ও যখন আমার চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল, আমি সিঁড়ির একধাপ ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন চোখে পড়ল, লেডি জুলিয়া সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছেন। জিজ্ঞেস করতে বললেন, একটা বই-এর জন্য নিচে গিয়েছিলেন। আমার কেমন অদ্ভুত মনে হল।
হেসে কথাটা শেষ করলেও কথার ইঙ্গিতপূর্ণ সুর শুনে পোয়ারোর মনে হল, মিসেস ভান্দারলিন লেডি ক্যারিংটনকে মোটেই পছন্দ করেন না।
বেশ বুঝতে পারলাম। আচ্ছা মাদাম, ওপরে যাবার পর আপনার পরিচারিকার আর্তনাদ আপনি শুনতে পেয়েছিলেন?
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই রকম কিছু একটা শুনতে পেয়েছিলাম আমি।
–আপনি নিশ্চয় তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন?
–হ্যাঁ, করেছিলাম। সে জানাল, কিরকম একটা সাদা ভাসমান মূর্তি সে দেখেছিল। সেই অদ্ভুত দৃশ্য দেখেই ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল। অশিক্ষিত মেয়েদের কথা আর কি বলব বলুন।
গতকাল রাতে লেডি জুলিয়ার পরণে কি পোশাক ছিল আপনার মনে আছে?
–হ্যাঁ, হাসলেন মিসেস ভান্দারলিন, আপনি কি বোঝাতে চাইছেন বুঝতে পারছি, সাদা পোপাশাক পরা লেডি জুলিয়াকে অন্ধকারে অন্যরকম মনে হয়েছিল আমার পরিচারিকার। বিচিত্র কি, এইসব মেয়েরা খুবই কুসংস্কারাচ্ছন্ন।
–আপনার এই পরিচারিকাটি কতদিন আপনার কাছে আছে?
–বেশি দিন নয়, মাস পাঁচেক হবে।
–আপনার অনুমতি নিয়েই, তার সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই আমি।
মিসেস ভান্দারলিনের চোখ একটু বড় হল। তিনি শান্ত গলায় বললেন, নিশ্চয়ই বলবেন।
-আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মিসেস ভান্দারলি, আপনার সৌন্দর্যের মতই আপনার ব্যবহারও মুগ্ধকর। আমি প্রশংসা না করে পারছি না।
–এই প্রশংসার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। উঠে দাঁড়িয়ে পোয়ারোর সঙ্গে করমর্দন করলেন মিসেস ভান্দারলিন। আবার বললেন, আপনার সাফল্য কামনা করি।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। পোয়ারা আপনমনে বিড়বিড় করলেন, সাফল্য আমি পাব না আপনি নিশ্চিত জানেন, সেই জন্যই সাড়ম্বরে সাফল্য কামনা করে গেলেন। কিন্তু আমি এরকুল পোয়ারো—
.
মিসেস ভান্দারলিনের ফরাসি পরিচারিকা মাদমোয়াজেল লিওনিকে দেখা গেল দরজার সামনে। কালো পোশাক আর কাঁধ-ছোঁয়া ঢেউ খেলানো চুলে তাকে বেশ আকর্ষণীয় দেখাচ্ছিল। পোয়ারো মনে মনে স্বীকার করলেন, মেয়েটির রূপ আছে।
মুখে সলজ্জ হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকতে ইতস্ততঃ করছিল সে। পোয়ারো তাকে ভেতরে আসার ইঙ্গিত করলেন।
-এসো মাদমোয়াজেল, ভয় নেই।
ধীর পায়ে হেঁটে এসে পোয়ারোর উল্টোদিকের চেয়ারে বসল সে।
–তোমাকে দেখে র্মসিয়ে চার্লিলকে খুবই বেরসিক বলে মনে হচ্ছে আমার।
লিওনি অবাক হয়ে তাকাল চোখ তুলে।
-তুমি খুবই সুন্দর। মঁসিয়ে চার্লিলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি দেখতে কেমন। সে উত্তরে বলেছিল, জানে না।
লিওনির মুখে এবারে কথা ফুটল। অবজ্ঞার স্বরে বলল, ওই পাথরের মূর্তিটার কথা বলছেন? লোকটা জীবনে কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়েছিল কিনা সন্দেহ।
-বেচারাই বলতে হবে, তরল কণ্ঠে বললেন পোয়ারো, নিঃসন্দেহে সে অনেক কিছু হারিয়েছে। তবে মনে হয়, এ বাড়িতে অনেকেই তোমার সৌন্দর্যের প্রশংসা করে, কি বল?
–মঁসিয়ে কি বোঝাতে চাইছেন, বুঝতে পারছি না।
-তাই কি হয় মাদমোয়াজেল, তুমি ঠিকই বুঝতে পারছ। তাহলে বলছি তোমাকে শোন। গতকাল রাতে তুমি শুনলাম ভূত দেখেছ। কিন্তু যখন শুনলাম তুমি মাথায় হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলে, তখনই বুঝলাম কোনো ভূত দেখে তোমার ওই অবস্থা হয়নি। বুঝলে লিওনি, ভূত দেখে কোনো মেয়ে যখন ভয় পায়, সঙ্গে সঙ্গে বুকে হাত দিয়ে কিংবা দুহাতে মুখ ঢেকে সে আর্তনাদ করে ওঠে। মেয়েদের ভয় পাবার ওটাই স্বাভাবিক ভঙ্গিমা।
কিন্তু তার হাত যদি মাথার ওপরে দু কানের পাশে থাকে তাহলে ধরে নিতে হয় ব্যাপারটা অন্য কিছু। আমি বলতে পারি, তোমার চুল এলোমেলো হয়ে গেছিল, আর তুমি দ্রুত হাতে চুলগুলো বিন্যস্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলে। আমি ঠিক বলছি কিনা এবারে তুমিই বল মাদমোয়াজেল। সত্যি করে বল তো, সিঁড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে তুমি অমন চিৎকার করে উঠেছিলে কেন?
আমি কিছু মিথ্যা বলছি না মঁসিয়ে পোয়ারা, আমি সত্যিই সাদা পোশাকে মোড়া একটা ছায়ামূর্তি দেখে আঁৎকে উঠেছিলাম। আপনি বিশ্বাস করুন।
-মাদমোয়াজেল, আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করো না। তোমার এই কাহিনী মঁসিয়ে চার্লিলের কানে হয়তো খুবই বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে পারে, কিন্তু আমি এরকুল পোয়ারো, আমার কাছে সেরকম নয়, বুঝতেই পারছে।
আসল কথাটা হল, একটা অপ্রত্যাশিত চুম্বন তোমাকে চমকে দিয়েছিল। আর তোমাকে চুমু খেয়েছিল মঁসিয়ে রেগি ক্যারিংটন, তাই নয় কি?
ঝকঝকে চোখে তাকাল লিওনি। পোয়ারোর চোখ তার চোখে আটকে গেল। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না সে। চোখ সরিয়ে মাথা নত করল।
পোয়ারো মেয়েটির মনোভাব উপলব্ধি করতে পেরে স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বললেন, একটা চুমুর ব্যাপার এমন কিছু নয়, তুমি ব্যাপারটা কি হয়েছিল আমাকে বল।
মুখ না তুলেই লিওনি বলতে লাগল, মিঃ রেগি কখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল আমি বুঝতেই পারিনি। আচমকা সে দুহাতে আমাকে জাপটে ধরে আদর করে চুল ঘেঁটে দিয়েছিল।
আমার তখন আর কিছু করার ছিল না। রেগি বলে বুঝতে পারিনি, তাই ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠেছিলাম।