যে তার প্রিয় স্বামীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে, তাকে বিয়ে করার কথা সে কখনোই ভাবতে পারে না।
মাদাম বেরোণ্ডি কান্নাজুড়ানো গলায় এমন আবগেপূর্ণ ভঙ্গীতে তার কাহিনী ব্যক্ত করেছিল যে অসঙ্গতিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও জুরিরা তা মেনে নিয়েছিল।
গভীর আবেগের সঙ্গে সে আরো বলে যে স্বামীর হত্যাকারী হিসেবে আদালতে প্রথমে জর্জেসের নাম না করার জন্য সে তার অপরাধ স্বীকার করে নিচ্ছে।
তবে সে তার স্বামীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো, তাকে খুন করার কথা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। সে আদালতে সত্য গোপন করার জন্য অপরাধী সত্য কথা; স্বামীর খুনের জন্য সে কখনোই দায়ী নয়।
শেষ পর্যন্ত জুরিদের রায়ে মাদাম বেরোণ্ডি এই মামলায় বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।
জর্জেন্স কনিউকে গত কুড়ি বছরেও পুলিস আর বার করতে পারেনি। মাদাম বেরোণ্ডিও যে তার মেয়েকে নিয়ে কোথায় চলে যায় সেখবরও কেউ জানে না।
.
পোয়ারোর মুখে পুরনো বেরোণ্ডি মামলা শোনার পর বর্তমান কেসটা যেন অনেক স্বচ্ছ হয়ে এলো আমার কাছে। আমি অনেক কিছুই এখন দেখতে পাচ্ছি।
পোয়ারো বলল, এবার তাহলে বল তুমি কি কি দেখতে পাচ্ছ।
-মাদাম ডওব্রেয়ুইলই হল সেই মহিলা জেন বেরোণ্ডি, যে মঁসিয়ে রেনাল্ডকে হত্যা করছে। বললাম আমি।
-তাহলে তুমি বলতে চাইছ, মাদাম বেরোণ্ডিই তার স্বামীকে খুন করেছিল? আদালত তাকে ভুল করেই নির্দোষ ঘোষণা করেছিল?
-আমার মত তাই। কেন, তুমি তা মনে কর না?
–আমিও অবশ্য তোমার সঙ্গে একমত। তবে আইনের চুলচেরা হিসেবে ফেলতে গেলে মাদাম বেরোণ্ডিকে নির্দোষই বলা যায়।
–সেই অপরাধের ক্ষেত্রে হলেও হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে অন্ততঃ নয়।
–অর্থাৎ মাদাম ডওব্রেযুইলই মঁসিয়ে রেনাল্ডকে খুন করেছে। কিন্তু এই খুনের মোটিভ কি? এই ক্ষেত্রে কোনো দিক থেকেই তার লাভবান হবার সম্ভাবনা নেই। আগের কেসের ক্ষেত্রে যেমন ছিল, বিত্তবান প্রেমিক তাকে বিয়ে করার জন্য তার স্বামীর মৃত্যুর অপেক্ষা করেছিল।
-খুনের মোটিভ অর্থ ছাড়া অন্য কিছু কি হতে পারে না? বললাম আমি।
–হতে পারে। যেমন, গভীর আসক্তি বা ঈর্ষা। তাছাড়া মানসিক ভারসাম্য হারালেও খুনী এধরনের অপরাধ করতে পারে। অবশ্য মাদাম ডওব্রেয়ুইলকে বলা যায় সম্পূর্ণ সুস্থ মহিলা।
–গভীর আসক্তি থেকেও এই অপরাধ সংগঠিত হতে পারে। যদি ধরে নেওয়া যায় মাদাম ডওব্রেয়ুইল ছিলেন মঁসিয়ে রেনাল্ডের রক্ষিতা, সেক্ষেত্রে তার প্রতি আকর্ষণ কমে আসছে অনুভব করলে প্রবল ঈর্ষা বা ক্রোধবশতঃ সঁসিয়ে রেনাল্ডকে সে খুন করতে পারে না?
হাসল পোয়ারো। বলল, মাদাম ডওব্রেয়ুইলকে নিয়ে অনেক ভেবেছ তুমি বন্ধু, কিন্তু তার সম্পর্কে আমি বলব, তোমার ধারণা ভুল।
আগের কেসে তার ধীরস্থির বুদ্ধির পরিকল্পনার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। চমৎকার একজন অভিনেত্রীও সে। বিত্তবান আমেরিকানকে পাওয়ার জন্য সে স্বামীর খুনী সেই যুবকটির সঙ্গে নিজেকে জড়ায়নি।
নিজের লাভের কথা মাথায় রেখেই তাকে অপরাধ করতে দেখি আমরা। তাছাড়া, কবর খোঁড়া পুরুষের কাজ, তার পক্ষে তা সম্ভব নয়।
মাদাম রেনাল্ড আর মাদাম বেরোণ্ডি তথা ডওব্রেয়ুইলের জীবনধারা আপাত দৃষ্টিতে একই মনে হলেও এক্ষেত্রে দুজনের ভূমিকা ভিন্ন।
মাদাম ডওব্রেয়ুইল আগে যে কাহিনী শুনিয়েছিল সে কাহিনীরই যদি পুনরাবৃত্তি ঘটত, তাহলে মামলা অত্যন্ত সরল হয়ে যেত। এক্ষেত্রে তা প্রতিফলিত হয়েছে মাদাম রেনাল্ডের কার্যকলাপে।
তাহলে কি তুমি বলবে মঁসিয়ে রেনাল্ডের রক্ষিতার সঙ্গে দৌড়ে তিনিও ছিলেন একজন প্রতিযোগিনী?
-তা আমি মনে করি না। বললাম আমি; তাকে আমি এমন দক্ষ অভিনেত্রী বলে মনে করি না।
হেস্টিংস, তুমি এখানে যুক্তি হারিয়ে ফেলছে। অপরাধ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ভাবাবেগের স্থান নেই, মনে রেখো। একজন অপরাধীর একজন দক্ষ অভিনেত্রী হতে বাধা নেই। কিন্তু তা অপরিহার্যও নয়।
স্বামীর মনোযোগ বা ভালোবাসা পাবার ক্ষেত্রে মাদাম রেনাল্ড প্রতিযোগিনী ছিলেন আমি মনে করি না। কারণগুলো তোমাকে আগেই বলেছি। সেই ছোট্ট ধূসর কোষগুলো নাড়াচাড়া করলে তুমি অনেক তথ্য পেয়ে যাবে।
–পোয়ারো, তুমি আর কি জেনেছ?
–যা যা জানবার জন্য মঁসিয়ে রেনাল্ড আমাকে ডেকে এনেছিলেন, সবই আমি আবিষ্কার করতে পেরেছি।
খুনীকে তুমি জেনেছ?
–হ্যাঁ, একজন খুনীকে আমি জেনেছি। কিন্তু এখানে দুটো খুন। দ্বিতীয় খুনের ব্যাপারে আমি এখনো নিশ্চিত নই।
–কিন্তু তুমি বলেছিলে শেডের লোকটার মৃত্যু স্বাভাবিক।
–তুমি এখনো বুঝতে পারনি দেখছি, হেসে বলল পোয়ারো, খুন না করেও খুনের অপরাধ ঘটানো সম্ভব হয়, দুটি মৃতদেহ দুটি অপরাধের কথাই বলে।
কিছুই মাথায় ঢুকল না আমার। বিহ্বল ভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল পোয়ারো।
–হ্যাঁ, ওই তো জ্যাক রেনাল্ড আসছেন। তাকে আমার বলা ছিল। বলল পোয়ারো।
–আশ্চর্য ঘটনা জানো, বললাম আমি, জ্যাক রেনাল্ড, ঘটনার দিন রাত্রে মারলিনভিলেতেই ছিলেন।
–আমি জানি। মাথা নেড়ে বলল পোয়ারো।
বুঝতে পারলাম, আমার আগেই পোয়ারো স্টেশনে খবর নিয়েছে। জিরয়েডও ব্যাপার জেনে থাকতে পারে।
এই সময় জ্যাক রেনাল্ড ঘরে প্রবেশ করল। সম্ভাষণ জানিয়ে পোয়ারো তাকে বসতে বলল।