–তাহলে এটা অনুমান করতে পারা যায়, সেই নক্সাগুলোর বিনিময়ে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থাগমের সম্ভাবনা। অর্থের মূল্যে চুরি যাওয়া কাগজগুলো মহার্ঘ্যই বলা চলে।
–হ্যাঁ। যদি বিশেষ জায়গায় হস্তান্তর করা যায়।
উদাহরণ হিসেবে দুটি ইউরোপীয় শক্তির নাম উল্লেখ করলেন স্যার জর্জ।
-বলতে চাইছেন, মিসেস ভান্দারলিনের এই তথ্যটা ভালোরকমেই জানা থাকতে পারে?
–তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পোয়ারো চিন্তিতভাবে দু চক্কর পায়চারি করলেন। ডেস্কের সামনে গিয়ে কয়েকটা কাগজ গুছিয়ে রাখলেন। তারপর চটপট জানালা টপকে টেরেসে পৌঁছে ফ্ল্যাস লাইটের আলোতে একেবারে শেষ প্রান্তের ঘাসগুলো ভালো করে পরীক্ষা করলেন।
ভেতরে এসে চেয়ারে বসলেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন, লর্ড মেফিল্ড, একটা ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হতে দেখেও আপনি বাইরে অনুসন্ধানের চেষ্টা করেননি কেন?
–গুপ্তচর বৃত্তির ঘটনা বুঝতে পেরেই অনুমান করতে পেরেছি, বাগানের শেষে রেখে আসা কোনো গাড়ি সে ব্যবহার করে থাকবে এবং তাকে নাগাল পাওয়া দুষ্কর।
-কিন্তু পুলিসকে তো জানাতে পারতেন?
স্যার জর্জ বললেন, মিঃ পোয়ারো প্রতিরক্ষা সম্পর্কীয় এবং গোপনীয়, কাজেই এক্ষেত্রে পুলিস ডেকে প্রচারের ঝুঁকি আমরা নিতে পারি না। গুরুত্বপূর্ণ নক্সাগুলি চুরি গেছে এরকম প্রচার হলে পার্টির পক্ষে তা মস্ত ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে।
-বোঝা গেল। পার্টির স্বার্থরক্ষার খাতিরেই আপনারা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। যাতে কাকপক্ষীর অজানিতেই ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা যায়। খুব ভালো কথা।
মিঃ পোয়ারো, বললেন লর্ড মেফিল্ড, নক্সাগুলো উদ্ধারের ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত তো?
–হতাশ হবার মতো কিছু দেখছি না। অবশ্য কিছু কাজ এখনো আমার বাকি। মিঃ চার্লিলের সঙ্গে এবারে কথা বলতে চাই।
-অবশ্যই। বললেন লর্ড মেফিল্ড, আমি তাকে কাছাকাছি থাকতে বলেছিলাম, দেখছি–তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
স্যার জর্জের দিকে ঝুঁকে বসলেন পোয়ারো।
–টেরেসের সেই ছায়ামূর্তির সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
–প্রিয় পোয়ারো, আমার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব নয়, কেন না, আমি আদৌ তাকে দেখিনি।
-হ্যাঁ, আপনি আগেই একথা বলেছেন। আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না, তাই নয়? দেখুন, স্যার জর্জ, আপনারা দুজনেই টেরেসের শেষ প্রান্তে ছিলেন। লর্ড মেফিল্ড দেখলেন, জানালার বাইরে বেরিয়ে এসে একটা ছায়ামূর্তি ঘাসের লন পার হয়ে চলে গেছে। আপনি পাশাপাশি দাঁড়ানো, সেই ছায়ামূর্তি আপনার চোখে না পড়ে থাকে কি করে?
স্যার জর্জের দৃষ্টি সজাগ হল। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, তখন থেকেই এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভেবে চলেছি। আমার চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত পরিষ্কার। জানালা টপকে ওই সময় কেউ বেরিয়ে থাকলে আমার চোখে অবশ্যই পড়ত। আমি শপথ নিয়ে বলতে পারি, এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি।
আমার ধারণা জানালার কাছে বাগানের গাছের ডালপালার ছায়া নড়তে দেখে লর্ড মেফিল্ডের চোখে মানুষের ছায়ামূর্তি বলে ভ্রম হয়ে থাকবে। তাকে সমাপতনই বলা চলে না কি, তিনি পরমুহূর্তেই ঘরে এসে দেখতে পেলেন নক্সাগুলি চুরি গেছে। ছায়ামূর্তি দর্শনের ভ্রমটাই তখন তার মনে বিশ্বাসে পরিণত হয়।
তার মনে গেঁথে গেছে যে জানালা টপকে নক্সাচোরকেই তিনি পালাতে দেখেছেন। না দেখে আমিই ভুল করেছি। তবুও
তবুও, হাসলেন পোয়ারো, আপনি বিশ্বাস করেন সেই সময় কোনো ছায়ামূর্তিই আপনার চোখে ধরা পড়েনি?
–আমি স্থির নিশ্চিত মিঃ পোয়ারো। তা ছাড়া তেমন হলে ঘাসের ডগায় পায়ের ছাপ আপনার নজরে আসত।
পোয়ারো গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন।
–আপনার যুক্তি যথার্থ। লর্ড মেফিল্ড বিশ্বাস করেন তিনি ছায়ামূর্তি দেখেছেন। সেই বিশ্বাস তার দৃঢ় হয়েছে, চুরির ঘটনা হাজির হওয়ায়। পায়ের ছাপের কথা যা বললেন, সেটা আমার কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। কেন না আপনি জানেন, আজ সন্ধ্যায় প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে।
এই অবস্থায় টেরেস পার হয়ে কোনো লোক ঘাসের ওপর দিয়ে যদি হেঁটে গিয়ে থাকে, তার পায়ের ছাপ ঘাসের ওপরে না পাওয়াই সম্ভব।
-তাহলে এখন
–এখন বাইরেটা বাদ রেখে আমাদের নজর ফেলতে হবে বাড়ির ভেতরে, লোজনের ওপরে।
এই সময় দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন লর্ড মেফিল্ড, তার পেছনে মিঃ চার্লিল।
যুবকটিকে খুবই বিমর্ষ লাগছিল। ততক্ষণে মানসিক আঘাতটা হয়তো অনেকটাই সামলে উঠতে পেরেছে। স্প্রিং লাগানো চশমা চোখে লাগিয়ে সে সন্ধানী দৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকালো।
পোয়ারো সরাসরি তার মুখের দিকে তাকালেন। দৃষ্টি স্থির রেখেই প্রশ্ন করলেন, মঁসিয়ে, এ ঘরে ফাইলপত্র গোছগাছ করার সময়ই আপনি বাইরে আর্তচিৎকারটা শুনতে পেয়েছিলেন?
-হ্যাঁ।
–চিৎকারটা শোনার পর কতক্ষণ আপনি এ ঘরে ছিলেন?
চার্লিল নীরবে চিন্তা করল। পরে বলল, সঠিক বলা মুশকিল। তবে পাঁচ থেকে দশ মিনিট মত হতে পারে।
তার আগে পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল?
–হ্যাঁ।
–আজ এই বাড়িতে সন্ধ্যায় অতিথি আপ্যায়নের একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল শুনেছি।
–হ্যাঁ, ড্রইংরুমে সকলেই ছিলেন।
–সকলেই বলতে, মিঃ এবং মিসেস স্যার জর্জ ক্যারিংটন, মিসেস ম্যাকট্টা, মিসেস ভান্দারলিন, যুবক রেগি ক্যারিংটন, লর্ড মেফিল্ড এবং আপনি নিজে, তাই তো?