ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিলো পিটার। বলল–এই তো আমার ডেরা। ভয়ে করছে? সত্যি ভয় করছে লীনার। কিন্তু মুখে বলল–না, তুমি তো রয়েছে সঙ্গে। পিটারের একটা হাত সজোরে আঁকড়ে ধরলো লীনা।
ঘরে ঢুকে পিটার বলল-খামটা দেখি লীনা।
ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে খামটা বের করে পিটারের হাতে দিলো লীনা।
খামের মুখ ছিঁড়ে ফেললো পিটার। বের করলো নোটগুলো।
একশো পাউণ্ডের দশখানা নোট।
লীনা বলল–এত টাকা। আমার আড়াই মাসের মাইনে।
কেমন বিচিত্র হাসলো পিটার। এটা তো তুচ্ছ। আমার কাছে আরো আছে, এই দেখ। ফোলিও ব্যাগটা খুলে মডেলটা বের করলো পিটার। আবার হাসলো সে বিচিত্র হাসি।
-এই সে মডেল যা তুমি অল্প কিছুক্ষণ আগে মিঃ স্টুয়ার্টের হাতে তুলে দিয়েছিলে।
–ওটা তোমার কাছে এলো কি করে? লীনা বিমূঢ়।
–মিঃ স্টুয়ার্টের কাছ থেকেই পেয়েছি। অবশ্য স্বেচ্ছায় তিনি দেন নি।
–তবে?
লীনার কৌতূহল আর বাধ মানে না।
মিঃ স্টুয়ার্ট আর বেঁচে নেই। কেমন যেন নির্মম শোনায় পিটারের গলা।
একটা আর্ত চিৎকার করে ওঠে লীনা। তারপর প্রায় মরিয়া হয়ে বলে–ভুল, তুমি ভুল করছো পিটার। যে মূর্তিটা আমায় তুমি দিয়েছিলে সেটা চুরি হয়ে গেছে কাল রাতেই। এটা একটা নকল মূর্তি। দোকান থেকে কেনা।
-সেকি! পিটার লাফিয়ে ওঠে চেয়ার ছেড়ে।
এবার লীনার পালা। খুব সূক্ষ্ম হাসির একটা ফালি ঠেটের কোণে ছড়িয়ে রাখে লীনা।
–কে নিয়েছে তাও জানি।
–কে নিয়েছে? কে?
পিটারের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে ভয় পায় লীনা। কেমন পাগলের মতো আচরণ করছে পিটার। তাড়াতাড়ি বলে–প্রমাণ নেই। তবু আমি জানি এ কাজ মিসেস হেলেনার ছাড়া কারোর নয়।
–কে এই মিসেস হেলেনা?
–ওপরের ফ্ল্যাটে থাকে।
রুমাল দিয়ে ঘাম মোছে পিটার। ভাঙা গলায় বলে–সব পণ্ড হয়ে গেল লীনা। সব ভুল। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটের ফাঁকে রাখে পিটার।
এ-পকেট ও-পকেট হাতড়ায়, দেশলাই-এর খোঁজ নেই।
পিটার বলে–তুমি বসো, আমি এখুনি আসছি।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে আসে পিটার। এখন ওর মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। ধোঁয়ার কয়েকটা রিং শূন্যে ছুঁড়ে দেয় আলগোছে। ওকে অনেকটা স্বাভাবিক লাগছে এবার।
-এবার বলো লীনা, কিভাবে চুরি গেল মডেলটা।
লীনা সমস্ত কিছু গুছিয়ে বলে পিটারকে।
হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে ওঠে পিটার।–কি অভদ্র আমি দেখছো লীনা। কতক্ষণ ধরে তুমি এসেছো অথচ এক কাপ চা খাওয়ানো হয়নি।
বাধা দেয় লীনা–এত রাতে আবার কাকে চা আনতে পাঠাবে?
পিটার শান্ত গলায় বলে–চিন্তার কোন কারণ নেই। ঐ মিটসেফের মধ্যে চা, চিনি, দুধ সবই মজুত আছে। কেরোসিন স্টোভ আছে। আর আমি তো আছিই তোমার সামনে। নিজের বুকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পিটার।
লীনাও যোগ দেয়–কখনো না। মহিলাদের উপস্থিতিতে কোন পুরুষ রান্নার ভার নিলে সেই মহিলার অকল্যাণ হয়, জানো তো।
.
০৮.
লীনা যখন বাড়ি ফিরলো তখন দশটা বেজে গেছে।
গুন গুন করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিল। নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো হঠাৎ।
মিসেস হেলেনার ঘরে আলো জ্বলছে। দরজা নিশ্চয়ই খোলা। না হলে সিঁড়িতে আলো আসছে কি করে। কি মনে করে ওপরে উঠতে লাগলো লীনা। সিঁড়ির বাঁক ঘুরেই দেখলো দরজাটা হাট করে খোলা। ব্যাপার কি?
খোলা দরজা দিয়ে উঁকি মারলো লীনা। একটা তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার করে পেছিয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে।
বীভৎস দৃশ্য। ঘরের ঠিক মাঝখানে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন মিসেস হেলেনা। চোখ দুটো খোলা, একটা ভয়ানক আতঙ্ক ফুটে আছে চোখের মণিতে। মুখের বাঁ-দিকে একটা ক্ষত দিয়ে রক্তের ক্ষীণ ধারা তখনও গড়িয়ে পড়ছে। যত তাড়াতাড়ি ওপরে উঠেছিলো তার চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে নেমে আসে লীনা।
ফোন করতে হবে এরকুলকে।
.
এরকুল বলল–ঠিকানাটা তুমি ঠিক দেখেছো লীনা।
–হ্যাঁ বাড়িতে ঢোকার সময় চোখে পড়লো বেশ বড় নম্বর ‘ভালো’।
ভালো। অ্যাণ্ড্রুজ তুমি এখনি ও.সি.-কে আমার নাম করে বলো যত তাড়াতাড়ি পারে এই ঠিকানায় চলে আসতে।
ফোন করে ফিরে এলো অ্যাণ্ড্রুজ।-সর্বনাশ হয়েছিল, আর-একটু হলেই।
.
দরজায় ঢোকবার মুখে এরকুল পোয়ারো দেখলো পুলিশের জীপ এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। ও.সি.-কে নামতে দেখলো এরকুল। ইশারায় ওকে আসতে বলে ঘরে ঢুকে গেল।
সুটকেস গোছাচ্ছিল পিটার।
এরকুল বলল–কোথায় যাচ্ছেন পিটার? যাওয়া তো হবে না।
হেসে ওঠে পিটার। তারপর লীনাকে দেখে বলল–একি লীনা, তুমি এখানে? কি ব্যাপার?
ব্যাপার সামান্যই। এগিয়ে গেল এরকুল। সুটকেসের ভেতর হাত ঢুকিয়ে শার্ট প্যান্ট পাজামার তলা থেকে বের করল এক ফুট লম্বা আড়াই ইঞ্চি চওড়া সোনালী মডেল।
–এটা কি মিঃ পিটার?
পিটারের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে একেবারে। তবু বলল–কি আবার? দেখতেই তো পাচ্ছেন। সাধারণ মডেল একটা।
-সাধারণ মডেল নয়।
মডেল তুলে মেঝেতে আছাড় মারে এরকুল। মাটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সেটা। ঘরময় করা মাটির টুকরো আর গোটা চারেক পুরু সোনার বাট।
এরকুল হাসে। পিটার ওরফে ক্লাইভ।
ও.সি. এগিয়ে গেল ক্লাইভের দিকে। পেছনে একজন কনস্টেবল।
লীনা বললো-ক্লাইভ কাকে বলছেন এরকুল? ও তো আমার পিটার।
করুণ হাসলো পিটার–সরি লীনা। তোমার স্বামী পিটার মারা গেছেন ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে দশ বছর আগে।