মাদাম রেনাল্ডের পর জ্যাক রেনাল্ডকে ডেকে দেখানো হল। সে-ও মৃতদেহ সনাক্ত করতে পারল না।
মাদাম ডওব্রেইল এলেন তার পরে। তিনি তো রেগে খাপ্পা।
–এসব কি ছেলেখেলা হচ্ছে মঁসিয়ে। খুনের ঘটনার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
–ধৈর্য হারাবেন না মাদাম, কর্কশ শোনাল জিরয়েডে স্বর, তদন্তে আমি যা জেনেছি…তা হলো দুটো খুনই আপনি করেছেন।
–আপনি আমাকে অপমান করছেন, চিৎকার করে উঠলেন ডওব্রেয়ুইল, এ অত্যন্ত অন্যায়।
ছুরির হাতল থেকে কালো লম্বা চুলটা এবারে টেনে তুলল জিরয়েড।
-এটা নিশ্চয়ই চিনতে ভুল করবেন না। মাদাম, সুযোগ পেলে এটা আপনার কিনা আমি প্রমাণ করে দেখাতে পারব।
–এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা, আমি কোনো অপরাধের বিষয়েই কিছু জানি না। তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠলেন মাদাম ডওব্রেয়ুইল।
–অপরাধের বিষয়ে আপনাকে এখনো কেউ অভিযুক্ত করেনি মাদাম। আপনি এবারে শান্ত হয়ে আমার কথার জবাব দিন। মৃত লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখুন তো তাকে চিনতে পারেন কি না?
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মৃতদেহের দিকে তাকালেন ডওব্রেয়ুইল। জিরয়েডের দিকে চোখ তুলে সহজকণ্ঠে বললেন, না, একে কখনো দেখিনি।
যথেষ্ট ধন্যবাদ।
মাদাম ডওব্রেয়ুইল দ্রুতপদে প্রস্থান করলেন।
আমাকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে জিরয়েড বলে উঠল, আপাততঃ মহিলাকে গ্রেপ্তার না করে নজরে রাখাই আমার ইচ্ছা। লোকটাকে কি মনে হয় আপনার, স্প্যানিশ?
–না, ফরাসি বলেই মনে হচ্ছে। জবাব দিলাম আমি।
এই সময় বাইরে অনেক মানুষের গলা পাওয়া গেল। একে একে ঘরে ঢুকলেন ম্যাজিস্ট্রেট মঁসিয়ে হয়টেট, তার কেরানী এবং কমিশনার মঁসিয়ে রেক্স।
-আমরা কেসের গভীরে যেতে পারিনি মঁসিয়ে জিরয়েড, তা না হলে দ্বিতীয় খুনের আভাস পাওয়া যেত। লোকটিকে সনাক্ত করা গেছে? বললেন ম্যাজিস্ট্রেট।
–কেউ চিনতে পারেনি, জিরয়েড বলল, আপনারা একবার দেখুন।
সকলে ঘরের কোণে গিয়ে মৃতদেহের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালেন।
গতকালের চুরি যাওয়া ছুরিটাই লোকটির বুকে বিদ্ধ করা হয়েছে। খুনী কোনো হাতের ছাপ রেখে যায়নি, বলল জিরয়েড, খুবই রহস্যময় কেস
ডাঃ ডুরান্ড মৃতদেহ পরীক্ষা করতে থাকেন। সকলের দৃষ্টি তার দিকে। ডাঃ সরে এসে জানালেন, আমি নিশ্চিত, লোকটি কম করেও আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে মারা গেছে।
জিরয়েডের চোয়াল ঝুলে পড়ল। আমরা সকলে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে রইলাম।
.
০৯.
আমরা বিস্ময়ে স্তব্ধ হতবাক হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। ডাক্তারের কথায় গোটা ব্যাপারটা আরও রহস্যময় হয়ে উঠল।
ছুরিটা চুরি গেছে চব্বিশ ঘণ্টা আগে, তাহলে আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে সেই ছুরি লোকটির বুকে বিদ্ধ হয় কি করে? বিস্ময়কর এই ব্যাপারটা যখন সকলকে চিন্তাক্লিষ্ট করে তুলেছে, সেই সময় পোয়ারোর তারবার্তা হোটেলের লোক আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেল।
পোয়ারো জানিয়েছে বারোটা আঠাশে মারলিনভিল স্টেশনে পৌঁছচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি স্টেশনের দিকে রওনা হলাম।
স্টেশনে পৌঁছে জানা গেল ট্রেন লেটে আসছে। খানিকটা সময় হাতে পেয়ে স্টেশনের কয়েকজন পোর্টারের সঙ্গে কথা বললাম। দুর্ঘটনার রাত্রে শেষ ট্রেনে স্টেশন ছাড়তে কোনো যাত্রীকে তারা দেখেছে কিনা জানতে চাইলাম।
পোর্টারদের প্রধান জানাল, সে-রাতে শেষ ট্রেনে জনাকুড়ি যাত্রী মারলিনভিল স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেছিল। তাদের মধ্যে দুজন বিদেশীও ছিল।
খবরটা পেয়েও ঠিক স্বস্তি পেলাম না। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, তরুণ মঁসিয়ে রেনাল্ড সে-রাতে ট্রেন ধরতে পেরেছিলেন তো?
–সেকি বলছেন সিয়ে? সেই দিনই মাত্র আধঘন্টা আগে তিনি পৌঁছেছেন, তারপর আর শেষ ট্রেন ধরা যায় কখনো?
-ওহো, দুর্ঘটনার রাত্রেই তাহলে জ্যাক রেনাল্ড মারলিনভিলেয় পৌঁছেছিলেন?
–হ্যাঁ, মঁসিয়ে। অন্য পথের শেষ ট্রেনটা পৌঁছেছিল এগারোটা চল্লিশে।
এই সংবাদে একটা ব্যাপার আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। দুর্ঘটনার রাতে জ্যাক রেনাল্ড মারলিনভিলেয় ছিল, সেই কারণেই তাকে নিয়ে মার্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
কিন্তু জ্যাক একথা স্বীকার না করে চেরবুর্গে থাকার কথা আমাদের বলেছিল কেন? কিন্তু এই খুনের ঘটনার সঙ্গে তার কোনো যোগ আছে, এমন কথাও ভাবা যাচ্ছে না।
মার্থা জ্যাকের জন্য উদ্বিগ্ন, কাউকে সন্দেহ করা হচ্ছে কিনা পোয়ারোকে ডেকে ও জানতে চেয়েছিল…তার মানে বোঝা যাচ্ছে, সব ঘটনার কথাই মার্থা জানে। তা না হলে এমন উদ্বিগ্ন কেন হবে?
একটু পরেই ট্রেন স্টেশনে ঢুকল। চিন্তাভারাক্রান্ত মাথা নিয়েই পোয়ারোকে অভ্যর্থনা জানালাম।
ট্রেন থেকে নেমে আমার প্রশ্ন করার আগেই পোয়ারো বলল, আমার অভিযান সম্পূর্ণ সফল হেস্টিংস।
–নিঃসন্দেহে আনন্দ সংবাদ। এদিককার খবর যে
আমাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, কি জিরয়েড কাউকে গ্রেপ্তার করেছে? লোকটা যে একটা গণ্ডমূর্খ আমি প্রমাণ করে ছাড়ব।
-শোন পোয়ারো, খুব খারাপ খবর। ভিলায় আর একটা খুন হয়েছে। আমাদের সেখানে যেতে হবে।
পোয়ারোর চোখ নিষ্প্রভ হয়ে গেল। চোয়াল ঝুলে পড়ল। বিহ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
–আর একটা খুন, বিড়বিড় করে বলল পোয়ারো, আমার সব ধারণাই কি তবে ভুল হল…হ্যাঁ, অসম্ভব নয় যদি…আচ্ছা হেস্টিংস, নিহত লোকটি কি মাঝবয়সী? তালাবন্ধ শেডের ভেতরেই মৃতদেহটা পাওয়া গেছে?