উত্তর দিল পোয়ারো, হা, আমিই এরকুল পোয়ারো। নম্র ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে পোয়ারো বলল, নিজেকে আপনার প্রয়োজনে লাগাতে পারলে আমি ধন্য মনে করব। এরপর সে ধীর পায়ে চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেল।
কেমন যেন রুক্ষভাবেই ভদ্রলোক বললেন, হা হা, ওই চেয়ারেই বসুন তার নির্দেশ সুবোধ বালকের মতো মান্য করে পোয়ারো সেই চেয়ারেই বসল। এখন তার ওপরেই এসে পড়েছে টেবিল ল্যাম্পের সম্পূর্ণ আলোটাই। ক্রোড়পতি বৃদ্ধ ভদ্রলোক আলোর আড়ালে প্রায় অন্ধকার থেকেই বসে যে গভীর ভাবে তাকেই নিরীক্ষণ করছিল, এটা স্বাভাবিক ভাবেই বুঝতে পারছিল পোয়ারো। আবার সেই কর্কশ কণ্ঠস্বর বেজে উঠল, হুমআমি সেটা কি করে বুঝবো যে আপনিই এরকুল পোয়ারো। পোয়ারো হতবাক হয়ে গেল এমন একটি অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে। আপনাকে চেনার কি উপায় আছে বলুন?
কোর্টের পকেটে আর একবার হাত ঢুকিয়ে চিঠিটা বার করে কার্লের সামনে মেলে ধরল পোয়ারো। বেশ উত্তেজনার সঙ্গে মাথা ঝাঁকালেন বৃদ্ধ চিঠিটার দিকে একপলক তাকাবার পর, এতক্ষণে ঠিক হয়েছে, আমি এইভাবেই চিঠি লিখতে বলেছিলাম কর্নওয়ার্দিকে। আবার ভাজ করে চিঠিটা পোয়রোর হাতে ফেরৎ দেবার সময় তিনি আবার বলে উঠলেন, তাহলে আপনিই সেই গোয়েন্দা ভদ্রলোক তাই না? ভদ্রলোক বেশ তো? বিশেষ করে তাকেই কথা বলার সুযোগ দেবেন ভদ্রলোক যেহেতু তাকে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এবং বাড়িতে সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেবেন, তা তো নয়ই, নিজেই যেন তিনি বক্তা।
বৃদ্ধকে আশ্বস্ত করতে চাইলো পোয়ারো হাত নেড়ে। এখানে কোনো ছলনার ব্যাপার নেই একথা বিশ্বাস করতে পারেন। পোয়ারো বলল। অদ্ভুত একটা আওয়াজ করলেন মুখে বেনেডিক্ট কার্লে এবং বললেন, এ ধরনের আশ্বাসই দিয়ে থাকে যাদুগররা টুপির মধ্যে থেকে সোনালী মাছ বার করার আগে। বুদ্ধিমানের মতো চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলো পোয়ারো কোনো উত্তর দিল না। নিজের থেকেই আবার বললেন বৃদ্ধ কার্লে, মহাশয়, আমাকে একজন সন্দিগ্ধ চিত্ত বৃদ্ধ বলে মনে হচ্ছে তাই না? আমি সত্যিই একান্তভাবে সেই রকমই। আমার চরিত্রের মূলমন্ত্র হলো, কখনো কাউকে বিশ্বাস করো না। এটাকে আপনি বৈশিষ্ট্যও বলতে পারেন। আদর্শগত ভাবে যুক্তিযুক্ত নয় হঠাৎ কোনো আগন্তুককে, কোনো বিত্তবান মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা। কারণটা কি আপনি জানেন? এর ফল অনেক সাংঘাতিক হয় শেষের পর্যায়ে তা দেখা গেছে।
শুরু থেকেই ভদ্রলোক তার সন্দেহের কথা বলে যাচ্ছেন অথবা জ্ঞান বিতরণ করছেন। পোয়ারোর পছন্দ হচ্ছিল না। সে পর্যন্ত আর অপেক্ষা না করে সে বলেই ফেলল, চিঠিতে যেভাবে লিখেছেন, আপনি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে কোনো বিষয়ে পরামর্শ করতে চান তাই না? এবার পোয়ারো আসল প্রশ্নের প্রস্তাব তুললো। নিশ্চয়ই। তা তো বটেই ডাইনে বায়ে দুদিকেই মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, এটা আপনাকে বলে রাখি যে আমি সর্বদা উৎকৃষ্ট জিনিসটাই পছন্দ করি। আমাকে কেউ ঠকাতে পারবে না, খারাপ কিছু দিয়ে। কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ আমি ঠিক অনুমান করতে পারবো। এটাই আমার জীবনের মূল আদর্শ। প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন। টাকার জন্য কোনো চিন্তা করবেন না। আপনার ফি সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করিনি, তাইতো। এই ব্যাপারটা সব সময় মনে রাখবেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। আর আমি সেটা করবোও না। সেটা যত অঙ্কেরই হোক–পরে আমার কাছে আপনার বিলটা দেবেন, কেন না সামান্য ব্যাপার নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। অবশ্যই সেজন্য আমাকে বোকা ভাববেন না, দু শিলিং নয় পেন্স হিসাবে ডেয়ারী প্রতিষ্ঠানের মালিক ডিম-এর বিল পাঠিয়েছিল আমার কাছে, কিন্তু তখন ডিমের বাজার দর ছিল, দু শিলিং সাত পেন্স, আমি খোঁজ নিয়ে তা জানতে পারি। এরা প্রত্যেকেই এক একটি চোর। এটাই আমার ধারণা। জোচ্চোর, আমি বরদাস্ত করব না কখনওই যে কেউ আমাকে ঠকিয়ে নিয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ তাদের ব্যাপার আলাদা যারা একেবারে উচ্চপদে আসীন। অবশ্যই তারা প্রত্যেকেই উপযুক্ত ব্যক্তি। তারা বেশী অর্থ দাবি করতে পারেন যোগ্যতা বলে। আমি নিজেও একজন, ওই গোষ্ঠী ভুক্ত আপনাকে বললাম এবং আমি সব জানি…।
তর্ক এড়িয়ে গেল পোয়ারো। নীরবে শ্রোতার ভূমিকা পালন করে গেল সে, ঘাড়টা একটু বাঁ দিকে কাত করে। প্রকৃতপক্ষে তার হৃদয়ের গভীরে যেটা ক্রমশই পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল সেটা হল কিছু পাওয়ার হতাশা। এখানে এসে সে ভুল করেছে এটা তার মনে হল। তাকে সম্পূর্ণ নিরাশ করেছে আজকের এই সাক্ষাৎকার। এরকম অদ্ভুত ঘটনা কখনো আগে তার জীবনে ঘটেনি। কোনো হদিশ খুঁজে পাচ্ছিল না সে যে এর উৎসটা কোথায়? এর পরেও একটা কিন্তু থেকে যায়। ক্রোড়পতি বেনেডিক্ট কালের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় এ পর্যন্ত সে পেয়েছে তার ফলে চিনে নিতে অসুবিধা হবে না ভদ্রলোককে কিংবদন্তীর নায়ক হিসাবে। স্বগতভাবে চিন্তা করলো ভদ্রলোকটি রূপ পাণ্ডিত্যের মুখোশপরা। কেবল বাসর্বস্ব। তাকে বহু বাতিকগ্রস্ত ক্রোড়পতির সান্নিধ্যে আসতে হয়েছে। সুদীর্ঘ কর্ম জীবনে। অবশ্য তাদের মধ্যে এক একটা তীব্র শক্তি পোয়ারো অনুভব করেছিলো। আর পোয়ারো নিজের অনুভব শক্তির দ্বারা সহজেই তাদের শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম আদায় করে নেয়। তাদের মধ্যে কেউ যদি শতছিদ্র পোকায় কাটা ড্রেসিং গাউন পরে থাকেন, তবে বোঝা যায়, সে বিশেষ করে তারা ভালোবাসেন ওই ড্রেসিং গাউনটা পরে থাকতে। এটাই হল তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতীক। যেন কোনো যাত্রাদলের সম্পত্তি বেনেডিক্ট কার্লের এই ড্রেসিং গাউনটা পোয়ারোর অন্ততঃ সেই কথাই মনে হল। ভদ্রলোক যেন যাত্রাদলের সাজ পরে মঞ্চের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নাটকীয় অভিব্যক্তির ছোঁয়া আছে তার চালচলন কথাবার্তাতেও খুব স্বল্পভাষী তিনি, প্রতিটি কথাই সংক্ষেপে বলেন। তার কথা বলাটা যেন নির্দিষ্টভাবে কোনো কিছুকে স্পষ্ট করে তোলার জন্য।