এরপর মৃতদেহের গায়ের পোশাক বদল করে তার পোশাকগুলো শেডের ভেতরেই কোথাও রেখে দিন মঁসিয়ে রেনাল্ড।
মাদাম রেনান্ডের কাছে জ্যাকের দেওয়া যে ছুরিটা ছিল এরপর সেটা মৃতদেহের পিঠে বিদ্ধ করে খুনটাকে নিখুঁত রূপ দেওয়া হল।
সেই সঙ্গে লোকটার মুখও বিকৃত করে দেওয়া হল। আর সেই রাতেই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মঁসিয়ে রেনাল্ড বাড়ির সংলগ্ন জমিতে একটা কবরও খুঁড়ে ফেললেন। অবশ্য তার আগে বেলা ডুবিনের ব্যাপারটা আছে।
প্রতিবেশিনী মাদাম উওব্রেযুইলের যাতে কোনোরকম সন্দেহ না জাগে সেজন্য রেনাল্ড দম্পতি চেয়েছিলেন ভবঘুরে লোকটির মৃতদেহ যাতে তাদের চোখে পড়ে।
সব ব্যবস্থা হয়ে যাবার পর মঁসিয়ে রেনাল্ড অপেক্ষা করতে থাকেন রাতের অন্ধকারে স্টেশন থেকে বারোটা দশের শেষ ট্রেনটা ধরবেন বলে।
এই অবস্থায় রাতে ভিলায় উপস্থিত হয় বেলা নামে একটি মেয়ে। শেষ ট্রেনটা ধরার তাগিদ ছিল বলে মঁসিয়ে রেনাল্ড কোনো রকমে মেয়েটির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তার সেই মনোভাবই প্রকাশ পায় ওই কথায়, ঠিক আছে…এখন তুমি যাও।
মেয়েটি চলে গেলে ঘরের দরজাটা ইচ্ছে করেই একটু ফাঁক করে ভেজিয়ে রাখেন। উদ্দেশ্য, পরদিন যাতে পুলিস বুঝতে পারে খুনী এই পথেই পালিয়ে গেছে।
এরপরই ঘটল সেই অবিশ্বাস্য ভয়ঙ্কর ঘটনাটা। গলফ লিঙ্কে যখন মঁসিয়ে রেনাল্ড কবর খোঁড়েন সেই সময় অদৃশ্য মহাবিচারকের শেষ আঘাত অলক্ষ্যে নেমে আসে তার ওপর। একটা অজানা হাত পেছন থেকে তার পিঠে ছুরি গেঁথে দিল…।
একটু থেমে পরে পোয়ারো জিজ্ঞেস করল। হেস্টিংস, দুটো খুনের কথা তোমাকে বলেছিলাম, কেন বলেছিলাম এবারে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ?
প্রথম খুন বা অপরাধের তদন্তের জন্য মঁসিয়ে রেনাল্ড আমাকে আগ বাড়িয়ে চিঠি লিখেছিলেন, তার সমাধান পেয়ে গেলে। নিখুঁত পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করবার জন্য যিনি নিজের কবর নিজেই আগে থেকে খুঁড়ে রেখেছিলেন, অদৃশ্য নিয়ন্তার কী নিদারুণ ব্যবস্থা, সেই তিনিই অজ্ঞাত হাতের ছুরিকাঘাতে শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যিই খুন হলেন। হেস্টিংস এমন এক রহস্যময় খুনের ঘটনা যে তার সমাধান বড় সহজ কথা নয়।
–তোমার তুলনা হয় না পোয়ারো। অভিভূত স্বরে বলে উঠলাম আমি, এমন দুরূহ জট মোচন করা তুমি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
–বেচারা জিরয়েডের জন্য দুঃখ হয় আমার, আমার প্রশংসা হজম করে নির্বিকার কণ্ঠে বলল পোয়ারো, সত্যকে জানবার সুযোগ কয়েকবারই পেয়েছে সে বিশেষ করে ছুরির বাঁট থেকে চুলটা নিজের হাতে তুলে এনেছে, তবু আত্মবিশ্বাসের অভাবে সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি।
–হ্যাঁ, ভালো কথা মনে করছ, ওই চুলটা কার ছিল বলে তুমি মনে করো?
–নিঃসন্দেহে মাদাম রেনাল্ডের। ওই একটি বিষয় নিয়েই অপরাধীকে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করতে পারত জিরয়েড। কিন্তু পারেনি সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেনি বলে।
মাদাম রেনান্ডের কথাটা একবার ভেবে দেখ, হেস্টিংস, কী অপরিসীম ধৈর্যের সঙ্গে তিনি নিজেকে ধরে রেখেছেন, তার মনের খবর বাইরের কেউ বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারছে না। তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি তার ছেলে জ্যাক খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে। কেন না তিনি নিশ্চিত ছিলেন, বিদেশে নিরাপদ দূরত্বেই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্যাককে ফিরে আসতে দেখেও তিনি বিচলিত হননি, কেননা তার ধারণা ছিল এ কেসে জ্যাকের জড়িয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
সেকারণেই তিনি তখন বলেছিলেন, এখন তাতে কিছু এসে যায় না। কথাটার অর্থ কেউ উপলব্ধি করতে পারেনি।
মাদাম রেনান্ডের নার্ভের বিস্ময়কর ক্ষমতা স্বীকার না করে উপায় নেই। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জর্জেস কনিউর মৃতদেহ নিজের স্বামী বলে সনাক্ত করতে গিয়ে তিনি যখন দেখতে পান, মৃতদেহটা সত্যি সত্যিই মঁসিয়ে রেনাল্ডের–এটা সত্যিই যে, ওই অভাবনীয় মর্মান্তিক দৃশ্য তিনি সইতে পারেননি, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে তার আচরণে কোনো ভাবে প্রকাশ পায়নি যে তার স্বামী মঁসিয়ে রেনাল্ড ছিলেন অতীতের পলাতক অপরাধী জর্জেস কেনিউ।
উপরন্তু তিনি প্রকারান্তরে প্রকাশ করেন মাদাম ডওব্রেয়ুইল ছিলেন তার স্বামীর রক্ষিতা–মহিলার পক্ষে তার স্বামীকে ব্ল্যাকমেল করা অসম্ভব নয়।
এই অসাধারণ মহিলার প্রশংসা না করে উপায় নেই। কোনো অপরাধীকেও যখন ভালোবাসেন, আন্তরিকভাবেই বাসেন।
পোয়ারোর বিশ্লেষণ আমার কাছে ছিল চমকপ্রদ। রহস্যের জট ছাড়ানোয় কী নিপুণ দক্ষতা তার।
–এবারে তোমার সেই সীসের পাইপের রহস্যটা পরিষ্কার কর। বললাম আমি।
–সেটা ধরতে পারনি? বলল পোয়ারো, মঁসিয়ে রেনাল্ড ভবঘুরের মৃতদেহটাকে নিজের বলে চালাবার মতলবে তার মুখটা বিকৃত করেছিলেন ওই বস্তুটা ব্যবহার করে। অকিঞ্চিৎকর হলেও ব্রুটা ছিল খুবই গুরুত্বপুর্ণ। কিন্তু হাতের কাছে পেয়ে জিরয়েড সেটা কাজে লাগাতে পারেনি। বুঝলে হেস্টিংস, অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে প্রমাণ বা ঘটনা যত সামান্যই হোক না কেন, তার যথাযথ বিশ্লেষণ করতে হয়।
যাইহোক, এবারে গোটা কেসটা নতুন করে আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে। প্রথমে খুঁজে বার করতে হবে, মঁসিয়ে রেনাল্ডকে কে খুন করে থাকতে পারে? এই ব্যক্তিটি কি ভিলার কাছাকাছি থাকে এমন কেউ, মঁসিয়ে রেনাল্ডের মৃত্যু যার স্বার্থ চরিতার্থ করবে? এরকম যে ব্যক্তিটিকে আমরা পাচ্ছি সে হল জ্যাক রেনাল্ড। কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই ছুরিটা ব্যবহার করে কাজটা করেছিল সে।