুঝিনি পরিস্থিতি কতখানি জটিল করে তুলেছিলাম। কি ভয়ঙ্করভাবে মরীয়া করে তুলেছিলাম নিজেকে। আমি মাদাম জোয়েলকে ঘিরে একটা বৃত্ত রচনা করেছিলাম এবং তিনি তা থেকে পিছলে বের হয়ে গেলেন। আর আমাদের চোখের সামনেই পিছলে গেলেন অন্যজন। আমরা থাকা সত্ত্বেও, সবাই সতর্ক থাকা সত্ত্বেও। খুনী সে লক্ষ্য পূরণে সম্ভব হল।
না, তা সে পারেনি। আমি ওকে মনে করিয়ে দিই।
আহ, সেটা একটা পরিবর্তন মাত্র। আমার কাছে ব্যাপারটা একই। হেস্টিংস আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাপারটা একই। একটা মানুষের প্রাণ চলে গেল, যার যাওয়াটা একেবারেই সঙ্গত নয়।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, সেটা ঠিক। আমি সে কথা বলতে চাইনি।
কিন্তু তুমি যা বলেছ সেটা আমাদের পক্ষে আরও ভয়ঙ্কর, ইঙ্গিতবাহী। হেস্টিংস মনে রেখো, খুনী তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারেনি। সে আবার আঘাত হানবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। বুঝতে পারছ বন্ধু। অবস্থা বদলে গেছে এখন। আরও খারাপের দিকে এগোচ্ছে।
তার মানে, একমাত্র অর্থ হচ্ছে–একটা নয়, দু-দুটো জীবন উৎসর্গ হতে চলেছে।
না, তুমি যতক্ষণ রয়েছ কিছুতেই সেরকম কিছু ঘটা উচিত নয়। দৃঢ় গলায় আমি বললাম।
পোয়ারো আমার হাতটা আলতো করে ধরে–এই বুড়ো মানুষটার ওপর তোমার এখনও ভরসা আছে? বিশ্বাস আছে? তুমি আমায় নতুন করে সাহস দিলে বন্ধু। এরকুল পোয়ারো বারবার ব্যর্থ হবে না। না, এই দ্বিতীয় জীবনের সুযোগটা আমি পুরোপুরি ব্যবহার করব। আমি আমার ভুল শুধরে নেব। একটু থেমে কি যেন ভাবে পোয়ারো।
কোথায় একটা ভুল হয়েছে। আমার পদ্ধতি, সিদ্ধান্ত বিচারে কোথাও একটা ভুল ঘটেছে, যার জন্য এই পরিণতির শিকার হয়েছি। নাহ আমি আবার নতুন করে শুরু করব। আর এবার আমি ব্যর্থ হব না। পোয়ারো দৃঢ় গলায় বলে।
তার মানে তুমি মনে করছ, নিক বার্কলির এখনও প্রাণ সংশয় রয়েছে। আমি একটু বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করি।
পোয়ারো অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়–নিশ্চয়ই, তা না হলে আমি হঠাৎ করে ওকে ডাক্তারের সঙ্গে নার্সিংহোমে পাঠালাম কেন? সেটা ওর মানসিক আঘাতের শুশ্রূষার জন্য নয়?
মানসিক আঘাত?
হেস্টিংস, একজন তার নিজের বাড়িতে থেকে অনায়াসে মানসিক আঘাত, স্নায়ু দৌর্বল্য সারিয়ে উঠতে পারেন। বস্তুতপক্ষে, নার্সিংহোমের থেকে বাড়িতেই সেটা অনেক ভালভাবে হয়। ওখানকার লাল বা সবুজ লিনোলিয়াস মেঝে, উজ্জ্বল আলো, ট্রে-তে করে আসা খাবার, অথবা নার্সদের বকবকানি, কোনওটাই উত্তমভাবে স্নায়ু দৌর্বল্যের ধকল সামলানোর কোনও বাড়তি কারণ হয় না, হতে পারে না। না, হেস্টিংস একমাত্র নিরাপত্তা সুরক্ষা ছাড়া মাদাম জোয়েলকে ওখানে পাঠাবার আমার আর কোনও কারণ ছিল না। আমি ডাক্তারকে আমার পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলতেই সৌভাগ্যবশত উনি রাজি হয়ে গেলেন, তাই সব বন্দোবস্ত হয়ে গেল। যেখানে কেউই ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না, এমন কি ওর নিকটতম আত্মীয় পর্যন্তও পারবে না। শুধুমাত্র আমরা কয়েকজন ছাড়া।
পোয়ারো হাসে–ডাক্তারের অনুমতি নেই। বেশি কথাবার্তা ওনার দুর্বল স্নায়ুর পক্ষে ক্ষতি হতে পারে, এটাই সবার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারী থাকবে।
কিন্তু পোয়ারো এভাবে কতদিন? আমি সংশয়গ্রস্থ হয়ে প্রশ্ন করি।
হ্যাঁ, খুবই স্বাভাবিক অনুধাবন। কিন্তু এই মুহূর্তে সাময়িকভাবে এই ব্যবস্থাটা আমাদের শ্বাস নেবার সুযোগ দেবে। আর তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, আমাদের তদন্তের চরিত্র এবার বদল ঘটবে।
সেটা কি রকম?
এখন থেকে আমাদের প্রাথমিক এবং অবশ্যই সর্বপ্রথম কাজ হবে মাদাম জোয়েলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা এবং একইসাথে সমান গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে খুনীকে ধরবার চেষ্টা করা।
আহ্ পোয়ারো, প্রিয় বন্ধু, এমনভাবে তুমি কথাটা বলছ যেন সেটা খুব সহজ কোন কাজ।
নিশ্চয়ই হেস্টিংস, নিশ্চয়ই খুব সহজ কাজ।
পোয়ারো গভীর চোখে আমার দিকে তাকায়–আমি তোমাকে বলেছিলাম নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে? খুনী অপরাধের ওপর তার নাম সই করে দিয়েছে। সে এখন অন্ধকারের আড়াল ছেড়ে প্রকাশ্যে বের হয়ে আসছে, তা খুব শীঘ্রই আসতে চলেছে।
আমি পোয়ারোর অভিব্যক্তিকে খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করি। তারপর সামান্য ইতস্তত করে বলি–তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ যে পুলিশ ঠিক কথাই বলেছে, এটা কোনও বদ্ধ উন্মাদের কাজ? একজন লুনাটিক, হোমিসিডেল ম্যানিয়াক-এর কাজ এটা?
আমি এ বিষয়ে একেবারে নিশ্চিত যে, এটা সেরকম কারও কাজ নয়, হতেই পারে না।
তুমি সত্যিই ভাব… আমি থমকে যাই, পোয়ারো আমার কথার শেষটা থেকে বলতে শুরু করে–খুনী মাদাম জোয়েলের খুব কাছের মানুষদের মধ্যে কেউ একজন, সে ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত।
কিন্তু গত রাতের ঘটনাটা কি সেই তত্ত্ব খারিজ করে দিচ্ছে না? আমরা সবাই-ই তো এক জায়গায় জড়ো হয়েছিলাম, সে ক্ষেত্রে….
পোয়ারো এবার আমাকে বাধা দেয়–তুমি কি শপথ করে বলতে পারো হেস্টিংস যে বিশেষ কোনও একজন ব্যক্তি আমাদের সেই বৃত্ত থেকে আচমকা সরে যায়নি, সামান্য সময়ের জন্য হলেও সে সরে গেছে আমাদের বৃত্ত ছেড়ে যেটা তার কাজ সারার পক্ষে যথেষ্ট সময়। তুমি কি এমন একজনের নাম হলফ করে বলতে পারো যে অনুষ্ঠান শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব সময়ের জন্য তোমার চোখের সামনে ছিল?
না, ওর কথার গূঢ় অর্থের অভিঘাতে আমি বাস্তবতা খুঁজে বেড়াই, কই আমার সেরকম তো মনে হয় না, তাছাড়া আলো অন্ধকারে কারও ওপর সেভাবে নজর রাখা সম্ভব নয়। সবাই তো প্রায় আসে পাশে ঘোরাঘুরি করছিল তারই মধ্যে কে যে কখন কোথায় সরে যাচ্ছে সেভাবে তো নজর রাখিনি, সম্ভবও নয়।
পোয়ারো মাথা নাড়ে সম্মতিবাচক ভঙ্গিতে–একেবারে ঠিক কথা বলেছ। আর ভেবে দেখ, কিছু ঘটানোর জন্য মাত্র কয়েক মিনিটই যথেষ্ট ছিল তার পক্ষে।
পোয়ারো থামে কিছুক্ষণ, তারপর আমাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে দু’হাত নেড়ে বলতে শুরু করে–মহিলা দু’জন বাড়ির দিকে রওনা হলেন। খুনী সবার নজর এড়িয়ে ওদের অনুসরণ করল। গাছের আড়াল থেকে খুনী সবকিছুই লক্ষ্য করছে, মহিলারা বাড়িতে ঢুকলেন, তারপর কালো শাল গায়ে দিয়ে মিস বার্কলি দরজার বাইরে এলেন। খুনী আড়াল থেকে সবকিছুই দেখল এবং গাছের আড়াল থেকে লক্ষ্যস্থির করে সে সফলভাবে তিনটি গুলি ছুঁড়ল।
তিনটে? আমি বাধা দিয়ে বলি।
হ্যাঁ, প্রথমবারের ভুল এবার আর করতে চায়নি সে। কোনও ঝুঁকি নেয়নি খুনী। আমরা ম্যাগির শরীরে তিনটে বুলেট পেয়েছি।
কিন্তু পোয়ারো, সেটা তো খুবই ঝুঁকির কাজ হয়েছে, তাই না?
না, সেরকম কিছু নয়। মাউজার পিস্তলে খুব একটা সেরকম আওয়াজ হয় না। তাই খুব যে ঝুঁকি নিয়েছিল খুনী তা বলা যাবে না।
পিস্তলটা পাওয়া গেছে?
না, আর ঠিক সেখানেই আমার সন্দেহটা ঘোরতর বাস্তব চেহারা নিচ্ছে যে কাজটা বহিরাগত কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। আমরা তো আগেই জেনে গেছি যে নিক বার্কলির পিস্তলটা চুরি করা হয়েছে খুনটাকে আত্মহত্যা হিসাবে প্রমাণ করানোর জন্য। এখন তো আর আত্মহত্যার থিয়োরি খাটালে চলবে না। খুনী খুব ভালভাবেই জেনে গেছে যে আমরা সব জেনে গেছি তাই খুনের ব্যাপারটাকে আর আত্মহত্যা বলে চালানো সম্ভব হবে না।
পোয়ারোর যুক্তি যে অকাট্য, মনে মনে আমিও সেটা স্বীকার করে নিই–তাহলে এখন পিস্তলটা তার কি কাজে লাগবে?
আমার প্রশ্নে পোয়ারো কাধ বাকায়–এই মুহূর্তে আমি সে সম্পর্কে নিশ্চিত নই। তবে আমি বা তুমি হলে কি করতাম? বিশাল ওই সমুদ্রকে কাজে লাগাতে না? শুধু হাত ঘুরিয়ে গভীর জলে জিনিসটাকে ছুঁড়ে দাও। চিরকালের জন্য সেটা হরিয়ে যাবে, কেউ কোনওদিন খুঁজে পাবে না।
আমার শরীরে পোয়ারোর কথাগুলো মৃদু কম্পন জাগায়–তোমার কি মনে হয়, খুনী বুঝতে পেরেছে যে সে ভুল মানুষকে খুন করেছে?
আমি নিশ্চিত যে এখনও সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। ব্যাপারটা অবশ্যই ওর কাছে অসুস্থজনক এক বিস্ময় এবং তিক্ত অভিজ্ঞতা হবে। যখন আসল সত্যিটা সে জানবে। নিজের বিস্ময়ে এবং হতাশা গোপন করা, আসলে কে মিথ্যে শিকার হল তার জানবার কৌতূহল, সেগুলো অবদমন করা সহজ কাজ হবে না।
আর ঠিক তখনই আচমকা আমার মনে পড়ল বিদ্যুৎ চমকের মতো, নিকের বাড়ির পরিচারিকা এলিনের অদ্ভুত আশ্চর্য রকমের কৌতূহলী এবং বিভ্রান্তকর ব্যবহার। আমি দেরি না করে পোয়ারোকে সবিস্তারে ঘটনাটা জানালাম। ব্যাপারটা শুনে পোয়ারোর ভ্রুযুগল অতিমাত্রায় কুঞ্চিত হয়ে উঠল।
ও, অবাক হয়েছিল, তাই তো? ম্যাগি মারা গেছে শুনে অবাক হয়েছিল, অদ্ভুতভাবে আচরণ করছিল।
শুধু অবাক হয়েছিল বললে খুবই কম বলা হবে। নিঃসন্দেহে যথেষ্ট কৌতূহলী ও উদ্দীপক ছিলেন। এরকম একটা দুঃখজনক ঘটনার কথা জেনে, মহিলা আতঙ্কিত বা দুঃখিত হলেন না, বরং কে মারা গেছেন তা নিয়ে দ্বিধায় দুললেন, এমন কি অন্য কেউ মারা গিয়েছেন নাকি সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেলন। খুবই কৌতূহলকর ব্যাপার।
কে সে? অন্য সময় সে যথেষ্ট দায়িত্বশীল, শান্ত, তাহলে কি…… এই সে? যাকে… পোয়ারো আচমকা থেমে যায় এবং হঠাৎ করেই গুম মেরে যায়। ধীর পায়ে সারাটা ঘর পায়চারি করতে শুরু করে। ওর মুখ চিন্তার কুঞ্চনে ভারাক্রান্ত। যে যে কাল রাতে এন্ড হাউসে ছিল, তাদের কেউই সন্দেহের উর্ধে নন। তবে……. অতিথিরা, নাহ, আমার মনে হয় না তারা কেউ জড়িত। সত্যি কথা বলতে কি বাড়ির মালকিনের সঙ্গে ওদের কারোরই খুব একটা অন্তরঙ্গতা ছিল না। থমথমে মুখে বলে পোয়ারো।
আর চালর্স ভ্যাইস?
হ্যাঁ, অবশ্যই ওনার কথাগুলো আমাদের ভুললে চলবে না। সত্যি কথা বলতে কি, যুক্তির বিচারে উনি আমাদের একজন প্রবল সন্দেহভাজন- ধীর পায়ে এসে আমার উল্টো দিকের চেয়ারটায় বসে পোয়ারো।
মোটিভ, প্রিয় হেস্টিংস, যাবার আগে আমাদের মোটিভটাকে বুঝতে হবে যদি আমরা এই অপরাধকে সঠিকভাবে বুঝতে চাই। বারবার আমি একটা জটিল গোলক ধাঁধায় ঢুকে পড়েছিলাম। মাদাম জোয়েল নিককে খুন করার কারও কি মোটিভ থাকতে পারে? আমি কোন রকমের সম্ভাবনাকেই বাদ দিই নি। সব কিছু নেড়েচেড়ে দেখেছি।
পোয়ারো একটু থামে। যেন দম নেবার অছিলায় কিছু ভাবে। তারপর আবার বলতে শুরু করে–এমন কি, লাজারুম সিনিয়র যে পুরানো তৈল চিত্রটা কিনতে চেয়েছেন, সেটা কোনও দুর্মূল্য পেন্টিং নয় তো? আমি একজন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে ছবিটা পরীক্ষাও করিয়েছি। তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই, তোমার হাত দিয়ে মাদাম জোয়েলকে আমি একটি চিরকুট পাঠিয়েছিলাম একজন আসবেন তিনি যা করতে চাইবেন বিনা বাধায় ও বিনা প্রশ্নে তাকে যেন তা করতে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই বিশেষজ্ঞ রায় দিয়েছেন ছবিটা মোটেই কয়েকশো পাউন্ডের বেশি দাম হবে না।
লাজারুম? তার মত একজন ধনী……তুমি নিশ্চয়ই সত্যি তা বিশ্বাস কর না।
সত্যি সে ধনী তো? দর্শনধারী হলেই কিন্তু সবকিছু প্রমাণ হয় না। আমরা কোনও কিছুকেই যেমন নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারি না, আবার সামান্যতম কিছুকেও উপেক্ষা করতে পারি না। কারণ কোনটা যে আমাদের সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যাবে আমরাই নিশ্চিত করে জানি না।
পোয়ারো টেবিলের ওপর পড়ে থাকা বস্তুগুলোকে আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে খুব শান্ত গলায় বলে–থাক, আবার ফিরে যাওয়া যাক আসল কথায়। শুরু করা যাক মোটিভ নিয়ে। একটা খুনের কি মোটিভ হতে পারে? কি কি কারণ থাকতে পারে যার জন্য একজন মানুষ আর একজনকে প্রাণে মেরে ফেলতে পারে?
পোয়ারো একটা গভীর শ্বাস নেয়। জামার হাতার ভঁজে আঙুল ঘষে সেটাকে সোজা করতে করতে বলে–বিকারগ্রস্থ খুনীদের আমরা এখানে বাদই দিচ্ছি। কারণ আমি ভাল ভাবেই জানি যে আমাদের বর্তমান সমস্যার ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা হতে পারে না। তাছাড়া রাগের মাথায় বা আকস্মিক উত্তেজনার বশে খুন হলে এর লক্ষণ অন্যরকম হবে। না এটাকেও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। এটা খুব ঠান্ডা মাথায়, পরিকল্পিত ভাবে খুন। এছাড়া আর কি হতে পারে?
এবার আমি মুখ খুলি–প্রথমত, লাভের জন্য খুন। মাদাম বার্কলি খুন হলে যাঁরা কোনও ভাবে লাভবান হবেন, সেটা প্রত্যক্ষ ভাবেই হোক বা অপ্রত্যক্ষভাবেই হোক। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় চার্লস ভ্যাইসকে আমরা বাদ দিতে পারি। কারণ উত্তরাধিকারী সূত্রে তার এমন কোনও লাভের বা প্রাপ্তি যোগের সম্ভাবনা নেই যে সে খুনের মত অপরাধে প্ররোচিত হতে পারে।
হ্যাঁ, মাত্র একজন আছেন, যিনি মাদাম জোয়েল বার্কলির মৃত্যুতে লাভবান হবেন। তিনি ওঁরই বান্ধবী, মিসেস রাইস। কিন্তু সেক্ষেত্রে লাভের অঙ্কটা এতই কম যে খুনের মত অপরাধের কথা কেউ ভাবতেও রাজি হবে না।
পোয়ারো মাথা নাড়ে। তারপর গভীর চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে–হেস্টিংস দেখা যাচ্ছে। লাভ-এর জন্য খুন, তাহলে এক্ষেত্রে এই তথ্যটাকে বাতিল করতেই হচ্ছে। এছাড়া অন্য আর কি মোটিভ হতে পারে?।
আমি বলি–ঘৃণা বা রাগজনিত কারণে খুন। বা ধর প্রেম-ভালবাসা যদি ঘৃণায় পরিণত হয় সেক্ষেত্রে ক্রাইম আসতে পারে। কারণ আমরা জানতে পেরেছি চার্লস ভাইস এবং কমান্ডার শ্যালিঙ্গার দু’জনেই মাদাম জোয়েল বার্কলির প্রতি অনুরক্ত। দ্বিতীয় জনের কথা তো আমরা নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ করলাম।
হ্যাঁ, খুব সৎ এবং একনিষ্ট ভালবাসা। অন্যজনের ব্যাপারে কিন্তু আমাদের ভরসা, বিশ্বাস করতে হবে মাদাম জোয়েল ক্রফটের বক্তব্যকে। এই বিষয়ে আমাদের হাতে যথেষ্ট তথ্য বা প্রমাণ নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চার্লস এস. ভ্যাইস কি তার এই সম্পর্কিত তুতো বোনটির ওপর এতটাই অনুরক্ত যে অন্য কারও স্ত্রী হওয়ার আগে তাকে খুন করাটাই শ্রেয়। বলে মনে করবে?
পোয়ারোর কথার উত্তরে আমি বলি–সন্দেহ আছে। ব্যাপারটা কেমন যেন নাটকীয় বলে মনে হচ্ছে।
আসলে ব্যাপারটা হয়তো অ-ইংরেজিত শোনাচ্ছে। তবে মনে রেখ হেস্টিংস, ইংরেজদের মধ্যেও কিন্তু আবেগ বলে কিছু আছে আর চার্লস ভ্যাইসকে আমার ওই ধরনের মানুষ বলে মনে হয়। যারা সহজে নিজেদের আবেককে প্রকাশ করে না তারা তাদের মনের মধ্যে হিংসার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। এক্ষেত্রে এটা অবাস্তব কিছুই নয়। আর আবেগজনিত কারণে কমান্ডার শ্যালিঙ্গারকে আমি কখনও খুনী হিসাবে সন্দেহ করব না–না, না, ওর ধারণা ওরকম হতে পারে না। কিন্তু চার্লস ভ্যাইস? না, ওর ক্ষেত্রেও তার নিরাপত্বতা সম্পর্কে বাজি ধরব না পোয়ারো থামে কিছুক্ষণ। হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘরের মধ্যে কয়েকবার পায়চারি করে এসে আবার চেয়ারে ফিরে এসে বসে। খুনের আর একটা মোটিভ হচ্ছে জেলাসি, ঈর্ষা। না, আগের ব্যাপারটা থেকে নিশ্চিত ভাবেই এর অনেকটা তফাত রয়েছে, কারণ ঈর্ষা যে সব সময়ে যৌন আবেগপ্রবণ হবে তার কোনও কারণ নেই সেখানে শত্রুতাবোধ বরং থাকতে পারে। পোয়ারো এবার আমার দিকে তাকায়। তোমার কি মনে হয় হেস্টিংস, আমাদের এই মামলায় জেলাসি কি কোনও ভাবে দায়ী হতে পারে অপরাধের জন্য?
আমাকে কোনও মন্তব্য করার সুযোগ না দিয়ে নিজেই আবার বলতে থাকে–কে শত্রু হতে পারে মাদাম জোয়েল বার্কলির? অন্য কোনও মহিলা? এক্ষেত্রে তো থাকত শুধু মাদাম রাইস। কিন্তু আমরা যতদূর জানি ওনাদের দুজনের মধ্যে তো কোনও রকমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। কিন্তু তবুও আমরা যতটা জানি সেখানে নিশ্চিত করে বলাটা কঠিন কাজ। গভীর ভাঁজ পড়ে পোয়ারোর কপালে। গভীর চিন্তায় ডুবে আছে যেন। বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর আবার বলে–বাকি রইল ভয়। মাদাম জোয়েল নিক কি কারও গোপন কোনও ব্যাপার জেনে ফেলেছেন? হয়তো এমন কিছু জানেন নিক যা জানাজানি হয়ে গেলে সেই ব্যক্তির মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে এমন কি জীবন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে তার। তাছাড়া এমনও হতে পারে তিনি নিজেই হয়তো ব্যাপারটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন, বা ব্যাপারটা তিনি দিব্যি ভুলেই গেছেন বা আমাদের কাছে গোপন করে, গেছেন, আমাদের বলবার প্রয়োজন বোধই করেননি।
আচ্ছা হেস্টিংস তোমার কি সত্যিই মনে হয় সেরকম কিছু ঘটা সম্ভব? এটা একটা হাইপোনেসিস, আমার মনে হয় না এরকম কিছু ঘটা সত্যি সম্ভব। কিন্তু যুক্তিযুক্ত আপাতগ্রাহ্য কোনও থিয়োরি, সম্ভাবনা কোথাও খুঁজে না পেয়ে এই সম্ভাবনাটির দ্বারা তাড়িত হচ্ছি। যখন তুমি অন্য সম্ভাবনাগুলোকে হেঁটে ফেলবে, তুমি তো সেদিকেই তাকাতে বাধ্য হবে, যেটা পড়ে রইল এবং পড়ে থাকছে বলবে……. যেহেতু অন্যগুলো নয়…… তাহলে হয়তো এটাই……..
দীর্ঘক্ষণ সে চুপ করে বসে রইল। তারপর একসময় সে উঠে দাঁড়াল। একটা সাদা কাগজের টুকরো টেনে নিয়ে কিসব যেন লিখতে শুরু করল গভীর মনোযোগ সহকারে।
আমি প্রশ্ন করি, কি লিখছ তুমি?
মনামি, আমি একটা তালিকা বানাচ্ছি। মাদাম জোয়েল বার্কলির আশেপাশে সবসময় যারা থাকে। আমার কার্যপদ্ধতি ও ভাবনা যদি সঠিক পথে চলে, তাহলে এই তালিকার মধ্যেই লুকিয়ে আছে খুনী।
বেশ কিছুক্ষণ লেখার পর কাগজের টুকরোটা আমার দিকে এগিয়ে বলে, দেখো তো হেস্টিংস, তালিকাটা ঠিকঠাক হয়েছে কি না, কোনও নাম বাদ পড়েছে নাকি।
আমি তালিকাটা মনোযোগ সহকারে পড়তে থাকি। ১। এলিন, ২। মালি (এলিনের স্বামী), ৩। মিঃ ক্রফট, ৪। মিসেস ক্রফট, ৫। মিঃ লাজারুম, ৬। মিসেস রাইস, ৭। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার। ৮। মিঃ চার্লস এস. ভ্যাইস, ৯। ?
মন্তব্য :
(ক) এলিন–পারিপার্শ্বিকগতভাবে সন্দেহজনক। ম্যাগি খুন হয়েছেন জেনে এর কথাবার্তা এবং আচরণ রীতিমতো সন্দেহজনক। পিস্তলটি চুরি করা এবং সব কটি খুনের চেষ্টা ঘটানো এবং ভুল করে ম্যাগিকে খুন করা, সব অপরাধগুলো ঘটাবার পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। ওর পক্ষেই ক্রাইমগুলো ঘটানো সবচেয়ে সহজ হবে। তবে গাড়ির ব্রেক-এ কারসাজি করা মনে হয় ওর আয়ত্বের বাইরে। আর মানসিকতার বিচারে মনে হয় না ওর পক্ষে ক্রাইম করার সামর্থ আছে।
মোটিভ কিছুই না। যদি না ঈর্ষা বা ঘৃণা বিষয়ক কোনো ব্যাপার থাকে।
নোট–আরও পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
(খ) মালি (এলিনের স্বামী)–অন্যসব এলিনের মতোই। তবে এর পক্ষে গাড়িতে কারসাজি করা তুলনামূলকভাবে সম্ভব।
নোট–একবার কথা বলে দেখতে হবে।
(গ) মিঃ ক্রফট একমাত্র সন্দেহজনক ব্যাপার। ফাঁকা বাড়িতে আমরা মিস বার্কলির শোবার ঘরের দিকে উঠতে দেখেছিলাম। ওনার জবাব তৈরি ছিল। সেটা অবশ্য সত্যি হলেও হতে পারে। কিন্তু যদি তা না হয়?
মোটিভ–নেই।
(ঘ) মিসেস ক্রফট–সন্দেহের তেমন কিছু নেই। মোটিভ–নেই।
(ঙ) মিঃ লাজারুম–অপরাধ করার সবরকম সুযোগ-সুবিধা ছিল। যথেষ্ট সন্দেহজনক আচরণ। মাত্র কয়েকশো পাউন্ড দামের পুরোনো ছবি কিনতে চাওয়া। গাড়ির ব্রেক একেবারে ঠিক ছিল কেন বলেছিলেন? (ফ্রেডরিকা রাইসের মুখে শোনা)
মোটিভ–এখনও পর্যন্ত সেরকম কিছু জানা যায় নি।
নোট–জানতে হবে সেন্ট লু-তে আসবার আগে লাজারুম কোথায় ছিল? অ্যারন লাজারুম এবং কোম্পানির বর্তমান আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে।
(চ) মিসেস ফ্রেডরিকা রাইস অপরাধ করার সবরকম সুযোগ ছিল। সন্দেহজনক আচরণ, নিক বার্কলিকে গায়ের চাদর ও কোট আনতে পাঠানো। বেশ কয়েকবার ইচ্ছাকৃতভাবে নিককে সবসময় মিথ্যেবাদী বলে প্রমাণ করার চেষ্টা কেন করেছিল? দুর্ঘটনার বিষয়টা নিয়ে নিকের বক্তব্যে ভরসা করা যায় না–এই মন্তব্যটা কেন করেছিল? দুর্ঘটনার সময় সত্যি টাভিস্টকে ছিল না? কেথায় ছিল তাহলে?
মোটিভ–লাভ? সম্ভাবনা খুব কম। ঈর্ষা? হতেও পারে। ভয়? তাও হতে পারে। যদিও ঐ তিনটের কোনওটার বিষয় নিশ্চিত হওয়া যায় নি।
নোট–নিক বার্কলির সাথে সম্পর্কটাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। সম্ভবত ফ্রেডরিকা রাইসের আগের বিয়ে কোনও আলো দেখাতে পারে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে।
(ছ) কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার সন্দেহজনক আচরণ সেরকম কিছু নেই। যদিও অপরাধ ঘটাবার সব সুযোগ (গোটা সপ্তাহটা এই অঞ্চলের থাকার জন্য) পুরোপুরি ওর মধ্যে ছিল। খুনের আধঘণ্টা পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন।
মোটিভ–নেই।
(জ) মিঃ চার্লস ভ্যাইস–সন্দেহজনক আচরণ হিসাবে ধরা যেতে পারে। নিক বার্কলির ওপর যেদিন, সে সময় গুলি চলেছিল, তখন তিনি ছিলেন না। এন্ড হাউস বিক্রির ব্যাপারে কি উনি সত্যি কথা বলছেন?
মোটিভ–লাভ? সম্ভাবনা সামান্য। প্রেম বা ঘৃণা? সম্ভব, বিশেষ করে ওর মতো এক রিপ্রেসেড চরিত্রের মানুষের। ভয়, সম্ভব।
নোট বাড়িটা কে মর্টগেজ রেখেছে? তার কাছে বাড়িটা সত্যি বন্ধক আছে কিনা খুঁজে বের করতে হবে। ভ্যাইসের কোম্পানির আর্থিক অবস্থা সম্পর্কেও খোঁজ খবর নিতে হবে।
(ঝ)–কেউ একজন। অবশ্যই আছে। এই ঝ হয়তো একজন বহিরাগত। তবে, কোনও একটা যোগসূত্র হয়তো রয়েছে এই পরিবারের কারোর সঙ্গে। সেটা যদি হয়, সম্ভবত সেক্ষেত্রে ক, খ, ঙ, চ–এদের মধ্যে কারও সঙ্গে হবার সম্ভাবনা বেশি।
ঝ-এর অস্তিত্ব প্রমাণ দিচ্ছে (১) এলিনের ম্যাগি বার্কলি খুন হবার ঘটনায় অবাক অথবা আতঙ্কিত না হওয়া। বরং ঘটনাটা জেনে সে যেন কিছুটা নিশ্চিত হয়েছিল। (২) ক্রফট এবং তার স্ত্রী-এর এই লজে এসে বসবাস করতে শুরু করা। (৩) ফ্রেডরিকা রাইসের ঈর্ষা বা ভয়ের মোটিভ প্রকাশিত করতে বা সে বিষয়ে জানবার জন্যে। সম্ভবত খুব তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা প্রকাশিত হয়ে পড়বে।
আমি যখন পড়ছিলাম পোয়ারো প্রখর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল।
কি মনে হচ্ছে? আমার পড়া শেষ হতেই সে প্রশ্ন করে।
চমৎকার, অসাধারণ পর্যবেক্ষণ। আমি প্রশংসার গলায় বলি, খুব পরিষ্কার ভাবে সবরকমের সম্ভাবনাকে এখানে তুলে ধরেছো তুমি।
আমার হাত থেকে কাগজের টুকরোটা ফেরত নিতে নিতে পোয়ারো বলে, একটা নাম কিন্তু বারবার আমাদের চোখের সামনে এসেও এড়িয়ে যাচ্ছে যেটা হল চার্লস এস. ভ্যাইস। ওনার কিন্তু পুরোপুরি সবরকমের সুযোগই ছিল অপরাধের। তারওপর ওর একটা নয়, দু-দুটো দারুণ মোটিভ রয়েছে। এটা যদি ঘোড়দৌড় হতো আমি নিঃসন্দেহে ভ্যাইসের ওপরই বাজি ধরতাম।
হ্যাঁ, নিশ্চিতভাবেই মিঃ ভ্যাইস একজন প্রধানতম সন্দেহভাজন। সত্যি কথা বলতে কি, আমার তো ওনাকেই অপরাধী বলে মনে হচ্ছে।
হেস্টিংস, প্রিয় বন্ধু, তোমার একটা বাজে অভ্যাস হচ্ছে তুমি যার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম তাকেই প্রধানতম সন্দেহের তালিকায় ধরে বসো। এগুলো অতিরিক্ত গোয়েন্দা গল্প পড়বার ফল। বাস্তব জীবনে কিন্তু দশবারের মধ্যে নয় বারই থাকে সবরকমের সন্দেহের উর্ধে রাখা হয় আসলে সেই অপরাধটা ঘটিয়ে থাকে।
আমি অপ্রস্তুত গলায় প্রশ্ন করি, সেক্ষেত্রে কি তুমি সেরকম কিছু সন্দেহ করছো?
একটাই খটকা হেস্টিংস, একটাই খটকা, অপরাধের বোল্টনেস, এটাই আমাকে ভাবাচ্ছে সবচেয়ে বেশি, বুঝলে হে ভায়া? অনেক মোটিভই ওই দরজায় এসেই ঠোক্কর খাচ্ছে। কোনও মোটিভকে অবশ্যম্ভাবি বলে ভাবা যাচ্ছে না।
হ্যাঁ, প্রথমেই তুমি সেইরকমই বলেছিলে।
হ্যাঁ, এখনও আমি সেই একই কথাই বলছি। কথাটা বলেই কাগজের টুকরোটাকে দলে মুচড়ে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
আমি প্রতিবাদ করে উঠতেই পোয়ারো বলে ওঠে, না হে এভাবে হবে না। আসলে নানা বিভ্রান্তি থাকলেও ছবিটা ক্রমে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। অর্ডার এন্ড মেথড। এটাই রহস্য অনুসন্ধানের প্রথম পর্যায় হতে হবে।
ঠিক আছে, আমি তার কথায় সায় দিই। তার পরের পর্যায়, মনস্তত্ব। মস্তিষ্কের ধূসর কোষগুলোকে তুখোড়ভাবে খেলাতে হবে। হেস্টিংস এবার তোমার শুতে যাওয়া উচিত।
পোয়ারোর আচমকা প্রসঙ্গান্তরে সরে যাওয়ার ব্যাপারটা আমাকে কিছুটা হতচকিত করে তুললেও আমি দৃঢ় গলায় প্রতিবাদ করি। আমি বলি যতক্ষণ না তুমি শুতে যাচ্ছো আমিও তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না।
খুব ভালো কথা। প্রকৃত বন্ধুর মতো কথা বললে। কিন্তু হেস্টিংস, তুমি তো আমাকে আমার চিন্তায় সাহায্য করতে পারবে না। আর সেই কাজটাই আমাকে জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে।
চিন্তা। আমি তবুও মাথা নাড়ি। তোমাকে চিন্তায় সাহায্য করতে যদিও না পারি, তুমি হয়তো কোনও সূত্র ভেবে বার করতে পারলে সে বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে পারো।
তুমি সত্যিই আমার বিশ্বস্ত বন্ধু। তাহলে এখন এক কাজ করো ওই আরাম কেদারায় গিয়ে বসো।
আমি তাতে আপত্তি করি না। আমি আরাম কেদারায় বসে দোল খেতে থাকি। কখন যে আমার চোখ বুজে আসে আমি নিজেই জানি না।
টেবিলের সামনে চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে দুচোখ বন্ধ করে গভীর মনোসংযোগে কি যেন ভেবে চলেছিল পোয়ারো। সামনের খোলা খাতাটায় কি সব আঁকিবুকি কাটছিল আর মাঝে মাঝেই সেই খাতা থেকে পাতা ছিঁড়ে ওয়েস্টপেপার বক্সে ছুঁড়ে ফেলছিল। ওইসব দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারি নি।
১০. নিক এর গোপন কথা
১০. নিক এর গোপন কথা
ঘুম যখন ভাঙল তখন সকাল হয়ে গেছে। কিন্তু গতরাতে পোয়ারোকে ঠিক যে জায়গায় যেভাবে বসে থাকতে দেখেছিলাম সেইভাবেই সে বসে আছে। কিন্তু ওর মুখের অভিব্যক্তিতে ব্যাপক বদল ঘটেছে। ওর চোখদুটো যেন জ্বল জ্বল করছে। আমি সোজা হয়ে বসলাম। জনতে চাইলাম পোয়ারোর কাছে তুমি কিছু খুঁজে পেয়েছে তাই না?
সে মাথা নাড়ে। সামনের টেবিলটায় আঙুল ঠুকে তাল বাজায়। হেস্টিংস, আমার তিনটে প্রশ্নের ঠিক ঠিক মতো উত্তর দেবে।
তিনটে প্রশ্ন! (১) মাদাম জোয়েল বার্কলি সম্প্রতি কেন ঠিক ঘুমোতে পারছিলেন না? (২) কালো রং ওনার পছন্দ নয়, তবু কেন তিনি সেই কালো রঙের পোষাক কিনেছিলেন অনুষ্ঠানের দিন পরবার জন্য? (৩) গতরাতে কেন তিনি বললেন, আমার এখন বেঁচে থাকার কোনও অর্থ নেই?
আমি বিস্ময়ের চোখে পোয়ারোর দিকে তাকাই। প্রশ্নগুলো নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হল।
উত্তর দাও হেস্টিংস, প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
প্রথম প্রশ্নটার উত্তরে বলা যায়, সম্প্রতি উনি খুবই উদ্বিগ্ন, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিলেন হয়তো। আর কালো রঙ-এর পোক? সব মানুষই তো একটু বদল চায়, হয়তো উনিও তাই চেয়েছিলেন।
আঃ হেস্টিংস, একজন বিবাহিত পুরুষ হয়েও মানবী মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে তোমার কণামাত্রও স্বচ্ছ ধারণা নেই। যদি কোনও মহিলা একবার ভেবে নেয় কোনও বিশেষ রঙ তাকে মানায় না, কখনোই সে সেই রঙ স্পর্শ পর্যন্ত করবে না। আর তৃতীয় প্রশ্ন? সেই ভয়ঙ্কর রাতের অভিজ্ঞতার পর এধরনের কথা স্বাভাবিক বলেই আমার মনে হচ্ছে তাই নয় কি?
না, আমার কাছে মোটেই সেটা স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। নিজের সম্পর্কিত বোনের মৃত্যুর পর সেই ভয়াবহতায় আক্রান্ত হয়ে কেউ নিজেকে সেই ঘটনার জন্যে দায়ী ভাবতেই পারে। সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার। উনি ক্লান্ত ভাবেই জীবনের কথা বলেছিলেন। যেটা তার কাছে তত প্রিয় নয় তেমন।
এরকম মানসিকতা ওর আগে ওর মধ্যে কখনও আমরা দেখিনি। এর আগে ওর নানা ভঙ্গী, মানসিকতা আমরা দেখেছি। অবিশ্বাসী, একগুঁয়ে, তুড়ি মেরে সব উড়িয়ে দেওয়া, ভয়ার্ত, সবরকম। কিন্তু সেসব মুহূর্তে জীবন ওনার কাছে ছিল মধুরতম। তিনি মৃত্যুকে ভয় পেয়েছিলেন সেসব মুহূর্তে। কিন্তু জীবন ওনার কাছে ক্লান্তিকর হয়ে ওঠেনি কখনও। না, কখনও নয়। মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন। হেস্টিংস, বড়সড়, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন চরম বিস্মিত করেছে তাকে। কি এমন ঘটেছিল সে রাতে, যাতে মাদাম জোয়েলের দৃষ্টিভঙ্গীতে এত বিরাট একটা পরিবর্তন ঘটে যায়। কিন্তু মনে রেখো হেস্টিংস মিস ম্যাগির মৃত্যুটাকে ধরা ছিল না, আমি সেই পরিবর্তনের কারণ হিসাবে। কি হতে পারে সেটা?
নাহ, আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
ভাব হেস্টিংস, ভাব, মস্তিষ্কের গ্রে সেলগুলোকে ব্যবহার করো।
সত্যি কথা বলতে কি……… আমার অসহায় ভঙ্গি দেখেই, কথা শেষ করতে না দিয়েই পোয়ারো বলে ওঠে, শেষবার আমরা ওনাকে ভালভাবে, খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করার সুযোগ পেয়েছিলাম?
সম্ভবত রাতে খাওয়া-দাওয়ার সময়।
ঠিক তাই। তারপর আমরা ওনাকে অতিথিদের অভ্যর্থনা করতে, তাদের স্বাগত জানাতে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। পুরোপুরিই গৃহকর্ত্রীর ভূমিকায়। রাতের খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে কি ঘটেছিল তোমার মনে আছে হেস্টিংস?
হ্যাঁ, একটা টেলিফোন এসেছিল, উনি সেটা ধরতে গিয়েছিলেন।
যাক, শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা তাহলে তুমি ধরতে পেরেছে। মাদাম জোয়েল টেলিফোনটা রিসিভ করতে উঠে গিয়েছিলেন তা অন্তত পক্ষে মিনিট কুড়ি হবে। আর সেই সময়টা একটা টেলিফোনের জন্য যথেষ্ট বেশি সময় নয় কি? এতসময় টেলিফোনে ওনার সঙ্গে কে কথা বলেছিল এবং সে কি বলেছিল। আদৌ কি সত্যিই টেলিফোন এসেছিল? তুমি কি নিশ্চিত? কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। এখন আমাদের কাছে প্রধান কাজ ব্যাপারগুলো ভালভাবে নিরীক্ষণ করে দেখতে হবে যে ওই সময় অর্থাৎ ওই কুড়ি মিনিটে ঠিক কি ঘটেছিল?
তুমি সত্যি–এরকম কিছু ভাবছ?
হ্যাঁ, ভাবছি।
হেস্টিংস, আমি তোমাকে আগেই বলেছি না মাদাম জোয়েল সব কথা আমাদের বলেন নি, একটা কিছু গোপন করে গেছেন–আসলে উনি যে কথাগুলো চেপে গেছেন তার সঙ্গে এই খুন বা আগের খুনের প্রচেষ্টার সম্পর্ক রয়েছে তা তিনি আদৌ বুঝতে পারছেন না বলেই হয়তো বলেন নি। কিন্তু আমি পুরোপুরি অনুমান করছি যে গতকাল খুন এবং আগের খুনের প্রচেষ্টার সঙ্গে সেই কথাগুলোর যোগসাজস অবশ্যই রয়েছে।
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, সত্যি যদি মাদাম জোয়েলের না বলা কথাগুলোর সঙ্গে এই রহস্যের কোনও যোগাযোগ না থাকত তাহলে ঘটনাটা আমার কাছে ব্যাখ্যা করা খুবই সরল হয়ে উঠত। ওই মিসিং ফ্যাক্টরটাই আসলে আমার কাছে সদর দরজা খোলার আসল চাবি। কিন্তু দুঃখের কথা, মাদাম জোয়েল সেটা বুঝতে পারছেন না। কিন্তু আমি জানি হেস্টিংস, আমি ঠিকই বলছি।
পোয়ারো কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। সামনের চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে দুচোখ বুজে কি যেন ভাবতে থাকে। খানিকক্ষণ পরে বলে ওঠে।
আমাকে প্রথমে ওই তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তাহলে…… তাহলে……
আমি তড়িঘড়ি আরাম কেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। গতকাল এই আরাম কেদারায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। সারাটা রাত এখানে কেটে গেছে আমার। ঘাড় থেকে মেরুদণ্ড বেয়ে একটা অস্বস্তিভাব হচ্ছে। পোয়ারোকে একলা বসে ভাববার সুযোগ করে দিয়ে আমি সোজা বাথরুমে ঢুকে প্রাতঃকর্মের সঙ্গে স্নানপর্বও শেষ করে নিলাম।
স্নান সেরে সোজা ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে বসলাম। খবরের কাগজটায় চোখ বোলাতে শুরু করলাম। না, নতুন সেরকম কোনও খবর নেই। শুধু একটা খবর ছেপেছে, মাইকেল, সেটনকে এখন মৃত বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। সম্ভবত আর ওনার জীবিত ফিরে আসবার কোনও সম্ভাবনা নেই। আর মাঝের পাতায় ছেপেছে–সমুদ্রতীরবর্তী অনুষ্ঠানে রহস্যজনকভাবে যুবতী খুন। মনযোগ সহকারে রিপোর্টটা পড়লাম। সেরকম কোনও তথ্য পেলাম না। অনুমান ভিত্তিক আষাঢ়ে গল্প জুড়ে দিয়ে ছেপেছে। ততক্ষণে প্রাতরাশ এসে গেছে। আমি প্রাতরাশে মন দিলাম। আমার খাওয়া প্রায় শেষের দিকে তখনই মিসেস রাইসের উদয় ঘটল। তিনি সোজা এসে আমার টেবিলেই বসলেন। আমি কৌতূহলী চোখে তাকাতে উনি বললেন, আপনি কি জানেন, উনি এখন ঘুম থেকে উঠেছেন কিনা?
হ্যাঁ, চলুন, আমি আপনাকে ওর কাছে নিয়ে যাচ্ছি।
ধন্যবাদ।
পোয়ারোর কাছে নিয়ে যাবার পথে আমি প্রশ্ন করলাম, অপনি কি খুন হওয়া মেয়েটিকে চিনতেন?
একবার মাত্র দেখেছিলাম স্কারবরোঘ-তে। নিকের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে এসেছিল একদিন।
যদিও মহিলার কথা বলার ভঙ্গিতে আমার মনে হচ্ছিল না যে উনি খুব একটা শক্ পেয়েছেন বলে। মহিলা আসলে খুবই আত্মকেন্দ্রিক।
পোয়ারো ইতিমধ্যেই ঘরেই ওর প্রাতরাশ সেরে নিয়েছিল। ফ্রেডরিকাকে দেখে সে সাদর অভ্যর্থনার সঙ্গে বসবার জন্যে চেয়ার এগিয়ে দিল। মৃদু হেসে এবং ধন্যবাদ জানিয়ে ফ্রেডরিকা আসন গ্রহণ করল।
বলুন, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি।
মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি একটা কথা সুনিশ্চিত ভাবে জানতে চাই–গতকাল রাতে যে দুঃখজনক ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটল তার আসল লক্ষ্য কি নিক ছিল?
কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। কথা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নাড়ে পোয়ারো।
স্থির চোখে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে উনি বললেন, নিক তো সবসময় হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল ভাবে বাঁচতে চেয়ে এসেছে।
হ্যাঁ, ভাগ্যের খেলায় ওপর নীচ তো আছেই। জীবন সর্বদা মসৃণ নয়। পোয়ারো নিজের মতো করে বলে।
আমার মনে হচ্ছে, এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা অর্থহীন।
বিষাদ ছাড়াও ফ্রেডরিকার এই কথাগুলোর মধ্যে একটা চোরা স্রোতটান ছিল যা আমি স্পষ্টই অনুভব করতে পারলাম। ওর মধ্যে একটা দুঃশ্চিন্তার ছাপও লক্ষ্য করলাম।
দু’এক মুহূর্ত নীরব থেকে সে আবার বলে, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার তরফে তো বটেই, নিকের হয়েও। সত্যি কথা বলতে কি, গতকাল রাতের ওই ভয়ঙ্কর ঘটনার আগে আমরা কেউই পরিস্থিতির ভয়ঙ্করতা বুঝে উঠতে পারিনি। বিশেষ করে আমি তো স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে পরিস্থিতিটা এতোটাই গম্ভীর।
তাই বুঝি? পোয়ারো হাসলেন।
ওর চোখে খুশির চেয়ে চঞ্চলতা বেশি জাগ্রত রয়েছে এটাও লক্ষ্য করলাম।
আমি এবার খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারছি, নিকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের যে বৃত্তটা রয়েছে তাদের মধ্যে নয়। ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর, বিরক্তিজনক, কিন্তু বাস্তব। আমি ঠিক বলছি তো মঁসিয়ে পোয়ারো?
আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। পোয়ারো সংক্ষিপ্ত ভাষায় মন্তব্য করে।
আপনি আগে একদিন আমাকে টাকিস্টক নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন না মিঃ পোয়ারো। আমি বুঝতে পারছি, আজ নয়তো কাল আসল সত্যিটা আপনি জেনে যাবেন, কিন্তু আসল সত্যিটা হচ্ছে আমি টাকিস্টকে ছিলাম না।
তাহলে কোথায় ছিলেন?
আমি আর মিঃ লাজারুম গত সপ্তাহের প্রথমদিকে এই অঞ্চলে এসেছিলাম। শেলকম্বে নামের ছোট্ট একটা জায়গায় আমরা ছিলাম।
ওহ, এখান থেকে সাত মাইল দূরে। তাই তো?
হাঁ, ঠিক ধরেছেন।
এবার হঠাৎ পোয়ারো প্রশ্ন করে, মিঃ লাজারুমের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব কতদিনের ম্যাডাম?
মাস ছয় আগে আমাদের আলাপ-পরিচয় হয়।
হুম, আর আপনারা একজন অন্যজনের প্রতি…….. কথা অসম্পূর্ণ রেখে পোয়ারো একদৃষ্টে চেয়ে থাকে ফ্রেডরিকার চোখের দিকে।
ফ্রেডরিকা কাঁধ বাঁকায়। উনি বেশ ধনী।
আহ, পোয়ারো মাথা নেড়ে বলে, আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর কিন্তু এটা নয়।
এবারে ফ্রেডরিকার মুখে সলজ্জ হাসির রেখা ফুটে উঠতে লক্ষ্য করলাম। বলল, আমার হয়ে আপনিই বলুন না, নিজের মুখে কি বলব?।
পোয়ারো এবার হাসে, ওয়েল, সেটা আপনি নিজের মুখে না বললেও আসলে সত্যিটা সত্যিই। আমি আবার আপনাকে বলছি ম্যাডাম, আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী।
বেশ, তাহলে খুব তাড়াতাড়ি আমাকে একটা ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট দিয়ে দেবেন। বলেই ফ্রেডরিকা উঠে দাঁড়ায়।
আমাকে আপনার আর কিছু বলার নেই তো মাদাম জোয়েল?
ফ্রেডরিকা পোয়ারোর দিকে তাকায়, নাঃ আপাতত নেই।
এবার একবার অন্তত নিককে দেখে আসি সে বেচারা কেমন আছে?
বাঃ খুব ভাল কথা। আপনার সঙ্গে খোলামেলা ভাবে কথাবার্তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
পোয়ারোর কথাগুলো শুনে ফ্রেডরিকা একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসে। ভাবলাম কিছু হয়তো বলবেন উনি। কিন্তু কিছু না বলে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। আমি দরজা খুলে ধরতে উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মহিলা অতি বুদ্ধিমতী ঠিকই কিন্তু এরকুল পোয়ারোও তো কম নয়। মহিলা চলে যাবার পর পোয়ারো মিটিমিটি হাসে।
আমি প্রশ্ন করি, কি বলতে চাইছো তুমি?
পোয়ারো সরাসরি কোনও উত্তর দেয় না আমার প্রশ্নের। শুধু বিড়বিড় করে বলতে থাকে, মিঃ লাজারুম অত্যন্ত ধনী মানুষ। আমাকে এটা গিলতে বাধ্য করা হয়েছে….
আমি পোয়ারোর কথা শুনে অবাক চোখে তাকাই তার দিকে। জঘন্য, জঘন্য ব্যাপার তাহলে সেটা। না বলে পারি না।
সবসময় ভুল জায়গায় সঠিক প্রতিক্রিয়াটা দেখানোর ব্যাপারে তোমার জুড়ি নেই হেস্টিংস। আসলে তুমি যা বলতে চাইছে, লাজারুমের অর্থের প্রসঙ্গ তুলে মাদাম সঠিক রুচির পরিচয় দেন নি, এ মুহূর্তে আমাদের সেটা বিচার করার সময় নয়। ভেবে দেখো হেস্টিংস, যদি মিসেস রাইসের একজন ধনী বন্ধু থাকেন যে তার সব চাহিদাই পূরণ করতে সক্ষম, তাহলে নিশ্চিতভাবেই মাদাম রাইস তার প্রিয়তম বন্ধুকে সামান্য কিছু অঙ্কের অর্থ প্রাপ্তির লোভে খুন করার চেষ্টা করতে হবে না নিশ্চয়ই।
হ্যাঁ, ঠিকই তো।
আমার মাথায় এ ব্যাপারটা তো আসেই নি। যদিও এটা একটা সম্ভাবনা মাত্র। কিন্তু পোয়ারো, তুমি ওকে নার্সিংহোমে যেতে বাধা দিলে না কেন?
বোকার মতো বলো না হেস্টিংস। আমি কেন তাকে বাধা দিতে যাব। আমার ভূমিকাটা ওর কাছে প্রকাশ করে দিতে যাব কোন দুঃখে শুনি? যদি আমি বাধা দিতে যাব তাহলে নার্সিংহোমের ডাক্তার, নার্সরা রয়েছেন কেন? ভুল আইডিয়া, তুমি তো জানো, হাসপাতালের ওইসব অক্লান্ত নার্সেরা নিয়ম কানুনের ব্যাপারে খুব কড়া এবং কর্তব্যনিষ্ট হয়।
যদি ওরা ওকে যেতে দেয়? সেই আশাঙ্কাটা কিন্তু থেকেই যায়। হয়তো নিকই তার প্রিয় বান্ধবীকে ভিতরে যাবার জন্য জেদ ধরে বসে, তখন?
সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকো হেস্টিংস। শুধু তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউই সে সুযোগ পাবে না হেস্টিংস। হ্যাঁ, আমাদের আর দেরি না করে এবার হাসপাতালের, দিকে রওনা হওয়া উচিত। পোয়ারোর কথা শেষ হয়নি আর ঠিক তখনই আমাদের বসবার ঘরের দরজাটা খুলে গেল। দেখলাম জর্জ শ্যালিঙ্গার হুড়মুড় করে ঘরের ভেতরে ঢুকে এলেন।
মিঃ পোয়ারো, এসব কি ব্যাপার? ওই বিদঘুঁটে, হতচ্ছাড়া নার্সিংহোম, যেখানে নিক ভর্তি আছে। আমি ওকে দেখতে চাইলাম, ওরা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করল, ডাক্তারের নাকি বারণ আছে। একটু থেমে রাগে গজগজ করতে করতে তিনি আবার বললেন, এসবের মানে কি? আমি জানতে চাই? নিক সত্যিই কি খুব মানসিক আঘাত পেয়ে অসুস্থ?
দুঃখিত মঁসিয়ে, এ ব্যাপারে আমি কি করতে পারি? আমারি কিছু করার নেই। নার্সিংহোমের নিজস্ব আইন, রীতিনীতির মধ্যে আমি নাক গলাতে পারি না।
দেখুন মিঃ পোয়ারো, আমাকে ওসব বোঝাতে আসবেন না। আমার কাকা হারলে স্ট্রীটের একজন ডাক্তার, স্নায়ু বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিশ্লেষক। নিয়ম-কানুন আমিও কম জানি না। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আত্মীয়-বন্ধুদের দূরে সরিয়ে রাখা এটা কি কোনও কারণ হতে পারে? আমি বিশ্বাস করিনা যে নিক এতটাই অসুস্থ যে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কারও সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করতে পারবে না। আসলে এসবের পিছনে রয়েছেন আপনি মিঃ পোয়ারো।
পোয়ারো খুব নরম ভঙ্গিতে হাসল।
আমি বরাবরই পোয়ারোকে লক্ষ্য করে দেখেছি পোয়ারো প্রেমিকদের প্রতি অতিশয় সহানুভূতিশীল। কখনও কখনও পক্ষপাতিত্ব করে বসে। পোয়ারো সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে শুনুন, আমার কথা মন দিয়ে শুনুন–যদি একজন দর্শনার্থীকে ভেতরে যেতে দিতে হয়, তাহলে সবাইকেই যেতে দিতে হবে, তাই নয় কি?
বুঝতে পেরেছি, আপনার কথা বুঝতে পেরেছি, ধরা গলায় বলে শ্যালিঙ্গার। কিন্তু তবুও……..
পোয়ারো হঠাৎ ওর জোড়া দু ঠোঁটের ওপর আঙুল সোজা ভাবে চেপে ধরে বলে, শো-স-স, আর কোনও কথা নয়, এতক্ষণ আমাদের মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছে সেটা ভুলে যাব আমরা। তাই তো?
ঠিক আছে, আমার মুখ দিয়ে আর একটা কথাও বের হবে না। শ্যালিঙ্গার দৃঢ় গলায় বলে।
এখন অতি গোপনীয়তাই হবে আমাদের একমাত্র মন্ত্র, কথাটা ভুললে চলবে না।
বুঝলাম। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার এবার উঠে দাঁড়ান, দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে যাবার সময় মুহূর্তের জন্য পিছন ফিরে তাকিয়ে বলেন, আশাকরি রোগিনীকে ফুলের তোড়া পাঠানোতে নিশ্চয়ই কোনও বাধানিষেধ নেই?।
পোয়ারো মৃদু হাসে।
শ্যালিঙ্গার চলে যাওয়ার পরে পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার, মাদাম রাইস ও মঁসিয়ে লাজারুম এরা তিনজনে ফুলের দোকানে না মারামারি শুরু করেন। এই ফাঁকে আমরা নিঃশব্দে চলো আমাদের গন্তব্যস্থলের রওনা হই। পৌঁছেই প্রথমে প্রশ্ন তিনটের উত্তর জানতে চাইব। যদিও উত্তরগুলো আমি জানি।
কিন্তু কখন তুমি উত্তরগুলো জানতে পারলে?
কেন, যখন আমি প্রাতরাশ করছিলাম,
আমাকে বল।
না, মাদামজোয়েলের নিজের মুখে সব শোনার জন্য ধৈর্য ধর হেস্টিংস।
ব্যাপারটা থেকে আমার মন ঘোরাবার জন্যই সম্ভবত পোয়ারো আমার দিকে একটা খোলা চিঠি এগিয়ে দিল।
এটা হল সেই ছবি বিশেষজ্ঞর দেওয়া রিপোর্ট। যাকে নিকের বাড়িতে সেই বিশেষ ছবিটার মূল্যায়ন করতে পোয়ারো পাঠিয়েছিল। সেই বিশেষজ্ঞই স্পষ্টই জানিয়েছেন, ছবিটার মূল্য কয়েক পাউণ্ডের বেশি মোটেই হবে না। সুতরাং, একটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া গেল।
আসলে ইঁদুরের গর্তে কোন ইঁদুরই নেই। আমিও পোয়ারোরই বলা উক্তিটা তুলে ধরি।
আমার উক্তিটা তুমি মনে রেখেছ দেখছি, কিন্তু সত্যিই কি তাই হেস্টিংস? কোনও ইঁদুর যদি নাই থাকবে, মিঃ লাজারুম এই ছবিটার জন্য কয়েকগুণ বেশি দর হেঁকেছেন কেন? একজন উঠতি চিত্র ব্যবসায়ীর নিছক মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে গলদ? শুধুই কি তাই?
এ সব কথা আলোচনা করতে করতে আমার নার্সিংহোমে পৌঁছে গেলাম। দোতলার একটা ঘরে আমাদের পৌঁছে দেওয়া হল। ছোটো খাটো চেহারার একজন নার্স আমাদের দেখে এগিয়ে এল। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে সে হাসিমুখে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, কাল রাতে মিস বার্কলি খুব ভাল ঘুমিয়েছেন।
নিক বিছানায় আধশোয়া বসে আছে। খুব ভাল সময় এসেছেন মিঃ পোয়ারো।
পোয়ারো নিকের একটা হাত নিজের দুহাতের মধ্যে নিয়ে বলল, সাহস, মাদাম জোয়েল সাহস। সব সময়ই বেঁচে থাকবার কোনও না কোনও একটা কারণ থাকে।
কথাগুলো নিককে কেমন বাঁকিয়ে দেয়। নিক অদ্ভুত চোখে পোয়ারোর মুখের দিকে তাকিয়েই থাকে। পোয়ারোও তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আপনি কি এখনও আমাকে বলবেন না ম্যাডাম, কেন আপনি অত্যন্ত উদ্বেগ আর দুঃশিন্তার মধ্যে ছিলেন? চেষ্টা করব? ঠিক আছে মাদামজোয়েল, আমার তরফ থেকে আপনার জন্যে রইল গভীর সমবেদনা।
নিমেষে নিক বার্কলির মুখটা কেমন রক্তশূন্য হয়ে গেল।
তাহলে আপনি জানেন সব? যদিও এখন আর কে কি জানল তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। এখন সব কিছু শেষ। আমি আর কখনো ওকে দেখতে পাব না। বলতে বলতে নিকের কণ্ঠস্বর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
সাহস রাখুন ম্যাডাম, সাহস রাখুন। আমি আপনাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি, মনকে শক্ত করুন।
আমার মনে আর সাহস অবশিষ্ট নেই। গত সপ্তাহগুলোয় একের পরে এক আঘাত আমার সমস্ত মনোবল ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।
আমি ঘনঘন দুজনের মুখের দিকে তাকাতে থাকি। ওদের কথাবার্তার বিন্দুবিসর্গ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
পোয়ারোও বুঝে নিয়েছে যে বন্ধু হেস্টিংস এসবের মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। আমরা কি নিয়ে কথা বলছি তার কিছুই জানে না সে।
অসুখী চোখদুটো এবার আমার চোখের সঙ্গে খেলে বেড়ায়। মাইকেল সেটন। আমি ওনার বাগদত্তা ছিলাম। তিনি মারা গেছেন।
.
১১.
মোটিভ
আমি নির্বাক। ধাতস্থ হবার বেশ কিছুক্ষণ পর পোয়ারোর দিকে ফিরে আমি বললাম, তুমি তাহলে এটাই বোঝাতে চাইছিলে?
অবশ্যই। সকালে।
কি করে বুঝলে তুমি? মানে অনুমান করলে কি করে?
সোজা ব্যাপার, খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। তারপরই কাল রাতে খাওয়া দাওয়ার সময়ের সমস্ত কথাবার্তা আমার মনে পড়ে গেল। ছবির মতো পরিষ্কার হয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠল সব।
তারপর পোয়ারো আবার নিকের দিকে ফেরে। গতরাতেই আপনি খবরটা শুনেছিলেন?
হ্যাঁ, রেডিওতে, ফোন আসবার পর ধরবার নাম করে আমি অন্য ঘরে চলে যাই। আমি সন্ধ্যের বেতার সংবাদটা শুনতে চেয়েছিলাম। যদি কোনও আশার খবর পাওয়া : যায়। প্রাণপণে উঠে আসা কান্নাটাকে গিলে নেবার চেষ্টা করতে করতে সে বলে, তারপর…… শুনলাম……..
শান্ত হোন, শান্ত হোন।
পোয়ালরা নিকের হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চাপ দেয়।
মারাত্মক, ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। এদিকে সবাই আসতে শুরু করেছে। আমি যে কি করব। পুরো ব্যাপারটাকে সামলাব কি করে কিছুই বুঝতে পারছি না। সব কিছুকে কেমন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। নিজেকেই যেন দেখতে পাচ্ছি আমি, বাইরে থেকে।
একটু থেমে সে সঙ্গে সঙ্গে, যেন বলতে ভুলে গেছে, এভাবে যোগ করে, ব্যাপারটা যথেষ্ট কষ্টদায়কও।
বুঝতে পারছি। স্বাভাবিক। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কি যেন ভাবে নিক। তারপর যখন সে আবার কথা বলে ওর গলায় কেমন একটা অসহায় আর্ততা ফুটে ওঠে।
ফ্রেডরিকার জন্যে গায়ে দেবার জিনিসটা আনতে গিয়ে আমি একলা হবার সুযোগ পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। ম্যাগি নীচের তলা থেকে বারবার চিৎকার করছিল তাড়াতাড়ি করবার জন্যে। শেষ পর্যন্ত আমার ছেড়ে রাখা শালটাকেই গায়ে দিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। আমি চোখের জল ভাল করে মুছে, কান্নার দাগ ঢাকতে মুখে একটু পাউডার বুলিয়ে ফ্রেডরিকা আর ম্যাগির কোট নিয়ে একতলায় নেমে আসি। বাড়ির বাইরে বের হতেই……… ম্যাগিকে দেখতে পাই….. পড়ে রয়েছে…… মৃত……..।
সত্যি, একটা দারুণ শক, নিঃসন্দেহে।
না, আপনি বুঝতে পারছেন না। আমি ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম। এটা আমার হবার কথা ছিল, আমি হলে পারতাম। আমার সেরকমই ইচ্ছে করছিল। আমি মরে যেতে চাইছিলাম, অথচ আমি দিব্যি বেঁচে আছি। আর আমাকে নিরাপত্তা দিতে সে বেচারি ম্যাগি বেঘোরে মারা গেল। মাইকেল মারা গেল বহু দূরে প্যাসিফিক সমুদ্রের জলে ডুবে।
বেচারা। পোয়ারো সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করে।
আমি বাঁচতে চাই না। আমি বেঁচে থাকতে চাই না। বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে চলে সে।
আমি বুঝতে পারছি মাদাম জোয়েল, আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এইরকম একটা পর্ব কখনও না কখনও আসে কিন্তু সময়ই সব কিছুকে ভুলিয়ে দেয়। শোক দুঃখকে অতিক্রম করে জীবন এগিয়ে চলে।
আপনি ভাবছেন, অল্প কয়েক দিনের মধ্যে আমি দুঃখ ভুলে যাব, অন্য কাউকে বিয়ে করব। কান্না মেশানো সুরে কথাগুলো বলে নিক।
না, না, আমি সেরকম কিছুই ভাবছি না। পোয়ারো শান্ত গলায় সহানুভূতির গলায় বলে, আপনি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মাদাম। একজন যথার্থ সাহসী মানুষের ভালবাসা পেয়েছিলেন আপনি কিন্তু ওনার সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েছিল কি ভাবে?
গত সেপ্টেম্বর, লা টকটেউ-তে, প্রায় এক বছর আগে।
আর আপনাদের এনগেজমেন্ট হয়েছিল কবে?
ক্রিসমাসের দুদিন পরে। কিন্তু ব্যাপারটাকে সেটন-এর ইচ্ছেতে গোপন রাখা হয়েছিল।
কেন?
মাইকের কাকা ম্যাথু সেটন পাখি খুব ভালবাসেন। আর উনি মহিলাদের দারুণ ঘৃণা করেন।
তার কারণ জানতে পেরেছিলেন?
মাইকেল যতটুকু বলেছিল–উনি একটু আধপাগল ধরনের ছিলেন। ওনার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল নারী পুরুষের জীবন ধ্বংস করে দেয়।
কিন্তু মিঃ সেটন কেন ব্যাপারটাকে মেনে নিয়েছিলেন?
মাইকেল পুরোপুরি ওনার ওপর নির্ভরশীল ছিল। মাইকেলের ব্যাপারে উনি অত্যন্ত গর্বিত ছিলেন। মাইকেলের বিশ্বব্যাপী উড়ান যানটি তৈরি করা এবং অন্যন্য সমস্তরকম আর্থিক খরচ বহন করছিলেন ম্যাথু কাকা। মাইকেলের ইচ্ছে ছিল বিশ্ব সফর থেকে ফিরে এসেই সে আমাদের বিয়ের কথা ঘোষণা করবে।
বেশ, বুঝলাম। পোয়ারো গম্ভীর গলায় মাথা নাড়ে।
মাইকেল বলেছিল, কোনওভাবে যেন আমাদের এনগেজমেন্ট-এর খবরটা ফাঁস না হয়ে যায়। যদি হয় তাহলে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হবে। ম্যাথু কাকা সবরকমের আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দেবেন আর উড়ানের মাধ্যমে তার বিশ্ব সফর মাইকেলের সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল বলে সেটা আমি গোপন রাখব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তাকে। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রেখেছি। আমার প্রিয় বন্ধু ফ্রেডিকেও এ ব্যাপারে কিছুই বলিনি।
পোয়ারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, শুধু আমাকে যদি একবার ব্যাপারটা জানাতেন।
নিক পোয়ারোর দিকে তাকায়, তাতে কি লাভ হতো? আমার ওপর হামলা বা হত্যার চেষ্টাগুলোর সাথে মাইকেলের তো কোনও যোগাযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, এসব কথা গোপন রাখার একটা প্রতিক্রিয়া আমার মনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। সারাক্ষণ একটা চাপা ভয়, দুশ্চিন্তা আমার মানসিক চাপ প্রচণ্ড বাড়িয়ে তুলেছিল যা এক অসহ্যকর অবস্থায় আমাকে উপনীত করেছিল।
হ্যাঁ, সেটা তো আমরা সবাই দেখেছি। পোয়ারো নিকের কথায় সায় দেয়।
এর আগেও মাইকেল একবার নিখোঁজ হয়েছিল, সেটা আপনি নিশ্চয়ই জানেন। হ্যাঁ, ভারতের দিকে যাবার পথে মরুভূমির মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। মাইকেল সেটা আমাকে বলেছিল। সে ঘটনাও খুব ভয়ঙ্কর ছিল, যার থেকে শেষ পর্যন্ত ও বের হয়ে আসতে পেরেছিল। আর আমিও এবার নিজেকে বারবার বলতাম এবারও সেরকম কিছু একটা হবে। আবার নিজেকে বোঝাতাম–সে যতই বিপদের মুখে পড়ুক না কেন, সব বাধা কাটিয়ে সে ফিরে আসবেই। অন্যেরা যখন বলতো সে মারা গেছে, তখন আমি আমার মনকে বোঝাতাম, সে বেঁচে আছে, সুস্থ আছে, সে ফিরে আসবেই। সবাই ভুল বলছে। আর……… তারপর………… কাল রাতে…………. ওর কথাগুলো ক্ষীণ হতে হতে যেন হাওয়ায় মিশে যায়।
পোয়ারো অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে–আমি বুঝতে পারছি, আপনার মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি।
এবার হঠাৎ করে পোয়ারো একেবারে অন্য প্রসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আচ্ছা মাদাম, মিঃ ভাইস-এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
নিক হকচকিয়ে যায় পোয়ারোর অপ্রাসঙ্গিক কথায়। প্রশ্ন করে চার্লস হঠাৎ ওর কথা আপনার মাথায় এল কেন?
না, না, এমনিই। আমি শুধু জানতে চাইছি। কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে নয়।
এমনিতে চার্লসের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালোই। তবে একটু ভীতু স্বভাবের মানুষ সে। কখনও সে এই জায়গাটা ছেড়ে অন্য কোথাও যায়নি।
মাদাম জোয়েল আমি শুনেছি, তিনি নাকি আপনার প্রতি নিবেদিত প্রাণ?
এবার নিকের মুখে খানিকটা বিব্রতভাব ফুটে ওঠে। হয়তো। তবে চার্লসের অনেক কিছুই আমার অপছন্দ। আমার জীবনযাত্রার ভঙ্গি, আমার ককটেল পার্টি, আমার বন্ধুরা, আমার কথাবার্তা, আসলে ও ভাবে আমার জীবনের মুড অপরিপক্ক, ও সবসময় আমাকে রিফর্ম করবার কথা চিন্তা করে, আশা করে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর হঠাৎ নিক তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়, ওর চোখ দুটোয় এক অদ্ভুত ঝিকিমিকি আলো খেলে যায়। কিন্তু এই খবরটা আপনাদের কানে পৌঁছে দিল কোন মহানুভব?
পোয়ারো মৃদু হাসে এই প্রশ্নে। কোনও উত্তর দেয় না। তারপর সেই ফিচেল মার্কা হাসিটা মুখে ধরে রেখেই সে বলে, যাইহোক ম্যাম, আপনি আপাতত এখানেই থাকবেন, হ্যাঁ। এখানকার সব নিয়মকানুন মেনে চলবেন। মনে রাখবেন এখানে যা কিছু হবে আপনাকে যা কিছু করতে বলা হবে তার সব কিছুই হবে আমারই নির্দেশে।
নিক এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আপনার নির্দেশই মেনে চলছি। এখন আর আমি কি করছি না করছি তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
যাইহোক, আমরা এবার উঠব। আপনার দুঃখে আর বেশিক্ষণ অনধিকার প্রবেশ করব না। আমরা উঠে দাঁড়াই। দরজার দিকে পা বাড়াই। হঠাৎ পোয়ারো ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, মাদাম একটা কথা মনে পড়ে গেল। আপনি একটা উইল করেছিলেন বলে আমায় জানিয়ে ছিলেন মনে পড়ে?
হ্যাঁ,
সেটা এখন কোথায় আছে?
ওহ, সেটা? এই আছে, কোথাও এদিক সেদিক।
পোয়ারো বলে এন্ড হাউসে নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ, এন্ড হাউসে তো বটেই।
এন্ড হাউসের কোথায়? নিশ্চয়ই কোনও নিরাপদ স্থানে। আপনার ডেস্কে, তালাচাবি দেওয়া তো?
উমম, আমি ঠিক বলতে পারব না। আসলে কাগজপত্র গুছিয়ে রাখার ব্যপারে আমি খুব একটা পটু নই। রেখেছি কোথাও। তবে নিশ্চিত করে বলতে পারব না সেটা কোথায় রেখেছি। খুঁজে দেখতে হবে। তবে হ্যাঁ, লাইব্রেরিতে একটা লেখার টেবিল আছে। তার চারটে ড্রয়ারেই আমি আমার সমস্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, বিল, ভাউচার হিসাবপত্র রাখি। সম্ভবত ওই টেবিলের কোনও এক ড্রয়ারেই নিশ্চয়ই ওটা রেখে থাকতে পারি।
পোয়ারো এবার সবিনয় ভঙ্গিতে বলে, আপনি কি আমাকে উইলটা খুঁজে দেখার অনুমতি দেবেন?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আপনি যদি চান অবশ্যই দেখতে পারেন। যা খুশি খুঁজে দেখতে পারেন আপনি।
ধন্যবাদ মাদাম জোয়েল, আপনার বদান্যতা এবং ভদ্রতার তুলনা নেই।
.
১২.
এলিন
নার্সিংহোম থেকে বের হবার পর দীর্ঘক্ষণ পোয়ারো কোনও কথা বলল না। তারপর একসময় সে আমার কব্জির কাছটা চেপে ধরল, তুমি দেখলে হেস্টিংস? আমি ঠিক বলেছিলাম। কিছু একটা ছিল, কিছু একটার অভাব, ছোট্ট একটুকরো ধাঁধা। যেটার অভাবেই সেই হারিয়ে যাওয়া সূত্রটার অভাবেই গোটা ব্যাপারটা অর্থহীন হয়ে যাচ্ছিল। ওর এত আনন্দ, উচ্ছ্বাসের কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কি এমন ঘটেছে? এগোনোর মতো কি কোনও জোরালো সূত্র পাওয়া গেছে?
অথচ দেখো, ব্যাপারটা সবসময়েই কিন্তু আমাদের চোখের সামনে ছিল। আমি দেখতে পাই নি। কি করে দেখতেই বা পাব? কিছু একটা অবশ্যই আছে, জানতে হলে আমাকে তো বুঝতে হতো সেই বিশেষ কিছুটা কি? এবং কেন?
পোয়ারোর বিড়বিড়ানি আমার কাছে ডাচ বা জার্মান ভাষার মতোই দুর্বোধ্য মনে হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে প্রশ্ন না করে পারলাম না। তুমি কি অপরাধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এরকম কিছু তথ্য, সূত্র বা ঘটনা খুঁজে পেয়েছ?
তুমি দেখতে পাওনি?
সত্যিটা হচ্ছে, না পাইনি। আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম।
হায় ভগবান, এটাও সম্ভব? আমরা যা খুঁজছিলাম সেই পথ নির্দেশ পেয়ে গেলাম।
আমি অনেক ভেবে বললাম, মোটিভ, অস্বচ্ছ মোটিভ বা কোনও ধরনের ঈর্ষা বোধ, তুমি কি সেরকম কিছু ইঙ্গিত করছ?
ঈর্ষা? না, বন্ধু না। সেই সাধারণ মোটিভ, টীকা, বন্ধুর টীকা, পোয়ারো শান্ত গলায় কথাগুলো বলে গেল।
কোন কথা না বলে আমি খরচোখে ওর দিকে তাকালাম।
মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে ম্যাথু সেটন মারা গেছেন। আর উনি ছিলেন কোটিপতি। ইংল্যন্ডের অন্যতম ধনী ব্যক্তি।
হ্যাঁ, ঠিকই….কিন্তু।
ওনার কাছে আত্মীয় বলতে আছে একমাত্র ভাইপো। যাকে তিনি ভীষণ রকম ভালবাসতেন। আমরা বিনা দ্বিধায় ধরে নিতে পারি, স্যার ম্যাথু তার সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী তাকেই করে গিয়েছেন।
মাইকেল সেটনকে? পোয়ারোর কথার মাঝে আমি জানতে চাই। আসলে ব্যাপারটা আমার কাছে তখনও একটা ধাঁধার মতো মনে হচ্ছিল। আমার কথায় আমল না দিয়ে পোয়ারো আমাকে বোঝাবার ভঙ্গিতে বলে চলে, গত মঙ্গলবার মাইকেল সেটন নিখোঁজ হলেন আর মাদাম জোয়েলকে প্রথম হত্যার চেষ্টাটা ঘটল বুধবার। এরপর থেকে একের পর এক মাদামের ওপর হামলা হয়েই চলল। হেস্টিংস, আমি নিশ্চিত, মাইকেল সেটন অনিশ্চিয়তায় ভরা উড়ান যাত্রায় পাড়ি দেবার আগে একটা উইল করেছিলেন।
এবার আমার কাছে ব্যাপারটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকল। পোয়ারো কথাগুলো আরো একটু গুছিয়ে বলে, মাইকেল সেটন তার সেই উইলে সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করেছিলেন তার সদ্য বাগদত্তাকে।
আমি বলি, পোয়ারো সমস্ত ব্যাপারটা তুমি কিন্তু আন্দাজে ধরে নিয়ে বলছ।
হ্যাঁ, তোমার কথা ঠিক।…. আমি কেবল অনুমান করেছি মাত্র। কিন্তু সঙ্গে এটাও ঠিক যে ঘটনাটা এইরকমই ঘটেছে–ঘটতে বাধ্য, আমার থিয়োরিতে বলে অন্যরকম ঘটতে পারে না। আর সত্য যদি অন্য কিছু ঘটত তাহলে এই অপরাধগুলো ঘটত না। তাছাড়া ভেবে দেখ, টাকার অঙ্কটা মোটেই কিন্তু সামান্য কিছু নয়, বিশাল অঙ্কের টাকা, যা অকল্পনীয় ব্যাপার।
আমি আর কোন কথা বললাম না। আমার মনের মধ্যে ব্যাপারগুলো কেবল ঘুরপাক খেতে লাগল। আমার মনে হচ্ছিল একটা হঠকারী পদ্ধতিতে ঘটনাটা পরিণতির দিকে এগোতে চাইছে। যা অসম্ভব। অথচ, আমার মনের ভেতর থেকে অন্য একটা কণ্ঠ বলছিল, পোয়ারোই ঠিক, পোয়ারোর এক স্বচ্ছন্দগতিময় অসাধারণত্ব রয়েছে বরাবর সঠিক থাকবার। হয়তো সেটাই আমাকে পোয়ারোর চিন্তার স্বপক্ষে ভাবতে, সহমত হতে, প্রভাবিত হতে। সঙ্গে অবশ্য এটাও আমার মনে হল, ব্যাপারটাকে প্রমাণ করতে পোয়ারোকে এখনও বহু পথ হাঁটতে হবে।
তোমার থিয়োরির সবচেয়ে বড় দুর্বলতাটা কিন্তু, এনগেজমেন্টের খবরটা কেউই জানে না, জানত না। তাই নয় কি? আমি তর্কের গলায় বলি।
না, না, আমি তা বিশ্বাস করি না। জানে, নিশ্চয়ই কেউ জানতো। সত্যি কথা বলতে কি কেউ একজন সবসময়ই পুরো ব্যাপারটা জানতো। যদি বা নিশ্চিত ভাবে না জেনেও থাকে, সঠিক নিখুঁত ভাবে আন্দাজ করেছিল। মাদাম জোয়েল রাইস কিছুটা সন্দেহ করেছিলেন সম্পর্কের ব্যাপারটা। গত রাতের ডিনারে ওর কথা নিক তো প্রায় মেনেই নিয়েছিলেন, অনেকটাই, নিজের নিশ্চিত বিশ্বাস থেকেই যদি মাদাম জোয়েল রাইস প্রসঙ্গটা তুলে থাকেন সে রাতে?
কিন্তু উনি কি ভাবে আন্দাজ করতে পারবেন?
অনেক রকম ভাবেই সম্ভব। যেমন ধরো মাইকেল সেটনের কোনও প্রেমপত্র যদি ওনার নজরে পড়ে থাকে? আমরা তো ইতিমধ্যে নিশ্চিত ভাবেই জেনে গিয়েছিলাম, কাগজপত্র গুছিয়ে রাখবার ব্যাপারে মিস বার্কলি অত্যন্ত অসতর্ক। সুতরাং এই সম্ভাবনাটা খুবই প্রবলভাবে থাকছে।
এবার আমি চিন্তান্বিত গলায় বলি, তোমার কি মনে হয় মিসেস রাইস বান্ধবীর উইলের ব্যাপারটা জানেন?
নিঃসন্দেহে। পোয়ারো দ্ব্যর্থহীন ভঙ্গিতে উত্তর দেয়। তারপর, একঝলক কি যেন ভেবে নিয়ে বলে ওহহহ, ভাল কথা। আমার তালিকাটা। তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই? সন্দেহভাজনদের সেই তালিকাটা? ক,খ,গ,…. নাহ, আর অত দূর এগোবার দরকার নেই। তালিকাটা কাটছাঁট করে খুব ছোট্ট করে এনেছি মাত্র দুইজনে।
আমি অবাক গলায় বলি, মাত্র দু’জন?
পোয়ারো খুশি খুশি ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, আমার কথায় সায় দেয়, হা।
আমি কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গারকে বাদ দিচ্ছি। যদিও প্লাইমাউথ থেকে এখানে আসতে তিনি আড়াই ঘণ্টা সময় নিয়েছিলেন। মাত্র তিরিশ মাইল দূরত্ব পার হতে কোনোমতেই অতটা সময় লাগবার কথা নয়। তবুও……..। লম্বা নাকের মিঃ লাজারুমকেও হেঁটে ফেলেছি। যদিও মাত্র কয়েক পাউন্ড দামের একটা ছবিকে বেশ কয়েকগুণ বেশি চড়া দামে কেনবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। খুবই অস্বাভাবিক। যাইহোক আমি অস্ট্রেলিয়ান দম্পতিদেরও বাদ দিচ্ছি। আমাদের তালিকাটাতে তবু কয়েকজন সন্দেহজনক থেকে যাচ্ছেন।
ফ্রেডরিকা রাইস তাদের একজন।
অবশ্যই। তিনি নিঃসন্দেহে তালিকার প্রথম দিকে থাকবেন। উইল অনুযায়ী (নিক বার্কলির) মাদাম জোয়েলের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া হবার সুত্রে অর্থকরী দিক দিয়ে তিনিই নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন। শুধু এন্ড হাউস নয়, গত রাতে মাদাম জোয়েল ম্যাগি বার্কলির পরিবর্তে নিক মারা গেলে, মাদাম জোয়েলে রাইস আজ সকালে প্রচুর সম্পত্তির মালিক একজন ধনী মহিলা হয়ে যেতেন।
আমি ব্যাপারটাকে বিশ্বাস তো দূরের কথা, ভালভাবে হজম করতে পর্যন্ত পারছিলাম না।
তার মানে তুমি বলতে চাও এরকম একজন সুন্দরী মহিলা যে খুনী হতে পারে তুমি বিশ্বাস করতে পারছ না?
পোয়ারো কৌতুকের চোখে আমার দিকে তাকায় তারপর আবার বলতে শুরু করে, জুরিদের মধ্যেও অনেকসময় এই ধরনের মানসিকতা দেখা যায়, তবে তুমি হয়তো ঠিক বলেছ, আরও একজন প্রধানতম সন্দেহভাজন রয়েছে।
কে? তীব্র কৌতূহলের গলায় প্রশ্ন করে, চার্লস ভ্যাইস? কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে সে তো শুধুমাত্র বাড়িটুকুই পেতে পারে বা পাবে।
হ্যাঁ, সম্ভবত সেকথা সে জানে না। তিনি স্বয়ং কি মাদাম জোয়েলের উইল তৈরি করেছেন? সম্ভবত না। তা যদি হত, তাহলে মোটেই নকিং এরাউন্ড সাম হোয়ার এই বাক্যবন্ধই তো ব্যবহার করেছিলেন মাদাম জোয়েল? না সেরকম ও আচরণ করত না। সুতরাং হেস্টিংস, এটাই স্বাভাবিক যে তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। সুতরাং মিঃ ভাইসের ধারণা থাকতে পারে মাদাম জোয়েল কোনো উইল করেন নি। সেক্ষেত্রে ওর আশা হতে পারে মাদাম জোয়েলের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় হিসাবে তিনি মাদাম জোয়েলের অবর্তমানে সম্পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন।
এটা আমার কাছে অনেক বেশি সম্ভব বলে মনে হচ্ছে।
তোমার রোমান্টিক মনই একথা বলছে হেস্টিংস। কুচক্রী আইনজীবী, অসৎ, খল, গল্প-উপন্যাসে যেমন দেখা যায়। তাছাড়া ওর চেহারাটাও মোটেই তেমন সুবিধের নয়। খলনায়ক হবার মতো সবরকম উপাদান ওর মধ্যে অবশ্যই রয়েছে, তোমার মত অনুযায়ী, তবে হাঁ, এটা ঠিক যে, পিস্তলটা হাতিয়ে নেবার এবং ব্যবহার করা সবচেয়ে ভাল সুযোগ ওনারই ছিল।
আর পাহাড়ের চাতাল থেকে অতবড় পাথরটা গড়িয়ে দেবার সুযোগ একমাত্র কোন পুরুষেরই রয়েছে।
হয়তো ঠিকই বলেছ। তবে কোন কিছুর সাহায্যে চাড় দিয়ে পাথরটা সহজেই কোন মহিলাও নাড়িয়ে ফেলতে পারে। আর এটা একটা মহিলার অপরাধী বুদ্ধিজনক ঘটনা। আর যেভাবে পাথরটা ভুল সময়ে ফেলে মাদাম জোয়েলকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করেছে, সেটা দেখে কাজটা কোনো মহিলারই বলে মনে হচ্ছে। আবার গাড়ির ব্রেক খারাপ করে রাখাটা পুরোপুরি পুরুষ অপরাধমনষ্কতারই প্রমাণ যদিও আজকাল অনেক মহিলারই গাড়ি বিষয়ে পুরুষের সমতুল্য জ্ঞানগম্যি থাকে। গাড়ির মেকানিক হিসেবেও তারা দক্ষ হন। তবে, অবশ্যই দুই-একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে মিঃ ভ্যাইসের বিরুদ্ধে থিয়োরিটাতে।
যেমন? আমি কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করি।
মাদাম জোয়েল রাইসের তুলনায় ওর এনগেজমেন্টের ব্যাপারটা জানতে পারবার সম্ভাবনা কম। সেক্ষেত্রে ওর মত একজন পাকা বুদ্ধির আইনজ্ঞের ঝোঁকের বশে তাড়াহুড়ো করে কোনো কাজ করে বসা, না ওর চরিত্রের সঙ্গে ব্যাপারটা একেবারেই মানাচ্ছে না। বিশেষ করে, সেটনের মৃত্যুর খবরটা যখন মাত্র কাল রাতেই জানতে পারা গেল।
আমরা পাহাড়ী, বাঁকাচোরা পথ ধরে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। এইভাবে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় আমরা এন্ড হাউসের দরজায় পৌঁছে গেলাম। দরজা ঠেলে ঢোকবার পর আমরা দেখলাম মধ্যবয়সী এক পুরুষ এক মনে ঘাস হেঁটে চলেছে। আমরা বুঝলাম, এই হচ্ছে বাড়ির মালি, অর্থাৎ এলিনের স্বামী। আমরা ওকে অতিক্রম করে ড্রইংরুমে এসে ঢুকলাম। আমি দরজার ঘণ্টাটা বাজালাম। কয়েক মুহূর্ত পরই যথারীতি টিপটপ, কালো পোশাকে সজ্জিতা এলিন এসে হাজির হল। আমাদের দেখে সে মোটেই বিস্মিত হল না। পোয়ারো ওকে জানাল আমরা মিস বার্কলির অনুমতি নিয়ে এসেছি, ঘরটা তল্লাশি করবার জন্যে।
ঠিক আছে স্যার।
পোয়ারো প্রশ্ন করে, পুলিশের কাজ শেষ হয়েছে?
হ্যাঁ, স্যার, ওরা সব, কাজ শেষ করে চলে গেছেন।
এলিন এবার ঘর ছেড়ে বের হবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। আর ঠিক তখনি পোয়ারো ওকে থামিয়ে দিয়ে একটা প্রশ্ন করে, গত রাতে তুমি যখন শুনলে মিস ম্যাগি বার্কলি গুলিতে মারা গেছেন, খুব অবাক হয়েছিলে কি?
হ্যাঁ, স্যার নিশ্চয়ই। খুবই অবাক হয়েছিলাম। মিস ম্যাগি অত্যন্ত চমৎকার মহিলা ছিলেন। তার এই ভাবে মৃত্যু………. আমি তো চিন্তা করতে পারি না। একমাত্র কেউ শয়তানি বুদ্ধির মানুষ থাকতে পারে যে মিস ম্যাগির ক্ষতি করতে চাইছে।
যদি অন্য কেউ মারা যেত, খুন হত, বোধহয় এত অবাক হতে না। তাই না? পোয়ারোর এই প্রশ্নে এলিন সহসা চমকে ওঠে, থতমত খেয়ে যায়। আপনার কথার সঠিক অর্থ আমি বুঝতে পারছি না স্যার।
কাল রাতে যখন আমি এ ঘরে আসি, তুমি আমাকে প্রশ্ন করেছিলে, কেউ কি আহত হয়েছে? কারও আঘাত লেগেছে? তুমি কি সেই ধরনের কিছু আশা করেছিলে? বা সেইরকম কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছিলে?
এলিন চুপ মেরে যায়। বাক্য হারা। হাতের আঙুলগুলো দিয়ে শেষ প্রান্তের ভাজে আঙুল বোলাতে থাকে। যেন সেগুলো সোজা করার চেষ্টা করছে। সেইভাবেই বিড়বিড় করে বলে, বুঝবেন না, আপনারা বুঝবেন না।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বুঝব। পোয়ারো বলে, যত আশ্চর্য অবাক হবার মত অসাধারণ কথাই আমি ঠিকই বুঝতে পারব। তুমি বরং কষ্ট করে কথাটা বলেই ফেল হে। পোয়ারোর গলায় প্রবল ব্যঙ্গ। এলিন ওর দিকে যথেষ্ট সন্দেহ নিয়ে তাকায়। তারপর মনে হল মনকে আশ্বস্ত করে, পোয়ারোকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে, আপনি তো নিজের চোখেই দেখছেন স্যার। বাড়িটা ভাল নয়। মনের জড়তা, দ্বিধা কাটিয়ে অবশেষে বলে। আমি ওর কথায় প্রায় আকাশ থেকে পড়লেও পোয়ারোকে দেখে মনে হল না কথাগুলো ওর কাছে আদৌও অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।
তুমি বলতে চাও বাড়িটা পুরনো। তাই তো?
হ্যাঁ, স্যার। এবং বাড়িটা ভালো নয়।
আচ্ছা এলিন, এই বাড়িতে তুমি কতদিন যাবৎ রয়েছ?
ছয় বছর। তবে তার আগে অল্প বয়সেও আমি এই বাড়িতে কাজ করেছি। রান্না ঘরে। রান্না পরিচারিকা হিসেবে। যেটা ছিল বৃদ্ধ স্যার নিকোলের সময়। পোয়ারো প্রখর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
এইসব পুরনো বাড়িগুলোতে অশুভ ছায়া পড়ে। ব্যগ্র গলায় এলিন বলে চলে।–আপনি দেখতে পাবেন না। কিন্তু হাওয়ায় সেই অশুভ পরিবেশ টের পাবেন। আমি সবসময় জানতাম এ বাড়িতে অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে।
পোয়ারো মাথা নীচু করে কি যেন ভাবে। তারপর স্পষ্ট চোখে এলিনের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি সঠিক প্রমাণিত হয়েছ।
হ্যাঁ, স্যার সত্যি, ওর গলায় একটা নিশ্চিত আত্মপ্রসাদের চোরাটান ছিল। কিন্তু তুমি ভাব নি এটা ছিল ম্যাগি। পোয়ারো বাঁকা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে। না, সত্যি স্যার। আমি ভাবতে পারিনি। ওনাকে সবাই ভালবাসতো।
আমি ধরতে পারলাম এলিনের কথাগুলো একটা সূত্র। আশা করলাম পোয়ারো এবার সেটা ধরে সুতো গোটাবে।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে পোয়ারো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল, তুমি গুলি ছোঁড়ার শব্দ পেয়েছিলে?
না স্যার, আসলে বাজি ফাটছিল অনেক। খুব শব্দ হচ্ছিল। গুলির আওয়াজ আলাদা করে বোঝবার উপায় ছিল না।
তুমি বাজি পোড়ানো দেখতে যাও নি?
না স্যার, আমার তখনও বাসন ধোওয়া বাকি ছিল।
তোমার সাহায্যকারী হিসাবে কে ছিল?
কেউ না স্যার। সবাই বাজি পোড়ানো দেখতে চলে গিয়েছিল।
তুমি যাওনি কেন? বাজি পোড়ানো দেখতে তোমার ভাল লাগে না?
হ্যাঁ স্যার, নিশ্চয়ই ভাল লাগে। তবে আমি আগে হাতের কাজ সেরে নিতে চেয়েছিলাম।
ওহ, খুব ভাল কথা! তাহলে তুমি শুনেছিলে মাদাম জোয়েল ম্যাগি তার কোট চাইছিলেন?
না স্যার, আমি শুনলাম মিস নিক সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন। তারপর মিস ম্যাগি একতলা থেকে কিছু একটা চেয়ে কয়েকবার তাড়া দিলেন। এবং তারপর বললেন–আমি কালো শালটা নিয়ে নিচ্ছি।
এক মিনিট। তুমি কথাগুলো শুনেও কোটগুলো খুঁজে দিতে যাওনি, প্রয়োজন বোধ করনি কেন এলিন?
আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি স্যার, আমি হাতের কাজ সারতে ব্যস্ত ছিলাম। পোয়ারো এবার সরাসরি বিদ্ধকারী চোখে এলিনের দিকে তাকায়।
মহিলা দুজনেও তোমায় ডাকেন নি। কারণ তারা জানতেন, প্রতি বছরের মতো, এবারও তুমি বাইরে বাজি পোড়ানো দেখছো। আচমকা এলিনের গাল, চিবুকে রক্তের ছোপ দেখা গেল।
আপনি কি বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি না। হ্যাঁ, আমাদের বাগানে যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু অন্যবারের মতো এবার যদি আমি বাজি পোড়ানো দেখতে না যাই, কাজ সেরে তাড়াতাড়ি বিছানায় যেতে চাই, সেটা নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই নয় কি?
আমি তোমাকে কোনওভাবে মনে আঘাত দিতে চাই নি। তুমি কেন তোমার ইচ্ছে মতো কাজ করবে না? অবশ্যই তা পারো। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকবার পর সে আবার বলে এলিন, আর একটা ছোট্ট ব্যাপার, আশাকরি এই ব্যাপারটাতে তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে। এটা তো একটা বহু পুরনো বাড়ি। তুমি কি জান, এই বাড়িতে কোনো লুকনো, গোপন কক্ষ বা খুপরি আছে?
এই ঘরেই একটা সেরকম জিনিস আছে, পাশ থেকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া যায়। খুব ছোট বেলায় একবার দেখেছিলাম। তবে, এত বছর পর এখন আমি হুবহু মনে করতে পারছি না, সেটা ঠিক কোথায় রয়েছে।
একজন মানুষের লুকিয়ে থাকবার পক্ষে সেটা যথেষ্ট বড়?
না, না, স্যার। সেরকম কিছু নয়। একটা কাবার্ড ধরনের জিনিস। দেড়-দু ফুট চওড়া। চৌকো আকৃতির।
ওহ, তাহলে যেটা আমি যা খুঁজছি, চাইছি তা নয়। আমি দেখলাম, এবং চরমতম বিস্মিতও হলাম।
এলিনের গালে চিবুকে আবার সেই রক্ত ছোপ লেগেছে। আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি কোথাও লুকিয়ে ছিলাম, তা নয় স্যার। তা নয়। আমি মিস নিককে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসতে এবং বাইরে বের হয়ে যাবার পদ শব্দ শুনি। তারপরই আর্তচিৎকার, কান্না শুনতে পেয়ে এঘরে ছুটে আসি। ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি। এটাই সত্যি। এটাই সত্যি, ঈশ্বরের দিব্যি।
.
১৩.
চিঠিগুলো
পোয়ারো এরপর এলিনকে শান্ত করে এবং সান্ত্বনার প্রলেপ লাগিয়ে ফেরত পাঠাল। তারপর চিন্তাজর্জরিত মুখে আমার দিকে ফিরে তাকাল। এলিন সত্যি কি গুলির শব্দ শোনেননি? নাহ্ সেটা হবার সম্ভাবনা না খুব কম। আমার বিশ্বাস সে শব্দ শুনেছিল। রান্না ঘরের জানালা খুলে বুঝবার, দেখবার চেষ্টা করেছিল। তারপর নিককে সিঁড়ি নেমে আসতে, বের হয়ে যেতে শোনে। নিকের আর্তচিৎকার শুনতে পেয়েই সে এঘরে এসেছিল কি ঘটেছেবুঝতে। এটা ঘটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সন্ধ্যেতে কেন সে বাজি পোড়ানো দেখতে বাগানে গেল না? এটাই জানতে চাইবার, এর পিছনে কারণটা কি?
নিছকই কৌতূহল। মনে রেখো, ঝ’-কে আমরা এখনো সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারিনি।
ঝ? প্রবল বিস্ময়ে প্রশ্ন করি আমি।
হ্যাঁ, মনে নেই? আমার সন্দেহ তালিকার শেষ নাম। অজানা সন্দেহভাজন। সে কে আমরা এখনও জানি না। তবে, এখন আমার ক্রমে সন্দেহ হতে শুরু করেছে ওই ঝ’ কোনোভাবে এলিনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, ঘটনার রাতে সে এই বাড়িতে এসেছিল। গোপন কুঠুরীতে লুকোয়। একটি যুবতাঁকে কালো শাল জড়িয়ে যেতে দেখে তাকে নিক বলে ভেবে নেয় (বা ভুল করে) এবং তাকে গুলি করে। অবশ্যই, অনুসরণ করে বাইরে যাবার পর। যদিও আমরা জেনেছি এই বাড়িতে কোনো লুকনো কুঠুরী নেই। সে রাতে এলিন কেন বাজি পোড়ানো দেখতে বাগানে যায় নি। সে রহস্য আমাকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। তবে তার আগে এসে মাদাম জোয়েলের উইলটা খুঁজে দেখি।
বাইরের ঘর খুঁজে কোনো কাগজপত্র পাওয়া গেল না। এরপর আমরা লাইব্রেরি ঘরে পৌঁছলাম। আধো অন্ধকার ঘর। ঘরটাতে বেশ বড় বড় ওয়ালনাট টেবিল। বেশ খানিকক্ষণ সময় গেল এই ঘরটাতে খুঁজতে। কারণ পুরো ঘরটা চূড়ান্ত অগোছাল অবস্থা। নানারকম বিল ও রিমিট, জমা দেওয়া টাকার রসিদ মিলে মিশে একাকার। বহু পুরনো চিঠি, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের, স্কুপ হয়ে রয়েছে নানা জায়গায়। প্রায় আধঘণ্টা পরে পোয়ারো একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল, সবই আমার মোটামুটি যাচাই করে দেখেছি। কিছু বাদ যায় নি। হঠাৎ পোয়ারো আমার দিকে একটা গোটা কাগজ ছুঁড়ে দেয়। একটা চিঠি। বেশ বড় বড় অক্ষরে হাতের লেখা।
প্রিয়তম,
পার্টি সত্যি সত্যি চমৎকার হয়েছে। আজকের দিনটা বেশ উষ্ণ। আশাকরি তুমি ওই জিনিসটা স্পর্শ করবে না। আবার শুরু কর না, প্রিয়তম। অবশ্য, ছেড়ে দেওয়াটা সত্যি সত্যি বড্ড কঠিন। আমার বয়ফ্রেণ্ডটিকে লিখছি দ্রুত সরবরাহ করতে। জীবন কি নরক সমতুল্য।
—তোমার, ফ্রেডি।
গত ফ্রেব্রুয়ারির তারিখ দেওয়া দেখছি। চিন্তিত গলায় পোয়ারো বলে। উনি যে ড্রাগ নেন তা অবশ্য প্রথমবার ওর দিকে তাকিয়েই আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
সত্যি আশ্চর্য, আমি কখনও ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। অবাক গলায় আমি বলি।
সেটা খুবই স্বাভাবিক। তুমি শুধু ওনার চোখ দেখতে, সৌন্দর্য উপভোগ করতে কিন্তু কোনদিনই ওনার মুড বোঝবার চেষ্টা করনি। কখনও সেটা প্রবলভাবে প্রাণোচ্ছল, আবার কখনও চরমভাবে প্রাণহীন, বিষাদগ্রস্থ। অবসন্নতায় আক্রান্ত। যা কখনও খুব স্বাভাবিক নয়।
মাদক গ্রহণ তো মরাল-সেন্সকে অ্যাটাক করে তাই না?
অবশ্যই, তবে মাদাম জোয়েল রাইস সেভাবে মাদকাগ্রস্থ নন। সবে হয়ত শুরু করেছেন।
আর নিক?
নাহ, মাদাম জোয়েলকে দেখে মনে হয় না উনি মাদকে অভ্যস্থ। হয়তো নেহাত মজা বা অ্যাডভেঞ্চারের জন্য মাঝে মাঝে ভোপ পার্টিতে যান। তবে, সেভাবে মাদক নেন না। আমি কথাটা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, এবং মুখে সেটা প্রকাশও করে ফেললাম। যাক, বাঁচা গেল। পোয়ারো হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়, যাক, চল এবার মাদাম জোয়েলের-ঘরটা একটু খুঁজে দেখা যাক।নিকের ঘরে এসে হাজির হলাম আমরা। এই ঘরেও একটা বেশ বড়সড় ডেস্ক রয়েছে। তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেখানে উইলটার চেহারা দেখা গেল না। শুধুমাত্র নিকের গাড়ির রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত কাগজপত্র ছাড়া আর কোনওরকম গুরুত্বপূর্ণ কাগজই সেখানে পাওয়া গেল না।
পোয়ারো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, এইসব অল্পবয়সী মেয়েরা, এদের ঠিকঠাকভাবে মানুষই করা হয়না বুঝলে হে। শৃঙ্খলা, গোছানো পদ্ধতি, এসব এদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। একটা ঘোট, চেষ্ট ড্রয়ার ঘাঁটাঘাঁটি করতে শুরু করে এরপর। ঠিকই চলছে। বেশ খানিকটা লজ্জিত ভাবেই তাকিয়ে থাকার পর, ওকে না বলে পারি না। পোয়ারো, কি হচ্ছে? মহিলাদের অন্তর্বাস রয়েছে দেখছ না ওখানে? নিজের কাজ চালিয়ে যেতে যেতে পোয়ারো ছোট্ট মন্তব্য করে, তাতে কি? আমি বিস্ময়ের গলায় প্রশ্ন করি, তুমি কি আশা করছ ওখানে……. হো হো করে প্রবল হাসির গমকে ফেটে পড়ে সে, হেস্টিংস, তুমি তখনও সেই ভিকটোরিয়ান যুগেই পড়ে রয়েছ। আরে আজকের আধুনিক যুবতীরা আর তাদের অন্তর্বাস নিয়ে লজ্জিত হয় না। তবুও আমার মনে হয় এটা আমরা পারি না।
না, বন্ধু, আমার মনে হয় না মাদাম জোয়েল নিক এসব ব্যাপারে খুব রক্ষণশীল। লুকোচুরি পছন্দ করেন না। তাহলে তো ড্রয়ারটাকে তিনি বন্ধ করেই রাখতেন। তাই না? পোয়ারোর যুক্তিগুলো আমাকে মোটেই কাবু করতে পারে না। বেশ দৃঢ় গলায় আমি প্রশ্ন করি, তবু এসবের কি প্রয়োজন আছে খুব?
এবার, এতক্ষণে পোয়ারো আমার দিকে ফিরে তাকায়, সে কথা যদি বল বন্ধু, কোথায়-কখন-কিভাবে যে প্রয়োজন তাকে কেউ বলতে পারে না। পোয়ারো এবার অন্তর্বাসের স্তূপের নীচ থেকে তার হাত বের করে আনে।
বাদামী একটা মোটা খাম, গোলাপী রিবন জড়িয়ে বাঁধা। সম্ভবত, মাইকেল সেটনের প্রেমপত্রের গোছা। শান্ত গলায় বলে সে। ততোধিক শান্তভঙ্গিতে সে গোছা খুলে ফেলে রিবনের বাঁধন থেকে, তারপর চিঠিগুলো বের করে পড়তে আমি আর্তচিৎকার করে উঠি স্ক্যানডালাইজড হয়ে গিয়ে। তুমি কিন্তু এটা কিছুতেই করতে পার না। খুব বেশি রকম বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কোন ছেলেখেলা নয় মোটেই এটা।
আমি মোটেই ছেলেখেলা করছি না বন্ধু। আচমকাই ওর মন তীক্ষ্ণ, তীব্র হয়ে ওঠে। আমি একজন, খুনিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
হ্যাঁ, কিন্তু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র……
এগুলো হয়ত কিছুই বলবে না, আবার হতে পারে অনেক কিছুই বলে দেবে। আমাকে সব প্রত্যেকটি সুযোগই নিতে হবে বন্ধু। এস, তোমাকেও চিঠিগুলো আমার সাথে পড়তে হবে। একজোড়া চোখের চেয়ে দুজোড়া চোখ অনেক বেশি কার্যকরী হতে পারে। যদিও ব্যাপারটা আমার একেবারেই পছন্দ হচ্ছিল না। যদিও, আমি বুঝতে পারছিলাম পোয়ারোর পক্ষে সব দিকগুলো, সম্ভাব্য সবকটি পথ হাতড়ে দেখাই উচিত, সঠিক কাজ। পোয়ারো আমাকে অবাক করে হঠাৎ বলে মনকে সান্ত্বনা দিতে চাইলে, ভেবে নাও, তোমার আমার অনেক আগেই নিশ্চিতভাবেই এলিন এগুলো সবকটাই পড়ে ফেলেছে। যদিও আমি মনের বিরুদ্ধে গিয়েও কাজটা করতে সান্ত্বনা খুঁজে নিলাম নিকের বলা কয়েকটা শব্দ, শেষ কথাগুলো, যা ইচ্ছে হয়, যেখানে খুশি খুঁজে দেখতে আপনারা যা ইচ্ছে করতে পারেন।
পোয়ারো ততক্ষণে একটা চিঠি খুলে পড়তে শুরু করেছে।
নববর্ষ প্রিয়তমা,
শুভ নববর্ষ। আমার নতুন বছরের রিজিলিউশন একটা মিষ্টি ব্যাপার। তোমাকে আরও-আরও ভালোবাসা। আমার জীবনটাতে তুমি এসে একেবারে অন্য চেহারা দিয়েছ। প্রথম দর্শন থেকেই আমরা দুজনেই জানতাম–যা ঘটেছে সেটাই আমাদের জীবনের একমাত্র গন্তব্য ছিল। হ্যাপি নিউ ইয়ার, আমার মিষ্টি সোনা।
—তোমার চিরদিনের মাইকেল।
ফ্রেব্রুয়ারী ৪
প্রিয়তমা,
আমাদের মধ্যে কি আরও ঘনঘন দেখা হতে পারে না? সত্যি বড় বিশ্রী ব্যাপার। এমন একটা ব্যস্ততার মধ্যে জড়িয়ে গিয়েছি। তোমাকে তো সব কথাই বলেছি। আবার আমাদের সম্পর্কটাকে নিয়েও এমন ছলনার আশ্রয় নিতে হচ্ছে। আমি জানি তুমি মিথ্যে এবং ছলনা কতটা ঘৃণা কর। আমিও করি। তবু এছাড়া কোন উপায় নেই। এই মুহূর্তে ম্যাথু কাকাকে সব কথা জানানোর অর্থই হচ্ছে পুরো দুধের গামলাটায় কয়েক ফোঁটা চোনা ফেলে দেওয়া। বিয়ে, নারী এসব উনি কতটা ঘৃণা করেন তুমি কল্পনাও করতে পার না।
মন খারাপ কর না সোনা। সব খুব তাড়াতাড়িই ঠিক হয়ে যাবে।
তোমার-তোমারই–মাইকেল।
মার্চ–২
প্রিয়তমা,
আগামীকাল আবার স্কারবরোঘ. যাচ্ছি। সেই স্কারবরোঘ। আমার জীবনটাকে ভগবানের আশীর্বাদধন্য করে তুলেছে যে জায়গা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এই জায়গাটা তাই আমার কাছে। আজ সকালে উঠেই তাই তোমার কথা মনে পড়ল।
প্রিয়তমা, তুমি জান না, আমি তোমায় কতখানি–কতটা ভালবাসি।
—তোমারই মাইকেল।
এপ্রিল–১৮
প্রিয়তমা,
সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। নিশ্চিতভাবেই এই সময়টা সফলভাবে করে ফিরতে পারি (এবং আমি জানি সফল হয়েই ফিরব)। আমি ম্যাথু কাকার সঙ্গে কথা বলব। পুরো ব্যাপারটা ওনাকে জানাব। উনি যদি খুশি না হন, তোমাকে মেনে নিতে না পারেন, আমার তাহলে আর কিছু করার নেই। ওনাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেব আমি তোমাকে বিয়ে করছি। আশা করছি, এই বিশ্ব সফরটাতে সফল হলে অর্থনৈতিকভাবে আমাকে আর ওনার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। সুতরাং, এসব ব্যাপার নিয়ে আর দুশ্চিন্তা কর না।
এদিকের আর সব খবর ভাল। আলবাট্রাস পুরোপুরি তৈরি। এবার শুধু আমার ওড়বার অপেক্ষা। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। ভগবানের কৃপায় সব ঠিকঠাক চলবে।
ভাল থেকো সুইটহার্ট
— তোমার–মাইকেল এপ্রিল ২০ প্রিয়তমা,
আমার দেবীপ্রতিমা, আমার পরী, গত চিঠির উত্তরে তুমি যা-যা বলেছ সবই সত্যি। এই চিঠিটা আমার জীবনের একটা সম্পদ হয়ে সযত্নে রক্ষিত থাকবে। আমি তোমার জন্যে অর্ধেকও উপযুক্ত নই। অন্য সবার থেকে তুমি এতো আলাদা, অন্যরকমের। আমি তোমাকে শ্রদ্ধাবশত ভালবাসি। আমার কাছে তুমি এক অতি মহার্ঘতম বস্তু।
—তোমার—মাইকেল
শেষ চিঠিটা আশ্চর্যজনক ভাবে তারিখ বিহীন।
প্রিয়তমাসু,
আমি আগামীকাল উড়ছি। অত্যন্ত উৎসাহী এবং উত্তেজিত বোধ করছি। সাফল্য সম্বন্ধে অবশ্য পুরোপুরি নিশ্চিত। আলবাট্রাসও পুরোপুরি প্রস্তুত। আমি জানি সে আমাকে কোন ভাবেই হতাশ করবে না। চিয়ার আপ সুইটহার্ট। আর কোনরকম চিন্তা কর না। হ্যাঁ, ঝুঁকি তো এই কাজটাতে আছেই। কিন্তু জীবনের কোন ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেই?
ভাল কথা, শুভানুধ্যায়ীরা অনেকে পরামর্শ দিল, আমার একটা উইল করে ফেলা উচিত। এরা খুবই বাস্তববাদী নিঃসন্দেহে। তবে এদের পরামর্শটা আমি গ্রহণ করেছি। ক্ষতি কি? ভাগ্যের কথা কে বলতে পারে? সুতরাং, আমি আধপাতার একটা নোট আমার আইনবিদ উইলফ্রেড অ্যান্ড কোম্পানী–তে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। গতকাল উইলটা তৈরি হয়ে এসেছে। কারও মুখে যেন একবার শুনেছিলাম, তিন শব্দের উইল–সব কিছু মায়ের। আমারটাও অনেকটা সেইরকম হয়েছে। তোমার ভাল নাম যে ম্যাগডালা, আমার খেয়াল আছে, চিন্তা কর না। আর হ্যাঁ, উইলকে জড়িয়ে সামান্য বিষাদময় প্রসঙ্গটায় মনে আঘাত পেও না, দুঃখবোধ কর না। করবে না তো, আমার সোনামনি? আমি ঠিক থাকব, ঠিক থাকব। অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতে পৌঁছে তোমাকে টেলিগ্রাম করব। তারপর থেকে যে-যে দেশে পৌঁছব সেখান থেকেও টেলিগ্রাম করব। ভাল থেকো। চিন্তা কর না আমাকে নিয়ে। দেখো, আমি ভালো থাকব। শুভরাত্রি। ভগবান তোমায় ভালো রাখুন —মাইকেল।
পোয়ারো চিঠিগুলোকে আবার ভাঁজ করে রাখে। দেখেছ হেস্টিংস। আমি চিঠিগুলোকে পড়লাম নিশ্চিত হয়ে আর তোমাকে যা বলেছিলাম তাই ঘটল।
তুমি কি সেরকম কোন সূত্র খুঁজে পেয়েছ?
না, না। সেরকমভাবে না হলেও, অন্যভাবে আমি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও প্রমাণ পেয়েছি।
অন্যভাবে? যেমন?
যেমন? যেমন আমরা জানতে পারলাম মাইকেল সেটন আমাদের মাদাম জোয়েলের নামে যে উইলটি করেছেন সেটা একেবারে আইনসিদ্ধ ভাবেই তৈরি করা হয়েছে। যদি অন্য আর কেউ এই চিঠিগুলো পড়ে থাকেন, তিনিও আমাদের মতোই নিশ্চিতভাবে সেই ব্যাপারটা জেনেছেন। আর যেভাবে অত্যন্ত দায়সারা, অসুরক্ষিত অবস্থায় চিঠিগুলো ফেলে রাখা, তাতে যে কেউই সহজে এগুলো পড়ে ফেলতে পারে।
এলিন? এলিন। প্রায় নিশ্চিতভাবে আমরা একটা ছোট পরীক্ষা করব পুরোপুরি নিশ্চিত হতে।
কিন্তু উইলটার তো কোন চিহ্নমাত্র দেখা গেল না? পোয়ারো মাথা নাড়ে। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে, সেটাই তো আমাকে অবাক করছে। তবে, যতদূর মনে হচ্ছে, অন্যমনস্কভাবে উনি জিনিসটাকে কোন আলমারির মাথায় ছুঁড়ে দিয়েছেন, অথবা হয়ত কোন চিনামাটির ফুলদানির মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছেন। মাদাম জোয়েলের স্মৃতিকে উসকে দিয়ে তার মুখ থেকে উইলটার খোঁজ জানতে পারবে অপেক্ষায় থাকা ছাড়া, আপাতত এই ব্যাপারে কিছুই করবার নেই।
আমরা বাইরের ঘরে এসে দেখলাম এলিন ঘরের ধুলো ঝাড়ছে আসবাবের থেকে। পোয়ারো ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার ভান করে বিদায় জানায়। দরজার হাতল টেনে বের হয়ে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়িয়ে আচমকা সে বলে, এলিন, মিস বার্কলি যে বিমান অভিযাত্রী মাইকেল সেটনের বাগদত্তা ছিলেন, এ কথাটাতো বলনি আমাদের? এলিন বাঁকা চোখে তাকায়। কি? কাগজে যাকে নিয়ে খুব লেখালেখি হচ্ছে? আমি ব্যাপারটা একেবারেই জানতাম না। মিস নিকের বাগদত্তা, হে ভগবান।
বাড়ির বাইরে বের হয়ে এসে আমি বললাম, দারুণ অভিনয়। না জানবার, আকাশ থেকে পড়বার ভানটা খুব বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছ। হ্যাঁ, ব্যাপারটা তো একেবারে আসলের মতোই লাগল।
হয়ত ও সত্যি কথাই বলেছে।
হুম। আর ওই চিঠির তোড়া নামের পর মাস ওই অন্তর্বাসগুলোর নীচে অনাবিষ্কৃত থেকে গেছে।
তাহলে ঠিক কি দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা? আমি নিজের মনকে প্রশ্ন করি। আমরা সবাই তো এরকুল পোয়ারো নই। আমরা অপরাধের জগৎ কে এগোবার ক্ষমতাধারী নই। আমরা অপরাধের গন্ধ শুঁকে এগোবার ক্ষমতাধারী নই। এই এলিন… এক রহস্যময় নারী।
পোয়ারো বলে, গভীর চিন্তান্বিত মুখে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে, নাহ, আমার ব্যাপারটা একদম ভাল লাগছে না। একটা হেঁয়ালি যেন। কোথায় যেন কিছু একটা রয়েছে। যা কিছুতেই আমি বুঝতে পারছি না।এক হাত মুঠো করে সখেদে অন্য হাতের তালুতে ঘুষি মারে সে।
.
১৪.
হারিয়ে যাওয়া উইলের রহস্য
আমরা আবার ফিরে গেলাম সোজা নার্সিংহোমে। নিক যথারীতি বেশ অবাক হল আমাদের দেখে।
হ্যাঁ, মাদাম জোয়েল। নিকের সপ্রশ্ন কৌতূহলী দৃষ্টির উত্তর দিয়ে পোয়ারো বলে, আমি এখনও এই কেসের তলদেশটাতে পা রাখতে পারি নি। কিছু কৌতূহলের এখনও, কোন সদুত্তর খুঁজে পাইনি। নিক বার্কলির চোখের কৌতূহলী দৃষ্টি আরও ঘন হয়ে উঠল। সে যেন সুতীব্র দৃষ্টিতে পোয়ারোর মুখে কি খুঁজতে লাগল। সিরিয়াস কথাগুলো সেরে নিই। আমি এসেছি। আপনার সেই, বস্তুটি আমি খুঁজে পাইনি।
ওহ্,নিকের বাঁকা ভুরু এবার সহজ হয়, ওটা নিয়ে আর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে কি? আমি তো মরিনি। আর আমি যতদূর জানি, কোন মানুষ যতক্ষণ না মারা যাচ্ছে তার উইলের কোন দাম বা গুরুত্বই নেই।
যেটা ঠিকই। তবে আমার নিজস্ব একটা অন্য কৌতূহল আছে আপনার এই উইলের ব্যাপারে।
পোয়ারো থামে। এক ঝলকে নিকের মুখটা চকিতে নিরীক্ষণ করে নিয়ে আবার বলে, ভাল করে চিন্তা করুন উইলটাকে ঠিক কোথায় রেখেছেন। মনে করবার আন্তরিক চেষ্টা করুন মাদাম।
নাহ, সেরকম সঠিকভাবে কিছু মনে করতে পারছি না। তবে যতটা মনে করতে পারছি কোন একটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম ওটাকে।
আপনি কোনভাবেই কোন সিক্রেট প্যানেলে রাখেননি তো এটাকে?
সিক্রেট কি? চরম বিস্ময়ের গলায় প্রশ্ন করে নিক।
আপনার পরিচারিকা এলিন আমাকে বলেছে আপনার বাড়ির লাইব্রেরিতে একটা গোপন চেম্বার রয়েছে।
ননসেন্স। আমি কোন দিন এরকম কিছুর কথা শুনিওনি, দেখিওনি কখনও। এলিন আপনাদের এই আষাঢ়ে গল্পটা বলেছে?
আশ্চর্য তো? তাহলে হয়ত অল্পবয়সে সে যখন রান্না ঘরের পরিচারিকা হিসাবে এন্ড হাউসে কাজ করত সে সময় দেখে থাকবে। হয়ত, হতে পারে রাঁধুনিটিই ওকে সেসময় এটা দেখিয়েছিল।
এই প্রথম আমি ব্যাপারটা শুনছি। সেরকম কিছু যদি থাকত ঠাকুরদা নিশ্চয়ই জানতেন। আর সেক্ষেত্রে, তিনি আমাকে অবশ্যই বলতেন। নিশ্চিতভাবেই। মিঃ পোয়ারো আপনি নিশ্চিত এলিন এসব বানিয়ে বলছে না তো?
না মাদাম জোয়েল, আমি এ বিষয়ে একেবারেই নিশ্চিত নই। আপনার এই এলিনের মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। কিছু একটা অস্বাভাবিক…….. গণ্ডগোল……. কোথায় যেন…….. পোয়ারোর কথায় নিক কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলে, আমার অবশ্য সেরকম কিছু কখনও মনে হয়নি। বেশ দায়িত্বশীলই মনে হয়েছে ওকে সবসময়।
পোয়ারোর সে কথা কানে গেল কিনা বুঝলাম না। হাতের পাতা উল্টে নখের দিকে তাকিয়ে এক মনে কি যেন চিন্তা করে যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখ তোলে সে।
আচ্ছা মাদাম, আপনি ওকে বাগানে গিয়ে বাজি পোড়ানো দেখবার ছুটি দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, প্রতিবারেই সবাইকে ছুটি দেওয়া হয়।
তবু সেই রাতে বাজি পোড়ানো দেখতে বের হয় নি সে।
হ্যাঁ, অবশ্যই গিয়েছিল, নিক জোর গলায় দাবি করে।
আপনি কি করে জানলেন মাদাম?
না, মানে ঠিক জানি না। প্রতিবছরই তো ওদের সবাইকে ছুটি দেওয়া হয়। ওরা বাইরে বাজি পোড়ানো দেখতে যায়। সেই হিসাবে বলছি। এবারও নিশ্চয়ই এসেছিল।
না, মাদাম জোয়েল। পোয়ারো মৃদু হেসে মাথা নাড়ে, বরং উল্টোটাই ঘটেছিল। এলিন বাড়ির ভেতরেই ছিল।
কিন্তু কেন? ভারি আশ্চর্য তো? নিকের গলায় বিস্ময়ের পরিবর্তে স্পষ্ট সংশয়।
মাদাম, আপনার এটা আশ্চর্য মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি নিশ্চিত এর আগে কখনও সে এরকম করেনি।
সে কি বলেছে কেন বাইরে যায়নি?
নাহ, সেরকম কিছু নিশ্চিত ভাবে বলেনি। কাজ সারছিল–এইটুকুই।
আশ্চর্য। গোটা ব্যাপারটাই আমার কেমন যেন গোলমেলে লাগছে। আচ্ছা, লুকানো প্যানেলটা ঠিক কোথায় আছে ও আপনাদের দেখিয়েছে?
ও বলেছে এখন মনে করতে পারছে না।
এরকম কিছু আছে, থাকতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
ও এটাও বলেছে বাড়িটা নাকি বাস করবার পক্ষে ঠিক নয়। ওর অস্বস্তি হয় থাকতে।
নিমেষে নিকের মুখ-চোখ বদলে যায়। দু চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। চোখের তারায় আতঙ্কের কালো ছায়া পড়ে, হ্যাঁ, এই কথাটা ও ভুল বলেনি। ইদানিং আমারও কেমন মেনে লাগত এই বাড়িটাতে থাকতে। মাঝে মাঝেই শরীর কেমন ছমছম করে উঠত। আর তাছাড়া………
মৃদু কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ে শরীরে। পোয়ালরা ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে।
মাদাম, আমরা মূল প্রসঙ্গ থেকে ক্রমশই সরে যাচ্ছি। উইল। ম্যাগি বার্কলির উইল। শেষ কোথায় আপনি দেখেছিলেন সেটাকে?
আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। আসলে মিঃ ক্রফট বলেছিলেন উইল বানানোটা খুব কঠিন ব্যাপার। তাই আমি পরপর বেশ কয়কটা খসড়া করেছিলাম। নতুন খসড়া করা হলেই পুরনোটা নষ্ট করে ফেলতাম।
পোয়ারো কৌতূহলী গলায় বলে, মিঃ ক্রফট? তিনি উইলের ব্যাপারটা জানতেন?
হ্যাঁ, উনিই তো প্রথম ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢোকান। উনি বলেছিলেন তুমি যদি সম্পত্তির ভাগ না করা অবস্থায় মারা যাও তাহলে সরকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেবে। তাই উনি আমাকে উইল করে রাখবার কথা বলেছিলেন।
বাহ্। বেশ উপকারী তো ভদ্রলোক পোয়ারো কথায় সায় দেয়।
হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে, উনি তো…….. আহ আমার মনে পড়েছে। উনি এলিন আর ওর স্বামীকে সাক্ষী হিসাবে সই করানোর জন্যেও নিয়ে এসেছিলেন।
কথাটা শোনামাত্র পোয়ারো অর্থপূর্ণ চোখে আমার দিকে তাকায়।
আহ-হ। সত্যি আমি একটা নির্বোধ। আমার মনে পড়েছে ওটা তো চার্লসের কাছে। রয়েছে।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। মিঃ ক্রফট বলেছিলেন একজন আইনবিদই ব্যাপারটার সঠিক দায়িত্ব। নিতে পারবেন।
হুম। মিঃ ক্রফট অবশ্যই ঠিক কথাই বলেছিলেন।
সুতরাং, আমরা ওটাকে একটা খামে বন্ধ করে সোজা চার্লসের কাছে পাঠিয়ে দিই।
তাহলে এই ব্যাপার। পোয়ারো ঠাণ্ডা গলায় কেটে কেটে বলেন।
নিক বালিশে হেলান দিয়ে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আমি সত্যিই অত্যন্ত দুঃখিত। আসলে গত কয়েকদিন ধরে যা চলেছে, মাথা কাজ করছে না।
আপনি যদি সত্যিই ওটা দেখতে চান আপনাকে চার্লসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
আপনার একটা লিখিত অনুমতিপত্র ছাড়া সেটা বোধহয় সম্ভব নয়।
নিক বিস্ময়ের চরমে ওঠা গলায় বলে, আরে না না, তার কোন দরকার নেই।
না, মাদাম জোয়েল, আমার বিনীত অনুরোধ সব কিছুরই একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি থাকে। সবারই সেটা মেনে চলা উচিত।
বেশ। নিক পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে মুখে মৃদু হাসে। বিছানার পাশ থেকে কাগজের প্যাড, কলম টেনে নেয়।
পোয়ারো চিঠিটা হাতে নিয়ে বের হবার উদ্যোগ করে। ধন্যবাদ। আমি সত্যিই ভীষণভাবে দুঃখিত। আপনাকে অনেক সমস্যায় ফেলেছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন। আমার একেবারেই মনে ছিল না। পোয়ারো মৃদু হাসে। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে হাসি মুখেই বলে, বাহ, চমৎকার ফুলগুলো।
নিক উচ্ছ্বাসের গলায় বলে, চমৎকার, তাই না? এই কারনেশানগুলো ফ্রেডির পাঠান। গোলাপগুলো জর্জের, আর জিম লাজারুম পাঠিয়েছে লিলিগুলো।
একটু থেমে সে আরও বেশি উচ্ছ্বাসের গলায় বলে, তার এটা দেখুন না।
কাপড়ের ঢাকনা সরাতেই একটা বেতের ফলের টুকরি বের হয়। তাতে দুর্দান্ত পাকা, রসালো, কালো আঙুরের থোকা। নিমেষে পোয়ারোর মুখটা পরিবর্তিত হয়ে ওঠে। দ্রুত, ক্ষিপ্র পায়ে সে সামনে এগিয়ে যায়। আপনি কি এখান থেকে ফল খেয়েছেন?
পোয়ারোর তীব্র প্রতিক্রিয়ায় নিক একটু ঘাবড়ে যায়, না, এখনও পর্যন্ত খাইনি।
খাবেন না। মাদাম হাসপাতালের খাবার ছাড়া অন্য কিছু বাইরের কোন খাবার ভুল করেও মুখে তুলবেন না। বুঝেছেন?
পোয়ারোর প্রতিক্রিয়া দেখে নিকের মুখের বিবর্ণতা আরও প্রগাঢ় হল, বুঝেছি। আপনি মনে করছেন সব এখনও শেষ হয়ে যায়নি–না, শেষ হয়নি। তাই না? খুনি এখনও চেষ্টা করে যাবে–যাচ্ছে, তাই না? ফিস্ ফিস্ করে বলে সে।
পোয়ারো নিকের হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে তুলে নেয়। চেপে ধরে, ওসব নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না। আপনি এখানে পুরোপুরি নিরাপদ। শুধু একটা কথা মনে রাখবেন, বাইরে থেকে আসা কোন জিনিস ছুঁয়েও দেখবেন না, খাবেন না, এমন কি কিছু ব্যবহারও করবেন না।
আমার ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসবার পরও, বিছানার বালিশে হেলান দিয়ে এলিয়ে থাকা, মৃতবৎ নিকের ফ্যাকাশে মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসছিল। পোয়ারো ঘড়ির দিকে তাকায়। চলো হে, তাড়াতাড়ি যেতে পারলে মিঃ ভ্যাইস দুপুরের খাবার খেতে বের হয়ে যাবার আগে ধরতে পারব।
আমাদের মিঃ ভ্যাইসের ঘরে পৌঁছে দেওয়া হল। উনি সাদরে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন।
আসুন মিঃ পোয়ারো। বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি?
পোয়ারো মৃদু হেসে নিকের চিঠিটা ওর হাতে তুলে দেয়। সেটা পড়বার পর মিঃ ভ্যাইস বিমূঢ় চোখে আমাদের দিকে তাকালেন।
মাফ করবেন, কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
পোয়ারো ভুরু কুঁচকে তাকায়, চিঠিটা কি যথেষ্ট সহজ ভাষায় লেখা নয়?
এই চিঠিতে……. বিহ্বলভাবে ভ্যাইস বলে, আমাকে বলা হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে নিক যে উইলটা আমায় করতে এবং গচ্ছিত রাখতে দিয়েছে, সেটা আপনার হাতে তুলে দিতে। চিঠিটার উপর আঙুল বোলাতে বোলাতে উনি বলেন।
হ্যাঁ, মঁসিয়ে।
কিন্তু, মহাশয়, আমাকে তো কোন উইল করতে বা রাখতে দেওয়া হয়নি।
মানে? পোয়ারোর দুচোখ এবার ছানাবড়া হয়ে যায়।
আমি যতদূর জানি, আমার তুতো বোন কোন উইল করে নি। আমি সেরকম কিছুই কখনও ওর জন্যে বানাইনি।
পোয়ারো কয়েক মুহূর্ত নিশব্দে বসে থাকে। বোধহয় বিস্ময়ের অভিঘাতটা সামলাতে। তারপর উঠে দাঁড়ায়, মিঃ ভ্যাইস, সেক্ষেত্রে আমার কিছু বলার নেই। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।
নিশ্চিত ভাবেই মিঃ পোয়ারো ভুল হচ্ছে একটা।
ঠিক আছে। আজ তাহলে চলি। আবার দেখা হবে।
বাইরে বের হয়ে এসে আমি প্রথম কথা বলি, ব্যাপারটা কি হল? তোমার কি মনে হয়? লোকটা মিথ্যে বলল?
কিছু বলা যাচ্ছে না।
তাহলে? এখন আমাদের কর্তব্য?
খুব জটিল হয়ে উঠল। একমাত্র মিঃ ক্রফটই আমাদের এ ব্যাপারে আলো দেখাতে পারেন।
ওনার তো এখানে কোন লোভ করার ব্যাপার নেই?
না, না, আমি সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপারটা দেখছি না। ভদ্রলোক বোধহয় প্রতিবেশীদের ব্যাপারে অহেতুক নাক গলানো, এবং গায়ে পড়ে তাদের সাহায্য করা ধরনের চরিত্রের মানুষ। কিছু লাভের আশায় কোন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন না।
আমরা যখন মিঃ ক্রফটের বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম উনি রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলেন। আমাদের দেখেই উনি নিকের বিষয়ে জানতে চাইলেন। সে ভাল আছে, পোয়ারো জানাল। ভদ্রলোক তাতে বেশ নিশ্চিন্ত হলেন মনে হল। কিন্তু মিঃ ক্রফট এতো কথা বলছিলেন, প্রশ্ন করছিলেন, যে পোয়ারো আমাদের এখানে আসবার আসল প্রসঙ্গটাই তুলতে পারছিল না। নিহত মেয়েটির ময়না তদন্ত হয়েছে কি? তার আত্মীয় পরিজনরা কখন এসে পৌঁছবেন? শেষকৃত্য কবে, কখন হবে? পুলিশ কি খুনের ব্যাপারে কোন সূত্র পেয়েছে? শেষ পর্যন্ত, সামান্য একটা বিরতি, ক্রফটের সামান্য থামার সুযোগে পোয়ারো প্রশ্নটাকে বলা ভাল একরকম ছুঁড়েই দেয়। এতক্ষণ যে কথাটা সে বলবার জন্যে প্রবল, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, আমার স্পষ্টই মনে আছে। পোয়ারোর প্রশ্নের উত্তরে উনি বললেন।
আসলে, কিছুটা মজা করেই আমি ওনাকে বলেছিলাম, প্রশ্ন করেছিলাম, উনি কোন উইল করেছেন কিনা?
মিঃ ক্রফট একটু থামলেন, কিন্তু উনি ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিয়ে নিলেন, সঙ্গে সঙ্গেই একটা উইল বানাবার কাজ শুরু করে দিলেন। আমি ওনাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করি, ব্যাপারটা খুব সহজ কাজ নয়, অনেক ঝামেলা আছে। কিন্তু উনি বলেন কোন সমস্যা হবে না, ওনার এক তুতো ভাই উকিল। তিনিই সবকিছু করে দেবেন। সব ব্যবস্থা করবেন। পোয়ারো মাথা নেড়ে অনুমোদনের ভঙ্গিতে সায় দেয়, এবং তারপর? আমরা ওটা ডাক যোগে মিঃ ভ্যাইসকে পাঠিয়ে দিই। নিকের সেই তুতো ভাই উকিলকে।
আপনি নিশ্চিত, ওটা মিঃ ভ্যাইসকে পাঠান হয়েছিল? পোয়ারোর কথায় মিঃ ক্রফট ক্ষুণ্ণ গলায় বলেন, মিঃ পোয়ারো, আমি নিজের হাতে ডাকাযোগে ওটা মিঃ ভ্যাইসকে পাঠিয়েছিলাম।
কিন্তু মিঃ ভ্যাইস যে বলছেন তিনি ওটা আদৌ পাননি? মিঃ ক্রফট বিস্ময়ের চোখে তাকালেন। তার মানে? উনি কি বলতে চাইছেন? উইলটা ডাক পথে খোয়া গেছে? কিন্তু তা অসম্ভব নয় কি? পোয়ারো মাথা নাড়ে, যাইহোক, ব্যাপারটা আর এখন তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। মাদাম জোয়েল মোটেই মারা যাচ্ছে না। কথাটা শেষ করে পোয়ারো উদ্দেশ্যপূর্ণ হাসে।
El Voila, আমরা বাড়ির বাইরে বের হয়ে আসবার পর পোয়ারো বলে। কে তাহলে মিথ্যে কথা বলছে? মিঃ ক্রফট? না মিঃ ভ্যাইস? সত্যি কথা বলতে কি আমি কিন্তু মিঃ ক্রফটের মিথ্যে কথা বলবার কোন কারণ দেখতে পাচ্ছি না। প্রথমত ওনার উইল থেকে কোন লাভই হবার নেই। দ্বিতীয় কথা, উইলটা বানাতে উনি সাহায্য করেছিলেন। আমার তো মনে হয়……
মি ক্রফটকে রান্না করতে দেখে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আরও খুশি হয়েছিলাম যখন দেখলাম টেবিলে রাখা খবরের কাগজে উনি সেই হাত চেপে ধরলেন। ওনার অলক্ষ্যে আমি সেই কাগজের থেকে অংশটুকু ছিঁড়ে এনেছি। আমাদের প্রিয় বন্ধু ইন্সপেক্টর জাপের কাছে আজই আঙুলের ছাপটা পাঠিয়ে দিতে হবে। দেখা যাক উনি আমাদের কোন তথ্য দিতে পারেন কি না।
আমি বিস্ময়ে হতবাক চোখে পোয়ারোর দিকে তাকাতে সে হাসে, হেস্টিংস, আমাদের সেই ক্রফট ভদ্রলোক, একটু বাড়াবাড়ি রকম ভদ্রলোক। আর সেখানেই কেমন যেন একটা প্রবল খটকা। কোথায় যেন……..
১৫. ফ্রেডরিকার আশ্চর্য ব্যবহার
১৫. ফ্রেডরিকার আশ্চর্য ব্যবহার
চিফ কনস্টেবল কর্ণেল ওয়েস্টন আমাদের দুপুরের খাবারটা তার সঙ্গে খেতে ডেকেছেন, হোটেলে ফিরেই খবর পেলাম। আমরা যথাসময়ে গিয়ে হাজির হলাম। লম্বা, সুদর্শন পুলিশ কর্মীটি দেখা গেল পোয়ারোর বিরাট ভক্ত। তার বিষয়ে প্রায় সব খবরই রাখে সে। সাদর অভ্যর্থনা জানানোর পর তিনি বললেন (এবং কথাটা অনেকবারই বললেন)। আমাদের পরম সৌভাগ্য, যে আপনাকে এখানে পেয়েছি। তবে তিনি দ্রুত অপরাধের সমাধান করে আসল অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে চান। তার আশঙ্কা না হলে হয়ত তদন্তের ভার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতে চলে যাবে। নিশ্চিতভাবেই নার্সিংহোমে মহিলাটি সুরক্ষিত আছেন। কিন্তু সেটা কোন সমাধান নয়। কতদিন ওনাকে সেখানে রাখা যাবে? কর্নেল ওয়েস্টনের কথায় পোয়ারো উত্তর দেয়, এই সমস্যার তো একটাই সমাধান। কর্নেল আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করেন, সেটা কি?অপরাধীকে তাড়াতাড়ি কজা করা। হুমম। কিন্তু সেটা খুব সহজ কাজ হবে না, কর্নেল ওয়েস্টন হতাশ গলায় বলেন। অবশ্যই। এই ধরনের মামলাগুলো সবসময়েই ভীষণরকম জটিল। আহ, যদি পিস্তলটাও, যেটা খুনে ব্যবহৃত হয়েছিল, সেটা হাতে পাওয়া যেত। চিফ কনস্টেবল হতাশ গলায় আবারও বললেন। সেটা ঠিক। তবে ঘাঘু অপরাধীরাও মাঝে মাঝেই এমন ছোট্ট, ছোট্ট বোকার মত ভুল করে বসে। পোয়ারো সমর্থনের ভঙ্গি করে মাথা নাড়ে।
আগামীকাল সকালে ময়না তদন্ত করা হবে। তবে তার ফলাফল আপাতত আমরা কাউকে জানাব না।
সেটাই ভাল। পোয়ারো উঠে দাঁড়ায়। আমরা এবার বিদায় নেব। আমরা দরজার দিকে কয়েক পা মাত্র এগিয়েছি, হঠাৎ উনি বললেন, ওহ, একটা কথাতত বলতে ভুলেই গেছি। কথাটা বোধহয় আপনার মতামতও চাই। পকেট থেকে একটা প্রায় দোমড়ানো মোচড়ানো কাগজের টুকরো বের করে পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দেন চিফ কনস্টেবল। আমার পুলিশকর্মীরা যে মাঠে বাজি পোড়ানো হচ্ছিল সেখানে তল্লাশি করতে গিয়ে এটা পেয়েছে।
পোয়ারো কাগজটাকে সোজা করে দুহাত দিয়ে চেপে, তারপর চোখের সামনে তুলে ধরে। বেশ বড় বড় অক্ষরে লেখা।
……. টাকার জোগাড় তাড়াতাড়ি কর…… তা না হলে, তুমি জান কি ঘটবে……… ভালই জানো……. আমি তোমাকে শেষবার সতর্ক করছি……….
পোয়ারোর চোখে বেশ তীব্র আগ্রহ ফুটে ওঠে। ইন্টারেস্টিং। আমি কি এটা রাখতে পারি? অবশ্যই। চিঠিটায় কোন আঙুলের ছাপ নেই। আপনি যদি এটার থেকে আর কোন তথ্য বার করতে পারেন আমি খুশিই হব। এরপর আমরা বের হয়ে এলাম। তার আগে অবশ্য চিফ ইন্সপেক্টর আমাদের জানিয়ে দিলেন ম্যাগির মা-বাবা আজ বিকেলেই ইয়র্কশায়ার থেকে এসে পৌঁছেছেন। আগামীকাল ময়না তদন্তের পরই তারা মেয়ের মৃতদেহ নিয়ে ফিরে যাবে ইংলন্ডে।
বাড়িতে ফিরে পোয়ারো খুব মনোযোগ দিয়ে চিঠিটাকে পরীক্ষা করছি, কোন প্রয়োজনীয় তথ্য? কোন সূত্র? আমার প্রশ্নে পোয়ারো কাঁধ ঝাঁকায়। কি করে বলা যেতে পারে? শুধু এটুকু বলা যেতে পারে চিঠিটার মধ্যে ব্ল্যাকমেলের দুর্গন্ধ আছে। সেই বাজি পোড়ানোর অনুষ্ঠানের রাতেই এই চিঠিটা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কে দিয়েছিল? কাকে? এবার সে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে চিঠিটাকে পরীক্ষা করতে থাকে। হাতের লেখাটাকে বিশেষ করে। তারপর আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে মৃদু হাসে। তোমার কি হাতের লেখাটা চেনা মনে হচ্ছে হেস্টিংস? আমি আরও একবার বেশ কিছু সময় নিয়ে চিঠির হাতের লেখাটাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করি আমার কি যেন একটা মনে পড়ছে। কি যেন……. আহ মনে পড়েছে। মিসেস রাইস।
একেবারে ঠিক ধরেছ। পোয়ারো সপ্রশংসক গলায় বলে।
নিঃসন্দেহে। যথেষ্ট মিল আছে। যথেষ্টই মিল। বেশ কৌতূহলজনক ব্যাপার। যদিও, আমার মনে হয় না, যথেষ্ট সন্দেহ আছে এটা মাদাম রাইসের লেখা বলে। উত্তরে আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনি দরজায় করাঘাতের শব্দ হল। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার ঘরে ঢুকলেন অসময়ে আপনাদের বিরক্ত করলাম হয়তো। আসলে আমি এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম একবার ঢু মেরে যাই। তদন্তের আর কোন অগ্রগতি হল কি না খোঁজ নিয়ে যাই।
Probleui, অগ্রগতি কি বলছেন মশাই? এ এক জব্বর মামলা। আমার তো মনে হচ্ছে দিনে দিনে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি আমি।
সেটা হলে খুবই বিশ্রী একটা ব্যাপার ঠিকই, কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করছি না। আপনার অনেক কীর্তি কাহিনি আমি শুনেছি। আমি জানি আপনি একজন অসধারণ ক্ষমতাবান মানুষ।
না-না, সেরকম কিছুই নয়। পোয়ারো বিনীত গলায় বলে।
আপনি কখনও ব্যর্থ হতে পারেন না। আপনি এই অপরাধের রহস্যও ভেদ করে ফেলেছেন। ঠিক কিনা?
পোয়ারো একটু ইতস্তত করে, দ্বিধার গলায় বলে, ঠিক সেরকম কিছু নয়। তবে হ্যাঁ অবশ্যই দুজনকে সন্দেহ করছি, বলা ভাল অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করে ফেলেছি।
আমি তাদের নাম জিজ্ঞাসা করলেও আপনি নিশ্চয়ই সেটা বলবেন না আমাকে?
পোয়ারো বিনীত ভঙ্গিতে হাসে। আমার সেটা বলা উচিত নয়। বুঝতেই পারছেন, আমার হয়তো ভুল হতে পারে। তারপর কয়েকমুহূর্ত স্থির পলকহীন চোখে কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার-এর দিকে তাকিয়ে থাকে পোয়ারো, তারপর হঠাৎ বলে, আপনি সে রাতে ৪.৩০-এর একটু পরে ডাভেনপোর্ট থেকে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু, আপনি এখানে এসে পৌঁছেছিলেন ১০টার ৫ মিনিট পর। ৩০ মাইল আসতে আপনার পৌনে দু ঘণ্টা সময় লাগল কেন? নাহ, আপনার অ্যালিবাইটাও কিন্তু একেবারেই পাকাপোক্ত নয়।
উ-ম-ম, আসলে…… কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার স্পষ্টতই আমতা আমতা করতে থাকেন।
অ্যালিবাই-এর প্রসঙ্গ যদিও বাদও দিই……… পোয়ারো মাখন মাখানো হাসে। আমি সব বিষয়েই খোঁজখবর নিয়েছি। আপনি মাদাম জোয়েল নিক-কে বিয়ে করতে চান। তাই তো?
কম্যান্ডারের মুখ রক্তবর্ণ হল। আমি সবসময়েই ওকে বিয়ে করতে চেয়েছি। মৃদুগলায় বলেন তিনি।
হুম। অথচ তিনি অন্য একজন পুরুষের বাগদত্তা সেক্ষেত্রে………..’
নিক তাহলে সত্যি মাইকেল সেটনের বাগদত্তা ছিল? আমি ব্যাপারটা গুজবই ভাবতাম।
আপনি কিছু সন্দেহ করেননি কখনও?
না, ওকে সন্দেহ করার কথা আমি ভাবতেই পারি না। দিন দুয়েক আগেই নিক আমাকে প্রথমবার সরাসরি জানিয়েছিল যে সে কারও বাগদত্তা। কবে থেকে স্পষ্ট করে জানায়নি সে সময়।
হ্যাঁ, তিনি নিঃসন্দেহেই মাইকেল সেটনই। তবে একটা কথা আমি জোর দিয়েই বলতে পারি মাদাম জোয়েল নিক আপনাকে যথেষ্টই পছন্দ করেন।
শ্যালিঙ্গার কথাগুলো শোনেন। কয়েক মুহূর্ত নীরবে কি যেন ভাবেন। তারপর প্রায় স্বগতোক্তি করার মত বিড়বিড় করেন, যদি তাই হয়………. ঠিক সেই সময়েই দরজায় টোকা পড়ে। এবার স্বয়ং ফ্রেডরিকা রাইস হাজির হলেন।
আমি তোমাকেই খুঁজছি। শ্যালিঙ্গারের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি, আমার হাতঘড়িটা কি দোকান থেকে এনেছ?
ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। শ্যালিঙ্গার তার প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকালেন। ঘড়ি বের করে মিসেস রাইসের হাতে তুলে দিলেন।
মাদাম জোয়েল রাইস মৃদু হাসেন, বলেন–আমি আপনাদের কোন জরুরি আলোচনায় বিঘ্ন ঘটালাম নাতো?
না-না মাদাম, আমরা নিছকই গল্পগুজব করছিলাম একটু। আপনি বসুন না। আসলে আমি ওনাকে বলছিলাম কি দ্রুত এসব খবর ছড়িয়ে পড়ে। ফ্রেডরিকা একটা চেয়ারে বসেন তারপর ঠাণ্ডা চোখে পোয়ারোর দিকে তাকান, কোন খবরের কথা হচ্ছে?
এই যে মাদাম জোয়েল নিক যে মাইকেল সেটনের বাগদত্তা ছিলেন। নিমেষে ফ্রেডরিকার দুচোখে তীক্ষ্ণ একটা ঝিলিক খেলে যায়। যেন নিজেকে আপ্রাণ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন, তাহলে নিক সত্যিই মাইকেল সেটনের সঙ্গে বাগদত্ত হয়েছিল? বেশ বিস্ময়ের রেশ ওনার গলায়।
আপনি অবাক হচ্ছেন মাদাম জোয়েল? পোয়ারো বিনীত গলায় প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, তা একটু হয়েছি বইকি। গত শরতে ওরা মেলামেশা করেছিল কিছুটা। কিন্তু তারপর, বড়দিনের সময় থেকে ওদের আর দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল বলে জানতাম না।
ব্যাপারটা ওরা নিখুঁতভাবে গোপন রাখতে পেরেছিলেন।
সেটা স্যার ম্যাথুর জন্যে। উনি ব্যাপারটার প্রবল বিরোধ করতেন জানতে পারা মাত্র।
ফ্রেডরিকার কথাটা শুনে পোয়ারো আগ্রহী গলায় বলে, আপনি তো ওনার প্রিয়তম বন্ধু ছিলেন। সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। আপনি কিছু সন্দেহ করেননি কখনও?
নিক খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে ছিল। তবে এখন আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি কেন ইদানিং ও এত উদ্বিগ্ন থাকত। কয়েক মুহূর্ত পরই ফ্রেডরিকা পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকায় প্রবলরকম আগ্রহভরা চোখে, মিঃ পোয়ারো আমাকে একটা কথা……… আচমকাই সে থেমে যায়। তার দীর্ঘ দোহারা চেহারাটা মৃদু কেঁপে ওঠে, মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। মাঝের টেবিলটার দিকে ওর দুচোখ স্থির হয়ে আটকে থাকে।
মাদাম, আপনি কি, অসুস্থ বোধ করছেন? পোয়ারো ফ্রেডরিকার কাঁধে হাত রাখে। সামান্য নড়ে মাথাটা, বিড়বিড় করে উনি বলেন, আমি ঠিক আছি। দুহাতের পাতায় মুখটা ঢেকে উনি সামনে ঝুঁকে পড়েন। আমরা সবাই অবাক হয়ে মিসেস রাইসের এই অদ্ভুত আচরণটা লক্ষ্য করতে থাকি। কয়েক মিনিট মাত্র। তারপরই উনি আবার সোজা হয়ে বসেন। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে বলে ওঠেন, আরে এত দুশ্চিন্তা করতে হবে না, আমি সুস্থ আছি। এখন কিছু উত্তেজক কথাবার্তা হোক। যেমন, খুন। মিঃ পোয়ারো আপনি আমাকে বলুন, কতটা এগোলেন আপনি?
না মাদাম, সেরকম করে বলবার মত কিছু এখনও ঘটেনি। পোয়ারো প্রতিশ্রুতিহীন জবাব দেয়।
কিন্তু আপনি নিশ্চিতভাবেই একটা ধারণা নিশ্চয়ই করতে পেরেছেন তাই না?
হ্যাঁ, সেটা করেছি ঠিকই। তবে এখনও প্রচুর প্রমাণ জোগাড় করতে বাকি রয়েছে।
এবার ওনাকে যেন কিছুটা অনিশ্চিত দেখায়। তারপর উনি উঠে দাঁড়ালেন, এবার আমি চলি। উনি ঘর ছেড়ে হঠাৎ করেই দ্রুত বের হয়ে যান।
শ্যালিঙ্গার সেদিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়েন, নারী, এরা যে কখন কি চায় হয়ত ভগবানও জানে না। নিক হয়ত ওই মহিলাকে খুবই পছন্দ করে। কিন্তু এই মহিলাটি যে নিককে সত্যি সত্যি কতটা পছন্দ করেন তাতে আমার সন্দেহ আছে গভীর ভাবে। একটু থেমে তিনি আবার বলে উঠলেন, যাকে প্রিয়তম….প্রিয়তম…….সম্বোধন করছে এক মুহূর্ত পরই তাকে হয়ত নিকুচি করেছে বলে ছুঁড়ে ফেলবে। এইসব মেয়েদের মতিগতি বোঝা সত্যিই ভার। তারপরই ওনার নজর পড়ে পোয়ারোর দিকে, আপনি কি কোথাও
পোয়ারো ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। সযত্নে টুপিটাকে ঝাড়ছে। কম্যান্ডার-এর মুখের দিকে তাকিয়ে সে বিনয়ী হাসে। হ্যাঁ, আমি একটু শহরে যাব।
কম্যান্ডার একঝলক কি যেন ভাবলেন, আমার হাতে এখন কোন কাজ নেই। আমি কি আপনার সঙ্গে আসতে পারি?
অবশ্যই, অবশ্যই। আমি খুশিই হব তাহলে। অতএব অবশেষে কম্যান্ডার আমাদের সঙ্গী হলেন।
পোয়ারো শহরে পৌঁছে প্রথমে একটা ফুলের দোকানে ঢুকল। আমরা নিশ্চিতভাবেই কিছু আরোগ্য কামনাময় শুভেচ্ছাসহ ফুল পাঠান উচিত মাদাম জোয়েল নিককে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করে সে। তবে পোয়ারোর ফুল পছন্দ করাটা এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়াল। কোনটা তার পছন্দ করা উচিত কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না সে। অবশেষে, বেশ বড়সড় একটা সোনালী বাক্স, অলঙ্করণ করা, তাতে একগুচ্ছ কমলালেবু রঙ উজ্জ্বল করোনেশন পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয় সে। আমি সকালেই ফুল পাঠিয়েছি। আমি বরং কিছু ফল পাঠাই। কম্যান্ডার বললেন। পোয়ারো দোকান থেকে দেওয়া কার্ডটাকে যত্ন করে, শুভেচ্ছাসহ, এরককুল পোয়ারো লিখে দোকানী মহিলার হাতে ফেরত দিতে দিতে বলে Inutile।
কি? শ্যালিঙ্গার ভুরু কুঁচকে তাকায় আমি বললাম অর্থহীন। বাইরে থেকে পাঠান কিছু খাওয়া মাদামের নিষেধ আছে।
কে বলল?
আমি বলছি। আমি নিয়মটা চালু করেছি। মাদাম তার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে মেনেও নিয়েছেন।
হে ভগবান। শ্যালিঙ্গার স্পষ্ট চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায়। তার কপালে চিন্তার কুঞ্চন ভেসে ওঠে, তার মানে, এই ব্যাপার?…… বিপদ এখনও কাটেনি……।
.
১৬.
মিঃ হোয়াইটফিল্ডের সঙ্গে সাক্ষাতকার
ময়নাতদন্তটা নেহাতই বিরস ধরনের অনুত্তেজক হল। ময়না তদন্তের পর আমি পোয়ারোর সঙ্গে যোগ দিলাম। আমরা দুজনে গেলাম রেভারেন্ড গাইলস বার্কলি এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। নিহত ম্যাগি বার্কলির মা বাবা দুজনেই সহজ সরল মানুষ। শহুরে সফিস্টিকেশনের ধার ধারেন না। মিসেস বার্কলি বেশ লম্বা। তুলনায় তার স্বামী বেশ ছোটখাটো চেহারার। ধূসর রঙা চুল। মেয়ের বেঘোরে মৃত্যুর শোকাচ্ছন্ন-তার বাইরে এখনও তারা স্বামী-স্ত্রী কেউই আসতে পারেন নি। আমাদের ম্যাগি বারবার দুঃখে ভারাক্রান্ত গলায় বলছিলেন তাঁরা আমার মেয়ে ছিল নিঃস্বার্থ, আত্মত্যাগী, সবসময় অন্যদের কথা ভাবত। তাকে কে খুন করতে পারে? ঠিক তখনি মিসেস বার্কলি বললেন, একটাই সান্ত্বনা, আপনার মত একজন মহান গোয়েন্দা যখন এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, তখন খুব শিগগিরই এই অপরাধের কিনারা হবেই হবে।
অপরাধী শাস্তি পাবেই। এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি মাদাম। তবে কখনও সেই শাস্তি খুব গোপনে ঘটে।
এর দ্বারা আপনি কি বোঝাতে চাইছেন মিঃ পোয়ারো? এবার প্রশ্নটা করেন মিঃ বার্কলি। পোয়ারো কথাটার কোন উত্তর দেয়না। শুধু ঘনঘন কয়েকবার মাথা নাড়ে। যার বহুরকম অর্থ হতে পারে।
পোয়ারো সান্ত্বনা দেয়, আচ্ছা, আর আপনাদের বিরক্ত করব না। যা ঘটে গেছে তার জন্যে আন্তরিক দুঃখবোধ জানানো ছাড়া, আপনাদের সহানুভূতি জানাবার ভাষা আমাদের নেই। সন্তানকে অকালে হারাবার যন্ত্রণা অন্য কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়।
আপনি সত্যিই অত্যন্ত সহৃদয় মিঃ পোয়ারো। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আমরা বাড়ির বাইরে বের হয়ে আসবার পর পোয়ারো বিষণ্ণ গলায় বলে, নিজেকেই ভীষণরকম অপরাধী মনে হচ্ছে জানো হেস্টিংস। আমিই মাদাম জোয়েল বার্কলিকে পরামর্শ দিয়েছিলাম কাউকে তার কাছে এনে রাখতে, অথচ, আমি এরকুল পোয়ারো ঘটনার জায়গায় হাজির থাকা সত্ত্বেও ব্যাপারটাকে আটকাতে পারলাম না।
নিয়তি কে ঠেকাতে পারে কে বন্ধু? আমি নরম গলায় বলি।
না হেস্টিংস, তোমার বক্তব্যে ঘটনার যথার্থ প্রতিফলন হচ্ছে না। এখানে কোন সাধারণ মানুষের কথা হচ্ছে না। আমি এরকুল পোয়ারো তাহলে আমার অসাধারণত্ব কোথায় যদি এরকম একটা পাতি অপরাধ ঠেকাতে না পারলাম? বিশেষ করে যেখানে নিক ও ম্যাগিকে পূর্ণ নিরাপত্তা দেবার নৈতিক দায়িত্ব ছিল আমার, এরকুল পোয়ারোর ওপর।
তা অবশ্য ঠিক। ব্যাপারটাকে তুমি যদি এভাবে ভাব তাহলে ব্যাপারটা সেইরকম দাঁড়াচ্ছে বটে।
বাস্তবিক। আমি সেইহেতু ভীষণরকম মর্মাহত, হৃদয়বিদারক অবস্থার মধ্যে রয়েছি।
আমি জানি পোয়ারোর মানসিক গঠন অন্য অনেকের মত নয়। একেবারে আলাদা। তাই কোন মন্তব্য করলাম না। চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলাম। এবং এখন, ইংল্যান্ড। পোয়ারোর কথাটা শুনে আমি আঁতকে উঠলাম। ইংল্যান্ড? Mai Gui পোয়ারো গভীর মনোযোগে হাতঘড়ির দিকে তাকায়। এখনও চেষ্টা করলে দুপুরের ট্রেনটা ধরা যাবে। চল হে আর দেরি করা যাবে না। মাদাম জোয়েল নিক আপাতত নার্সিংহোমে যখন নিরাপদে আছেন, থাকবেন, আমরা দু চারদিন ছুটি নিতেই পারি। তার চেয়ে জরুরি কিছু তথ্য, সূত্র সেই সুযোগে জোগাড় করে ফেলতে হবে।
লন্ডনে নেমেই আমাদের প্রথম কাজ হল মৃত ক্যাপটেন সেটনের সলিসিটার মহাশয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা। মেসার্স হোয়াইটফিল্ড, প্রাগরিটার অ্যান্ড হোয়াইটফিল্ড। পোয়ারো আগে থেকেই সাক্ষাতকারের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। সন্ধে ৬.০০ টায় আমরা সংস্থার মালিক মিঃ হোয়াইটফিল্ডের মুখোমুখি হলাম। পোয়ারো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে আনা বিশেষ অনুমতির চিঠিটা ওনার হাতে তুলে দিল। সেটাকে ভাল করে খুঁটিয়ে পড়ে চশমার কঁচ রুমালে মুছতে মুছতে তিনি আমাদের দিকে তাকালেন, খুবই দুঃখজনক ঘটনা।
পোয়ারো ততক্ষণে ওনাকে গুছিয়ে আমাদের আসবার কারণটা জানায়, সত্যিই খুব দুঃখজনক। তবে তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে খুনটা খুবই অন্যধরনের, বেশ অসাধারণ ধরনের।
কিন্তু, আমি বুঝতে পারছি না, এই খুনটার সঙ্গে আমার সদ্য প্রয়াত ক্লায়েন্ট-এর যোগাযোগটা ঠিক কোথায়?
আমি সেটা খুঁজতেই আপনার কাছে এসেছি।
মিঃ হোয়াইটফিল্ড এবার একটা গভীর শ্বাস টানেন, বুঝলাম। বেশ আপনার কি জানবার আছে বলুন। আমি আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।
ধন্যবাদ। আপনি স্বর্গত মাইকেল সেটনের জন্যে কোন উইল করেছিলেন সম্প্রতি?
অবশ্যই। সেটন পরিবারের সবার উইল আমরাই করে আসছি।
পোয়ারো এবার স্পষ্ট চোখে মিঃ হোয়াইটফিল্ডের দিকে তাকায়, প্রয়াত ম্যাথু সেটন? তার উইলের ভাগটা কিরকমভাবে হয়েছিল?
কিছুটা ভাগ গেছে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে। তবে তার বিশাল, আমার বলা উচিত সুবিশাল সম্পত্তির প্রায় পুরো অংশটাই গেছে মাইকেল সেটনের কাছে। ওনার আর কোনও কাছের আত্মীয় নেই।
খুব বিরাট সম্পত্তির অংশ বলছেন?
স্যার ম্যাথু সেটন ছিলেন ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় সর্বাপেক্ষা ধনী ব্যক্তি। একথা ভুলে যাবেন না।
মাথা হেলিয়ে মিঃ হোয়াইটফিল্ডের বক্তব্যর প্রতি পুরোপুরি সমর্থন জানিয়ে পোয়ারো এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা প্রসঙ্গে চলে যায়, স্যার ম্যাথুর মৃত্যুটা কি অনাকাঙ্খিত বা হঠাৎ ঘটে যাওয়া বলে আপনি মনে করেন?
নিশ্চয়ই। একেবারেই অপ্রত্যাশিত বলতে পারেন। ওনার স্বাস্থ্য খুবই ভাল ছিল। অসুস্থতার কোনরকম লক্ষণই ছিল না। হঠাৎ এভাবে মৃত্যু তো অনেক দূরের ব্যাপার।
পোয়ারো গম্ভীর মুখে কি যেন চিন্তা করে কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলে, তাহলে ক্যাপটেন মাইকেল সেটনের উইল অনুযায়ী সম্পত্তির মালিকানা এখন কে পাচ্ছেন?
নিশ্চিভাবেই ওনার স্ত্রী। বা বলা ভাল বাগদত্তা। মিসম্যাগদালেনা বার্কলি।
পোয়ারো এবার উঠে দাঁড়াল। ধন্যবাদ মিঃ হোয়াইটফিল্ড। আমার প্রয়োজনীয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা আমি পেয়ে গেছি।
মিঃ হোয়াইলফিল্ডের সঙ্গে করমর্দন করে আমরা ওর অফিসের বাইরে বের হয়ে এলাম।
তুমি যেভাবে ভেবেছিলে ব্যাপারটা ঠিক সেইরকমই ঘটেছে পোয়ারো। বাইরে বের হয়ে এসে আমি বললাম।
সেটা তো হতে বাধ্য। অন্যরকম কিছু ঘটবার সম্ভাবনা কোথায়? পোয়ারো বিড়বিড় করে আত্মমগ্ন ভঙ্গিতে বলে।
এরপর আমরা গেলাম সুবিখ্যাত রেস্তোরাঁয় চেশয়ার চিজসে। ইন্সপেক্টর জেপ সেখানে আমাদের জন্যে পূর্বনির্ধারিত ভাবে অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের দেখামাত্র তিনি সাদর উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন।
বহুদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা হল মঁসিয়ে পোয়ারো। জেপ বললেন।
পোয়ারো হাসে, কেমন আছেন বলুন?
ভাল। আপনি? আবারও খুনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছেন?
পোয়ারো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, কথায় আছে না তেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে। অপরাধ তেমন আমার পিছু ছাড়ে না।
জেপ এবার সরাসরি প্রসঙ্গে আসেন, যাইহোক, আপনি যে ফিঙ্গার প্রিন্টগুলো আমাকে পাঠিয়ে ছিলেন তাতে কিছুই উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় নি। উনি যেই হন, আমাদের খপ্পরে আগে কোনদিন পড়েননি। তাছাড়া, আমি মেলবোর্নেও খোঁজ নিয়েছিলাম। আপনার দেওয়া নাম বা চেহারার বর্ণনার কারো খোঁজ পাওয়া যায়নি সেখানে।
তাই, পোয়ারো একটা ছোট্ট মন্তব্য করে। ওর মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে। আর অন্য ব্যাপারটায় আপনার কথামত আমি লাজারুম আর ওনার ছেলের বিষয় খোঁজ নিয়েছিলাম। ওরা ব্যক্তিগতভাবে এবং পেশাদার জীবনেও যথেষ্ট সুনামের অধিকারী। কোন বদনাম নেই তাদের বাজারে। তবে, সম্প্রতি তারা বেশ আর্থিক টানা পোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন।
তুই বুঝি?
হ্যাঁ, পুরনো ছবি বা জিনিসপত্রের বাজার এখন সেরকম ভাল নয়। সবার নজর এখন হাল ফ্যাশানের জিনিসপত্রের ওপর। তাছাড়া গত বছর একটা নতুন বাড়ি তৈরি করতে শুরু করেছেন ওরা। সবমিলিয়ে..
ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ জেপ। আপনি আমার অনেক উপকার করলেন।
আরে না, না, পুরনো বন্ধুর জন্যে এটুকু তো করতেই হবে।
পোয়ারো সমর্থনের ভঙ্গিতে মৃদু বিনীত হাসে। তারপর বলে আর ডাঃ ম্যাক অ্যালিস্টার, ওনার ব্যাপারে কিছু জানতে পারলেন?
আহ, নিশ্চয়ই। উনি মেয়েদের ডাক্তার। না, না গায়নোকলজিস্ট নয়, একজন হাতুড়ে ধরনের। সাধারণভাবে মহিলাদের যৌন ইচ্ছে সংক্রান্ত সমস্যার চিকিৎসাই করেন। সেসব ব্যাপারে ওনার চিকিৎসা নাকি খুবই ফলদায়ক।
এই ডাঃ ম্যাক অ্যালিস্টার কে? আমি বেশ অবাক ভাবে প্রশ্ন করি। আচমকা এই নামটা কোথা থেকে উড়ে এল?
ডাঃ ম্যাক অ্যালিস্টার হলেন কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গারের কাকা। মনে আছে উনি একবার উল্লেখ করেছিলেন, ওনার এক কাকা চিকিৎসক?
আমার মনে পড়ল, কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে তার যোগাযোগ কোথায়?
আমার প্রশ্নে পোয়ারোর কপালে ভাঁজ পড়ে, হয়ত কিছুই নেই। কিন্তু এরকুল পোয়ারো কোন গন্ধ না খুঁকে ছেড়ে দেয় না। হয়ত এইভাবেই খুলে যাবে কোন দরজা। আর হেস্টিংস দরজা যে সত্যিই খোলে, তার প্রমাণ তো অতীতে পেয়েছি আমরা। বহু……বহুবার। তাই না?
এরপর সন্ধ্যেটা বেশ ভালই কাটল। ইন্সপেক্টর জেপের অনুরোধে আমরা তিনজনেই কয়েক পাত্র পোর্ট পান করলাম। পোয়ারো এবং জেপ পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থনে ডুবে গেল। বেশ লাগছিল শুনতে। কিন্তু কখন যেন আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, মন ডুবে গিয়েছিল বর্তমান মামলার ঘটনায়। পোয়ারো এখনও যেভাবে কোন তথ্য বা সূত্র খুঁজে পায়নি। অথচ মামলাটা হাতে নেবার পর দিন কম গেল না। আমার কেমন শীত শীত করে উঠল হঠাৎ তাহলে….. তাহলে কি এরকুল পোয়ারোকে প্রথমবার পরাজয় স্বীকার করে নিতে হবে? পোয়ারোর চোখের সামনে ম্যাগি বার্কলির মৃত্যুটা কি তাহলে সেই অনিবার্যতার নিষ্ঠুর ইঙ্গিত? হঠাৎ পিঠে হাতের চাপে আমার ঘোর কাটল। সম্বিত ফিরে পেলাম। পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি ভাবছ বন্ধু?
নাহ, কিছু না, কিছু না। নিজের অপ্রস্তুত ভাবটাকে আড়াল করার চেষ্টা করতে করতে বলে উঠি।
সাহস রাখ, প্রিয় বন্ধু সাহস রাখ। পোয়ারো আমার পিঠে হালকা চাপড় মারে, সব কিছু এখনও শেষ হয়ে যায় নি।
আমি হেসে উঠি। পোয়ারো আমার মনের অবস্থাটা নির্ভুল বুঝতে পেরেছে। আমার। হাসির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পোয়ারোও হাসে। আমাদের হাসতে দেখে ইন্সপেক্টর জেপও সশব্দে হেসে ওঠেন।
এরপর আমরা হাসিখুশি মনে বিদায় নিই ইন্সপেক্টর জেপের কাছ থেকে। পরের সকালে আমরা আবার সেন্ট লু ফিরে আসি। হোটেলে পৌঁছে পোয়ারো নার্সিংহোমে ফোন করে এবং নিকের সঙ্গে কথা বলতে চায়। হঠাৎ করেই আমি ওর মুখের ভাব বদলে যেতে দেখি। প্রবল হতাশা, চিন্তা, উদ্বেগ ফুটে ওঠে যুগপৎ ওর মুখে। হা, হা, আমি এখনি আসছি। ফোনটা ছেড়ে দিয়ে পোয়ারো প্রবল রাগ মেশা হতাশায় মাথা ঝাঁকায়, কি কান্ড। চল হেস্টিংস। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে এক চরম আশঙ্কা ভেসে ওঠে। আতঙ্কিত গলায় আমি বলি কি হয়েছে পোয়ারো?
মাদাম জোয়েল নিক ভয়ঙ্কর অসুস্থ। কোকেন বিষক্রিয়াতে আক্রান্ত। Mon Dieu, Mon Dieu, কেন যে আমি ওনাকে এখানে রেখে চলে গিয়েছিলাম? কেন?
.
১৭.
এক বাক্স চকোলেট
নার্সিংহোমে যাবার পুরো রাস্তাটা পোয়ারো নিজের মনে বিড়বিড় করে চলল। নিজের অতি আত্মবিশ্বাসকে অভিশাপ দিচ্ছিল। আমার বোঝা উচিত ছিল। স্বগতোক্তি করে পোয়ারো বলে ওঠে আমার বোঝা উচিত ছিল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে রুষ্ট গলায় বলে, কিন্তু আমি থাকলেই বা কি হত? আমি যা ব্যবস্থা করেছিলাম মাদাম নিকের কাছে পৌঁছন অসম্ভব। হ্যাঁ, পুরোপুরি অসম্ভব। কেউ নিশ্চয়ই আমার নির্দেশ অমান্য করেছে–কে?
আমরা নার্সিংহোমে পৌঁছবার পর একতলায় একটা ছোট্ট ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ডাঃ গ্রাহাম একটু পরই এলেন। তাকে রীতিমত বিধ্বস্ত, ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। চিন্তা করবেন না। উনি ঠিক আছেন। সমস্যাটা হচ্ছিল উনি কতটা বিষ শরীরে নিয়েছেন বুঝতে না পারায়। এখন পরিস্থিতি সামলে নেওয়া গেছে।
কিন্তু কি ভাবে এটা ঘটল? পোয়ারো ডাক্তারের কথা শুনে প্রথমে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, এরপর তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্নটা করে। ভেতরে যেতে কাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল?
না না কাউকে ভেতরে যেতে দেওয়া হয়নি।
অসম্ভব পোয়ারো দৃঢ় গলায় বলে।
না না, আমি সত্যি বলছি। বিশ্বাস করুন।
কিন্তু, তাহলে………… পোয়ারোর গলায় তীব্র সংশয় ভেসে ওঠে।
এক বাক্স চকোলেট।
ওহ-হ। আমি ওনাকে বলেছিলাম, হে ভগবান, বার বার বুঝিয়েছিলাম বাইরে থেকে আসা কিছু খাওয়া তো দূরের কথা, স্পর্শও না করতে।
আমি সেটা জানতাম না। বোঝেনই তো কোন মেয়েকে চকোলেট থেকে দুরে রাখা কত কঠিন। তবে ভগবানকে অজস্র ধন্যবাদ, উনি মাত্র একটাই খেয়েছিলেন।
চকোলেটের ভেতর কি ভাবে কোকেন পোরা হয়েছে?
খুব শক্ত কাজ মশায়। মাঝখান থেকে অর্ধেক করে ভেতরটা বার করে দিয়ে কোকেন পুরে দিয়ে আবার চকোলেটটা জোড়া দেওয়া হয়েছে। একেবারে অপেশাদার কাঁচা হাতের কাজ।
পোয়ারো মৃদু একটা খড়খড় শব্দ করে।
আমি ক্ৰমে ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। যাই হোক, একবার কি মাদাম জোয়েলের সঙ্গে দেখা করা যাবে?
আমার মনে হয় ঘণ্টাখানেক পর যদি আপনি আসেন তবে ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।
আমরা ঘণ্টাখানেক সেন্ট লু-র রাস্তায় অলসভাবে হেঁটে বেড়ালাম। পোয়ারো এক মনে কি যেন চিন্তা করে চলেছে হাঁটতে হাঁটতে। আমি কথা বলে ওর মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটালাম না। মাঝে মাঝেই পোয়ারো মাথা নাড়ছিল আমার ভয় করছে হেস্টিংস। ভয় করছে। বেশ ভয় করছে। এমন অদ্ভুত, শরীর শিরশির করে ওঠা ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছিল যে আমিও রীতিমত আতঙ্কিত বোধ করতে শুরু করলাম। একসময় ও হঠাৎ আমার কবজির কাছটা খামচে ধরল, আমি ভুল করেছি। শোন বন্ধু, আমি প্রথম থেকেই ভুল করছি।
তার মানে তুমি বলতে চাও এটা টাকার জন্যে নয়?
না, না, অবশ্যই নয়। ওই ব্যাপারটায় আমি একশো শতাংশ ঠিক। ওহ হ্যাঁ। কিন্তু ওই দুটো……. খুবই সহজ………. অত্যন্তই সহজ। তবে হ্যাঁ একটা নাটকীয় মোড় অবশ্যই অপেক্ষা করছে, হ্যাঁ, অবশ্যই কিছু একটা। তারপর হঠাৎ ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে আচমকা। আমি ওনাকে বলেছিলাম। বলেছিলাম কিনা? Ettee petite, বাইরে থেকে আসা কোন কিছু স্পর্শ করবেন না। আমায় অমান্য করেছেন উনি। এরকুল পোয়ারোকে অমান্য করেছেন। চার-চারটে মৃত্যুর ছোবলও কি ওনার জন্যে যথেষ্ট নয়? পঞ্চম সুযোগটাও নিতেই হবে?
আমি কোন কথা বলিনা। বলতে পারিনা। নিশব্দে ওর উত্তেজনার পারদটাকে ছুঁতে চেষ্টা করে চলি। তারপর একসময় আমরা ফিরে চলি। সামান্য অপেক্ষার পর আমাদের ডাক পড়ে। বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া নিক। অস্থিরভাবে হাত দুটো নড়ে চলেছে, এপাশ ওপাশ করছে। মুখে চোখে জ্বরের ভাব। আবার। বিড়বিড় করে বলে সে।
পোয়ারো নিককে দেখা মাত্র বেশ আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে। ওর হাতটাকে নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে।
তাহলে আপনার এই নার্সিংহোমও আটকাতে পারল না। তীক্ষ্ণ গলায় বলে নিক।
আপনি যদি আমার নির্দেশ মানতেন তাহলে অবশ্যই সব ঠিকঠাকই চলত।
নিক বিস্ময়ভরা চোখে তাকায়, কিন্তু আমি তো তাই করেছি।
পোয়ারো অস্থিরভাবে মাথা নাড়ে মাদাম জোয়েল আমি আপনাকে বলেছিলাম বাইরের কোন খাবার খাওয়া তো দূরের কথা, স্পর্শও না করতে। কোন কিছু নয়।
কিন্তু, আমি তো সেরকম কিছু করিনি।
কিন্তু ওই চকোলেটগুলো?
ওহ, ওগুলো তো আপনি পাঠিয়েছিলেন।
মানে?
ওগুলো তো আপনার পাঠান। ওগুলো কেন খাব না?
পোয়ারো এবার তড়িতাহতের মত চমকে ওঠে, কিন্তু আমি তো সেরকম কিছু পাঠাইনি।
তা কি করে হতে পারে? বাক্সের ভেতর আপনার স্বহস্তে লেখা কার্ড ছিল।
কি? পোয়ারো বিমূঢ় মুখে তাকিয়ে থাকে।
নিক হতবাক ভঙ্গিতে পোয়ারোকে লক্ষ্য করে। তারপর নার্স মেয়েটিকে ইঙ্গিতে কাছে ডাকে। সে এলে তাকে চকোলেটের বাক্সের ভেতর যে কার্ডটা ছিল সেটা আনতে বলে। যুবতীটি কাঁচের জানালাটার পাশে টেবিলটার দিকে এগিয়ে যায়। কার্ডটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে। নিক কার্ডটা পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দেয়। পোয়ারো কার্ডটা হাতে নিয়ে কে গেলে। আমি বিস্ফারিত চোখে দেখি, ফুলের দোকানের কার্ডটাতে পোয়ারো যে কথাগুলো লিখেছিল, এই কার্ডটাতেও স্পষ্ট স্বচ্ছন্দ হাতের লেখায় হুবহু সেই কথাগুলোই লেখা।
Sacritonnere’ পোয়ারোর হতবাক মুখ দিয়ে শব্দদুটো ছিটকে বের হয়।
দেখলেন তো? নিক অভিযোগের গলায় বলে।
আমি এটা লিখিনি।
কি? নিক তীব্র চোখে তাকিয়ে থাকে।
যদিও এটা হুবহু আমার হাতের লেখার মতই।
পোয়ারোর কথাটা শুনে নিক সায় দেবার মত করে বলে হ্যাঁ। কমলা রঙের কারনেশান ফুলগুলোতে তো একই রকম হাতের লেখা ছিল।
পোয়ারো তীব্র চোখে কার্ডটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
আর তাই ওই চকোলেটের বাক্সটা পেয়ে আমি কোনরকম সন্দেহ করিনি।
কি করে বা সন্দেহ করবেন? কি করে সন্দেহ করা সম্ভব। ওহ্, জিনিয়াস, এক জিনিয়াস শয়তানের মুখোমুখি হয়েছি আমরা। অসাধারণ।
নিক অস্থিরভাবে নড়েচড়ে বসে।
নিজেকে দোষী ভাববেন না মাদাম জোয়েল। দোষ যদি কেউ করে থাকে, সে আমি। হ্যাঁ আমি। এই সম্ভাবনায় কথাটা আমার আগেই ভাবা উচিত ছিল। অবশ্যই ভাবা উচিত ছিল। না ম্যাডাম না। চিন্তা করবেন না। সাহস আনুন মনে। সাহস। এরপর থেকে এরকুল পোয়ারো আর এরকম কোন কিছু হতে দেবে না। দিব্যি দিচ্ছি। এটাই ছিল আমার শেষ ভুল।
এরপর এরকুল পোয়ারো ঘর থেকে বের হয়ে এল। আমরা গিয়ে মেট্রনের ঘরে ঢুকলাম। গোটা ব্যাপারটায় মহিলা বেশ বিব্রত এবং হতচকিত, বিমর্ষও।
পোয়ারো তাকে যথাসম্ভব সান্ত্বনা দেবার পর বলল, কাল পাহারাদার যে ছিল আমি একটু তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
মেট্রন সঙ্গে সঙ্গে তাকে ডেকে পাঠালেন। রোগাটে চেহারার, সরল মুখশ্রীর এক যুবক। চকোলেটের বাক্সটা কাল কখন এসেছিল প্রশ্ন করায় সে অসহায় মুখে উত্তর দেয়, সারাদিন কত মানুষ কত কিছুর জন্যে আসছে যাচ্ছে, সবার কথা, সবকিছুর কথা মনে রাখা মুশকিল।
পোয়ারো তাকে বলে নার্স মেয়েটি বলেছে এটা সবার শেষে এসেছিল। সন্ধ্যে ছটা নাগাদ।
সঙ্গে সঙ্গে যুবকটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, হা, হা ঠিক। এক ভদ্রলোক বাক্সটা নিয়ে এসেছিলেন।
রোগা চেহারা, পাতলা চুল? পোয়ারো আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করে।
চুল পাতলা খেয়াল আছে। চেহারাটা রোগাটে, কিনা মনে করতে পারছি না।
তোমার কি মনে হয় চার্লস ভ্যাইস নিজেই বাক্সটা নিয়ে এসেছিলেন? বিড়বিড় করে পোয়ারোকে বলি। আমার খেয়াল ছিল না স্থানীয় মানুষ হিসাবে ওকে অনেকেই চেনে।
না, না, যিনি এসেছিলেন তিনি মিঃ ভ্যাইস নন। পাহারাদার যুবকটি বলে উনি লম্বায় বেশ কিছুটা বেশি ছিলেন। অনেক বেশি সুপুরুষও। একটু ভেবে নিয়ে সে যোগ করে।
লাজারুম। আমার মুখ থেকে শব্দটা বের হওয়া মাত্র পোয়ারো তীব্র ভৎর্সনার চোখে। আমার দিকে তাকায়। আমি মাথা হেলিয়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি করি।
তারপর? পোয়ারো পাহারাদারটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
আমি ভদ্রলোকের হাত থেকে পার্সেলের বাক্সটা নিয়ে ভেতরের ঘরের টেবিলে রাখি। যত জিনিস আসে সব ওখানে জমা করাটাই নিয়ম। তারপর যে রোগীর জিনিস সেই ঘরের নার্স এসে সেটা নিয়ে যায়।
পোয়ারো এবার মাথা নাড়ে, ঠিক আছে, ধন্যবাদ। তুমি এখন আসতে পার।
পাহারাদারটি বের হয়ে যাবার পর পোয়ারো মেট্রনের দিকে তাকিয়ে বলে, এবার একটু নার্সটির সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি।
নার্স মেয়েটি খুব সহজেই সন্ধ্যে নাগাদ পার্সেলটা নিয়ে যাবার কথা মনে করতে পারল।
পোয়ারো বিড়বিড় করে বলে, তার মানে পার্সেলটা নীচের টেবিলে বেশ কিছু সময় পড়েছিল নজরবিহীন অবস্থায়।
এই বাক্সটা ছাড়াও আরও দুটো বাক্স ছিল। একটা ফুলের। অন্যটা ডাক মারফত এসেছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, সেটাও এক বাক্স চকোলেট।
কথাটা শোনামাত্র পোয়ারো কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করে, আরও একটা অন্য বাক্স? কে পাঠিয়ে ছিল সেটা?
না, ওই বাক্সটার ভেতর কোন কার্ড বা প্রেরকের নাম ছিল না। মিস বার্কলি দুটো বাক্সই খুলেছিলেন। তারপর আক্ষেপের ভঙ্গিতে বলেছিলেন–কি দুর্ভাগ্য, এত লোভনীয় চকোলেট অথচ আমার খাওয়া বারণ। তারপর তিনি ওই বাক্সটা আমাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বলে অন্য বাক্সটা থেকে তুলে একটা চকোলেট খেয়েছিলেন।
হাসপাতালের বাইরে বের হয়ে এসে পোয়ারো প্রবল চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে বলে। সংশয়ের ওপর আবার নতুন সংশয় যোগ হচ্ছে। ওর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে অন্তত একটা ব্যাপার তো বুঝতে বা জানতে পারা গেল, বাক্সটা লাজারুম এনেছিলেন।
ব্যাপারটা আমার কাছে খুব আশ্চর্যের লাগছে।
তুমি কি ওনাকে এব্যাপারে কিছু বলবে?
অবশ্যই। নিশ্চিতভাবেই। মাদামজোয়েলের শারীরিক অবস্থা এখন কেমন সেটা ওনাকে জানানো আমাদের কর্তব্য। মাদাম মৃত্যুর দোরগোড়ায় রয়েছেন, হয়ত বাঁচাবেন না, শুনলে ওনার মানসিক অবস্থাটা ঠিক কি রকম হয় জানতে খুব ইচ্ছে করছে। তুমি খুব খুঁটিয়ে এই কথাটা শোনামাত্র ওনার মুখের অভিব্যক্তিটা ঠিক ঠিক নজর করবে। অবশ্যই বুঝে নেবে।
লাজারুসকে খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। সৌভাগ্যবশত হোটেলের বাইরে গাড়ির গেট খুলে ঝুঁকে পড়ে তিনি কি যেন পরীক্ষা করছিলেন।
পোয়ারো বিনা কালক্ষেপে সোজা ওর কাছে চলে গেল, মঁসিয়ে লাজারুম, কাল সন্ধ্যেবেলা আপনি মাদাম জোয়েল নিকের জন্য একটা চকোলেটের বাক্স রেখে এসেছিলেন।
দৃঢ় গলায় বলে হ্যা। বেশ একটু অবাক হয়েই পোয়ারোর দিকে তাকায় সে। এরকম একটা সামান্য ব্যাপারে পোয়ারোকে মাথা ঘামাতে দেখে যেন কিছুটা বিরক্ত গলাতেই এরপর সে বলে, আসলে ওটা পাঠিয়েছিলেন ফ্রেডি, মানে, মিসেস রাইস। উনিই আমাকে বলেছিলেন, অনুরোধ করেছিলেন ওটা পৌঁছে দিয়ে আসতে।
ওহ, তাই বুঝি? কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তারপর পোয়ারো প্রশ্ন করে, মিসেস রাইস এখন কোথায়?
একতলার লাউঞ্জে পেয়ে যাবেন।
আমরা ভেতরে ঢুকে দেখলাম তিনি এক কাপ চা নিয়ে বসে আছেন। আমাদের দেখামাত্র উদ্বিগ্ন, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখে তিনি প্রশ্ন করলেন, নিক নাকি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে?
হ্যাঁ। খুব রহস্যজনক ব্যাপার মাদাম জোয়েল, আচ্ছা, আপনি কাল বিকেলে মাদাম নিককে একবাক্স চকোলেট পাঠিয়েছিলেন তো?
হ্যাঁ, নিকই আমাকে বলেছিল সেগুলো পাঠাতে।
মাদাম জোয়েল নিক আপনাকে চলোলেট পাঠাতে অনুরোধ করেছিল? পোয়ায়োর ভঙ্গিতে বিস্ময় চাপা থাকে না।
অবশ্যই, ফ্রেডরিকা দৃঢ় গলায় বলেন।
কিন্তু ওনার সঙ্গে আপনার দেখা হল কি ভাবে? কারও সঙ্গে ওনার দেখা করা তো বারণ।
না দেখা হয়নি। নিক আমাকে টেলিফোন করেছিল।
কথাটা শুনে পোয়ারোকে কিছুটা চমকিত দেখায়, আচ্ছা কথাগুলো বলার সময় ওনার গলা বা কথা বলার ভঙ্গি কি দুর্বল ক্লান্ত মনে হয়েছিল?
না, একেবারে না। বরং বেশ দৃঢ় গলায় কথা বলছিল। বেশ কিছুটা অন্যরকমই লেগেছিল ওর গলা এবং কথা বলার ভঙ্গিটা। প্রথমটা আমি তো বুঝতেই পারিনি নিকই যে কথা বলছে।
তবু আপনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে এটা আপনার বান্ধবীই বলছেন।
ফ্রেডরিকা এবার কিছুটা চমকিত চোখে তাকায়। পোয়ারোর কথার অর্থটা যেন সঠিকভাবে ওর বোধগম্য হয় না।
তার মানে? নিক না হলে কে হবে?
পোয়ারো মৃদু হাসে, অথচ গম্ভীর মুখে বলে, খুব কৌতূহল-উদ্দীপক প্রশ্ন। একটু থেমে কি যেন ভেবে নেয় পোয়ারো, আপনি দিব্যি করে বলতে পারবেন ওটা আপনার বান্ধবীরই কণ্ঠস্বর ছিল?
না। ধীর কণ্ঠে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলে ফ্রেডরিকা। নিকের কণ্ঠ ওটা, আমি নিশ্চিত বলতে পারব না, ওর কণ্ঠ ভিন্নরকম। তবে সেই সময় আমার মনে হয়েছিল হয়ত ফোনে শুনতে ওইরকম লাগছে। অথবা অসুস্থতার কারণে………..
পোয়ারো মাথা হেলিয়ে ফ্রেডরিকার বক্তব্যে সায় দেয়।
প্রায় হতভম্ব গলায় ফ্রেডি এবার বলে, কে? তাহলে ওটা কে ফোন করেছিল?
আমি সেটাই তো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি মাদাম। পোয়ারোর গলার গাম্ভীর্যে এবার ফ্রেডির মুখে ধীরে ধীরে তীব্র আতঙ্ক ফুটে ওঠে। কি যেন একটা বুঝে নেবার ভঙ্গিতে সে বলে, নিক কেমন আছে মিঃ পোয়ারো? ওর কিছু হয়েছে কি?
পোয়ারো সায় দেবার ভঙ্গিতে মাথা দোলায়, আপনার বান্ধবী ভয়ঙ্কর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আপনার পাঠান চকোলেটগুলোর মধ্যে তীব্র বিষ মেশান ছিল। পোয়ারোর কথাগুলো শুনতে শুনতে ফ্রেডি শিউরে ওঠে। ভয়ঙ্কর আতঙ্কে দুহাতে মুখ ঢাকে, না, না, তা হতে পারে না। বিষ? হে ভগবান তা কি করে সম্ভব? আমি আর জিম ছাড়া চকোলেটগুলোর বাক্সটা কেউ স্পর্শ করেনি। আপনাদের নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে মিঃ পোয়ারো। ভুল হচ্ছে। এ হতে পারে না।
আমার কোন ভুল হচ্ছে না মাদাম। ভুল হবার কোন সুযোগই নেই। পোয়ারো ঘুরে দাঁড়ায়। সিঁড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। আমি ওকে অনুসরণ করি।
আমাদের ঘরে এসে পোয়ারো ক্ষিপ্তভঙ্গিতে টুপিটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। পুরোপুরি অন্ধকারে রয়েছি। মাদাম জোয়েল নিকের মৃত্যুতে কে লাভবান হবে? মাদাম রাইস চকোলেট বাক্স কিনেছেন স্বীকার করছেন। তারপরেও উনি……… না, সেটা অত্যন্ত মূখের মত কাজ হবে। আর উনি মোটেই বোকা নন। একেবারেই না। সেক্ষেত্রে….।
কিন্তু উনি কোকেন নেন। হেস্টিংস ব্যাপারটা মাথায় রাখ। এতে কোন ভুল নেই। আর চকোলেটের ভেতর কোকেন পোরা ছিল তাতেও কোন ভুল নেই। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ? উনি বললেন অন্যটায়, এটায় নয়। এটার ব্যাখ্যাও পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য চকোলেটের বাক্সটার কথাতো ওনার জানবারই কথা নয়। তাহলে? পোয়ারো একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ে। ওর কপালে চিন্তার গভীর খাঁজ। মাদাম রাইস নিশ্চিতভাবেই কিছু জানেন। কিন্তু মুখ খুলছেন না। আর উনি সেরকম মহিলা নন কথার চাপে ঘাবড়ে গিয়ে কিছু বলবেন। কিন্তু কি জানেন উনি? সেটা বলছেন না? ওনার টেলিফোনের কথা কি সত্যি? না উনি বানিয়ে বলছেন? যদি সত্যি হয় তাহলে ওটা কার গলার স্বর ছিল?
সব পুরো অন্ধকার।
হতাশার বহিঃপ্রকাশ শুনে আমি বললাম অন্ধকারের পরই কিন্তু সূর্যোদয় হয়।
পোয়ারো সমর্থনের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, তাহলে, দ্বিতীয় আরেকটা বাক্স ছিল। সেটা এসেছিল ডাকযোগে।
আমি আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। পোয়ারো দ্রুত আমাকে বাধা দেয়, না, না, আবার একটা প্রবচন নয়। আমি আর নিতে পারব না। তুমি কি সত্যি আমার একজন শুভাকাঙ্খি বন্ধু?
আমি বেশ অবাক চোখে তাকাই অবশ্যই।
তাহলে যাও হেস্টিংস, এক বাক্স তাস কিনে আন।
আমি তীব্র চোখে ওর দিকে তাকালাম। আবার ঠাণ্ডা গলায় বললাম, বেশ।
আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম এই তাস কিনে আনবার অজুহাতে পোয়ারো এখনকার মতো ব্যাপারটা আমার কাছে এড়িয়ে যেতে চাইছে।
এখানেই আমি ওকে ভুল বুঝেছিলাম। সেই রাতে খাবার পর প্রায় ১০-১৫ মিনিট নাগাদ বসবার ঘরে এলাম দুজনে। দেখলাম আমার আনা তাসগুলো একটার ওপর একটা বসিয়ে সাজিয়ে ঘর বানাচ্ছে। আমি জানি এটা ওর পুরনো পদ্ধতি। যখন স্নায়ুর ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়, পোয়ারো এইভাবেই স্নায়ুকে শান্ত করে, বলা ভাল নিজের স্নায়ুকে বশে আনে। এইসব দেখতে দেখতে চেয়ারে হেলান দিয়ে কখন যে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই জানি না। হঠাৎ পোয়ারোর ঝাঁকুনিতে আমার ঘুম ভাঙল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম, সোয়া পাঁচটা। সকাল হয়ে গেছে। চোখ কচলাতে কচলাতে পোয়ারোর দিকে তাকালাম, আমাকে দুহাত নাড়াতে নাড়াতে উচ্ছ্বাসভরা গলায় সে আমাকে বলে চলেছে, তুমি ঠিক বলেছ বন্ধু, একদম ঠিক বলেছিলে।
আমি আধো ঘুমের গলায় বলি–কি ব্যাপার?
মাদাম জোয়েল মারা গিয়েছেন।
কি-ই-ই-ই? আমি আঁতকে উঠি, চেয়ারে সটান উঠে বসি।
আরে না, না। সত্যি সত্যি ব্যাপারটা ঘটেনি।
আমি একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলি। উত্তেজনার চোখে পোয়ারোর দিকে তাকাই। এ আবার কি ধরনের রসিকতা?
তবে ব্যাপারটার যদি ব্যবস্থা করা যায় আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে।
পোয়ারো হাশিখুশি ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকায়–খুনটা সম্পূর্ণ হল, চারবার, চারবার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়ে অবশেষে খুনী সফল হল। আমি দেখতে চাই তারপর কি ঘটে?
খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হবে এটা। আমারও তাই মনে হচ্ছে না। আমার দিকে। তাকিয়ে কথাটা বললেও, আসলে নিজের মনে স্বগোতোক্তির মতো করে বলে।
.
১৮.
জানালায় একটি মুখ
পরের দিনের ঘটনাগুলো আমার স্মৃতিতে যথাযথ নেই। সকাল থেকেই প্রচণ্ড বেগে জ্বর এল। জ্বরের ঘোরে প্রায় অচেতন হয়ে শুয়ে রইলাম। এরপর কি ঘটনা ঘটল কিছুই জানতে পারলাম না। শুধু শুয়ে শুয়ে জ্বরের ঘোরে বুঝতে পারছিলাম পোয়ারো একবার করে ঘরে আসছে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে।
পরে জানতে পারলাম পোয়ারো ডাঃ গ্রাহামের সঙ্গে কথা বলে নিজের পরিকল্পনাটায় তাকে রাজি করায়।
ডাঃ গ্রাহামের বিশ্বস্ত কয়েকজন হাসপাতাল কর্মচারীকেও নিজের পরিকল্পনায় সামিল করে। অবশ্যই ডাঃ গ্রাহামের হাসপাতাল কর্মচারীদের প্রভাবেই এটা সম্ভব হয়। তারপর পুলিশ। কর্নেল ওয়েস্টন প্রথমে পোয়ারোর প্রস্তাবকে খুব একটা বাস্তবতার বা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মানতে পারছিলেন না। পোয়ারোর বোঝানোর পর তিনিও অনেকটা নিমরাজি হয়েই সম্মতি দিলেন। যদিও তিনি বেশ পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন ব্যাপারটাতে তার কোন দায়িত্ব থাকছে না। মিথ্যাচারের দায়িত্ব পুরোটাই পোয়ারোকে নিতে হবে। এবং তারপরের দায়িত্বও। পোয়ারো এককথায় রাজি হয়ে যায়।
সারাটা দিন কম্বল মুড়ে শুয়েই কাটিয়ে দিলাম। মাঝে মাঝেই পোয়ারো এসে ঘটনার সাম্প্রতিকতম অগ্রগতি সম্পর্কে আমাকে ওয়াকিবহাল করে যাচ্ছিল। বিকেলের দিকে ঘরে এসে চোখ টিপে মুচকি হেসে বলল, এক প্রস্থ লিলি পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে বুঝলে? গভীর সমবেদনার সঙ্গে কথাটা বলে পোয়ারো।
একটু হেসে ও আবার যোগ করে কি ভয়ঙ্কর মজার ব্যাপার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ও আবার বেরিয়ে যায়। রাতের দিকে আবার ঘরে আসে।একটু আগে মাদাম রাইসের সঙ্গে কথা হল। উনি প্রিয় বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যুতে ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। নিক নেই বিশ্বাসই করতে পারছেন না। বারবার বলছিলেন, ওরকম একজন ছটফটে, প্রাণচঞ্চল মেয়ে……… এ ভাবে অকালে……আমিও সর্বান্তকরণে ওর কথায় সায় দিলাম। ওহ কি মজার সব কাণ্ডটা যে ঘটবে এবার।
তুমি কি করে ব্যাপারটাকে উপভোগ করছ? ক্ষীণ গলায় আমি বলি।
আঃ হেস্টিংস, বোকার মত কথা বল না। এটা আমার পরিকল্পনার একটা অঙ্গ। মজাটাকে সফল ভাবে সফল করা। যাইহোক, কথা প্রসঙ্গে উনি বারবার বলছিলেন চকোলেটের ব্যাপারটা উনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। ব্যাপারটা অসম্ভব। আমি তখন ওকে বলি, ময়না তদন্তের রিপোর্টেই সব জানা যাবে। তখন আপনি নিশ্চিত হবেন। আমার মুখে চকোলেটে কোকেন মেশানো ছিল শুনে, মাদাম জোয়েল নিকের তাতেই মৃত্যু হয়েছে জানতে পেরে উনি ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন।
তুমি ঠিকই বলেছ হেস্টিংস। সম্ভাবনা প্রবলভাবে সেদিকেই ইঙ্গিত করেছে। কিন্তু অপরাধের অতি সরলীকরণ ব্যাপারটাই আমার বেশ ধাঁধায় ফেলেছে হে।
পোয়ারো আমার সামনের চেয়ারটায় বসে। এস, আর একবার সম্ভাবনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তিনটে সম্ভাবনা ঘটতে পারে। প্রথম সম্ভাবনা, মাদাম রাইস চকোলেট এনেছিলেন। মিঃ লাজারুম সেটা দিয়ে আসেন। এক্ষেত্রে ওদের দুজনের কেউ একজন, অথবা, দুজনই অপরাধী হতে পারেন আর ওই তথাকথিত মাদাম জোয়েলের ফোন? নির্ভেজাল বানানো।
পোয়ারো থামে। তারপর একটু ভেবে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে সম্ভাবনা দুই, দ্বিতীয় চকোলেট বাক্সটা। যে কেউ সেটা পাঠাতে পারে। আমাদের সন্দেহের তালিকায় ক থেকে জ’-র মধ্যে যে কেউ। কিন্তু, সেক্ষেত্রে ফোনটা করা হল কেন? ব্যাপারটা এভাবে জটিল করা হল কেন? তোমার কি মনে হয় হেস্টিংস?
আমি মাথা নাড়লাম। একশ দুই ডিগ্রি জ্বরের ঘোের ধরা মস্তিষ্ক নিয়ে আমার পক্ষে এরকম জটিল বিষয়ে মন্তব্য করা অসম্ভব।
পোয়ারো চেয়ার থেকে একবার উঠে দাঁড়ায়, তারপর আবার বসে পড়ে। এবার সম্ভাবনা তিন, মাদাম রাইসের আনা নির্দোষ সাধারণ বাক্সটাকে বদলে দেওয়া হয়েছিল বিষভরা চকোলেটের বাক্স দিয়ে। সেক্ষেত্রে টেলিফোনটার একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ পাওয়া যায়। মাদাম রাইসের পক্ষে মাদাম জোয়েল বার্কলিকে খুন করার যুক্তিসঙ্গত বেশ কিছু কারণও বের করা অসম্ভব হবে না। সুতরাং, সম্ভাবনা তিন-কেই সবচেয়ে বেশি যুক্তিগ্রাহ্য কারণ বলে মনে হচ্ছে। তাই নয় কি?
অবশ্যই। পোয়ারো আমার কথায় নির্বিবাদে সায় দেয়। এতকিছু পরেও পোয়ারো কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারে না। দু হাতে মুখ ঢেকে চেয়ারে হেলান দিয়ে একমনে কি যেন ভাবতে থাকে। নানা কথা চিন্তা করতে করতে একসময় কখন যেন দুর্বলতাজনিত কারণে ঘুমিয়ে পড়ি।
আমার আবার যখন ঘুম ভাঙল তখন বেশ গভীর রাত। টেবিলের সামনের চেয়ারটায় বসে রয়েছে পোয়ারো। ওর সামনে একটা খোলা বড় কাগজ। আমি দেখেই চিনতে পারলাম। ওটা সেই কাগজ যেটার মধ্যে পোয়ারো ক’ থেকে জ’ পর্যন্ত সন্দেহজনকদের একটা তালিকা তৈরি করেছিল। পোয়ারো যেন আমার মনের অনুচ্চারিত প্রশ্নটা পড়তে পারে, হ্যাঁ বন্ধু, পুরো ব্যাপারটাকে আবার নতুন করে বানাচ্ছি আমি। একেবারে সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছি আবার। আবার, নতুন কিছু প্রশ্ন যার উত্তর খুঁজে পাওয়াটা এই নতুন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খুব জরুরি।
কতদুর এগিয়েছ তুমি? আমার প্রশ্নে পোয়ারো উত্তর দেয়, প্রায় শেষ করে ফেলেছি। তুমি শুনতে চাও?
নিশ্চয়ই।
বেশ। আমি তাহলে তোমাকে পড়ে শোনাচ্ছি পুরোটা।
পোয়ারো সামান্য কেশে নিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে পড়তে শুরু করে।
(ক) এলিন–কেন সে রাতে বাজি পোড়ানো দেখতে না গিয়ে বাড়ির ভেতর ছিল। মাদামজোয়েলের অবাক হওয়া এবং দেওয়া প্রমাণ (প্রতি বছরই ও বাজি পোড়ানো দেখতে বের হয়) বলে দিচ্ছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। ও কি সন্দেহ করেছিল কিছু ঘটবে? ও কি কাউকে বাড়িতে (জ?) ঢুকতে দেখেছিল? গোপন প্যানেল আছে ঘরে, এ ব্যাপারে কি ও সত্যি কথা বলছে? যদি সত্যি সেরকম কিছু থাকে, কোথায় আছে কেন মনে করতে পারছে না? ও জোর দিয়ে আছে বলছে? যদি সত্যি সেরকম কিছু থাকে, কোথায় আছে কেন মনে করতে পারছে না? ও জোর দিয়ে আছে বলছে, অথচ, মাদামজোয়েল অস্বীকার করছেন। ব্যাপারটা বানানো হলে, এলিন কেন বানিয়ে বলছে? নিককে লেখা মাইকেল সেটনের প্রেমপত্রগুলো কি ও পড়েছে? নাকি মাদামজোয়েলের এনগেজমেন্টের খবর শুনে ওর বিস্ময় সত্যি?
(খ) এলিনের স্বামী যতটা দেখায় সত্যি কি ততটাই নির্বোধ বা সরল, ভাল মানুষ? ওকি সেসব জানে (যাই হোক সেটা) যা এলিন জানে?
(গ) এলিনের সন্তান–রক্ত, হিংসা দেখে ওর আনন্দ পাওয়া কি ওর বয়সী ছেলের পক্ষে স্বাভাবিক, নাকি সে মানসিক অসুস্থ? এই মানসিক অসুস্থতা কি সে বাবা-মা কারও কাছ থেকে পেয়েছে? ও কি খেলনা পিস্তল থেকে কখনও গুলি ছুঁড়েছে?
(ঘ) মিঃ ক্রফট কে ইনি? কোথা থেকে এসেছেন? তিনি যেটা দিব্যি করে বলছেন, সেটা কি সত্যি! উইলটা সত্যি উনি পাঠিয়েছিলেন? যদি না পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে তার পেছনে উদ্দেশ্য কি?
(ঙ) মিসেস ক্রফট (মিঃ ক্রফটের মত একই) কে, কোথা থেকে এসেছেন, ওরা স্বামী-স্ত্রী কি কোন কারণে আত্মগোপন করে আছেন? তাই যদি হবে, কারণ কি সেই আত্মগোপনের? বার্কলি পরিবারের সঙ্গে ওদের কি কোন সম্পর্ক, যোগাযোগ আছে?
(চ) মিসেস রাইস–উনি কি নিক-এর বাগদানের ব্যাপারে জানতেন? নিছক অনুমান? না কি উনি বান্ধবীর প্রেমপত্রগুলো পড়েছিলেন? সে ক্ষেত্রে উনি জানতেন বা অনুমান করা ওর পক্ষে কঠিন ছিল না যে নিক এবার সেটনের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী? মাদাম জোয়েলের সম্পত্তি থেকে উনি কি পাবেন, তা উনি জানতেন কি? (সম্ভবত জানতেন। নিক ওনাকে নিশ্চয়ই বলেছিলেন) নিজের মাদক সরবরাহের সেই নোটে। বয়ফ্রেন্ড’ বলে কাকে উল্লেখ করেছিলেন মিসেস রাইস? সে কি জ’? ফোন করে নিকের তাকে চকোলেট কিনতে বলার কথাটা কি সত্যি? নাকি ইচ্ছাকৃত মিথ্যে?
একটা ব্যাপার দেখেছ? পোয়ারো হঠাৎ পড়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকায়। মাদাম রাইস সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো পুরোপুরি অস্পষ্ট, এক একটি প্রহেলিকা যেন। যে কারণে, নিশ্চিতভাবেই, উনি সব কিছু জানেন। কথাগুলো বলে পোয়ারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর আবার ওর লেখা পাতাটায় চোখ রাখে, পড়তে শুরু করে।
(ছ) মিঃ লাজারুম ওনাকে এই অপরাধে যুক্ত করার মতো সেরকম কোন প্রশ্ন নেই। শুধুমাত্র উনি বিষাক্ত চকোলেটের বাক্সটা বদলে দিয়েছিলেন। তাছাড়া, আর একটাই মাত্র ছোট্ট খটকা। উনি একটা প্রায় মূল্যহীন ছবি কেনবার জন্যে কেন এত চড়া দাম দিয়েছিলেন?
উনি হয়তো নিক-কে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। আমার উত্তরটা শুনে পোয়ারো মাথা নাড়ে। নাহ, ভুলে যেওনা বন্ধু, উনি ব্যবসায়ী। কোন জিনিস ক্ষতিতে কিনে বিক্রি করতে চাইবেন না। বন্ধুকে সাহায্য করার ইচ্ছে থাকলে গোপনে কোনভাবে টাকা ধার দিয়েও সাহায্য করতেন।
কিন্তু এই অপরাধের সঙ্গে ওই ঘটনার কোন যোগ নেই। পোয়ারো কথাটা শুনে সায় দেবার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।সেটা সত্যি, তবে এই খটকাটার উত্তর আমি অবশ্যই জানতে চাইব। নিশ্চিতভাবেই জানতে চাইব।
পোয়ারো এক মুহূর্ত থামে, তারপর বলে–এবার, জ’।
(জ) এখানে একটা প্রশ্ন চিহ্ন ছাড়া আপাতত আমার হাতে কিছু নেই। সত্যিই কি কেউ আছে এই জ’ চরিত্রে? যদি থাকে…..
তখনি পোয়ারোর নজর পড়ে আমার ওপর, কি ব্যাপার? কি হয়েছে হেস্টিংস? আমি এতক্ষণে পোয়ারোর নজর ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। আমার গলা চিরে একটা তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার বের হসে আসে। আমার কাঁপা কাঁপা হাতের আঙুল নির্দেশ অনুসরণ করে পোয়ারো জানালার দিকে তাকায়।
একটা মুখ পোয়ারো, ভয়ঙ্কর একটা মুখ, জানালার কাঁচের ওপর………
যদিও এ মুহূর্তে সেখানে কিছু নেই। পোয়ারো জানালাটার কাছে গিয়ে সেটাকে ঠেলে দেয়, ঝুঁকে বাইরেটা দেখে।
কেউ নেই এখন। পোয়ারো চিন্তিত গলায় বলে, তুমি নিশ্চিত হেস্টিংস যে তুমি কাউকে সত্যি দেখেছ? মনের ভুল নয়তো?
না, আমি নিশ্চিত, বীভৎস একটা মুখ।
হুম, ওপাশে একটা ব্যালকনি আছে। আমাদের কথা শুনবে ঠিক করে থাকলে অবশ্যই ওখানে উঠে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। বীভৎস মুখ বলতে তুমি কি বোঝাতে চাইছ হেস্টিংস?
ফ্যাকাশে, কঠিন চোখে নির্মমভাবে তাকিয়েছিল। প্রায় ভৌতিক একটা মুখ।
হুম। পোয়ারো কাগজগুলো গুছোতে-গুছোতে চিন্তিত মুখে বলে এটাই আশার কথা, এই বীভৎস মুখের মালিক যদি আমাদের কথা শুনেও থাকে, মাদাম জোয়েল নিক যে বেঁচে আছেন সেই বিষয়ে আমরা কোন কথা আলোচনা করছিলাম না, শোনেনি।
কিন্তু পোয়ারো, নিককে মৃত বানিয়ে তোমার কি লাভ হল? তোমার পরিকল্পনা মত সেরকম কিছু নাটকীয় ব্যাপার তো ঘটল না।
নাহ্, এত তাড়াতাড়ি সেরকম কিছু ঘটবে আশা করছি না। ২৪ ঘণ্টা অন্তত কাটুক। আগামীকাল, আমার গোয়েন্দাগিরি যদি ভুল না হয় তাহলে আগামীকাল অবশ্যই কিছু একটা ঘটবে। পোয়ারো একটু থামে, তারপর উদাস গলায় বলে, আর তা যদি না ঘটে, ধরে নিতে হবে আমার প্রথম থেকে এ পর্যন্ত সম্পূর্ণ থিয়োরিটাই ভুল।
পরদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গল বেশ বেলাতে। সামান্য দুর্বল লাগছিল। জ্বরটা কমে গেছে অবশ্য পুরোপুরি। আমরা প্রাতরাশ খাবার পর পোয়ারো সেদিনের ডাকে আসা চিঠিগুলো নিয়ে বাছতে বসল। আহ, এই যে।
পোয়ারোর ছোট্ট মন্তব্য শুনে আমি আমার চিঠির দঙ্গল থেকে মুখ তুলে বললাম কি ব্যাপার হে?।
এই চিঠিটা পড় পোয়ারো আমার দিকে একটা চিঠি এগিয়ে দেয়। আমি হাতে নিয়ে চিঠিটার দিকে তাকাই। ম্যাগি বার্কলির মা, মিসেস বার্কলির লেখা চিঠিটার বয়ান এই রকম
প্রিয় মঁসিয়ে পোয়োনরা,
বাড়ি ফিরে এসে আমার হতভাগ্য মেয়ের একটা চিঠি পেলাম। সেন্ট লু-তে পৌঁছানোর পর সে চিঠিটা পাঠিয়েছিল। চিঠিটা পড়বার পর কেন জানি না মনে হচ্ছে আপনার কাজে হয়ত সাহায্য করতে পারে চিঠিটা। অন্তত একবার পড়ে দেখতে চাইতে পারেন। তাই চিঠিটা পাঠালাম।
আপনার সহৃদয় সাহায্যের জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা জানবেন।
—মিসেস জিন বার্কলি
পোয়ারো ততক্ষণে ম্যাগির চিঠিটা পড়া শেষ করেছে। এবার সে চিঠিটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়।
প্রিয় মা,
আমি নিরাপদেই পৌঁছেছি। বেশ আরামদায়ক সফর ছিল। এখানকার আবহাওয়াও এখন খুব ভাল। নিক ভালই আছে। তবে মাঝে মাঝে ওকে দেখে একটু অস্থির মনে হচ্ছে। তবে, আমি এখনও বুঝতে পারছি না ও কেন এত তাড়াহুড়ো করে আমাকে টেলিগ্রাম করে এখানে ডেকে পাঠাল।
আজ আর লিখছি না। আমি আর নিক এখন প্রতিবেশীর বাড়িতে চা খেতে যাব। ওরা অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি। নিকের ভাড়াটে। নিক বলেছে ওরা এমনিতে দয়ালু হলেও, মানুষ হিসাবে খুব বিশ্রী, ভয়ানক।
—তোমার ম্যাগি।
পুঃ–নিক বলেছে ওর দুর্ভাবনা, উদ্বেগের কারণ আছে। পরে আমাকে সব বলবে। এই বাড়ি থেকে চায়ের নিমন্ত্রণ থেকে ফিরে ওর কথা শুনব।
মৃতের কণ্ঠস্বর পোয়ারো শান্তভাবে বলে এবং যা আমাদের কিছুই জানাল না পোয়ারোর কথাটা শুনে আমি প্রশ্ন করি তোমার অন্য চিঠিগুলো, ওগুলো থেকেও কিছু জানতে পারলে না?
না হেস্টিংস, আমি খুবই হতাশ। যে তিমিরে ছিলাম সেখানেই থেকে গেলাম। প্রাপ্তিযোগের ঘর শূন্য।
পোয়ারোর কথা শেষ হওয়া মাত্র ফোনটা বেজে উঠল। পোয়ারো ফোনটা ধরা মাত্র দেখলাম নিমেষে পোয়ারোর মুখের ভাব পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। আমার চোখ থেকে নিজের উত্তেজনা আড়াল করতে পারে না ও। ফোনালাপে পোয়ারোর অবদান কিছুই ছিল না বলতে গেলে। মনোযোগ দিয়ে অন্য পক্ষের কথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে শুধু সাড়াবোধক শব্দ করছিল সে। ফলে বার্তার কিছুই আমার কানে পৌঁছল না, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কি বিষয়ে ওই চমকদার ফোনটা।
শেষ পর্যন্ত একসময় বাক্যালাপ শেষ হল। Tnes bien, Jeaouses remerei বলে ফোনটা নামিয়ে রেখে পোয়ারো, আমি যেখানে বসেছিলাম, সেখানে ফিরে আসে। ওর দুচোখে উত্তেজনা চকচক করছিল।
Mon ami পোয়ারো অস্ফুটে বলতে বলতে আমার সামনের চেয়ারটায় বসে, তোমায় কি বলেছিলাম? এবার ঘটনা ঘটতে শুরু করবে।
কি হয়েছে?
মিঃ চার্লস ভ্যাইস ফোন করেছিলেন। তিনি জানালেন আজ সকালে ডাক মারফত তিনি তার বোনের করা একটি উইল পেয়েছেন। যেটা গত ফেব্রুয়ারি মাসের বানানো।
কি?
একেবারে নিখুঁত সময় ওটা পৌঁছেছে। কি বল?।
আমি ভুরু কুঁচকে তাকাই তোমার কি মনে হয়? উনি সত্যি বলছেন?
পোয়ারো হাসে এই তো সবে শুরু বন্ধু। মাদাম জোয়েল নিক মারা গেছেন। এখন নতুন নতুন এরকম অবাক করা কত কাণ্ডকারখানা ঘটবে। শুধু দেখে যাও।
সত্যিই তাই। তা নতুন উইলের বিষয়বস্তু কি?
মিঃ ভ্যাইস সেসব কিছু বললেন না বিস্তারিতভাবে। সেটাই উচিত। তবে এটা যে নিজের বলা উইলটাই, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ এটার সাক্ষী হিসাবে শ্রীমতী এলিন উইলসন এবং তার স্বামীর সই ছিল।
পোয়ারো একঝলক কি যেন ভেবে নিয়েই দ্রুত পায়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। আমি মাদাম জোয়েল ম্যাগির চিঠিটা আর একবার পড়তে চাই। আমার কি একটা ব্যাপার যেন নজর এড়িয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। কৌতূহল উদ্দীপক কিছু একটা। চিঠিটা তুলে নিয়ে পোয়ারো আরও একবার পড়তে থাকে।
আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়াতে থাকা ইয়টগুলোর পাল্লাবাজি দেখতে থাকি। হঠাৎ পোয়ারোর মুখ থেকে বের হয়ে আসা প্রবল বিস্ময়তাড়িত একটা শব্দে আমি মুখ ফিরিয়ে তাকাই। পোয়ারো দু হাতে তার মাথাটা চেপে ধরে আছে। ওহ আমি কি অন্ধ হয়ে গেছি? পোয়ারো চাপা আর্তনাদ করে ওঠে।
কি হয়েছে?
কি হয়নি হেস্টিংস? কি হয়নি? এরকম একটা সরল ব্যাপার কি করে নজর এড়িয়ে গেল? কিচ্ছু দেখতে পেলাম না আমি? কিছু না?
ভগবানের দোহাই পোয়ারো, বল কি হয়েছে?
দাঁড়াও, দাঁড়াও। আবার ব্যাপারগুলোকে, নতুন করে সাজাতে হবে। পোয়ারো টেবিল থেকে তার সম্ভাব্য অপরাধীদের তালিকাটা তুলে নেয়। দ্রুত সেটার ওপর নজর বুলিয়ে চলে। ওর ঠোঁট দুটো নড়তে থাকে। আর তালে তালে সায়ব্যঞ্জক ভঙ্গিতে ওর মাথাটা নড়তে থাকে।
পড়া শেষ হলে পোয়ারো আরাম কেদারাটায় হেলান দিয়ে বসে। ওর দুচোখ বন্ধ হয়ে যায়। গভীর চিন্তায় ডুবে যায় সে।
একসময় একটা গভীর শ্বাস ফেলে উঠে বসে, সোজা হয় সে। আমার দিকে সোজাসুজি তাকায়। প্রিয় মুদ্রাভঙ্গিতে হাত দুটোকে বুকের কাছে জড়ো করে বলে ব্যাস, সব মিলে যাচ্ছে যা-যা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল, জট পাকাচ্ছিল, সব খাপে খাপে বসে যাচ্ছে।
তার মানে, তুমি রহস্যের সমাধান করে ফেলেছ? উত্তেজিত গলায় বলি আমি।
হ্যাঁ, প্রায় সবগুলো জট খুলে গেছে। আমার থিয়োরি মোটামুটি ঠিকই ছিল। আর সেই জন্যেই আসল সত্যিটাকে আশ্চর্যভাবে ধোঁয়াটে মনে হচ্ছিল। তবে এখন সবকিছুই জলের মত স্পষ্ট, স্বচ্ছ। একটু থেমে ও আবার বলতে থাকে আমাকে এখন দুটো টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে দুটো প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে। যদিও, তার উত্তরগুলো ইতিমধ্যে আমি জেনে ফেলেছি। এখানে তা জমা আছে। আঙুল দিয়ে নিজের মস্তিষ্কটা দেখায় সে।
আর সেই প্রশ্ন দুটোর উত্তর কখন পাবে তুমি? কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করি। হঠাৎ পোয়ারো উঠে দাঁড়ায়।
হেস্টিংস, তোমার মনে আছে। মাদাম জোয়েল নিক এন্ড হাউসে একটা নাটক করতে চেয়েছিলেন? আজ রাতে আমরা ওখানে সেইরকমই একটা নাটক করব। কিন্তু সেই নাটকের পরিচালক হবে এরকুল পোয়ারো। মাদাম জোয়েল তাতে একটা বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করবেন। পোয়ারো মুচকি হাসে। তুমি তো জান হেস্টিংস, অনেকের মুখেই শুনেছ এন্ড হাউসে নাকি কিছু আছে। সবার কেমন শরীর ছমছম করে। কিন্তু সেই কিছু মানে ভূত-প্রেতাত্মাটাকে কেউ দেখেনি এন্ড হাউসে, আজ দেখবে।
আমি একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পোয়ারো শুরুতেই থামিয়ে দেয় আমাকে, না, না, আমি আর একটা কিছুও বলব না। আজ রাতেই নিজের চোখে কানে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবে। তখনই সব জেনে নিও।
দ্রুতপায়, আচমকা ঘর ছেড়ে বের হয়ে যায় সে।
.
১৯.
পোয়ারোর পরিচালনায় নাটক
এক কৌতূহল-উদ্দীপক জমায়েত। আজ সারাদিনে পোয়ারোর দেখা প্রায় পাইনি বলতে গেলে। এমনকি রাতের খাবারও খেতে আসেনি। ফোনে বলে রাত ন’টায় আমি যেন সরাসরি এন্ড হাউসে চলে যাই। এন্ড হাউসের বাইরের ঘরে পোয়ারোকে ঘিরে সবাই বসেছিল। আমি দেখলাম পোয়ারোর তালিকার ক’ থেকে ছ’ পর্যন্ত সবাই হাজির রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই, তালিকার জ’ ব্যক্তিটি (থাকতেও পারে, কে জানা নেই) এই জমায়েতে হাজির নেই। এমনকি হুইল চেয়ারে চেপে মিসেস ক্রফটও হাজির হয়েছেন, আমার দিকে তাকিয়ে উনি মৃদু হাসলেন তাও এই সুযোগে আমার একটু বাড়ির বাইরে বের হওয়া হল।
আমি ঘরের চারপাশটা ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে নিলাম (আমার দুচার মিনিট দেরি হয়েছিল আসতে) পোয়ারো বসে আছে মিঃ ভ্যাইসের ডান পাশে। নীচু গলায় কি যেন বলছে পোয়ারো ওকে। এলিন দরজার পাশেই একটা টুলে বসেছে। ওর পাশে ওর স্বামী। ভদ্রলোক বড়বড় শ্বাস নিচ্ছেন। বেশ নার্ভাস। ফ্রেডরিকা, লাজারুম, কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার বাকিরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুরো ঘরটা জুড়ে বসেছিল। ওদের সবার থেকে কিছুটা দূরে বসেছিলাম আমি।
দেখা গেল, পরিচালক হলেও পোয়ারো সক্রিয়ভাবে নাটকের পরিচালনায় অংশ নিচ্ছেন না। সেই দায়িত্বটা ও দিয়েছে চার্লস ভ্যাইসকে। এতক্ষণ ধরে বোধ হয় সে সবই বোঝাচ্ছিল ওনাকে। পোয়ারো যে তার আস্তিনের তলায় আমাদের জন্যে কি অবাক করা কাণ্ড লুকিয়ে রেখেছিল কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
যুবক আইনজীবীটি সামান্য কেশে, গলা সাফ করে নিয়ে বলতে শুরু করে এই জমায়েতটা একটু অন্য ধরনের। পরিস্থিতিটা সত্যিই ভীষম রকমের অদ্ভুত। বলা উচিত চমকপ্রদ। আমার তুতো বোন নিকের মৃত্যু ঘিরে এক আশ্চর্য পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। তার মৃত্যুর পর ময়না তদন্ত চলছে, মৃত্যু হয়েছে খুনের উদ্দেশ্যে। বিষ প্রয়োগে, কে, কিভাবে বিষ প্রয়োগ করেছে সেটা পুলিশই তদন্ত করে খুঁজে বার করবে। আমি সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। আমার যেটা বলবার কথা, যা বলতে এখানে এসেছি সেই কথাই বলি। যে কোন মৃত ব্যক্তির শেষ ইচ্ছাপত্র তার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার পরই পড়তে হয়। কিন্তু মিঃ পোয়ারোর সনির্বন্ধ অনুরোধে এবং বিশেষ কারণে আমি নিকের অন্ত্যেষ্টি কাজ সম্পন্ন হবার আগেই তার শেষ ইচ্ছাপত্রটি খুলে পড়ছি। যার যা প্রাপ্য এই সম্পত্তি থেকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। সেকারণেই আজ রাতে সবাইকে এখানে জমায়েত হতে বলেছি। আর এই উইলটাও ভারী অদ্ভুত ভাবে আমার কাছে পৌঁছেছে। এটার তারিখ লেখা আছে, ফ্রেব্রুয়ারী মাসের। অথচ, আশ্চর্য দেখুন, এটা মাত্র আজ সকালেই আমার কাছে পৌঁছেছে। যদিও, কোন সন্দেহই নেই যে উইলটা আমার বোনের হাতেই লেখা। এবং আইনিভাবে তৈরি। ভ্যাইস একটু থামে।
আরও একবার গলা সাফ করে নেয়। তারপর আবার বলতে শুরু করে। ঘরের প্রতিটি মানুষের চোখ তখন ওর ওপর নিবদ্ধ এটা খুবই ছোট্ট’। হাতের হলুদ রঙের মোটা খামটা থেকে একটা কাগজের পাতা বের করে, সামান্য বিরতির পর সে পড়তে শুরু করে এটা ম্যাগডেলা বার্কলির সম্পত্তির বাটোয়ারা বিষয়ে শেষ ইচ্ছাপত্র। আমি নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি আমার সম্পত্তির সঠিক ভাগ-বাটোয়ারা দায়িত্বে থাকবেন আমার তুতো ভাই চার্লস ভ্যাইস।
আমার শেষ ইচ্ছানুসারে আমার স্থাবর অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তির মালিক হবেন আমার মৃত্যুর পর মিসেস মিলডেরড ক্রফট। আমার বাবাকে দারুণভাবে সঙ্গদান ও সেবা করার জন্যে, বন্ধুত্বর সামান্য নিদর্শন হিসাবে তার প্রতি আমার প্রতিদান। আমার বাবা ফিলিপ বার্কলির হয়ে আমি মিসেস ক্রফটকে তার সার্ভিসের অতুলনীয় উপকারের বিনিময়ে সামান্য কিছুটা ফিরিয়ে দিতে চাই।
সই– ম্যাগডেল বার্কলি।
সাক্ষী– এলিন উইলসন, উইলিয়াম উইলসন’ ভ্যাইস থামলেন।
আমি স্তব্ধ, নির্বাক হয়ে গেলাম। ঘরের প্রতিটি মানুষেরই অবস্থা আমারই মত। শুধুমাত্র মিসেস ক্রফট বারকয়েক সমর্থনসূচক ভঙ্গিতে মাথাটা নাড়ালেন। এটা সত্যি। শান্ত গলায় বললেন তিনি। ফিলিপ বার্কলি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলেন। এবং সেটা মনে হয় আমারই জন্যে। যাইহোক, সেই বিষয়ে আমি কিছু বলব না। এতদিন যখন কাউকে কিছু বলিনি, আজও কিছু বলব না। গোপন বিষয় গোপনই থাকুক। যদিও, এখন দেখছি নিক ব্যাপারটা জানত। খুব সম্ভবত ওর বাবা ওকে জানিয়েছিলেন। আমরা যে বারবার এখানে আসতাম সেটা এই এন্ড হাউসকে দেখতে কাছ থেকে, ফিলিপ বার্কলির মুখে সব সময় যেটার কথা বহুবার শুনেছিলাম। নিক সব জানত তাই বারবার আমরা এখানে আসি ও চাইত। লজটায় আমাদের থাকতে দিত। ভাড়া নিতে চাইতনা এক পয়সাও। আমরা প্রায় জোর করেই ভাড়াটা দিতাম। কিন্তু ও নানাভাবে সেটা আমাদের ফেরত দিয়ে দিত। আর শেষ পর্যন্ত, এই পৃথিবীতে নাকি কৃতজ্ঞতাবোধ বলে কিছু নেই। ভুল, ভুল। এই ঘটনাটাই তো জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ, নিকের মত মানুষদের মধ্যে, তা বেঁচে আছে, থাকবে।
সারা ঘরে তখনও তারপরও এক বিস্ময় বিজড়িত নৈঃশব্দ। পোয়ারো ভ্যাইসের দিকে তাকায় আপনার এই ব্যাপারে কোন ধারণা ছিল?
ফিলিপ বার্কলি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলেন আমি জানতাম। কিন্তু সেখানে কোনরকম স্ক্যান্ডাল ঘটেছিল বলে শুনিনি কখনও।
পোয়ারো সপ্রশ্ন চোখে মিসেস ক্রফটের দিকে তাকায়। তিনি দৃঢ়ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন নাহ আমার থেকে আপনি কিছু জানতে পারবেন না। সেই গোপনতা আমার সঙ্গেই কবরে যাবে। আগেই বলেছি, অতীতেও এ ব্যাপারে কখনও কারও কাছে মুখ খুলিনি। আজ বা পরেও কোনদিন খুলব না।
ভ্যাইস শান্তভাবে বসে হাঁটুতে পেন ঠুকতে থাকে সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়……
পোয়ারো ভ্যাইসের দিকে ঝুঁকে পড়ে এই উইলটাকে মাদাম জোয়েলের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় হিসাবে আপনার আদালতে চ্যালেঞ্জ জানান উচিত। যখন এই উইল তৈরি করা হয়েছিল তখন একরকম ব্যাপার ছিল। কিন্তু এখন এটা বিশাল এক সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ব্যাপার।
ভ্যাইস ঠাণ্ডা চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায় উইলটা পুরোপুরিভাবে আইনসঙ্গত। আমার বোনের করা তার সম্পত্তির বাটোয়ারাকে আইনি পথে বিরোধীতা করার কোন ইচ্ছে, আগ্রহই আমার নেই।
আপনি খুবই সৎ মানুষ। মিঃ ক্রফট সমর্থনের ভঙ্গিতে বলেন। আশ্চর্য করে দিল মেয়েটা। একবারের জন্যেও কখনও বুঝতে দেয়নি এই কাণ্ডটা করতে চলেছে।
স্বামীর কথায় মিসেস ক্রফট মাথা নাড়েন মিষ্টি মেয়েটা আমাদের অবাক করে দিতে চেয়েছিল।
ও হয়ত ওপর থেকে আমাদের দেখছে। আর ও যা চেয়েছিল, সেটাই ঘটতে দেখে হয়ত খুব খুশি হচ্ছে। পোয়ারো বলে। তারপর এক মুহূর্তের মধ্যে, যেন কি মনে পড়ে গেল, এভাবে বলে, যেন হঠাৎ কোন পরিকল্পনা মাথায় এল, আচ্ছা, আমরা আজ এখনি একটা প্রেতচক্রে বসলে হয় না? সবাই টেবিল ঘিরে বসে পড়ুন।
প্ল্যানচেট? মিসেস ক্রফট আঁতকে ওঠা গলায় বলেন, কিন্তু……… তার গলায় এখন একধরনের বিপন্নতা।
হ্যাঁ, ব্যাপারটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। হেস্টিংস, আমার প্রিয় বন্ধু এখানে আছে। ওর মধ্যে মাধ্যমশক্তি প্রচণ্ড (আবার আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন? আমি মনে মনে বলি), অন্য জগৎ থেকে বার্তা নিয়ে আসতে পারব আমরা। এ তো এক দারুণ সুযোগ। আমাদের এই সুযোগটাকে অবশ্যই কাজে লাগান উচিত। একটু থেমে পোয়ারো হাতে তালি বাজায়। ঘরের সবার দিকে ইঙ্গিত করে, তাড়াতাড়ি, টেবিলটার কাছে চেয়ার টেনে নিয়ে ঘিরে বসুন সবাই। আলো, আলোগুলো নিভিয়ে দেওয়া হোক।
অনেকেই যে খুব প্রসন্ন মনে বা সাহসের সঙ্গে পোয়ারোর নির্দেশ মানল তা বলা যাবে না। তবে পোয়ারোর ইচ্ছের কেউ বিরোধিতাও করল না। আসলে হয়ত ঘটনাচক্রের দ্রুততা, আকস্মিকতায় তারা এতটাই হতচকিত হয়ে পড়েছিলেন যে প্রতিবাদ করা বা বিরোধিতা করার কথা ভাববারও সময় পাননি।
অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সবকিছু করা হল। ঘর এখন ঘন অন্ধকার। টেবিল ঘিরে অজানা-অচেনা শঙ্কায় দুরু দুরু বক্ষ কয়েকটি মানুষ। যেহেতু গরমের রাত, জানালাগুলো খোলা থাকলেও পর্দাগুলো সব টেনে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে আবছা মৃদু একটা আলো ঘরে এসে পড়েছে। প্রায় ভুতুড়ে, রহস্যময়, আবছায়া পরিবেশ। নিস্তব্ধ ঘরে সবাই প্রায় মিনিট তিন শ্বাস বন্ধ করে বসে রইল। তারপর ধীরে, খুব ধীরে টেবিলটা কাঁপতে শুরু করে (আমি মনে মনে পোয়ারোকে অভিসম্পাত দিই আমাকে এসব করতে হবে, ওর পুরো পরিকল্পনাটা, কেন আগে থাকতে আমাকে জানায়নি কিছু) আমার শ্বাস ভারী হয়ে ওঠে (সবাই সেটা শুনতে পায়, শুনতে পেতে বাধ্য করি নাটকীয়তা ব্যবহারে) ইতিমধ্যে অন্ধকারের সুযোগে পোয়ারো নিশব্দ পায়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমার কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলে চালিয়ে যাও। উনি বাইরে, টেরেসে চলে এসেছেন। খুব শিগগির নাটকের ওপর নাটক ঘটতে শুরু করবে।
আমি অন্য সবার মনের অবস্থানটা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। অন্ধকারে, ঘরের কোথাও কিছু একটা, কিছু এসেছে, অপেক্ষায় আছে। কিছু একটা অভুতপূর্ব ঘটতে চলেছে। প্রতি মুহূর্তে শ্বাসরোধ করে তারই অপেক্ষা করে চলেছিল ঘরের প্রতিটি মানুষ। আমি নিজেও যথেষ্ট নার্ভাস বোধ করছিলাম। আমার তো তবু একটা ধারণা রয়েছে কি ঘটতে পারে, ঘটতে চলেছে। তবুও, আমার হৃৎপিন্ডটা মুখের কাছে এসে আটকে আছে মনে হচ্ছে। বাকিদের তাহলে কি অবস্থা? ঠিক এই সময়েই, ঘরের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। প্রায় নিঃশব্দে (আগে থেকেই তেল দিয়ে বোধহয় তৈরি করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রভাবটা হল মারাত্মক) দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা দমকা হাওয়া ঘরে ঢুকে এল। বাগান থেকে বয়ে আসা সাধারণ হাওয়া। অথচ, মনে হল সবার শরীরে যেন একটা হিমশীতল মৃত্যুর স্পর্শ লাগল।
এবং তারপরই আমরা সবাই দেখতে পেলাম দরজার সামনে, আবছা ছায়ার মত প্রায় অবয়বহীন একটা আদল। নিক বার্কলি। এক ভৌতিক, অলৌকিকতার ভঙ্গিতে, নিঃশব্দে, ধীরে, প্রায় ভেসে আসবার মত, এগিয়ে আসতে থাকে সে। অমানুষিক এক দৃশ্য। যার প্রভাব স্বাভাবিক, নিশ্চিত, এবং প্রগাঢ়ভাবে ঘরে উপস্থিত প্রতিটি মানুষের মনের ওপর পড়ে। আমি মনে মনে তারিফ না করে পারি না। কি অসাধারণ একজন অভিনেত্রীকে পায়নি সিনেমা, হলিউড। নিশ্চিতভাবেই নিক তার এই নতুন চরিত্রে অভিনয় উপভোগ করছে। নিখুঁতভাবে তার প্রতিফলনও ঘটাচ্ছে। এন্ড হাউসে নিক একটা নাটক করতে চেয়েছিল। কি নাটক, তা আমি জানি না। তবে সেই নাটকের চেয়ে এই চরিত্রটা যে বেশ কয়েকগুণ বেশি ভাল, নাটকীয়তা ভরা তা আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি।
প্রায় ভাসতে ভাসতে (সেটা কি করে, এখনও আমি জানি না) ঘরের মাঝখানে চলে এল। আর তখনি ঘরের থমথমে নৈঃশব্দ ভেঙ্গেচুরে খানখান হয়ে গেল। আমার পাশেই, হুইল চেয়ারটা থেকে কেমন একটা দম আটকে আসা কান্না জাতীয় শব্দ ভেসে এল। মিসেস ক্রফট। ঘড়ঘড়ে গলা আটকে আসা শব্দ। মিঃ ক্রফট। তীব্র চমকিত, আতঙ্কিত, ভগবানের নাম স্মরণ। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার ও লাজারুম সামনে ঝুঁকে পড়ে বিড়বিড় করতে থাকে। চালর্স ভ্যাইস দম দেওয়া পুতুলের মত চেয়ারে হেলান দিয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকেন। শুধুমাত্র ফ্রেডরিকা রাইস, কোনরকম নড়াচড়া বা শব্দ করলেন না। এবং তারপরই তীক্ষ্ণ গলার একটা চিৎকার উঠল ফিরে এসেছে, সে ফিরে এসেছে। হাঁটছে, হাঁটছে। যাদের খুন করা হয়, তারা হাঁটে। তারা হাঁটে। আহ হে ভগবান…….
তারপরই, একসাথে ঘরের সবগুলো আলো জ্বলে উঠল। পোয়ারোর মুখে দেখলাম একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠেছে। যেন এক রিং মাস্টারের হাসি। সাদা ধবধবে ওড়না জাতীয় একটা গাউন পরে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিক। এক এক করে সবার মুখগুলো দেখছে।
সবার আগে ফ্রেডরিকাই কথা বলে। অবিশ্বাসের তীব্রতর ভঙ্গিতে হাত বাড়ায় সে, বন্ধুকে স্পর্শ করে নিক, নিক, তুমি সত্যি আসল।
নিক হাসে, এগিয়ে যায় হ্যাঁ, আমি সত্যি, যথেষ্ট আসল। তারপর সে মুখ ফেরায় আপনি আমার বাবার জন্যে যা করেছিলেন তার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ মিসেস ক্রফট। কিন্তু আমি দুঃখিত, তার লাভটা এক্ষুনি আপনি পাচ্ছেন না।
হে ভগবান, ওহ হে ভগবান। মিসেস ক্রফট প্রায় খাবি খেতে থাকেন, চেয়ার থেকে পড়ে যাবার উপক্রম হয়, আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল বার্ট নিয়ে চল। আমি রসিকতা করেছি মাত্র। শুধু রসিকতা, বিশ্বাস কর। খুবই সন্দেহজনক রসিকতা বাস্তবিক।
আবার দরজা খুলে যায় আর প্রায় নিঃশব্দে একজন মানুষ ঘরে ঢোকেন। আমি অবাক হয়ে যাই। ইন্সপেক্টর জেপ। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে তিনি মাথা নাড়েন কোন প্রশ্নের উত্তর মিলে যাবার তৃপ্ত ভঙ্গিতে। আর তারপরই তার মুখ নিমেষে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে হুইল চেয়ারে বসা ভেঙ্গে পড়া, হতচকিত, প্রবল বিব্রত পঙ্গু মহিলাটির চেহারার দিকে নজর পড়তেই। দ্রুত ক্ষিপ্র পায়ে তিনি এগিয়ে যান। আরে আরে আরে, কি আশ্চর্য, এক পুরনো বন্ধু যে। মিলি মেরটন। আপনি তাহলে এখানে আপনার পুরনো খেলা শুরু করেছেন মাননীয়া?
মিসেস ক্রফট বিড়বিড় করে কি একটা কথা বলতে থাকেন। বড়ই ক্ষীণ দুর্বল সেই প্রতিবাদ। জেপ ধমকে ওঠেন, থামুন। আপনার জারিজুরি সব শেষ। তারপর পোয়ারোর দিকে ফিরে জেপ বলেন মাননীয়াটিকে চিনে রাখুন মঁসিয়ে পোয়ারো। এই সময়ের সবচেয়ে ধূর্ততম প্রতারক মিলি মেরটন। আমাদের কাছে খবর ছিল এক গাড়ি দুর্ঘটনায় উনি মারাত্মক আহত। কিন্তু উনি কোথায় আছেন জানতে পারা যাচ্ছিল না। পঙ্গু, আহত, হুইল চেয়ারে বসা অবস্থাতেও উনি প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এখানে। বাস্তবিক, জোচ্চুরির ক্ষেত্রে উনি একজন বিরাট মাপের শিল্পী মানতেই হবে।
তার মানে উইলটা জাল? একটা প্রতারণা? প্রবল বিস্ময়ের গলায় ভ্যাইস প্রশ্ন করেন।
অবশ্যই জাল। তুমি ভাবলে কি করে ওরকম বোকা বোকা, চরম অসঙ্গতিপূর্ণ একটা উইল আমি করব, করতে পারি। আমি এন্ড হাউস তোমাকে দিয়ে গিয়েছি চার্লস। বাকি সবকিছু ফ্রেডরিকাকে।
আর ঠিক তখনি ঘটল ব্যাপারটা। আচমকা।
জানালার বাইরে যেন একটা আগুনের ঝলক ঝলসে উঠল। তীব্র, কান ফাটানো একটা শিসের মত শব্দ। তারপর আরও একটা। জানালার বাইরে একটা মর্মভেদী আর্তচিৎকার আর কিছু একটা পড়ে যাবার শব্দ। এদিকে ফ্রেডরিকা তখন পায়ের ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর কবজির কাছ থেকে রক্তের সরু ধারা নেমেছে।
২০. ঝ
২০. ঝ
পুরো ব্যাপারটা এত দ্রুত চোখের পলকে ঘটে গেল, যে প্রথমটা কেউ বুঝে উঠতেই পারল না। তারপর, অত্যন্ত হিংস্র একটা অভিব্যক্তি সহকারে পোয়ারো জানালার দিকে ছুটল। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার ওকে অনুসরণ করলেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই ওরা দুজনে একটা নিথর পুরুষ শরীরকে ধরাধরি করে নিয়ে এল। আরাম কেদারায় শরীরটাকে শুইয়ে দেবার পর, মুখটা দৃশ্যমান হতেই, আমার মুখ দিয়ে প্রায় একটা আর্ত চিৎকার ঠিকরে বের হয়ে এল, সেই মুখটা, জানালার সেই মুখটা। সাদাটে, দুর্বলতা মাখা, ফ্যাকাশে, প্রায় আধিভৌতিক একটা মুখ, যেন একটা মুখোশ। একবার দেখলেই যা মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। লোকটার মাথার পাশ দিয়ে রক্তের একটা ধারা নেমেছে। ফ্রেডরিকা ধীর পায়ে এগিয়ে চেয়ারে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
আপনি আহত মাদাম। পোয়ারো ওকে বাধা দিয়ে বলে-কিছু না। গুলিটা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে। সামান্য ব্যাপার।
নীচু হয়ে ঝুঁকে পড়ে সে লোকটার মাথায় হাত রাখে। লোকটা এবার চোখ খোলে, ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, মানুষটার ঠোঁট দুটো বার কয়েক কেঁপে ওঠে, আশা করি তোমার জন্যে এবার আমি পেরেছি করতে। ফিসফিসিয়ে বলে সে। তারপরই, হঠাৎ তার গলার স্বর বদলে যায়, ওহ্ ফ্রেডি, আমি এরকমভাবে বলতে চাইনি, তুমি সবসময় এত ভাল ব্যবহার করেছ আমার সঙ্গে। প্রায় শিশুর স্বরে সে বলে।
ঠিক আছে, এটা কোন ব্যাপার নয়। লোকটির পাশে হাঁটু ভাঁজ করে বসে ফ্রেডরিকা। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আমি এভাবে……….. কথাটা শেষ হয় না। লোকটার মাথাটা একপাশে হেলে যায়। ফ্রেডরিকা পোয়ারোর দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকায়।
হ্যাঁ, ম্যাডাম উনি মারা গেছেন। শান্ত গলায় বলে সে।
ফ্রেডরিকা অনুত্তেজিত, ধীর ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। একটা হাত লোকটার কপালে চুঁইয়ে রেখে গভীর দুঃখের ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। তারপর বুক চেরা গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাদের দিকে, ঘরের অন্য সবার দিকে ঘুরে দাঁড়ায় আমার স্বামী। শান্ত ভঙ্গিতে বলে।
ঝ’ আমার মুখ দিয়ে প্রায় অজান্তেই বের হয়ে আসে। পোয়ারো দ্রুত আমার মন্তব্যটাকে ধরে নেয় হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। ধীর শান্ত গলায় বলে প্রথম থেকেই আমি বলে আসছিলাম, কেউ একজন, ঝ’ নিশ্চয়ই আছে এইসব কিছুর মধ্যে বলিনি?
উনি আমার স্বামী। আবার বলে ফ্রেডরিকা। ভঙ্গিতে ক্লান্তি। লাজারুমের এগিয়ে দেওয়া চেয়ারটায় হেলান দিয়ে এলিয়ে বসে সে। গভীর একটা শ্বাস ছাড়ে এবার সব কথা খুলে বলবার সময় হয়েছে। এখনি।
আমার স্বামী ছিল এক ছন্নছাড়া, বাউন্ডুলে প্রকৃতির মানুষ। মাদকাসক্ত। ও-ই আমাকে ড্রাগ নেওয়া ধরায়। ওকে ছেড়ে আসবার পর থেকেই অভ্যাসটা ছাড়বার জন্যে আমি লড়াই করছি। শেষ পর্যন্ত, আমি প্রায় সেরে উঠছি। কিন্তু ওহ ব্যাপারটা কি কঠিন, প্রাণান্তকর। কেউ বুঝবে না সেটা কি কঠিন ব্যাপার। আমি কখনও, কোনদিন ওকে ছেড়ে আসতে, পালিয়ে সরে আসতে পারতাম না। সবসময় ও আমাকে ভয় দেখাত, টাকার দাবি করত, তারপর আমাকে গুলি করে মারবার, খুন করবার হুমকি দিত। ওর কোন দোষ নেই অবশ্য তাতে ও পুরোপুরিই মানসিক অসুস্থ ছিল। বিকৃত মস্তিষ্ক। একটু থেমে মাথা নীচু করে কি যেন ভেবে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে সে আমার ধারণা ম্যাগি বার্কলিকে ও-ই গুলি করেছিল। নিশ্চিতভাবেই, ওকে মারতে চায়নি। আমাকে ভেবেই গুলিটা ছোঁড়া হয়েছিল। প্রথমে আমি ধরেই নিয়েছিলাম নিককে হত্যার চেষ্টাগুলো আমার স্বামীই করছে। তারপর বুঝি, না, বোধহয় ওগুলো অন্য কারও কাজ। তারপর, হঠাৎ একদিন মঁসিয়ে পোয়ারোর টেবিলে একটা ছেঁড়া, দুমড়ানো কাগজে অতি পরিচিত একটা হাতের লেখা দেখতে পাই। আমাকে লেখা ওর চিঠির অংশ ছিল সেটা। তখনি আমি বুঝে যাই, মঁসিয়ে পোয়ারো সঠিক রাস্তাতে হাঁটতে শুরু করেছেন, এবং এরপর, সবকিছু প্রকাশিত হয়ে পড়াটা শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা।
আবার একটু থামে ফ্রেডরিকা। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে কিছুটা প্রশ্ন বা কৌতূহলের ভঙ্গিতে বলতে শুরু করে কিন্তু চকোলেটের ব্যাপারটা আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। আমি কখনই কোনভাবে নিককে বিষ দেবার চেষ্টা করিনি। দুহাতে এবার নিজের মুখ ঢেকে ফেলে সে। হৃদয়বিদারক গলায় বলে ব্যাস, এইটুকুই। আর কিছু বলার নেই আমার।
.
২১.
এবং সেই ব্যক্তিটি, ‘ত’
লাজারুম সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত তার পাশে গিয়ে বসে বলে প্রিয়তমা? আমার প্রিয়তমা। পোয়ারো সেলারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এক গ্লাস ব্র্যান্ডি এনে ফ্রেডির হাতে তুলে দেয়। ফ্রেডি চুমুকে গ্লাস শেষ করে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হাসে তাহলে এখন? সে এবার জেপের দিকে তাকায়। জেপ এবার মাথা নাড়ে। যা করবার সেন্ট-লু পুলিশই করবে।
নিক আর্তস্বরে বলে মিঃ পোয়ারো ব্যাপারটাকে আমাদের মধ্যেই মিটিয়ে ফেলা যায় না?
আপনি তাই চাইছেন মাদাম জোয়েল?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আর আমার ওপর নিশ্চয়ই আক্রমণ হবে না। তাই এসবের মধ্যে পুলিশকে না জড়ালেই নয় কি?
না, এটা সত্যি, আপনার ওপর আর আক্রমণ হবার সম্ভাবনা নেই। তবুও……..
আমি জানি। আপনি ম্যাগির কথা ভাবছেন। কিন্তু মিঃ পোয়ারো, আর কোন কিছুই তো ম্যাগিকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। শুধু শুধু ফ্রেডরিকাকে বিরাট একটা অপপ্রচারের মধ্যে টেনে এনে লাভ কি? বেচারার জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। এমনিতেই সারা জীবন প্রচুর কষ্ট সহ্য করেছে মেয়েটা। অনেক যন্ত্রণা পেয়েছে। আপনি শুনছেন ওনার এসব প্রাপ্য নয়?
পোয়ারো ঠাণ্ডা গলায় বলে নিশ্চয়ই নয়। স্বামী-হিসাবে লোটা একটা অপদার্থ, জঘন্য প্রকৃতির মানুষ ছিল। আপনারা আজ নিজের চোখেই তো দেখলেন কেমন চরিত্রের মানুষ ছিল সে। লোকটা মারা গেছে। ব্যাপারটাকে এখানেই শেষ করে দিন। পুলিশ ম্যাগির খুনিকে খুঁজুক। ওরা কোনদিনই তাকে খুঁজে পাবে না।
পোয়ারো এবার এলিনের দিকে ঘুরে তাকায়–তোমার কিছু বলার আছে?
দিব্যি করে বলছি আমার সন্তানের নামে, এ বিষয়ে আমি বা উইলিয়াম আমরা স্বামী-স্ত্রী কোন দিন, কখনো, কারো কাছে একটা শব্দও উচ্চারণ করব না।
পোয়ারো এবার ঘরের অন্য সবার দিকে এক এক করে তাকায় আপনাদের সবারও একই মত তো?
ঘরের সবাই, এমনকি ইন্সপেক্টর জেপ-ও পর্যন্ত নিকের ইচ্ছেতে সায় দেয়। শুধু একজন ছাড়া, চার্লস ভ্যাইস। চার্লস, প্রিয় ভাই। নিক আর্তস্বরে বলে।
দুঃখিত, আমি আইনের বিপরীতে হাঁটতে পারিনা।
পোয়ারো এবার উৎসাহের গলায় বলে ঠিক বলেছেন। আপনি বলিষ্ঠ চরিত্রের মানুষ। আমিও আপনার সঙ্গে একমত।
মিঃ পোয়ারো, প্লিজ নিক অনুনয়ের গলায় বলে।
দুঃখিত মাদাম জোয়েল। আপনি আমাকে এই কেসে টেনে এনেছিলেন। আপনার ইচ্ছেতেই আমি এসেছিলাম। কিন্তু এখন এই ভাবে আপনি আমাকে চুপ করিয়ে দিতে পারেন না। কিছুতেই না। পোয়ারো ওর মধ্যমা তীক্ষ্ণ শাসনের ভঙ্গিতে উঁচিয়ে তোলে। ওর ওই রুক্ষ্ম ভঙ্গিটা আমি খুব ভাল ভাবে চিনি, জানি। সবাই বসুন। এখন আমি বলব সত্যিটা। আসল সত্যিটা।
পোয়াহোর উদ্ধত শাসনের ভঙ্গিটা সবাইকে চুপ করিয়ে দেয়। সবাই চুপচাপ চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগের ভঙ্গিতে পোয়ারোর দিকে তাকায়। Ecountez. আমি একটা দীর্ঘ তালিকা বানিয়েছিলাম। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আমি তাদের অক্ষরমালার ক্রমানুসারে ক’ থেকে জ’ পর্যন্ত চিহ্নিত করেছিলাম। সে তালিকায় অচেনা, রহস্যময় একজনও ছিল। ঝ’। আজ রাতের আগে পর্যন্ত যার পরিচয় আমরা কেউ জানতে পারিনি। যদিও আমি সব সময়ই নিশ্চিত ছিলাম এই অপরাধের সঙ্গে ঝ’ অবশ্যই জড়িত, সেরকম কেউ রয়েছেই। আজ রাতের ঘটনা প্রমাণ করল আমি সঠিক ছিলাম। কিন্তু গতকাল রাতে নতুন করে সব হিসেব করতে, অপরাধের অঙ্কটা নতুন করে সমাধান করতে বসেই প্রথমবার আমি বুঝতে পারি, আমি একটা বিরাট ভুল করে বসেছি। সন্দেহভাজনদের তালিকা থেকে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ নাম বাদ দিয়েছি। ত’ এতদিন যাকে আমি ধর্তব্যের মধ্যেই আনিনি।
আরও একজন অচেনা, ব্যক্তি? রহস্যময় চরিত্র? ভ্যাইস কিছুটা প্রচ্ছন্ন কৌতুকের গলায় বলে।
টানা কথা বলে পোয়ারো থামে। আমাদের সবার মুখের ওপর দিয়ে ঠাণ্ডা, অনুত্তেজিত চোখ বুলিয়ে নেয়, না। ঠিক সেরকম নয়। পোয়ারো মগ্ন গলায় বলে চলে ত’ সম্পূর্ণ এক ভিন্ন তাৎপর্যময় ব্যক্তি কথাটা বলে সে ফ্রেডরিকার দিকে ঝুঁকে পড়ে নিজেকে সামলান মাদাম জোয়েল। আপনার স্বামী খুনী নন। মাদাম জোয়েল ম্যাগিকে গুলি করেছিলেন আমাদের এই ত’ ব্যক্তিটি।
ফ্রেডি তীব্র চোখে তাকায় সে কে?
পোয়ারো জেপের দিকে দিকে তাকায়। সে এগিয়ে আসে এবং ঠিক সেইরকম প্রবল কর্তৃত্বব্যঞ্জক গলায় কথা বলতে শুরু করে দেয়, যে ভঙ্গীতে পুলিশ আদালতে অপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয় আমি মিঃ পোয়ারোর সাহায্যে সন্ধ্যেবেলার অনেকটা আগে গোপনে এ বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলাম। বসবার ঘরের ভারী পর্দার আড়ালে লুকিয়ে বসেছিলাম। একজন যুবতী মেয়ে সেসময় ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালান। তারপর ফায়ার প্লেসের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তিনি কিছু একটা চাপ দিয়ে, সম্ভবত কোন স্প্রিং-এর সাহায্যে একটা প্যানেল সরিয়ে ফেলেন। সেখান থেকে তিনি একটা পিস্তল বের করে নেন এবং ঘর ছেড়ে বের হয়ে যান। আমি ওকে অনুসরণ করি। তিনি একটা রুমাল দিয়ে সযত্নে পিস্তলটাকে মুছে একটা পোশাকের মধ্যে সন্তর্পনে সেটা ঢুকিয়ে দেন। পোষাকটা মিসেস রাইসের।
মুহূর্তের মধ্যে নিক তীক্ষ্ণ গলায় চীৎকার করে ওঠে, মিথ্যে, পুরোটাই এসব মিথ্যে।
VOLTA’ পোয়ারো আঙুল তোলে, এই হচ্ছেন সেই ত। যিনি ম্যাগি বার্কলি, নিজের বোনকে গুলি করে খুন করেছেন।
আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? ক্ষিপ্ত গলায় চীৎকার করে ওঠে নিক, আমি কেন ম্যাগিকে খুন করতে যাব?
কারণটা খুব সহজ। মাইকেল সেটনের সম্পত্তির উত্তরাধিকার দখল করা। মাইকেল সেটন ম্যাগডেলা বার্কলির সঙ্গে বাগদানে আবদ্ধ হয়েছিলেন। সেটা ম্যাগি, আপনি নন মাদাম জোয়েল নিক।
আপনি আপনি………. নিক কথা খুঁজে পায়না। ওকে কেমন খেই হারানো, অথৈ জলে পড়া মানুষ মনে হয়। বাক্যহারা। থরথর করে কাঁপতে থাকে। পোয়ারো ইন্সপেক্টর জেপের দিকে তাকায়। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে? জেপ মাথা হেলিয়ে সায় দেয় হ্যাঁ। ওরা সদলবলে বাইরে অপেক্ষা করছে।
তাহলে? এখন আমরা একটা পুরোপুরি হাস্যকর অবাস্তব নাটকের সাক্ষী হতে চলেছি?
নিক ফেস করে ওঠে তা বলতে পারেন।
পোয়ারো মৃদু হাসে গত কয়েক মাস ধরে আপনি এন্ড হাউসে যে নাটকটা অভিনয় করে চলেছেন। তবে এসবের মধ্যে আমাকে টেনে আনাটা আপনার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল মাদাম জোয়েল। এরকুল পোয়ারো থাকলে আর কেউ নাটকের প্রধান চরিত্র-নায়ক হতে পারে না। কখনো না। আপনার কবর আপনিই নিজের হাতে খুঁড়েছিলেন।
.
২২.
নটে গাছটি মুড়োলো
আপনারা পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা চান? পোয়ারো তৃপ্ত ভঙ্গিতে চারপাশে সবার মুখের দিকে তাকায়। আমি জানি অপরাধীকে হারাবার গর্ব এটা। আমরা সবাই এবার বাইরে বাগানে ঘরের গুমোট ছেড়ে মুক্ত আবহাওয়াতে এসে বসলাম। ইতিমধ্যে আমাদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। নিক-এর সঙ্গে ক্রফট দম্পতিকেও পুলিশ নিয়ে গেছে।
আমি, ফ্রেডরিকা, শ্যালিঙ্গার, লাজারুম, ভ্যাইস পোয়ারোকে ঘিরে বসলাম।
Eh bien, প্রথমেই স্বীকার করে নিই, আমি বেশ বোকা বনতে বাধ্য হয়েছিলাম। পুরোপুরি, সম্পূর্ণভাবে। একটা বাচ্চা মেয়ে যে নাকি নিজেই আমাকে চেয়েছিল। তদন্তের ৯০ শতাংশ অংশ ওনাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনিনি। মাদাম রাইস, আপনি যখন বলেছিলেন আপনার বান্ধবী একজন চতুর মিথ্যেবাদী, আমি আমলই দিইনি। কিন্তু কি সত্যি কথাটাই বলেছিলেন আপনি। ভীষণ সত্যি।
নিক সবসময়ই ভীষণরকম মিথ্যে কথা বলত। ফ্রেডরিকা বলে। সেই কারণেই বারবার অলৌকিকভাবে মৃত্যুর হাত থেকে ওর রেহাই পেয়ে যাবার কাহিনীগুলো আমি মোটেই বিশ্বাস করিনি।
অথচ আশ্চর্যভাবে, অবিশ্বাস্যভাবে আমি করেছিলাম।
ওগুলো কি তাহলে সত্যি ঘটেনি? আমি প্রশ্ন করি, সত্যি বলতে কি, আমি যে রীতিমত সংশয়গ্রস্থ, স্বীকার করে নিতে বাধ্য হই।
খুব চালাকির সঙ্গে ব্যাপারগুলো যে ঘটেছে তার ভান করা হয়েছিল। পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে আবার বলতে শুরু করে, আর সেই বানানো সাজানো ঘটনাগুলো সবার মনে ছাপ ফেলতে শুরু করে, মাদাম জোয়েল নিকের জীবন সত্যিই বিপদগ্রস্থ। কিন্তু ঘটনার শুরু তারও অনেক আগে। মূল প্রসঙ্গে ঢুকবার আগে সেগুলো ছুঁয়ে যাওয়া দরকার। আপনাদের জানা প্রয়োজন।
সামান্য থেমে পোয়ারো আবার শেষ করা কথার সূত্র ধরে বলতে থাকে, প্রথম থেকে আমরা জানি, সুন্দরী, প্রাণচঞ্চল নিক বার্কলি বাড়িটাকে আশ্লেষময়, পাগলের মত ভালবাসেন। কিন্তু তার হাতে সেরকম টাকা পয়সা ছিল না। বাড়িটা বন্ধক দেওয়া ছিল। তিনি টাকা খুঁজছিলেন, প্রচণ্ডভাবে মরিয়া হয়ে। টাকার প্রয়োজন ছিল তার, অথচ তিনি সেটা পাচ্ছিলেন না! লে-টকেততে যুবক মাইকেল সেটনের সঙ্গে তার পরিচয় হল। সেটন তার সৌন্দর্যে আকর্ষিত হয়। নিক জানতেন সেটন কোটিপতি কাকার বিশাল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। উনি ভাবলেন ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। কার্যক্ষেত্রে কিন্তু দেখা গেল সেটন মোটেই সেরকম তীব্রভাবে বা সিরিয়াসভাবে নিকের প্রতি আকর্ষিত হয়নি। ওর সঙ্গ আনন্দদায়ক লাগত সেটনের, ব্যস এইটুকুই ছিল ওর তরফের আকর্ষণ। স্কারবরোঘোতে আবার দেখা হল দুজনের। আর এখানেই পুরো উল্টে পাল্টে গেল ব্যাপারটা। ম্যাগির সঙ্গে আলাপ হল সেটনের, নিকের মাধ্যমেই। আর পাগলের মত, দুর্বারভাবে উনি প্রেমে পড়লেন ম্যাগির সঙ্গে প্রথম দর্শনেই। নিক প্রায় বজ্রাহত হল। ম্যাগিকে কোনদিনই উনি সুন্দরী বলে ভাবেননি। কিন্তু যুবক সেটনের কাছে উনি অন্যরকম। তার জন্যে পৃথিবীর একমাত্র মেয়ে। গোপনে দুজনে বাগদানে আবদ্ধ হলেন। একজনেই মাত্র জানলেন পুরো ব্যাপারটা। মাদাম জোয়েল নিক। বেচারা ম্যাগি, সে খুশি ছিল যে একজনের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে সে কথা বলতে পারত। প্রেমিক বা বাগদত্তার চিঠিগুলোও বোনকে পড়ে শোনাতেন তিনি। আর ঐ ভাবেই উইলের কথাটা মাদাম জোয়েল নিক জানতে পেরেছিলেন। ব্যাপারটা ওর মাথায় গেঁথে গিয়েছিল।
তারপরই স্যার ম্যাথু সেটনের অপ্রত্যাশিত, আচমকা মৃত্যু ঘটল। তারপরই রইল মাইকেল সেটন রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে গেছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিকের মাথায় চমকপ্রদ একটা পরিকল্পনা এসে গেল। সেটন জানতেন না নিকের নামও ম্যাগডেলা। ওকে নিক বলেই জানতেন তিনি। অথচ পৃথিবীর সবাই জানত সেটনের সাথে নিকেরই বন্ধুত্ব। ম্যাগির সাথে ওর সম্পর্ক তখনও সবার কাছে গোপন। এই সুযোগটাকেই নিখুঁতভাবে কাজে লাগাবেন ঠিক করলেন নিক। সেটনের সঙ্গে নিজের বাগদানের কথা প্রচার করলে কেউই খুবই একটা তাই আশ্চর্য হবে না। কিন্তু সেটা করতে হলে, ম্যাগিকে অবশ্যই মরতে হবে। কারণ, আসল সত্যিটা একমাত্র সে-ই জানে। সময় খুব কম ছিল ওর হাতে। নিজের ওপর প্রাণঘাতী হামলার ভান করে, সুকৌশলে উনি ম্যাগিকে কয়েকদিন নিজের কাছে এনে রাখবার ব্যবস্থা করে ফেললেন। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ওর ওপর প্রাণঘাতী হামলার সব কটিই নিখুঁতভাবে সাজানো। ছবির দড়ি উনিই কেটে রেখেছিলেন। নিজেই (গাড়ি নিয়ে ধাক্কা মেরে তারপর) গাড়ির ব্রেকের তার ছিঁড়ে দেন। পাথরটাও বলাবাহুল্য উনি নিজেই ফেলেছিলেন। তখন যে পাথরের তলায়, স্নানের জায়গায় উনি হাজির ছিলেন না সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
তারপর উনি কাগজে আমার নাম দেখলেন। ওনার এত বড় দুঃসাহস, ব্যাপারটাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে আমাকে এরকুল পোয়ারোকে এর মধ্যে টেনে আনলেন, জড়ালেন। আর আমিও সত্যি সত্যি ওর টুপিতে গুলির ফুটোটা দেখে বিশ্বাস করে নিলাম যে অঘটনগুলো ঘটেছে। আর ওনার ফাঁদে পা দিয়ে আমিও বলে ফেললাম, সিদ্ধান্ত নিলাম ওনার সঙ্গে সঙ্গে থাকবার জন্যে কোন আত্মীয়াকে ডেকে আনতে। নিকও ঠিক এই সুযোগটাই খুঁজছিলেন। উনি ম্যাগিকে ডেকে পাঠালেন।
তারপর রেডিওয়ে উনি শুনতে পেলেন, জানতে পারলেন সেটনের মৃত্যুর, নিখোঁজ হয়ে যাবার খবরটা সত্যি। ব্যস, নিশ্চিন্ত হলেন উনি। এখন ওনার হাতে প্রচুর সময়। পরিকল্পিতভাবে এগোবার সুযোগ এসে গেল ওর হাতে। প্রথমেই ম্যাগির থেকে মাইকেল সেটনের লেখা প্রেমপত্রগুলো কৌশলে আদায় করে নিলেন। তারপরের অপরাধক্রম খুব সহজ, অনুমান সম্ভব। বাজি পোড়ানোর পার্টির রাতে ম্যাগিকে নিয়ে শীতপোশাক নেবার অজুহাতে বাড়িতে এলেন। বোনকে নিজের শালটা পরতে দিলেন। তাকে বুঝতে না দিয়ে কোন একটা পথে বাড়ির বাইরে এসে বোনকে গুলি করেই দ্রুত বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন। পিস্তলটাকে বাইরের ঘরের ফায়ারপ্লেসের কাঠের গোপন প্যানেলের ভেতর লুকিয়ে ফেললেন। ওর দৃঢ় ধারণা ছিল সেটার অস্তিত্বের কথা কেউ জানত না (দুর্ভাগ্যবশত এলিন সেটার খোঁজ জানত)। তারপর দোতলায় গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না শোনা গেল লাশ আবিষ্কৃত হয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন। তারপরই ছুটে বের হলেন তিনি ফ্রেঞ্চ উইনডোটা দিয়েই সম্ভবত তাড়াতাড়ি পৌঁছবার জন্যে।
কি দুর্দান্তভাবে নিজের চরিত্রতে অভিনয় করে চলেছিলেন উনি। অসাধারণ,হা একটা দারুণ নাটকের মঞ্চ সাজিয়ে তুলেছিলেন তিনি এই বাড়িটাকে। পরিচালিকা এলিন একবার বলেছিল এই বাড়িটাতে শয়তান বাস করে। আমি ওর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। আর সেই শয়তানের অনুপ্রেরণাতেই আমাদের ছোট্ট, মিষ্টি মেয়েটি, মাদাম জোয়েল নিক এতবড় একটা নিষ্ঠুর অপরাধ ঘটিয়ে ফেলেন। তবে এটাও ঠিক উনি যা কিছুই করেছিলেন সবই এই বাড়িটাকে বাঁচাতেই করেছেন। প্রাণের চেয়েও প্রিয় ছিল ওনার কাছে এই এন্ড হাউস।
কিন্তু সেই বিষাক্ত চকোলেট? এই ব্যাপারটা এখনও আমার মাথায় ঢোকেনি। ফ্রেডরিকা কৌতূহলী গলায় বলে।
খুবই চতুরভাবে, প্রায় পেশাদারি অপরাধীর মানসিকতায় ব্যাপারটা করা হয়েছিল। ম্যাগির খুন হওয়াটা যে দুর্ঘটনা ছিল, ম্যাগি যে খুনির লক্ষ্য ছিল না, তার লক্ষ্য যে এখনও নিক, সেটা বোঝাবার জন্যেই হাসপাতালের মধ্যেও খুন করার চেষ্টা হল, নাটকটা ঘটান হয়েছিল। মাদাম জোয়েল নিক নিজেই তার গলার স্বর বিকৃত করে মাদাম রাইসকে ফোন করেন।
ওহ ওটা তাহলে নিকের গলা ছিল? ফ্রেডরিকা অবাক গলায় বলে।
অবশ্যই। Nest ce pas? পোয়ারো মাথা দুলিয়ে প্রাজ্ঞের ভঙ্গিতে হাসে আর কে হবে? হতে পারে? তারপর, উনি সেই চকোলেটের বাক্স এসে পৌঁছনোর পর তার মধ্যে থেকে তিনটেতে কোকেন পুরে দেন (নিজের পোশাকের ভেতর গোপন কোকেন নিয়ে এসেছিলেন উনি হাসপাতালে, সম্ভবত এই পরিকল্পনাটার জন্যেই। কারণ মাদাম জোয়েল খুব ভাল করে জানতেন, উনি নিজেই আমাকে কৌশলে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন)। মাদাম রাইসের মাদক নেবার অতীত ইতিহাস আমি জানি। তারই পাঠানো চকোলেটের ভেতর কোকেন থাকাটা তাই খুবই স্বাভাবিক। উনি ভেবে নিয়েছিলেন আমি এবং পুলিশ সেক্ষেত্রে খুব সহজেই দুই আর দুই-এ চার করব। বিষ প্রয়োগের, হত্যার চেষ্টার অভিযোগে মাদাম জোয়েল রাইসকে গ্রেপ্তার করা হবে। সহজ অঙ্ক। আর অন্য বাক্সে আমার কার্ডটা? এটা উনি একটা অসাধারণ চাল দিয়েছিলেন। আমার পাঠান ফুলের তোড়ার সঙ্গে দেওয়া কার্ডটাকেই উনি আবার ব্যবহার করেছিলেন চকোলেটের বাক্সে।
সামান্য নীরবতার পর ফ্রেডরিকা বিষণ্ণ গলায় বলে। কিন্তু কেন? নিক আমায় বারবার কেন খুনি সাজাবার চেষ্টা করছে? আমার কোটের পকেটে কেনই বা পিস্তলটা রেখেছিল? বিষ মেশানো চকোলেট আমি পাঠিয়েছিলাম বোঝাবার, প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছিল?
প্রশ্নটা আপনার মনে জাগাটা স্বাভাবিক। আচ্ছা মাদাম, আপনি একটা কথা বলুন তো আমাকে। আপনার মনে কখনও এই ব্যাপারটা এসেছে যে মাদাম জোয়েল আপনাকে আর ততটা পছন্দ করেন না ইদানীং? পোয়ারোর প্রশ্নটা শুনে ফ্রেডরিকা দৃঢ় গলায় বলে, না, এরকম তো কখনও মনে হয়নি। বরং ও আমাকে পছন্দ করে বলেই মনে হত।
পোয়ারো এবার ঘুরে তাকায় মিঃ লাজারুম, একটা কথা সত্যি সত্যি বলুন। সভাবে বললেন। মাদাম জোয়েল নিকের সঙ্গে আপনার কোন সম্পর্ক রয়েছে, মানে ছিল?
লাজারুম মাথা নাড়ে, নাহ, অস্বীকার করব না, একটা সময় নিকের প্রতি আমার কিছুটা দুর্বলতা ছিল কিন্তু অল্প সময়েই তা কাটিয়ে উঠি। ফ্রেডির প্রতি আমি তারপর থেকেই নিবেদিত।
আহ্, এটাই ওনার ট্রাজেডি। উনি মানুষ (পুরুষ) কে আকর্ষণ করতেন। আর তারপর তারা ওকে ছেড়ে অন্য কোন নারীতে সরে যেতেন, যাইহোক, মাদাম রাইস, আপনার প্রশ্নের উত্তরটা আশা করি পেয়ে গেলেন? হ্যাঁ, উনি মিঃ লাজারুমকে ভালবাসতেন, এখনও ভালবাসেন। আপনাক সরিয়ে দিয়ে উনি মিঃ লাজারুমকে পেতে চেয়েছিলেন। লাজারুমকে কেড়ে নেবার সময়টা, তারপর থেকেই উনি আপনাকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। অসম্ভব ঘৃণা। অবশ্য, তার প্রকাশ উনি ঘটতে দেননি কোনদিনও।
কিন্তু মিঃ পোয়ারো, নিক যে অপরাধী সেটা কখন, কিভাবে আপনার মনে হল? এবার শ্যালিঙ্গার প্রশ্ন করেন।
পোয়ারো বিনীতভঙ্গিতে হাসে প্রশ্নটা শুনে, খুব লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করব, ব্যাপারটা আমার মাথায় আরও আগে আসা উচিত ছিল। অনেক আগে। কিন্তু মাদাম জোয়েল নিককে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। উনি যা বলতেন অন্ধের মত বিশ্বাস করতাম। কিন্তু তারপর আচমকা আমার চোখে একটা ব্যাপার ধরা পড়ে। উনি অত্যন্ত চতুর মহিলা ঠিকই। কিন্তু উনি একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছিলেন। সৌভাগ্যবশত শেষ পর্যন্ত যা আমার নজর এড়ায়নি। আমি যখন ওনাকে বললাম কোন বন্ধু বা আত্মীয়াকে ওনার কাছে এনে সঙ্গী হিসাবে রাখতে, উনি নিমরাজি হবার ভান করলেন। অথচ ততদিনে উনি ম্যাগিকে এখানে আসবার জন্যে টেলিগ্রাম করে দিয়েছিলেন। এই ছোট্ট ভুলটা যখন ধরতে পারলাম ওনার, আমার প্রথম টনক নড়ল। ম্যাগি এখানে পৌঁছে ওর বাবা মাকে পৌঁছানোর খবর জানিয়ে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। প্রথমে না ধরতে পারলেও, শেষ পর্যন্ত চিঠির একটা নিরীহ অংশই আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। ম্যাগি লিখেছিলেন আমি সত্যি বুঝতে পারছি না নিক আমাকে এভাবে তড়িঘড়ি চলে আসবার জন্যে কেন তার করল। মঙ্গলবারের পরে আসলেও তো ক্ষতি ছিল না। এই মঙ্গলবার শব্দটা আমার মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। নিক এভাবে কেন আগেভাগেই তার করেছিলেন? মঙ্গলবার কথাটা কেন উল্লেখ করেছিলেন? তড়িঘড়ি তার আগে কেন ম্যাগিকে ডেকে আনলেন?
পোয়ারো থামে। একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ে। তার একটাই কারণ, মাদাম জোয়েল চেয়েছিলেন মঙ্গলবার রাতটা মাদাম ম্যাগি এন্ড হাউসে হাজির থাকুন। কিন্তু কেন তার সেই তীব্র আকুতি? আমার চোখ খুলে গেল। এবার মাদাম জোয়েল নিককে আমি ভিন্ন আলোয় দেখা শুরু করলাম। ওর বক্তব্যগুলোকে অন্ধের মত বিশ্বাস না করে কাটাছেঁড়া করা শুরু করলাম। যার ফলে উঠে এল এক একটা নির্মম সত্য। মাদাম ম্যাগিকে সাত তাড়াতাড়ি মঙ্গলবারের বাজি পোড়ানোর রাতে এন্ড হাউসে ডেকে আনা হয়েছিল খুন করার জন্যেই। কিন্তু কেন? এই রহস্য সমাধানে আমার অবশ্য ভীষণরকম সাহায্য করেছে। বন্ধুবর হেস্টিংস। এক সন্ধ্যায় ও ম্যাগি নামটা নিয়ে বিশ্লেষণে বসেছিল হঠাৎ করেই। ম্যাগি নামটা কি কি হতে পারে পুরো আকারে ম্যাগগি। মার্গারেট। ঝলসে উঠেছিল। মাদাম ম্যাগি-র পুরো নামটা ম্যাগডেলা নয়তো? এবং ……… খোঁজ নিয়ে জানলাম আমার অনুমানই ঠিক। রহস্যের ঘোর জটের মাঝে দুই ম্যাগডেলা বার্কলির উপস্থিতি জানতে পারার পরই ব্যাপারটা আমার কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। বাকিটা এরকুল পোয়ারোর সেই বিখ্যাত ধূসর মস্তিষ্কের কামাল।
আমার প্রথম খটকাটা অবশ্য লেগেছিল মাত্র কয়টি প্রেমপত্র দেখে। একজন প্রেমিকা তো তার প্রেমিকের সবগুলো প্রেমপত্রই রেখে দেবে। মাদাম জোয়েল বার্কলির কাছে মাত্র ওই কয়টি চিঠি কেন? তার উত্তর মাদাম জোয়েল ম্যাগির কাছ থেকে তার কাজে লাগবে এরকম কয়েকটা চিঠি বেছে নিয়েছিলেন। আর সেই চিঠিগুলোরই একটা কিন্তু আমার কাছে, সমস্ত জট খুলে দিল। পোয়ারো এবার একটু থামে। ও সেই ট্রিপিক্যাল ভঙ্গিতে গোঁফে মোচড় দেয়। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার উৎসুক গলায় প্রশ্ন করেন সেটা কি?
পোয়ারো বিনীত ভঙ্গিতে হাসে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৭ তারিখ মাদাম জোয়েল নিকের অ্যাপেনডিক্স অপারেশান হয়। অথচ, মাইকেল সেটনের মার্চ-২ তারিখের চিঠিতে সে বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই। কোন উদ্বেগ বা দুশিন্তা নেই। কুশল প্রশ্ন নেই। ওই চিঠিটাই নিশ্চিত করে দেয়, আমাকে প্রায় চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় চিঠিগুলো মাদাম জোয়েল নিক-কে লেখা হতেই পারে না। অন্য কাউকে লেখা। অন্য কারো জন্যে লেখা। কে? সেটা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধিমান হবার দরকার হয় না। এরপর পুরো মামলাটা আমার কাছে জলের মত পরিষ্কার হয়ে যায়।
ফ্রেডরিকা সজল চোখে তাকায় একটা মিষ্টি, ছোট্ট মেয়ে………..
পোয়ারো এবার হঠাৎ লাজারুমের দিকে ফিরে তাকায় একটা ব্যাপার আমার কাছে এখনও পরিষ্কার হয়নি। আপনি কি আমাকে সাহায্য করবেন?
লাজারুম অবাক চোখে তাকায়। কিছুটা শঙ্কিতও।
পোয়ারো হাসে যে ছবিটার ৫০ পাউন্ড দাম হবার কথা নয়, আপনি তার জন্যে মাদাম জোয়েলকে ১০০ পাউন্ডের দর দিয়েছিলেন কেন?
লাজারুম কয়েক মুহূর্ত পোয়ারোর মুখের দিকে বিব্রত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর হাসে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, দেখুন মিঃ পোয়ারো, আমি একজন ব্যবসায়ী। আপনি ঠিকই বলেছেন। স্যার নিকোলাসের ওই ছবিটা সম্ভব ২০-২৫ পাউন্ডের বেশি দাম হবে না। তবু আমি ১০০ পাউন্ড দর দিয়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম নিক ছবিটার বাজার দর যাচাই করে দেখবে। এবং জানবে আমি প্রকৃত বাজার দরের অনেক বেশি দর দিয়েছি। তারপর থেকে আমি কোন ছবি বা জিনিস কিনতে চেয়ে দর দিলে ও আর বাজার দর যাচাই করতে যেত না। অনেক কম দর দিয়ে এ বাড়িতে দশ বারো পনেরো হাজার পাউন্ড দামের পুরনো জিনিসপত্র কিনে নিতে পারতাম আমি একবার ৫০-৭৫ পাউন্ড ক্ষতি করে।
পোয়ারো হাসে, থাক, এই মামলায় আর কোনো উত্তর না-জানা প্রশ্ন রইল না।