একসময় শো শেষ হল। দর্শক-শ্রোতার আনন্দোচ্ছ্বাস আর করতালিধ্বনিতে হল মুখরিত হয়ে উঠল।
আমার কেমন অস্বস্তি বোধ হতে লাগল। দমফাটা হৈ-হট্টগোল অসহনীয় হয়ে উঠল। বাইরে গিয়ে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে না পারলে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। পোয়ারোকে রেখে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
আমাদের হোটেলের কাছেই থিয়েটার। ঘরে এসে খানিকটা হুইস্কি নিয়ে বসলাম।
হঠাৎ দরজা ঠেলে ঘরে যে ঢুকল, তার দিকে চোখ পড়তেই লাফিয়ে উঠলাম।
সিনডেরেলা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।
–হলে সামনের সারিতে তোমাকে আর তোমার বন্ধুকে দেখতে পেলাম। এই তোমার সেই গোয়েন্দা বন্ধু? কভেন্ট্রিতে তোমরা কেন এসেছ বলো তো?
থেমে থেমে কথাগুলো বলল মেয়েটি।
মঞ্চের পোশাক তখনো গায়ে চাপানো ছিল। একটা ক্রোক দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। আমি ভাবছি, একটু কি ভয়ার্ত শোনাল তার স্বর? যেজন্য সে ভয় পাচ্ছে নিশ্চয় তা জানে পোয়ারো-বুঝতে পারছি।
কিন্তু আমার সিনডেরেলা…আমার হৃদয়ও তো আকুল হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেবল তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো কথা আমি বলতে পারছি না।
-তোমার গোয়েন্দা বন্ধু কি আমার খোঁজ করছে? অস্ফুটে বলল সে।
আমি তেমনি বাক্যহারা। সে এগিয়ে এসে চেয়ারে বসল, তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
আমি হাঁটু মুড়ে বসে তার দুহাত জড়িয়ে ধরলাম। হৃদয়ের সমস্ত আবেগ জড়ো করে বলতে লাগলাম, কেঁদো না প্রিয়তমা, তোমার কোনো ভয় নেই, আমি তোমাকে রক্ষা করব। সব কিছুই আমি জানি।
কান্না থামিয়ে সে আমার চোখে চোখ রাখল। জল টলটল করছে।
সেদিন তুমিই তো ছুরিটা নিয়ে এসেছিলে? বললাম আমি।
–হ্যাঁ। অস্ফুটে উচ্চারণ করল সে।
–কেন এনেছিলে?
–আমার ভয় ছিল ওটার গায়ে হাতের ছাপ যদি পাওয়া যায়?
–কিন্তু তুমি তো গ্লাভস পরেছিলে। তবু ভয় ছিল?
–তুমি কি আমাকে পুলিসের হাতে দেবে?
–না।
–দেবে না কেন?
–সিনডেরেলা–আমি তোমাকে ভালোবাসি।
কোনোদিন কাউকে ভালোবাসার কথা চিন্তাও করিনি আমি। কিন্তু আজ এই অদ্ভুত পরিবেশ আর পরিস্থিতিতে সেই কথাটাই না জানি কেন না বলে পারলাম না তাকে।
সে মুখ নিচু করল। বিড়বিড় করে বলল, ওহ না। আমাকে ভালোবাসা যায় না–আমার সম্পর্কে কিছুই জান না তুমি
–জানি সবই। সে-রাতে তুমি মঁসিয়ে রেনাল্ডের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে। তোমাকে খুশি করার জন্য তিনি মোটা অঙ্কের একটা চেক দিয়েছিলেন। তুমি ঘৃণাভরে সেটা টুকরো করে ছিঁড়ে ফেল। তারপর তুমি তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আস। জ্যাক রেনাল্ড সমুদ্রযাত্রা না করে ফিরে এসেছিল–সেকথা তুমি জানতে কিনা বলতে পারব না। বিষাদাচ্ছন্ন মনে ফেরার পথে গলফ খেলার মাঠে রাত বারোটা নাগাদ একটি লোককে তোমার চোখে পড়ে। পেছন থেকে দেখলেও তাকে তুমি সম্ভবতঃ চিনতে পেরেছিলে। আগেই জ্যাক রেনাল্ডকে হুমকি দিয়ে একটা চিঠি লিখেছিলে। লোকটাকে সামনে দেখতে পেয়ে পেছন থেকে তুমি তাকে আঘাত করেছিলে। তাকে খুন করেছিলে।
দুহাতে মুখ ঢাকল সে। অস্ফুটে বলতে লাগল, ওহঃ তুমি সব বলেছে।
একটু পরে আমার দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ স্বরে বলে উঠল, আমি খুনী–একথা জেনেও তুমি আমাকে ভালোবাসবে?
-ভালোবাসা বড় অবুঝ সিনডেরেলা। বললাম আমি, জানি না কেন, প্রথম দেখা হওয়ার দিন থেকেই আমি নিজের কাছে বড় অসহায় হয়ে পড়েছি–তোমাকে ভালো না বেসে পারিনি।
আমার কথাগুলোতে কি ছিল জানি না। এমনভাবে হৃদয়ের গভীর আবেগ কখনো কারো কাছে প্রকাশ করিনি।
সিনডেরেলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মুখ ঢাকল। স্খলিত কণ্ঠে বলতে লাগল-ওহ, আমি কি করব…কি করব…কে আমাকে বলে দেবে
-শান্ত হও বেলা, তার চুলে বিলিকেটে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি প্রতিদান চাই না কিছু, কেবল তাকে ভালোবেসে আমাকে সাহায্য কর।
জ্যাক রেনাল্ডকে আমি ভালোবাসি তুমি তাই মনে করো?
ঠোঁটের কোণে হাসবার চেষ্টা করে সে আবার বলল, কিন্তু তোমাকে যেভাবে ভালোবাসি তাকে সেভাবে কখনো ভালোবাসতে পারব না।
বলতে বলতে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল আমাকে। আমার ঠোঁট লিপ্ত হল তার উপর্যুপরি উষ্ণ চুম্বনে। তার আন্তরিক ভালোবাসার বন্য প্রকাশ আমাকে অভিভূত করল।
ঠিক এই সময় দরজার দিকে চোখ পড়তে চমকে উঠলাম। পোয়ারো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে।
–এখুনি এখান থেকে চলে যাও তুমি, আমি ওকে আটকে রাখছি। পোয়ারোকে আমি আগলে রাখলাম। সিনডেরেলা আমাদের পাশ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
–তাকে যেতে দিয়ে ভালোই করলে, বলল পোয়ারো, তবে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। এখন শান্ত হয়ে বসো।
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি তাকে ধরবার চেষ্টা করবে না?
–আমি তো জিরয়েড নই, হেস্টিংস। কিন্তু পুরনো বন্ধুর প্রতি তোমার এই ব্যবহার খুবই অস্বস্তিকর। ফটোগ্রাফ দেখে মেয়েটিকে যে তুমি চিনতে পেরেছ, সেকথা আমাকে বলনি। কিন্তু তুমি জানতে না, আমি জানতাম সেকথা। এখন আমার সামনেই তাকে তুমি পালিয়ে যেতে সাহায্য করলে।
তোমার কাছে একটা কথা আমি জানতে চাই হেস্টিংস, তুমি কি আমার সঙ্গে কাজ করবে না বিরুদ্ধাচরণ করবে?
সংযত কণ্ঠে শান্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো কে করল পোয়ারো। প্রতিটি শব্দ যেন আমার বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হল। পোয়ারো আমার বন্ধু।