–বেশ। তুমি মূর্তিটা শুধু তাকে দিয়ে বলবে, এ গিফ্ট ফ্রম পিটার।
–শুধু এইটুকু। আর কিছু না?
–হ্যাঁ, আর সামান্য একটু বাকি আছে, তিনি একটা মুখআঁটা লেফাফা দেবেন তোমাকে তুমি সেটা নিয়ে চলে আসবে। তারপর আমাকে দিয়ে দেবে।
-তোমাকে তখন পাবো কোথায়?
–আমি কাছেই থাকবো।
–সেকি? অবাক হলো লীনা। এই যে বললে ডোভার যাবে।
-ও হ্যাঁ হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি যেন নিজের ভুল শুধরে নিলো পিটার। তবে রাত্রিতে ফিরবো তো, এসেই দেখা করবো তোমার সঙ্গে।
আর একদফা অবাক হলো লীনা। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
পিটার উঠলো চেয়ার ছেড়ে। আজ তাহলে চলি লীনা। আবার কাল দেখা হবে।
–রাতে থাকবে না?
-না। এক বন্ধুর মেসে থাকবো। কথা দেওয়া আছে। বলল পিটার। ভয় নেই। দু-একদিনের মধ্যেই পাকাপাকি ভাবে এসে উঠছি এখানে। এ ঘর তোমার।
-তা জানি না। তবে তুমি আমার। লীনা আমার, লীনা।
লীনার চিবুকে হাত দিয়ে একটু আদর করলো পিটার। তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। লীনাও পেছনে গেল পাশাপাশি নামতে লাগলো সিঁড়ি দিয়ে।
.
০৩.
ডাবল ডেকারটা পিটারকে নিয়ে চলে গেল। যতক্ষণ না দৃষ্টির একেবারে বাইরে চলে গেল ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো লীনা।
পিটার তার স্বামী। কতদিন পর দেখা। কতদিন? নিজেকে জিজ্ঞাসা করলো লীনা।
নিজেই নিজের উত্তর দিলো–দশ বছর।
দীর্ঘ দশটা বছর কেটে গেছে এর মধ্যে। সেই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা। সবাই বলেছিল, পিটার মারা গেছে। কিন্তু লীনা বিশ্বাস করেনি। ও জানতো, পিটার বেঁচে আছে। ফিরে আসবে একদিন। তাই তো এতদিন পর ঠিক ফিরে এসেছে পিটার তার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখে।
হঠাৎ চমক ভাঙালো লীনার। কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছে আকাশপাতাল। স্মৃতির গোলকধাঁধায় শাক খাচ্ছে অন্ধের মতো। বাসটা তো চলে গেছে অনেকক্ষণ। ভয়ঙ্কর কথাটা হঠাৎ চাবুক মারলো যেন। মনে পড়লে তাড়াতাড়িতে ঘরে দরজাটা বন্ধ করে আসা হয়নি। সর্বনাশ! দরজা খোলা পেয়ে কেউ যদি চুরি করে নিয়ে যায় মডেলটা! পিটার বলেছিল, ওর দাম নাকি অনেক। বডোলোকেরা ড্রয়িংরুম সাজানোর জন্যে অবিশ্বাস্য দামে কিনে নেয় ওদের কোম্পানির জিনিস। এলাকাটাও ভালো নয়। চুরি, ছিনতাই লেগেই আছে।
দ্রুতপায়ে ঘরের দিকে এগোতে লাগল লীনা।
ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় সে। দরজার পর্দা উড়ছে হাওয়ায়। ওপরে সিঁড়ির দিকে তাকালো। তেতলায় উঠবার মুখে দাঁড়িয়ে হেলেনা।
লীনাকে দরজার সামনে থমকে দাঁড়াতে দেখে তাড়াতাড়ি নেমে এলেন তিনি।
-দরজা খোলা রেখে বাইরে বেরিয়ে ছিলে লীনা। কি ভুলো মন তোমার! আমি তখন থেকে পাহারা দিচ্ছি। দেখো তো সব ঠিক আছে কিনা। হেলেনার কাথায় চাপা উদ্বেগ।
কথা না বলে ভেতরে ঢুকলো লীনা। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অস্ফুটে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো তার গলা দিয়ে। টেবিলের ওপর মূর্তিটা নেই!
–কি হলো, লীনা?
হেলেনা ঢুকে পড়লেন ঘরের ভেতর।–কিছু চুরি গেছে নাকি?
–হ্যাঁ। লীনার চোখ ফেটে জল আসছিল তখন, একটা পুতুল।
পুতুল? হেসে উঠলেন হেলেনা। আমি ভাবলাম, না জানি কি। টাকা পয়সা, সোনা রুপা বা মণি মুক্তো। ভালো করে মনে করো। কোথায় রেখেছে পুতুলটা। চোর কি আর পুতুল নিতে আসবে।
হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন হেলেনা।
নিজের ঘরের মধ্যে বসে রইলো লীনা। যেন পাথর। সমস্ত চেতনা ঘুমিয়ে পড়েছে। তার কোন অনুভূতি আর জেগে নেই। এরপর কি করবে লীনা? কাল রাতে মিঃ স্টুয়ার্টের হাতে কি তুলে দেবে সে? আর পিটার? তাকে যে অনেকদিন পর ফিরে পেয়েছে লীনা? তবে কি পেয়েও হারাবে তাকে।
হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মনে হলো তার। আছে, একজন আছে, যে পারে লীনাকে এই সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে।–পোয়ারো, এরকুল পোয়ারো।
নিরাশার ভাবটা কেটে গেল লীনার।
দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়লো আবার।
পোয়ারোর বাড়ি কাছে। আস্তে হাঁটলেও মিনিট পনেরোর বেশি লাগে না। সামান্য সময়টুকু যেন ধৈর্য ধরতে পারছে না লীনা। ব্যস্ত পায়ে সামনের টেলিফোন বুথটার দিকে এগোল সে।
.
০৪.
প্রাইভেট ডিটেকটিভ এরকুল পোয়ারো বিছানার ওপর আড় হয়ে শুয়ে একটা ক্রাইম নভেলের মধ্যে ডুবে ছিলো। সামনে সোফার ওপর বসে ওর সখা বনাম সচিব অ্যাণ্ডজ। সিগারেট পুড়ছে একের পর এক। সামনের টেবিলে সেদিনের ইংরেজি দৈনিকটা।
অ্যাণ্ড্রুজ হঠাৎ আধপোড়া সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে বলল–আজকের সবচেয়ে ইমপর্টেন্ট নিউজটা পড়েছে, এরকুল?
ইমপর্টেন্ট নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের ওপর। তোমার কাছে হয়তো যা ইমপর্টেন্ট, আমার কাছে তা একেবারেই
বাধা দিল অ্যাণ্ড্রুজ।–আঃ, তোমার দর্শন থামাও। এখন দেখছে দেশের গোল্ড স্মাগলিং কেমন বেড়ে গেছে।সোনার দাম কিন্তু তার জন্যে একটুকুও কমেনি। এই তো পাশের বাড়ির মিসেস অ্যান্ড্রু সেদিন দুঃখ করছিলেন।
-আঃ, কি বাজে বকছো।
অ্যাণ্ড্রুজকে বেশ বিষণ্ণ মনে হয়। এতবড় একটা সিরিয়াস ব্যাপার।
–কি বলবো, বন্ধু। হাতের বইটা মুড়ে রেখে বিছানার ওপর সোজা হয়ে বসে এরকুল–কেউ যদি আমাদের না ডাকে।
-সত্যি, বহুদিন একেবারে বেকার, তাই না?
–হ্যাঁ, মিসেস লিসার সেই ব্যাপারটার পর থেকে হাতে তো কোন কেস নেই।
–আচ্ছা, সেটাও তো সোনাদানার ব্যাপার ছিল।