সব রকম বিরোধিতা এড়িয়ে থেকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার কথা জানিয়েছিল আমাকে। আমি তার পরামর্শ মেনে নিয়েছিলাম।
–মঁসিয়ে রেনাল্ড, আপনার বাবার এই চিঠিটা পাওয়া গেছে–আপনি পড়ে বলুন কে এই চিঠি তাকে লিখতে পারে।
কোটের পকেট থেকে চিঠিটা বার করে তিনি এগিয়ে দিলেন। জ্যাক চিঠিটা পড়ে ফেরত দিয়ে বলল, না, এসম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।
আর একটা কথা, সঁসিয়ে রেনাল্ড, আপনি যুদ্ধের স্মারক হিসেবে আপনার মাকে একটা ছুরি উপহার দিয়েছিলেন। আপনি বেদনা পাবেন জেনেও বলতে হচ্ছে খুনী সেই ছুরি দিয়েই মঁসিয়ে রেনাল্ডকে হত্যা করেছে।
মুহূর্তে জ্যাকের মুখ ব্লটিংপেপারের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেল। শুষ্ককণ্ঠে বলল, সেটা তো একটা কাগজ-কাটা ছুরি–ছুরিটা কোথায়? আমি সেটা দেখতে চাই।
ম্যাজিস্ট্রেট মঁসিয়ে রেক্সকে অনুরোধ জানালেন শেড থেকে ছুরিটা নিয়ে আসার জন্য। কমিশনার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
আমরা অপেক্ষা করেত লাগলাম। মিনিট দুয়েক পরেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন কমিশনার।
-মঁসিয়ে জর্জ–সেই ছুরিটা কাচের ট্রেতে নেই।
–অসম্ভব, আমি বলে উঠলাম, আজ সকালেই সেটা আমি দেখে এসেছি—
অবশিষ্ট কথা আমার গলায় আটকে গেল।
–আপনি দেখে এসেছেন, চাবি পেলেন কোথায়?
নিজেকে খুবই অপরাধী বোধ হতে লাগল। সব কথাই অকপটে খুলে জানালাম আমি। ম্যাজিস্ট্রেটের মৃদু ভর্ৎসনাও আমাকে কৃতকর্মের জন্য শুনতে হল। তবে তিনি প্রসঙ্গটা হাল্কা করে দিলেন রোমান্টিক রসিকতার প্রলেপ দিয়ে।
–তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আপনার বান্ধবীকে এগিয়ে দিয়ে এসে শেডের দরজায় তালা লাগাতে কুড়ি মিনিট অন্ততঃ খোলা ছিল ঘরটা–খুবই শোচনীয় ব্যাপার।
-হত্যাকারী বা হত্যাকারীর সহযোগী আশপাশেই ছিল ছুরিটা পুনরুদ্ধারে জন্য। ছুরির বাঁটে হাতের ছাপ পাওয়া যেতে পারে, নিশ্চয়ই এই ভয় ছিল। বললেন কমিশনার।
পোয়ারো বলে উঠলো, আপনি তো বলেছিলেন, ছুরির ওপর কোনো হাতের ছাপ ছিল না।
জিরয়েড বললেন, সম্ভবতঃ সে নিশ্চিত ছিল না।
-খুনী হাতে গ্লাভস পরে ছিল, কাজেই সে নিশ্চিত ছিল বলা যায়। বলল পোয়ারো।
–আমি বলছি খুনীর সহযোগীর কথা। বললেন জিরয়েড।
–আপাততঃ আমাদের তদন্তের কাজ এখানেই শেষ হল। ঘোষণা করলেন মঁসিয়ে হয়টেট, মঁসিয়ে জিরয়েডের হাতেই আমরা কেসের দায়িত্ব তুলে দিলাম। আশা করি তিনি তাঁর দক্ষতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারবেন, খুনীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে পারবেন। মাদাম, আপনাকে আমার আন্তরিক সহানুভূতি জানাচ্ছি।
ম্যাজিস্ট্রেটের কেরানী টেবিলের কাগজপত্র গুছিয়ে নিলেন। তারপর কমিশনারসহ তিনজনে প্রস্থান করলেন।
–চল বন্ধু, আমরাও তাহলে হোটেলে ফিরে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিই।
বলে আমার হাত ধরে উঠে পড়ল পোয়ারো।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পোয়ারো উদ্ভট কাণ্ড করল। হলের কোণায় হ্যাঁঙ্গারে একটা ওভারকোট ঝোলানো ছিল। মিঃ স্টোনার কিংবা জ্যাক রেনাল্ডেরই হবে। হঠাৎ ভেতরে ঢুকে পোয়ারো কোটের মাপ নিয়ে একটা কাগজে টুকে নিল।
কাজটা আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকলেও দেখলাম, পোয়ারোর মুখে তৃপ্তির হাসি। বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, চল, এবারে যাওয়া যাক।
২. হোটেলের পথে চলতে চলতে
০৬.
হোটেলের পথে চলতে চলতে পোয়ারো বলল, হেস্টিংস, আজ সকালে যা যা ঘটলো, আমাকে সব খুলে বল।
-মাদাম রেনাল্ডের কথাই মাথায় ঘুরছে। তার স্বামী যে ছেলেকে একটা রহস্যময় সমুদ্রযাত্রায় পাঠাচ্ছেন, মনে হচ্ছে এবিষয়টা তার অজানা ছিল না। খুনের কারণটাও সম্ভবতঃ তিনি জানেন–কিন্তু কি এক অজ্ঞাতকারণে গোপন করে যাচ্ছেন। বললাম আমি।
-তুমি ঠিকই অনুমান করেছে, মাথা নেড়ে সমর্থন জানাল পোয়ারো, আমি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছি মাদাম রেনাল্ড কিছু গোপন করতে চাইছেন। খুনের ব্যাপারে তার ওপরেই প্রথম সন্দেহ পড়েছিল আমার।
-তুমি ওঁকে সন্দেহ করেছিলে?
-হ্যাঁ, উইলের শর্ত একমাত্র তারই অনুকূল ছিল। এই কারণেই আমি তাঁর কব্জি পরীক্ষা করে দেখি। নিশ্চিত হই তিনি নিজেই দড়ি দিয়ে হাত বাঁধেননি।
তারপর তিনি মুখোশপরা লোকের যে কাহিনী শোনান, তা আমার পরিচিত। ওসব আগেই আমি শুনেছি কিংবা পড়েছি কোথাও।
সেই কব্জিঘড়ির কথাটা মনে কর, তিনি যা বললেন তা সত্যি ছিল না।
–তোমার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না পোয়ারো। তুমি পরিষ্কার করে বলো।
–বেশ, তাহলে ভেঙ্গেই বলছি। খুনের ঘটনাটা কখন ঘটেছিল বলে তোমার মনে হয়?
-মাদাম রেনাল্ড তো বললেন, ঘড়িতে সেই সময় দুবার ঘণ্টা বেজেছিল–মানে রাত দুটো
-আশ্চর্য ব্যাপার হলো, তার এই বক্তব্য সবাই বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমি জানি তিনি মিথ্যা কথা বলেছিলেন। ঘটনা ঘটেছিল আরো দুঘণ্টা আগে। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি ঘড়িটার কাচ ভাঙ্গলেও বিকল হয়নি। নির্দিষ্ট কোনো কারণেই কেউ ঘড়ির কাঁটা দুটো স্তব্ধ করে দিয়েছিল। মাদাম রেনাল্ড ব্যাপারটা জানতেন বলেই আমার বিশ্বাস।
-সেই কারণটা কি হতে পারে?
–তা এখনো আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। তবে একটা সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাচ্ছি। মারলিনভিল স্টেশন থেকে শেষ ট্রেনটা রাত বারোটা সতেরোয় ছেড়ে যায়–একথাই আমি ভাবছি।
–বুঝতে পারছি, বললাম আমি, তুমি বলতে চাইছ, সেই ট্রেনে কেউ চলে গেছে আর ঘড়ির দুঘণ্টা পরের সময়টাই তার অ্যালিবাই।