একজন পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। পুরুষ সঙ্গীটি জ্যাক রেনাল্ড।
–তাহলে বলছ, আর কোনো বাধা নেই, বলল মার্থা।
–প্রিয়তমা, তুমি কি বুঝতে পারছ না? আমাদের মিলতে বাধা দেবার আর কেউ নেই।
–ওঃ জ্যাক–কিন্তু আমার বড় ভয় করছে যে
পাতার আড়াল থেকে নজরে পড়ল–ওরা দুজন আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় পরস্পরকে নিরীক্ষণ করছে।
–আর কেন মিছে ভয় প্রিয়তমা?
–ভয় আমার তোমার জন্যে প্রিয়
থেমে থেমে আবেগজড়িত কণ্ঠে উচ্চারণ করল মার্থা।
আর কিছু শোনা সম্ভব হল না। একজোড়া পায়ের শব্দ কানে এলো। আমি সেখান থেকে সরে এলাম।
অপ্রত্যাশিতভাবেই দেখা পেয়ে গেলাম জিরয়েডের।
–আপনি এখানে? বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম।
-আপনি যে কারণে, জিরয়েড বলল, কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা আমার কানে এসেছে। তা আপনার সেই প্রাচীন বন্ধুটি কোথায়? প্যারিসে খুনীর সন্ধানে নাকি? শ্লেষ মিশ্রিত স্বরে বলল জিরয়েড।
কথা শেষ করে পেছন ফিরে চলে গেল সে। আমিও হাজারো জট মাথায় নিয়ে হোটলে ফিরে এলাম।
.
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলেই সাংঘাতিক খবরটা পেলাম। ভিলা জেনেভিয়েভে আর একটা খুন হয়েছে। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে দুঃসংবাদটা।
ব্রেকফাস্ট শেষ করা হল না। তখনই ছুটতে হল ভিলার দিকে।
পোয়ারো এখানে নেই। এর মধ্যে কে খুন হয়ে গেল? আমাকে ও বলে গিয়েছিল ভিলার লোকজনের ওপর নজর রাখতে।
গেট খুলে ভেতরে ঢুকেই চাকরবাকরদের জটলা চোখে পড়ল। ফাঙ্কেইসকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি শুনছি এসব?
-হ্যাঁ মঁসিয়ে। সাংঘাতিক ব্যাপার, ফ্রাঙ্কেইস হাত-পা ছুঁড়ে বলতে লাগল, আর একজন খুন হয়েছে।
-কে খুন হলো?
–তা বলতে পারব না মঁসিয়ে। অজানা একজন লোককে শেডের মধ্যে পাওয়া গেছে। মঁসিয়ের মৃতদেহের মাত্র একশোগজ দূরে। বুকে ছুরি বিধিয়ে মারা হয়েছে।
.
০৮.
দ্রুতপদক্ষেপে শেডে চলে এলাম। প্রবল উত্তেজনায় বুক কাঁপছে আমার।
পকেট টর্চ জ্বেলে মেঝের চারপাশ পর্যবেক্ষণ করলাম।
মঁসিয়ে জিরয়েড এককোণে টর্চের আলো ফেলল। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম সটান পড়ে আছে মৃতদেহ।
মাঝারি উচ্চতার মাঝবয়সী মানুষ, গায়ের রঙ ময়লা। পরনে নীল রঙের দামি কিন্তু পুরনো স্যুট। মুখে আতঙ্কের ছাপ।
বুকের ডানদিকে যে ছুরিটা বিদ্ধ হয়ে আছে–দেখে আগের দিনের খোয়া যাওয়া ছুরিটার কথা আমার মনে পড়ে গেল।
–উনি ফিরলেন?
ঠাট্টার সুরে জানতে চাইল জিরয়েড।
আমি প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কখন খুন হল?
–ডাক্তারের অভিমত আমি জানি না। আমার বিশ্বাস অন্তত বারো ঘন্টা আগে মৃত্যু হয়েছে। আপনি ছুরিটা কখন শেষ দেখেছিলেন?
গতকাল সকাল দশটা হবে।
–সকাল দশটা। তাহলে খুনটা খুব একটা পরে হয়নি।
–কিন্তু এই শেডের ভেতরে
–চমৎকার! মৃতদেহ তাহলে কি পর্যবেক্ষণ করলেন? এই আপনার গোয়েন্দাগিরি? পা-দুটো কেমন জড়ো করা দেখেছেন? হৃদপিণ্ডে ছুরিকাঘাত হলে কেউ এভাবে পড়ে থাকে না। আর হাত দুটোও কেমন দুপাশে ছড়িয়ে আছে–এসব অস্বাভাবিক নয়? আর ওই দিকে তাকিয়ে দেখুন
জিরয়েড শেডের কোণায় টর্চের আলো ফেলল। একরাশ ধুলো পড়ে আছে মেঝের ওপর। দেখেই বোঝা যায় লোকটাকে বাইরে থেকে টেনে নিয়ে আসা হয়েছে।
ছুরিকাঘাতের পরে নিয়ে আসা হয়েছে–দুজন লোক—
হ্যাঁ, বলল জিরয়েড, একজন স্ত্রীলোক। পায়ের ছাপ মুছে ফেলার চেষ্টা হলেও দু-একটা জুতোর ছাপ রয়ে গেছে।
মৃতদেহে বিদ্ধ ছুরির গা থেকে মেয়েদের একটা লম্বা চুল টেনে তুলে আবার বলল–এটাও সেকথা বলে।
মনে পড়ল, ঠিক এরকম একটা চুল পোয়ারো পড়ার ঘরের চেয়ারে পিঠ থেকে সংগ্রহ করেছিল।
লোকটার হাতের নখগুলোর দিকে তাকিয়ে কি মনে হয়? বলল জিরয়েড।
স্বীকার করতে হল নজর আছে বটে তার। কেন না মৃতলোকটির হাতের নখগুলো ভাঙ্গা এবং বিবর্ণ চামড়াও রুক্ষ।
-ওই হাত কোনো ভদ্রলোকের হাত হতে পারে না, বলে চলল জিরয়েড, অথচ গায়ে দেখুন দামী সুট। বিসদৃশ নয়?
–খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। আমি বললাম।
–পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, লোকটা পরিচয় গোপন করে এসেছিল। কিন্তু উদ্দেশ্য কি? এব্যাপারে এখনো কিছু জানা সম্ভব হয়নি। তবে সে যে নিজের পরিচয় গোপন করতে চেয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আরো মজা হল, এবারেও খুনী আগের মতই হাতে গ্লাভস পরে কোনো রকম ক্লু না রেখেই কাজ সমাধা করেছে।
–দুটি খুন একই ব্যক্তির বলে আপনি সন্দেহ করছেন? জানতে চাইলাম আমি।
–আমার ভাবনা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, আমরা এবার মারকয়ডের সঙ্গে দেখা করব। বলতে বলতেই দরজার সামনে ডি. ভিলা মারকয়ডকে দেখা গেল। জিরয়েড তাকে বলল, মাদাম রেনাল্ডকে ডেকে নিয়ে আসার জন্য। একটু পরেই সে মাদামকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো।
টর্চের আলো ধরে মৃতদেহের কাছাকাছি নিয়ে এলো জিরয়েড তাকে।
-এই যে দেখুন মাদাম, লোকটাকে চিনতে পারছেন আপনি?
মৃতদেহ দেখে কোনো প্রতিক্রিয়াই প্রকাশ পেল না মাদাম রেনাল্ডের মুখে। নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, এই লোককে জীবনে কখনো দেখিনি–বহিরাগত।
–সে-রাতে যে দুজন লোক আপনাকে আক্রমণ করেছিল, এই লোকটি কি তাদের মধ্যে ছিল? ভালো করে দেখে বলুন।
-না, মঁসিয়ে, আমি নিশ্চিত, এই লোক তাদের মধ্যে ছিল না।
–বেশ, ধন্যবাদ, মাদাম।