কলিং বেল টেপার পর তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দরজাটা খুলে গেল ঠিক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই। উর্দি পরিহিত একটি লোককে দেখা গেল দরজার অপর প্রান্তে, এবং এই সভ্য ভব্য লোকটিকে সহজেই খানসামা হিসাবে মনে করা যায়। তার চোখেমুখে সাবলীল অভিব্যক্তির ছাপ, এবং চেষ্টাকৃত বিনয় বজায় ছিলো। একটুও ঘাটতি ছিল না, লোকটি যেন এই ঠাট বজায় রাখতে দৃঢ় সংকল্প। যদিও সেটা তার নিজ স্বভাবের গুণে কষ্টকল্পিত প্রচেষ্টা, সেটা হল তার পরিপাটীর নিপুণতা এবং সবদিক থেকেই। পোয়ারোর দৃষ্টিতে সে উত্তীর্ণ হল, মনে মনে লোকটির প্রশংসা করলো পোয়ারো।
স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, বিনীত কণ্ঠে জানতে চাইল খানসামা, আগে থেকেই স্থির করা ছিলো কি আপনার এখানে আসার কথা?
পোয়ারো মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো।
আরো একটু জানতে চাই স্যার। নামটা কি আপনার?
অবশ্যই, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল পোয়ারো, এ সামান্য ব্যক্তির নাম মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো।
খানসামার পরবর্তী আচরণ দেখে মনে হল যে তার কথায় সে সন্তুষ্ট হয়েছে। খানসামা একপাশে সরে দাঁড়ালো অভিবাদন জানানো ভঙ্গিমায়। পোয়ারোকে প্রবেশ পথ মুক্ত করে দিল। সে আবার নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল ভেতর থেকেই; পোয়ারো যখন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। অল্প সময়ের জন্য অভিজ্ঞ খানসামা তার দিকে তাকিয়ে যেন কি চিন্তা করল। খানসামার পরবর্তী নির্দেশের জন্য পোয়ারোও কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তার বোধ হয় মনে পড়ে থাকবে যে আরো করণীয় কাজ তার বাকী আছে। যখন সে তৈরি হাতে আগন্তুকের টুপি, ছড়ি ও ওভারকোট খুলে নিচ্ছিল, তারপর সে বাকী কাজটার জন্য তৎপর হল।
কিছু মনে করবেন না স্যার, আরো একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হচ্ছি। খানসামা বলল, আপনি কি কোনো চিঠি এনেছেন আপনার সঙ্গে?
পোয়ারো এ বিষয়ে সজাগ ছিল না। যেখানে যেমন ভাবে দেখাতে হয়। পোয়ারো কোটের পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে মেলে ধরল খানসামার দিকে, বেশ গম্ভীরভাবে। চিঠিটা তার হাত থেকে নিয়ে একবার উল্টে পালটে দেখে ফিরিয়ে দিল তাকে খানসামাটি। সযত্নে পকেটে চালান করে দিল পোয়ারো চিঠিটি ভাঁজ করে নিয়ে। চিঠির প্রতিটি কথা, প্রত্যেক ছন্দ যেন মুখস্থ আছে, তার চিঠির বক্তব্যও অতি সরল এবং মনোগ্রাহী। মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো।
প্রিয় মহাশয়,
মিঃ বেনেডিক্ট কার্লে কোনো এক বিষয়ে পরামর্শ নিতে চান, আপনার নিকট। যদি আপনার পক্ষে সম্ভব হয়, তবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার ঠিক সন্ধ্যা-সাড়ে সাতটায় উপরোক্ত ঠিকানায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলে বিশেষ বাধিত হবেন তিনি।
আপনার অনুগত
হুগো কর্নওয়ার্দি
(সেক্রেটারি)
পুনশ্চঃ অনুগ্রহ করে সঙ্গে এই চিঠিটাও নিয়ে আসবেন।
টুপি ও ছড়িটা পোয়ারোর কাছ থেকে নিয়ে তাকে আহ্বান জানালো খানসামা, আসুন স্যার। আপনাদের সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করা হয়েছে মিঃ কর্নওয়ার্দির ঘরেই।
আগে আগে চলল খানসামা তাকে পথ নির্দেশ করার জন্য–পোয়ারো প্রশস্ত কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল খানসামাটিকে অনুসরণ করে। পোয়ারোর দুচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো প্রশংসার ঘরের চারিপাশ লক্ষ্য করার পর। সে যত দেখে ততই আশ্চর্য বোধ করে। খুব কম বাড়ি আছে এমন সব মূল্যবান সামগ্রী দ্বারা সুশোভিত। এটা তার অনুমান। পোয়ারোর মনোভাব বড়ই স্পর্শকাতর প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক এইসব শিল্প সামগ্রী সম্পর্কে। নিঃশব্দে মৃদুপায়ে দোতলার করিডোর পথ দিয়ে তারা এগিয়ে চলল, খানসামার নির্দেশে একটা ঘরের সামনে দাঁড়াল। খানসামা ঘরের দরজায় কয়েকবার টোকা দিল হালকাভাবে। একটু কাঁপলো বোধহয় পোয়ারোর ভ্ৰযুগল। আবার বোধহয় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে চলেছে তার মনে হল। হয়তো আবার কোথাও ছন্দপতন হবে। কখনো দরজায় এভাবে নক করে না অভিজ্ঞ কোনো খানসামা। মনে মনে প্রমাদ গুনলো পোয়ারো। সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হলো যে এই খানসামাটি, খানসামা সম্প্রদায়ের অভিজাত কুলের একজন। পোয়ারো চিন্তা করল হয়তো তার এই আচরণের পশ্চাতে তার মনিবের নির্দেশ রয়েছে। পোয়ারোর আর একবার খামখেয়ালীপনার নিদর্শন পেল। এ সমস্তই কোটিপতি কার্লের হরেক রকম খেয়ালীপনার আরেকটি। তাহলে মিঃ কার্লের খেয়ালীপনা শুরু হয়ে গেল এখন থেকেই? এখন পোয়ারো ভাবলো একথা। একটা গলার আওয়াজ ভেসে এল তার কানে ঠিক এইসময়ে। মৃদু ঠেলা দিলে যাতে খুলে যায় এমনভাবে ভেজানো ছিল দরজা, কিছুটা ভেতরে ঢুকে খানসামা, মৃদু গলায় তার সঙ্গীকে জানালো, স্যার আপনি অপেক্ষা করছিলেন যে ভদ্রলোকটির জন্য
পোয়ারো এবার ঘরের ভেতর প্রবেশ করল, খানসামাটির চোখের ইশারায়। ঘরটা বিশাল বড়। আসবাবের বাহুল্য নেই, ঘরটা বেশ ফঁকাই বলা যায়। ঘরের একদিকে একটা ছোট আলমারি ফাইল পত্র রাখার জন্য। মোটা মোটা রেফারেন্স বই চারিপাশে সুদৃশ্য স্টীলের র্যাকে সাজানো। ভারী কাঠের একটা টেবিল ঘরের মাঝখানে, মসৃণ কাগজে আবৃত। কয়েকটা গদি আঁটা চেয়ার টেবিলের চারপাশে। আসবাব বলতে এইসব। যেহেতু ঘরের মধ্যে আলোর প্রাচুর্য ছিল না, সেজন্য ঘরের চার কোণে আলো আধারি খেলা বেশ লক্ষ্য করবার মতো। ঘরটার বিশালত্বর দিক দিয়ে আলোর সংখ্যা বিশেষ কম। ঘরের ভেতরে একটা তেপায়া ছোট টেবিলের ওপর সবুজ ঘেরাটোপ দেওয়া মাত্র একটি টেবিল ল্যাম্প জ্বলছিল। আর দরজা পথে কেউ ঢুকলে সমস্ত আলোটাই তার উপরে প্রতিফলিত হবে, এমনভাবে রাখা ছিল টেবিল ল্যাম্পটা। পোয়ারোর চোখ ধাঁধিয়ে গেল যখন সে প্রথম প্রবেশ করলো ঘরে। উপলব্ধি করতে পারলো সে সহজের ল্যাম্পটা দেড়শো পাওয়ার-এর কম নয়। তার দৃষ্টি যখন সামঞ্জস্য ফিরে পেল, তখন পোয়ারো টেবিল ল্যাম্পের ঠিক পেছনে অর্ধশায়িত অবস্থায় আরাম কেদারায় বেনেডিক্ট কার্লেকে আবিষ্কার করল। লম্বা খাড়া নাসিকা, রোগা ছিপছিপে দীর্ঘ শরীর, পরিধানে সেই পরিচিত বিচিত্র ড্রেসিং গাউন। তাতে রঙবেরঙের খেলা। মাথাটা সামনের দিকে সামান্য ঝুলে রয়েছে বিশেষ কায়দায়। একগুচ্ছ সাদা চুল মাথায় কাকাতুয়ার ঝুঁটির মতো। একজোড়া জ্বলজ্বলে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি মেলে পুরু লেন্সের আড়াল থেকে নবাগত আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। প্রথম একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন তিনি হুম অবশ্য ধীরে ধীরে, নবাগত আগন্তুককে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর। তার গলার আওয়াজ, ধারালো এবং তীক্ষ্ণ। কানে শুনলে বিশ্রী লাগে, তাহলে আপনিই এরকুল পোয়ারো, প্রশ্ন করলেন তিনি।