পোয়ারো সম্পূর্ণ থেমে গেলো না। আবার সে তার নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে প্রশ্ন করল, মিঃ কার্লে, চিঠিতে আপনি সেরকমই লিখেছিলেন যে, আপনি কোনো বিষয়ে আমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চান। যেন আচম্বিতে পরিবর্তন দেখা গেল ক্রোড়পতি কার্লের হাবভাবের মধ্যে। তিনি খুব ধীরে ধীরে, চাপা স্বরে কথা বলছিলেন। সামান্য উত্তেজিত হয়ে এক সময় ঝুঁকে পড়লেন আমার দিকে, তিনি বললেন এবার, হ্যাঁ সেটাই ঠিক। আমি এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য শুনতে চাই। আপনি কি বলেন। পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সর্বক্ষেত্রেই। আমার নীতি কি এটাই? সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক বা ধুরন্ধর গোয়েন্দা এই দুইজন-এর মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে আমাকে। এদের মধ্যে কাকে সবচেয়ে আমি প্রয়োজনে লাগাতে পারব এটাই বেছে নিতে হবে আমাকে।–তাকে কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো পোয়ারো, কিন্তু মঁসিয়ে, ব্যাপারটা তবুও আমার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। অবশ্যই আপনি ঠিক বলেছেন মঁসিয়ে পোয়ারো, সেটাই তো স্বাভাবিক। হঠাৎ রাগান্বিত হলেন ক্রোড়পতি কার্লে, তিনি বললেন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে, আপনি কি করে জানবেন। এখনও তো ব্যাপারটা আপনাকে যথাযথ বলা হয়নি। আগের মতোই হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন তিনি, গদী আঁটা চেয়ারে বসে। আচ্ছা মঁসিয়ে পোয়ারো স্বপ্ন সম্বন্ধে আপনার কোনো অভিজ্ঞতা আছে? ধুরন্ধর গোয়েন্দা প্রবরকে একি সব অদ্ভুত কথা শুনতে হচ্ছে? স্বপ্ন? বৃদ্ধ কার্লে কি তাকে স্বপ্নের কাহিনি শোনাবার জন্যই ডেকে এনেছেন? একী পাগলামো তার। কোনো মানে হয় না। এইভাবে তার মূল্যবান সময় নষ্ট করার। যাই হোক পোয়ারো নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করল। নিজের থেকেই কুঞ্চিত হল তার ভ্র যুগল। স্বপ্নেও সে কল্পনা করতে পারেনি এমন ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হবে সে। শুনুন মঁসিয়ে কার্লে এ বিষয়ে আপনাকে আমি নেপোলিয়নের বুক অফ ড্রীমস্ বইটি পড়ে দেখতে অনুরোধ করছি। অথবা আপনি সাহায্য নিতে পারেন ফ্যাশন দুরস্ত হার্লে স্ট্রিটের কোনো আধুনিক মনোবিশেষজ্ঞদের।
কার্লে তার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনলেন। তারপর উত্তর দিলেন ধীর কণ্ঠে, আমার দুর্ভাগ্য আমি কোনো ফল পাইনি, আপনার বলার আগেই আমি দু জায়গাতেই দেখা করেছি। মঁসিয়ে পোয়ারো। এবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন, খুবই অস্পষ্ট শোনাচ্ছিল তার কণ্ঠস্বর প্রথম দিকে, আবার একটু একটু করে তার স্বর চড়া পর্দায় যেতে লাগল। আমাকে কাটাতে হয় বারবার সেই একই স্বপ্নের ঘোরে প্রতি রাতে সেই একই স্বপ্নের জের টেনে যেতে হয় আমাকে। আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। এজন্য আমাকে কি মানসিক যন্ত্রণা পেতে হচ্ছে। আমি বাস্তবিকই খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি। এ অসহ্য আমি আর পারছি না। বিচিত্র সেই স্বপ্ন। আর, জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, ঠিক অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকে স্বপ্নের সেই দৃশ্যগুলি। আমি আমার চেয়ারে যেন বসে আছি, ঠিক এর পাশের ঘরেই। সাবেকী আমলের এক টেবিল আমার সামনে। টেবিলের ওপর সুন্দর একটা টাইমপিস ঘড়ি। কাটায় কাটায় তিনটে বেজে তেইশ, ঘড়িটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে একবার দেখে নিই। কোনো দিনও এর নড়চড় হয় না এই সময়ের এটাই আশ্চর্য! আমি কি বলতে চাইছি, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। একটা ভয়ার্ত বিহ্বল ছায়া বেনেডিক্ট এর চোখে কাঁপতে থাকে। যখন ঘড়িটার দিকে তাকাই, বুঝতে পারি এবার সময় হয়ে গেছে সেই স্বপ্ন দেখার। আমার বুকটা তখনই ভীষণভাবে কেঁপে ওঠে। আমার করণীয় কাজটা এবার শেষ করে নিতে হবে, ঠিক তখনই চিন্তা করি। আমি অত্যন্ত ঘৃণা বোধ করি এমন কি এ ধরনের কাজ করাটা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। অথচ আমি অসহায়, কাজটা আমাকে শেষ করতেই হবে যে ভাবেই হোক…তার কণ্ঠস্বর ক্রমশ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। পোয়ারো অবিচলিত ভাবে বলল, কি এমন কাজটা যেটা আপনাকে শেষ করতেই হবে বলে আপনি মনে করছেন?
বেনেডিক্ট কার্লে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন, ঠিক তিনটে বেজে আঠাশ মিনিটের সময়, আমার ডানদিকের ডেস্কের দ্বিতীয় ড্রয়ারটা খুললাম আমার রিভলবারটা সেখানে রাখা ছিল। ড্রয়ার থেকে বার করে সেটা টেবিলের ওপর রাখলাম। জানালার ধারে চলে এলাম রিভলবারে গুলি ভর্তি করে। তারপর বলুন, তারপর সেখানে কি ঘটলো, জানতে চাইলো পোয়ারো। হ্যাঁ তারপর, তারপর আমি নিজেই নিজেকে গুলি করি…।
এক অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা নেমে এল ঘরের মধ্যে। পোয়ারো সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলো। অতএব এটাই আপনার সেই স্বপ্ন?
হ্যাঁ, বললেন কার্লে।
প্রতি রাত্রেই কি আপনি শুধু এই স্বপ্নটা দেখেন?
ঠিক তাই তিনি উত্তর দিলেন।
বলতে পারেন আপনি নিজেই নিজেকে গুলিবিদ্ধ করার পর কি ঘটেছিলো? জানতে চাইলেন পোয়ারো।
কার্লে উত্তর দিলেন তখন আমার আবার ঘুম ভেঙে যায়। পোয়ারো আস্তে আস্তে মাথা দোলাচ্ছিল। আমার তখন মনের অবস্থা এমন যে কিছুই বলতে পারলাম না অথচ অনেক কিছুই বলার ছিল, কিন্তু বলা হল না ধ্যানমগ্ন যোগীর মতো পোয়ারো কি যেন ভাবছিলো তখন। আপনি কি সবসময় ওই নির্দিষ্ট ড্রয়ারে রিভলবার রাখতেন অর্থাৎ আপনার নিজের স্বার্থে?
হা রাখতাম, বললেন কার্লে।