কি বলুন, মিসেস কার্লে? পোয়ারো জানতে চাইলেন।
মিসেস কার্লে বললেন, তিনি অবশেষে আত্মহননের পথটাই বেছে নিলেন তীব্র মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে।
মনে পড়ে গেল পোয়ারোর বেনেডিক্ট কার্লের কথা। আমি সত্যি যেটা করতে চাই। আমি এবার সেই কাজটা সমাধা করতে যাচ্ছি। এবার আমার জীবনের ইতি টানব আমি। পোয়ারোর চিন্তা থেমে গেল কথাটা মনে হতেই।
সময়ে সময়ে মানুষ পাগল হয়ে যায় রাত্রি জাগরণে, আবার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। তবে একথা সে মেনে নিতে পারছে না এজন্য কেউ আত্মহত্যা করবে। আর এই স্থানেই সে অন্যদের সঙ্গে একমত হতে পারছে না। কারো যুক্তিই তার যুক্তি সঙ্গত মনে হচ্ছে না এক্ষেত্রে মিঃ কার্লে নিজেই তাকে বলেছিলেন অথবা এও বলা যেতে পারে তিনি তার শেষ ইচ্ছাই প্রকাশ করেছিলেন, এভাবে বেঁচে থাকা যায় না, একথাটাই কেবল তার মনে হচ্ছিল কোনো এক অশুভ শক্তি এসে রাতের পর রাত আমার ঘুমের গুহায় হানা দেবে, আমার দেহ মন অবশ করে দেবে। আর আমি ঘুমাতে না পেরে পাগলের মতো ছটফট করব, কতদিন তা সহ্য করা যায়? এর ইতি টানা প্রয়োজন। আর তা এখনই এগুলিও তিনি বলেছিলেন, আত্মহনন হল সেই চূড়ান্ত সম্পত্তির অর্থ। যখন পোয়ারো শুনেছিল কার্লের কথাগুলো মনে হচ্ছিল এগুলা তার মনের কথা নয়, কেউ তার মুখ দিয়ে যেন এ কথাগুলো বলাচ্ছিল।
কেউ যেন তাকে আত্মহত্যার পথে এগিয়ে যেতে প্ররোচিত করছিল। তখন যেমন পোয়ারোর মনে হয়েছিল তেমন আজও মনে হচ্ছে, সত্যি সত্যি যদি তিনি আত্মহত্যা করে থাকেন, তবে স্ব ইচ্ছায় করেননি। আড়াল থেকে হয়তো তাকে কেউ মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছে, তার এই কাজের পিছনে হয়তো কারো কৌশল নিযুক্ত আছে। তাহলে দেখতে হবে কে হতে পারে সেই অদৃশ্য মানুষটি? খতিয়ান করে দেখতে হবে মিঃ কার্লের মৃত্যুতে তার কি লাভ হতে পারে। চিন্তা করছিল পোয়ারো।
আপাতত তার চিন্তাটাকে সুপ্ত রেখে পোয়ারো সরাসরি ফিরে তাকাল মিসেস কার্লের দিকে। সে বলল, কখনো কি আপনার মনে এমন সন্দেহ জেগেছিল যে আপনার স্বামী আত্মহত্যা করতে পারেন?
মিসেস কার্লে উত্তর দিলেন, সে রকম নয় তবে
মিসেস কার্লে এই তবে টা কি? কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল পোয়ারো, থামলেন কেন বলুন?
তার কথার জের টেনে মিসেস কার্লে আবার বললেন, তবে, মাঝে মাঝে কেমন অদ্ভুত বলে মনে হত তার চালচলন, অর্থাৎ ঠিক স্বাভাবিক আচরণ তখন তিনি করতেন না।
ফোঁস করে উঠল জোয়ানো কার্লে, খুব স্পষ্ট ভাবেই সে বলল, না, কখনই আত্মহত্যা করতে পারেন না আমার বাবা। তিনি সেরকম মানুষই নন। যথেষ্ট সচেতন থাকতেন তিনি নিজের সম্পর্কে সব সময়। কখনো কি এরকম মানুষ নিজেকে শেষ করতে পারেন একেবারেই সম্ভব নয়, তার সম্বন্ধে এরকম ধারণা করাটা শুধু অবাস্তবই নয় এটা একটা মিথ্যার অবতারণা করা।
এবার মুখ খুলল স্টীলিং ক্লীট, তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আছে কিনা একথা কারুর বাহ্যিক আচার আচরণ দেখে সবসময় বিচার করা যায় না এবং সেটা অন্য কারো মতের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। আরো ব্যাখ্যা দিল ডঃ স্টীলিং ক্লীট তার এই মতের সমর্থনে, সেজন্য আশ্চর্য, অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে পারে কোনো কোনো আত্মহত্যার ঘটনা। সামান্য আভাস ও কেউ কল্পনা করতে পারে না আগে থেকে এটা আরো আশ্চর্যের ব্যাপার। অবশ্য ঢাক ঢোল পিটিয়ে কেউই আত্মহত্যা করে না।
কারণ সেক্ষেত্রে তার আত্মহত্যার কাজ সফল হবে না, তাকে সেই কাজ থেকে বিরত হবার জন্য সকলেই চেষ্টা করবে। আর সেজন্যই তার আত্মহত্যা করা হয়ে ওঠে না। হয়তো কেউ কেউ আত্মহত্যা করবার পূর্বে পাগল হয়ে যায় এমন একটা প্রবাদ আছে। কথাটা নির্ভেজাল ভাবে সত্যি। কেউ কি তার সুন্দর জীবন সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় নষ্ট করতে চায়। অর্থাৎ সাধারণতঃ কেউ নিজেকে হত্যা করে না জ্ঞানত। দেখা যাচ্ছে মানুষ নিজেকে খতম করে ফেলে অজ্ঞান অবস্থায় অতএব–পোয়ারো তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, মিঃ স্টীলিং ক্লীট মিঃ কালের মধ্যে কেউ কোনো পাগলামির লক্ষণ প্রত্যক্ষ করেনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একথাটা ভুলে গেলে চলবে না। সম্ভবত আপনিও নন, লক্ষ্য করেছিলেন কি আপনি?
ওঃ, থতিয়ে গিয়ে বললেন, না, হ্যাঁ আমিও ঠিক বুঝতে পারিনি। এতে আর বোঝ না বোঝার কি আছে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয় না কারোর পাগলামির লক্ষণ। অথবা বুঝিয়ে দিতে হয় না পাখি পড়ানোর মতো। এ ব্যাপারটা হল অনুভূতি দিয়ে বোঝার ব্যাপার। একটা বাড়তি মনোযোগ চাই এজন্য। যেটা স্নায়ুকোষগুলি সচল রাখে। একটু থামল এবার পোয়ারো এবং ফিরে এলো কাজের কথায়।
উঠে দাঁড়ালো পোয়ারোর চেয়ার ছেড়ে, যদি অনুমতি দেন, তবে সেই বিয়োগান্ত ঘটনাস্থল, মানে অকুস্থল আমি নিজের চোখে দেখে আসতে ইচ্ছা করি। অবশ্যই দেখতে পারেন বলে স্টীলিং ক্লীট তাকে দোতালায় সঙ্গে করে নিয়ে এলো।
তার সেক্রেটারীর ঘরের থেকে অনেক বড় মিঃ কার্লের বসার ঘরটা। পুরু কার্পেট দিয়ে মোড়া ঘরের সম্পূর্ণ মেঝেটা। হাতলওয়ালা চেয়ার চামড়ায় মোড়া, ঘরের বাড়তি শোভা বাড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট সৌখিন ও বিলাসবহুল আসবাবপত্র। বিরাট একটা লেখার টেবিল একধারে রাখা আছে। পোয়ারো তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিমায় ঘরের ভেতরটা সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলো। তারপর সন্তর্পণে টেবিলটা পেরিয়ে এসে দাঁড়ালো সে জানালার সামনে, সে দেখল দামি কার্পেটের উপর চাপ চাপ কালচে দাগ জানালার ঠিক নীচে। তার বুঝতে কোন অসুবিধা হলো না যে দাগটা টাটকা রক্তের, যেন সেই ক্রোড়পতি কালে তাকে বলছেন তার মনে পড়ল : ঠিক তিনটে বেজে আঠাশ মিনিটের সময় আমি ওই টেবিলের ডানদিকের নিচের ড্রয়ারটা থেকে আমার গুলি ভরা রিভলবারটা বার করে জানালার ধারে চলে আসি। রিভলবারে আগে থেকেই গুলি ভরে রেখেছিলাম। তাই কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না। তাই ঠান্ডা মাথায় ধীর স্থির ভাবে রিভলবারটা হাতে তুলে নিলাম। আর তারপর হ্যাঁ তারপর নিজেকে গুলিবিদ্ধ করলাম।
২. কার্লের আর্তনাদ
পোয়ারোর চোখের সামনে যেন ঠিক একটা এই রকম চিত্র ভেসে উঠল। সে অবশ্য কার্লের আর্তনাদ নিজের কানে শোনেনি। সেই প্রতিধ্বনি তার কানে এখনো বাজছে তার মনে হল। মনে হলো ঘড়িতে যেন নির্দেশ দিচ্ছে এখনই তিনটে আঠাশ। নিজের মনে মাথা নাড়ছিল পোয়ারো অবশ্য কার্লের মৃত্যুর সময় সে যদি উপস্থিত থাকত তাহলে সে দেখতে পেত দৃশ্যটা ঠিক এই রকমই এবং ভয়ার্ত আর্তনাদ শুনতে পেত সে। একথাও চিন্তা করলো পোয়ারো, সে যদি সেই সময় উপস্থিত থাকতো তাহলে কি, মৃত্যুর হাত থেকে তাকে বাঁচাতে পারতো? নিয়তি তবে আর কাকে বলে? সেদিন তাকে সব আশঙ্কার কথা পরিষ্কার ভাবে বললেন ভদ্রলোক, কিন্তু একবার তিনি জানতে চাইলেন না যে এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে কিনা? অদ্ভুত মানুষ তিনি। তাকে তিনি ডেকে আনলেন তার সমস্যার কথা বলার জন্য। কিন্তু যখনই পোয়ারো সমাধানের পথ বলতে গেল তখনই তিনি নির্বিবাদে বললেন, এখানেই আমার বক্তব্যের ইতি টানছি, আপনার সাহায্যের প্রয়োজন নেই, আমি নিজেই মোকাবিলা করতে পারবো আমার আসন্ন বিপদের। আপনি এখন যেতে পারেন। আর দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো কথাটা যেন পাঁচ কান না হয়ে যায়। আমি কেবল আপনাকেই আমার আশঙ্কার কথা বললাম। যদি সেই আশঙ্কার কথা অন্য কারো মুখে শুনি তাহলে বুঝবো সেজন্য আপনিই দায়ী হ্যাঁ, আপনিই। আমি তার আশঙ্কার কথা কারো কাছে প্রকাশ করব না, কার্লে একরকম জোর করেই আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন। নিজের মনে মাথা নাড়ল পোয়ারো, আমি কত মক্কেলকেই এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছি এর আগে। সেটা যত অপ্রিয়ই হোক না কেন, কথাটা প্রকাশ করা কর্তব্য মনে করল সে কারণ তার যে অবস্থা গেল। কার্লের ব্যক্তিগত জীবনের একটা অধ্যায় সম্পর্কে নীরব থাকতে পারে না সে, বিশেষ করে এ অবস্থায়, এই মুহূর্তে। এই আকস্মিক মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত কিছু প্রকাশ না করলে ব্যাহত হবে পুলিসী তদন্তের কাজ। সে নিয়মের বাইরে যেতে পারবে না একজন গোয়েন্দা হিসাবে।