- বইয়ের নামঃ তিন গোয়েন্দা ভলিউম ৬০: শুঁটকি শত্রু
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
শুঁটকি শত্রু
০১.
ফ্যাশন শোতে যাচ্ছি ভাবতেই দারুণ লাগছে, কিশোর পাশা বন্ধুদের উদ্দেশে বলল। এইমাত্র ওরা ওদের প্রিয় দোকান ফ্যাশন হাউজ -এ প্রবেশ করল।
যে ড্রেস পরে মডেলিং করব সেটা কি ওরা দিয়ে দেবে নাকি? প্রশ্ন করল রবিন মিলফোর্ড।
মাথা নাড়ল মুসা আমান।
রবিন! তোমার ক্লজিটের যেরকম ঠাসাঠাসি অবস্থা, কবে যে দরজাটা ভেঙে যাবে!
রবিন হাসল বন্ধুর দিকে চেয়ে।
গেছে অলরেডি!
ছেলেরা মহা উত্তেজিত। ফ্যাশন হাউজ মস্ত দোকান। ওটার ভিতরেই শো হবে। রকি বীচের বেশ কয়েকজন ছেলে-মেয়ে মডেল। কিশোর আর রবিনও রয়েছে তাদের সঙ্গে।
আরি! সবিস্ময়ে বলে উঠল কিশোর। ফ্যাশন হাউজকে তো কখনোই এমন সাজে দেখিনি।
দোকানটার দিকে দৃষ্টি বুলাল তিন গোয়েন্দা। আগাগোড়া বিশাল এক লাল কার্পেট ফেলা হয়েছে। কার্পেটের দুধারে সারি সারি চেয়ার। প্রত্যেকটা চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়েছে একটা করে রঙিন বেলুন।
কাপড়ের ব্ল্যাকগুলোর উপরে কার্ডবোর্ডে লিখে রাখা হয়েছে: ব্যাক টু স্কুল।
ধ্যাত, বিরক্তি প্রকাশ পেল মুসার কণ্ঠে। গরমের ছুটি শেষ হতে আরও তিন সপ্তা বাকি, অথচ এখনই স্কুলে ফিরে যেতে বলছে!
মুচকি হাসল কিশোর।
ভালই তো, ব্যাক টু স্কুল বলছে, কিন্তু আসলে তো ফ্যাশন শো!
কিশোর, দেখো, বলে উঠল রবিন। দেয়াল ঘড়ির দিকে আঙুল তাক করেছে। একটা বেজে গেছে। শোয়ের আর এক ঘণ্টা বাকি।
স্টোরের মালিক মিরা ব্যস্ততার সঙ্গে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তাকে ও তার সেলসগার্ল রীটাকে চেয়ার গুনতে দেখল ছেলেরা।
মিরার মাথায় খাটো, কালো চুল। চোখজোড়া নীল। কালো প্যান্ট ও চকচকে লাল ব্লাউজ ওর পরনে।
রীটা পরেছে স্ট্রাইপৃড় টি শার্ট ও ট্যান প্যান্ট। বাদামী চুলের মেয়েটির মুখ ভর্তি ফুটকি চিহ্ন।
মিরা আর রীটা আমাদের চেয়ে কম এক্সাইটেড না, বলল গোয়েন্দাপ্রধান।
নার্ভাসও বলতে পারো, যোগ করল রবিন। মুসার দিকে ফিরল। শোতে নাম না দেয়ায় এখন খারাপ লাগছে না তোমার?
মাথা নাড়ল মুসা।
জিন্স আর সকার শার্টের মডেলিং করতে দেবে না, খারাপ লাগবে কেন?
রবিন চোখ নাচাল, কিন্তু হেসে ফেলল কিশোর। রবিন আর মুসার পছন্দ এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে।
আমাদের বরং সুবিধেই হয়েছে, বলল কিশোর। মুসা আমাদের আউটফিট বদলাতে সাহায্য করতে পারবে।
অন্যান্য যেসব ছেলে-মেয়েরা মডেল হবে, তারা আসতে শুরু করেছে। জুলি মরগ্যান আর রুডি মার্শকে দেখতে পেল ওরা। পরমুহূর্তে এমন একজনকে দেখল, ওরা যাকে আশা করেনি।
শুঁটকি টেরিও নাম লিখিয়েছে নাকি? গুঙিয়ে উঠল কিশোর।
ও মনে হয় দুটি প্যান্টের মডেলিং করবে, বলে হেসে ফেলল রবিন।
আমি কিন্তু কথাটা শুনতে পেয়েছি, রবিন মিলফোর্ড! খ্যাক করে উঠল শুঁটকি। তিন গোয়েন্দার কাছে হেঁটে এল। মেয়েদের মত পনিটেইল রেখেছে শখ করে।
গোয়েন্দাদের আবার মডেলিং করার শখ হলো কবে থেকে?
আজকে থেকে, জবাবে বলল গোয়েন্দাপ্রধান।
দাঁতে দাঁত পিষে মাথা নাড়ল টেরি।
তুমি এখানে কেন, টেরি? কিশোর প্রশ্ন করল।
চোখ জ্বলে উঠল টেরির।
ডয়েল নিউজে আর্টিকল লিখছি আমি।
এ আর নতুন কথা কী? মুসা বিড়বিড় করে বলল।
ডয়েল নিউজ শুঁটকির নিজের খবরের কাগজ। বাসায় বসে কম্পিউটারে নিজেই লেখে।
ফ্যাশন শো-র নতুন ড্রেসগুলো সম্পর্কে লিখবে, তাই না? রবিন বলল।
ধূর্ত হাসল টেরি।
না, বলল। গসিপ কলাম লিখব ঠিক করেছি।
কিশোর একদৃষ্টে চেয়ে টেরির দিকে। কী ধরনের গুজব রটাতে চাইছে শুঁটকি?
গসিপ রটানো কি ঠিক, টেরি? বলল অবশেষে। বিশেষ করে মিথ্যে গুজব।
চুলে আঙুল চালাল টেরি।
মিথ্যে গুজব রটা কে বলল তোমাকে?
তুমি তো আগেও অনেক বানোয়াট গপ্পো কেঁদেছ, টেরি, বলল মুসা। আমরা তো চিনি তোমাকে।
রেগে গেল শুঁটকি।
দেখো, বাজে কথা বলবে না। বানাবার কোন দরকারই পড়বে না, বলল। রসাল খবরের অভাব হবে না এখানে।
এই বলে চলে গেল টেরি। এক গাদা সোয়েটার দেখতে লাগল মন দিয়ে।
শুঁটকি যখন এসে হাজির হয়েছে, বলল রবিন। তখন এর চাইতে খারাপ আর কী হতে পারে?
মুসা দরজার দিকে আঙুল দেখাল।
কেন শিপটনের ব্যাপারে কী বলবে?
কিশোর ঘুরে তাকাল। দেখতে পেল কেন শিপটন ঢুকছে। সঙ্গে ওর যমজ দুই ভাই মানি আর পেনি। যমজ বাচ্চা দুটো মডেল হবে।
আমরা শো করব! চেঁচিয়ে উঠল মানি।
আমরা সবার চেয়ে সুন্দর! যোগ করল পেনি।
মুখে আইসক্রীম লেগে আছে, তাও? মুসা বলল।
কোন বিকার হলো না যমজদের। হাসি মুখে পাণ্ডা বার চকোলেট আইসক্রীম খেয়ে চলেছে।
কিশোরের এবার নজর গেল কেনের মাথায় পরা কালো বেরে টুপির দিকে।
তোমার জাদুকরের পোশাকের সঙ্গে মানাবে টুপিটা, বলল ও। ও জানে, কেন বড় হয়ে ম্যাজিশিয়ান হতে চায়।
আমি ঠিক করেছি ম্যাজিশিয়ান হব না, বলল কেন। পকেটে হাত ভরে ভাঁজ করা এক কাগজ বের করল। শিল্পী হব।
কাগজটা তুলে ধরল। সাদা একটা ছোপ ছাড়া আর কিছু ধরা পড়ল না কিশোরের চোখে।
কী পড়েছিল? প্রশ্ন করল মুসা। দুধ?
তুমি গ্রেট আর্টের কিছুই জানো না, কাটখোট্টা গলায় বলল কেন। পেইন্টিংটায় আঙুল রাখল। এটা মেরু ভালুকের ছবি। তুষারঝড়ের মধ্যে পড়েছে।
ঘাড় কাত করল কিশোর। কোথায় মেরু ভালুক আর কোথায়ই বা তুষারঝড়?
এরপর কী আঁকবে ওদেরকে বলো না, ভাইকে বলল মানি।
আমার পরের প্রজেক্ট হচ্ছে, ঘোষণা করল কেন। পোকা-মাকড়দের ছবি আঁকা।
তেলাপোকা? সবিস্ময়ে বলল রবিন।
মাথা ঝাঁকাল কেন।
তবে আঁকব কালো ভেলভেটের ওপর। প্রদর্শনীতে যেমনটা দেখা যায় আর
খাইছে! অত তেলাপোকা পাবে কোথায়? মুসা বলল।
জোগাড় হয়ে গেছে অলরেডি, জানাল কেন। শুধু কালো ভেলভেট এখনও হাতে পাইনি।
মিরা এসময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
যারা ফ্যাশন শোতে অংশ নিচ্ছে, তারা আমার সঙ্গে স্টকরূমে চলো প্লিজ। চলো! উত্তেজিত কণ্ঠে বলল রবিন।
কেন শিপটন পিছনে রয়ে গেল। অন্যরা মিরাকে অনুসরণ করে স্টোরের পিছনদিকের রূমটায় চলে এল। ডাঁই করে রাখা গাদা গাদা বাক্স আর কাপড়ের র্যাক দেখা গেল এখানে।
ওদের জানা আছে কে কোন ড্রেস পরবে। কদিন আগে রিহার্সাল হয়ে গেছে। মিরা যার যার পোশাক বাছাই করে দেবার পর নেমট্যাগ ঝুলিয়ে দিয়েছে।
কিশোরের জন্য বেছে রাখা লাল জ্যাকেটটা ঝুলছে, গোলাপি রঙের প্লাস্টিকের হ্যাঁঙ্গার থেকে।
মিরা এক হাত উঁচিয়ে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
শো চলার সময় তোমরা বাক্সগুলোর পেছনে চেঞ্জ করতে পারবে, জানিয়ে দিল। মেয়েরা ডান দিকে, আর ছেলেরা বাঁ দিকে।
মানি জুলি মরগ্যান ও অন্যান্য মেয়েদের উদ্দেশে বলল, উঁকি দিয়ো না যেন।
পেনি হাতে ধরা পাণ্ডা বার দোলাল।
তাকালে ভাল হবে না কিন্তু!
ছোট বাচ্চাদের লজ্জা-শরম একটু বেশিই থাকে, হাসি চাপল কিশোর।
মানি, পেনি, বলল মিরা। চারদিকে কাপড়-চোপড় রয়েছে, এখানে আইসক্রীম খেয়ো না।
কিন্তু পাণ্ডা বার পকেটে রাখলে তো গলে যাবে, আদুরে আদুরে গলায় বলল মানি।
ওই দেয়ালটার কাছে একটা ছোট ফ্রিজ আছে, আঙুল তাক করে বলল মিরা। ওখানে রেখে দাও।
গজগজ করতে করতে যমজরা ফ্রিজটার দিকে এগিয়ে গেল।
আচ্ছা, এবার বলো, বলল মিরা, ফ্যাশন শো সম্পর্কে তোমাদের কারও কোন প্রশ্ন আছে?
কিশোর হাত তুলল।
এই আগস্ট মাসের গরমে আমরা শীত-পোশাকের মডেলিং করছি কেন?
চমৎকার প্রশ্ন করেছে, কিশোর, সপ্রশংস কণ্ঠে বলল মিরা। মৌসুম আসার আগেই পোশাক প্রদর্শনী করার নিয়ম। লোকে যাতে আগেভাগে কিনে রাখতে পারে।
খাইছে! তারমানে ফেব্রুয়ারী মাসে বেদিং সুট বিক্রি করা হবে? মুসা ঢোক গিলল।
এ সময় রীটাকে হন্তদন্ত হয়ে স্টকরূমে ঢুকতে দেখা গেল। ওর হাতে বড়সড়, চারকোনা একটা বাক্স।
এটা এইমাত্র এসে পৌঁছেছে, মিরা, বলল। প্যারিসের লুলু থেকে।
কোটটা পাঠিয়ে দিয়েছে! মিরার কণ্ঠে উত্তেজনা। বাক্সটা খুলে ফেলল ঝটপট। হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। এত তাড়াতাড়ি পেয়ে যাব ভাবিনি।
বাক্স থেকে সাবধানে ছেলেদের একটা কোট বের করল মিরা। চকচকে রুপোলী বোতামওয়ালা কালো মখমলের এক কোট।
দুর্দান্ত! কিশোর অস্ফুট মন্তব্য করল।
এক্সকিউজ মি! অপরিচিত এক কণ্ঠ।
সবাই ঘুরে দাঁড়াল কণ্ঠস্বরটা লক্ষ্য করে। রুপোলীচুলো এক মহিলা, সোনার ইয়ারিং পরে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। দামি, সুদৃশ্য এক হ্যান্ডব্যাগ কাঁধ থেকে ঝুলছে।
আপনি কি মিরা নায়ার? প্রশ্ন করলেন।
মিরা আয়ার।
আমি মিসেস হগার্ড, বললেন অচেনা ভদ্রমহিলা। আমার বাচ্চাদের জন্য কিছু হেয়ার ব্যারেট কিনতে চাই।
আপনার মেয়েদের বয়স কত? মিরা জিজ্ঞেস করল।
মিসেস হগার্ড তার হাতব্যাগের ভিতরে হাত ভরে দিলেন। দুটো খুদে ইয়র্কশায়ার টেরিয়ার বের করে আনলেন পরমুহূর্তে। মাত্র তিন বছর।
ডগি! চেঁচিয়ে উঠল মানি।
আদর করি চলো! পাল্টা চেঁচাল পেনি।
মিসেস হগার্ড কুকুর দুটোকে মাটিতে নামিয়ে দিলেন। কোটটার দিকে দৃষ্টি তার। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলেন।
এরকম ব্ল্যাক ভেলভেট সচরাচর দেখা যায় না। আমি এটা কিনব।
এটা তো ছোটদের কোট, মিসেস হগার্ড, বলল মিরা। আপনার গায়ে ফিট করবে না।
আমার জন্যে না তো! ঘোষণা করলেন, মিসেস হগার্ড। আমার সোনামণিদের কোটে নতুন কলার চাই। কালো ভেলভেটটা দারুণ মানাবে?
আপনার কুকুর দুটো কি আগস্টেও কোট পরে নাকি? রুডি মার্শ প্রশ্ন করল।
মাথা ঝাঁকালেন ভদ্রমহিলা।
এয়ারকুলারে ঠাণ্ডা লাগে ওদের।
মিরা মাথা নাড়ল।
সরি। ফ্যাশন শোর জন্য কোটটা আমাদের দরকার। বিক্রি করতে পারছি না।
উঁহ, যত্তসব আদিখ্যেতা, খ্যাক করে উঠলেন মিসেস হগার্ড। তারপর কুকুর দুটোকে তুলে নিয়ে গটগট করে বেরিয়ে চলে গেলেন।
মিসেস হগার্ড রকি বীচের সবচেয়ে বড় বাড়িটায় থাকেন, বন্ধুদের উদ্দেশে ললল কিশোর। চাচার সঙ্গে একদিন হাঁটতে বেরিয়েছিলাম, তখন দেখিয়েছিলেন।
অত বড় বাড়িতে এত ছোট কুকুর রাখেন? মুসা বলল।
মিরা এসময় কোটটা তুলে ধরল আবার।
কে, বলে সবার উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিল সে। পরবে এটা?
ছেলেরা সবাই হাত তুলল। মিরা কিশোরের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল।
আমি? ঢোক গিলে বলল কিশোর।
হ্যাঁ, তুমি, বলল মিরা। কিশোরকে কোটটা পরতে সাহায্য করল। তোমার জ্যাকেটটা অন্য কেউ পরবে।
তোমাকে দারুণ মানিয়েছে, কিশোর, রবিন তারিফ করে বলল।
নিজেকে রাজপুত্র মনে হচ্ছে কিশোরের। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকল না সুখকর অনুভুতিটা। কেননা গর্জে উঠেছে রুডি মার্শ।
এটা অন্যায়! কোটটা আমাকে পরতে দেয়া উচিত!
.
০২.
কিশোর হতচকিত।
রুডির দিকে চেয়ে রয়েছে সবাই। রুডি বয়সে কিশোরের চাইতে বড়। স্কুলে প্রায়ই ফ্যাশনদুরস্ত পোশাক পরে আসে।
তোমাকে পরতে দেয়া উচিত একথা কেন বলছ, রুডি? জিজ্ঞেস করল মিরা।
কারণ আমি পিকচার পার্ফেক্ট মডেলিং স্কুলে ক্লাস করেছি, বলল। কোমরে ভঙ্গি নিয়ে হাত রেখে পাঁই করে এক পাক ঘুরে নিল। সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওর দিকে।
মিরা হেঁটে এল কিশোরের কাছে। কোটের হাতা দুটো ধরে টানল।
হাতা দুটো তোমার জন্য একটু বড় হয়ে গেছে, বলল। ঠিক ফিট করেনি।
কিশোর আঙুল বাড়িয়ে দিল।
কই, ঠিকই তো আছে, বলল।
একটু লম্বা ছেলেকে এটা ভাল মানাবে, বলল মিরা।
আমার মত! খোশমেজাজে বলে উঠল রুডি।
আমি দুঃখিত, কিশোর, বলল মিরা।
মনটা খারাপ হয়ে গেল কিশোরের। শোতে এটা পরতে পারবে ভেবে খুশি হয়ে গিয়েছিল। মনে হলো ওর মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া হলো বুঝি।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোট খুলে দিল ও।
রুডির হাতে কোটটা তুলে দিচ্ছে, এসময় কেন শিপটনকে পিছনের কামরায় উঁকি মারতে দেখল। ওর চেহারায় ধূর্ততার আভাস।
ছেলেটা সব সময় একটা না একটা মতলব ভাজে, মনে মনে বলল গোয়েন্দাপ্রধান। ওর মতলবটা কী এখন?
রুডি কোটটা পরল। তারপর হাসি মুখে বারবার ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখাল।
খাইছে! ওর কি মাথাও ঘোরে না নাকি? ফিসফিস করে বলল মুসা।
সবাই ফ্লোরে চলো, ডাকল মিরা। কোথায় মডেলিং করবে দেখে নাও।
তিন গোয়েন্দা ওকে অনুসরণ করবে, এমনিসময় প্যাড আর কলম হাতে ওদের সামনে লাফিয়ে পড়ল শুঁটকি টেরি।
আমি কাপড়ের র্যাকের পেছনে লুকিয়ে ছিলাম, বলল ও। দারুণ একটা নিউজ হবে।
কীসের নিউজ? কিশোরের প্রশ্ন।
তুমি কোটটা পেয়েও হারালে।
শ্রাগ করল কিশোর।
তাতে কী?
তাতে এই, তুমি হিংসায় জ্বলে-পুড়ে মরছ। তুমি চাইবে প্রতিশোধ নিতে!
আবার শুরু হলো, ভাবল কিশোর, শুঁটকির নোংরা খেলা।
কোটটা আমার গায়ে লাগেনি, বলল কিশোর।
চলে এসো, কিশোর, বলল রবিন, বুঝতে পারছি ও ফালতু খবর রটানোর সুযোগ খুঁজছে।
স্টকরাম ত্যাগ করল ছেলেরা। প্রচুর লোকজনকে ঢুকতে দেখা গেল স্টোরে। ফ্যাশন শো দেখতে এসেছে।
স্টোরের চারধারে চোখ বুলাল কিশোর। মিসেস হগার্ড হেয়ার ব্যারেটের একটা ব্ল্যাক ঘোরাচ্ছেন। কেন শিপটন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নানারকম মুখভঙ্গি করছে।
এই কার্পেটটা হচ্ছে তোমাদের রানওয়ে, বলল মিরা। স্টকরূমের বাইরে পেতে রাখা লালরঙা লম্বা কার্পেটটা দেখাল।
রুডি একটা হাত উঠাল।
মডেলিং স্কুলে আমরা একে ক্যাটওয়ক বলতাম।
মিয়াও! মিয়াও! পেনি বেড়াল ডাকল।
হেসে উঠল মিরা।
রানওয়েতে হাঁটা-চলা প্র্যাকটিস করা যাক, বলল। মানি, পেনি, আগে তোমরা।
পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল যমজরা।
ওকে, বলল মানি। রেডি, সেট, গো!
সবার চোখের সামনে কার্পেটের উপর ছোটাছুটি শুরু করল দুভাই।
কী করছ কী তোমরা? মিরা জবাব চাইল।
রানওয়েতে দৌড়চ্ছি, জবাব দিল পেনি।
এটা নামেই রানওয়ে, শুধরে দিল মিরা। তোমরা আস্তে-ধীরে, সুন্দর করে হাঁটবে, সবাই যাতে তোমাদের ড্রেস দেখতে পায়।
সব কজন ছেলে-মেয়ের প্র্যাকটিস শেষ হলে দেয়াল ঘড়ি দেখল মিরা।
দুটো বাজে প্রায়, বলল ও। সবাই প্রথম প্রস্থ আউটফিট পরে ফেলল।
সবাই ছুটল স্টকরূমের দিকে। বাক্সের পিছনে গিয়ে কাপড় পাল্টাচ্ছে। জুতো, স্কার্ফ আর সোয়েটার উড়তে লাগল চারদিকে।
আমার ব্লু টাইটস কোথায়?
ভেস্টটা খুঁজে পাচ্ছি না!
কিশোর তার লাল জ্যাকেটটা পরছে। রবিন বেচারাকে সুট পরতে হবে। টাই বাঁধতে ওকে কসরত করতে হচ্ছে রীতিমত।
মুসা, হাঁক ছাড়ল। এদিকে একটু আসবে?
টাই বাধা সত্যি বড় ঝামেলার কাজ, কাজটা করে দিয়ে বলল মুসা।
কিশোর, সবার আগে তুমি, বলল মিরা। রেডি তো?
ধড়াস করে উঠল কিশোরের হৃৎপিণ্ড।
রেডি।
রীটা সিডি প্লেয়ার চালু করে দিল, কিশোর যেই ঘর থেকে বেরোবার জন্য পা বাড়াল।
লাল কার্পেটে পা রেখে চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল কিশোর। একটা চেয়ারও খালি পড়ে নেই। পেটের ভিতর প্রজাপতি উড়ছে ওর।
কিশোর ব্যাক-টু-স্কুল জ্যাকেটের মডেলিং করছে, শ্রোতাদের উদ্দেশে ঘোষণা করল মিরা।
লাল কার্পেটের উপর দিয়ে সাবধানে, ধীর গতিতে হাঁটছে কিশোর। শেষপ্রান্তে পৌঁছে মৃদু হেসে ঘুরে দাঁড়াল।
থ্যাংক ইউ, কিশোর, মিরা বলল।
কিশোর স্টকরূমে ফিরে যাচ্ছে, এ সময় যমজরা ওর গায়ের উপর এসে আছড়ে পড়ল।
সরোহ! চেঁচিয়ে উঠল মানি।
হাতে বেলুন নিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে গেল যমজরা।
এখন আপনাদের সামনে আসছে মানি আর পেনি, মিরার ঘোষণা এল। ওরা দেখাবে, যমজরাও আলাদা ড্রেস পরে।
ফ্যাশন শো-র বাকি সময়টুকু দারুণ উত্তেজনার মধ্যে কাটল। কিশোর আর রবিন আরও তিন ধরনের আউফিটের মডেল হলো।
এবার কালো ভেলভেট কোটের মঞ্চে আসার পালা।
সবাইকে একেবারে তাক লাগিয়ে দেব, আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ছে রুডির কণ্ঠে। ঝটপট কোটটা পরে নিয়ে বেরিয়ে গেল ও।
দেখা যাক ও কেমন করে, বলল মুসা।
তিন গোয়েন্দা স্টকরূমের ভিতর থেকে উঁকি মেরে চেয়ে রইল।
এবার আপনাদের সামনে আসছে, গর্ব ভরে বলল মিরা, আমাদের সেরা আউটফিট!
ঠোঁটে অহঙ্কারের হাসি নিয়ে, রানওয়ে ধরে গটগট করে হেঁটে গেল রুডি।
রবিন? মুসা? কিশোর ধীর কণ্ঠে বলল। আমি যখন কোটটা পরি তখন কি ওটার পেছনে ওই মস্ত ফুটোটা ছিল?
প্রশ্নই ওঠে না, দৃঢ়কণ্ঠে জানাল মুসা। চোখ ছানাবড়া।
কিশোরের বাহু চেপে ধরল রবিন। কে কাটল কোটটা?
কে জানে। কোটটার নীচে কালো লাইনিং আছে, ফিসফিস করে বলল কিশোর। হয়তো কারও চোখে পড়বে না।
কিন্তু ঠিক এসময় ছোট এক ছেলে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে।
মা, মা, দেখো! চেঁচিয়ে উঠল। কোটের পিছনে কত বড় ফুটো!
.
০৩.
খাইছে! বলে উঠল মুসা।
গোটা স্টোরে পিনপতন নিস্তব্ধতা। রুডি কাঁধের উপর দিয়ে কোটের পিছন দিকটা দেখার চেষ্টা করছে।
সুইস পনিরের মত দেখাচ্ছে, দর্শকদের মধ্য থেকে একটি মেয়ে বলে উঠল।
লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল রুডির। এক দৌড়ে ফিরে এল স্টকরূমে।
আজকের মত শো এখানেই শেষ হচ্ছে, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, ত্বরিত বলল মিরা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
স্টকরূমে ঢোকার সময় কিশোরকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় ফেলেই দিচ্ছিল রুডি।
সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে! চিৎকার করে বলল। কোটটা খুলে ফেলেছে গা থেকে। আমি সুপারমডেল হতে চেয়েছি-ক্লাউন নয়!
দর্শকরা তোমাকে দেখতে তো পেয়েছে অন্তত, খুরি গলায় বলল জুলি মরগ্যান।
ওর দিকে দুমুহূর্ত চেয়ে থাকল রুডি। তারপর দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
আমি দোষের কী বললাম? জুলি অবাক গলায় প্রশ্ন করল।
মিরা স্টকরূমে এসে ঢুকল। সোজা গিয়ে দাঁড়াল রুডির র্যাকের সামনে।
মেঝেতে এটা কেন? বলে একটা কাচি তুলে নিল। এটা তো আমার সিউয়িং বাস্কেটে থাকে।
তারমানে এই কাঁচিটা দিয়েই অপকর্মটা করা হয়েছে, মনে মনে বলল কিশোর।
কাজটা যে করেছে সে খোলাখুলি স্বীকার করো, বলল মিরা। কথা দিচ্ছি, আমি কিছু বলব না।
কেউ স্বীকার করল না দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিরা।
আমি সারা দিন স্টোরেই থাকব। কারও কিছু বলার থাকলে গিয়ে বলে এসো, কথাগুলো বলে ঘর ত্যাগ করল।
হাহ-হাহ-হা!
হাসির শব্দে ঘুরে তাকাল তিন গোয়েন্দা।
আমি জানতাম এরকম একটা কিছু ঘটবে। খুশি ধরছে না শুঁটকির।
তুমি এত নীচ! ঘৃণা ঝরল রবিনের কণ্ঠে। ফ্যাশন শো বরবাদ হয়ে গেল আর তুমি মজা পাচ্ছ!
কী করব বল, বলল শুঁটকি। প্যাড দোলাল। আমার দরকার ছিল গসিপ, পেয়েও গেছি।
একটু পরে ওকে ঘর ত্যাগ করতে দেখল তিন গোয়েন্দা।
ইচ্ছা করছিল কষে দুঘা লাগিয়ে দিই, দাতে দাঁত পিষে বলল মুসা।
বাদ দাও শুঁটকির কথা, বলল কিশোর। আমাদের সামনে অনেক কাজ পড়ে আছে।
কীরকম? রবিন জিজ্ঞেস করল।
জানতে হবে না, কে কোটটা কাটল?
ঝিক করে উঠল রবিনের দুচোখের তারা।
তারমানেই রহস্য, বলল হাসি মুখে।
কথায় আছে না, চেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, বলল মুসা।
ওর কথা শুনে হেসে ফেলল গোয়েন্দাপ্রধান।
মুসা এসময় হাতঘড়ি দেখল।
ড্যাডি একটু পরেই চলে আসবে আমাদের নিতে।
নো প্রব্লেম। আগে কাপড় পাল্টে নিই, তারপর ক্ল খুজব, বলল কিশোর।
অন্য মডেলরা বাড়ি চলে গেছে। রয়ে গেছে শুধু কিশোর, মুসা আর রবিন।
কিশোর আর রবিন পোশাক পাল্টাবার পর, একটা বাক্সের উপর বসল তিনজন।
ক্লু বলতে এখন পর্যন্ত ওই কাঁচিটাই, বলল গোয়েন্দাপ্রধান। নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল।
রবিনের মুখে চিন্তার ছাপ।
একটা ব্যাপার বুঝলাম না, কিশোর, বলল ও। ঘর ভর্তি লোকের মধ্যে কোটটা কাটল কে?
আর আমি তো সর্বক্ষণ এই স্টকরূমেই ছিলাম, জানাল মুসা।
হু, বলল কিশোর। কিন্তু মিরা আমাদেরকে যখন রানওয়েতে নিয়ে যায় তখন কিন্তু এখানে কেউ ছিল না। অন্তত পনেরো মিনিট।
কালপ্রিট তখনই সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ে এখানে, বলল মুসা।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
কাঁচিটা একটা জোরাল সূত্র। আরও কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখি এসো।
ছেলেরা পিছনের কামরাটা তন্নতন্ন করে খুঁজল। হঠাই তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল রবিন।
পেয়েছি। পেয়েছি!
কী পেয়েছ? সূত্র? কিশোর প্রশ্ন করল।
না! বলল রবিন। লাল রঙের এক বেরে টুপি তুলে ধরে দেখাল। আমার নতুন জ্যাকেটের সাথে ভাল মানাবে। সুন্দর না?
এই? হতাশ কণ্ঠে বলল মুসা। আমি ভাবলাম কী না কী।
আমরা ক্লু খুঁজছি, রবিন, বলল কিশোর। কাপড় না।
রবিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে টুপিটা রেখে দিল।
কালো কোটটা যে র্যাক থেকে ঝুলছিল তার নীচে চোখ রাখল কিশোর। পরমুহূর্তে চকচকে কিছু একটা দৃষ্টি কাড়ল ওর।
রবিন, মুসা, এদিকে এসো! জরুরী কণ্ঠে ডাকল বন্ধুদের।
চকচকে জিনিসটা কুড়িয়ে নিয়েছে গোয়েন্দাপ্রধান। বড় বড় মুক্তোখচিত সোনার এক ক্লিপ-অন ইয়ারিং।
চেনা-চেনা লাগছে না? বলল মুসা।
হাতের তালুর উপর ইয়ারিংটা গড়িয়ে দিল কিশোর।
হু। মিসেস হগার্ডের কানে এরকম ইয়ারিং দেখেছি।
কোট র্যাকের কাছে আসার ওঁর কী দরকার পড়ল? সপ্রশ্ন কণ্ঠে বলল রবিন।
আঙুল মটকাল মুসা।
কুকুরদের জন্য উনি কোটটা চাইছিলেন।
কিশোর ক্লুটা পকেটে রাখল।
প্রথম সাসপেক্টকে পাওয়া গেল, বলল ও নীচের ঠোঁটে চিমটি কেটে। মিসেস হগার্ড।
আর কে কাটতে পারে কোটটা? মুসার প্রশ্ন।
নিচু মনের কেউ, বলল রবিন।
ছেলেরা পরস্পর মুখ তাকাতাকি করল।
শুঁটকি! বলে উঠল একসঙ্গে।
শুঁটকি গুজব রটানোর জন্য ছোঁকছোঁক করে বেড়াচ্ছিল, বলল গোয়েন্দাপ্রধান। স্টোরি বানানোর জন্য ও নিজেই ওটা কেটে থাকতে পারে।
শুঁটকির নামটাও মনে গেঁথে নিল কিশোর।
কেন শিপটনকেও আমার সন্দেহ হচ্ছে, জানাল।
কেন শিপটন? জিজ্ঞেস করল রবিন। ও কোট কাটতে যাবে কেন?
ওর পেইন্টিঙের জন্য কালো ভেলভেটের দরকার, বলেছিল না? বলল কিশোর। তা ছাড়া ওকে আমি কোটটার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি।
মাথা দোলাল রবিন।
ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে কেসটা।
শুরুতেই তিনজন সাসপেক্ট আর দুটো কু পাওয়া বিরাট ব্যাপার, খুশি মনে বলল কিশোর। কাল আবার দেখা করছি আমরা। আলোচনা হবে কেসটা নিয়ে।
.
সেদিন সন্ধ্যায় মেরি চাচীকে সালাদ তৈরি করতে সাহায্য করছিল কিশোর।
সুপারমডেল হতে কেমন লাগল তোর? শসা কাটার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলেন চাচী।
লেটুস ছিঁড়ছিল কিশোর, মুখ তুলে চাইল।
মডেলিঙের কাপড়-চোপড় পরতে ভালই লাগে, চাচী, বলল ও। কিন্তু গোয়েন্দা আছি গোয়েন্দাই থাকতে চাই।
তারমানে চকচকে শু-র চেয়ে তোর ক্লু বেশি পছন্দ?
হেসে ফেলল কিশোর। কেসের কথাটা চাচীকে বলতে যাবে এসময় তোর বেলের শব্দ।
দেখ তো কে এল, বললেন চাচী। আমার হাত ভেজা।
যাচ্ছি, বলল কিশোর।
দরজার কাছে চলে এল ও। পীপ হোল দিয়ে উঁকি দিল। কেউ নেই।
কে? গলা চড়িয়ে বলল কিশোর।
সাড়া পেল না দেখে দরজাটা আস্তে আস্তে খুলল ও। দোরগোড়ায় পড়ে রয়েছে এক টুকরো কাগজ।
কী এটা?
ওটা তুলে নিয়ে গুঙিয়ে উঠল কিশোর। ডয়েল নিউজ। কাগজের শিরোনামে রয়েছে: গুজব! গুজব! গুজব!
শুঁটকি দ্রুত কাজে নেমে গেছে, ভাবল কিশোর। পড়তে গিয়ে মাথা ঘুরে উঠল ওর। লেখাটা বাংলা করলে দাঁড়ায়:
বলতে পারেন কোন তথাকথিত গোয়েন্দা ভেলভেটের চমৎকার কোটটা কেটেছে?- জনশ্রুতি, সে নাকি হিংসায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে, সে ফ্যাশন শোতে মডেলিংও করেছে। গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে তবে কি সে ইঁদুরের মত কাপড় কাটতে লেগেছে? খাসা! পাঠক, ভেবে দেখুন তো ছন্দে কীসের সঙ্গে মিলছে?
কিশোর কাগজটা থেকে মুখ তুলে ঢোঁক গিলল।
খাসা আর পাশা!
.
০৪.
পরদিন। মুসা আর রবিনের সঙ্গে কথা বলছে কিশোর।
শুঁটকি কোট কাটার জন্য আমাকে দায়ী করছে, দুঃখ করে বলল।
ওরা আজও ফ্যাশন হাউজে চলেছে, যদি আর কোন ক্লু পায়।
শুঁটকি তোমাকে দোষ দিচ্ছে কেন? মুসা প্রশ্ন করল।
কোটটা আমার পরার কথা ছিল, কিন্তু শেষমেশ রুডিকে পরতে দেয়া হ তাই।
যাকগে, নাম তো আর উল্লেখ করেনি শয়তানটা, রবিন বলল।
করার দরকার পড়েনি, জানাল কিশোর। ইঙ্গিতই যথেষ্ট।
মন খারাপ কোরো না, কিশোর, বন্ধুকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল মুসা। রকি বীচের কটা ছেলে-মেয়ে ওর ফালতু কাগজ পড়ে?
এসময় দুটো ছোট মেয়ে ওদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। কিশোরের দিকে চেয়ে মুখ টিপে হাসাহাসি করতে লাগল ওরা।
কিশোর পাশার কথাই লিখেছে, একজন বলল।
আমিও পড়েই বুঝতে পেরেছি, বলল অপরজন। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল দুজনে।
ভাল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল কিশোর।
মেইন স্ট্রীট ধরে হাঁটছে এখন তিন বন্ধু। রবিন আচমকা বাহু চেপে ধরল কিশোরের।
আমরা শুঁটকির কথা বলছিলাম না? বলল। ওই দেখো, ফ্যাশন হাউজ থেকে কে বেরোচ্ছে।
টেরিকে দেখা গেল এক মহিলার সঙ্গে বেরিয়ে আসছে দোকান থেকে। দেখে মনে হলো মহিলা ওদের গভর্নেস হতে পারে।
মহিলার হাতে প্রকাণ্ড এক শপিং ব্যাগ। শুঁটকির পনিটেইল হাঁটার ছন্দে লাফাচ্ছে।
কী কিনল, কে জানে, বলল রবিন।
শয়তান জাদুকরের হ্যাট আর ঝাড় হবে আর কী? আওড়াল মুসা।
কাছেই এক ফুড শপে গিয়ে ঢুকল মহিলা। শুঁটকি বাইরে দাঁড়িয়ে জানালায় চোখ রাখল। ও যেই ঘুরে দাঁড়াল, চমকে উঠল কিশোর।
মুসা! রবিন! জরুরী কণ্ঠে বলল। শুঁটকির পনিটেইলে একটা কালো বো। দেখে মনে হচ্ছে ভেলভেট।
কোটের সেই ভেলভেট নয় তো? মুসার জিজ্ঞাসা।
ওটা হলে তো হাতেনাতে ধরেই ফেলব।
এখান থেকে দেখে কী মনে হচ্ছে, ওটাই? রবিন জানতে চাইল উত্তেজিত কণ্ঠে।
কোটের ভেলভেটটা ছিল পুরু আর মোলায়েম, জানাল কিশোর। জীবনেও ভুলব না।
মুসা চোখ সরু করে রাস্তার ওপারে চেয়ে রয়েছে।
ওর ঘাড়টা চেপে ধরে কেড়ে নিয়ে আসি বো-টা? দাঁতের ফাঁকে বলল।
না, না, আপত্তি করল কিশোর। কাজটা কৌশলে সারা যায় কিনা দেখো।
সেটা সম্ভব ও যদি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে তবেই, বলল রবিন। কিন্তু শুঁটকি তো সর্বক্ষণ ছটফট করছে।
এসময় ফ্যাশন হাউজের জানালায় চোখ সেঁটে গেল কিশোরের। পুরোদস্তুর পোশাক পরা একটা ম্যানিকিন। ঠিক ওদের বয়সী একটি কিশোরের মত লাগছে। ওটাকে দেখেই বুদ্ধি খেলে গেল গোয়েন্দাপ্রধানের মাথায়।
শুঁটকিকে ঠায় দাঁড় করিয়ে রাখার একটা উপায় পেয়েছি, ধীরে ধীরে বলল ও।
কীভাবে? রবিন কৌতূহলী হলো।
ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াল কিশোর।
রবিন, ডামি সাজবে?
মানে?
মানে খুব সোজা-ম্যানিকিন, বলল কিশোর।
বলতে চাইছ আমাকে পুতুলের মত কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?
হাসল কিশোর।
আমিও থাকব, বলল। ও যদি ফাঁদে ধরা দেয় তবেই কেল্লা ফতে। মুসা। ওর মাথা থেকে খুলে নেবে বো-টা।
পারবে না, মুসা? রবিন বলল। আলগোছে ওর পিছনে গিয়ে এক টানে খুলে নিতে?
পারব না মানে, বলে উঠল মুসা। পায়ের দিকে আঙুল ইশারা করল। স্নিকার পরি কী করতে?
মুসা এপারে অপেক্ষা করতে লাগল। ওদিকে, কিশোর আর রবিন তড়িঘড়ি হেঁটে চলে এল শুঁটকির কাছে।
হাই, টেরি, বলল কিশোর।
শুঁটকি ঘুরে দাঁড়ালে ওর কালো বো নড়ে উঠল।
আমার আজকের গসিপ কলামটা দেখেছ? বাঁকা হেসে প্রশ্ন করল।
দেখেছি, বলল কিশোর। কিন্তু কাকে নিয়ে লিখেছ তা বুঝিনি।
আমিও বুঝিনি, সায় জানিয়ে বলল রবিন।
কিশোর তিন পর্যন্ত গুণল। তারপর কাঠ-পুতুল বনে গেল। ওর দেখাদেখি একই কায়দা ধরল নথিও।
এ আবার কী? শুঁটকি অবাক।
বুঝতে পারলে না? মাথায় দুহাত রেখে বলল রবিন। আমরা ডামি।
তাতে কোন সন্দেহ নেই, তীব্র তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল শুঁটকি।
আমরা ম্যানিকিন, শুধরে দিল কিশোর।
কী কারণে, জানতে পারি? সুর করে প্রশ্ন করল শুঁটকি।
মিরা আমাদেরকে ওর জানালায় দাঁড়িয়ে কাপড়ের মডেলিং করতে বলেছে, বলল গোয়েন্দাপ্রধান। তাই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা প্র্যাকটিস করছি।
শুঁটকি ওর কথায় কান না দিয়ে হাঁটা ধরল।
পাগলামি আর কাকে বলে!
তা তো বলবেই, ফুট কাটল কিশোর। করে দেখতে গেলে বোঝা যায় কত কঠিন।
তোমার দ্বারা সম্ভব না, যোগ করল রবিন।
থমকে দাঁড়িয়ে গেল শুঁটকি।
কী বলতে চাও তোমরা? খেঁকিয়ে উঠল। পারি কিনা দেখতে চাও? পরমুহূর্তে, শূন্যে হাত দুটোকে নিথর রেখে চিবুক সোজা করল ও।
দারুণ তো! প্রশংসা করল কিশোর মনে মনে। শুঁটকি মুসার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছে বলে আরও খুশি হলো।
দেখি কতক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারো, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল ও।
চোখের কোণে লক্ষ করল মুসা রাস্তা পার হচ্ছে। পা টিপে টিপে শুঁটকির দিকে এগোচ্ছে ও।
সব ঠিকঠাক, ভাবল কিশোর।
হঠাৎ জোরাল গুঞ্জনের শব্দ কানে এল ওর। মাথার উপরে একটা মাছি চক্কর কাটছে!
ভনন! ভনন! ভনন!
হাত নেড়ে ওটাকে সরাতে চাইছে কিশোর। কিন্তু ওকে তো কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
ঠিক ওর নাকের ডগায় এসে বসল মাছিটা।
জলদি করো, মুসা-বলল মনে মনে। নাক চুলকাচ্ছে, অথচ হাত দেওয়ার উপায় নেই। জলদি!
কিন্তু হলো না। নাক সুড়সুড় করে উঠলে হাঁচি পেয়ে গেল ওর।
ওকে হাঁচতে দেখে চমকে উঠল রবিন। ফলে, দুজনেরই ভঙ্গি গেল বদল হয়ে।
এসময় চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল শুঁটকি।
মুসা আমান! চেঁচিয়ে উঠল। তুমি আমার পিছনে কী করছ?
শ্রাগ করল মুসা। হাতে ওর কালো বোটা। আমার বো! বলে পিছনে হাত দিয়ে পনিটেইল স্পর্শ করল শুঁটকি। তুমি আমার ভেলভেট বো চুরি করেছ!
০৫.
মুসা তোমার বো চুরি করেনি, জোর দিয়ে বলল কিশোর।
করেছে! গর্জন ছাড়ল পুঁটকি। আর তুমি ওকে দিয়ে চুরিটা করিয়েছ!
আমি? বলল কিশোর।
শুঁটকি মাথা ঝাঁকাল।
জি। তুমি যে শুধু কাঁচি চালাও তাই না, তুমি একটা চোরও!
কিশোর ছোঁ মেরে মুসার হাত থেকে বো-টা কেড়ে নিল।
আমি যদি কাঁচি চালাই, তা হলে এটা কী?
শুঁটকির নাকের সামনে বো-টা দোলাচ্ছে, এসময় এক টুকরো কাগজ দেখতে পেল কিশোর-পিছনে স্ট্যাপল করা। ফ্যাশন হাউজের প্রাইস ট্যাগ।
একটু আগে কিনেছি ওটা, ঐ কুঁচকে বলল শুঁটকি। বাইরে এসে পরেছি। ওটা দিয়ে দাও বলছি!
আঙুলে বো-টার স্পর্শ নিল কিশোর। ওই কোটটার মত পুরু আর মোলায়েম নয়।
সরি, টেরি, বলে বো-টা বাড়িয়ে দিল কিশোর। আমরা আসল কাট আপকে ধরতে চাইছি বলে নাটকটা করতে হলো।
থাবা মেরে কেড়ে নিল জিনিসটা শুঁটকি।
তাকে ধরতে আবার এসব করতে হয় নাকি? আমি তো কাগজে সূত্র দিয়েই দিয়েছি।
ছেলেরা পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল।
ইন ফ্যাক্ট, বলে নাক উঁচু করল বঁটকি। আমি ডয়েল নিউজকে ডেইলি পেপার করব ভাবছি। যাতে প্রতিদিন গসিপ কলাম লিখতে পারি।
খাইছে! আওড়াল মুসা।
শুঁটকি বো-টা বেঁধে নিল লম্বা চুলে। তারপর যার সঙ্গে এসেছিল, সেই মহিলাকে বেরোতে দেখে এগিয়ে গেল।
চলো, আমরা ফ্যাশন হাউজে যাই, প্রস্তাব করল কিশোর। মিরা হয়তো তদন্তের কাজে হেল্প করবে আমাদের।
কিন্তু ওরা যখন স্টোরের ভিতরে ঢুকল, মিরা ওদেরকে ক্লু দিতে রাজি হলো না।
একবার শুধু একটু উঁকি মেরেই চলে আসব, বলল রবিন।
মাথা নেড়ে সাফ নিষেধ করে দিল মিরা।
এখন থেকে স্টকরূম বন্ধ থাকবে।
ও, আচ্ছা, বলল গোয়েন্দাপ্রধান। স্টোরের সামনের দিকে হেঁটে এসেছে, জুয়েলারি কাউন্টারের উপর একটা কাগজ চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে দেখতে পেল। ডয়েল নিউজের একটা কপি।
তাই তো বলি, ফিসফিস করে বলল কিশোর। মিরাও আমাকে সন্দেহ করছে!
শুঁটকির মাথাটা ভেঙে দিতে ইচ্ছা করছে আমার! দাঁত কিড়মিড় করে বলল মুসা। ওকে হাতের কাছে পেলে দেখে নিতাম।
দোকান ত্যাগ করল ওরা। বাইরে এসে এক বেঞ্চির উপর বসল।
শুঁটকিকে সন্দেহ তালিকা থেকে বাদ দেয়া যায়, বলল গোয়েন্দাপ্রধান।
তারপরও দুজন থাকে, বলল রবিন। মিসেস হগার্ড আর কেন শিপটন।
কেন তোমার বাসার কাছেই থাকে, কিশোর, বলল মুসা। লাঞ্চের পর ওকে চেক করলে হয় না?
লাঞ্চের পর কিশোর তো প্রায়ই বাঘাকে নিয়ে হাঁটতে বেরোয়, বলল রবিন। ঠিক না, কিশোর?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। পরমুহূর্তে মাথায় একটা বুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে গেল ওর।
মানি আর পেনি তো কুকুর ভালবাসে, তাই না? বন্ধুদের উদ্দেশে বলল।
হ্যাঁ, একসঙ্গে জানাল রবিন ও মুসা।
ওরা যখন বাঘাকে আদর করবে, সেই সুযোগে আমরা কেনের ওপর তদন্ত চালাব, বাতলে দিল কিশোর।
সাবাস! বলে উঠল মুসা।
.
কিশোরের বাসায় ফিরে এল তিন বন্ধু। মেরি চাচী রবিন ও মুসাকে খেয়ে যেতে বললেন। ওরা বাসায় ফোন করে অনুমতি নিয়ে নিল।
মেরি চাচীর বানানো টিউনা সালাদ স্যান্ডউইচ চিবোতে চিবোতে বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। বাঘাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এল কেন শিপটনদের ব্লকে।
ওর ঘরটা সার্চ করতে না হলেই বাঁচি, বলল রবিন।
ওর পোষা ইগুয়ানার জন্য বলছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না, বলল রবিন। নাক টিপে ধরল। ওর মোজার দুর্গন্ধের জন্য।
ওরা গিয়ে দেখল মিসেস শিপটন বাগান পরিচর্যা করছেন। ওদেরকে দেখে হাসলেন ভদ্রমহিলা, বাঘাকে হাত বুলিয়ে আদর করলেন।
কেমন আছ তোমরা? কুশল জানতে চাইলেন।
ভাল, মিসেস শিপটন, বলল কিশোর। কেন, মানি, পেনি ওরা বাসায় আছে?
হ্যাঁ, জানালেন তিনি। মানি-পেনি উপরতলায় ফিঙ্গার পেইন্টিং করছে। কেন আছে পিছনের উঠনে। ও-ও আঁকাআঁকি করছি।
কেন কি তেলাপোকা আঁকছে? নাক কুঁচকে প্রশ্ন করল রবিন।
হ্যাঁ, বললেন মিসেস শিপটন। কালো রঙের কীসের ওপরে যেন।
কালো? চমকে গেল কিশোর।
মিসেস শিপটন, স্বাভাবিক গলায় বলল ও। আমরা কেনের সাথে একটু কথা বলে আসি?
মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন মিসেস শিপটন।
বেশ তো, যাও না। ও খুশি হবে বন্ধুদের দেখলে।
বন্ধুদের শুনে শ্বাস টানল মুসা, স্পষ্ট শুনতে পেল কিশোর।
ধন্যবাদ, মিসেস শিপটন, বলল ও। শিকল ধরে টানল বাঘাকে।
বাড়িটাকে এক পাক দিয়ে পিছনে এল ওরা।
ওই যে! গলা খাদে নামিয়ে বলল কিশোর।
ইজেল সামনে নিয়ে বসেছে কেন শিপটন। পাশে ছোট টেবিলের উপর। কাঁচের এক জার রাখা।
দিলে তো আলো বন্ধ করে, তিন গোয়েন্দা কাছিয়ে এলে বিরক্তির সুরে বলল কেন। আর আমার বিলিকেও ভয় পাইয়ে দিয়েছে তোমাদের কুকুরটা।
বিলি কে? কিশোরের প্রশ্ন।
কাঁচের জারটা দেখাল কেন। জারের ভিতরে ইয়া বড় এক তেলাপোকা।
ঘেন্নায় নাক কুঁচকে গেল রবিনের।
লোকে বিলিকে পানির পোকা বলে, ব্যাখ্যা করল কেন। কিন্তু আমি ওকে স্রেফ একটা বড়সড় তেলাপোকা মনে করি।
কালো এক টুকরো জিনিসের উপর তেলাপোকাটাকে আঁকছে কেন দেখে নিল কিশোর।
নীচের দিকে চোখ গেলে আরেকটা জিনিস নজরে এল। কেন শিপনের পাশে একই ধরনের জিনিসের আরেকটা ছোটখাট তূপ।
কালো ভেলভেটের উপর আঁকছে নাকি, কেন? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
পেইব্রাশ তুলে ধরল কেন।
হতেও পারে, নাও হতে পারে, বলল।
কিশোর হাত বাড়াল জিনিসগুলোর উপর।
কোথায় পেয়েছ?
কেন শিপটন তার আগেই ধপ করে বসে পড়ল ওগুলোর উপর।
তাতে তোমার কী? পাল্টা প্রশ্ন করল।
মুসা এগিয়ে এল কেনের কাছে।
গতকাল ফ্যাশন হাউজে যে ভেলভেটের কোটটা কাটা হয়েছে এগুলো সেই কাপড়।
তুমি কেটেছিলে ওটা, কেন? কিশোর জবাব চাইল।
শ্রাগ করল ছেলেটি।
হয়তো, হয়তো নয়।
বাঘা দৌড়ে গেল। কেন বসেছে, সেই আসনটা কামড়ে ধরে টানতে লাগল।
অ্যাই, সরাও ওকে! চেঁচিয়ে উঠল কেন।
কিশোর বাঘাকে সরিয়ে নেবে, এ সময় কারা যেন খিলখিল করে হেসে উঠল।
যমজ ভাইদেরকে ডাক দিল কেন শিপটন। কুকুরটাকে দেখে যাও।
ছেলেরা ঘুরে দাঁড়াল। যমজ ভাইরা বাড়ির পিছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখছে।
পরমুহূর্তে কুকুর দেখে সোৎসাহে ছুটে এল।
সভয়ে শ্বাস চাপল কিশোর। রঙমাখা হাত নিয়ে ছুটে আসছে দুভাই।
.
০৬.
করো কী! করো কী! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বাঘাকে নানা রঙে রঙিন করার খেলায় মেতে গেল যেন দুভাই। শীঘি সবুজ, লাল, হলদে ডোরা আঁকা হয়ে গেল বাঘার সারা গায়ে।
হয়েছে, হয়েছে! বলে মুসা যমজদের টেনে সরিয়ে দিল।
কিশোর কেন শিপটনের পেইন্টিংটা কেড়ে নিয়ে শূন্যে তুলে ধরল।
দিয়ে দাও বলছি! কেন গর্জে উঠল।
আগে বলো কালো কাপড়টা কোথায় পেয়েছ, বলল কিশোর।
বলছি, বলছি, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল কেন। এত যখন শোনার শখ।
কালো জিনিসটা তুলে নিল কেন। ঝাড়া দিল বার কয়েক। অসংখ্য ফুটো দেখা গেল ওটার মধ্যে।
এটা ছিল আমার জাদুকরের আলখেল্লা, বলল ও। যখন আমি গ্রেট ম্যাজিশিয়ান হতে চাইতাম।
কাটলে কেন? রবিনের প্রশ্ন।
রেখে কী লাভ? বলল কেন। আমি তো এখন বড় শিল্পী।
কিশোর ভাল মত স্পর্শ করে দেখল কাপড়টা। ভেলভেট নয়। হতাশ হয়ে পড়ল ও।
এবার দয়া করে আমাকে একটু কাজ করতে দাও, বলল কেন শিপটন। কালকে বিকেলে আমার প্রথম আর্ট শো কিনা।
শিয়োর, বিমর্ষ কণ্ঠে বলল কিশোর।
আমরা তোমাকে আর বিরক্ত করব না, বলল মুসা।
বাঁচালে, হাঁফ ছেড়ে বলল কেন শিপটন।
কেন আর যমজদের কাছ থেকে বিদায় নিল তিন গোয়েন্দা। বাইরে বেরিয়ে এল।
কেন শিপটন একদম পরিষ্কার, বলে বাঘার দিকে চাইল কিশোর। কিন্তু বাঘা নয়। শুঁটকি শত্রু
এখন বাকি থাকলেন শুধু মিসেস হগার্ড, বলল রবিন।
এখনই যাব আমরা, কিশোর? মুসা জিজ্ঞেস করল।
মাথা নাড়ল গোয়েন্দাপ্রধান।
কালকে যাই, প্রস্তাব করল। বাঘাকে গোসল করাতে হবে তো।
নোংরা একটা থাবা মাথায় রাখল বাঘা, তারপর জোরে বার দুয়েক হুফ-হুঁফ করে উঠল।
.
একদম নড়বি না, চুপ করে বসে থাক! ইয়ার্ডে বাঘার গা ঘষছে কিশোর, চলে গেছে বাসায়।
বিশাল মেটাল বেসিনটা থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এল বাঘা। সারা গায়ে সাবা, মাখা।
হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল কিশোর। লাল-হলুদ-সবুজ রং এখনও লেগে রয়েছে বাঘার লোমে।
ঠিক আছে, বাঘা, আমাকে গোসল করাতে দিলি না তো, বলল কিশোর, কালকে তোকে ড্যাশিং ডগ পেট সেলুনে নিয়ে যাব। তারপর দেখব বিদঘুঁটে রং নিয়ে ঘুরিস কী করে।
এই কথা শুনে বাঘা গা ঝাড়া দিল। ছিটকে সরে গেল কিশোর।
আর এসময় কার যেন তীক্ষ্ণ চিৎকার ওর কানে এল। মুখ তুলে চেয়ে দেখে সাবান-পানির ছিটে মেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে রুডি মার্শ।
রুডি!
থ্যাংকস আ লট, কোনমতে আওড়াল রুডি। দিলে তো ধোয়া কাপড়টার বারোটা বাজিয়ে।
বাঘা আসলে বুঝতে পারেনি, সাফাই গাইল কিশোর।
কিন্তু তুমি পেরেছিলে,কাটখোট্টা জবাব দিল রুডি।
তারমানে?
তুমি বুঝেশুনে ঠাণ্ডা মাথায় কালো কোটটা কেটে দিয়েছিলে, বলল রুডি। কেননা তুমি ওটা পরতে পারেনি। রকি বীচের সব ছেলে-মেয়েরা এই কথাই বলছে।
চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল কিশোরের। গুজবটা এভাবে বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়বে ভাবতে পারেনি ও।
ওরা ফালতু কথা বলছে, রুডি, বলল ও মৃদু কণ্ঠে। আমি কখনোই অমন ছোটলোকি কাজ করব না।
অথচ করেছ, চিবুক বাড়িয়ে দিয়ে বলল রুডি। এবং একাজে অন্যদের সাহায্যও নিয়েছ।
এক কপি ভেজা ডয়েল নিউজ তুলে ধরল রুডি।
পড়ে দেখো!
গসিপ ছাপা হয়েছে প্রথম পৃষ্ঠায়। জোরে জোরে পড়ল কিশোর: প্রিয় বন্ধুর জন্য কারা সব কিছু করতে প্রস্তুত? সূত্র দিচ্ছি: সাদা-কালো।
কান গরম হয়ে গেল গোয়েন্দাপ্রধানের। রবিন আর মুসার প্রতি ইঙ্গিত করেছে শুঁটকি।
একদম বাজে কথা! দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করল ও। কিন্তু রুডি মার্শ ততক্ষণে দুপ দাপ পা ফেলে গেটের দিকে চলেছে।
কিশোর হাঁটু গেড়ে বসে বাঘার ভেজা শরীরে হাত বুলোতে লাগল।
রহস্যটার কিনারা না করলেই নয়, মনে মনে বলল। শুঁটকি আমার প্রিয় বন্ধুদের ঘাড়েও দোষ চাপিয়েছে!
.
সে রাতে চাচা-চাচীর সঙ্গে ডিনারে বসে প্রসঙ্গটা তুলল কিশোর।
চাচা, শুঁটকি একটার পর একটা মিথ্যে গুজব রটাচ্ছে। কী করব আমি?
তোর উচিত মাথা গরম না করা, পরামর্শ দিলেন চাচা। চিকেনে গোলমরিচের গুঁড়ো ছিটালেন। সত্য কখনও চাপা থাকে না।
তোর চাচা ঠিক কথাই বলেছে, বললেন মেরি চাচী। দেখিস, মিথ্যে বেশিদিন টিকবে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর। ষড়যন্ত্রের জাল যত শীঘি ছিন্ন হয় ততই মঙ্গল।
.
পরদিন সকালে মুসা আর রবিনের সঙ্গে দেখা করল ও। বাঘাকে নিয়ে ড্যাশিং ডগ পেট সেলুনের উদ্দেশে রওনা হলো ওরা।
শুঁটকির এতদূর বাড় বেড়েছে যে সাদা-কালোর কথা পর্যন্ত তুলে ফেলেছে ক্রুJদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল রবিন।
ওর যা খুশি বলুক,বন্ধুকে শান্ত করার জন্য বলল মুসা। আমাদের কী?
মেইন স্ট্রীট দিয়ে হাঁটছে ওরা। সাইডওয়কে রঙিন চকে লেখা একটা মেসেজ চোখে পড়ল কিশোরের। লিখেছে; কিশোর পাশার নাম এখন থেকে কোট-কাটা কিশোর।
কিশোরকে মাথা নাড়তে দেখে ওর হাত চেটে দিল বাঘা।
গুজবটা ওরা মেইন স্ট্রীটেও পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছে!
ড্যাশিং ডগে গিয়ে ঢুকল ছেলেরা।
কিশোর আগে এখানে আসেনি। গোলাপি রঙের আসবাব দিয়ে সাজানো সেলুনটা। সুন্দর সব কুকুরের ছবি সেঁটেছে দেয়ালে।
হ্যালো। আমার নাম রয়, ডেস্কের পিছনে বসা লোকটি বলল। কী দরকার বলো।
ইঙ্গিতে বাঘাকে দেখাল কিশোর।
লোকটি বহুবর্ণ বাঘার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।
এসময় দরজা খুলে গেল।
আরে, মিসেস হগার্ড যে! বলে উঠল লোকটা। আসুন, আসুন।
চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল কিশোর।
দরজার কাছে, কোলে খুদে কুকুর দুটো নিয়ে দাঁড়িয়ে মিসেস হগার্ড।
কুকুর দুটোর গায়ে ছোট লাল কোট-আর গলায় দামি চকচকে কালো ভেলভেটের কলার!
.
০৭.
কিশোর, ফিসফিস করে বলল মুসা। দেখেছ?
উপরে-নীচে মাথা নাড়ল কিশোর। মিসেস হগার্ডের দিকে চেয়ে রয়েছে। ভদ্রমহিলা কথা বলছেন রয়ের সঙ্গে।
বেশ গরম লাগছে এখানে, বললেন মিসেস হগার্ড।
একেই বোধহয় বলে আগস্টের ডগ ডে, বলল রয়।
আমার কাছে সারা বছরই ডগ ডে! কুকুর দুটোকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বললেন ভদ্রমহিলা।
জলদি লুকিয়ে পড়ো, কিশোর বলল বন্ধুদের উদ্দেশে। আমি চাই না উনি আমাদেরকে দেখে ফেলুন।
বাঘার শিকল ধরে টান দিল কিশোর। ঘাপটি মারল গোলাপি রঙের এক পর্দার পিছনে। ওর দেখাদেখি একই কাজ করল মুসা ও রবিন।
কিশোর! গলা নামিয়ে ডাকল রবিন। আমরা একা নই। দেখেছ!
ঘুরে তাকাল কিশোর। উঁচু টেবিলে বসে দুটো কুকুর। কোকড়াচুলো এক পুড়ল, আর তোয়ালে মোড়া এক বুলডগ।
শশ, কুকুর দুটোকে লক্ষ্য করে বলল কিশোর। ঠোঁটে আঙুল রেখেছে।
বিশ্বাস করতে পারো, মিসেস হগার্ডের কুকুরদের গলায় কালো ভেলভেটের কলার! মুসা ফিসফিসে কণ্ঠে বলল।
হু, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। দেখা যাক, ঘটনা কদ্দুর গড়ায়।
হঠাৎ মৃদু এক গর্জন কানে এল ওদের। নীচের দিকে তাকাল কিশোর। ছোট্ট এক ইয়র্কি পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে।
মিসেস হগার্ডের ঝাড়ন, বলল মুসা। এই যা, ভাগ!
অপর ইয়র্কিটাও এসে উঁকি মারছে। গা গুঁকছে বাঘার। এবার ডাক ছাড়তে শুরু করল।
খাইছে!
কী হচ্ছেটা কী ওখানে? সামনে থেকে শোনা গেল রয়ের গলা।
বাঘা পাল্টা ঘেউ-ঘেউ করে পর্দার নীচ দিয়ে সঁত করে বেরিয়ে গেল। তিন গোয়েন্দা ওর পিছু-পিছু ছুটল।
বাঘা, ফিরে আয় বলছি! কিশোর হাঁক ছাড়ল।
খুদে ইয়র্কি দুটো বাঘাকে তাড়া করে বেড়াতে লাগল ওয়েটিং রূম জুড়ে।
এক মহিলা ম্যাগাজিন পড়ছিলেন, চেঁচিয়ে উঠলেন। এক ভদ্রলোক তাঁর চিহুয়াহুয়া চেপে ধরলেন বুকের সঙ্গে।
কুকুর তিনটে সোফা আর চেয়ার টপকে ছুটে বেড়াচ্ছে।
ওই, ধাড়ি কুকুরটা আমার সোনামণিদেরকে তাড়া করছে! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস হগার্ড।
ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো! বাঘাকে ধরার চেষ্টারত কিশোর বলল।
কুকুরগুলোর লাথি খেয়ে এদিক-সেদিক উড়ছে ম্যাগাজিন। কোনদিকে হৃক্ষেপ নেই ওদের। ঘরময় ছোটাছুটি করেই চলেছে। তার সঙ্গে সমান তালে চলেছে হাঁক-ডাক।
স্টপ! গর্জে উঠল রয়। ডাউন! হীল!
ইয়র্কি দুটো বাঘার গায়ে লাফিয়ে উঠে ঘেউ-ঘেউ করতে লাগল। বাঘা কেউ-কেঁউ করে নালিশ জানাল। শেষমেশ আর না পেরে দৌড়ে এসে আশ্রয় নিল কিশোরের কাছে। ওর মাথা চাপড়ে আদর করল কিশোর। ওদিকে মিসেস হগার্ড তার কুকুরছানাদের পরম আদরে কোলে তুলে নিলেন।
আমার সোনামণিদের কোট আরেকটু হলেই ছিঁড়ে দিয়েছিল ধাড়িটা, চোখ পাকিয়ে বললেন।
মুসার হাতে বাঘার শিকলটা ধরিয়ে দিল কিশোর। গিয়ে গেল মিসেস হগার্ডের কাছে।
কালো কলার দুটো কোথায় পেলেন, মিসেস হগার্ডঃ
তোমার চাই নাকি? জবাবটা দিল রয়। আরও আছে আমার কাছে।
কিশোর ঘুরে দাঁড়াল।
আমার ডগি ফ্যাশন কালেকশনের কোট ওগুলো, জানাল রয়। আজ ডিসপ্লে দেব। বলে একটা বাক্স ডেস্কের নীচ থেকে টেনে বের করল।
বাক্সের ভিতর উঁকি দিল কিশোর। খুদে হ্যাট, সোয়েটার আর কোটে ঠাসা ওটা। অনেকগুলোরই দেখা গেল কালো ভেলভেটের কলার।
রয় কাল আমাকে এগুলো দেখিয়েছে, বললেন মিসেস হগার্ড। কালো ভেলভেটের কলারওয়ালা কোট দেখেই মনে ধরে যায় আমার।
তা হলে ফ্যাশন হাউজের কালো কোটটা কিনতে চাইছিলেন কেন? কিশোর প্রশ্ন করল।
ওটা তো দারুণ দেখতে, বললেন ভদ্রমহিলা। আমার নাতনীকে খুব মানাত।
আপনার নাতনী? বলে পকেট থেকে মুক্তার ইয়ারিংটা বের করে দেখাল কিশোর। কালকে এটা ফ্যাশন হাউজে পেয়েছি আমরা।
ইয়ারিং দেখে হাসলেন মিসেস হগার্ড।
কোটের সাইয দেখছিলাম, বললেন। তখন হয়তো পড়ে গেছে। স্টকরূমে তখন আমি ছাড়া কেউ ছিল না।
আচ্ছা, তা হলে ব্যাপারটা এই, মনে মনে বলল কিশোর। ইয়ারিংটা ফিরিয়ে দিল।
আচ্ছা, চলি, বললেন মিসেস হগার্ড। রয়কে দেখাতে এসেছিলাম আমার সোনামণিদের নতুন পোশাকে কেমন দেখাচ্ছে।
সেলুন ত্যাগ করছেন তিনি, খুদে কুকুর দুটো শেষবারের মত ঘেউ-ঘেউ করে গেল বাঘার উদ্দেশে।
আমার কাছে চমৎকার এক ডেনিম জ্যাকেট আছে, বলে হাতে হাত ঘষল রয়। বাঘাকে খুব মানাবে। দেখাব?
দরকার নেই, জানাল কিশোর। গোসল করালেই ওর রূপ খুলে যাবে।
বাঘার শিকল ধরল রয়।
এক ঘণ্টা পরে এসে নিয়ে যেয়ো।
ড্যাশিং ডগ ত্যাগ করল ছেলেরা।
মিসেস হগার্ডও ফসকে গেল, হতাশ কণ্ঠে বলল রবিন। এখন আর বাকি থাকল কে?
নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল গোয়েন্দাপ্রধান।
কেউ না। অথচ যা করার শীঘি করতে হবে, বলল। নইলে শুঁটকি যাতা কথা লিখতেই থাকবে।
মেইন স্ট্রীট ধরে হাঁটছে, ছোটখাট এক জটলা চোখে পড়ল ওদের।
কী হচ্ছে ওখানে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
আর্ট শো, বলে কাছিয়ে গেল কিশোর।কেন শিপটনের আর্ট শো!
সাইডওয়কে সারি দিয়ে রাখা কেনের আর্টওয়র্ক। পিঁপড়ে, ফড়িং অবশ্যই বিলির ছবি শোভা পাচ্ছে সেখানে।
তুমি কোথা থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছ? এক লোক শিল্পীকে প্রশ্ন করল।
বিলির কাঁচের জারটা উঠিয়ে দেখাল কেন।
পাথরের তলা থেকে।
কিশোর লক্ষ করল একটা পেইন্টিং অন্যগুলোর চাইতে আলাদা। পোকা মাকড়ের বদলে বাদামী-সাদা এক ছোপ।
রবিনেরও দৃষ্টি কেড়েছে ছবিটা।
কেউ মনে হয় পোকাটাকে মাড়িয়ে দিয়েছিল, বলল।
পোকার মত লাগছে না আমার কাছে, কিশোর বলল।কাছ থেকে খুঁটিয়ে পরখ করল। বাদাম আর চকোলেট চিপ ছিটিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্রলেপটা। আইসক্রীম।
মুসা একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে ছোপটার দিকে।
খাইছে! পাণ্ডা বার আইসক্রীম! চেঁচিয়ে উঠল ও।
আর খেয়াল করে দেখো, বলল কিশোর। ছবিটার নীচে কেন, শিপটনের সই নেই। আছে মানি আর পেনির।
কালো পটভূমিটা পরিচিত ঠেকল কিশোরের চোখে। হাত বাড়াল ছোঁয়ার জন্য। পুরু আর মোলায়েম।
রবিন। মুসা! উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল কিশোর। এটাই সেই কালো কোটের ভেলভেট!
.
০৮.
খপ করে কে যেন চেপে ধরল কিশোরের কব্জি। চেয়ে দেখে মানি। হাসছে কান অবধি।
হাত ছাড়িয়ে নিল কিশোর। পাণ্ডা বার আইসক্রীমের ছবিটা দেখিয়ে বলল, ওটা এল কোত্থেকে?
গর্বের হাসি হাসল মানি।
কেনের প্রদর্শনীতে সুযোগ পেয়ে ঢুকে পড়লাম।
তোমার পছন্দ হয়েছে? পেনি জিজ্ঞেস করল।
না, সাফ জবাব দিল কিশোর। চেরি ভ্যানিলা পাণ্ডা বার হলে পছন্দ হত।
পরস্পর মুখ তাকালাকি করল যমজরা। চোখে হতাশা।
ওটা তো আইসক্রীমের দাগ, তাই না? গোয়েন্দাপ্রধানের কণ্ঠে কৈফিয়ত তলবের সুর।
না তো! ফস করে বলে দিল মানি।
তা হলে কী ওটা? মুসার জিজ্ঞাসা।
উম…মেরু ভালুক, পেনি জানাল।
কাদা-ধসের মধ্যে পড়ে গেছে, জোগান দিল মানি।
কিশোর কালো ভেলভেটের দিকে আঙুল তাক করল।
বুঝলাম, কিন্তু ওই কালো ভেলভেট এল কোত্থেকে?
এটাই তো সেই ফ্যাশন হাউজের কোটের কাপড়টা, জোর দিয়ে বলল রবিন।
যমজরা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াল। চোখে-মুখে আতঙ্ক।
মানি, পেনি, ফালতু প্রশ্নের জবাব দেয়ার দরকার নেই। হঠাৎ শোনা গেল পরিচিত এক কণ্ঠ।
চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। পিছনে দাঁড়িয়ে শুঁটকি টেরি স্বয়ং।
সবাই জানে কিশোর পাশা কোটটা কেটেছে, বলল গোটা শহরে রটে গেছে এ কথা।
তোমার সৌজন্যে, ফোড়ন কাটল রবিন।
শুঁটকি প্লাস্টিকের মানিব্যাগ বের করল।
ছবিটা কিনব আমি। বিছানার পাশে ঝুলিয়ে রাখব।
খবরদার! গর্জে উঠল মুসা। তুমি ছবিটা কিনতে পারবে না। তুমি চাইছ সরাই যাতে মনে করে তোমার কথাই ঠিক-কিশোরই কোটটা কেটেছে। তোমার শয়তানী আমাদের বুঝতে বাকি নেই, শুঁটকি
কী সব উল্টোপাল্টা বকছ! বলে উঠল শুঁটকি।
মানি হাত পেতে দিল শুঁটকির সামনে।
পঞ্চাশ সেন্ট।
একমাত্র প্রমাণ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে বিচলিত হয়ে পড়ল রবিন। অসহায়ের মত চেয়ে রয়েছে কিশোরের মুখের দিকে।
গটগট করে এসময় কেন শিপটনের কাছে পৌঁছে গেল মুসা।
ওটা দাও দেখি, বলে ছোঁ মেরে জারটা কেড়ে নিল ওর হাত থেকে।
আরে, করো কী? হাহাকার করে উঠল কেন। বিলি আমাদের শোয়ের সুপারস্টার। মোনালিসার মত।
অ্যাই, শুঁটকি, জারটা তুলে ধরে বলল মুসা। বিলিকে হ্যালো বলো। নইলে দেব গায়ে ছেড়ে।
বি-বি-বিলি? তোতলাচ্ছে রীতিমত শুঁটকি।
কিশোর আর রবিন ওর পিছনে দাঁড়ানো।
বিলি সারা সপ্তা জারের ভিতর রয়েছে, বলে ঢাকনা খুলতে শুরু করল। মনে হয় পাণ্ডা বার আইসক্রীম চাখতে ওর খারাপ লাগবে না।
শুঁটকি বিলির দিকে চেয়ে রয়েছে। চিবুক কাঁপতে শুরু করল হঠাৎ। পাণ্ডা বার পেইন্টিংটা খসে পড়ল হাত থেকে। পরমুহূর্তে বাপরে বলে চিৎকার করে উঠল।
দাঁড়াও, দাঁড়াও। শুঁটকিকে লেজ গুটিয়ে পালাতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল মানি। ছবি কিনবে না?
ইতোমধ্যে কেন শিপটন এসে জারটা নিয়ে নিয়েছে মুসার হাত থেকে। কিশোর যমজদের কাঁধ জড়িয়ে ধরল।
ব্যাপারটা কী বলো তো, ভাইয়ারা, আদরের সুরে বলল। সত্যি কথা বললে তোমাদেরকে আইসক্রীম কিনে দেব।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল যমজদের। কিশোরকে ওরা বিশ্বাস করে।
বলছি, বলল মানি। মিরা ম্যাডাম মিনি ফ্রিজে পাণ্ডা বর রাখতে বলেছিল। কিন্তু আমাদের মাথায় শয়তানী চাপল কোটটা আইসক্রীম মাখিয়ে নষ্ট করব।
তারপর? তাগিদ দিল কিশোর।
সবাই যখন লাল কার্পেটে প্র্যাকটিস করছে, আমরা স্টকরূমে ফিরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে পাণ্ডা বার বের করি, বলল মানি।
তারপর কোটে আইসক্রীম ঘসে দাও, বলল মুসা।
হ্যাঁ, পেনি বলল। পরে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আমরা কাঁচি দিয়ে কোটটা কেটে দিই।
কিশোর বলল, যাতে কোটে আইসক্রীম লেগে থাকতে দেখে কেউ তোমাদের ধরতে না পারে! এমনকী গন্ধও যেন না পায়।
হ্যাঁ, বলল মানি। টুকরোটা আমি প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখি। সেজন্যেই এখন কাপড়টার গায়ে দাগ দেখতে পাচ্ছ।
কেন শিপটনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল কিশোর।
তুমি জানতে তোমার ভাইরা এ কাজ করেছে?
নাহ, কথাটা স্রেফ উড়িয়ে দিল কেন। আমি ভেবেছি ওটা ফিঙ্গার পেইন্টিং।
যমজদের হাতের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানল কিশোর। রঙিন চকের গুঁড়ো লেগে রয়েছে আঙুলে আর তালুতে।
তোমরা দেয়ালে আমার সম্পর্কে আজেবাজে কথা লিখেছ, ঠিক না?
মাথা নিচু করে ফেলল যমজরা।
বিশ্বাস করো, বলল মানি, টেরির কথায় আমরা তোমার নামে ওসব লিখেছি। যাতে তোমার ওপর সবার সন্দেহ আরও বেশি করে পড়ে। আমাদের কোন দোষ নেই।
তোমাদের খেল খতম, কঠিন গলায় বলল মুসা। এখনই মিরার কাছে গিয়ে সব খুলে বলবে তোমরা?
তা হলে তো আর কখনও মডেল হতে পারব না! পেনি ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল।
মানি হাত নেড়ে কথাটাকে উড়িয়ে দিল।
তাতে বয়েই গেল। ওই সোয়েটারগুলো ভীষণ কুটকুট করে।
তিন গোয়েন্দা যমজদেরকে সোজা ফ্যাশন হাউজে নিয়ে এল। দুই অপরাধী মিরার সামনে দাঁড়িয়ে অকপটে সব স্বীকার করল।
তোমরা তো দোষ করেছই, বলল মিরা। আমিও কম দায়ী না। খামোকা কিশোরকে সন্দেহ করেছি। তাছাড়া আমার উচিত ছিল সর্বক্ষণ ঘরটা পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
মাফ-টাফ চেয়ে নিল যমজরা। তারপর কিশোরের কাছ থেকে আইসক্রীমের পয়সা নিয়ে এক ছুটে বেরিয়ে গেল দোকান ছেড়ে।
এত সুন্দর কোটটা নষ্ট হয়ে গেল, বলল রবিন, খারাপ লাগছে!
ভেবো না, বলল মিরা। রকি বীচে অমন কোট অনেক দেখতে পাবে তোমরা।
তাই? কিশোর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
মৃদু হাসল মিরা।
হ্যাঁ, ফ্যাশন শো-র পরে পাঁচটা কোটের অর্ডার পেয়েছি। ফুটো ছাড়া অবশ্য।
হেসে ফেলল তিন গোয়েন্দা।
দোকান থেকে বেরিয়ে এল ওরা। স্বস্তি বোধ করছে কিশোর। মস্ত বড় এক পাথর যেন নেমে গেছে বুকের উপর থেকে।
শুঁটকিকে ফোন করে এখনই সব জানানো দরকার, বলল রবিন। যাতে আজেবাজে লেখা বন্ধ করে।
প্রস্তাবটা নিয়ে দুমুহূর্ত ভাবল গোয়েন্দাপ্রধান। তারপর মাথা নেড়ে নিষেধ করল।
দরকার কী, বলল। মিথ্যে যদি বাতাসের বেগে রটতে পারে, তবে সত্যিটাও জানাজানি হতে দেরি হবে না।
আজকের দিনটা পিযা প্যালেসে সেলিব্রেট করবে ঠিক করল ওরা।
কিন্তু তার আগে ড্যাশিং ডগ থেকে বাঘাকে নিয়ে আসি চলো, বলল রবিন। ড্যাশিং ডগের দিকে হাঁটা দিল তিন গোয়েন্দা।