হতভম্ব হয়ে রইলেন লর্ড মেফিল্ড। কোনো রকমে বললেন, ব্যাপারটা কি হল আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
-না পারার কিছু নেই লর্ড। লেডি জুলিয়া পরিষ্কারই জানিয়ে গেলেন, কে বা কারা ওই নক্সাগুলো চুরি করতে পারেন।
-আপনি বলছেন, লেডি জুলিয়া নক্সাগুলো চুরি করেননি?
নিশ্চয়ই নয়, লর্ড মেফিল্ড। কিন্তু তিনি যখন সেগুলো ফেরত দেবার প্রস্তাব করেছেন তখন ধরে নেওয়া যায় চুরি করেছে তার নিজের নোক কেউ, হয় স্বামী নয়তো ছেলে। কিন্তু ওদিকে দেখা যাচ্ছে, স্যার জর্জ আপনার সঙ্গে টেরাসে ছিলেন। তাহলে…আসুন গতকালের ঘটনাগুলো আবার নতুন করে সাজিয়ে দেখা যাক।
গতকাল রাতে খেলা শেষ করে উঠে লেডি জুলিয়া তার ঘরে চলে যান। খানিক আগেই ওপরে উঠে এসেছিল রেগি। কিন্তু লেডি তাকে ঘরে দেখতে পেলেন না। ছেলের খোঁজ নিতে তিনি তখনই আবার নিচে আসেন। কিন্তু সেখানেও সে ছিল না।
রাত শেষ হলেই তিনি চুরির ঘটনার কথা জানতে পারেন। আরও শুনতে পেলেন জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার ছেলে জানিয়েছে রাতে সে ঘর ছেড়ে বেরোয়নি। স্বভাবতঃই তিনি বুঝতে পারেন, তার ছেলে মিথ্যা কথা বলেছে।
ছেলের অনেক ব্যাপারই তিনি জানতেন। বিশেষ করে তার টাকার অনটনের বিষয়। টাকা পাবার জন্য সে অস্থির হয়ে উঠেছিল।
এদিকে; তিনি এ-ও লক্ষ করেছেন মিসেস ভান্দারলিনের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সে। সব মিলিয়ে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যান লেডি জুলিয়া। মিসেস ভান্দারলিনের ফঁদে পা বাড়িয়েছে রেগি, তারই প্ররোচনায় নক্সাগুলো চুরি করে সে।
লেডি জুলিয়া আসক্ত হলেও নীতিভ্রষ্ট নন। তিনি স্থির করেন, ছেলেকে চাপ দিয়ে নক্সাগুলো উদ্ধার করবেন এবং যথাস্থানে ফেরত দেবেন।
–এত একটা কল্পকাহিনী হয়ে যাচ্ছে মঁসিয়ে পোয়ারো, বাস্তবে এমন ব্যাপার একেবারেই অসম্ভব। সম্পূর্ণ অসম্ভব।
–আপনি ঠিকই বলেছেন, লর্ড মেফিল্ড, সত্যিই অসম্ভব। তবে লেডি জুলিয়া এরকমই ভেবেছেন। তিনি জানেন না, রেগি গতকাল রাত্রে তার ঘরে উপস্থিত না থাকলেও সে নক্সাগুলো চুরি করেনি। আমি এরকুল পোয়ারো জানি, সে কোথায় ছিল। তখন সে মিসেস ভান্দারলিনের ফরাসি পরিচারিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করছিল।
–সবকিছুই রাবিশ। পোয়ারোর কথা উড়িয়ে দিতে চাইলেন লর্ড মেফিল্ড, কেসটা যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে।
-কেস শেষ হয়ে গেছে লর্ড মেফিল্ড, সমাধানটা এরকুল পোয়ারোর মুঠোয়। আপনি আমাকে নেহাৎ একজন হাতুড়ে বৈদ্য ভেবে রেখেছেন। তাই গতকাল আপনাকে যখন বলি নক্সাগুলো কোথায় আমি জানি, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেননি। এখনো পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছেন না যে সত্যি ঘটনাটা আমি জানি।
-নক্সাগুলো তাহলে কোথায়, বলছেন না কেন?
–সেগুলো হাতের নাগালেই রয়েছে লর্ড মেফিল্ড, আপনার পকেটেই পাওয়া যাবে। লর্ড মেফিল্ডের মুখ থেকে বাক্যস্ফুর্তি হল না। তিনি থ হয়ে রইলেন কিছু সময়। পরে সম্বিত ফিরে এলে বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কি সব বলছেন?
-হ্যাঁ, বলছি, আমি যা জানি তাই। একদম গোড়ায় আপনার কথা থেকেই আমি সত্যের সন্ধান পেয়েছিলাম। আমাকে চিন্তা করতে হয়েছিল, আপনারই বলা কথাটা, দূরের জিনিস আপনি ভালো দেখতে পান না।
তাই যদি হয় তাহলে একটা ছায়ামূর্তি জানালা টপকে চলে গেল দুর থেকে আপনি দেখলেন কি করে? এর সমর্থনযোগ্য যুক্তি আপনি বারবার দেখাবার চেষ্টা করেছেন, আমি সব যুক্তি খণ্ডন করা সত্ত্বেও। কিন্তু কেন আপনি এ কাজ করেছেন?
স্যার জর্জ টেরেসে আপনার সঙ্গে পায়চারি করছেন, মিসেস ভান্দারলিন তখন ওপরতলায়, রেগি ক্যারিংটন সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়েছিল ফরাসি পরিচারিকাটির সঙ্গে, মিসেস ম্যাকাট্টা, তার ঘরে নিদ্রামগ্ন, তাঁর নাক ডাকার শব্দ বাইরে থেকে পাওয়া যাচ্ছিল। পাশের ঘরটিই গৃহকর্তার। এই হল সমগ্র দৃশ্যপট।
ছেলেকে ঘরে এবং নিচে কোথাও দেখতে না পেয়ে মিসেস ক্যারিংটন ভেবে নিয়েছেন, তার ছেলেই অপরাধী। এর পরও দুটি সম্ভাবনা-সূত্র পাওয়া গেল।
একা হল, হয় চার্লিল নক্সাগুলো নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছিল, অথবা আপনি যখন ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, ডেস্কের ওপরে রাখা নক্সাগুলো তখন একমাত্র আপনার পকেটেই যাওয়া সম্ভব।
চার্লিলের নির্দোষিতার ব্যাখ্যা আপনিই দিয়েছেন। কিছু করার ইচ্ছা থাকলে আগেই সে প্ল্যানগুলো নকল করে রাখতে পারত, কেউ তা টের পেত না। কাজেই নক্সা সে নেয়নি।
তাহলে এবারে আর কিছু অপরিষ্কার রইল লর্ড মেফিল্ড?
ছায়ামূর্তির ব্যাপারে আপনি যেভাবে বারবার জোর দিয়েছেন, চার্লিলের নির্দোষিতার ব্যাপারে নিশ্চয়তা জাহির করেছেন, এই সব কিছুই ছিল অস্বাভাবিক এবং বিষয়গুলি আমাকে খুঁটিয়ে বিচার করতে হয়েছে।
তবে এই চুরির মোটিভ আবিষ্কার করতে আমাকে যথেষ্ট হিমসিম খেতে হয়েছে। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না নক্সাগুলো আপনি চুরি করলেন কেন?
আপনি যে একজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি তা আপনার কথাতেই প্রকাশ পেয়েছিল। আপনি আগাগোড়া চেষ্টা করেছেন যাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি সাজা না পায়। এমন একজন সৎসজ্জন ব্যক্তি নক্সাগুলি চুরি করেছে, কোনো গূঢ় কারণ ছাড়া এমন ঘটনা ঘটতে পারে না। তাছাড়া, এই চুরির ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়লে আপনার ভবিষ্যৎ উন্নতির পথও বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা। সব মিলিয়ে একটা নিদারুণ গোলকধাঁধা।