যদিও পোয়ারোর বক্তব্য বুঝতে পারছিলাম না, তবুও বললাম হ্যাঁ, মাদাম রেনাল্ডের ছুরি। সেটাকেই দ্বিতীয়বার ভবঘুরে লোকটার বুকে বিধে থাকতে দেখেছি আমরা। ছুরি তাহলে দুটি না একটি?
-অনেক ভাবতে হয়েছে আমাকে ছুরির বিষয়টা নিয়ে। ছুরি দুটি। তবে মালিক একজন জ্যাক রেনাল্ড। অথচ হেস্টিংস, সত্যিকথাটা হল, জ্যাক রেনাল্ডকে অভিযুক্ত করা এক মস্ত বড় ভুল। যদিও জর্জেস কনিউ-এরই ছেলে সে, ছেলে বাপের মতো হবে বংশানুক্রমিক ধারার এমন কথা লোককে বলতে শোনা যায়–কিন্তু
আমি হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলাম, এ আবার কি কথা বলছ তুমি
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে পোয়ারো জানতে চাইল, ক্যালাইনে যাওয়ার জাহাজ কটায় বলতে পার?
–বিকেল পাঁচটায় বলে মনে হয়। বললাম আমি।
–তাহলে এখনো সময় পাওয়া যাবে। একজন সাক্ষীর খোঁজে ইংলন্ড যেতে হবে।
–সাক্ষী? কে সে? জানতে চাইলাম আমি।
রহস্যময় হাসি হেসে পোয়ারো বলল, মিস বেলা ডুবিন। রেনাল্ড পরিবারের সঙ্গে মেয়েটির অবশ্য কোনো সম্পর্ক ছিল না। তবে স্টোনর নামটা শুনেছে। ভুলে যেও না বন্ধু, জ্যাক রেনাল্ড বিত্তবান তার ওপর কুড়ি বছরের যুবক।
একজন তরুণীর প্রেমের পক্ষে আদর্শ পাত্র। মোটা টাকার চেক দিয়ে মেয়েটিকে মঁসিয়ে রেনাল্ড কেনার চেষ্টা করেছিলেন–এই বিষয়টাকে আমি অবহেলা করতে পারি না। যে করে হোক মেয়েটিকে খুঁজে বার করতে হবে।
তোমার মনে থাকার কথা, জ্যাক রেনাল্ডের ঘরে কাগজপত্রের ভেতর থেকে একটা ফোটোগ্রাফ এনেছিলাম, তাতে লেখা ছিল আমার ভালোবাসা জেনো-বেলা। এই যে দেখে রাখো।
কোটের পকেট থেকে ছবিটা বার করে আমার হাতে দিল।
স্তম্ভিত হয়ে গেলাম ছবির মুখটা দেখে– আমার সিনডেরেলা।
.
১৪.
চকিতে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম আমার মুখভাব লক্ষ্য করেনি সে। নির্বিকার মুখে ছবিটা ফিরিয়ে দিলাম।
–চল, এখুনি বেরিয়ে পড়া যাক।
অগত্যা তাড়াহুড়ো করেই বেরিয়ে পড়তে হল।
পোয়ারোর পর্যবেক্ষণ মাথায় ঘুরছিল। সেই সঙ্গে সিনডেরেলা জুড়ল। জাহাজে ওঠার পর এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম।
পোয়ারো সাক্ষী খুঁজতে চলেছে। পোয়ারো কি ভাবছে মেয়েটি জ্যাক রেনাল্ডকে খুনের অবস্থায় দেখেছে?
না কি তাকেই খুনী বলে ভাবছে? কিন্তু তা কি করে সম্ভব? মঁসিয়ে রেনাল্ডকে খুন করার কোনো মোটিভ তার থাকতে পারে না।
কিন্তু মেয়েটি খুনের জায়গায় উপস্থিত হল কি করে? ক্যালাইনে দুজনেই ট্রেন ছেড়েছি। জাহাজে উঠে থাকলে আমার চোখে পড়ত নিশ্চয়। এক হতে পারে যদি ট্রেনে চেপে মারলিনভিলে ফিরে আসে। তাহলে ফ্রাঙ্কেইস যে সময়টা বলেছে, ভিলা জেনেভিয়েভে তার ফিরে আসা সম্ভব হতে পারে।
কিন্তু বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিল রাত দশটার পর…তারপর? এরপর কি সে হোটেলে কিংবা ক্যালাইনে ফিরে গিয়েছিল?
খুনটা হয় মঙ্গলবার। তার সঙ্গে আমার দেখা হয় বৃহস্পতিবার সকালে। আদৌ সে ফ্রান্স ছেড়ে গিয়েছিল বলে আমার মনে হয় না।
মেয়েটি কি জ্যাক রেনাল্ডের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল? কিন্তু আমি তো তাকে বলেছিলাম, জ্যাক ঘটনাস্থলে নেই, বুয়েনস এয়ার্সে চলে গেছে। সম্ভবতঃ সে জানত জ্যাক মারলিনভিলেই রয়েছে…সমুদ্রযাত্রা করেনি। জ্যাকের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কিনা বোঝা যাচ্ছে না। পোয়ারোর সম্ভবতঃ সেটাই জানা উদ্দেশ্য।
এমন হওয়াও অসম্ভব নয় মার্থা উওব্রেয়ুইলের সঙ্গে দেখা করতে এসে বেলা ডুবিনের মুখোমুখি হয়েছিল জ্যাক। অথচ তাকে অবহেলা করেই মার্থা ডওব্রেয়ুইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।
এটা খুবই স্বাভাবিক যে বিত্তবান পরিবারের ছেলে জ্যাক কিছুতেই কপর্দকহীন মেয়েকে নিজের যোগ্য বলে মনে করতে পারে না।
ভাবনাচিন্তার ছাঁকুনি দিয়ে নিজের কর্তব্য নিরূপণ করবার চেষ্টা করছিলাম। পোয়ারোর কথায় সম্বিৎ ফিরল।
–গ্রেপ্তারের খবরটা ইংরাজি কাগজগুলোতে ছাপা হবে আগামী পরশু, পোয়ারো বলল, তার আগেই আমাদের কাজ শেষ করতে হবে।
পোয়ারোর পরিকল্পনা বোঝা দুষ্কর। তাই আমি জানতে চাইলাম, ইংলন্ডের জনারণ্যে কেবল একটি ছবি সম্বল করে মেয়েটিকে খুঁজে বার করবে তুমি?
পোয়ারো হাসল। বলল, থিয়েটারের এজেন্ট সেই জোসেফ অ্যারোসকে নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার? একজন কুস্তিগিরের ব্যাপারে একবার আমাকে সাহায্য করেছিল সে। তার সাহায্যেই মেয়েটিকে খুঁজে বার করব।
.
ফটোগ্রাফ দেখেই মিঃ অ্যারোস বলে উঠল, এতো ডুলসিবেলা বোনেদের একজন। দুই বোনই গায়িকা ও নর্তকী। ঠিক আছে আপনারা আজ চলে যান আমি খবর পাঠিয়ে দেব।
পরদিন সকালেই ভদ্রলোক একটা চিরকূট পাঠিয়ে আমাদের জানাল, ডুলসিবেলা বোনেদের কভেন্ট্রির প্যালেসে পাওয়া যাবে।
সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কভেন্ট্রির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
থিয়েটারে কোনোরকম খোঁজখবর না নিয়ে সেদিনের প্রোগ্রাম দেখে পোয়ারো টিকিট কেটে ফেলল।
শো-এর সর্বশেষ প্রোগ্রাম ছিল ডুলসিবেলা বোনেদের গান ও নাচ।
ঘোষকের ঘোষণা শেষ হতেই দুই বোন মঞ্চে উপস্থিত হল। বুক কাঁপছিল আমার। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলাম।
দেখে দুই বোনকে যমজ বলেই মনে হল। অবশ্য একজনের চুলের রঙ হালকা হলুদ, আরেকজনের ঘন কাল। দুজনেরই মিষ্টি সুন্দর চেহারা। গানের গলাও সুন্দর। গানের সঙ্গে মানানসই নাচও করল তারা।