ইতিমধ্যে তার জন্মকে কেন্দ্র করে চাঞ্চল্যকর কিছু গুজবও ছড়িয়ে পড়ল। শোনা যায়, একজন রাশিয়ান গ্র্যান্ড ডিউকের অবৈধ কন্যা মাদাম বেরোণ্ডি।
অনেকে এমনও অনুমান করল, কোনো অস্ট্রিয়ান আর্ক-ডিউক তার জন্মদাতা-বাবা–মায়ের অবৈধ মিলনে তার জন্ম।
অসাধারণ রূপ-লাবণ্য, লাস্য এবং জন্ম ইতিহাসের রহস্য সব মিলিয়ে এক তীব্র আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন তিনি।
এক তরুণ উকিল জর্জের্স কনিউ জেনির প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগল। মাঝবয়সী স্বামীর প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেই জেনিও প্রেমের খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছিল।
প্যারিসে মাস তিনেক সময়ের মধ্যে জনৈক আমেরিকান মিঃ হিরাম. পি. ট্রাপও রীতিমত ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে বেরোণ্ডি পরিবারের সঙ্গে।
এমনি যখন অবস্থা, সেই সময় একদিন মাদাম বেরোণ্ডি তার বন্ধুমহলে বলাবলি শুরু করলেন, তিনি স্বামীর জন্য খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কারণ তাঁর স্বামীর হেফাজতে কতকগুলি গোপন রাজনৈতিক কাগজপত্র সে দেখেছে। সেসব নথিতে প্যারিসের কিছু উগ্রপন্থী সদস্যের নাম সে চিনতে পেরেছে। এই নামগুলোই তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। যে কোনো সময় যা কিছু ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা।
দিন কয়েক পরেই মাদাম বেরোণ্ডির আশঙ্কা যথার্থ প্রমাণ হয়ে যায়।
সেদিন পরিবারের রাঁধুনী সকালে বাড়ির দরজায় উপস্থিত হয়ে বিস্মিত হয়ে যায়। সাধারণতঃ মাদাম বেরোণ্ডিই তাকে দরজা খুলে দেন। সেদিন দরজা ছিল ভোলা। তাছাড়া শোবার ঘর থেকে একটা গোঙানির শব্দও তার কানে আসছিল।
অশুভ কিছুর আশঙ্কা করে সে শোবার ঘরে ছুটে যায়। দেখতে পায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাদাম বেরোণ্ডি ঘরের মেঝেয় পড়ে গোঙাচ্ছেন। অর্ধ-অচেতন অবস্থা তার।
বিছানার ওপর বুকে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় মঁসিয়ে বেরোণ্ডির রক্তাপ্লুত দেহ পড়েছিল।
মাদাম বেরোণ্ডি যে ঘটনা ব্যক্ত করেছিল তা হল, মাঝরাতে নিঃশ্বাসের কষ্ট হতে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলে দেখতে পায়, কালো মুখোশপরা দুজন লোক তার মুখ চেপে ধরে দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলছে। সে যাতে চিৎকার করতে না পারে সেজন্য তার মুখে কাপড় গুঁজে দেয়।
মুখে মুখোশ আঁটা থাকা সত্ত্বেও মাদাম বেরোণ্ডি বুঝতে পারে, আততায়ী দুজন রাশিয়ান। তারা তার স্বামীর কাছে গোপন নথিপত্র দাবি করে। তিনি তাদের দাবি মানতে অস্বীকার করলে একজন তার বুকে ছুরি বিঁধিয়ে দেয়।
তার পকেট থেকে চাবি বার করে নিয়ে তারা আলমারি খোলে। সব কাগজপত্র ওখানেই রাখা ছিল। সমস্ত কুড়িয়ে নিয়ে তারা চলে যায়।
বেরোণ্ডি পরিবারের ওপর আঘাতের এই ঘটনা সেই সময় খুবই আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু পুলিস অনেক অনুসন্ধান করেন মুখোশধারী লোকগুলোর কোনো সন্ধান করতে পারেনি।
জনসাধারণ যখন এই ঘটনা প্রায় ভুলতে বসেছে সেই সময় হঠাৎ একদিন স্বামীকে হত্যা করার অপরাধে মাদাম বেরোণ্ডিকে গ্রেপ্তার করল পুলিস।
যথারীতি মামলা আদালতে উঠল। তখনই রহস্যময়ী জেনি বেরোণ্ডির জীবনকাহিনী জনসাধারণ জানতে পারে। জনৈক ফল ব্যবসায়ীকে জেরা করে জানা যায় লায়ন্সের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম।
স্বামীকে হত্যা করার উদ্দেশ্য জানা গেল মিঃ হিরাম. পি. ট্রাপকে জেরা করে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের যথেষ্ট চেষ্টা করা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত সে স্বীকার করতে বাধ্য হল, সে জেনিকে ভালোবাসত।
কিন্তু তাকে বিয়ে করার বাধা স্বরূপ ছিল তার মাঝবয়সী স্বামী মঁসিয়ে বেরোণ্ডি। জেনি তার বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারলে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে ভেবেছিল ট্রাপ।
জেরার জবাবে জেনিও স্বীকার করেছিল, বিত্তবান আমেরিকানকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে সে মঁসিয়ে বেরোণ্ডির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
বিচার চলাকালে জেনি আদালতকে তার বানানো কাহিনী শুনিয়ে গেল। সে কাহিনী সম্পূর্ণ অবাস্তব হলেও অধিকাংশ লোকই তা বিশ্বাস করল। যদিও শেষ পর্যন্ত আদালত মাদাম বেরোণ্ডিকেই অভিযুক্ত করল। আদালতের রায় ছিল, মুখোশধারী দুজন রাশিয়ানই তার স্বামীকে খুন করেছিল। এই হত্যার যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিল মাদাম বেরোণ্ডিও তার প্রেমিক জর্জেস কনিউ।
কনিউকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা জারি হল, কিন্তু তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
মামলার চূড়ান্ত পর্যায়ে প্যারিসে সরকারি উকিলের নামে ডাকে একটি চিঠি এলো। চিঠি লিখেছিল জর্জেস কনিউ–কিন্তু তাতে তার কোনো ঠিকানা দেওয়া ছিল না।
কনিউ তার চিঠিতে স্বীকার করল, সে মাদাম বেরোণ্ডিকে ভালোবাসতো। তার পরামর্শ মতোই সে মঁসিয়ে বেরোণ্ডিকে হত্যা করেছিল।
মাদাম বেরোণ্ডি তাকে বুঝিয়েছিল, স্বামীর অত্যাচার ও নির্যাতনে সে অতিষ্ঠ। তার কবল থেকে মুক্ত হতে পারলে কনিউকে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব হবে।
কনিউ পরে জানতে পেরেছিল, তাকে বিয়ে করার জন্য নয়, বিত্তবান আমেরিকান মিঃ হিরাম. পি. ট্রাপকে বিয়ে করার মতলবেই কনিউকে দিয়ে সে তার স্বামীকে হত্যা করিয়েছিল। জেনি আসলে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।
এই চিঠির জবাবে মাদাম বেরোণ্ডি আদালতে তার নির্দোষিতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে স্পষ্টই স্বীকার করল, যদিও আদালত দুই রাশিয়ানকে তার স্বামীর হত্যাকারী বলে রায় দিয়েছে, আসলে রাশিয়ানদের কাহিনী ছিল তার মনগড়া। জর্জেস কনিউ পাছে তার স্বামীর মতো তাকেও হত্যা করে সেই ভয়ে সে আগে আদালতে তার নাম প্রকাশ করতে চায়নি। তবে স্বামীকে হত্যা করার জন্য তার প্ররোচনার কথা জর্জেস তার চিঠিতে যা উল্লেখ করেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এরকম কোনো বোঝাঁপড়া জর্জেসের সঙ্গে তার হয়নি।