- বইয়ের নামঃ সামনে কুয়াশা
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
সামনে কুয়াশা
১. প্রথম রহস্য কাহিনী
সামনে কুয়াশা (এরকুল পোয়ারো)
(আগাথা ক্রিস্টির ডায়েরি থেকে তার প্রথম রহস্য কাহিনী)
০১.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে।
আকাশে সূর্য হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে ইতিমধ্যে পশ্চিমের দিগন্ত রেখায়। কিছুটা সময় পরেই বড় এক লাল টমোটার মতো আকার নিয়ে সে অদৃশ্য হয়ে যাবে দিগন্তের অপর পারে। তার আগেই অবশ্য ছড়িয়ে পড়বে অমলিন রক্তাভা। ভারী সুন্দর দেখতে হবে দৃশ্যটি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এসব দৃশ্য দেখার মতো সময় নেই মানুষের। মানুষ এখন নিরন্তর ছুটে চলেছে অর্থ আর যশের পেছনে। ইট, কাঠ, পাথরের বেড়াজালে বাস করে মানুষের মনটাও কেমন বরফ আর কঠিন হয়ে গেছে। না হয়েই বা উপায় কি। সমস্যার নাগপাশে বন্দী সাবই। নিজেকে ছাড়িয়ে দৃষ্টি একটু দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেখার মতো কোন উপায় নেই তার। মনটা কেঁদে ওঠে। ইচ্ছে হয় মায়াবী এই জালটা ছিঁড়ে কোথাও পালিয়ে যাই, দুখণ্ড প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিয়ে আলাপন সারি। সেখানে আকাশ অল্প বিস্তৃত প্রান্তরে সাথে, কথা বলি ঝর্নার সাথে, স্নান করি তটিনী তরঙ্গে, মেতে উঠি আনন্দে। আলোর একটি কণা, হাসির টুকরো আনন্দের পথ, ফুল কুড়িয়ে নিই। ধরে রাখি চিরদিন নিজের কাছে।
হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবছিলো লীনা।
লীনা স্যাণ্ডর্স। সেকেণ্ডারী স্কুলের ইংলিসের টিচার। মনটা ভালো নেই। অনর্থক ধমক খেয়েছে হেডমিস্ট্রেসের কাছে। হ্যাঁ, অনর্থক বৈ কি। লীনা জানে, ওর কোন দোষ নেই। মেয়েরা যদি রেজাল্ট ভালো না করে তার জন্যে কি সে দায়ী হবে? সে কি সবকিছু করতে পারে একা? কেউ ক্লাসে তার লেকচার ফলো করে না। পড়ার বইয়ের বদলে মন দেয় ফিল্ম ম্যাগাজিনে। হলিউডের তারকাদের দিকে তাকিয়ে থাকে দিনরাত। টিচার কি করবে তবে? তাছাড়া রেজাল্ট খারাপ তার ক্লাসের মেয়েদেরই। অন্যেরা মোটেই এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। কিন্তু হেডমিস্ট্রেস কেমন ভাবে ওকেই শুধু কথাগুলো শোনালেন, কথাগুলো এখনও কানে লেগে আছে লীনার। কানদুটো জ্বালা করছে তখন থেকে।
থার্ড পিরিয়ডটা অফ ছিল লীনার। কমনরুমে বসে ছিলেন একাই। বেয়ারা এসে খবর দিলো, বড় দিদিমণি ডাকছেন।
বড় দিদিমণি মানে হেডমিস্ট্রেস শীলা কাউড্রে। নাম শুনলে মনে হয় স্বাভাবিক যে কোন স্লিম ফিগারের সুন্দরী হবেন বুঝি। কিন্তু আদপে তা নয়। পৃথুলা চেহারা। বয়েস হয়েছে বেশ। রূঢ় স্বভাবের জন্যে ছাত্রীরা তো বটেই, টিচাররাও পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে তাকে। সেই তিনি হঠাৎ কি কারণে…স্বাভাবিক ভাবেই মনটা চিন্তিত হয়ে যায় লীনার। তবু সামান্য চাকরি করে সে। হেডমিস্ট্রেসের ডাকে তাকে তো সাড়া দিতেই হবে।
-বসুন। দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হয়নি।
কি গলা। যেন হাঁড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে শব্দগুলো, কি ছিড়ি কথার। রসকসের কোন বালাই নেই। কানদুটো ঝা ঝাঁ করছে লীনার। তবু বসলো।
-বলুন কি বলবেন?
-হ্যাঁ, বলছি। গত দুটো এগজামিনেই মেয়েদের ইংলিশের রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছে। টেস্টে তত দশজন অ্যালাউ হলো না। শুধু ইংলিশে পুওর মার্কসের জন্যে। ছিঃ ছিঃ, মিসেস স্যাণ্ডার্স, ভেরী ডিসগ্রেসফুল। ছাত্রীদের মাতৃভাষা ইংলিশ। অথচ সেই সাবজেক্টটাতেই যদি তারা এমনি করে তাহলে আর আপনি….
কথাটা শেষ করলেন না শীলা কাউড্রে। কিন্তু লীনা বুঝতে পারলো–তাহলে আর আপনি আছেন কেন?
আছি কেন? থেকেই বা কি করা যায়? তুমিই বা কতটুকু পারছো শুনি? তোমার নিজেরও তো মাতৃভাষা ইংরেজি। অথচ এক মিনিটের ভাষণেই কতগুলো বিদেশী শব্দ ব্যবহার করে ফেললে। মাতৃভাষার প্রতি যদি সামান্য দরদ থাকতো তাহলে এই অবস্থা হতো না তোমার।
কথাগুলো অবশ্য সে মনে মনে বলল। আর সামনে বলল–আমি দেখছি ম্যাডাম, কি করা যায়। সামনের বার আশাকরি ভালোই হবে।
–আশা করি-টরি নয়। হতেই হবে। যেন মেঘ গর্জন, ইউ মাস্ট, আচ্ছা। ডান হাতের তর্জনীটা সামান্য ওপরে তুললেন হেডমিস্ট্রেস। যেন নির্দেশ করলেন দরজার দিকে। উঠে দাঁড়ানো লীনা। ওল্টানো পেপার কাটিংটা আবার চোখের সামনে মেলে ধরলো কাউড্রে। তার চোখে লীনা দেখলো, শার্লক হোমস।
সেই থেকে মেজাজটা খারাপ হয়েছে লীনার। বাকি ক্লাসগুলো কি করে যে নিয়েছে মনে করতে পারছে না ও।পিরিয়ড শেষ হতে যেন নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচেছিল। আর এক মুহূর্তে দেরী না করে ছুটতে ছুটতে নেমে এসেছিলো নীচের রাস্তায়। আর তখনই তার মেজাজটা ফের তেতো হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ।
সেই লোকটা। সামনের পানের দোকানে দাঁড়িয়ে ঝুলানো আগুন থেকে সিগারেট ধরাচ্ছে পরনে দামী স্টেটলনের প্যান্ট। রঙটা অন্য। ক্রিম কালারের হাওয়াই শার্টটা ঠিকই আছে। সিগারেট ধরিয়ে লোকটা যেন চোরা চোখে একবার দেখে নিলো লীনাকে।
বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির করে উঠলো লীনার। অজানা আতঙ্কের একটা হিমেল স্রোতে মেরুদণ্ড বেয়ে ওপরে উঠে আসতে থাকে ক্রমশঃ। ঠিক একটা তৈলাক্ত সরীসৃপের মতোই। ভয়ে আর বিতৃষ্ণার যুগপৎ আক্রমণে কেমন যেন হয়ে পড়ে লীনা। আজ প্রথম নয়। পর পর তার তিনদিন এরকম হলো। কে লোকটা। কি চায়? কেন এমন ভাবে লীনাকে অনুসরণ করছে? লীনা স্যাণ্ডার্স নামের এই সাধারণ মেয়েটার সঙ্গে ওর কি প্রয়োজন? তবে কি কোন রহস্যের বেড়াজালে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ছে নাকি লীনা? এই বিরাট বিচিত্র শহর লণ্ডন। তার হরেক পাপচক্রের কোন একটির মধ্যে কুক্ষিগত করতে চাইছে লীনাকে? সন্ধ্যের আবছা আলো ক্রমেই ঘন হয়ে নামছে পৃথিবীর বুকে। স্ট্রীটল্যাম্পগুলো জ্বলে গেছে ইতিমধ্যেই। অন্ধকার একেবারে দূর হয়নি। কেমন একটা মায়াবী আলো-আঁধারির খেলা।