ঠিক এমনি সময় ফ্রাঙ্কেইস বাড়ির দরজা খুলে দিল। আমরা ছুটে ওপরে উঠে গেলাম।
ঘরের ভেতর থেকে ধস্তাধস্তির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ ছিল। একটু পরেই দরজা খুলে দিল সিনডেরেলা।
–মাদাম নিরাপদ তো? জানতে চাইল পোয়ারো।
–হ্যাঁ, তবে খুবই বিধ্বস্ত। আমার আসতে একমুহূর্ত দেরি হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত।
বিছানার ওপরে কাত হয়ে পড়েছিলেন মাদাম রেনাল্ড। ভীষণভাবে হাঁপাচ্ছিলেন।
-গলা টিপে ধরেছিল আমার। দম টানতে টানতে বললেন তিনি।
সিনডেরেলা উবু হয়ে মেঝের ওপর থেকে একটা দড়ি পাকানো মই তুলে পোয়ারোর হাতে দিল।
–এটা ব্যবহার করেই ওপরে উঠে এসেছিল, বলল পোয়ারো, কিন্তু কোথায় সে?
আঙুল তুলে ঘরের এক কোণায় নির্দেশ করল সিনডেরেলা। মুখটা কাপড়ে ঢাকা।
–মরে গেছে নাকি? পোয়ারো জানতে চাইল।
–মনে হয়। পাথরে মাথা ঠুকে গিয়ে থাকবে।
–কিন্তু ওটা কে? জানতে চাইলাম আমি।
–মঁসিয়ে রেনাল্ডের খুনী। মাদাম রেনাল্ডকে সে খুন করতে চেয়েছিল।
আমি হাঁটু মুড়ে বসে মুখের ওপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিলাম। বিস্ময়ে কথা হারিয়ে গেল আমার। একটা সুন্দর মুখ আমাকে যেন ব্যঙ্গ করল। সে মুখ মার্থা উওব্রেয়ুইলের।
সেই রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল।
এমন একটা নাটকীয় ফাঁদ পাতার পর আমরা আবিষ্কার করলাম মাদাম রেনাল্ডের ঘরে মাথা ডওব্রেয়ুইলের মৃতদেহ।
পোয়ারো বলল, মাদামের ঘরে তাকে আবিষ্কার করা হলেও মঁসিয়ে রেনান্ডের প্রকৃত খুনী সেই।
কিন্তু বেলা ডুবিনই তো তাকে খুন করেছে বলে আদালতে স্বীকারোক্তি করল। বললাম আমি।
–সে খুনী বলে যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে তা ঠিক নয় হেস্টিংস। সে খুন করেনি।
–তাহলে এরকম স্বীকারোক্তি করার স্বার্থ কি তার?
জ্যাক রেনাল্ডকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচানো। তাকে সে আন্তরিকভাবে ভালোবাসত। মামলাটা খুবই জটিল হয়ে পড়েছিল। তবে গোড়া থেকেই আমার মনে হয়েছিল, কেসটা পূর্বপরিকল্পিত ঠান্ডা মাথার একটা খুন। পুলিসকে অন্ধকারে রাখার জন্য নিজেকে নিজে খুন করার যে অদ্ভুত পরিকল্পনা নিয়েছিলেন মঁসিয়ে রেনাল্ড, ঘটনাচক্রে সেই পরিকল্পনাই তার খুনী সুচতুরভাবে কাজে লাগিয়েছিল।
–কিন্তু তুমি তো বলেছিলে, মঁসিয়ে রেনান্ডের পরিকল্পনার কথা একমাত্র মাদাম রেনাল্ডই জানতেন।
–হ্যাঁ, তিনিই একমাত্র জানতেন। এবং তাকেই আমাদের সন্দেহ করার কথা। কিন্তু তার অপরাধ প্রমাণ করার মতো কোনো তথ্য ছিল না। স্বভাবতই ভাবনা হল, তাহলে আর কে খুনী হতে পারে?
মার্থা উওব্রেয়ুইলের স্বীকারোক্তি থেকেই সেই তথ্যের আভাস পাওয়া গেল। সে বলেছিল বাগানে সেই ভবঘুরে লোকটার সঙ্গে মঁসিয়ে রেনাল্ডের বচসার সময় সে আড়াল থেকে শুনেছিল। আমি অনুমান করলাম, তাহলে সে রেনাল্ড দম্পতির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও শুনে থাকতে পারে, অবশ্য যদি তারা বাগানের বেঞ্চিতে বসে আলোচনা করে থাকেন।
–যদি ধরে নিই তাদের আলোচনা সে শুনেছে, তবে মঁসিয়ে রেনাল্ডকে সে খুন করতে চাইবে? কি স্বার্থ উদ্ধার হবে তার?
–স্বার্থ খুবই সরল। তা হলো অর্থ। তাহলে এই দিকটা নতুন করে সাজিয়ে দিচ্ছি দেখ।
বলে পোয়ারো চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। পরে তার ব্যাখ্যা শুরু করল, মার্থা তরুণ রেনাল্ডকে ভালোবাসতো, তবে অন্তর থেকে নয়, তার অর্থের দিকে তাকিয়ে, বিত্তবান পিতার পুত্র হিসেবে সে জানত, বাবার মৃত্যুর পর জ্যাক তার ধনসম্পত্তির অর্ধেক পাবে, আর জ্যাকের স্ত্রী হিসেবে সেই টাকার সেও হবে একজন দাবিদার। এদিক থেকে মার্থার কার্যকলাপ তার মায়েরই মতো।
এর পরে আসে ছুরির প্রসঙ্গে। জ্যাক তিনটে ছুরি তৈরি করেছিল। একটা সে দিয়েছিল মাকে, একটা বেলা ডুবিনকে আর তৃতীয়টা, নিজের জন্য না রেখে দিয়েছিল মার্থাকে। সে কখনোই স্বীকার করেনি যে একটা ছুরি নিজের জন্য রেখেছে। তাহলে তৃতীয় ছুরিটা মার্থার কাছে থাকাই সম্ভব।
তাহলে মার্থার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো কি দাঁড়াচ্ছে দেখ, প্রথমতঃ মঁসিয়ে রেনান্ডের পরিকল্পনার কথা মার্থা আড়াল থেকে শুনে থাকবে। দ্বিতীয়তঃ র্মসিয়ে রেনাল্ডের মৃত্যুতে তার আগ্রহ থাকার সঙ্গত কারণ রয়েছে।
তৃতীয়তঃ মার্থা হল এমন একজন কুখ্যাত অপরাধীর সন্তান, যে অন্ততঃ সরাসরি খুন না করে থাকলেও নৈতিক দিক থেকে সে তার স্বামীর খুনী। সেই খুনের সঙ্গে জর্জেস কনিউ-এর নামও অবশ্য জড়িত। সবশেষে সেই ছুরির প্রসঙ্গ।
একটু থামল পোয়ারো। পরে আগের প্রসঙ্গের জের টেনে বলল, বেলা ডুবিন স্বেচ্ছায় মঁসিয়ে রেনাল্ডকে খুন করার কথা স্বীকার করেছে। আপাতঃদৃষ্টিতে এখানেই মামলার যবনিকা পড়েছে। কিন্তু আমি এতে সন্তুষ্ট হতে পারিনি।
গোড়া থেকে সমস্ত ঘটনার পর্যালোচনা করার পর আমি আমার অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে থাকি। আমার মনে হল, বেলা ডুবিনকে বাদ দিলে আর একজনকেই মঁসিয়ে রেনাল্ডের খুনী হিসেবে ভাবা যেতে পারে, আর সে হল, মার্থা ডওব্রেয়ুইল।
কিন্তু তার বিরুদ্ধে দাঁড় করাবার মতো প্রমাণ অনুপস্থিত। সে সন্দেহের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছে নিজেকে।
বাধ্য হয়েই আমাকে অন্য পথ ধরতে হল। তার বিরুদ্ধে আমার আগে বলা দ্বিতীয় তথ্যটাকেই আমি খুঁটি হিসেবে চালতে চাইলাম। মাথার ভেতরের মানুষটাকে বাইরে টেনে না আনা পর্যন্ত নিঃসন্দেহ হওয়া যাচ্ছিল না।