সত্যি সত্যি পেছন ফিরে তাকালো লীনা। লোকটা আসছে। ঠিক, একই ভাবে, গত দুদিনের মতো, বাঁ-হাতে একটা বড়সড় ফোলিও ব্যাগ। ডান হাতে দুআঙুলে ধরা সিগারেট, মাঝে মাঝে সিগারেট ধরা হতটা ওপরে উঠে আসছে। দুঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরছে সিগারেট। অল্প অল্প ধোঁয়া ছাড়ছে। আর আশ্চর্যের বিষয়, এই অন্ধকারেও কালো চশমার আড়ালে ঢেকে রেখেছে চোখদুটো। এই জিনিষটা ভারী অদ্ভুত লাগছে লীনার। লোকটির কি কোন দোষ হয়েছে? নাকি ধরা দিতে চায় না?
লোকটির আকৃতি, চলার ভঙ্গী দেখে হঠাৎই একটা কথা মনে হলো লীনার। একটুকরো আশার ফুলকি। কিন্তু তাও কি সম্ভব। মাত্র একমাসের পরিচয়। তাও দশ বছর আগে।…ভাবতে ভাবতেই জোরে পা চালালো লীনা। হাইড ব্রিজটা পার হয়ে, নীচু রাস্তার বাঁ দিকে। কয়েকটা আঁকাবাঁকা গলিপথ। শেষ গলিটার শেষ প্রান্তে তিনতলা বাড়িটার দোতলায় দেড় কামরার ফ্ল্যাট লীনার, গত দশ বছর এই তার আশ্রয়। আর স্কুলমাস্টারী।
ঘরে ঢুকলো, সুইচ টিপে আলো জ্বালালো। মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রকটা পাল্টে নিলো। এবার একটু রেস্ট। লীনা শরীরটা ছেড়ে দিলো বিছানার ওপর।
.
০২.
–আসতে পারি?
চমকে ওঠে লীনা। তাড়াতড়ি উঠে বসে বিছানার ওপর। দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে। পর্দা দুলছে। ওপরে অস্পষ্ট ছায়া।
–কে? লীনার গলায় স্বর ফুটলো না ভালো করে।
উত্তর এলো না। তার বদলে এক আগন্তুক নিজেই ভেতরে ঢুকে এলো। ঘরের একটি মাত্র চেয়ারে বসলো সে। হাতের ফোলিও ব্যাগটা সাবধানে নামিয়ে রাখলো মেঝেতে।
-কে, কে আপনি? লীনার স্বরে উত্তেজনা। না, এভাবে না বলে-কয়ে ঘরের ভেতর।
হাত তুলে বাধা দিলো আগন্তুক। চোখ থেকে কালো চশমাটা খুললো। হেসে বললো–সত্যিই আমাকে তুমি চিনতে পারো নি লীনা?
লীনা একদৃষ্টিতে দেখছিলো আগন্তুককে। কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর এগিয়ে এলো সে। আশা-নিরাশার দোলায় দুলছে মন।
–তুমি…তুমি পিটার। সত্যি তুমি।
বিস্ময়ে অবরুদ্ধ হয়ে আসে তার গলা। আশা আর আনন্দটা যেন একসঙ্গে আক্রমণ করেছে তাকে। চেতনারা হারিয়ে গেছে অবচেতনায়।
-হ্যাঁ, আমি। আগন্তুক এবার বেশ ছড়িয়ে হাসলো। ভালো করে চেয়ে দেখো।
দেখলো লীনা।
হ্যাঁ, ঠিক সেই মুখ সেই চোখ। কপালের ওপর সেই কাটা দাগ পর্যন্ত স্পষ্ট।
তবু সন্দেহ আর বিশ্বাসের পর্দা সরে গেল না একেবারে। কণ্ঠে দ্বিধা জড়িয়ে লীনা বলল–তাহলে সেই ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট!
না, মরিনি! দেখতেই পাচ্ছে। তবে পুরো একটা মাস অজ্ঞান হয়েছিলাম। তারপরেও বেশ কিছুদিন পুরনো কথা কিছু মনে করতে পারতাম না।
মুখ উঁচ করলো পিটার।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললল লীনা। বড্ড রোগা হয়ে গেছে পিটার।–তা এততদিন ছিলে কোথায়?
-কোথায় ছিলাম না তাই বলো। বিষণ্ণ হাসি হাসলো পিটার। দশ-দশটা বছর পার হয়ে গেল, তাই না লীনা। দীর্ঘসময় টেমসের কত জল বয়ে গেছে বলো তো! এখন আসছি নিউইয়র্ক থেকে। খাস আমেরিকায় কি করছি জিজ্ঞেস করলে না?
-বলল শুনি।
—বিজনেস।
-বিজনেস-কিসের?
–টয় গুডসের।
–মানে পুতুল-টুতুল?
–অনেকটা তাই বলতে পারো।
–সেটা কি এখান থেকে হতো না?
–হত। কিন্তু মুশকিল কি জানো। এখনো অনেকের মোহ আছে আমেরিকা নামটার প্রতি।
–তাই নাকি?
–মেটেরিয়ালস আমরা পাঠিয়ে দিই। জিনিসটা তৈরী হয় ওদেশে।
–তুমি এখানে কিছুদিন থাকবে তো?
–হ্যাঁ, আমি এদেশেই থাকবো। আমি এখানকার চীফ এজেন্ট।
একটু চুপ করে থাকে পিটার, মাথা নিচু করে কি যেন ভাবে। তারপর বলে, তোমাকে একটা কাজের ভার দেবো লীনা। সেজন্যেই আমি এসেছি আজ।
-কাজ? তোমার বিজনেসে?
–ধরো তাই। কেন পারবে না?
-না পারার কি আছে। একটু যেন লজ্জা পায় লীনা। তারপরে সহজেই বলে-কাজটা কি, তাতো বলোনি!
-বলছি।
ফোলিও ব্যাগটা মেঝের ওপর থেকে তুলে নিয়ে হাঁটু দুটোর ওপর রাখে পিটার। চেন খুলে ভেতর থেকে একটা প্রাচীন মডেল বের করে রাখে টেবিলের ওপর।
লম্বায় প্রায় ফুটখানেক হবে মূর্তিটা। চওড়ায় ইঞ্চি আড়াই। আগাগোড়া সোনালী রঙে মোড়া।
লীনা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। লণ্ডনের যে কোন অভিজাত স্টেশনারী সপে এরকম মূর্তি দুর্লভ নয়। তবু এই মূর্তিটির যেন বিশেষত্ব আছে। অপূর্ব ফিনিশ। কি মনে করে মূর্তিটা হাতে তুলে নেয় লীনা। বেশ ভারী। কেজি দেড়েক ওজন হবে। বিস্মিত লীনা। মূর্তিটা নামিয়ে রাখে টেবিলের ওপর।
পিটার ওর দিকে তাকিয়ে হাসে–খুব ভারী তাই? নিরেট পাথরের তৈরী।
-পাথরের এমন রং করা যায় নাকি? সোনালী পাথর? লীনা অবাক হয়ে ভাবে।
এটা কাল তার আটটার সময় ডেলিভারি দিয়ে আসতে হবে একজনকে। পিটার বলে, অথচ কাল সকালেই একটা জরুরী কাজে আমাকে চলে যেতে হচ্ছে ডোভারডাই।
–তাই আমার কথা মনে পড়লো, কেমন, ঠিক কিনা?
–না, তা ঠিক নয়। পিটার বুঝি একটু অপ্রস্তুত। আমাকে ভুল বুঝো না।
-ঠিক আছে। লীনা হাসে।সময় তো বললে। এখন স্থান আর পাত্র বলে। অর্থাৎ কোথায় কার কাছে দিয়ে আসতে হবে।
-বলছি। পিটার সিগারেট ধরায় একটা। একমুখ ধোঁয়া ছাড়ে। তারপর বলে, কাল রাত ঠিক আটটার সময় হোটেল প্যারাডাইসে মিঃ স্টুয়ার্টের হাতে দিয়ে আসতে হবে এট। হোটেলটা তুমি চেনো তো? জিজ্ঞাসা করে পিটার।
লীনা ঘাড় নাড়ে! অর্থাৎ সে চেনে।
সিলিং-এর দিকে মুখ করে পর পর কয়েকটা রিং ছাড়ে পিটার। তারপর আবার বলে–একেবারে কোণের দিকে একটা টেবিলে একা থাকবেন মিঃ স্টুয়ার্ট ছাইরঙের স্যুট থাকবে পরনে। চোখে কালো চশমা, জামার বটম হোলে লাল গোলাপ। আশাকরি চিনতে কোন অসুবিধা হবে না।