পোয়ারো কাছেই ছিল। চিঠি পড়া শেষ করে বুঝতে পারি সর্বাঙ্গে শিথিলতা। শান্ত চোখে পোয়ারোর দিকে তাকালাম।
চিঠিটা আমার হাতে ফেরত দিয়ে পোয়ারো বলল, আমি আগেই জানতাম।
–সে অন্য মেয়ে জেনেও আমাকে বলনি কেন?
–এরকম একটা ভুল তুমি করবে আমি ভাবতে পারিনি। ফটোটা তুমি হাতে নিয়ে দেখেছিলে। যমজ বোন হলেও তাদের আলাদা ভাবে চেনা অসম্ভব ছিল না।
-সেই সুন্দর চুল
-নাচগানের সময় ওরকম পরচুল তাদের ব্যবহার করতে হয়। দুই বোনের চুল দুই রঙের। একজনের কালো, অন্য জনের হালকা রং। তাছাড়া কভেন্ট্রির হোটেলে এমন নাটকীয় পরিস্থিতি ছিল যে তোমাকে বলার সুযোগ ছিল না।
অবশ্য, এটাও স্বীকার করছি, তোমাদের প্রেম কতটা সত্য তা জানার ইচ্ছাও আমার ছিল। তবে বন্ধু, তোমাকে আমি ভুলের মধ্যে ফেলে রাখিনি।
পোয়ারোর গলায় আন্তরিকতার সুর, এক ঝটকায় যেন তার সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে দিল। আমার সত্যিকার বান্ধব সে।
তুমি কি মনে করো, সে আমার কথা ভাবে?
–চিঠির প্রতিটি ছত্রে তোমাকে নিয়ে তার ভাবনার কথা প্রকাশ পেয়েছে। তুমি কি তা বুঝতে পারনি?
–কিন্তু চিঠিতে তো কোনো ঠিকানা নেই…তাকে আমি পাব কোথায়?
–তার জন্য অধীর হবার কিছু নেই। তোমার পোয়ারো রয়েছে..
.
জেল থেকে ছাড়া পেল জ্যাক রেনাল্ড। মারলিনভিলে ফিরে যাবার আগে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এল। স্টোনর তার সঙ্গে ছিল।
–মাঁসিয়ে পোয়ারো, মেয়েটিকে আড়াল করার চেষ্টা কোনো কাজে এলো না। এভাবে সে উপস্থিত হবে ভাবতে পারিনি। বিষণ্ণ হেসে বলল জ্যাক।
-তার না এসে উপায় ছিল না, বলল স্টোনর, আপনাকে সে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে দিতে পারে না ।
কিন্তু জিরয়েড লোকটা যে এতবড় গর্দভ জানা ছিল না। বলল জ্যাক, বেলার জীবনে এখন কি ঘটতে চলেছে ঈশ্বর জানেন।
–বেলার ব্যাপারে ভাবিত হবার কিছু নেই, সহজ গলায় বলল পোয়ারো, ফরাসি আদালত যুবতী ও সুন্দরীদের ব্যাপারে যথেষ্ট সহৃদয়।
–কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, বাবার খুনের ব্যাপারে নৈতিকভাবে আমি দায় এড়াতে পারি না। বেলার ব্যাপারে আমার জড়িয়ে পড়ার জন্যই তাকে অকালে এভাবে চলে যেতে হল। এই বেদনা আমাকে আজীবন বয়ে চলতে হবে।
একটু থেমে সামান্য কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে জ্যাক আবার বলল, বেলা বাবাকে খুন করেছে, কথা মনে হলেই শরীর শিহরিত হয়। মার্থার সঙ্গে জড়িত হবার পর বেলার মানসিকতা বুঝতে আমি ভুল করেছিলাম। তাকে আমার নির্লজ্জ বলেই বোধ হয়েছিল। চিঠি লিখে তাকে যে অক্ষমতা জানাবো সে সাহসও পাইনি। ব্যাপারটা মাথার কানে যাবার ভয় ছিল। এখন বুঝতে পারছি, কাজটা কাপুরুষের মতো হয়ে গিয়েছিল। অথচ সে কোনো পেছুটান না রেখেই আমাকে বাঁচানোর জন্য সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে এসেছে। আমি বেঁচে থাকব ঠিকই কিন্তু অহরহ বুকে একটা হাহাকার আমাকে দগ্ধে মারবে।
দু-একটা বিষয় কিন্তু এখনো আমার কাছে পরিষ্কার হল না মঁসিয়ে পোয়ারো, সেই লোকদুটি যখন মায়ের ঘরে প্রবেশ করে তখন রাত দুটো বাজে বলে কেন যে মায়ের ভুল হল বুঝতে পারছি না। আমি মায়ের ঘরে প্রবেশ করেছিলাম, একথা মা ভাবতেও পারেননি। আর হল, সে-রাতে বাবার পোশাক আর আমার ওভারকোট নিয়ে আপনি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
–ওসব নিয়ে আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই মঁসিয়ে, বলল পোয়ারো, আপনাকে পরে আমি সব বুঝিয়ে বলব। এখন সে-রাতের কথাটা আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই।
-বলার মতো বিশেষ কিছু নেই মঁসিয়ে পোয়ারো। আগেও বলেছি মার্থার সঙ্গে দেখা করার জন্য চেরবুর্গ থেকে ফিরে আসি। ট্রেন লেটে পৌঁছেছিল। পথ কমাবার জন্য গলফ লিঙ্কের পথ ধরেছিলাম।
বাড়ির কাছাকাছি যখন পৌঁছাই, কেমন একটা দমফাটা চিৎকার আমার কানে এলো। তাড়াতাড়ি একটা ঝোপের আড়াল নিলাম। আকাশে চাঁদ ছিল। চাঁদের আলোয় কবরটা চোখে পড়ল। বাবা সেখানে দাঁড়িয়ে। একটা ছায়ামূর্তি, হাতে ছুরি। বাবাকে পেছন থেকে ছুরিবিদ্ধ করার জন্য উদ্যত হয়েছে। সেই মুহূর্তে আমাকে দেখতে পেয়ে সে আঁৎকে উঠেছিল। আমি বুঝতে পারলাম, আমি ভেবে, সে আমার বাবাকে খুন করেছে।
চিৎকার করে কেঁদে উঠে সেই মুহূর্তে সে ছুটে পালিয়ে যায়।
-তারপর? জানতে চায় পোয়ারো।
–বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার মাথায় খেলে যায় এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়। এখনি আমাকে পালাতে হবে। নইলে মেয়েটির বিরুদ্ধে আমাকে সাক্ষী দিতে ডাকবে ওরা। আমাকে যে তারা সন্দেহ করতে পারে সেকথা তখন মনে হয়নি। আমি হাঁটাপথে বেউভয়াসে পৌঁছে সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে চেরবুর্গে ফিরে যাই।
এই সময় হোটেলের বয় স্টোনরের হাতে একটা তারবার্তা দিয়ে গেলো। মারলিনভিল থেকে আসা তারবার্তায় জানানো হয়েছিল মাদাম রেনাল্ডের জ্ঞান ফিরে এসেছে।
–অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ। চলুন, তাহলে সকলে মিলে মারলিনভিলে যাওয়া যাক।
বেলা ডুবিনের কেসের তদারক করবার জন্য জ্যাক স্টোনরকে থাকতে বলল। তারপর আমাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে মারলিনভিলে রওনা হল।
.
ভিলা মারগুয়েরিটের কাছে জ্যাক গাড়ি থেকে নেমে গেল মার্থাকে তবে খালাস পাবার শুভসংবাদটা দেওয়ার জন্য। আর মাদাম রেনাল্ডকে তার ছেলের মুক্তির সংবাদ দেওয়ার জন্য আমরা চললাম ভিলা জেনেভিয়েভের উদ্দেশ্যে।