আরো হতে পারে…আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে খুনটা হয়ে থাকতে পারে…তাকেও ছুরিবিদ্ধ করা হয়েছে…অবশ্য পিঠে না-ও হতে পারে…
আমি থ হয়ে পোয়ারোর অত্যদ্ভুত কথা শুনে গেলাম।
-তুমি তো দেখছি হুবহু বর্ণনা দিয়ে গেলে। নিশ্চয় আগে কিছু শুনে থাকবে। অবাক হয়ে বললাম আমি।
-না, বন্ধু, সে সুযোগ আমার ছিল না। সদ্য ট্রেন থেকে নেমেছি। সংবাদটা শুনে তাই প্রথমে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
–তাহলে এতসব জানলে কি করে তুমি?
এবারে মদগর্বী পোয়ারো স্বরূপে ফিরে গেল। বলল, মস্তিষ্কের সেই ধূসর কোষগুলোর ক্রিয়া বন্ধু, আর কিছু না। দ্বিতীয় খুনের সম্ভাবনা তারাই আমাকে জানিয়েছিল। তাহলে চল আর দেরি করে কাজ নেই।
.
ভিলা জেনেভিয়েভের দিকে যেতে যেতে দ্বিতীয় খুনের ঘটনার কথা পোয়ারোকে জানালাম। সব শুনে সে বলল, কিন্তু বলছ একই ছুরি দিয়ে দুটো খুন হয়েছে?
-হ্যাঁ। ব্যাপারটা রহস্যময়। বললাম আমি।
–কিছুই রহস্যময় নয় ভায়া। দুটো ছুরি থাকা অসম্ভব নয়। জ্যাক রেনাল্ড ছুরিগুলো তৈরি করিয়ে একটা হয়তো নিজের ব্যবহারের জন্য রেখে দিয়েছিল।
–কিন্তু সেকথা তো আগে বোঝা যায়নি।
–সবই কি আর বোঝা যায়, উপলব্ধি করে নিতে হয়।
.
শেডে ঢুকে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে পোয়ারোর সর্বপ্রথম নজরে পড়ল পোশাকের দিকে।
-একি, কোট ট্রাউজার-সবই দেখছি বাগানের মালির ব্যবহার করা—
ঠিকই ধরেছেন।
পাশ থেকে জিরয়েড বলে উঠল।
মৃতদেহের কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে পর্যবেক্ষণ করল পোয়ারো।
-নখগুলো লক্ষ্য করেছেন। বলল পোয়ারো।
–হ্যাঁ। চোখে পড়েছে সবই। বলল জিরয়েড।
–ডাঃ ডুরান্ড। কঠিন মুখে ডাকল পোয়ারো।
সাড়া দিয়ে এগিয়ে গেলেন ডাক্তার।
-মৃতব্যক্তির মুখে গাঁজলা লক্ষ্য করেছেন?
ডাক্তার স্বীকার করলেন তিনি লক্ষ্য করেননি।
–তাহলে এবারে দেখে কি মনে হচ্ছে? উঁহুমৃত্যু ছুরির আঘাতে হয়নি। পোশাকেও রক্তের দাগ নেই
ছুরির ফলাটাও সামান্য বেঁধানো—
হ্যাঁ, মঁসিয়ে খুবই অস্বাভাবিক।
-না, মঁসিয়ে ডুরান্ড, অস্বাভাবিক মোটেও নয়। লোকটিকে মৃত্যুর পরে ছুরি মারা হয়েছে
–আমার সঙ্গে নিশ্চয় আপনি একমত হবেন?
–হ্যাঁ, মঁসিয়ে আমি একমত।
-মৃত্যুর পরে ছুরি বেঁধানো–এ তো অদ্ভুত ব্যাপার, বলে উঠলেন মঁসিয়ে হয়টেট, এমন ঘটনা তো আগে শোনা যায়নি।
–খুবই ঠান্ডা মাথার কাজ বোঝা যাচ্ছে। পুলিসকে বিভ্রান্ত করার পরিকল্পনা।
–তাহলে এই লোকটা খুন হল কি করে? চিন্তিতভাবে জানতে চাইলেন কমিশনার।
-খুন নয় মঁসিয়ে। যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে তাহলে বলব, লোকটা মৃগীরোগে মারা গেছে।
সকলের মুখেই বিস্ময়সূচক শব্দ ধ্বনিত হল। ডাঃ ডুরান্ড এগিয়ে গিয়ে আবার মৃতদেহ পরীক্ষা করেন।
পরে সরে এসে পোয়ারোকে সমর্থন জানিয়ে বললেন, আপনার অনুমানই ঠিক সঁসিয়ে পোয়ারো। ছুরিকাঘাতের কথাটা মাথায় ছিল বলে মৃত্যুর অন্য লক্ষণগুলো আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি।
পোয়ারো সগর্বে মাথা উঁচিয়ে উপস্থিত সকলের ওপর চোখ বুলিয়ে নিল। তার চমকপ্রদ পর্যবেক্ষণ সকলেরই চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে।
জিরয়েড এগিয়ে এলো। সংযত কণ্ঠে বলল, আর একটা বিষয় মঁসিয়ে, এই কাল লম্বা চুলটা ছুরির বাঁটে পাওয়া গেছে–কোনো মহিলার চুল।
-ওহ, মহিলার চুল, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল পোয়ারো-ভাবনার বিষয়ই বটে।
আর কোনো কথা না বলে শেড থেকে বেরিয়ে এলো পোয়ারো। হোটেলের দিকে রওনা হলাম আমরা।
-বুঝলে হেস্টিংস, জিরয়েড লোকটা মহা তাঁদড়। একটি মহিলার চুল তুলে ধরে আমাকে ভুল পথে নিয়ে যাবার তাল করছিল।
.
মধ্যাহ্ন ভোজের পরে দুজনে বসার ঘরে আরাম করে বসেছি। হোটেলে ফিরে আসার পর থেকে নিজের মনেই ডুবে আছে পোয়ারো। অথচ ওর প্যারিস ভ্রমণের খবর শোনার জন্য আমি ছটফট করছিলাম। এবারে সে প্রসঙ্গ না তুলে আর পারা গেল না।
পোয়ারো নড়েচড়ে বসল। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল।
–আমার হঠাৎ করে প্যারিসে চলে যাওয়াটা তোমার কাছে রহস্যময় হয়ে আছে বুঝতে পারছি। কিন্তু নিজে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে কিছু বলার উপায়ও ছিল না।
প্যারিস কেন গিয়েছিলাম জান? এই যে–এটার জন্য
পকেট থেকে একটা ছোট খাম বার করে আনল পোয়ারো। খামের মুখ খুলে ভেতর থেকে খবর কাগজের রঙচটা একটা কাটিং বার করে আমার হাতে তুলে দিল।
কাটিং-এ একটি মহিলার মুখের ছবি ছাপা ছিল। সেই ছবির দিকে তাকিয়ে আমি সবিস্ময়ে বলে উঠলাম, একি, এতো মাদাম ডওব্রেয়ুইল।
মৃদু হেসে মাথা নাড়ল পোয়ারো।
বেরোণ্ডি কেসের কথা আমার মুখে হয়তো শুনে থাকবে। ইনিই হলেন সেই কুখ্যাত মাদাম বেরোণ্ডি। সেই দিনগুলোতে এই ছবির মহিলা এই নামেই পরিচিত ছিলেন। এই কেসের সুবাদে বেরোণ্ডি কেস এখন আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়ে গেল।
এরপর বেরোণ্ডি মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ শোনা গেল পোয়ারোর কাছ থেকে।
বেরোণ্ডি কেস
বছর কুড়ি আগে লায়ন্স থেকে মঁসিয়ে বেরোণ্ডি তার সুন্দরী স্ত্রী এবং ছোট্ট একটি মেয়েকে নিয়ে প্যারিসে এসেছিলেন। ছোট একটি মদ তৈরির প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র পার্টনার হিসেবে তার রোজগার যা ছিল তাতে আধুনিক ফ্যাসানের বিলাসী জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ভালোভাবেই উপভোগ করতে পারছিল পরিবারটি।
মঁসিয়ে বেরোণ্ডির সুন্দরী স্ত্রী অল্পসময়ের মধ্যেই সমাজের উঁচু হলে রোমান্সের ক্ষেত্রে রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করল।