ভিলায় পৌঁছে আমরা দেখা করতে চাই জানিয়ে ফ্রাঙ্কেইসকে দিয়ে ওপরে খবর পাঠিয়ে দিল পোয়ারো।
আমরা নিচে যখন অপেক্ষা করছি তখন দেখা গেল জ্যাক আর মার্থা ভিলায় ঢুকছে। পোয়ারো ঝট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে মিলিত হল।
-মঁসিয়ে রেনাল্ড, আপনারা এখন ভেতরে ঢুকবেন না। আপনার মা খুবই মুষড়ে পড়েছেন। দ্রুত বলে গেল পোয়ারো।
-কিন্তু আমাদের যে তার কাছে এখনই যেতে হবে। বলল জ্যাক রেনাল্ড।
-তাহলে আপনি বরং একা যান। মাদমোয়াজেলকে এখন নেবেন না। আমার পরামর্শ শুনুন
এমন সময় পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে ফিরে তাকালাম সকলে। লিওনির হাতে ভর দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন মাদাম রেনাল্ড।
–আপনার সহযোগিতার জন্য অশেষ ধন্যবাদ সঁসিয়ে পোয়ারো
।–মা—
ওপরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো জ্যাক।
সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে পড়ে কঠিন স্বরে বলে উঠলেন মাদাম রেনাল্ড, আমাকে তুমি আর মা বলে ডাকবে না। তুমি আর আমার ছেলে নও। এই মুহূর্ত থেকে আমি তোমাকে ত্যাগ করলাম।
-মা—
করুণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল জ্যাক। তার দৃষ্টি স্থির।
পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে মাদামকে কিছু বোঝাতে চায়। তাকে বাধা দিয়ে মাদাম রেনাল্ড জ্যাকের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, তোমার হাতে তোমার বাবার রক্ত লেগে রয়েছে। তুমিই তোমার বাবার মৃত্যুর কারণ।
এই মেয়েটির জন্য তুমি তোমার বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করেছ। আর একটি মেয়েকেও তুমি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চলেছ। তোমার মুখ আমি দেখতে চাই না। এই মুহূর্তে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।
তোমার বাবার এক কপর্দকও যাতে তুমি স্পর্শ করতে না পার, কালই আমি সেই ব্যবস্থা করব। যে মেয়েটির জন্য তোমার বাবাকে মরতে হল, তাকে সঙ্গে নিয়ে এবারে নিজের পথ খুঁজে নাও গে।
কথা শেষ করে তিনি ধীরে ধীরে ওপরে চলে গেলেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই হতবাক স্তব্ধ। কারোর মুখে টু শব্দ নেই। জ্যাক আর সইতে পারছিল না। তার শরীর টলতে লাগল। আমি আর পোয়ারো ছুটে গিয়ে তাকে ধরলাম।
-এত মানসিক চাপ উনি সইতে পারছেন না, মার্থাকে বলল পোয়ারো, ওকে এখন কোথায় নেওয়া যায় বলুন তো?
-আমার প্রিয় জ্যাক। আমাদের ভিলাতেই সে থাকবে। আমি আর আমার মা তার শুশ্রূষা করব।
জ্যাক রেনাল্ডকে ধরাধরি করে আমরা ভিলা মারগুয়েরিটে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করলেন। তিনি জানালেন, মানসিক চাপে শরীর বইতে পারছে না। পূর্ণ বিশ্রাম আর ভালো শুশ্রূষা পেলে সুস্থ হয়ে উঠবেন।
সেদিন শেষ পর্যন্ত মার্থার হাতেই জ্যাকের দায়িত্ব দিয়ে আমরা হোটেলে গিয়ে উঠলাম। দুটো ঘর ভাড়া নেওয়া হল।
হোটেল ম্যানেজার পোয়ারোকে জানাল, ইংলিস লেডি মিস রবিনসন আপনাদের জন্য সেলুনে অপেক্ষা করছেন মঁসিয়ে।
পোয়ারো এবার আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো। পরে চোখ নাচিয়ে বলল, শোন হেস্টিংস, আমি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করেছি।
–কিন্তু
–কিন্তুর কিছু নেই। মারলিনভিলে আনার জন্য ডুবিনকে ওই নামের পোশাকটা পরাতে হয়েছে। পুলিস গন্ধ পেলে
আসলে ডুবিন নয়–আমার সিনডেরেলা। সেলুনে ছুটে গিয়ে আমি তাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে টেনে নিলাম।
পোয়ারো এগিয়ে এসে বলল, মাদমোয়াজেল, আমাদের কাজ এখনো অনেক বাকি। আপাততঃ তুমি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। হেস্টিংস আর আমাকে এখনি বেরতে হবে। কাল আবার তোমাদের দেখা হবে।
-এখুনি কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?
–ব্যস্ত হয়ো না, কালই সব জানতে পাবে।
–আমি আপনাদের সঙ্গে যাব–কোনো কথা শুনব না। জেদ ধরল সিনডেরেলা।
পোয়ারো কথা বাড়াল না। বুঝতে পারল লাভ হবে না। বলল, তাহলে এসো সঙ্গে।
.
ভিলা জেনেভিয়েভ রাতের অন্ধকারে ডুবে আছে। কোনো ঘরেই আলো দেখা যাচ্ছে না। আমরা দাঁড়িয়ে আছি মাদাম রেনাল্ডের শোওয়ার ঘরের নিচে। জানালা খোলা ছিল। পোয়ারো সেদিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে।
পোয়ারোর উদ্দেশ্য কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তাই তাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে আমরা এখন কি করছি?
–সজাগ থাক। বলল পোয়ারো। ঘণ্টা দুয়েক হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
পোয়ারোর কথা শেষ হতে পেল না, একটা আর্ত চিৎকার রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে দিল।
বাঁচাওবাঁচাও–আমাকে বাঁচাও
দোতলার একটা ঘরে আলো জ্বলে উঠল। চিৎকারের শব্দটাও সেদিক থেকে আসছে। চোখে পড়ল জানালার কাছাকাছি দুটি অস্পষ্ট মূর্তি লড়াই করছে।
–মাদাম নিশ্চয়ই তার ঘর বদল করে থাকবেন।
বলতে বলতে ছুটে গিয়ে পোয়ারো সামনের দরজায় করাঘাত করতে লাগল। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। শিগগিরই খোলার সম্ভাবনা ছিল না। ওদিকে সমানে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার উঠছে।
পোয়ারো অস্থির ভাবে ছুটে এসে বললো, কি করা যায় বলো তো?
সেই মুহূর্তে আমাকে হতবাক করে দিয়ে সিনডেরেলা কাঠবিড়ালির মতো দেয়াল বেয়ে ওপরে সেই ঘরের জানালার দিকে উঠে যেতে লাগল।
–হ্যায় কপাল। ও যে পড়ে যাবে।
আমি অসহায় ভাবে চিৎকার করে উঠলাম।
–ঘাবড়িও না হেস্টিংস। ওটাই ওর পেশা। ও এসে দেখছি ভালোই হল।
এক মিনিটের মধ্যেই জানলা টপকে ঘরের ভেতরে লাফিয়ে পড়ল সিনডেরেলা। পরক্ষণেই তার চিৎকার ভেসে এলো, সরে দাঁড়ান আপনি। আমার কব্জি দুটো সাধারণ মনে করবেন না। লোহার মতো কঠিন।