-ভদ্রমহিলা নিজের হাতে চুরির কাজটা যদি নাও করে থাকেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত–আপনার কি এরকম সন্দেহ হচ্ছে না?
সচকিত হলেন স্যার জর্জ। সরাসরি পোয়ারোর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আমি বুঝতে পারছি না, উনি এগুলো চুরি করবেন কেন? কার কি স্বার্থ এতে উদ্ধার হতে পারে?
বেশ কৌতুকের সঙ্গে স্যার জর্জকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন পোয়ারো। তারপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, কিছুক্ষণ আগেই আলোচনার সময় বলেছি, নক্সাগুলোর আর্থিক মূল্য যথেষ্ট এবং এগুলোর বিনিময়ে প্রচুর অর্থাগমের সম্ভাবনা। তাহলে অর্থনৈতিক অনটন মেটাবার জন্য কেউ
দেখুন, মিঃ পোয়ারো, তেমন যদি মনে করেন, তাহলে বলব, আজকের দিনে, কার না অর্থের প্রয়োজন? কমবেশি অভাবগ্রস্ত সকলেই।
পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়ে বললেন, আপনার ক্ষেত্রেও কথাটা স্বীকার্য বলে মনে করছি স্যার জর্জ।
–আমার ক্ষেত্রে–মানে আমি তো অভাবগ্রস্ত নই।
-নন কেন? অভাব আপনারও আছে, মসৃণ গলায় বললেন পোয়ারো, আপনার অবস্থায় উপযুক্ত সাংসারিক খরচ-খরচা একটা বিরাট ব্যাপার। তার ওপর আছে যুবক ছেলের একটা বাড়তি খরচের টান–
-ওঃ, আর্তনাদের মত শব্দ করলেন স্যার জর্জ, পড়াশোনার খরচই বিরাট। তার ওপরে এই বয়সে-যাবতীয় হাতখরচাও টানতে হয় আমাকে
সাংসারিক অভাব অনটন খরচখরচার ব্যাপারে বলার সুযোগ পেয়ে স্যার জর্জ তাঁর মনের সঞ্চিত ক্ষোভ অভিযোগ, দাবি-দাওয়া সব কিছু অকপটে প্রকাশ করে গেলেন। বর্তমান সমাজ-পরিস্থিতি, যুবসমাজ, মায়েদের সন্তানের প্রতি প্রশ্রয় ও শাসনের অভাব, তার ক্ষোভ অভিযোগ সব কিছুতেই স্পর্শ করল।
তাঁর এই স্বাভাবিক অকপট মানসিকতার প্রশংসা মনে মনে করলেন পোয়ারো। যদিও বিষয়টা তাদের আলোচ্য বিষয়ের বাইরের হয়ে পড়ল তবু ধৈর্য সহকারে শুনে গেলেন। পরে প্রসঙ্গের ইতি টানবার জন্যই বলতে বাধ্য হলেন, আমরা প্রসঙ্গান্তরে অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেললাম, স্যার জর্জ। অনেক রাত হল–আপনি বরং শুতে চলে যান। আপনার কাছ থেকে অনেক সাহায্য পেলাম আমি, ধন্যবাদ।
–হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন মিঃ পোয়ারো। আমার শুতে যাওয়া উচিত। একটা কথা শুধু জেনে যেতে চাই, নক্সাগুলো কি সত্যি সত্যিই উদ্ধার করা সম্ভব হবে?
পোয়ারো এবারে নিজের মধ্যে ফিরে গেলেন। ধীরে ধীরে বললেন, উদ্ধার না করতে পারার কোনো কারণ তো দেখতে পাচ্ছি না। চেষ্টা তো করে দেখি।
শুভরাত্রি জানিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন স্যার জর্জ।
নিজের মনে চেয়ারেই বসে রইলেন পোয়ারো। কিন্তু চিন্তার গভীরে হাতড়ে চলেছে তার মন। তাই স্থির দৃষ্টি দেয়ালের দিকে নিবদ্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষণ।
কোটের পকেট থেকে একটা নোটবুক আর কলম বার করে এরপর তার চিন্তার সূত্রগুলোকে সাজাতে বসলেন।
একটা সাদা পৃষ্ঠায় তিনি লিখলেন :
মিসেস ভান্দারলিন
লেডি জুলিয়া ক্যারিংটন
মিসেস ম্যাকাট্টা
রেগি ক্যারিংটন
মিঃ চার্লিল।
এই নামগুলোর পরে তিনি আবার লিখলেন :
মিসেস ভান্দারলিন এবং মিঃ রেগি ক্যারিংটন
মিসেস ভান্দারলিন এবং লেডি জুলিয়া
মিসেস ভান্দারলিন এবং মিঃ চার্লিল
কলম নামিয়ে কয়েক মুহূর্ত নীরব রইলেন। সহসা জোরে জোরে কয়েকবার মাথা নেড়ে নিজের মনে বলে উঠলেন, ঘটনা এবং আপাত উদ্দেশ্য। এরপর লিখে চললেন–
লর্ড মেফিল্ড কার ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন? সত্যিই কি তিনি কোনো ছায়া দেখেছিলেন? যদি না দেখে থাকেন, তাহলে কেন এমন জোর দিয়ে বলছেন, দেখেছেন?
স্যার জর্জ কি কোনো কিছু দেখেছিলেন? তিনি নিশ্চিত যে কিছু দেখেননি। ঘাসের লন পরীক্ষা করার পর তার কাছে একথা জানতে চেয়েছিলাম।
দ্রষ্টব্য : লর্ড মেফিল্ড ঘরে থাকার সময়ে এক চোখে পরার চশমা ব্যবহার করেছেন। তিনি দূরের বস্তু ভালো দেখতে পান না।
স্যার জর্জের ব্যাপারটা আবার উল্টো। তিনি দূরের বস্তু দেখতে পান তবে কাছের জিনিস ভালোভাবে দেখতে পান না।
টেরেসের শেষ প্রান্তের কোনো দৃশ্য দেখতে পাওয়ার ব্যাপারে স্যার জর্জ অনেক নির্ভরযোগ্য। তবু লর্ড মেফিল্ড সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে তিনি একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেয়েছেন।
মিঃ চার্লিল যে সন্দেহের ঊর্ধ্বে তা কি মনে করা চলতে পারে? লর্ড মেফিল্ড তার নির্দোষিতা জোর দিয়ে সমর্থন করেছেন। কারণটা কি?
কারণ কি এই যে তিনি নিজে তাকে সন্দেহ করেন এবং তার জন্য তিনি লজ্জিত? এমনও হতে পারে তিনি অন্য কাউকে সন্দেহ করেন। সেই ব্যক্তি মিসেস ভান্দারলিন নাও হতে পারে।
নোট নেওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো। ধীর পায়ে স্টাডিঘরের দিকে এগোলেন।
.
পোয়ারোকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে লর্ড মেফিল্ড তার দিকে তাকালেন।
–মঁসিয়ে পোয়ারো, ক্যারিংটনকে আপনার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে?
–হ্যাঁ, লর্ড মেফিল্ড। তার কাছ থেকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন শোনা গেল।
–কি বিষয়ে?
–আপনার অনুষ্ঠানে মিসেস ভান্দারলিনের উপস্থিতি প্রসঙ্গে। আমার ধারণা, আপনিও ব্যাপারটা উপলব্ধি করে থাকবেন।
পোয়ারোর সন্দেহটা অনুধাবন করতে পেরে অস্বস্তি বোধ করলেন লর্ড মেফিল্ড।
-আপনি যা ভাবছেন, তা আদৌ ঠিক না, মঁসিয়ে পোয়ারো। ভদ্রমহিলার প্রতি আমার কোনো প্রকার দুর্বলতা থাকার কথা নয়। ক্যারিংটন সেরকমই ভেবেছে নাকি?