–তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার জন্য আমি দুঃখিত পোয়ারো, আমি বললাম, আমি নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমাকে মার্জনা কর। কথা দিচ্ছি, ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।
বন্ধু, মনে হয় মেয়েটিকে তুমি ভালোবাস, একথা নিজেও জানতে না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এই মেয়েটিই ছুরিটা নিয়েছিল। তোমাকে আমি সতর্ক করে দিয়েছিলাম। যাই হোক, এখন আমাকে কিছু বল, যদি আমার চেয়ে বেশি কিছু জেনে থাক–
–চমকে দেওয়ার মতো কোনো খবর তোমার ঝুলিতে নেই পোয়ারো। মিস ডুবিনকে সন্ধানের চেষ্টা করে বৃথা সময় ব্যয় করো না। সেদিন রাতে মঁসিয়ে রেনাল্ডের সঙ্গে যে মেয়েটি দেখা করেছিল, সে এ নয়। এই অপরাধের সঙ্গেও এই মেয়েটি জড়িত নয়, তোমাকে আমি নিশ্চিত বলতে পারি। ফ্রান্স থেকে বাড়ি পর্যন্ত ট্রেন ভ্রমণে সেদিন সে আমার সঙ্গে ছিল। ভিক্টোরিয়ায় তার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়। সেদিন রাতে তার পক্ষে মারলিনভিলে যাওয়া কোনো মতেই সম্ভব নয়।
–একথা তুমি আদালতে শপথ নিয়ে বলতে পারবে? চিন্তিতভাবে আমার দিকে তাকাল পোয়ারো।
-নির্দ্বিধায়।
-হেস্টিংস, উঠে দাঁড়িয়ে বলল পোয়ারো, তোমার ধারণা খুবই বিস্ময়কর, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি।
.
১৫.
আমার গল্পটা পোয়ারো কতটা বিশ্বাস করল বুঝতে পারছিলাম না। বেলাকে আর কোনো ভাবে অভিযুক্ত করা যায় কিনা তাও বুঝতে পারছিলাম না। তবে পোয়ারো যে নিরস্ত হবে না সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না।
পরদিন সকালে একসঙ্গেই ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসলাম। ওকে জানালাম, একটা কাজে একবার বাইরে যেতে হবে।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো পোয়ারো। বলল, যে খবর জানবার জন্য বাইরে যাবার কথা ভাবছ, যদি জানতে চাও তোমাকে আমি তা জানাতে পারি।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে।
–শোন হেস্টিংস, ডুলসিবেলা বোনেরা কভেন্ট্রি ছেড়ে চলে গেছে। থিয়েটারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেই অজ্ঞাতবাসে যাত্রা করেছে তারা।
-তুমি খবর নিয়েছিলে?
–হ্যাঁ। এবং এটাই সত্য খবর। এছাড়া আর কি করতে পারত তারা?
আমিও তা বুঝতে পারছিলাম। আমার দুর্বলতার সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে পোয়ারোর নাগালের বাইরে সরে পড়েছে সে। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে বিব্রত হতে হবে আমাকেই।
বুঝতে পারছিলাম না, সে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে কিনা। পোয়ারো নিশ্চয়ই কোনো পথ খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে। সেটা তার অতি নম্র সৌজন্যমূলক ব্যবহার দেখেই বুঝতে পারছিলাম।
আপাতঃ শান্ত মূর্তির আড়ালেই সে বেশি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সবদিকে নজর রেখে সতর্ক থাকতে হবে আমাকে।
চোখের কোণে আমাকে লক্ষ্য করে পোয়ারো বলল, তাকে কেন খোঁজ করলাম না নিশ্চয় বুঝতে পারছ হেস্টিংস?
–দয়া দেখিয়েছ।
–আমার জায়গায় তুমি হলে যা করতে আমিও তাই করেছি। ছুটোছুটি করে হয়রান হবার প্রয়োজন দেখি না। বেলা ডুবিনকে যেতে যাও। প্রয়োজন হলে যথাসময়ে নিশ্চয়ই তার খোঁজ পেয়ে যাব।
পোয়ারো অভাবিত ভাবে শান্ত আর নির্লিপ্ত। আমার কাছে যা খুবই অস্বস্তিকর বোধ হতে লাগল।
–তোমার পরিকল্পনার কথা জানতে ইচ্ছে হলেও, আর জিজ্ঞেস করব না। সে অধিকার আমি হারিয়েছি পোয়ারো। মেয়েটিকে আমি পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছি।
-না, বন্ধু, তোমাকে গোপন করার মতো কিছুই নেই আমার। আমরা ফ্রান্সে ফিরে যাচ্ছি।
পোয়ারোর কথা শুনে আমি বিস্ময়াহত। আমাকে পোয়ারো ত্যাগ করেনি, সর্বক্ষেত্রে তার সহচর হবার অধিকার থেকে চ্যুত করেনি আমাকে।
আমার মনোভাব বুঝতে পেরে পোয়ারো বলল, হ্যাঁ, বন্ধু। আমি জানি, তোমার পোয়ারোকে কখনোই ত্যাগ করতে পার না তুমি। তবে ইচ্ছে করলে ইংলন্ডে থেকে যেতে পার তুমি।
জবাবে আমি কেবল মাথা নাড়লাম। আমার চেতনার আলোকে নতুন করে যেন পোয়ারোকে আবিষ্কার করলাম। তবু নিঃসংশয় হতে পারছিলাম না, এমন একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তার বিশ্বাস ফিরে পাব।
তবে যাই ঘটুক আমাকে সতর্ক থাকতে হবে। পোয়ারোর কাছাকাছি থেকে তার গতিবিধির ওপর নজর রাখতে হবে। পোয়ারো যতক্ষণ আছে, বেলা বিপদমুক্ত নয়।
আমি বললাম, তুমি যেভাবে খুশি নিতে পার, সবকাজ আমরা দুজনে মিলেই করতে চাই।
-আমিও একমত, বলল পোয়ারো, তবুও তোমাকে সতর্ক করে দেওয়া আমি কর্তব্য বলে মনে করি।
-তোমাকে আমার শত্রুর ভূমিকা নিতে দেখলে কিছুমাত্র বিচলিত হব না পোয়ারো। তবু আমি
আমাকে বাধা দিয়ে পোয়ারো বলল, তবু তুমি যে কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছ তা নিয়েই সন্তুষ্ট। কিন্তু বন্ধু, আমি আপাততঃ জ্যাক রেনাল্ডকে নিয়েই ভাবতে চাই।
নামটা শুনে মনে হল আমি যেন এতক্ষণ কল্পনার জগতে ছিলাম। এ কেসের বিন্দুমাত্র ছায়া চিন্তার জগত থেকে সরে গিয়েছিল।
জ্যাক রেনাল্ড আমাকে বাস্তবের মাটিতে নিয়ে এল। বেচারা জ্যাক। সে এখন জেলে বন্দি। ফাঁসির সম্ভাবনায় প্রতিটি মুহূর্তে শঙ্কিত হচ্ছে।
এই মুহূর্তে আমার ভূমিকাটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। জ্যাক রেনাল্ড নিরপরাধ। বেলাকে আমি বাঁচাতে পারি, কিন্তু তার বিনিময়ে ওই নিরপরাধ মানুষটির গলায় ফাঁসির দড়ি হয়তো ঝুলিয়ে দিতে হবে।
কিন্তু এমন জঘন্য কাজ আমি কি করে করব? অসম্ভব। যে করেই হোক নিরপরাধ জ্যাক রেনাল্ডকে জেলের দরজার বাইরে মুক্ত আকাশের তলায় বার করে নিয়ে আসতে হবে। যে কোনো মূল্যে।