- বইয়ের নামঃ হিকরি ডিকরি ডক
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ সমতট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
হিকরি ডিকরি ডক
১. ভ্রুকুটি করলো পোয়ারো
হিকরি ডিকরি ডক (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি
০১.
ভ্রুকুটি করলো পোয়ারো, মিস লেমন।
হ্যাঁ, মঁসিয়ে পোয়ারো?
এই চিঠিতে তিন-তিনটি ভুল আছে।
তার কণ্ঠস্বরে অবিশ্বাসের সুর শোনা গেল। অথচ মিস্ লেমনের স্বপক্ষে বলা যায় ভীষণই সচেতন ও দক্ষ মহিলা, ভুল সে কখনো করেনি। আদৌ সে মহিলা নয়, সে যেন একটা মেশিন–নিখুঁত সেক্রেটারি যে এমনভাবে চালিয়ে নিয়ে এসেছে, তার কাজের ধারা, পদ্ধতিও মেশিনের মতো হয়ে গেছে। পোয়ারোর দক্ষ পুরুষ পরিচায়ক জর্জ এবং ততোধিক দক্ষ সেক্রেটারি মিস্ লেমন তার জীবনে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করে আসছে।
তবু তা সত্ত্বেও আজ সকালে একটা সহজ সাধারণ চিঠি টাইপ করতে গিয়ে তিন-তিনটি ভুল করে বসে আছে মিস্ লেমন।
সেই ত্রুটিপূর্ণ চিঠিটা মিস্ লেমনের সামনে মেলে ধরলো এরকুল পোয়ারো, রাগ করেনি সে, তবে কেবল হতভম্ব হয়ে গেছে সে। এটা এমনি একটা ব্যাপার যা ঘটা উচিত নয়–কিন্তু সেটা ঘটেছে, চিঠিটা তার হাত থেকে নিয়ে দেখলে মিস্ লেমন, পোয়ারো তার জীবনে এই প্রথম মিস্ লেমনের মুখ লাল হয়ে উঠতে দেখলো লজ্জায়।
ওহো, প্রিয়, বললো সে, চিন্তা করতে পারি না, কি করেই বা অন্তত, হা হা, এখন বুঝতে পারছি, কারণ আমার বোনের জন্য
তোমার বোন?
আর একটা ধাক্কা, মিস্ লেমনের যে বোন আছে, আগে জানতো না সে, তোমার বোন? পুনরাবৃত্তি করলো এরকুল পোয়ারো। তার কণ্ঠস্বরে অবিশ্বাসের ছোঁয়া।
হ্যাঁ, মাথা নাড়লো সে। মনে হয় না তার কথা আমি তোমার কাছে কখনো উল্লেখ করেছি। বস্তুতঃ তার সারাটা জীবন কেটেছে সিঙ্গাপুরে, তার স্বামীর রাবারের ব্যবসা ছিলো সেখানে। এরকুল পোয়ারো মাথা নেড়ে জানিয়েছিলো, বুঝেছে সে। মিস লেমনের মতো মেয়েদের বোনেদের। বিয়ে হয় সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যাতে করে এ জগতের মিস্ লেমনেরা যান্ত্রিক দক্ষতা নিয়ে তাদের নিয়োগ কর্তাদের কাজকর্ম মেশিনের মতো সুষ্ঠু ভাবে শেষ করতে পারে (সেই সঙ্গে অবশ্যই তাদের অবসর মুহূর্তে ফাইল ব্যবস্থার নতুনত্ব আবিষ্কারও থাকবে)।
আমি উপলব্ধি করি, বললো লেমন, এগিয়ে যাও, মিস্ লেমন আবার বলতে শুরু করলো।
বছর চারেক আগে বিধবা হয়। সন্তানহীনা। উপযুক্ত ভাড়ায় তাকে আমি একটা ফ্ল্যাট জোগাড় করে দিই, কিন্তু সত্যিকথা হল সে খুবই একা। কখনো ইংল্যান্ডে থাকেনি সে। তার পরিচিত কিংবা অন্তরঙ্গ বন্ধু বলতে কেউ নেই এখানে। তার হাতে প্রচুর সময়, যাই হোক ছয় মাস আগে ও আমাকে বলে এই চাকরিটা নেওয়ার কথা ভাবছে ও।
চাকরি?
ওয়ারডেন আমার ধারণা ঐরকমই বলে যাকে তারা কিংবা মেট্রন-ছাত্রদের একটা হোস্টেলের, মালকিন একজন আংশিক গ্রীক মহিলা হোস্টেল পরিচালনার জন্য তিনি একজন প্রার্থী খুঁজছিলেন। হিকরি রোডের উপর পুরনো আমলের বাড়ি। সেখানে আমার বোনের শয়নকক্ষ, বসবার ঘর, বাথরুম ও রান্নাঘর সহ একটা সুন্দর বাসস্থান পাওয়ার কথা।
মিস্ লেমন থামলো এখানে। এ অব্দি সে যা যা বললো তাতে বিপর্যয়ের নাম গন্ধ কোথাও নেই। উৎসাহ বোধ করলো পোয়ারো।
দুটো হাত এক করে আমি কখনো ওকে এক দণ্ড বসে থাকতে দেখিনি। বাস্তববাদী মহিলা, এবং ভালোভাবেই কাজ চালাতে পারে, তবে তাই বলে এই নয় যে, এই হোস্টেলে টাকা ঢালতে চায় সে, বা সেরকম কিছু। একেবারে বেতনভোগী ও মাইনে খুব বেশি নয়। তবে টাকার দরকার নেই ওর, তাছাড়া খুব একটা খাটুনির কাজও নয়। সব সময়েই তরুণরা ওর প্রিয় এবং তাদের সঙ্গে ওর ব্যবহারটাও ভালো, বহুদিন প্রাচ্যে ছিলো জাতিগত পার্থক্য এবং মানুষের সমর্থ উপলব্ধি করতে পারে ও। এই হোস্টেলের ছাত্ররা সব জাতি সম্প্রদায়ের, বেশিরভাগই ইংরাজ, তবে তাদের মধ্যে আসলে কিছু কালো চামড়ার মানুষ আছে বলে আমার বিশ্বাস।
স্বভাবতই, বললো এরকুল পোয়ারো।
এমন আমাদের হাসপাতালগুলো অর্ধেক নার্সই কালো চামড়ার, একটু দ্বিধা করে বললো মিস লেমন, আর আমি এও জেনেছি ইংরাজ নার্সদের থেকে তারা অনেক, অনেক বেশি কর্তব্যপরায়ণ ও মনোযোগী। যাহোক, সে প্রসঙ্গ এখানে আসে না। একটা পরিকল্পনা নিয়ে আমরা আলোচনা করি এবং শেষ পর্যন্ত আমরা এগিয়েও যাই। আমি কিংবা আমার বোন হোস্টেলের মালকিন মিসেস নিকোলেটিসকে খুব বেশি পাত্তা দিই না। ভদ্রমহিলা খিটখিটে স্বভাবের। কখনো তার ব্যবহার চমৎকার, আবার কখনো বা দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, একেবারে উল্টো যাকে অবাস্তব বলা যেতে পারে, তিনি যদি সম্পূর্ণ যোগ্যব্যক্তি হতেন, আমার তো মনে হয় তার কোনো সহকারীর দরকার হতো না।
সুতরাং তোমার বোন চাকরিটা নিল? জিজ্ঞেস করলো পোয়ারা।
হ্যাঁ, প্রায় মাস ছয়েক আগে ২৬ নং হিকরি রোডে চলে যায় ও। সবদিক থেকে সেখানকার কাজ ওর খুবই পছন্দসই হয় এবং উৎসাহ বোধ করে।
মন দিয়ে শুনলো এরকুল পোয়ারো, এখনো পর্যন্ত মিস্ লেমনের বোনের অভিমান পর্বটুকু যেটুকু শুনেছি অতি সাদামাটা নীরব বলেই মনে হলো তা কিছুদিন হলো খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছে
ও, চিন্তিত কেন?
দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো, হোস্টেলে এমন যা সব ঘটনা ঘটছে, যা একেবারেই পছন্দ নয় ওর।
কেন ছেলেমেয়ে এক সঙ্গে থাকে নাকি সেখানে? জানতে চাইলো পোয়ারো।
ওহো, তা নয় মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি সেরকম কিছু বলতে চাইনি, আসলে ব্যাপারটা হলো হোটেল থেকে জিনিসপত্র উধাও হয়ে যাচ্ছে।
উধাও হয়ে যাচ্ছে?
হ্যাঁ, উধাও হওয়া জিনিসগুলো অত্যন্ত মামুলি–আর সবই অস্বাভাবিক ভাবে।
তুমি বলছো, জিনিসগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে, তার মানে চুরি হয়ে যাচ্ছে বলো?
হা, ঠিক তাই।
তা, পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে।
না, এখনো দেওয়া হয়নি। আমার বোনের আশা তার আর দরকার হবে না। কিছু তরুণ ছাত্র ওর খুব প্রিয়–মনে হয় সেই জন্যেই, পুলিশ তাদের জ্বালাতন করবে; তা ও চায় না, তাছাড়া ব্যাপারটা ও নিজেই সমাধান করতে চায়।
হা, চিন্তিত ভাবে বললো পোয়ারো। আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমি যদি বলি, তোমার নিজের উদ্বেগ যা তোমার বোনের উদ্বেগের প্রতিফলন বলে আমি মনে করতে পারি, কিন্তু সেটা তো বোঝাচ্ছে না।
আমি ঠিক এই পরিস্থিতি পছন্দ করি না। আদৌ আমি এসব পছন্দ করি না। আমি চিন্তাই করতে পারি না কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে যা আমি বুঝতে পারছি না।
চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দিলো পোয়ারো, সাধারণ চুরি নয়? ক্রেমাটোম্যানিয়াল? মানে চুরি করার জন্য উদ্দাম সেরকম কিছু?
না, আমি তা মনে করি না, এ বিষয়ে আমি লেখাপড়া করেছি, মিস্ লেমন যথেষ্ট সচেতন, এনসাইক্লোপেডিয়া আর মেডিক্যাল জার্নাল আমার বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি, কিংবা বলতে পারো আমার মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারেনি।
প্রায় মিনিট খানেকের উপর নীরবে কি যেন ভাবলো পোয়ারো, বহুভাষিক হোস্টেলকে কেন্দ্র করে মিস্ লেমনের বোনের এই ঝামেলায় সেকি জড়িয়ে পড়বে? কিন্তু মিস্ লেমনের ভুল চিঠি টাইপ করাটা অত্যন্ত বিরক্তিকর এবং অসুবিধাজনক। এই ঝামেলায় তাকে যদি জড়িয়ে পড়তে হয়, নিজের মনে বললো সে, সেটা একটা কারণ হতে পারে।
সৌজন্য প্রকাশের জন্য পোয়ারো তার মাথা নত করে বললো, আচ্ছা মিস লেমন বিকেলে চায়ের বৈঠকে তোমার বোনকে আমন্ত্রণ জানালে কি রকম হয়? হয়তো আমি তাকে একটুআধটু সাহায্য করতে পারি।
সে ত তোমার অসীম দয়া মঁসিয়ে পোয়ারো। সত্যি তোমার অসীম দয়া। বিকেলে সব সময়েই আমার বোনের অখণ্ড অবসর।
তাহলে আগামীকালই হোক, তা তুমি এর ব্যবস্থা করতে পারবে?
মাথা নেড়ে সায় দিলো মিস লেমন, আর সেই সময়ে বিশ্বস্ত জর্জকে খাবার ও দামি সুগন্ধি চায়ের ব্যবস্থা করতে বলা হলো।
.
০২.
মিস লেমনের বোন মিসেস হার্বার্ডের সঙ্গে তার বোন-এর অবশ্যই মিল আছে। গায়ের রং হলুদ, গোলগাল মুখ, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল, তবে বোনের মতো অতো চটপটে নয়। কিন্তু বোনের মতো তার চোখের চাহনিও তীক্ষ্ণ।
মঁসিয়ে পোয়ারো আপনার মতো অমন ব্যস্ত মানুষ আমার জন্য কষ্ট করছেন, এ আপনার বদান্যতারই পরিচয়, বললো সে। আর এমন চমৎকার উৎকৃষ্ট চা ঠিক আপনার স্বভাবের মতোই সুন্দর। জানেন, ফেলিসিটির বর্ণনা মতো মনে মনে আমি আপনার যে ছবি এঁকেছিলাম, আপনি ঠিক সেইরকম।
ফেলিসিটি, সেটা যে মিস্ লেমনের খ্রিস্টান নাম, সেটা মনে পড়তেই পোয়ারোর অবাক হওয়া ভাবটা তার মুখ থেকে মিলিয়ে গেলো। পোয়ারো তাকে বলে তার আশা, মিস্ লেমনের থেকেও তার দক্ষতা যেন কোনো অংশে কম না হয়।
নিশ্চয়ই, অন্যমনস্ক ভাবে মিসেস হার্বার্ড বলে উঠলো, মানুষজনের ব্যাপারে ফেলিসিটি কখনো তেমন যত্ন নেয়নি, কিন্তু আমি নিয়ে থাকি, আর সেই কারণে আমি চিন্তিত।
তা তোমার চিন্তার কারণটা ঠিক কি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলতে পারবে?
হ্যাঁ আমি পারি; চুরির কেস, টাকা গহনা হলেও তবু বলা যেতো নির্ভীক চোর সে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিপরীত তবে ক্রেমাটোম্যানিয়া কিংবা অসৎ কাজ বলা যেতে পারে। উধাও হওয়া জিনিসগুলো তালিকা পরে শোনাচ্ছি। সে তার হাতব্যাগ থেকে ছোট্ট নোটবই বার করল।
সান্ধ্যজুতো (নতুন একপাটি)
ব্রেসলেট (কস্টিউম জুয়েলারি)
হীরের আংটি (সুপের প্লেটে পাওয়া গেছে)। পাউডার, লিপস্টিক, স্টেথোস্কোপ, কানের দুল, সিগারেট, লাইটার, পুরানো ফ্লানেলের ট্রাউজার, ইলেকট্রিক লাইট বাল্ব, চকোলেট বাক্স, স্লিকস্কাফ (টুকরো টুকরো করা অবস্থায় পাওয়া গেছে) ঝোলাব্যাগ (টুকরো টুকরো করা) বোরিক পাউডার, বাথ সল্ট, রান্নার বই।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো এরকুল পোয়ারো, উল্লেখযোগ্য বটে, বললো সে, আর একেবারে মনোরম, মিসেস হার্বার্ডের দিকে তাকিয়ে বললো সে, আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
কিন্তু কেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
এমন একটা অদ্বিতীয় আর চমৎকার সমস্যা উপস্থাপন করার জন্য অভিন্দন জানাচ্ছি।
মঁসিয়ে পোয়ারো মনে হচ্ছে সমস্যাটা আপনি বুঝতে পেরেছেন!
কিন্তু না, এখনো পর্যন্ত আমি কিছুই বুঝিনি, এ প্রসঙ্গে খ্রিস্টমাসের সময় আমার কয়েকজন তরুণ বন্ধুর এক ধরনের খেলার কথা মনে করিয়ে দেয় আমাকে, তিনজন মহিলা লেডি, প্রতিটি মহিলার সুযোগ এলে তারা একটা প্রবাদ উচ্চারণ করতো। আমি প্যারিসে গিয়েছিলাম সেখানে আমি একটা জিনিস ক্রয় করি। জিনিসের নাম যে যার প্রয়োজন মতো বসিয়ে দেয় তাদের লেখার মধ্যে। পরবর্তী ব্যক্তি একইভাবে সেই প্রবাদের পুনরাবৃত্তি করে এবং আর একটা জিনিসের নাম বসিয়ে দেয়। এই খেলার উদ্দেশ্য হলো, তাদের বর্ণিত জিনিসগুলো ঠিক ঠিক মনে রাখা, এ এক ধরনের অস্বাভাবিক ও বিস্ময়কর ধরনের খেলা বলে আমি মনে করি। একখণ্ড সাবান, একটা সাদা হাতি, একটা টেবিল আর একটা রাশিয়ান পাতিহাঁস, এমন জিনিসগুলোই কেবল মনে করতে পারি। অবশ্যই মনে রাখার অসুবিধার কারণ হলো একটা জিনিসের সঙ্গে অপর জিনিসের কোনো যোগ নেই-বলা যেতে পারে পরিণতির অভাব, যেমন এইমাত্র যে তালিকাটা আমাকে দেখালেন, বারোটা জিনিস সঠিক ভাবে সাজানো অসম্ভব ব্যাপার, ব্যর্থ হলে একটা কাগজের শিঙা প্রতিযোগীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। সে নারী কিংবা পুরুষই হোক তাকে পরবর্তী সময়ে আবৃত্তি চালিয়ে যেতে এই শর্তে আমি একজন শিঙাওয়ালা মহিলা প্যারিসে গিয়েছিলাম ইত্যাদি, তিনটি শিঙা সংগৃহীত হলে তার অবসর নেওয়াটা বাধ্যতামূলক, এক্ষেত্রে শেষ জন বিজয়ী হবে।
মঁসিয়ে পোয়ারো, তুমিই যে বিজয়ী, আমি নিশ্চিত, অনুগত কর্মিণীর বিশ্বাস নিয়ে বললো মিস লেমন।
পোয়ারোর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো।
হ্যাঁ, এটাই ঘটনা, বললো সে, এমনকি ভীষণভাবে এলোমেলো জিনিসগুলোও ঠিক ঠিক ভাবে সাজানো যেতে পারে–তবে উদ্ভাবনী দক্ষতা ও পরিণতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। যেমন একজন নিজেই নিজেকে বলে, টেবিলের উপর রাখা একটা বিরাট মার্বেল পাথরের সাদা হাতির ময়লা আমি একখণ্ড সাবান দিয়ে পরিষ্কার করি–এইরকম আর কি?
প্রথার সাথে মিসেস হার্বার্ড বলে উঠলো, তাহলে সম্ভবত যে তালিকাটি আমি আপনাকে দিয়েছি সেটা দিয়ে একই জিনিস আপনি করতে পারেন।
নিঃসন্দেহে আমি করতে পারি। একজন মহিলা তার ডানপায়ে জুতো পরে, বাঁ হাতে ব্রেসলেট পরলেন, তারপর তিনি মুখে পাউডার ও ঠোঁটে লিপিস্টিক লাগিয়ে নিচে নৈশভোজের জন্য নেমে আসেন এবং তার আংটিটা স্যুপের মধ্যে ফেলে দেন-এই রকম আরকি। সুতরাং আপনার তালিকা থেকে এইভাবে আমি মনে করতে পারি কিন্তু তাই বলে এই নয় যে, এটাই আমাদের কার্য। কথা হচ্ছে এলোমেলোভাবে জিনিসগুলো কেন চুরি করা হলো? এর পিছনে কোনো রীতি বা নিয়ম আছে? কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা কিংবা সেরকম কিছু এখানে প্রাথমিক বিশ্লেষণ করতে হবে। প্রথম কাজ হবে জিনিসগুলোর তালিকা সতর্কতার সঙ্গে অনুধাবন করা।
একটা নীরবতা নেমে আসে। পোয়ারো নিজেই অনুধাবন করতে থাকে, বাচ্ছা ছেলে মেয়েকে দেখার মতো পোয়ারোকে নিবিষ্ট মনে নিরীক্ষণ করতে থাকে মিসেস হার্বার্ড, সবশেযে পোয়ারো মুখ খুলতেই লাফিয়ে উঠলো মিসেস হার্বার্ড।
প্রথম যে জিনিসটা আমার মনে দাগ কেটেছে সেটা হলো, বললো পোয়ারো, উধাও হয়ে যাওয়া জিনিসগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই কম দামের, ব্যতিক্রম শুধু দুটি ক্ষেত্রে স্টেথোস্কোপ আর হীরের আংটি। একমুহূর্তের জন্য স্টেথোস্কোপটা আলাদা করে সরিয়ে রেখে আংটিটার উপর আমি মনোনিবেশ করতে চাই, আপনি বলেছেন এটা দামি জিনিস–তা এর দাম কতো হতে পারে?
ঠিক কতো যে আমি তা বলতে পারবো না আঁসিয়ে পোয়ারো। সেটা ছিল একটা কাটা হীরে, ওটা মিস্ লেমনের মায়ের বাগদানের চিহ্ন স্বরূপ আংটি, ওটা পাওয়া যাচ্ছে না শুনে তিনি মুষড়ে পড়েন। সেই দিনই সন্ধ্যায় মিস্ জনহাউসের স্যুপের প্লেটের ভেতর থেকে সেটা পাওয়া যেতেই আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম
সুতরাং এরকমই কিছু একটা ঘটে থাকবে, কিন্তু আমি মনে করি, জিনিসগুলো চুরি যাওয়া আর ফিরে পাওয়া অর্থপূর্ণ, ধরুন যদি লিপস্টিক, পাউডার কিংবা বই হারাতো সেক্ষেত্রে আপনাদের পুলিশকে খবর না দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি। কিন্তু দামি হীরের আংটিটা স্বতন্ত্র। পুলিশ যে আসবে সে সম্ভাবনা সব সময়েই থাকতে পারে। তাই আংটিটা ফিরিয়ে বেতন্ত্র পুলিশ যে আসদেওয়াটা যুক্তিযুক্ত পাউডার কিংবা বই
কিন্তু যেই নিক না কেন, ফেরত যে দিতে হবে তা জেনেও কেনই বা সেই আংটিটা নিতে গেলো?
ভ্রুকুটি করলো মিস লেমন।
তবু কেন? বললো পোয়ারো, সে প্রশ্নে আমি পরে আসছি, আমি এইসব জিনিস চুরির শ্রেণিবিভাগ করতে ব্যস্ত, প্রথমে সেই হীরের আংটির কথাই ধরা যাক। কে এই মিস যেমন, যার কাছ থেকে আংটিটা চুরি যায়? যথেষ্ট আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে নিশ্চয়ই?
ওহো না, তার নিজস্ব অর্থ বলতে যৎসামান্যই, তবে সবসময়ই খুবই সতর্ক সে। যে আংটিটার কথা আমি বলছি সেটা ছিলো না। সম্প্রতি ধূমপানও বন্ধ করে দিয়েছিলো সে।
তাহলে তার পছন্দ কি? তোমার নিজের ভাষায় মেয়েটির সম্পর্কে কিছু তো।
বেশ তাহলে শুনুন। নেহাতই সাদামাটা দেখতে, নারী সুলভ চেহারা কিন্তু তার মধ্যে খুব বেশি দীপ্তভাবে কিংবা জীবনবোধ বলতে কিছু নেই। কি বলবেন তাকে–তবে হ্যাঁ তার মধ্যে আন্তরিকতার অভাব নেই।
তার আংটি আবার মিস জনহাউসের স্যুপের প্লেট থেকে ফেরৎ পাওয়া যায়। তা কে এই মিস জনহাউস?
ভ্যালেরি জনহাউস। চতুর মেয়ে সে, ময়লা রং, ব্যঙ্গে ভরা তার কথাবার্তা। একটা বিউটি পার্লারে কাজ করে সে। ম্যানরি না মোয়ার–নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই, এই দুটি মেয়ে পরস্পরের বন্ধু।
কি যেন চিন্তা করলো মিস হার্বার্ড। তারপর বললো সে, হ্যাঁ আমি বলবো সেইরকমই। পরস্পরের মধ্যে তাদের কিছু করার ছিলো না। আমি বলবো প্রত্যেকেরই সঙ্গেই প্যাট্রিসিয়ার ভাব ছিলো। কিন্তু ভ্যালেরি জনহাউসের অনেক শত্রু তার ওই ধরনের বাঁকা বাঁকা কথার জন্যই হয়তো…সেটা সে জানতোই বটে, আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।
মনে হয় জানি, বললো পোয়ারো।
সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে যে চমৎকার মেয়ে এই প্যাট্রিসিয়া, কিন্তু একটু অনুজ্জ্বল, নিষ্প্রভ যাকে বলে আর কি, তবে ভ্যালেরি জনহাউসের ব্যক্তিত্ব আছে, পোয়ারো চুরি যাওয়া তালিকার উপর আবার মনোনিবেশ করলো অতঃপর।
তা কিসের জন্য এত ষড়যন্ত্র? এখানে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জিনিস চুরি গেছে। জিনিসগুলো খুবই সামান্য প্রকৃতির। এই জিনিসগুলো কেবল জীবনে ব্যর্থ মেয়েদেরই প্রলোভিত করতে পারে। যেমন ধরা যাক সম্ভবত লিপস্টিক, কস্টিউম জুয়েলারি, পাউডার, বাথ সল্ট, চকোলেটের বাক্স। তারপর স্টেথোস্কোপের প্রসঙ্গে আসা যাক : কোথায় এটা বিক্রি করা যায় কিংবা বন্ধকী রাখা যায় চোর সে কথা বেশ ভালো ভাবেই জানে। এর মালিক কে?
মিঃ বেটসন-দারুণ বন্ধুসুলভ তরুণ সে।
মেডিক্যাল ছাত্র?
হ্যাঁ।
সে কি খুবই ক্রুদ্ধ?
জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, ছেলেটি একেবারে নীরস, রগচটা–মুহূর্তে যা খুশি বলে দেবে, তবে অচিরেই তার রাগ পড়ে যায়। কোনো জিনিস চুরি গেলে নির্বিকার চিত্তে সে মেনে নেবে সেরকম প্রকৃতির মানুষ সে নয়।
তা সেরকম প্রকৃতির মানুষ এখানে আছে নাকি?
হা আছে–মিঃ গোপালরাম, আমাদের ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে একজন। সব ব্যাপারেই তার মুখে হাসি লেগেই থাকে, হাত নেড়ে সে বলে থাকে, কে কোনো জিনিসের মালিক, ওটা কোনো ব্যাপরই নয়।
তার কোনো জিনিস চুরি গেছে?
না।
আহ! আচ্ছা ফ্লানেলের ট্রাউজারটা কার?
মিঃ ম্যাকনারের, বহু পুরানো ট্রাউজার। অন্য কেউ হলে বলতো, পুরানো জিনিস চুরি গেছে তো কি হয়েছে। কিন্তু মিঃ ম্যাকনারের আবার পুরানো জিনিসের উপর ভীষণ টান, কোনো কিছুই ফেলে না সে।
তাহলে এখন আমরা মনে করতে পারি–চুরি যাওয়া জিনিসগুলো যেন মূল্যবান ছিলো না–পুরানো ফ্লানেলের ট্রাউজার, ইলেকট্রিক লাইটবাক্স, বোরিক বাউডার, বাথ সল্ট, রান্নার বই। ভুলবশতঃ বোরিক পাউডার সরানো হয়েছে; কেউ হয়তো নতুন বাল্ব বদলানোর জন্য বাতিল অকেজো বাল্বটা সরিয়ে থাকবে, কিন্তু পরে ভুলে গেছে রান্নার বইটা কেউ হয়তো ধার করে নিয়ে গেছে, কিন্তু আর ফেরৎ দেয়নি। আর ট্রাউজারটা কোনো ঠিকা ঝি নিয়ে গিয়ে থাকবে।
সাফাই-এর কাজের জন্য দুটি মেয়েকে রেখেছি। তাদের সম্পর্কে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, না জানিয়ে তারা এ কাজ করবে না।
তোমার ধারণাই হয়তো ঠিক। যাই হোক এরপর সান্ধ্য জুতোর কথায় আসা যাক। নতুন জুতাজোড়ার এক পাটি। কার সেটা?
সেলী ফিঞ্চের, আমেরিকান মেয়ে এখানে স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করছে সে।
সেটা যে কোথাও স্রেফ ভুল করে রেখে দেওয়া হয়েছে, অথচ জায়গাটার কথা কেউ মনে করতে পারছে না, এ ব্যাপারে তুমি কি নিশ্চিত? কারণ একপাটি জুতো কারোর কাজে লাগতে পারে না বলেই এ কথা বলছি।
না মঁসিয়ে পোয়ারো, ভুল করে কোথাও রাখা হয়নি সেটা, আমরা সবাই তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, কিন্তু কোথাও পাইনি। মিস ফিঞ্চের একটা পার্টিতে যাওয়ার কথা ছিলো। সান্ধ্যপার্টি আমরা যাকে বলি ফর্মাল ড্রেস–পোশাকের সঙ্গে জুতোও মানিয়ে পড়তে হয়। তাহলে বুঝতেই পারছেন সান্ধ্য জুতোটা তার কাছে কতোই না জরুরী ছিলো।
তাহলে তার নিশ্চয়ই খুব অসুবিধা হয়েছিল–সেই সঙ্গে বিরক্তও হয়ে থাকবে সে।
-হা-হা। আমার আশঙ্কা, সম্ভবত এক্ষেত্রে জুতোেচুরির ব্যাপারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক জড়িয়ে থাকলেও থাকতে পারে–একটু সময়ের জন্য নীরব থাকে সে, এরপর আরো দুটো জিনিস বাকি থাকে-টুকরো টুকরো করে কাটা একটা ঝোলা, আর একই ভাবে কেটে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা একটা সিল্কের স্কার্ফ, এ দুটি অস্বাভাবিক কাজের ব্যাপারে আমরা বলতে পারি, এর পিছনে কোনো অসার দম্ভ কিংবা লোভের সম্পর্ক নেই। বরং বলা যেতে পারে ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রতিহিংসা নেওয়ার একটা প্রবণতা থেকে যায়। ঝোলাটা কার?
প্রায় সব ছাত্রছাত্রীদেরই একটাই দোকান থেকে কেনা। তাই সেটা যে আসলে কার নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল, তবে মনে হয় সেটা লিওনার্ড বেটসন কিংবা কলিন ম্যাকনারের হতে পারে।
আর সিল্কের স্কার্ফটা কার?
ভ্যালেরি জনহাউসের, সেটা সে খ্রিস্টমাসের উপহার হিসাবে পেয়েছিল। পান্নার মতো সবুজ রঙ-সত্যি সেটা খুবই উৎকৃষ্ট ছিলো।
মিসেস হার্বার্ড তোমার জন্য শুভ কখন চুরি যায় বলোতোসিয়ে পোয়ারো।
মিস জনহাউসের তাই বুঝি!
চোখ বন্ধ করলো পোয়ারো, মনে মনে একটা দূরবীন উপলব্ধি করেছিল সে। সে যেন সেই দূরবীন দিয়ে লক্ষ্য করছিল, ঝোলা ও স্কার্ফের কাটা টুকরো টুকরো অংশ, রান্নার বই, লিপস্টিক, বাথ সল্ট নখ আর বুড়ো আঙুলের নখগুলো অনেক পুরানো ছাত্রীদের কথাই মনে করিয়ে দেয়? কেন কোথাও এগুলো একত্র করার সঙ্গত কারণ নেই। একটার সঙ্গে আর একটা ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। লোকেরা চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু পোয়ারো বেশ ভালোভাবেই জানে যেভাবেই হোক আর কোথাও না কোথাও এসবের একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ ঠিক আছে। সম্ভবত অনেক উদাহরণ। সম্ভবত প্রত্যেক সময়ে দুর্দিনে বিভিন্ন নিদর্শন পরিলক্ষিত হতে পারে। কিন্তু সেইসব নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটাই সঠিক–তবে এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোথা থেকে শুরু করা যায়–
চোখ মেলে তাকাল সে।
এ ব্যাপারে আরো কিছু প্রতিফলন দরকার। ভালোরকম প্রতিফলন মানে বিশ্লেষণ।
ওহো, নিশ্চয়ই মঁসিয়ে পোয়ারো, আগ্রহ সহকারে জোর দিয়ে বললো মিসেস হার্বার্ড, আপনাকে আমি কষ্ট দিচ্ছি না তো
না, না একটুও নয়। আমাদের এখন বাস্তব দিকটার কথা ভাবতে হবে। এবার তাহলে শুরু করা যাক–সেই জুতো, সান্ধ্যজুতোহা মিস্ লেমন সেখান থেকেই আমরা শুরু করতে পারি।
হ্যাঁ, মঁসিয়ে পোয়ারো। মিস্ লেমন লেখার প্যাড আর পেন্সিল নিয়ে লিখতে বসে গেলো।
সম্ভবত মিসেস হার্বার্ড তোমার জন্য অপর জুতোর পাটিটা সংগ্রহ করবে। তারপর বেকার স্ট্রিটে হারানো সম্পত্তির বিভাগে যাবে। আচ্ছা কখন চুরি যায় বলোতো?
একটু সময় চিন্তা করে বললো মিসেস হার্বার্ড, হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে মাঁসিয়ে পোয়ারো। সম্ভবত মাস দুই আগে হবে? ঠিক কোনো দিন এখুনি সেটা বলতে পারছি না, তবে সান্ধ্য পার্টির তারিখটা মিস্ সেলী ফিঞ্চ-এর কাছ থেকে জেনে বলতে পারি।
হ্যাঁ, সেই ভালো–আর একবার মিস্ লেমনের দিকে ফিরলো সে, এ ব্যাপারে তোমাকে একটু লুকোচুরি খেলা খেলতে হবে। তুমি বলবে, আর একপাটি জুতো ইনার সার্কল ট্রেনে ফেলে এসেছ–এরকম ঘটা স্বাভাবিক–কিংবা অন্য কোনো ট্রেনে ফেলে আসার কথাও বলতে পারো। আমরা বাসে, আচ্ছা হিকরি রোডে কতগুলো চলাচল করে?
মাত্র দুটি মঁসিয়ে পোয়ারো।
ভালো, বেকার স্ট্রিট থেকে সাড়া না পেলে এখন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে চেষ্টা করে দেখতে পারো, আর তাদের বলো একপাটি জুতো ট্যাক্সিতে ফেলে এসেছে।
কিন্তু আপনি কেন ভাবছেন–মিসেস হার্বার্ড শুরু করতে চায়। পোয়ারো বাধা দিলো তাকে।
ফলাফলটা কি হয় আগে দেখা যাক, তারপর সেগুলো যদি ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক হয়, তখন তুমি, আমি আর মিসেস হার্বার্ড অবশ্যই আবার আলোচনায় বসবো। এখন তুমি বলো কোনো কোনো জিনিস যা আমার জানা একান্ত প্রয়োজন।
সত্যি কথা বলতে কি আমার মনে হয়, আমি সব কিছুই বলেছি।
না, না, আমি তোমার সঙ্গে ঠিক একমত হতে পারছি না, এখানে আমরা বিভিন্ন যুবক যুবতাঁকে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতে দেখেছি, যাদের মেজাজ একজনের থেকে আর একজনের একেবারে বিপরীত। ব্যাপারটা এইভাবে সাজানো যেতে পারে–এ ভালোবাসে বিকে, কিন্তু বি ভালোবাসে সিকে আর সম্ভবত ঐজন্য ডি ও ই ছোরা জাতীয় অস্ত্র উঁচিয়ে আছে, এসব খবরই আমাকে জানতে হবে, পারস্পরিক মানবিক ভাবপ্রবণতা, ঝগড়া-বিবাদ, হিংসা-বন্ধুত্ব, অশুভ কামনা বা অপকারের ইচ্ছা এবং সবরকম নির্মমতা।
কিন্তু আমি নিশ্চিত, অস্বস্তিবোধ করলো মিসেস হার্বার্ড, এসব ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ আমি জানি না। আর আমি তাদের সঙ্গে তেমনভাবে মেলামেশাও করি না, হোস্টেলটা আমি পরিচালনা করি মাত্র, আর ক্যাটারিং-এর দেখাশোনা করে থাকি। ব্যস এই অব্দি।
কিন্তু মানুষজনদের ব্যাপারে তুমি আগ্রহী। তুমি আমাকে সেইরকম বলেছো। তুমি তরুণদের ভালোবাসো। এই কাজটা তুমি অতো টাকা রোজগারের জন্য নয় মানুষের সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার জন্য, কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের তুমি পছন্দ করে থাকো, আবার কেউ কেউ তোমার পছন্দের তালিকায় পড়ে না। এ ব্যাপারে তুমি আমাকে বলবে হ্যাঁ, তোমাকে বলতই হবে। কারণ তুমি চিন্তিত-তাই বলে যা ঘটেছে তার জন্য নয়–তা হলে তুমি অনেক আগেই পুলিশের শরণাপন্ন হতে
হোস্টেলে পুলিশ প্রবেশ করুক মিসেস নিকোলেটিস তা চান না, একথা আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি।
না, তুমি এমন একজনের জন্য চিন্তিত–যাকে তুমি মনে করো এসবের জন্য দায়ী সে কিংবা অন্তত এ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছে সে। কেউ একজন, সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, তাকে তুমি পছন্দ করে থাকো।
সত্যি মঁসিয়ে পোয়ারো?
হ্যাঁ সত্যিই তাই, আর আমি মনে করি, তোমার সেই উদ্বেগ যথার্থ, সেই সিল্কের স্কার্ফটা টুকরো টুকরো হওয়া ভালো নয়। আর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়া সেই ঝোলাটা, সেটাও ভালা ব্যাপার নয়। বাকি ঘটনাগুলো ছেলেমানুষি–তবু আমি এখনো নিশ্চিত নই। না, আমি একেবারই নিশ্চিত নই।
.
০৩.
একটু দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে এলো মিসেস হার্বার্ড। ২৬এ, হিকরি রোডে তার দরজা খুলে দাঁড়াতেই পিছন থেকে একজন বড় মাপের লালচুলের যুবক বলে উঠলো : হ্যালো মা-লিওনার্ড বেটসন তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই সম্বাধন করেছিল, তার হৃদয়টা বন্ধু সুলভ এবং তার স্বভাবে হীনমন্যতা কিংবা কোনো রকম জটিলতার স্থান নেই। হৈ-চৈ করতে বেরিয়েছিলেন বুঝি?
মিঃ বেটসন, মনে রেখো আমি চা পান করতে বেরিয়েছিলাম। একেই আমার দেরি হয়ে গেছে, এখন আর আমার দেরি করো না।
জানেন, আজ আমি একটা সুন্দর মৃতদেহ কাটাছেঁড়া করেছি, বললো লিও। একেবারে টুকরো টুকরো করে কেটেছি যাকে বলে।
বেয়ারা ছেলে, ওরকম ভয়ঙ্কর হয়ো না। চমৎকার মৃতদেহ, তাই নাকি? আমাকে একেবারে খুঁতখুঁতে ভেবো না।
শব্দ করে হাসলো বেটসন। হা-হা-হা শব্দটা সারা হলে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরলো।
মেলিয়ার কাছে কিছুই নয় ভেবেছিলাম, বললো সে, ডিসপেনসারিতে গিয়েছিলাম, একটা মৃতদেহ সম্পর্কে তোমাকে বলতে এসেছিলাম। আমি বলি, হঠাৎ তার মুখটা সাদা কাগজের মতো হয়ে গেলো। আমি তো ভাবলাম বুঝি বা মারা গেলো সে, আচ্ছা মা হার্বার্ড, এ ব্যাপারে আপনি কি মনে করেন? আশ্চর্য হননি।
এতে আমি বিন্দুমাত্র অবাক হইনি, মিসেস হার্বার্ড বলে, সম্ভবত মেলিয়া ভেবেছিল তুমি সত্যিকারের মৃতদেহের কথা বলছো তাকে।
কি বলতে চান আপনি, সত্যিকারের মৃতদেহ নয়? মৃতদেহগুলো কি বলে মনে করেন আপনি? সিন্থেটিকের?
অবিন্যস্ত চুলের একটি পাতলা রোগাটে যুবক ডানদিকের ঘর থেকে বেরিয়ে চলতি পথে বলে উঠলো, ওহো, তুমি? আমি তো ভেবেছিলাম, কোনো যণ্ডামার্কা লোক বুঝি, কণ্ঠস্বর তো একজনের, কিন্তু গলার জোর শুনে মনে হয়েছিল বুঝি দশটা লোক একসাথে কথা বলছে।
আশা করি, তাতে তোমার স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়েনি নিশ্চয়?
স্বাভাবিকের বেশি কিছু নয়? বললো নিজেল চ্যাপম্যান, এবং ফিরে চললো আবার।
বেচারা! আমাদের মৌসুমী ফুল, বিদ্রূপ করে বললো বেটসন অপসৃয়মাণ চ্যাপমানের দিকে তাকিয়ে।
দেখো লিও, তোমার দুটো বদ স্বভাব পাল্টাতে হবে, বললো মিসেস হার্বার্ড। মেজাজটা ভালো করতে হবে, যা আমি পছন্দ করি, আর দেওয়া নেওয়ার মনোভাব নিতে হবে তোমাকে।
মিসেস হার্বার্ডের স্নেহভরা কথা শুনে অমন বড় মাপের তরুণ লিওনার্ডের মাথাটা শ্রদ্ধায় নেমে পড়লো, জানো মা, আমাদের নিজেকে আমি পর ভাবি না। সেই সময়, একটি মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিল, চিৎকার করে বলে উঠলো সে, ওহো মিসেস হার্বার্ড আপনি এসে গেছেন। মিসেস নিকোলেটিস তার ঘরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাড়াতাড়ি যান।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিসেস হার্বার্ড, তারপরেই উপরতলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো সে।
উপরে কি হয়েছে ভ্যালেরি? যথা সময়ে হার্বার্ড মার কাছে আমাদের স্বভাবের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো বুঝি পাঠিয়ে দেওয়া হবে?
মেয়েটি তার সুন্দর কাঁধ ঝাঁকিয়ে হলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে গিয়ে বলে উঠলো, দিনকে দিন এই বাড়িটা পাগলাগারদের মতো হয়ে উঠছে, তারপর সে আর মুহূর্তের জন্যও দাঁড়ালো না সেখানে।
ছাব্বিশ নং হিকরি রোড আসলে দুটো বাড়ির সমন্বয়, ২৪ এবং ২৫ নং পাশাপাশি। একেবারে নিচের তলাটা একই বাড়ির মতোন। সেখানে দুটো বাড়ির বসবার ঘর, ডাইনিংরুম এবং দুটো ক্লোকরুম, বাড়ির পিছন দিকে একটা ছোট্ট অফিস ঘর। তবে দুটি আলাদা সিঁড়ি বাড়ির ওপর তলায় যাওয়ার পথ। বাড়ির ডানদিকের ঘরগুলো মেয়েদের অধিকারে এবং অন্যদিকে ২৪ নং বাড়িতে ছেলেরা থাকে। মিসেস নিকোলেটিসের ঘরের দরজায় মৃদু টোকা মেরে ঢুকলো মিসেস হার্বার্ড।
মিসেস নিকোলেটিসের বসবার ঘরটা বড় গরম। বড় বৈদ্যুতিক চুল্লিটা সবসময়ই জ্বালা থাকে, জানালাটা সবসময়ই আঁট করে বন্ধ; ময়লা সিল্ক এবং ভেলভেটের কুশানে মোড়া সোফার উপর বসে ধূমপান করছিলেন মিসেস নিকোলেটিস। কালো বড়মাপের চেহারা তার; তা সত্ত্বেও এখনো তাকে দেখতে পেশ ভালোই লাগে। অবশ্য মুখ দেখলে বদমেজাজী বলেই মনে হয়। চোখ দুটো বাদামী রং-এর।
আচ্ছা, তাহলে তুমি এসে গেছ। মিসেস নিকোলেটিসের কণ্ঠস্বরে একটা প্রচ্ছন্ন অভিযোগের সুর যেন শোনা গেল।
সত্যিকারের লেমন রক্তের মানুষ মিসেস হার্বার্ড অবিচলিত। হ্যাঁ, তীক্ষ্ণস্বরে বললো সে, আমি এসে গেছি। শুনলাম, আপনি নাকি আমাকে বিশেষভাবে ডেকে পাঠিয়েছেন?
হ্যাঁ অবশ্যই, এটা বিস্ময়কর, অস্বাভাবিকের থেকে কিছু কম নয়।
বিস্ময়কর কিসের?
এই বিলগুলো। তোমার হিসেব, সফল যাদুকরের মতো কুশনের নিচ থেকে কতকগুলো কাগজ বার করে তার সামনে মেলে ধরে তিনি বললেন, এই সব হতভাগ্য ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারে আমরা কি খেতে দিচ্ছি? দিনকে দিন নিস্তেজ হয়ে পড়ত তারা। এই সব ছাত্রছাত্রীরা কে, তাদের কথা কে চিন্তা করবে?
তরুণ ছাত্রছাত্রীদের খিদে মেটানোর জন্য, বললো মিসেস হার্বার্ড, ভালা প্রাতঃরাশ আর রাতে সুন্দর নৈশভোজের ব্যবস্থা থাকে। এ সবই মিতব্যয়িতার সাথে করা হয়। একটুও বাড়তি খরচ হয় না।
মিতব্যয়িতার সাথে? একটুও বাজে খরচা হয় না? একথা তুমি আমাকে বলতে পারলে? বিশেষ করে আমি যখন শেষ হয়ে যাচ্ছি?
কেন, এখান থেকে আপনি তো বেশ ভালো লাভই করেছেন মিসেস নিকোলেটিস। ছাত্রছাত্রীদের কাছে দরটা একটু বেশিই বলতে হয়। সে যাই হোক, তরুণ ছাত্রছাত্রীদের ঠিক মতো খাবারের যোগান দিতে হবে।
বাঃ এই বিলগুলোর মোট খরচের অঙ্কটা স্ক্যান্ডালে ভরা। এর জন্য দায়ী ওই ইতালীয় বাঁধুনী আর তার স্বামী। খাবারের ব্যাপারে তারা তোমাকে প্রতারণা করছে।
ওহো, না তারা একাজ করতেই পারে না মিসেস নিকোলেটিস। আমি আপনাকে আশ্বাস দিতে পারি, কোনো বিদেশীই আমার ঘাড়ে এ রকম দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারে না।
তাহলে তুমি, হ্যাঁ তুমিই আমাকে ঠকাচ্ছো।
আগের মতো তেমনি অবিচলিত রইলো মিসেস হার্বার্ড–আমি আপনাকে এ ধরনের কথা বলার অনুমতি দিতে পারি না। মিসেস হার্বার্ড এমন ভাষায় কথা বললেন, যেন সাবেকি আমলের দিদিমা তার নাতনীকে নিষ্ঠুরভাবে দোষারোপ করছে। এটা কোনো ভালো কাজ নয়, বিশেষ করে আজকের দিনে, আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, এভাবে চললে আপনাকে অসুবিধায় পড়তে হবে।
আচ্ছা, নাটকীয় ভাবে বিলগুলো শূন্যে ছুঁড়ে ফেললেন মিসেস নিকোলেটিস। মেঝের উপর যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়লো সেগুলো, নিচু হয়ে সেগুলো নীরবে কুড়োতে থাকলো মিসেস হার্বার্ড। আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছেন, উত্তেজিত করে তুলছেন, তার নিয়োগকর্তী চিৎকার করে উঠলেন।
আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, থাকতে না পেরে এবার বলে উঠলো মিসেস হার্বার্ড, কিন্তু আপনার পক্ষে এটা খারাপ, ব্লাডপ্রেসারের ক্ষেত্রে উত্তেজিত হওয়া খুবই খারাপ।
তুমি স্বীকার করছে গত সপ্তাহের চেয়ে এ সপ্তাহের খরচ অনেক বেশি?
অবশ্যই। এখন ল্যাম্পসন স্টোর্সের সব জিনিসের দামই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেখবেন আগামী সপ্তাহের খরচ অনেক কমে যাবে। গোমড়া মুখ করে তাকালেন মিসেস নিকোলেটিস।
আপাতদৃষ্টিতে সব কিছুই তুমি বেশ ন্যায়সঙ্গত ভাবে ব্যাখ্যা করে থাকে। আপনার আর কিছু বলার আছে?
আমেরিকান মেয়ে সেলী ফিঞ্চ বলছিল এখান থেকে চলে যাবে সে, আমি তাকে যেতে দিতে চাই না। সে একজন ফালব্রাইট স্কলার। অন্য ফালব্রাইট স্কলারদের এখানে নিয়ে আসতে পারে সে। তাই দেখতে হবে সে যেন এখান থেকে চলে না যায়।
তা তার চলে যাওয়ার কারণ?
মিসেস নিকোলেটিস পাহাড় সমান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, আমি কি করে মনে রাখবো? তাছাড়া কারণটা আসলও নয়, যেকথা আমি বলতে পারতাম।
চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লো মিসেস হার্বার্ড। এ প্রসঙ্গে মিসেস নিকোলেটিসের কথা বিশ্বাস করতে অপারগ সে।
আমাকে তো সেলী কোনো কথা বলেনি? বললো সে, কিন্তু তার সঙ্গে তোমাকে কথা তো বলতেই হবে?
হ্যাঁ অবশ্যই।
আর যদি এইসব কালো চামড়ার ছাত্রছাত্রীরা–এইসব ভারতীয়রা, এইসব নিগ্রোরা তার চলে যাওয়ার কারণ হয়, তাহলে তারা বরং সবাই এখান থেকে চলে যেতে পারে বুঝলে? এই বর্ণবৈষম্যের ঝামেলায় আমি আমেরিকানদের পক্ষে। এক অদ্ভুত নাটকীয় ভঙ্গিমা করলেন তিনি।
আমি যতদিন দায়িত্বে আছি তা হতে দেবো না, শান্তস্বরে বললো মিসেস হার্বার্ড। সে যাই হোক, আপনার পথ ভুল। এখানে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেরকম মনোভাব নেই। আর আমার বিশ্বাস, সব ব্যর্থ, সেলীও সেরকম ধরনের মেয়ে নয়। সে আর মিঃ অ্যাকিমবোকে প্রায়ই একই সাথে মধ্যাহ্নভোজ সেরে থাকে, আর তার থেকে বেশি অন্য কেউ কালো চামড়ার পুরুষ হতে পারে না।
তারপর কমিউনিস্টদের প্রসঙ্গও আছে–তুমি তো জানো কমিউনিস্টদের সম্পর্কে আমেরিকানদের কিরকম ধারণা, নিজেল চ্যাপম্যান এখন একজন কমিউনিস্ট।
এতে আমার সন্দেহ আছে।
হা, হা, সেদিন সন্ধ্যায় কি বলেছিল তোমার শোনা উচিত ছিলো। লোকেদের বিরক্ত করার জন্য নিজেল যা খুশি বলতে পারে। সেদিক থেকে খুবই ক্লান্ত সে।
তুমি ওদের বেশ ভালো করেই জানো, প্রিয় মিসেস হার্বার্ড। সত্যিই তুমি বড় চমৎকার মেয়ে। আমি বার বার নিজেকে বলে থাকি-মিসেস হার্বার্ড ছাড়া আমি কি করবো? আমি ভয়ঙ্করভাবে তোমাকে বিশ্বাস করি।
তার মানে পাউডার দেওয়ার পর জ্যাম, ব্যঙ্গ করে বললো মিসেস হার্বার্ড।
সে আবার কি?
কিছু নয়। চিন্তা করবেন না, আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। এরপরেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো মিসেস হার্বার্ড। উৎসাহের সঙ্গে তার ধন্যবাদ জ্ঞাপনের নকল ভাবাবেগটা এড়ানোই কারণ হতে পারে, নিজের মনে বললো সে : মিথ্যে আমার সময় নষ্ট করা–কি রকম পাগল করা মহিলা উনি। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে তার বসবার ঘরে এসে ঢুকলো।
কিন্তু মিসেস হার্বার্ডের জন্য শান্তি এখনো বিলম্বিত। ঘরে সে প্রবেশ করা মাত্র দীর্ঘদেহী একজন নারী উঠে দাঁড়াল। আমি আপনার সাথে কয়েক মিনিট কথা বলতে চাই। দয়া করে আপনি যদি
নিশ্চয়ই, হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আমি তোমার কথা শুনবো এলিজাবেথ, দারুণ বিস্মিত মিসেস হার্বার্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মেয়ে এই এলিজাবেথ জনস্টন আইনের ছাত্রী, উচ্চাভিলাষী এবং কঠোর পরিশ্রমী সে। চৌখস এবং যোগ্য মেয়ে সে, হোস্টেলে সফল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজন সে, এইজন্যই মিসেস হার্বার্ড সবসময় তাকে শ্রদ্ধা জানায়।
এখন সে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু তার কথার মধ্যে একটা তোতলানো ভাব লক্ষ্য করলো মিসেস হার্বার্ড! তবে তার কালো চেহারাটা যেন অনুভূতিহীন। কোনো ব্যাপার-ট্যাপার আছে নাকি?
হা, দয়া করে আপনি আমার ঘরে আসবেন? প্লিজ যদি একটু দয়া করেন। এক মিনিট। মিসেস হার্বার্ড তার গা থেকে কোট এবং হাতের দস্তানা খুলে ফেলল। তারপর ঘরের বাইরে এসে অনুসরণ করলো মেয়েটিকে। একেবারে টপ ফ্লোরে মেয়েটির ঘর।
এই হলো আমার কাজের নোট, ঘরে ঢুকে মেয়েটি বললো, এতো : নোট লিখতে মাসের পর মাস লেগে গেছে। এ এক কঠিন অধ্যবসায়, আর দেখুন আমার সেই পরিশ্রমের কি হাল করা হয়েছে।
মিসেস হার্বার্ডের চোখ কপালে উঠলো, হা করে শ্বাস নিলো।
লেখার টেবিলের উপর কালি ছড়িয়ে রয়েছে। মোর্টের উপর সব কাগজগুলোর উপরেই কালি ছড়িয়ে পড়েছে। কালিসিক্ত কাগজগুলোর উপর হাত বোলালো, তখনো ভিজে ছিলো।
জেনেশুনে বোকার মতো প্রশ্ন করলো সে, তুমি নিজে কালি ছিটিয়ে দাওনি তো?
না, আমি নিজে কাগজে কালি ছিটাতে যাব কেন? আমার অসাক্ষাতে এই জঘন্য কাজটা করা হয়েছে।
তুমি কি মিসেস বিগসকে–
সাফাইয়ে কাজ করে মিসেস বিগস। একেবারে উপরতলার শয়নকক্ষের তদারকি করার ভার তার উপর।
না, মিসেস বিগস নয়। এমনকি আমার নিজের কালিও নয়, আমার কালি বিছানার উপর সেলফে রয়েছে–স্পর্শও করা হয়নি সেটা। বাইরের কেউ কালি নিয়ে এসে ইচ্ছা করে এ কাজ করেছে।
মিসেস হার্বার্ড মর্মাহত। খুবই জঘন্য কাজ এবং কাজটা অতি নিষ্ঠুরও বলা যেতে পারে। এখানে একটু থেমে সে আবার বললো, বলার মতো ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছি না এলিজাবেথ। আমি মর্মাহত, ভীষণভাবে মর্মাহত, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, এই শয়তানকে আমি ঠিক খুঁজে বার করবো, তবে এ ব্যাপারে তোমার কি ধারণা বলো।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো মেয়েটি। আপনি তো দেখেছেন, কালিটা সবুজ। সচরাচর সবুজ কালি কেউ ব্যবহার করে না। তবে একজনকে আমি এই কালি ব্যবহার করতে দেখেছি–তার নাম নিজেল চ্যাপম্যান।
নিজেল? একাজ ও করেছে বলে তুমি মনে করো? যাহোক অনেক প্রশ্ন আমাকে করতে হবে। এ বাড়িতে এমন একটা ঘটনা ঘটার জন্যে আমি দুঃখিত এলিজাবেথ। তবে আমি তোমাকে বলতে পারি, এর গোড়া উপড়ে দেওয়ার চেষ্টা আমি করবো।
ধন্যবাদ মিসেস হার্বার্ড।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মিসেস হার্বার্ড। কিন্তু নিচে আসার জন্য সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। কি ভেবে চলতে চলতে করিডোরের একেবারে শেষপ্রান্তে গিয়ে হাজির হলো সে।
চমৎকার ঘর। আরো চমৎকার ঘরের অধিকারিণী সেলী ফিঞ্চ নিজে। সেলী তখন লিখছিল। তার ঘরে ঢুকে বললো মিসেস হার্বার্ড, এলিজাবেথ জনসনের কি হয়েছে শুনেছো?
তা ব্ল্যাক বেকের কি হয়েছে?
ছদ্মনামটা খুবই আদরের। মেয়েটি নিজেও সেটা গ্রহণ করেছে। অতঃপর কি ঘটেছে তার আনুপূর্বিক ব্যাখ্যা করে গেলো মিসেস হার্বার্ড। রাগের মধ্যে দিয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করলো সেলী। এ এক জঘন্য কাজ। কেউ করতে পারে বলে তো আমার বিশ্বাস হয় না। বিশেষ করে আমাদের বেকের মতো মেয়ের ক্ষতি। সবাই তাকে পছন্দ করে। তবে আমার ধারণা একজনই তাকে অপছন্দ করে। তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে এনে ভারাক্রান্ত গলায় বললো সেলী, আর এই কারণেই আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। মিসেস নিক আপনাকে বলেছেন?
হ্যাঁ, তিনি খুব মুষড়ে পড়েছেন। মনে হয় তোমার চলে যাওয়ার আসল কারণটা যে কি তা তুমি বলোনি।
বলিনি ঠিক কথা, তাকে ধোঁয়াশার মধ্যে ফেলাটা কোনো কাজের কথা নয় বলেই বলিনি। আপনিতো জানেন তিনি কি পছন্দ করেন, হ্যাঁ সেটাই আমার না বলার কারণ। এখানে যা যা সব ঘটেছে আমার একেবারেই পছন্দ নয়। আমার একপাটি জুতো হারানো, ভ্যালেরির স্কার্ফ টুকরো টুকরো করে ফেলা আর লেন-এর ঝোলা ব্যাগটার এইরকম হাল করা এ সবই অদ্ভুত ব্যাপার–এমন ভালো নয়। এক মুহূর্তের জন্য কী হলো যে, তারপর হঠাৎ দাঁত বার করে হাসলো সে। অ্যাকিমবোকে ভীত বললো সে, তাকে সবসময়েই শ্রেষ্ঠ এবং সভ্য বলে মনে হয়–কিন্তু সেকেলে ওয়েস্ট আফ্রিকানরা আবার বশীকরণ বা যাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী, এইসব অন্ধ কুসংস্কার। যতোসব অজ্ঞানতার পরিচয়।
আমার শোনার ধৈর্য নেই। কিছু সাধারণ লোক নিজেদের মধ্যে এরকম নোংরা কাজ করে থাকে।
দাঁত বার করে বাঁকা হাসি হাসলো সেলী। আপনি সাধারণ লোকের উপর জোর দিচ্ছেন, আমার ধারণা, এই বাড়িতেই এরকম একজন আছে সে মোটেই সাধারণ লোক নয়।
আর কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো মিসেস হার্বার্ড। এক তলায় ছাত্রদের কমনরুমে প্রবেশ করলো সে। মাত্র চারজন ছাত্রছাত্রী ছিলো সেখানে তখন। ভ্যালেরি জনহাউস তার সুন্দর দেহটা সোফায় এলিয়ে দিয়ে বসে আছে, নিজেল চ্যাপম্যান একটা টেবিলের সামনে বসে আছে। টেবিলের উপর একটা ঢাউস বই খোলা রয়েছে, ম্যান্টলপীসের দিকে ঝুঁকে পড়েছে প্যাট্রিসিয়া লেন এবং বর্ষাতি গায়ে একটি মেয়ে সবেমাত্র তখন কমনরুমে এসে প্রবেশ করেছিল। মিসেস হার্বার্ডকে দেখা মাত্র সে তার মাথা থেকে উলিক্যাপটা সরিয়ে দিল। মেয়েটি দেখতে বেশ ভালো, তার বাদামী চোখ দুটো বিস্ফারিত। যেন দারুণ অবাক হয়ে গেছে সে তাকে দেখে।
মুখ থেকে সিগারেটটা সরিয়ে ধীরে ধীরে অলস ভঙ্গিতে বলে উঠলো ভ্যালেরি, হ্যালো মা, আপনি কি আমাদের শ্রদ্ধেয় মালকিনকে মিষ্টি সিরাপ খাইয়ে এলেন?
সঙ্গে সঙ্গে প্যাট্রিসিয়া লেনও বলে উঠলো, তিনি কি মুগ্ধদেহীং মনোভাব অবলম্বন করেছেন?
দেখো এখানে একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে, বললো মিসেস হার্বার্ড, আর নিজেল, আমি চাই এ ব্যাপারে তুমি আমাকে সাহায্য করো।
মা আমি? বইটা বন্ধ করে তার দিকে তাকাল নিজেল। হঠাৎ একটা বদ মতলবে তার মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণেই অবাক হওয়ার মতোই তার মুখে হাসি ফুটে উঠতে দেখা গেলো। কেন, আমি কি করেছি?
আশাকরি কিছুই নয়। বললো মিসেস হার্বার্ড। কিন্তু এলিজাবেথ জনস্টনের নোটের উপর ইচ্ছাকৃত ভাবে বিশ্রী করে কালি ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। তুমি তো সবুজ কালি দিয়ে লিখে থাকো নিজে, স্থির চোখে তাকাল সে। তার মুখের উপর থেকে একটু আগের সেই হাসিটা উধাও হয়ে গেলো। হ্যাঁ সবুজ কালি দিয়েই আমি লিখি। ভয়ঙ্কর জিনিস, বললো প্যাট্রিসিয়া। নিজেল আমার বিশ্বাস, তুমি একাজ নিশ্চয়ই করোনি। আমার মনে হয়, আমি তোমাকে সবসময়েই বলে থাকি তুমি তোমার কাজের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে।
হা জড়িয়ে পড়তেই ভালোবাসি। অকপটে স্বীকার করলো নিজেল। আমার মনে হয় নীল কালি ব্যবহার করলেই ভালো ছিলো সবাই যা করে থাকে। কিন্তু মাম আপনি কি এ ব্যাপারে খুবই সজাগ? মানে আমি বলতে চাই এই অন্তর্ঘাতমূলক কাজের জন্য।
হা, নিজেল সত্য করে বলো তো, একাজ কি তোমার?
না অবশ্যই নয়। আপনি তো জানেন লোককে বিরক্ত করতে আমি ভালোবাসি। কিন্তু এমন একটা জঘন্য কাজ, না কখখনো নয়। আর অবশ্যই ব্ল্যাক বেকের কোনো ক্ষতি আমি কখনোই চাইবো না। আচ্ছা আমার সেই কালিটা কোথায়? মনে আছে গতকাল সন্ধ্যায় আমি আমার পেনে কালি ভর্তি করেছিলাম। ঐখানে ঐ সেলফ-এর উপর আমি সাধারণত রেখে থাকি। লাফিয়ে উঠে সেদিকে ছুটে গেলো সে। হা ওই তো সেটা এখানেই রয়েছে। কালির বোতলটা হাতে তুলে নিয়ে শিষ দিয়ে উঠলো সে। আপনি ঠিকই বলছেন। বোতল প্রায় শূন্য। অথচ এটা প্রায় ভর্তি থাকার কথা। বর্ষাতি গায়ে চাপানো মেয়েটি একটু হাঁ করে তাকাল। ওহে প্রিয়, বলে উঠলো মেয়েটি, ওহে প্রিয়, আমি এটা অপছন্দ করি
মেয়েটিকে অভিযুক্ত করে বলে উঠলো নিজেল। তোমার কোনো এ্যালিবাই আছে সিলিয়া?
না, না, একাজ আমি করিনি। সত্যি এ কাজ আমি করিনি। যাহোক আমি বলতে পারি, সারাদিন আমি হাসপাতালে ছিলাম। একাজ আমি করতে পারি না
নিজেল এখন তুমি, তাদের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে মিসেস হার্বার্ড বললো, সিলিয়াকে বিরক্ত করো না।
ওদিকে রাগতস্বরে প্যাট্রিসিয়া বলে উঠলো, আমি বুঝতে পারছি না, নিজেকে কেন সন্দেহ করা হচ্ছে? তার কালি ব্যবহার করা হয়েছিল বলে
হ্যাঁ ঠিক তাই প্রিয়তমা, বললো ভ্যালেরি, তোমার বন্ধুর হয়ে লড়ে যাও।
কিন্তু এটা তো অন্যায়
কিন্তু আমি সত্যিই এ ব্যাপারে কিছু করিনি, আন্তরিকভাবে প্রতিবাদ করলো সিলিয়া।
কাজটা তুমি করেছে, একথা কেউ চিন্তাও করে না, অধৈর্য হয়ে বললো ভ্যালেরি, আর তুমিও তো জানো, মিসেস হার্বার্ডের সাথে তার দৃষ্টি বিনিময় হলো, এসবই ঠাট্টা-ইয়ার্কির সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে কিছু একটা করতে হবে।
কিছু একটা করতে যাওয়া হচ্ছে, কঠিন সুরে বললো মিসেস হার্বার্ড।
.
০৪.
একটা ছোট্ট বাদামী রং-এর কাগজের মোড়ক পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দিয়ে মিস্ লেমন বললো, মঁসিয়ে পোয়ারো, এই নাও তোমার সেই ইঙ্গিত জিনিসটা।
মোড়কের উপর থেকে কাগজটা সরাতে চোখ দুটো উজ্জ্বল হলো উঠলো পোয়াবোর, সত্যি তারিফ করবার মতন–সুন্দর ডিজাইনের রুপালী রং-এর সান্ধ্যজুতো।
তুমি যেমন বলেছিলে, এটা বেকার স্ট্রিট থেকে পাওয়া গেছে।
আমাদের খাটুনি অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে, বললো পোয়ারো, সেই সঙ্গে আমার অনুমানের স্বীকৃতিও পাওয়া গেল।
হা, তা তো বটেই, বললো মিস্ লেমন। তবে মঁসিয়ে পোয়ারো, যদি না তোমাকে খুব বেশি অসুবিধায় পড়তে হয়। আমার বোনের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি। নতুন করে সেখানে আর একটা ঘটনা ঘটেছে। তুমি অনুমতি দিলে চিঠিটা পড়তে পারি?
চিঠিটা তার হাতে তুলে দিলে পোয়ারো পড়ার পর মিস লেমনকে ফোনে তার বোনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললো, একটু পরেই মিস্ লেমন ইশারা করলো, লাইন পেয়েছে।
তার হাত থেকে রিসিভারটা নিয়ে পোয়ারো বললো, মিসেস হার্বার্ড?
ও হ্যাঁ, মাঁসিয়ে পোয়ারো। এতো তাড়াতাড়ি ফোন করলেন? সত্যিই আপনি কি দয়ালু, সত্যি আমি অত্যন্ত।
কোথা থেকে ফোন করছো? মানে আমি বলতে চাইছি কেউ আমাদের আলোচনা শুনে ফেলবে না তো?
না, সব ছাত্রছাত্রীরাই এখন বাইরে বেরিয়ে গেছে। রাধুনী এখন বাজারে, আর তার স্বামী ইংরেজি খুব কমই বুঝতে পারে। ধোবিনী বাড়িতে আছে বটে, তবে সে কালা, কানে শুনতে পায় না। আমি নিশ্চিত আমাদের আলোচনার কথা শোনার মতো আপাতত বাড়িতে কেউ নেই।
খুব ভালো, স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারবো। সন্ধ্যায় বক্তৃতা কিংবা ফিল্ম দেখানোর ব্যবস্থা আছে তোমাদের ওখানে? কিংবা প্রমোদরঞ্জনের সেরকম কিছু?
হ্যাঁ আছে বৈকি! এইতো সেদিন মিস বালট্রাউট তার আবিষ্কারের অভিযানের উপর দীর্ঘ একটা বক্তৃতা দিয়ে গেলো। সেদিন খুব কম ছাত্র-ছাত্রীই বাইরে গিয়েছিল।
আচ্ছা, তাহলে সবাইকে জানিয়ে দাও আজ সন্ধ্যায় তোমার বোনের নিয়োগ কর্তা মাসিয়ে এরকুল পোয়ারো আসছে, সে তার এক আকর্ষণীয় কেসের উপর বক্তৃতা দেবে তোমার ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে।
আমি নিশ্চিত, খুবই ভালো হবে সেটা, কিন্তু আপনি কি মনে করেন?
মনে করাকরির কিছু নেই। আমি নিশ্চিত।
সেদিন সন্ধ্যায় কমনরুমে নোটিশ বোর্ডে একটা নোটিশ টাঙ্গানো থাকতে দেখলো ছাত্র-ছাত্রীরা :
প্রখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ মঁসিয়ে পোয়ালরা আজ সন্ধ্যায় এখানে তার এক সফল বিখ্যাত ক্রিমিন্যাল কেসের তদন্তের কাজ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য দয়া করে তার
সম্মতি দিয়েছেন। ছাত্রছাত্রীরা এ ব্যাপারে নানান মন্তব্য করতে ছাড়লো না। কে এই প্রাইভেট ডিটেকটিভ? তার কথাতো কখনো শুনিনি। ওহো আমি শুনেছি। একজন ঠিকা ঝি-কে হত্যার অপরাধে এক ব্যক্তির মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রায় কার্যকর হতে যাচ্ছিল। ঠিক সময়ে এই লোকটি উপস্থিত হয়ে তার নিখুঁত তদন্তের রিপোর্ট পুলিশ স্টেশনে জমা দিলে সেই খুনের আসামীকে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয় কাণ তিনি তখন প্রকৃত খুনীকে ধরে ফেলেছিলেন। আমার কাছে শুধুই আলুভাতে মনে হচ্ছে। আমার মনে হয়, এটা নেহাতই কৌতুক। অবশ্য কলিন উপভোগ করতে পারে। অপরাধ মনস্তত্বের ব্যাপারে সে খুবই আগ্রহী বরং পাগলা বলা যেতে পারে। আমি কিন্তু ওকে এতো গুরুত্ব দিতে পারছি না। তবে অস্বীকার করবো না, যে লোকটার সঙ্গে অপাধীদের গোপন যোগাযোগ আছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে হয়তো রোমাঞ্চ অনুভব করা যেতে পারে। টেবিলে নৈশভোজ পরিবেশিত। আর অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরা যার যার আসনে বসে গিয়েছিল। এমন সময় মিসেস হার্বার্ড তার বসবার ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে এলেন। তাকে অনুসরণ করছিল ছোট মাপের চেহারার একজন ভদ্রলোক। তার কালো চুলগুলো সন্দেহজনক, গোফটা ভয়ঙ্কর।
মঁসিয়ে পোয়ারো এরা আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কয়েকজন। মিসেস হার্বার্ড পরিচয় করিয়ে দেয়। আর ইনি হলেন মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো। নৈশভোজের পর উনি আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
সম্ভাষণ বিনিময়ের পর মিসেস হার্বার্ডের অনুরোধে হঠাৎ তার ডান পাশ থেকে একটি মেয়ে বলে উঠলো, সত্যিই কি মিসেস হার্বার্ডের বোন আপনার হয়ে কাজ করেন।
তার দিকে ফিরে তাকাল পোয়ারো, হ্যাঁ অবশ্যই। অনেক বছর ধরে মিস্ লেমন আমার সেক্রেটারী। অত্যন্ত দক্ষ সে, তার জন্য এক এক সময় আমার আশঙ্কা হয়।
তাই বুঝি। আমি অবাক হচ্ছি
মাদমোয়াজেল, আপনার অবাক হওয়ার কারণ? পোয়ারো তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় হাসলো। মেয়েটির সম্পর্কে মনে মনে অনুধাবন করলো, যেমন সে করে থাকে। বেশ চিন্তিত, মনের দিক থেকে খুব একটা দ্রুত নয়। বুঝি বা একটু ভীতও বটে–তারপর নিজের থেকেই সে আবার জিজ্ঞেস করলো। আপনার নাম আর কি বিষয়ে পড়াশোনা করছেন জানতে পারি?
সিলিয়া অস্টিন। পড়াশোনা করি না। আমি একজন ওষুধ প্রস্তুতকারক। সেন্ট ক্যাথেরিন হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত।
আহ সে তো খুব আকর্ষণীয় কাজ? পোয়ারো এবার অন্যদের প্রসঙ্গ তুললো, আর এঁরা সব? এঁদের সম্পর্কে আপনি আমাকে কিছু বলতে পারেন? আমি জেনেছি, এখানে বহু বিদেশী ছাত্র-ছাত্রী থাকে কিন্তু দেখেশুনে মনে হচ্ছে তো বেশির ভাগই ইংরেজ। ব্যাপার হলো বেশ কিছু বিদেশী ছাত্র-ছাত্রী এখন বাড়ির বাইরে। যেমন মিঃ চন্দ্রলাল আর মিঃ গোপালরাম–ওরা ভারতীয় আর মিস রেনজীর ডাচ মহিলা আর একজন হলো মিঃ আহমেদ আলি–ইজিপসিয়ান। ভয়ঙ্কর ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে যে।
আর যারা এখানে আছেন, তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
বেশ তাহলে শুনুন, মিসেস হার্বার্ডের বাঁ-পাশে বসে আছে নিজেল চ্যাপম্যান, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যযুগীয় ইতালীয় ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করছে সে। তারপরে তার ঠিক পাশের মেয়েটি প্যাট্রিসিয়া লেন, গামা কোসে–প্রত্নতত্ত্ববিদ্যায় ডিপ্লোমা নিতে যাচ্ছে। বড়মাপের লাল চুলওয়ালা ছেলেটি লিও বেটসন, মেডিক্যাল ছাত্র। আর ওই কালো চেহারার মেয়েটি ভ্যালেরি জনহাউস-একটন বিউটি পপের সঙ্গে যুক্ত। তার ঠিক পাশের মেয়েটি, কলিন ম্যাকনার–মানসিক রোগের চিকিৎসায় পোস্টগ্র্যাজুয়েটের ছাত্রী।
কলিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তার কণ্ঠস্বরে সামান্য একটু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো। নিবিষ্ট মনে তাকে লক্ষ্য করলো পোয়ারো এবং দেখলো তার মুখে ফিকে রঙ লেগেছে। নিজের মনে বললো সে, সুতরাং মেয়েটি তার প্রেমে পড়েছে এবং সহজে সেটা সে লুকাতে পারলো না, আর একটা জিনিষ লক্ষ্য করলো সে-তরুণ ম্যাকনার মেয়েটির দিকে একটুও তাকাল না বরং সে তার পাশে উপবিষ্ট লালচুলের মেয়েটির সঙ্গে বেশ হেসে হেসে কথা বলছিল। আর সেই মেয়েটি হলো সেলী ফিঞ্চ। আমেরিকান-এখানে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে এসেছে। তাদের পাশের মেয়েটি জেনেভিভ মারিকত-ইংরেজিতে অধ্যয়ন করছে; তার মতো বেনি হ্যাঁলিত তার পাশেই বসেছিল, সে সুন্দরী মেয়ে জিন টমকিনসন সেন্ট ক্যাথেরিনের সঙ্গে যুক্ত। সে একজন সাইকোথেরাপিস্ট। কালো চামড়ার মানুষ অ্যাকিমবোকে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে এসেছে ভয়ঙ্কর কালো লোক সে। তারপর এলিজাবেথ জনস্টন, জামাইকার মেয়ে আইন পড়ছে, আমার ডানদিকের ওরা দুজন তুর্কী ছাত্র, সপ্তাহখানেক আগে এসেছে এখানে, তারা সামান্যই ইংরেজি জানে।
ধন্যবাদ, আপনারা সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকেন, নাকি আপনাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে।
পোয়াবোর হাল্কা কথার সুরে একটা গাম্ভীর্যের ভাব লুকিয়ে ছিল। উত্তরে সিলিয়া বললো, ওহো আমরা সবাই ঝগড়া করতে ব্যস্ত থাকি। যদিও–
যদিও কি মিস অস্টিন।
বলছি–ঐ যে নিজেল, মিসেস হার্বাডের পাশেই যে বসে আছে দেখছেন, লোককে ক্ষেপাতে ওস্তাদ সে। আর লেন বেটসন একটুকুতেই রেগে যায়। এক এক সময় তার বন্য রাগ দেখার মতন। তবে সত্যিই খুব মিষ্টি স্বভাবের ছেলে সে।
আর কলিন ম্যাকনার–সেকি খুব বিরক্তবোধ করে থাকে?
ওহো না সে কেবল তার ভ্র তুলে থাকে আর তাকে বেশ খুশি খুশি দেখায়।
তাই বুঝি। আর ঐ তরুণীটি ওর সঙ্গে আপনার কখনো ঝগড়া হয়?
ওহো না, আমরা সবাই খুব মিশুকে। এক এক সময়ে জেনেভিভের একটু যা ভাবান্তর ঘটে থাকে, আমার মনে হয় ফরাসীরা একটু স্পর্শকাতর–ওহো মানে আমি–আমি দুঃখিত–এরপর চুপ হলো মেয়েটি।
আর আমি একজন বেলজিয়ান, গদগদ হয়ে বললো পোয়ারো। সিলিয়া সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার আগেই দ্রুত জিজ্ঞেস করলো পোয়ারো, মিস্ অস্টিন একটু আগে আপনি বললেন আপনি অবাক হচ্ছেন–কিসের জন্য?
স্নায়ু দুর্বলতায় মেয়েটি তার রুটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললো। ওহো, ওটা কিছু নয়, সত্যি কিছু নয়, স্রেফ একটা ঠাট্টা মাত্র। আমি ভেবেছিলাম মিসেস হার্বার্ড–কিন্তু সত্যি সেটা লজ্জার কথা, আমি কিছু বোঝাতে চাইনি।
পোয়ারো তাকে আর চাপ দিলো না। মিসেস হার্বার্ডের দিকে ফিরে তাকাল সে। মিসেস হার্বার্ড এবং নিজেল চ্যাপম্যান তিনজনে মিলে আলোচনায় রত হলো। অচিরেই চ্যাপম্যান একটা বিতর্কে জড়িয়ে পড়লো, তার বক্তব্য হলো অপরাধ একটা শিল্প–এবং সমাজের সব থেকে অযোগ্য হলো পুলিশ, যারা পুলিশের চাকরীতে ঢোকে তারা তাদের গোপন যৌন বিকৃতি চরিতার্থ করার জন্য। পোয়ারো তার পাশে বসা চশমা পরিহিত তরুণ-যুবতীর উদ্বেগ লক্ষ্য করে কৌতুক বোধ করছিল। মেয়েটি বেপরোয়া ভাবে নিজেলের মন্তব্য নস্যাৎ করার চেষ্টা করছিল। যাই হোক, তার দিকে একেবারেই তাকাল না, কিংবা বলা যেতে পারে ভ্রূক্ষেপই করলো না। সদয় চিত্তে কৌতুক বোধ করলো মিসেস হার্বার্ড।
তোমরা সব তরুণেরা আজকাল রাজনীতি আর মনস্তত্ব ছাড়া কিছুই বোঝে না। বললো মিসেস হার্বার্ড। ছেলেবেলায় আমি হাল্কা মেজাজে থাকতে ভালোবাসতাম। নাচতাম, গলা চড়িয়ে গান গাইতাম। এখনো কমনরুমের মেঝেটা বিরাট, নাচের উপযোগী কিন্তু তোমরা কখনো কি নাচ করেছে?
হাসলো সিলিয়া এবং গাঢ় স্বরে বলে উঠলো, নিজেল তুমি কিন্তু নাচতে। একবার আমি তোমার সাথে নাচ করেছিলাম। তবে আমার মনে হয় না তুমি মনে রেখেছে।
তুমি আমার সঙ্গে নেচেছিলে? বিশ্বাস করতে চাইল না নিজেল। কোথায়? কোথায় নেচেছিলে?
কেন কেমব্রিজ–মে দিবসে।
ওঃ মে দিবসে। তারুণ্যের বোকামো বুঝতে পারলো নিজেল। ঐ বয়সে সবাই অমন ছেলেমানুষি করে থাকে। বয়স হলেই ভুলে যায়।
নিজেলের বয়স এখন পঁচিশের বেশি নয়। পোয়ারো গোঁফের ফাঁকে তার হাসিটা চাপবার চেষ্টা করল।
ওদিকে পোয়ারো উঠে দাঁড়াল এবং তার স্বাভাবিক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বক্তৃতা দিতে শুরু করলো। নিজের গলার স্বর বেশ ভালোই লাগে তার কাছে। তিনি ৪৪ বছর ধরে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা বর্ণনা দেওয়ার পর বললো, তাহলে আপনারা দেখলেন অপরাধ জগৎটা কেমন। অপরাধী আর পুলিশের সম্পর্কটাই বা কেমন। এই শহরের একজন ভদ্রলোককে আমি বলেছিলাম, একজন সাবান প্রস্তুতকারককে আমি চিনি, সে তার সুন্দরী স্বর্ণকেশী সেক্রেটারীকে বিয়ে করার জন্য তার স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছিল, হাল্কা চালেই গল্পটা শুরু করেছিলাম তার কাছে। কিন্তু সেই সঙ্গে তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম তার মধ্যে। সেই মাত্র তার চুরি যাওয়া টাকা ফেরৎ পাওয়ার জন্য সে আমাকে চাপ দিতে থাকে। তাকে কেমন কৃশ দেখায়, ভয়ার্ত দুটি চোখ, এ টাকা আমি উপযুক্ত চ্যারিটি ট্রাস্টে দেবো, আমি তাকে বলি, টাকাটা নিয়ে আপনি যা খুশি করতে পারেন, উত্তরে সে বললো, তখন আমি তাকে বলি খুবই অর্থপূর্ণভাবে। মঁসিয়ে, আমার উপদেশ হলো, খুব সাবধান, নীরবে মাথা নাড়ল সে, তারপর বাইরে বেরিয়ে এসে পিছন ফিরে তাকাতে দেখি যে, তার কপালের ঘাম মুছছে। যদিও সে তার স্বর্ণকেশী সেক্রেটারীর মোহাচ্ছন্ন মনে হয় আমার সেই উপদেশ শোনার পর সে আর বেশিদূর এগোবে না, কিংবা তার স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে হত্যা করার মতন বোকামো করবে না। নিরাময়ের থেকে প্রতিরোধ সবসময়ই ভালো। আমরা হত্যা প্রতিরোধ করতে চাই–হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা আমরা করি না।
মাথা নুইয়ে সে এবার বলে, আমি বোধহয় আপনাদের দীর্ঘক্ষণ চিন্তায় ফেলে রেখেছিলাম।
প্রচণ্ড ভাবে হাততালি দিয়ে উঠলো ছাত্রছাত্রীরা। পোয়ারো মাথা নুইয়ে তাদের অভিবাদন গ্রহণ করলো। তারপর সে যখন প্রায় তার আসনে বসতে যাচ্ছে ম্যাকনার হঠাৎ বলে উঠলো, আর এখন সম্ভবত এখানে আপনি যেজন্য এসেছেন সে ব্যাপারে কিছু বলবেন।
মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো। তারপর অভ্যর্থনা করে উঠলো প্যাট্রিসিয়া কলিন।
ভালো কথা, আমরা এখন সবাই আন্দাজ করতে পারি, পারি না? চারিদিক তাকিয়ে দেখে নিলো সে, তার চোখে মুঠো মুঠো ঘৃণা। মঁসিয়ে পোয়ারো বেশ মজার মজার গল্প আমাদের শুনিয়েছেন। কিন্তু এর জন্য তিনি এখানে আসেননি। তিনি একটা বিশেষ কাজে এসেছেন। মঁসিয়ে পোয়ারো সত্যি করে বলুন তো এরকম একটা ধারণা করে নেওয়াটা আমাদের ন্যায়সঙ্গত নয়?
হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি, পোয়ারো বললো, মিসেস হার্বার্ড আমাকে গোপনে বলেছেন, এখানকার কয়েকটা ঘটনা তার উদবেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে–
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো লেন বেটসন। তার মুখটা থমথম এবং হিংস্র দেখাচ্ছিল। দেখুন! তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠলো, এসব কি হচ্ছে? আমাদের জড়ানোর জন্যই কি এই পরিকল্পনা?
এবার দৃঢ়তার সঙ্গে বলে উঠলো মিসেস হার্বার্ড।
মঁসিয়ে পোয়ারোকে কিছু বলার জন্য আমি অনুরোধ করেছিলাম সেই সঙ্গে এখানে সম্প্রতি যে সব ঘটনাগুলো ঘটে গেছে সে ব্যাপারে ওর উপদেশ চেয়েছিলাম, কিছু একটা করতে হবে। আমার মনে হয়েছে, এর একমাত্র বিকল্প হলো পুলিশ।
সঙ্গে সঙ্গে সবাই নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক জুড়ে দিলো। উত্তেজনায় ফেটে পড়লো জেনেভিভ। ফরাসী ভাষায় উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলো সে, পুলিশের কাছে যাওয়া অপমানের, লজ্জার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অনেকেই মরিয়া হয়ে উঠলো। শেষ অব্দি লিওনার্ড বেটসনের চড়া গলা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলো।
আমাদের গণ্ডগোলের ব্যাপারে মঁসিয়ে পোয়ারোর বক্তব্য শোনা যাক। পোয়ারো কিছু বলার আগে মিসেস হাবার্ড বলে উঠলো, সমস্ত ঘটনার কথা আমি মঁসিয়ে পোয়ারোকে বলেছি, তিনি যদি কোনো প্রশ্ন করতে চান আমি নিশ্চিত, তোমরা কেউ আপত্তি করবে না।
মাথা নিচু করে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো পোয়ারো। ধন্যবাদ, তারপর যাদুকরের মতো একটা কাগজের মোড়ক খুলে একজোড়া সান্ধ্যজুতো সেলী ফিঞ্চের হাতে তুলে দিলো। মাদমোয়াজেল, আপনার জুতোজোড়া।
দু পাটি কেন? হারানো পাটিটা কোথা থেকে এলো?
বেকার স্ট্রিট স্টেশনে লস্ট প্রপারটি অফিস থেকে। কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি চিন্তা করলেন কি করে সেটা সেখানে থাকতে পারে?
অত্যন্ত সহজ অনুমানের ভিত্তিতে। আপনার ঘর থেকে কেউ একজন একপাটি জুতো নিয়ে থাকবে? কিন্তু কেন? পড়বার জন্য বা বিক্রি করবার জন্যও নয়, যেহেতু সবাই বাড়িতে খোঁজাখুঁজি করবে, সেই কারণে জুতোটা নষ্ট করা অতো সহজ নয়। সবথেকে সহজ উপায় হলো জুতোটা কাগজের মোড়কে করে বাসে কিংবা ট্রেনে নিয়ে ভীড়ের সময় আসনের উপর ফেলে রাখা, এটাই আমার প্রথম অনুমান এবং সেটা যে ঠিক তার প্রমাণ পাওয়া গেলো।
এখানে একটু থেমে পোয়ারো আবার বলতে শুরু করল। আমার অবস্থাটা খুবই দুর্বল। আমি এখানে একজন অতিথি। মিসেস হার্বার্ডের আমন্ত্রণে সুন্দর সন্ধ্যেটা কাটানোর জন্য এসেছি–ব্যস এই পর্যন্ত। অবশ্য সেই সঙ্গে মাদমোয়াজেলকে সুন্দর একজোড়া সান্ধ্যজুতো ফেরত দেওয়ার জন্যও বটে। আর কিছু-একটু থেমে সে আবার বললো মঁসিয়ে বেটসন, হা বেটসন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই গণ্ডগোলের ব্যাপারে আমি কি চিন্তা করছি। কিন্তু একজন নয়, আপনারা সবাই মিলে আমাকে আহ্বান না করলে এ ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে কিছু বলা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।
মিঃ অ্যাকিমবো তার কোকড়ানো চুলের মাথাটা ঘনঘন দুলিয়ে বলে উঠলো, হ্যাঁ সেটাই হবে সঠিক পন্থা। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পন্থা হলো সবার উপস্থিতিতে এ ব্যাপারে ভোট নেওয়া।
অধৈৰ্য্য হয়ে সেলী ফিঞ্চ বলে উঠল, ওহো, তুমি বড় হতাশ করে দাও। অ্যাকিমবোকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বললো সে। আজকের এই সমাবেশ একটা পার্টির মতোই, আমরা সব বন্ধুরা একত্রে মিলিত হয়েছি। আর কোনো হৈ-চৈ না করে মঁসিয়ে পোয়ারো কি উপদেশ দেন শোনা যাক।
সেলী আমি তোমার সঙ্গে আর একমত হতে পারছি না। প্রতিবাদ করে নিজেল।
মাথা নত করলো পোয়ারো।
খুব ভালো কথা বললো সে, এই প্রশ্নটা আপনারা সবাই আমাকে করেছেন। উত্তরে আমার উপদেশ খুবই সহজ সরল, মিসেস হার্বার্ড কিংবা মিসেস নিকোলেটিসের উচিত এখনি পুলিশে খবর দেওয়া, আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট করা উচিত নয়।
.
০৫.
নিঃসন্দেহে পোয়ারোর মন্তব্য অভাবনীয়। প্রতিবাদ কিংবা পাল্টা মন্তব্য করা যায় না। কিন্তু একটা অস্বস্তিকর নীরবতার মধ্যে ডুবে রইলো সান্ধ্য বৈঠক এবং বৈঠকের সদস্যরা। সেই অস্বস্তিকর নীরবতার মধ্যে থেকে পোয়ারোকে উদ্ধার করলো মিসেস হার্বার্ড তার বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে। তোমাদের সবাইকে শুভরাত্রি–
তারপর নিজের বসবার ঘরে পোয়ারোর মুখোমুখি বসে মিসেস হার্বার্ড। একটু ইতস্তত করে বললো, জোর দিয়েই আমি বলবো, আপনিই ঠিক মঁসিয়ে পোয়ারো। সম্ভবত পুলিশে আমাদের খবর দেওয়াই উচিত, বিশেষ করে অমন বিশ্রী কালি ছিটানোর ঘটনার পর। কিন্তু, সেইসাথে আমি বলবো, অমন স্পষ্ট করে সবার সামনে আপনার বলা উচিত হয়নি।
আহ! পোয়ারো তার নিজস্ব ব্র্যান্ডের একটা সিগারেটের ধোঁয়া উদগীরণ করে বললো, তুমি কি মনে কর ব্যাপারটা আমার গোপন করা উচিত ছিলো–
আমার মনে হয়, চুপচাপ থাকলে ভালো ছিলো, তারপর একজন পুলিশ অফিসারকে আহ্বান করে গোপনে ঘটনাটা তার কাছে ব্যাখ্যা করলে ভালো হতো। মানে আমি বলতে চাইছি; যেই এই নোংরা কাজ করে থাকুক না কেন, এখন তাকে সতর্ক করে ছেড়ে দিলেই চলতো।
সম্ভবত হা।
তারপর মিসেস নিকোলেটিস রয়েছেন, জানি না পুলিশের কথা শুনলে তার মনোভাব কেমন হবে। তার মনে কি আছে কেউ জানে না।
সেটা জানা খুবই কৌতূহলের ব্যাপার।
তাই স্বভাবতঃই আমরা পুলিশকে এখানে আসতে দিতে পারি না। আগে তাঁকে রাজি করাতে হবে, তারপরও কে আবার এলো?
দ্রুত টোকা পড়তে থাকে দরজায়। মিসেস হার্বার্ড বলতে যাচ্ছিল ভেতরে এসে, কিন্তু তার বলবার আগেই দরজা খুলে গেলো এবং কলিন ম্যাকনার ঘরে এসে ঢুকলো, উদ্ভ্রান্ত চেহারা, ঝাপসা চোখ। আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন, কলিন বলে। কিন্তু না এসেও পারলাম না। আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন, মঁসিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে একটা কথা বলতে চাই।
আমার সঙ্গে? তার দিকে ফিরে তাকাল পোয়ারো অবাক চোখে।
হ্যাঁ, গম্ভীর স্বরে বললো কলিন, আপনার সঙ্গেই।
কাঁপা কাঁপা হাতে চেয়ার টেনে পোয়ারোর সামনে বসলো। আজ রাতে আপনি আমাদের সঙ্গে কথা বলে যথেষ্ট আনন্দ দিয়েছেন। আমি স্বীকার করছি আপনার অভিজ্ঞতা প্রচুর আর বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা সব, কিন্তু আপনার কাজের পদ্ধতি আর ধারণা দুটো সেকেলে ধরনের। আমার এই কথা বলার ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমা করবেন।
কলিন, সত্যিই তুমি ভীষণ অভদ্র, মুখ কালো করে বলে উঠলো মিসেস হার্বার্ড।
আমি ওঁকে অপমান করার জন্য একথা বলিনি, তবে ব্যাপারটা পরিষ্কার করার জন্যই বলেছি। মঁসিয়ে পোয়ারো অপরাধ এবং শাস্তি–যতদূর সম্ভব আপনার দিগন্ত বিস্তৃত, যার কিনারা পাওয়া যায় না।
ওগুলো আমার কাছে স্বাভাবিক পরিণতি বলেই মনে হয়, বললো পোয়ারো।
আইনটাকে আপনি সংকীর্ণ ভাবে ব্যাখ্যা করছেন। তাছাড়া আমার ধারাগুলো অত্যন্ত পুরানো, সেকেলে, অথচ আজকাল আইন অনেক বেশি উদার–অনেক নতুন বিবেচনা প্রস্তুত অপরাধতত্ত্বের নতুন নতুন ব্যাখ্যা আছে। অপরাধীকে শাস্তি দিতে গেলে নতুন নতুন অনেক আইন ঘাঁটতে হয়। এই হলো আমার বলার কারণ এবং সেটা আমি জরুরী বলে মনে করি মঁসিয়ে পোয়ারো।
কিন্তু আপনার ঐ নতুন ফ্যাসানের আইনের কচকচি শুনতে আমি চাই না। আমি আপনার সাথে একমত হতে পারলাম না।
তাহলে এই বাড়িতে যা যা ঘটে যাচ্ছে, তার কারণগুলো আপনাকে অবশ্যই বিচার করে দেখতে হবে। আপনাকে খুঁজে বার করতে হবে–কেন, কেন এসব ঘটছে।
হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে অবশ্যই একমত, আর এটা খুব জরুরীও বটে। কারণ সব ব্যাপারেই একটা না একটা কারণ থাকবেই। আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে ভালোরকম কারণই থাকতে পারে।
প্রস্তাবটা মনমতো হলো না মিসেস হার্বার্ডের। তাই সে চুপ করে থাকতে পারলো না। অধৈৰ্য্য হয়ে বলেই ফেললো, যতো সব রাবিশ।
এই এখানেই আপনি ভুল করছেন : তার দিকে ঈষৎ ঘুরে বসে কলিন বললো, মনস্তাত্ত্বিক পশ্চাৎপটটা আপনাকে বিবেচনা করে দেখতেই হবে।
মনস্তাত্ত্বিক প্রলাপ? ব্যঙ্গ করে বললো মিসেস হার্বার্ড। এ ধরনের আজেবাজে কথা শোনার মতো ধৈৰ্য্য আমার নেই।
কারণ আপনি এসবের কিছুই জানেন না। তিরস্কারের মতো করে বলে কলিন এবার পোয়ারোর দিকে ফিরলো।
জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো আমি কিন্তু এ বিষয়ে খুবই আগ্রহী, আমি এখন সাইকোলজির পোস্টগ্র্যাজুয়েটের ছাত্র। মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার এতো সব কথা বলার কারণ হলো, আইন অনুযায়ী অপরাধীকে আপনি সালাম দিতে পারেন না। গণ্ডগোলের আসল উৎস আপনাকে বুঝতে হবে। আজকের তরুণদের বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য এটা খুবই জরুরী। আপনাদের সময় এ ধরনের ধারণা কেউ জানতো না শুধু নয়, আমার একটুও সন্দেহ নেই, সেগুলো মেনে নিতে আপনারা খুব কষ্ট পেতেন।
চোরের ওপর বাটপারি। কঠোর ভাষায় বললো মিসেস হার্বার্ড।
অধৈৰ্য ভাবে ভ্রুকুটি করলো কলিন।
পোয়ারোর কথায় নম্রতার সুর : নিঃসন্দেহে আমার ধারণাগুলো সেকেলে ধরনের। কিন্তু মিঃ ম্যাকনার আপনার কথা শুনতে আমি প্রস্তুত।
বিস্ময়ভরা চোখে তার দিকে তাকাল কলিন। আপনি বেশ ভালো কথাই বলেছেন মঁসিয়ে পোয়ারো। এখন আমি আপনাকে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিতে চাই।
ধন্যবাদ, নম্রভাবে বললো পোয়ারো।
সুবিধার জন্য আজ রাতে আপনার নিয়ে আসা জুতোজোড়া দিয়েই শুরু করবো। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, একপাটিই জুতো চুরি গেছিল; মাত্র একপাটি। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলতে থাকে কলিন ম্যাকনার। কিন্তু এর গুরুত্ব হয়তো আপনি বুঝতে পারেননি। এ একটা চমৎকার আর সন্তুষ্ট করার মতো উদাহরণ বটে। সিনড্রেলা রূপকথার কাহিনীর সঙ্গে আপনি হয়তো পরিচিত আছেন।
মূল ফরাসী গল্প :–উঞ্ছবৃত্তি করেও পারিশ্রমিক পেতো না সিনড্রেলা। বেচারী মনের দুঃখে আগুনের পাশে বসেছিল, তার বোনেরা সুন্দর কার্যকার্য করা পোষাকে তাকেও সেই প্রিন্সেস বল-এ পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। মাঝ রাতে তার সেই সুন্দর পোষাক ছেঁড়া নেকড়ায় পরিণত হওয়া মাত্র তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরে এলো সে, একপাটি চটি সেখানে ফেলে রেখে। এখানেই আমরা সেই সিনড্রেলার সাথে কাউকে তুলনা করতে পারি। (অবশ্যই অবচেতন মনে) এখানে কারোর হতাশ, পরশ্রীকাতর এবং হীনম্মন্যতার পরিচয়ই পাই। হ্যাঁ আমি এখানে সেই মেয়েটির কথাই বলছি যে কিনা সান্ধ্যজুতো চুরি করেছিল। কেন? সম্ভবত সে নিজেই জানতো না কে যে একাজ করতে গেলো। কিন্তু তার মনের ইচ্ছাটা এখানে পরিষ্কার, রাজকুমারী হওয়ার বাসনা জেগেছিল তার মনে, রাজকুমারীর মন জয় করতে চেয়েছিল সে, আর সে চেয়েছিল রাজকুমার তাকে দাবী করুক। আর একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, এমন একজন আকর্ষণীয়া সুন্দরী মেয়ের সান্ধ্যজুতো যে চুরি করে, সে মেয়েটিরও সেই পার্টিতে যাওয়ার কথা।
কলিনের পাইপের তামাক শেষ হয়ে গিয়েছিল, প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে সে আবার বলতে লাগল; এখন আমরা আরো কিছু ঘটনার প্রসঙ্গে আসছি। চুরি যাওয়া জিনিসগুলো সামান্যই; সবই মেয়েদের ব্যবহৃত জিনিস–পাউডার, লিপস্টিক, কানের দুল, ব্রেসলেট, আংটি-এর দুটি উদাহরণ আছে। মেয়েটি নিজেকে বিজ্ঞাপিত করতে চেয়েছিল। এমনকি শাস্তিও পেতে চেয়েছিল সে,-যেমন আজকাল প্রায়ই তরুণদের মধ্যে একধরনের অপরাধ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
এগুলো সাধারণ অপরাধমূলক চুরির কেস বলে মনে হয় না। তেমন মূল্যবান জিনিযও নয়। ডিপার্টমেন্ট স্টোরস-এ গিয়ে যে কোনো উচ্চমধ্যবিত্ত, কিংবা মধ্যবিত্ত মহিলা এ সব জিনিষ চুরি করতে পারে, যদিও তার দাম দেওয়ার মতো ক্ষমতা তাদের আছে।
ননসেন্স, রাগত স্বরে বলে উঠলো মিসেস হার্বার্ড। সে সব কিছু অসৎ লোকের কাজ। অর্থের লোভ, এখানে সে সুযোগ কোথায়?
ভুলে যেও না, চুরি যাওয়া জিনিষগুলোর মধ্যে একটা দামী হীরের আংটিও ছিল, মিসেস হার্বার্ডের আপত্তি সত্ত্বেও পোয়ারো বললো।
কিন্তু সেটা তো ফেরত দেওয়া হয়েছে।
আর মিঃ ম্যাকনার, আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না স্টেথিস্কোপটা মোহময়ী পর্যায়ে পড়ে?
এর মধ্যে একটা গূঢ় অর্থ আছে। যে সব নীরব নারীসুলভ আকর্ষণে ঘাটতি থাকে, তারা তখন জীবনের উন্নতি করার পথ ধরে থাকে। তাই মনে হয় স্টেথিস্কোপটা সেই অবলম্বন
আর সেই রান্নার বইটা?
ওটা সেই পারিবারিক জীবনের ছবি, স্বামী ও পরিবার।
আর বোরিক পাউডার?
কলিন এবার খিঁচিয়ে উঠল : প্রিয় মঁসিয়ে পোয়ারো, বোরিক পাউডার কেউ চুরি করে না কেনই তারা করবে?
ঠিক এই প্রশ্নটাই আমি নিজেকে করছি। আমি স্বীকার করছি মঁসিয়ে ম্যাকনার, মনে হচ্ছে, এ সব প্রশ্নের উত্তর আপনার জানা আছে। তাই যদি হয় তাহলে আপনার পুরানো ফ্লানেল ট্রাউজার চুরির ব্যাপারে কি ব্যাখ্যা করবেন বলুন।
এই প্রথম হোঁচট খেতে হল কলিনকে। গলা পরিষ্কার করে বললো সে, এর ব্যাখ্যা আমি করতে পারি–কিন্তু তাতে কারো জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, সে এক অস্বস্তিকর ব্যাপার।
আর অন্য এক ছাত্রীর নোটের উপর কালি ছিটিয়ে দেওয়া, একজনের স্কার্ফ টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা? এসব কি আপনাকে উদ্বিগ্ন করে না?
কলিনের মুখের স্বাভাবিক ভাবটা হঠাৎ বদলে যায়। পোয়ারোর দৃষ্টি এড়ায় না।
হা, করে বৈকি, বললো সে, বিশ্বাস করুন অবশ্যই আমাকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। এ দুটি ঘটনা সাংঘাতিক। অবশ্যই মেয়েটির চিকিৎসার প্রয়োজন এবং এখনি। এটা পুলিশ কেস নয়। বেচারী খুদে শয়তান জানেও না, এসবের অর্থ কি, কি ব্যাপার? হাত-পা কাটা অবস্থার মতো সে, আমি যদি–বাধা দিল পোয়ারো।
তার মানে আপনি জানেন মেয়েটি কে?
হ্যাঁ, তার উপর আমার দারুণ সন্দেহ আছে।
এই সেই মেয়ে, যে কিনা পুরুষের মন জয় করতে ব্যর্থ। লাজুক মেয়ে। স্নেহ বৎসল মেয়ে। এই সেই মেয়ে যে নিজেকে নিঃসঙ্গ বলে মনে করে, হতাশায় ভুগছে। সেই মেয়ে
এই সময় দরজায় আবার টোকা পড়লো। নীরব হলো পোয়ারো। দরজায় টোকা আবারও পড়ল।
ভেতরে এসো–বলল মিসেস হার্বার্ড।
দরজা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সিলিয়া অস্টিনকে প্রবেশ করতে দেখা গেল।
আহ্, মাথা নেড়ে পোয়ারো বলে উঠল, ঠিক এই মুহূর্তে মিস্ সিলিয়া অস্টিনকেই আমি অনুমান করেছিলাম।
কলিনের দিকে তাকাল সিলিয়া। তার চোখে আগুন ঝরে পড়ছিলো।
আমি জানতাম না, তুমি এখানে, এক নিঃশ্বাসে সে বললো, আমি এসেছিলাম–আমি এসেছিলাম এখানে–
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে হার্বার্ডের কাছে ছুটে গেল।
দয়া করে পুলিশে খবর দেবেন না। আমি, হ্যাঁ আমিই জিনিষগুলো নিয়েছি। জানি না কেন। চিন্তাও করতে পারি না কেন নিয়েছি। এমন কি আমি চাইওনি। সেগুলো, আপনা থেকেই আমার কাছে চলে এসেছে। তারপর কলিনের দিকে ফিরে মেয়েটি বললো, তাহলে তুমি এখন জেনে গেছ, আমি কি ধরনের মেয়ে আমার ধারণা, তুমি আমার সঙ্গে আর কখনো কথা বলবে না। আমি জানি, আমি ভয়ঙ্কর
ওহো! তুমি নিজে যা ভাবছ তা একেবারেই নয়। বন্ধুভাবে কলিন বললো, তোমার অসুস্থতার জন্য তুমি একাজ করেছ, ভালো করে দেখলে কি জিনিষগুলো! তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস কর তাহলে আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে আমি সুস্থ করে তুলব।
ওঃ কলিন, সত্যি বলছ তুমি?
তার দিকে তাকাল সিলিয়া, তার প্রতি শ্রদ্ধা ও আবেগ গোপন করতে পারলো না সিলিয়া।
তোমার ব্যাপারে আমি বেশ চিন্তিত ছিলাম। গুরুজনদের মতো স্নেহভরে সিলিয়ার হাত নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে কলিন উঠে দাঁড়িয়ে মিসেস হার্বার্ডের দিকে ফিরে বললো, আশা করি এখন পুলিশে খবর দেবার মতো বোকামো করার দরকার নেই। তেমন মূল্যবান কোনো জিনিষ চুরি যায়নি। তাছাড়া যে জিনিষগুলো সিলিয়া নিয়েছে ও ফেরত দেবে।
ব্রেসলেট ও পাউডার আমি ফেরত দিতে পারব না, উদ্বিগ্ন হয়ে বললো সিলিয়া। ওগুলো আমি ফেলে দিয়েছি। তবে নতুন কিনে দেব।
আর স্টেথিস্কোপটা? জিজ্ঞাসা করলো পোয়ারো, সেটা আপনি কোথায় রেখেছেন?
সিলিয়ার চোখ ঝলসে উঠল।
আমি কখনো কোনো স্টেথিস্কোপ নেইনি। পুরানো একটা স্টেথিস্কোপ আমার কি কাজে লাগবে? তার দৃষ্টি গম্ভীর হল। আর এলিজাবেথের নোটের ওপর আমি কালি ছিটাইনি। এরকম কাজ আমি করি না।
মাদমোয়াজেল, মিস জনহাউসের স্কার্ফ টুকরো টুকরো করার ব্যাপারটা আপনি অস্বীকার করতে পারেন না।
আমি মনে করি ওটা একটা অন্য ব্যাপার। অস্বস্তি ও কতকটা অনিশ্চয়তার মধ্যে বললো, আমার মনে হয় ভ্যালেরি কিছু মনে করবে না।
আর পিঠে ঝোলানো ব্যাগটা।
ওহো, ও কাজ আমি করিনি। ওটা কোনো বদমেজাজী লোকের কাজ।
মিস হার্বার্ডের নোটবুক থেকে টাইপ করা হারানো জিনিসের তালিকাটা বার করে সিলিয়ার উদ্দেশ্যে পোয়ারো বললো, এখন সত্যি করে বলুন তো, এসব ঘটনাগুলোর মধ্যে কোনো কোনো ঘটনার সঙ্গে আপনি জড়িত, আর কোনোটার সঙ্গেই বা না।
তালিকাটা দেখামাত্র সিলিয়ার উত্তর পাওয়া গেল।
ঝোলা ব্যাগ, ইলেকট্রিক বাল্ব কিংবা বোরিক পাউডার কিংবা বাথ সল্ট, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। তবে আংটিটা ভুল করে নিয়েছিলাম, সেটা বোঝা মাত্র ফিরিয়ে দিয়েছি। আর একটাই কারণ, আমি অসৎ হতে চাইনি। সেটা কেবল
কেবল কি সেটা?
সিলিয়ার চোখে অনিশ্চিত অস্থিরতা থিক থিক করছিল, জানি না, আমি সত্যিই জানি না, সব যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
কলিন কোনো যুক্তিতর্ক মানতে চায় না, এমনি ভাব দেখিয়ে বলল, আপনি যদি ওকে প্রশ্নবাণে আর জর্জরিত না করেন তবে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ হব। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, ভবিষ্যতে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না, এখন থেকে আমি ওর সব কাজের জন্য দায়ী থাকব।
ওঃ কলিন, তুমি আমার কত যে ভালো।
সিলিয়া এখন তোমার সম্পর্কে আমাকে কিছু বলবে? যেমন তোমার আগের পারিবারিক জীবনের কথা–তোমার বাবা মা একসাথে ভালোভাবে মিলেমিশে থেকে ছিলেন তো?
ওহো না। বাড়িতে এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ
ওদের কথার মাঝে বাধা দিলেন মিসেস হার্বার্ড।
ওসব কথা থাক, তুমি এসে তোমার দোষ স্বীকার করার জন্য আমি খুবই খুশী। এত সব দুশ্চিন্তার কারণ, তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। তবে একথাও বলবো, তুমি যে ইচ্ছা করে এলিজাবেথের নোটের ওপর কালি ছেটাওনি, তোমার কথা আমি মেনে নিচ্ছি। এখন তুমি ও কলিন যেতে পারো।
তারা চলে যাওয়ার পর মিসেস হার্বার্ড একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।
ভালো কথা, পোয়ারোর উদ্দেশে বললো সে, এ ব্যাপারে আপনি কি মনে করেন?
পোয়ারোর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আমার মনে হয় একটা প্রেমের দৃশ্যে আমরা সাহায্য করছি-একেবারে আধুনিক স্টাইলে প্রেম যাকে বলে।
আমাদের সময়কার প্রেমের ধারা এখন কতই না বদলে গেছে? মিসেস হার্বার্ড দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আবার বললেন, সিলিয়ার যখন মাত্র চার বছর বয়স তখন ওর বাবা মারা যান। ওর ছেলেবেলা ভালোই কাটে তবে ওর নির্বোধ মা
আহ, মেয়েটি কিন্তু খুবই বুদ্ধিমতী। নিজের থেকে ও কিছু বলবে না। যতটুকু সে শুনতে চায় ঠিক ততটুকুই ও বলবে। মেয়েটি তাকে খুবই ভালোবাসে।
এসব যুক্তি আপনি বিশ্বাস করেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
সিলিয়ার মনে যে সিনড্রেলার জটিলতা ছিল, এ আমি বিশ্বাস করি না। আর জিনিষগুলোর চুরির সময় ও বলেছে যে ও কেন একাজ করেছে ও জানত না, এ যুক্তিও আমি মানতে পারছি না। আমার মনে হয় অখ্যাত জিনিষগুলি চুরির ঝুঁকি ও নিয়ে থাকবে ওর প্রেমিক কলিনের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য–এ ব্যাপারে ও সফল। ও যদি সাধারণ লাজুক মেয়ের মতো হত তাহলে কলিন ওর দিকে তাকাই না। আমার মতে, পোয়ারো বলল, মেয়েটি সব মনের মানুষকে পাওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল।
তাহলে দেখা যাচ্ছে সমস্ত ব্যাপারটাই পাখির বাসা বাঁধতে চাওয়ার মতো।
সত্যি মঁসিয়ে পোয়ারো, এ ব্যাপারে অযথা সময় নষ্ট করার জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। যাহোক যার শেষ ভালো তার সব ভালো।
না, না, পোয়ারো মাথা নাড়লো। আমার তো মনে হয় না, এ সব ঘটনার শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি। যাহোক হয়তো আমরা এই জটিল কেসের রাস্তা পরিষ্কার করেছি, কিন্তু এখনো কিছু ব্যাপার ঠিক পরিষ্কার হয়নি। আমার মনে হয় এখনো কিছু সংকট রয়ে গেছে–সত্যি অত্যন্ত সংকটজনক কিছু।
মিসেস হার্বার্ডের ফর্সা মুখখানি আবার কালো হয়ে গেল। ওঃ মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি সত্যিই তাই মনে করেন?
এটা আমার ধারণা, ম্যাডাম আমার আশঙ্কা, প্যাট্রিসিয়া লেনের সঙ্গে একবার কথা বলার সুযোগ পাব কিনা। আমি সেই চুরি যাওয়া হীরের আংটিটা দেখতে চাই।
কেন পাবেন না সঁসিয়ে পোয়ারো। আমি এখুনি নিচে গিয়ে ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমিও লিও বেটসনের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
একটু পরে প্যাট্রিসিয়া লেন ঘরে ঢুকলেন। মুখে হাজারো প্রশ্ন।
আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত মিস্ লেন।
ও কিছু নয়। মিসেস হার্বার্ড বললেন আপনি আমার হীরের আংটিটা দেখতে চান। আংটিটা আঙুল থেকে খুলে পোয়ারোর হাতে দিল মিস্ লেন।
সত্যি খুব বড় মাপের হীরের আংটি। তবে আমার ধারণা সেকেলে।
মিস লেন বললেন–আমার মায়ের বাগদানের আংটি।
আপনার মা কি এখনো জীবিত?
না, বাবা ও মা দুজনেই মৃত।
বড় দুঃখের কথা।
হ্যাঁ, আমার দুঃখ আমি তাদের বড় একটা ঘনিষ্ঠভাবে পাইনি। তারপর আমি প্রতুবিদ্যায় পোস্টগ্র্যাজুয়েট হচ্ছি বলে মা খুব নিরাশ হন।
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে পোয়ারো ভাবল : তার অনুমান মেয়েটির বয়স সবে তিরিশ পেরিয়েছে। ঠোঁটে সামান্য লিপস্টিক ছাড়া অন্য কোনো প্রসাধন নেই। চশমার আড়ালের ওর গভীর নীল চোখে গাম্ভীর্যের ছাপ। মেয়েটির আচরণে কোনো দম্ভ নেই, কোনো অহঙ্কার নেই, পোষাকে ফ্যাশন বলতে কিছু নেই, সাদামাটা পোশাক। তবে বুদ্ধিমতী ও শিক্ষিত মেয়ে ও, নিজের মনে পোয়ারো বললো, কিন্তু খুব শিগগীর বুড়িয়ে যাবে ও। সেই মুহূর্তে মেয়েটির কথা ভাবতে গিয়ে তার কাউন্টেস ভেরা রসকোফের কথা মনে পড়ে গেলো তার। কিরকম চমৎকার দেখতে ছিল সে, অথচ আজকের দিনে প্যাট্রিসিয়ার মতো মেয়েরা
তবে এই কারণে আমিও যেন বুড়িয়ে যাচ্ছি। আপন মনে বললো পোয়ারো, এমন কি এই চমৎকার মেয়েটিই হয়তো কোনো পুরুষের কাছে খেয়াল হিসাবে আবির্ভূত হবে। তবে তাতে সন্দেহ আছে।
প্যাট্রিসিয়া তখন বলছিল : মিস জনস্টনের যা ঘটেছে তার জন্য আমি সত্যিই মর্মাহত সবুজ কালি ব্যবহার করার ফলে হয়তো মনে হতে পারে যে, নিজেল ইচ্ছাকৃতভাবে এমন একটা বিদ্বেষপরায়ণ কাজ করেছে, কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো আমি আপনাকে আশ্বস্ত করে বলতে পারি, এ কাজ সে কিছুতেই করতে পারে না।
আঃ মেয়েটির দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাল পোরে।
নিজেলকে সহজে বোঝা যায় না। মেয়েটি আন্তরিকভাবে বলল-দেখুন ওর ছেলেবেলায় পারিবারিক জীবনটা খুবই কষ্টের ছিল।
আর এক প্রেম কাহিনি। নিজের মনে বলে ফেললো।
কি বললেন?
না কিছু না। হ্যাঁ আপনি কি বলছিলেন যেন
নিজেলের ব্যাপারে। তাকে বোঝা কষ্টকর। ভালো বা মন্দ যা হোক সবসময়েই সবকিছুর বিরোধিতা করার প্রবণতা আছে তার মধ্যে। তবে সে সত্যি চালাক ও মেধাবী। তবে স্বীকার করতে হবে মাঝে মাঝে তার ব্যবহার দুর্ভাগ্যজনক হয়ে ওঠে। তখন সে নিজের প্রতিরোধের কথা ভুলে যায়, ভুলে যায় কোনো কিছুর সঠিক ব্যাখ্যা করতে। সবাই যখন সবুজ কালির প্রতিবাদ করতে ব্যস্ত, তখন সে ঠিকভাবে প্রতিবাদ করতে পারেনি। তার বক্তব্য ছিল একটাই–তারা যদি তাই মনে করতে চায়, তাদের তাই ভাবতে দিন। তার এই মনোভাব মূর্খতারই পরিচয়।
এতে অবশ্যই ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলো; আপনি তো ওকে অনেক বছর ধরে জানেন।
না, মাত্র একবছরের আলাপ আমাদের। গত বছর বেড়াতে যাওয়ার সময় ওর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সেখানে ওর প্রথমে ফ্লু হয়। তারপর নিউমোনিয়া। তখন আমি ওর শুশ্রূষা করি। স্বাস্থ্যের ব্যাপারে একদমই যত্ন নেয় না। শিশুর মতো ওর যত্ন নেওয়া উচিত। সত্যি ওকে দেখাশুনা করার জন্য কাউকে ওর প্রয়োজন।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো পোয়ারো। হঠাৎ তার মনে হল প্রেমের ক্ষেত্রে খুবই ক্লান্ত সে–প্রথমে সিলিয়া, ওর চোখে ভয়ঙ্কর প্রেমের আকুতি। আর এখন প্যাট্রিসিয়া ম্যাডোনার মতো আন্তরিক ভাবে তাকিয়ে আছে। স্বীকার করতেই হবে একজোড়া যুবক-যুবতী পরস্পরের কাছে এলে তাদের মধ্যে অবশ্যই ভালোবাসার জন্ম হতে পারে। তাদের করুণার চোখে দেখলো পোয়ারো। তারপর উঠে দাঁড়াল সে।
মাদমোয়াজেল, যদি অনুমতি করেন তো এই আংটিটা আপাতত আমার কাছে রেখে দিচ্ছি। আগামীকাল অবশ্যই ফেরত পাঠাব।
নিশ্চয়ই, একটু অবাক হয়ে পাট্রিসিয়া বললো–আপনার ইচ্ছে হলে নিশ্চয়ই নেবেন।
আপনি অত্যন্ত দয়ালু। তাই বলছি মাদমোয়াজেল এইরকম নরম মন নিয়ে একটু সাবধানে থাকবেন।
সাবধানে? কিরকম সাবধানে বলুন তো?
আমার ইচ্ছা আমি জানি, বললো এরকুল পোয়ারো। তখন সে চিন্তিত।
২. এলিজাবেথের নোটের কাগজে
০৬.
এলিজাবেথের নোটের কাগজে কালি ছিটিয়ে অন্তর্ঘাতমূলক কাজের কথা শুনে মিঃ চন্দ্রলাল উত্তেজিত হয়ে উঠলো। অত্যাচার নিপীড়ন। ইচ্ছাকৃতভাবে নেটিভদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। কালো চামড়ার মানুষের প্রতি এক অন্যায় নিপীড়ন। এর থেকে বড় উদাহরণ আজ হতে পারে না।
মিঃ চন্দ্রলাল! তীক্ষ্ণ স্বরে প্রতিবাদ করল মিসেস হার্বার্ড। এ ধরনের কথা তুমি বলতে পার না। কেউ জানে না, এ কাজ কে করেছে। আর কেনই বা করা হয়েছে।
কিন্তু মিসেস হার্বার্ড, আমি ভেবেছিলাম, সিলিয়া নিজে এসে আপনার কাছে সব স্বীকার করেছে, বললো জিন টমনিকসন। এটা তার চমৎকার মনোভাবের পরিচয়। তার প্রতি আমাদের সবার দয়া হওয়া উচিত।
জিন মনে হচ্ছে তুমি যেন জেহাদ ঘোষণা করছো। রাগত ভাবে ভ্যালেরি জনহাউস বললো।
আমার মনে হয়, কথাটা নির্দয়ের মতো হয়ে গেল।
এমন একটা চরম বিদ্রোহের শর্ত! কঁপা গলায় বললো নিজেল! এতো সব বলার কারণ আমি বুঝতে পারছি না। অক্সফোর্ড গ্রুপ এটা ব্যবহার করে আর
ওহো, ঈশ্বরের দোহাই, আমরা অক্সফোর্ড গ্রুপ কি এখন প্রাতঃরাশ সারতে পারি?
মা, এসব কি শুনছি? আপনি কি বলেন, সত্যি কি সিলিয়া এসব জিনিষ চুরি করতে পারে? এজন্যই কি সে প্রাতঃরাশে যোগ দেয়নি?
মাঝখান থেকে মিঃ অ্যাকিমবো বলে উঠলো, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
এ ব্যাপারে কেউ তাকে কিছু জানাল না। সবাই নিজেদের কথায় চিন্তিত।
সত্যি কথা বলতে কি জানো, আমি একেবারেই অবাক হইনি, ধীরে ধীরে বললো সেলী। সব সময়ে আমার এরকমই একটা ধারণা ছিল…
তার মানে তুমি বলতে চাইছ যে, আমার নোটে সিলিয়াই কালি ছিটিয়ে দিয়েছিল? অবিশ্বাস ভরে তার দিকে তাকাল এলিজাবেথ জনস্টন।
না, সিলিয়া কালি ছেটায়নি, বললেন মিসেস হার্বার্ড। আর আমার ইচ্ছে তোমরা এ আলোচনা বন্ধ করো। পরে আমি তোমাদের সব কিছু বলব, কিন্তু…।
কিন্তু গতকাল জিন আপনার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে। ভ্যালেরি বললো।
আসলে আমি ঠিক শুনবো বলে শুনিনি, ঘটনাচক্রে আমি সেখান দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন।
এখন এসো বেশ, খোলাখুলি ভাবেই তাহলে বলি, নিজেল বললো, আমি আমার সবুজ কালির বোতল থেকে কালি ছিটিয়েছি।
না না ও কালি ছিটায়নি। ও কেবল ভান করেছে, ওঃ নিজেল, তুমি কি করে এত বোকা হলে?
আমি মহৎ হয়ে তোমাকে আড়াল করতে চাইছি প্যাট গতকাল সকালে কে আমার কালি ধার নিয়েছিল? তুমিই নিয়েছিলে?
প্লিজ, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না, বললো অ্যাকিমবো।
তুমি বুঝতে চাও না, সেলী তাকে কটাক্ষ করল। আমি তোমার অবস্থায় পড়লে নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম। চোরের মায়ের বড় গলা করে চিৎকার করতাম না।
উঠে দাঁড়াল চন্দ্রলাল। তুমি জিজ্ঞাসা করেছ, মাও কি? তুমি আরো জিজ্ঞাসা করেছ সুয়েজ চ্যানেলের ব্যাপারে ইজিপ্ট কেন ক্রুদ্ধ।
ওহো ওসব বাজে কথা ছাড়, দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠল নিজেল।
প্রথম অক্সফোর্ড গ্রুপ, আর এখন রাজনীতির আলোচনা চলছে। তাও প্রাতঃরাশের সময়। আমি চললাম।
বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে, তোমার কোটটা সঙ্গে নিও। তার দিকে প্যাট্রিসিয়া ছুটে গেল।
অনেকক্ষণ কিছু বলার চেষ্টা করছিল কলিন ম্যাকনার। এবার সে রেগে বলে উঠলো–তোমরা সবাই একটু কথা কম বল, আমার কথা শোনো। মনঃস্তত্বের সঙ্গে আমাদের কি কারোর পরিচয় নেই? আমি বলছি এই মেয়েটাকে দোষ দেওয়া যায় না। অত্যন্ত মানসিক অশান্তিতে ভুগছে সে। আন্তরিক সহানুভূতি, যত্নের সঙ্গে চিকিৎসার প্রয়োজন তার। না হলে তার জীবনে অস্থিরতা থেকেই যাবে। আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি–তার এখনি সর্বতোভাবে যত্ন নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
কিন্তু হাজার হোক, স্পষ্ট ভাষায় জিন বলে, তার প্রতি সদয় হওয়ার পক্ষে আমিও আছি–এ ধরনের ঘটনার জন্য আমাদের অবশ্যই ক্ষমা করে দিতে হবে! মানে চুরির জন্য আর কি!
চুরি? বিরক্ত হল কলিন, ওঃ কতবার তোমাদের বলব, এসব আদৌ চুরি নয়। তুমি আমাকে মানে তোমরা সবাই আমাকে অসুস্থ করে তুলছ। কারো জিনিষ সে চুরি করেনি।
ওহো, এসো জিন। লেন বেটসন বললো, ওসব বাজে কথায় আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমারও।
তারা একসঙ্গে বেরিয়ে গেল। সিলিয়াকে বলো সে যেন এসব ভুলে যায়। বেটসন বলল যাওয়ার সময়।
আনুষ্ঠানিক ভাবে আমি প্রতিবাদ করতে চাই, কুঁসে উঠল মিঃ চন্দ্রলাল। আমার চোখের জন্য বোরিক পাউডারের খুব প্রয়োজন। সেটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে, নেই।
তুমি খুব দেরি করে ফেলেছো মিঃ চন্দ্রলাল, মিসে হার্বার্ড বললো।
জেনেভিভ ফরাসী ভাষায় কি বললো বোঝা গেল না।
জেনেভিভ, তোমাকে অবশ্যই ইংরেজিতে কথা বলতে হবে–তুমি যখনি উত্তেজিত হবে, ইংরেজিতে তোমার উত্তেজনা প্রকাশ করতে না পারলে কখনো ইংরেজি শিখতে পারবে না। এই সপ্তাহে রোববার তুমি নৈশভোজ খেয়েছিল আমার সঙ্গে। কিন্তু আজও তুমি দামটা মিটিয়ে দাওনি।
আহ! আমার পার্সটা সঙ্গে নেই। আজ রাতে মিটিয়ে দেবো।
প্লিজ, অ্যাকিমবো বলে উঠলো, আমি বুঝতে পারছি না।
আমার সঙ্গে এসো অ্যাকিমবো, সেলী বলল, ইনস্টিটিউট যাওয়ার পথে আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে দেব।
ওহে প্রিয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো মিসেস হার্বার্ড। কেন যে এ চাকরিটা আমি নিতে গেলাম।
একমাত্র ভ্যালেরিই এখন ডাইনিংরুমে হাজির ছিল। বন্ধুসুলভ ভঙ্গিমায় দাঁত বার করে হাসলো সে। বললো, চিন্তা করবেন না মা, ভালো জিনিষ সব সময়েই বেরিয়ে আসে। এখন সবাই লম্ফ ঝম্ফ করার দিকে।
আমাকে বলতে হচ্ছে, আমি খুব অবাক।
হা। তুমি নও কি?
অন্যমনস্ক ভাবে ভ্যালেরি বললো, সত্যি আমার ভাবা উচিত ছিল।
তুমি কি প্রথম থেকেই ভেবেছিলে?
ভালো কথা, একটা দুটো ব্যাপারে আমার খটকা লেগেছে। সে যাহোক সিলিয়া কলিনকে চেয়েছিল, পেয়েছেও।
হা। আবার আমি ভাবতেও পারছি না যে, এ ভুল, সম্পূর্ণ ভুল।
বন্দুক সমেত তোমার মনের মানুষকে তুমি পেতে পার না। হাসল ভ্যালেরি। বলল, এই প্রতারণা কি ক্লিপ্টোম্যানিয়ার পর্যায় পড়ে থাকে? কোনো চিন্তা করো না মা। আর ঈশ্বরের দোহাই, সিলিয়াকে বলল, সে যেন জেনেভিভের পাউডার ফেরত দেবার ব্যবস্থা করে। না হলে খাওয়ার সময় আমরা কেউ শান্তি পাব না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিসেস হার্বার্ড। এসময় সিলিয়া ডাইনিংরুমে প্রবেশ করল। তার চোখ দুটো চোখের জলে লাল।
অনেক দেরী করেছ সিলিয়া। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর কোনো খাবার নেই। বলল মিসেস হার্বার্ড।
অন্যদের সঙ্গে আমি দেখা করতে চাইনি।
আমি সেটা বুঝতে পারি। কিন্তু একদিন না একদিন তো তাদের সঙ্গে দেখা করতেই হবে।
ও হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু আমার মনে হয় আজ সন্ধ্যায় সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আর এখানে থাকব না। এ সপ্তাহের শেষে আমি চলে যাব।
মিসেস হার্বার্ড অবাক হলেন।
আমার মনে হয় না তার প্রয়োজন আছে। হয়তো এখন তোমার একটু খারাপ লাগবে আর সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এসব তরুণতরুণীদের মন খুবই উদার, ওরা তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। অবশ্য যতটা সম্ভব ওদের হারানো জিনিসের দাম তোমাকে মিটিয়ে দিতে হবে। তার জন্য তোমাকে
বাধা দিল সিলিয়া। ও হ্যাঁ, আমি আমার চেকবুক সঙ্গে এনেছি। আর একথাই আমি আপনাকে বলতে এসেছিলাম।
বেশ তো। এখন আমাদের হারানো জিনিষের একটা তালিকা তৈরি করতে হবে।
যতোটা সম্ভব আমি করে রেখেছি। তবে সেগুলো আমাকে কিনে দিতে হবে, না টাকা দিয়ে দেব বুঝতে পারছি না।
পরে ভেবে বলব। এখনি বলা শক্ত।
তালিকাটার ওপর চোখ বুলিয়ে সিলিয়া বলে, মোটামুটি অংকের একটা চেক আমি আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি, বেশি হলে ফেরত দেবেন, কম পড়লে বলবেন, বাকিটা আমি দিয়ে দেব।
সেই ভালো। মিসেস হার্বার্ড আন্দাজে একটা অঙ্কের চেক দিতে বললো, সঙ্গে সঙ্গে সিলিয়া রাজী হয়ে গেল। সে তার চেকবুক বার করল। চেক সই করতে গিয়ে সিলিয়া দেখল তার পেনে কালি নেই। তখন সে দেয়ালে টাঙানো সেলফগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিজেলের সেই ভয়ঙ্কর সবুজ পেনের কালি ছাড়া অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের পেনে কালি ছিল না। ওহো আমি ওর কালিই ব্যবহার করব। নিজেল কিছু মনে করবে না। বাইরে বের হলে ওর জন্য এক বোতল সবুজ কুইঙ্ক কালি আনব। সিলিয়া বলল।
অতঃপর সিলিয়া তার পেনে সবুজ কালি ভরে চেক লিখে মিসেস হার্বার্ডের হাতে দিল। মিসেস হার্বার্ড তাকে অনুরোধ করল যাতে সে কিছু অন্তত খেয়ে যায়। অন্তত মাখনরুটিও খেয়ে যায়। সিলিয়া কথা শুনল। এক টুকরো মাখনরুটি সে মুখে দিল।
ওদিকে ইতালীয় চাকর গেরোনিমো ঘরে ঢুকে জানাল, মিসেস নিকোলেটিস তাকে ডেকেছেন। মিসেস হার্বার্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।
চিড়িয়াখানার বাঘের মতো কুঁসছিলেন মিসেস নিকোলেটিস তার ঘরে পায়চারি করতে করতে। মিসেস হার্বার্ডকে দেখে সে রেগে বললো, এসব কি শুনছি? আমাকে না জানিয়ে তুমি পুলিশে খবর দিয়েছ? তুমি নিজেকে কি ভাব?
আমি পুলিশে খবর দেয়নি।
তুমি মিথ্যেবাদী। আমি ভুল করেছি তোমাকে বিশ্বাস করে, তোমার সব কাজে সম্মতি দিয়ে। সম্মানিত হস্টেলে পুলিশ
এটা প্রথম নয়, বললো মিসেস হার্বার্ড। আগের অপ্রীতিকর ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে বললো সে, একজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ছাত্র অসৎ উপায়ে এখানে এসেছিল টাকা রোজগার করতে। আর একজন কুখ্যাত কমিউনিস্ট বিক্ষোভকারী নাম ভাড়িয়ে এখানে এসে উঠেছিল আর।
আহ! এখানে কেউ নাম ভাড়িয়ে এসে আমাকে মিথ্যে পরিচয় দিলে সে কি আমার অপরাধ? আমার সেই দুর্ভাগ্যের কথা তুলে তুমি আমাকে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার চেষ্টা করছ?
সে সব আমি কিছুই করছি না, আমি শুধু বলছি এখানে বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রী মিশে গেছে। তাদের নিরাপত্তার জন্য যদিও বা পুলিশ আসেই তা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু পুলিসকে ডাকাই হয়নি। একজন প্রখ্যাত প্রাইটে ডিটেকটিভ ঘটনাচক্রে এখানে এসে পড়েন আর আমাদের সঙ্গে নৈশভোজে যোগ দেন। ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি অপরাধতত্ত্বের ওপর সুন্দর বক্তৃতা দেন।
যেন আমাদের ছাত্রছাত্রীদের অপরাধতত্ত্বের ব্যাপারে জ্ঞান দেওয়া খুবই জরুরী ছিল তাই না? ওসব বাজে কথা। ওরা ভালোভাবে জানে, এখানে যেসব জিনিষ চুরি গেছে, সেগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, এক ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক কাজ। আর এ ব্যাপারে এখনো কোনো কিনারা হয়নি।
কথাটা ঠিক নয়। আশা করি আমি কিছু করতে পেরেছি।
হা, তোমার কিছু করার মধ্যে এই বন্ধুটিকে আমাদের ঘরের কলঙ্কের কথা বলে দেওয়া এই তো? এক ভয়ঙ্কর বিশ্বাসভঙ্গের নজির বুঝলে?
একেবারেই না। এই হস্টেল চালানোর জন্য আমি দায়ী। এর পবিত্রতা রক্ষা করার ভার আমার উপরেই। আপনাকে একটা সুখবর দেই; ব্যাপারটা এখন মিটে গেছে। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজন ছাত্রী স্বীকার করেছে, সে এই দুষ্কর্মের জন্য দায়ী।
নোংরা মেয়ে, ঝাঝালো স্বরে বলে উঠলো মিসেস নিকোলেটিস। ওকে রাস্তায় বার করে দাও।
তার অরা দরকার হবে না। সে এই হস্টেল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর সব হারানো জিনিষের দাম মিটিয়ে দিয়েছে।
তাতে কি লাভ? আমার এই সুন্দর স্টুডেন্ট হোমের এখন বদনাম হবে। কেউ আর এখানে আসবে না। সোফায় বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল মিসেস নিকোলেটিস। কেউ আমার কথা চিন্তা করে না। কাল যদি আমি মরে যাই, কেই বা তোয়াক্কা করবে?
বুদ্ধিমতীর মতো তার এই সব অবান্তর প্রশ্ন অনুত্তর রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মিসেস হার্বার্ড। ঈশ্বর আমাকে ধৈর্য ধরার ক্ষমতা দাও। নিজের মনে বলে রান্নাঘরে ঢুকল মিসেস হার্বার্ড, রাঁধুনী মারিয়ার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। মারিয়ার মুখ সবসময় গোমড়া ও অসহযোগী মনোভাব। পুলিশ-এর কথা হাওয়ায় তার কানে ভেসে এসে থাকবে।
দেখছি এবার আমাকেও অভিযুক্ত করা হবে। আমাকে আর গেরোনিমোকে। বিদেশে আমরা কি সুবিচার আশা করতে পারি? আমি আর এখানে রান্নার কাজ করতে পারব না।
বেশ, তুমি যা খুশী করতে পার। রাগত স্বরে বলে, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল মিসেস হার্বার্ড।
সেদিন সন্ধ্যা ছটায় মিসেস হার্বার্ড আর একবার তার দক্ষতার পরিচয় দিলেন। ছাত্রছাত্রীদের জানিয়ে দিল, তারা যেন নৈশভোজের আগে তার সঙ্গে দেখা করে। তার আহ্বানে সবাই যখন সাড়া দিতে হাজির হল, সে তখন তাদের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলে, সিলিয়া তাকে হারানো জিনিষগুলো কেনার ব্যবস্থা করতে বলেছে, আগাম একটা চেকও দিয়েছে সে। এ খবর শুনে সবাই খুশী। এমনকি একগুঁয়ে স্বভাবের জেনেভিভও তার হারানো পাউডার ফিরে পাওয়ার আনন্দে বলল, আমি জানি সিলিয়ার আর্থিক সচ্ছলতা আছে, ওর মতো মেয়ে কখনো চুরি করতে পারে না। এটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র। মঁসিয়ে ম্যাকনার ঠিকই বলেছিলেন।
নৈশভোজের ঘন্টা বাজতেই সবাই ডাইনিংরুমে আসলো। সিলিয়া তখনও আসেনি। লেন বেটসন মিসেস হার্বার্ডকে বলল, হলের বাইরে আমি সিলিয়ার জন্য অপেক্ষা করব। আমি তাকে নিয়ে আসব। যাতে সে দেখতে পায় সব ঠিকঠাক চলছে।
সে তোমার বদান্যতার পরিচয় দেয়।
ঠিক আছে মা, চললাম।
ঠিক সময়ে নৈশভোজের টেবিলে স্যুপ পরিবেশিত হল। আর ঠিক এসময়েই সিলিয়ার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।
এসো সিলিয়া। বন্ধুরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
কলিন ম্যাকনার সবার শেষে এল। নৈশভোজ শেষ হওয়ার ঠিক আগে সে উঠে দাঁড়িয়ে ধরা গলায় বলল, একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তাই দেরি হল। যাহোক, প্রথমে আমি তোমাদের একটা শুভ সংবাদ দেই–আগামী বছর আমার কোর্স শেষ হলে আশা করছি আমি আর সিলিয়া বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হব।
খবরটা শুনে সবাই লাফিয়ে উঠলো, বন্ধুদের অভিনন্দন আর ভালোবাসায় ডুবে গেল কলিন। সবাই তাকে ধন্য ধন্য করতে থাকলো তার এই নির্ভীক সিদ্ধান্তের জন্য। শেষ পর্যন্ত তাদের আলিঙ্গন থেকে কোনোরকমে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে বাঁচলো সে, ভয়ঙ্কর লজ্জা তাকে পেয়ে বসেছিল। আর সিলিয়ার মুখটা তখন রক্তিমাভা ধারণ করেছিল। ওর মুখ দেখে মনে হল, বুঝি ওর শরীরের সমস্ত রক্ত উঠে এসেছে ওর সারা মুখে।
সিলিয়ার পক্ষে ও বিপক্ষে ভালো ও মন্দ মেশানো বন্ধুদের নানান মন্তব্যের উত্তরে সিলিয়া ম্লান স্বরে বললো, ওহো আমার মনে হয়, আমি এ কাজ করেছি–তবে আশা করি আগামীকাল সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমাদের মনের সন্দেহের সব জমা মেঘ সরে রৌদ্র ঝলমলিয়ে উঠবে। সত্যিই আমি তাই মনে করি। এলিজাবেথ, তোমার নোটে কালি ছেটানো পিঠে ঝোলানো ব্যাগ টুকরো টুকরো করে ছেঁড়া, এসব কুকাজ যে করেছে আমার মতো এগিয়ে এসে সেও যদি দোষ স্বীকার করে তো সব কিছুই পরিষ্কার হয়ে যায়।
খুশীর হাসিতে ফেটে পড়ল ভ্যালেরি। তারপর আমরা আবার একসঙ্গে মিলেমিশে সুখে শান্তিতে বাস করতে পারব।
তারপর সবাই মিলে কমনরুমে গিয়ে বসল। সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হল কে সিলিয়াকে কফির পেয়ালা এগিয়ে দেবে। কফি খাওয়া হলে সবাই কমনরুম ছেড়ে চলে গেল। তারপর ২৪ ও ২৬ নম্বর হিকরি রোডের বাসিন্দারা যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়ল।
ওদিকে ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে মিসেস হার্বার্ড মনে মনে বলল, এই শুভ সূচনার জন্য ধন্যবাদ। এখন আমরা সব চিন্তা উদ্বেগ কাটিয়ে উঠেছি।
.
০৭.
মিস লেমনের খুবই কদাচিত দেরি হয়। দশ মিনিট দেরিতে অফিসে ঢোকামাত্র সে ক্ষমা চাইল।
আমি অত্যন্ত দুঃখিত মঁসিয়ে পোয়ারো। অফিসে আসার জন্য বেরোতে যাব হঠাৎ ঠিক সেসময়ই বোন ফোন করল।
আহ, আমার বিশ্বাস, শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে নিশ্চয়ই সুস্থ সে।
নাঃ মাথা নাড়ল মিস্ লেমন। সত্যি কথা বলতে কি, অত্যন্ত বিপর্যস্ত সে। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজন আত্মহত্যা করেছে।
পোয়ারোর দৃষ্টি স্থির, পলক ফেলতে বুঝি ভুলে গেছে সে। আচ্ছা, তার নাম কি বলো তো?
সিলিয়া অস্টিন।
কি করে?
ওদের ধারণা মরফিয়া নিয়ে থাকবে সে।
এটা কি দুর্ঘটনা বলে মনে হয়?
ওহো না, মনে হয় নোট সে লিখে গেছে।
এমনটা আশা করিনি। তবে এটা সত্যি যে আমি কিছু একটা আশা করেছিলাম। পোয়ারো বলল।
পেন্সিল আর প্যাড নিয়ে বসল মিস্ লেমন।
না, আজ আর কোনো নোট দেওয়া নয়। সকালের ডাকগুলো খুলে দেখ। চিঠিগুলো ফাইল করে দিও। উঠে দাঁড়ালো পোয়ারো, ফোন এলে যাহোক কিছু বলে দিও। আমি এখন হিকরি রোডে চললাম।
.
পোয়ারাকে আহ্বান করলো গেরোনিমো। আগের দুরাতের সম্মানিত অতিথিকে সে চিনতে পারল। সঙ্গে সঙ্গে ফিসফিস করে স্বচ্ছন্দে বললো, আঃ সিনিয়ার, আপনি এসে গেছেন? আমরা এখানে একটা ভীষণ গণ্ডগোলের মধ্যে পড়েছি। সিলিয়া অস্টিনকে আজ সকালে মৃত অবস্থায় তার বিছানায় পাওয়া গেছে। প্রথমে ডাক্তার, তারপর পুলিস ইনসপেক্টরও তার দলবল নিয়ে এসে গেছে উপরে। কেন যে তিনি আত্মহত্যা করলেন? গতকাল রাতে আনন্দ উৎসবে তার বাগদান পাকা হল।
বাগদান?
হা, মিস্টার কলিনের সঙ্গে–বলিষ্ঠ চেহারা, মুখে সবসময় পাইপ।
জানি।
কমনরুমের দরজা খুলে সে চুপিচুপি পোয়ারোকে বলল : আপনি আপাতত এখানে থাকুন। পুলিস চলে গেলে সিনিয়ারকে বলব, আপনি তার জন্য এখানে অপেক্ষা করছেন। এই ভালো হ্যাঁ?
পোয়ারো বলল, ভালো। তারপর গেয়রানিমো চলে যেতেই ঘরের সব জিনিসগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকল।
ওদিকে ওপরতলায় ইনসপেক্টর শার্প-এর মুখোমুখি বসে তার বিনীত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল মিসেস হার্বার্ড। বিরাট চেহারা তার, নরম প্রকৃতির, তার আচরণের মধ্যেও একটা নম্র ভাব বিদ্যমান।
আমি জানি, আপনার সঙ্গে এ ঘটনা অত্যন্ত অস্বস্তিকর আর বিপর্যয়েরও বটে। নরম গলায় বললো সে। কিন্তু দেখুন ডঃ কোলস যেমন আপনাকে বললেন এ কেসের তদন্ত করতেই হবে। আর সেজন্য এ ঘটনার আগে ওপরের একটা সঠিক চিত্র আমাদের তুলে ধরতে হবে, এখন আপনি বলছেন যে, মেয়েটি সম্প্রতি বিপর্যস্ত ও অখুশী ছিল। প্রেমঘটিত কোনো ব্যাপারে?
না ঠিক তা নয়। ইতস্ততঃ করলো মিসেস হার্বার্ড।
দেখুন আপনি আমাকে সব খুলে বলুন, কোনো কিছু গোপন করবেন না, অনুরোধ করল ইনসপেক্টর শার্প। মেয়েটির আত্মহত্যা করার প্রকৃত কারণ যদি জানা থাকে তো বলুন। তার গর্ভবতী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা
আদৌ সেরকম কিছু নয়। ইনসপেক্টর শার্প, আমার বলতে দ্বিধা হচ্ছে ঘটনাটা নেহাতই সামান্য। মেয়েটি বোকার মতো কিছু কাজ করে। হ্যাঁ আমিও বোকামো করেছিলাম। সত্যি কথা তাহলে শুনুন–গত তিনমাসে বা তার কিছু আগে থেকে কতগুলো জিনিস এখান থেকে হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়। সামান্যই জিনিস। মানে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।
ও টাকাকড়ি কিছু?
না, যতদূর জানি টাকাপয়সা কিছু চুরি হয়নি।
আহ, সেজন্য কি এই মেয়েটি দায়ী।
হ্যাঁ।
আপনি তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন।
না ঠিক সেরকম নয়, গত পরশু রাতে–আমার এক বন্ধু আসে এখানে নৈশভোজে যোগ দিতে। মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো–এ নামে কাউকে চেনেন কি?
মঁসিয়ে পোয়ারো? বললো সে। চিনি বৈকি, খুব চিনি! এখন আগ্রহ আমার আরো বেড়ে গেল। তারপর
নৈশভোজের পর তিনি চুরি নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাদের সবার সামনে তিনি আমাকে পুলিসকে খবর দিতে বলেন। তারপরই সিলিয়া আমার ঘরে এসে দোষ স্বীকার করে। তখন সে খুবই বিপর্যস্ত ছিল।
তাকে অভিযুক্ত করার কোনো প্রশ্ন উঠেছিল?
মতামত নেই? যেমন ধরুন, মিস জনস্টনের রিসার্চের কাগজের ওপর কালি ছিটানোর ঘটনা?
ইনসপেক্টর শার্প আপনি যদি ভেবে থাকেন যে কাজ আমি করেছি, সেটা হবে সম্পূর্ণ অসত্য। অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে আমিই এ কাজ করেছি। কারণ আমিই একমাত্র সবুজ কালি ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু এ ব্যাপারে যদি আমাকে প্রশ্ন করেন তো বলতে পারি, স্রেফ আমার প্রতি আক্রোশের বশে কেউ এ কাজ করেছে।
আক্রোশ কি রকম?
আমার কালি ব্যবহার করাটা। হয়তো কেউ ইচ্ছা করে আমার কালি ব্যবহার করেছে, যাতে মনে হয় এটা আমার কাজ। ইনসপেক্টর, এখানে অনেকেরই আমার ওপর আক্রোশ আছে।
আপনার উপর আক্রোশ আছে বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন? ইনসপেক্টর তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলো।
সত্যি আমি অর্থ করতে চাই না। তবে এখানে অনেকে থাকে। কার মনে কি আছে কে জানে।
এরপর তালিকার নাম লিওনার্ড বেটসন। নিজেলের থেকে লেন বেটসন অনেক বেশি সহজবোধ্য তবে সে অন্যরকম, সন্দেহজনক ও নিষ্ঠুর।
ঠিক আছে! রুটিন মাফিক জেরা শেষ হবার পরই রেগে উঠল লিওনার্ড। হ্যাঁ, আমি কফির পেয়ালা তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে কি হয়েছে?
আপনিই তাহলে বলছেন যে নৈশভোজের পর আপনিই কফির পেয়ালা হাতে দিয়েছেন।
হা, তবে আপনি বিশ্বাস করুন বা না করুন, কিন্তু তাতে মরফিয়া ছিল না।
আপনি তাকে কফি খেতে দেখেছেন?
না, আমি তাকে কফি খেতে দেখিনি। কারণ আমরা তখন চারদিকে ঘুরছিলাম। আমার সঙ্গে আবার তখন একজনের তর্ক হয়। তাই সে তখন কফি পান করেছিল কিনা আমি লক্ষ্য করিনি। তার চারপাশে অনেকেই ছিল।
তাই বুঝি। তবে আপনার কথা শুনে মনে হয় কেউ তাকে কফিতে মরফিয়া মিশিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু আপনি যদি কারো কাপে কিছু ঢালতে চান, সেটা কারোর দৃষ্টি এড়াতে পারে না।
সব সময় সেটা সম্ভব নাও হতে পারে। শার্প বললো।
লেন এবার সত্যি সত্যি রেগে গেল। আপনি কি ভেবেছেন আমি ঐ বাচ্চা মেয়েকে বিষ খাওয়াতে চেয়েছিলাম? তার বিরুদ্ধে আমার কোনো অনুযোগ বা অভিযোগ নেই।
না, আমি বলছি না আপনি তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছেন।
সে নিজেই হয়তো বিষ খেয়ে থাকবে। এ ছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে না।
সে চিন্তা আমরাও করতে পারি, যদি না সেই জাল আত্মহত্যার নোটটা না পাওয়া যেত।
জাল আত্মহত্যার নোট! কেন, সেটা সে নিজে লেখেনি?
সেদিন ভোর সকালে সেই চিঠির কিছু অংশ সে নিজে হাতে লিখেছিল?
বেশ–সে কাগজের কিছু অংশ ছিঁড়ে ছিঁড়ে তার আত্মহত্যার নোট হিসাবে ব্যবহার করতে পারে।
তাহলে এখন আসল ঘটনায় আসুন মিঃ বেটসন। ধরুন আপনি যদি আপনার আত্মহত্যার নোট লিখতে চান, তাহলে নিশ্চয়ই অন্য কাউকে লেখা একটা চিঠি নিয়ে তার কিছু অংশ সাবধানে ছিঁড়বেন না।
আমি তা করতে পারি। মানুষ অনেকরকমের মজার কাজ করতে পারে।
সেক্ষেত্রে চিঠির বাকি অংশটা কোথায় গেল?
আমি কি করে জানব? কারণ সেটা আপনার কাজ আমার নয়।
আমার কাজ আমি করব। তবে আপনাকে বলছি আপনি ভদ্রভাবে আমার কথার উত্তর দিন।
বেশ আপনি কি জানতে চান বলুন? মেয়েটিকে আমি খুন করিনি। আর তাকে খুন করার কোনো মোটিভও আমার নেই।
তাকে আপনি পছন্দ করতেন?
লেন এবার নরম গলায় বলল–হ তাকে আমি ভালোবাসতাম। চমৎকার মেয়ে ছিল সে, একটু বোকা, কিন্তু ভালো।
মেয়েটি যখন নিজে মুখে স্বীকার করে সে চুরি করেছিল আপনি বিশ্বাস করেছিলেন?
সে যখন নিজের মুখে বলেছিল, তখন অবশ্য তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু এর সঙ্গে আবার এও বলল সে, সেটা যেন একটু অদ্ভুত বলেই মনে হয়েছিল আমার।
সে যে এ কাজ করতে পারে, আপনি চিন্তা করতে পারেননি, এই তো!
না, সত্যিই নয়।
একটু আগে লিওনার্ডের সব নিষ্ঠুরতা এখন চাপা পড়ে গেছে। এখন তার আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রয়োজন নেই। সে যে ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল সেই সমস্যার সমাধান করার কাজে মন দিল সে।
তাকে ক্লিপ্টোম্যানিয়াক বলে আমার কখনো মনে হয়নি, আমি কি বলতে চাইছি আপনি যদি বুঝতে পারতেন, বলল সে, সে চোরও ছিল না।
সে যা করেছিল, তার অন্য কারণ কি আপনি ভাবতে পারেন?
অন্য কারণ মানে? আর কি অন্য কারণ থাকতে পারে?
কেন তার প্রতি মিঃ কলিন ম্যাকনারের আগ্রহ বানানোর জন্যও তো হতে পারে।
কিন্তু তা তো অনিশ্চিত ছিল, তাই না?
কার্যত সে সফল তো হয়েছিল।
হ্যাঁ, যে কোনো মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের প্রতি কলিন আকর্ষণ বোধ করে।
ভালো, যদি সিলিয়া এটা জানে
লেন মাথা নাড়ল। না, সেরকম চিন্তা কখনোই তার মাথাতে আসবে না। মানে, তার পরিকল্পনাতেও এরকম চিন্তা আসবে না। তাছাড়া সে এসব জানত না।
মানে আমি বলতে চাইছি, হয়তো আপনি কোনো সৎ উদ্দেশ্যে তাকে এরকম পরামর্শ দেবেন।
মৃদু হাসল লেন। আপনি ভাবছেন বোকার মতো আমি ও কাজ করব? অতই জেদীই কি আপনি?
এবার প্রসঙ্গ বদলালেন ইনসপেক্টর। আপনি কি মনে করেন এলিজাবেথ জনস্টনের ওপর কালি ছিটিয়েছিল সিলিয়া? কিংবা অন্য কেউ একাজ করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
অন্য কেউ হবে। সিলিয়া বলেছে–সে একাজ করেনি। আমি তার কথা বিশ্বাস করি। আমি কখনো সিলিয়াকে বিরক্ত করিনি। যেমন কিছু লোক করে।
আর সিলিয়া কি কাউকে উত্ত্যক্ত করেছিল বলে মনে হয় আর কেনই বা?
জানেন সিলিয়া অনেককে তিরস্কার করেছিল। কয়েক মুহূর্ত ভাবল লেন। যে কেউ তাড়াতাড়ি কথা বললে সহ্য করতে পারতো না সে। টেবিলের দিকে তাকিয়ে সে বলল, আমার আশঙ্কা, কোনো ঘটনা থেকে এ স্বভাবের জন্ম হয় না। পরিসংখ্যান থেকে বেশ ভালো ভাবে তার মনে গেঁথে গিয়েছিল–এধরনের কিছু একটা হবে। যাহোক, জানেন এটা তিরস্কারের সামিল–বিশেষ করে যারা হরবর করে দ্রুত কথা বলে থাকে, যেমন উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে নিজেল চ্যাপম্যান।
আহ, হা, নিজেল চ্যাপম্যান।
আর সবুজ কালির ব্যাপারটা ধরতে হবে।
তাহলে আপনি মনে করেন নিজেলই একাজ করেছিল?
হ্যাঁ, অন্তত সেটা সম্ভব। জানেন এক ধরনের আক্রোশকারী সে। আর আমার মনে হয় তার একটা জাতিগত মনোভাব ছিল। আমাদের মধ্যে অন্য একজনের এরকম মনোভাব ছিল।
আপনার কি মনে হয় মিস্ জনস্টন ছাড়া অন্য কেউ তার নির্ভুল আর অপরের দোষত্রুটি শুধরে দেওয়ার অভ্যাস বরদাস্ত করতে পারত না, বিরক্ত বোধ করত?
হ্যাঁ, কলিন ম্যাকনার তেমন সন্তুষ্ট ছিল না এ ব্যাপারে।
আরো কয়েকটা এলোমেলো প্রশ্ন করল শাপ, কিন্তু লেন বেটসনের উত্তরগুলো তেমন কার্যকর হল না। এরপর ভ্যালেরি জনহাউসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলো শার্প।
ঠান্ডা প্রকৃতির ভ্যালেরির রুচি ছিল। তাকে একটু চিন্তিত বলেও মনে হল। অন্য পুরুষদের মতো অতটা স্নায়ু দুর্বলতা তার মধ্যে লক্ষ্য করা গেলো না। সিলিয়ার সে খুব ভক্ত। সে আরো বললো, সিলিয়ার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ছিল, কিন্তু যে ভাবে সে তার হৃদয় দিয়ে কলিন ম্যাকনারকে গ্রহণ করেছিল, সেটা খুবই বেদনাদায়ক।
মিস জনহাউস, আপনি কি মনে করেন না, সিলিয়া ক্রিপ্টোম্যানিয়াক ছিলো?
হ্যাঁ, আমি সেরকমই মনে করি। এ বিষয়ে আমার খুব বেশি কিছু জানা নেই।
আচ্ছা, অন্য কেউ জিনিসগুলো চুরি করে তার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়নি তো?
ভ্যালেরি তার কাধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো, তার মানে আপনি কি বলতে চাইছেন, ঐ গর্দভ কলিনকে আকর্ষণ করার জন্য?
মিস জনহাউস, ব্যাপারটা আপনি খুব তাড়াতাড়ি ধরে ফেললেন তো!
হ্যাঁ, আমি সেটাই বোঝাতে চাইছি। আমার অনুমান, আপনি তাকে এ ব্যাপারে পরামর্শ দেননি তো?
কৌতুক বোধ করল ভ্যালেরি।
না, তা কেন করতে যাবো? তাছাড়া আমার নিজের স্কার্ফ আমি তাকে টুকরো টুকরো করে কাটতে বলবো? আমি সেরকম পরের উপকার করার পাত্রী নই।
অন্য কেউ তাকে সেরকম পরামর্শ দিয়েছে বলে মনে হয় আপনার?
আমার তা মনে হয় না। বরং আমার তো মনে হয় তার পক্ষে এটাই স্বাভাবিক।
স্বাভাবিক বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?
তাহলে শুনুন, প্রথমে সেলীর জুতো চুরি যাওয়ার সময়েই সিলিয়ার উপর আমার কেমন যেন একটু সন্দেহ হয়েছিল। সেলী ফিঞ্চ-এর প্রতি সিলিয়ার হিংসা ছিলো। এখানে সেলী অনেক মেয়ের থেকে বেশি আকর্ষণীয় ও সুন্দরী। তার প্রতি কলিনের দুর্বলতা ছিলো। তাই সেদিন রাত্রে তার সেই ফ্যান্সি ড্রেসের জুতোটা চুরি হওয়ার দরুন তাকে কালো জুতোর সঙ্গে কালো পোষাক পড়ে পার্টিতে যেতে হয়েছিল। অন্যদিকে সিলিয়াকে বেশ ভালো ও ফিটফাট দেখাচ্ছিল সেদিন। মনে রাখবেন, আমি কিন্তু অন্য জিনিস উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সিলিয়াকে সন্দেহ করিনি, যেমন ব্রেসলেট, পাউডার, কমপ্যাক্ট ইত্যাদি
সেগুলো চুরি করার জন্য কে দায়ী হতে পারে?
কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভ্যালেরি বলে, ওহো, আমি তো জানি না। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো ঘর পরিষ্কার করার সেই মেয়েটি
আর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা?
ওটার কোনো মানে হয় না।
আচ্ছা, মিস জনহাউস, আপনি তো এখানে অনেকদিন ধরে আছেন, তাই না?
হ্যাঁ, আমি বলতে পারি, আমি এখানকার পুরানো বাসিন্দা। তার মানে আমি এখনো দুবছরেরও বেশি সময় ধরে রয়েছি।
তাহলে অন্য সবার থেকে আপনি এখানকার সবচেয়ে পুরানো।
আমি তা বলতে পারি।
সিলিয়া অস্টিনের মৃত্যুর ব্যাপারে আপনার নিজের কি ধারণা বলবেন? ওর মোটিভ কি জানেন?
মাথা নাড়ল ভ্যালেরি। এবার সে গম্ভীর হয়ে গেলো।
না, বলল সে। ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর বলতে পারি। আমার তো মনে হয় না, এখানে কেউ সিলিয়ার মৃত্যু চায় বলে আমার জানা নেই। চমৎকার মেয়ে ছিলো সে, কখনো কারোর অপকার করেনি। সবেমাত্র তার বাগদান পর্ব শেষ হয়েছিল, আর…
হ্যাঁ, আর কি? সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল ইনসপেক্টর।
আমার আশঙ্কা। সে জন্যই কি, ধীরে ধীরে বললো, সেলী, কারণ তার বাগদান হয়ে গেছে। কারণ সে সুখী হতে যাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে এমন কে পাগল আছে, যে তার মৃত্যু কামনা করতে পারে?
কথাগুলো বলতে গিয়ে তার গলা কেঁপে উঠল। তার দিকে চিন্তিত ভাবে তাকালো শার্প।
হা, বললো সে, পাগলামোর ব্যাপারটা আমরা একদম উড়িয়ে দিতে পারি না। বলে চলে সে, এলিজাবেথ জনস্টনের নোট আর কাগজ নষ্ট হওয়ার প্রসঙ্গে আপনার কোনো মতামত আছে?
না। ওটা আক্রোশের ব্যাপার। আমার মনে হয় না, সিলিয়া একাজ করতে পারে।
কে করতে পারে, কোনো ধারণা আছে?
ঠিক আছে বলছি, হয়তো আমার অনুমান ভুল হতে পারে, তবে আমার যতদূর মনে হয়, একাজ প্যাট্রিসিয়া লেনের।
তাই বুঝি! মিস্ জনহাউস, আপনি তো আমাকে চমকে দিলেন। আমি জানতাম প্যাট্রিসিয়া লেন খুব অমায়িক মহিলা।
আমি বলছি না, একাজ সে করেছে। তবে আমার এ অনুমান মাত্র।
কারণটা কি জানতে পারি?
ব্ল্যাক বেককে পছন্দ করে না প্যাট্রিসিয়া। ওদিকে ব্ল্যাক বেক প্যাট্রিসিয়ার প্রেমিককে সবসময় তিরস্কার করে থাকে।
তার মানে আপনি কি মনে করেন, নিজেদের থেকে প্যাট্রিসিয়ারই এমন জঘন্য কাজ করার সম্ভাবনা বেশি?
ওহো, নিশ্চয়ই। আমার তো মনে হয় না নিজেল এ নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে। তাছাড়া সে তার নিজস্ব ব্র্যান্ডের কালি নিশ্চয়ই ব্যবহার করতে যাবে না। তার স্নায়ুকোষগুলো খুবই তীক্ষ্ণ। কিন্তু প্যাট্রিসিয়াও এরকম বোকার মতো কাজ করবে না, যাতে নিজেল জড়িয়ে পড়তে পারে, সে কি একথা না ভেবে কাজটা করেছে?
কিংবা এমনো হতে পারে অন্য কেউ সে কাজটা করে নিজেল চ্যাপম্যানকে জড়াতে চেয়েছে?
হ্যাঁ, এ আর এক সম্ভাবনা বটে।
নিজেল চ্যাপম্যানকে কে কে অপছন্দ করে?
জিন টমকিনসন। সে আর লেন বেটসন অনেক সময় ভালো কাজও কাট-ছাঁট করে দেয়।
আচ্ছা মিস জনহাউস, সিলিয়া অস্টিনের কাছে মরফিয়া কি করে এলো, আপনার কোনো ধারণা আছে?
আমি ভাবছি, কেবল ভাবছি। অবশ্য আমার মনে হয় কফির মাধ্যমেই একমাত্র উপায়। সিলিয়া সবসময় ঠান্ডা পান করত, তার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হতো। সেদিনও সে অপেক্ষা করেছিল, তার পাশে ছোট একটা টেবিলের উপর কফির পেয়ালা রেখে দিয়ে। আমার ধারণা কেউ হয়তো তার কফির পেয়ালায় একটা ট্যাবলেট কিংবা ঐ রকম কিছু ফেলে দিয়ে থাকবে। কিন্তু তাতে অনেক ঝুঁকি থাকতে পারে। কারোর না কারোর চোখে পড়ারই কথা। এ এমনি একটা কাজ যা সহজেই চোখে পড়ার মতন।
মরফিয়া কিন্তু ট্যাবলেটের আকারে হয় না। বললো ইনসপেক্টর শার্প।
তাহলে কি রকম? পাউডার?
হা।
ভ্র কোঁচকালো ভ্যালেরি।
তাহলে তো আরো কঠিন ব্যাপার তাই না?
কফি ছাড়া অন্য আর কিছু ভাবতে পারেন?
শুতে যাওয়ার আগ সে মাঝে মাঝে একগ্লাস দুধ খেতো, তবে আমার মনে হয় না, সেদিন সে দুধ খেয়েছিল।
সেদিন সন্ধ্যায় কমনরুমে ঠিক কি ঘটেছিল বলতে পারেন?
হ্যাঁ, কেন পারব না? আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। আমরা সবাই বসে গল্প করছিলাম। বেশিরভাগ ছেলে তখন বাইরে ছিল। একটু আগেই সিলিয়া শুতে চলে গিয়েছিল, এবং জিন টমকিনসনও! সেলী আর আমি অনেকক্ষণ বসেছিলাম সেখানে। আমি চিঠি লিখছিলাম, আর সেলী কতকগুলো নোটের ওপর চোখ বুলাচ্ছিল। আমার যতদূর মনে পরে, আমিই কেবল। সবার শেষে শুতে যাই।
তার মানে অন্য দিনের মতো সেই সন্ধ্যাটাও স্বাভাবিক ছিলো। ঘটনা তাই না।
সম্পূর্ণভাবে ইনসপেক্টর।
ধন্যবাদ মিস জনহাউস। আপনি এখন যেতে পারেন। তবে এখন মিস লেনকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন।
প্যাট্রিসিয়া লেনকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল। তবে আশঙ্কাজনক কিছু নয়। প্রশ্নোত্তরের মধ্যে তেমন নতুনত্ব কিছু প্রকাশ পেল না। এলিজাবেথ জনস্টনের রিসার্চের কাগজপত্র নষ্ট হওয়ার প্রসঙ্গে প্যাট্রিসিয়া অভিযোগ করল সিলিয়াকে সরাসরি।
কিন্তু মিস লেন সেটা প্রচণ্ডভাবে অস্বীকার করেছিল।
হতে পারে লজ্জায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল সে। কিন্তু অন্য আরো সব ঘটনার সঙ্গে এটা কি মিলে যায় না?
জানেন, এই কেসটার ব্যাপারে আমি কি দেখতে পেয়েছি মিস লেন? কোনো মিলই আমি খুঁজে পাইনি।
আমার ধারণা, প্যাট্রিসিয়া বলে, তাহলে আপনি কি মনে করেন, বেক-এর কাগজ নষ্ট করার মূলে নিজেই? কারণ সেই সবুজ কালি ব্যবহার করে, তাইতো? কিন্তু নিজের কালি নিজে ব্যবহার করার মতো আহাম্মক নয় সে। সে যাহোক, আমি আপনাকে আবার বলছি সে এ কাজ করতে পারে না।
মিস জনস্টনের সঙ্গে তার সম্পর্ক সব সময় ভালো ছিল কি?
হ্যাঁ, এক এক সময় তার স্বভাব অত্যন্ত বিরক্তিকর বলে মনে হয়। কিন্তু সত্যি সে কিছু মনে করে না। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লো প্যাট্রিসিয়া লেন। দু-একটা জিনিস আপনাকে বোঝাবার চেষ্টা করব বুঝতেই পারছেন ইনসপেক্টর, আমি নিজেল চ্যাপম্যানের সম্বন্ধে বলছি। সে ইচ্ছা করেই তার শক্রবৃদ্ধি করেছে। আজ আমি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি সে ভীষণ কঠিন স্বভাবের লোক ছিল। এর ফলে অনেকেই তার বিরুদ্ধে ছিল। তাছাড়া সে সব সময় ঠাট্টাইয়ার্কি করত। কিন্তু এসব ঠাট্টাইয়ার্কি এমন বীভৎস পর্যায়ে চলে যেত যে লোকে তখন তাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। কিন্তু বাস্তবে সে ছিল অসুখী। কিন্তু তার বাইরের কঠিন দিকটা লোকে দেখে তার ভেতরের কোমল ও দুর্বল দিকটার কথা কেউ ভেবেও দেখে না। কিন্তু জানেন ইনসপেক্টর আমি দেখেছি, তার জন্য মনে মনে খুব কষ্টও পাই
আহ, বললো ইনসপেক্টর। এটা তাদের পক্ষে দুর্ভাগ্যও বটে।
হ্যাঁ। কিন্তু কি জানেন ইনসপেক্টর, সত্যি তারা সাহায্য করতে পারে না। একেবারে ছেলেবেলা থেকে দুর্ভাগ্য তার সাথী হয়ে গেছে। নিজেদের বাড়ির জীবন খুবই অসুখী। তার বাবা খুবই নিষ্ঠুর ছিলেন। নিজেকে বুঝতে চাইতেন না। আর তার বাবা তার মার সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করেন। ছেলেবেলাতেই তার মা মারা যান। তারপর একদিন নিজেল তার বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে, অজানা পথে। তার বাবা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, নিজেলকে সে এক পেনিও দেবে না। তার তোয়াক্কা করে না নিলে। তার স্বাস্থ্যও ভালো নয়, তার মনটা চমৎকার। এখানে এসে থামল প্যাট্রিসিয়া। দীর্ঘ সময় ধরে এক নাগাড়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য হাঁপিয়ে উঠেছিল সে।
ইনসপেক্টর শার্প চিন্তিত হয়ে তার দিকে তাকাল। বহু প্যাট্রিসিয়া লেনদের দেখেছে সে, কিন্তু প্রেমিকদের এমন গভীর প্রেমের কথা সে এর আগে কখনো শোনেননি। অবাক হয়ে শার্প ভাবে, আচ্ছা সিলিয়া অস্টিনের প্রতি নিজেল চ্যাপম্যান আকর্ষণ বোধ করেনি তো। সেটা সম্ভব নয়, আবার একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর তাই যদি হয়, ভাবলো সে, প্যাট্রিসিয়া লেন নিশ্চয়ই ক্ষুব্ধ হয়ে থাকবে। আর এমনি ক্ষুব্ধ হয় যে, সিলিয়াকে আঘাত করার কথাও তার মনে হয়ে থাকবে। তার সেই ক্ষোভ, বিরক্তি এমনি চরমে উঠে থাকবে যে, শেষ পর্যন্ত সেকি সিলিয়াকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে? যে কারণেই হোক, নিশ্চয়ই নয়। কারণ কলিন ম্যাকনারের সঙ্গেই তার বাগদানের খবরটা শোনার পর অবশ্যই তাকে খুন করার মোটিভ বলতে আর কিছু থাকার কথা নয়। তাই ইনসপেক্টর শার্প তার সন্দেহের তালিকা থেকে প্যাট্রিসিয়া লেনকে বাদ দিয়ে এবার জিন টমকিনসনের খোঁজ করল।
.
০৮.
মিস টমকিনসনকে দেখতে কঠোর প্রকৃতির যুবতীর মতো, বয়স সাতাশ, শার্পের সামনে বসে সে প্রথমে বললো, হ্যাঁ, ইনসপেক্টর, বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি?
মিস টমকিনসন, আমার মনে হয় না, এই বিয়োগান্ত ঘটনার ব্যাপারে আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারবেন।
সত্যি এটা খুবই বেদনাদায়ক ঘটনা। প্রথমে মনে হয়েছিল, নেহাতই আত্মহত্যা করার ঘটনা, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা একটা খুনের ঘটনা–এখানে সে নীরবে মাথা নাড়ল।
আমরা মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে গেছি, সিলিয়া কখনোই নিজে বিষ খেতে পারে না, শার্প বলল। সেই বিষ কোথাথেকে আসতে পারে আপনি জানেন?
মাথা নাড়ল জিন। জেনেছি সেন্ট ক্যাথেরিন হাসপাতাল থেকে, সেখানে সে কাজ করত। কিন্তু আত্মহত্যার ঘটনা বলেও তো মনে হতে পারে। কিন্তু সিলিয়া ছাড়া কে সেই বিষ জোগাড় করতে পারে?
অনেকেই, বললো ইনসপেক্টর শার্প, অবশ্য তারা যদি তাকে খুন করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে থাকে। এমনকি আপনি নিজেও মিস টমকিনসন।
সত্যিই ইনসপেক্টর শার্প! জিনের কথায় ঘৃণা প্রকাশ পাচ্ছিল।
ভালো কথা, মিস টমকিনসন, আপনি প্রায়ই তো ডিসপেনসারিতে যান, যান না?
হ্যাঁ যাই। সেখানে মিলড্রেড ক্যারির সঙ্গে দেখা করতে চাই। কিন্তু কখনোই বিষের কাপবোর্ডে হাত দেওয়ার স্বপ্নও আমি দেখিনি।
কিন্তু বাস্তবে আপনি সেটা করলেও করতে পারেন।
না অবশ্যই সেরকম আমি কিছু করতে পারি না।
হ্যাঁ, আমি বলছি আপনি পারেন। তাহলে শুনুন মিস টমকিনসন, মনে করুন আপনার বন্ধুটি কাজে ব্যস্ত ছিলো। বাইরের রোগীদের দেখার জন্য একটি মেয়ে ডিসপেনসারি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। অপর দুজন ডিসপেনসার তখন ঘরের সামনের দিকে ছিল। আর আপনি তখন ঘুরতে ঘুরতে বিষের কাপবোর্ডের সামনে যান আর মরফিয়ার একটা বোতল পকেটে ঢুকিয়ে দেন। সেই দুজন ডিসপেনসার যা ভাবতে পারে না, আপনি তাই করলেন।
ইনসপেক্টর, আপনার কথাগুলি আমার রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে এ এক বাজে অভিযোগ।
কিন্তু এটা অভিযোগ নয়। সেরকম কিছুই নয়। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনি বলছেন, এ কাজ আপনার দ্বারা সম্ভব নয়, আর আমি বলছি, হ্যাঁ সম্ভব। তা বলে আমি কখনো বলছি না যে আপনি সেটা করেছেন। আর কেনই বা করতেন তা বলুন?
ঠিক তাই। ইনসপেক্টর শার্প আপনি কেন বুঝতে পারছেন না, সিলিয়া আমার বন্ধু ছিল।
এমন বহু ঘটনা আছে যে বন্ধুরাই তাদের বিষ খাইয়ে হত্যা করেছে। এক এক সময় এমন কতগুলো প্রশ্ন থাকে আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করে থাকি। বন্ধু তখন আর বন্ধু থাকে না। বুঝলেন?
কিন্তু, আমার আর সিলিয়ার মধ্যে তো কোনো মতপার্থক্য ছিল না।
হস্টেলে কয়েকটা জিনিস চুরির ব্যাপারে আপনি তাকে সন্দেহ করতেন?
না, কখনো নয়। আমি সবসময় সিলিয়াকে উচ্চ আদর্শের মেয়ে বলে ভাবতাম। স্বপ্নেও ভাবিনি, সে এ কাজ করতে পারে।
অবশ্যই, সতর্কতার সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে শার্প বললো, সত্যিই ক্লিপ্টোম্যানিয়াকরা কখনোই নিজেদের সাহায্য করতে পারে না, পারে তারা?
আমি বলতে পারি না। এরকম ধারণা সহজেই আমি সমর্থন করতে পারি। পারে?
না, নিজেলের কাজ নয়। আমার মনে হয় মিঃ অ্যাকিমবো করতে পারে, তার সম্ভাবনাই বেশি।
সত্যি? এ কাজ কেনই বা সে করতে গেল?
বিদ্বেষ। এসব কালো চামড়ার মানুষরা পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হয়।
এটা খুব আগ্রহের ব্যাপার মিস টমকিনসন। এখন বলুন আপনি শেষ কখন মিস সিলিয়াকে দেখেছিলেন?
শুক্রবার রাতে নৈশভোজের পর।
মিস অস্টিনের কফির পেয়ালায় কে মরফিন মেশাতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই।
আচ্ছা, এই বাড়ির কোথাও বা কোনো ঘরে মরফিয়া থাকতে দেখেননি?
না, না, আমার তো মনে হয় না।
আপনি সেরকম মনে করেন না বলতে কি বোঝাতে চাইছেন মিস টমকিনসন?
তাহলে বলি শুনুন, আমি আজও অবাক হই সেই বাজে বাজী ধরার কথায়।
কিসের বাজী?
ওঃ একদিন দু-তিনজন যুবক তর্ক করছিল খুনের ব্যাপারে। কিভাবে খুন করা হয়, বিশেষ করে বিষ খাইয়ে।
তা এ সব আলোচনায় কারা ছিল বলতে পারেন?
কেন বলতে পারব না। আমার মনে হয়, প্রশ্নটা প্রথমে সিলিয়া আর নিজেল তোলে। তারপর লেন বেটসন আসে। প্যাট্রিসিয়াও সেখানে ছিল।
আপনার মনে আছে, এই আলোচনায় কে কি বলেছিল আর তর্কই বা কি ভাবে হয়েছিল?
কয়েক মুহূর্ত ভাবল জিন টমকিনসন। তারপর বলতে লাগল–আমার মনে হয়েছে। বিষপ্রয়োগ করে কাউকে হত্যা করার ব্যাপারে প্রধান অসুবিধা হল প্রয়োজনীয় বিষ সংগ্রহ করা। আর এই বিষ সংগ্রহ করার জায়গা থেকে খুনীর সন্ধান পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে নিজেল বলে ওঠে যদি তিনটি উপায়ে বিষ সংগ্রহ করা যায় তাহলে খুনীর ধরা পড়ার সম্ভাবনা নাও থাকতে পারে, ইনসপেক্টর শার্প। আমার মনোভাব সেকেলে ধরনের। আর এও বিশ্বাস করি, চুরি তা কোনো তুচ্ছ জিনিসই হোক না কেন, তা চুরিই।
তার মানে আপনি মনে করেন। সেই জিনিসগুলো নেবার জন্যই সিলিয়া চুরি করেছিল?
অবশ্যই আমি সেটা বিশ্বাস করি।
বস্তুত অসাধুতার লক্ষ্মণ এটা, এই তো?
আমার আশঙ্কা তাই।
আহ! ইনসপেক্টর শার্প তার মাথা নেড়ে বললো, সেটা খুবই খারাপ। একটু থেমে সে আবার বলে, সে যা হোক, একজন ক্রিপ্টোম্যানিয়াককে সত্যিকারের চোর বলে ধরে নেওয়া, তারপর পুলিসকে খবর দেওয়ার কথা চিন্তা করা, তবু এসব সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, সবকিছুতেই শেষে একটা সুখের ইঙ্গিত ছিলো এই কেসেমিস অস্টিনের জীবনে বিয়ের ঘন্টা বাজতে চলেছিল।
হ্যাঁ, কলিন ম্যাকনার যা করেছে তার জন্য কেউ বিস্মিত হবে না, বললো জন টমকিনসন। জানি নিশ্চিত, সে একজন নাস্তিক, অবিশ্বাসী, উপহাসের পাত্র, অপ্রিয় যুবক। সবার সঙ্গে তার ব্যবহার খারাপ। আমার মতে সে একজন কমিউনিস্ট।
আহ! ইনসপেক্টর শার্প আবার বলে, এ খুবই খারাপ। মাথা নেড়ে সে বললো, সে যা হোক মিস অস্টিন নিজের মুখে দোষ স্বীকার করেছে।
ধরা পড়ার পর, শার্প বলে উঠলো।
তা কার কাছে ধরা পড়ল সে?
সেই মিস্টার কি যেন নাম? হ্যাঁ, মনে পড়েছে, পোয়ারো, যিনি আমাদের কাছে এসেছিলেন।
কিন্তু মিস অস্টিন যে তার কাছে ধরা পড়েছিল সে কথা আপনি ভাবছেন কেন? তিনি তো এধরনের কথা বলেননি। তিনি তো কেবল পুলিসকে খবর দিতে বলেছিলেন।
তিনি নিশ্চয়ই হাবেভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি ব্যাপারটা জানেন। সিলিয়া নিশ্চয়ই জেনে গিয়েছিল, তার খেলা শেষ। তাই সে ছুটে যায়। স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য।
তা না হয় হলো, কিন্তু এলিজাবেথের কাগজের ওপর কালি ছেটানোর ঘটনা? সেটা কি সে অস্বীকার করেছিল?
আপনার ধারণা ভুল, বললো শার্প। এ অভিযোগ তীব্রভাবে অস্বীকার করেছিল সে। আর এ ব্যাপারে তার কোনো হাতই ছিল না। এখন আপনি কি বলবেন, জিজ্ঞাসা করলো শার্প।
এ কাজ নিজেল চ্যাপম্যান করতে পারে। লেন বেটসন তখন তাকে জিজ্ঞেসা করে, তার মাথার ঠিক আছে তো? নিজেল বলে, হ্যাঁ সজ্ঞানেই সে কথা বলছে। প্যাট তাকে সমর্থন করে বলে নিজেল ঠিকই বলেছে। সম্ভবতঃ লেন বা কলিন মনে করল যে কোনো হাসপাতাল থেকে বিষ সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে পারে তারা।–নিজেল বাধা দিয়ে বলেছিল–আদৌ সে নিজেদের সম্পর্কে কথা বলেনি। আসলে সে বলতে চাইছিল, ডিসপেনসারি থেকে সিলিয়া যদি কিছু নিয়ে আসে তাহলে তা কারো না কারো নজরে পড়বেই। তখন প্যাট বলে, না তা : হতে পারে না। ধরা যাক সিলিয়া মরফিয়া বার করে নিয়ে অন্য কোনো পাউডার ভর্তি করে দিল সেই বোতলে। হাসল কলিন, তারপর সে বললো, তাতে রোগীদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় ও প্রচুর অভিযোগ আসতে পারে। নিজেল বলে, আমি অবশ্য বিশেষ সুযোগের কথা বলছি না, নিজেল আরো বলে, ডাক্তার বা ডিসপেনসারের খেতাব যদিও তার নেই, কিন্তু তিনটে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে অনায়াসে সে বিষের বোতল হাতাতে পারে। তখন লেন বেটসন জানতে চায়, ঠিক আছে, তোমার বক্তব্য আমি শুনলাম। এখন সেই তিনটি উপদেশের ব্যাখ্যা করে দেখাও তো। নিজেল বলে, এখন আমি তোমাকে বলবো না, তবে তিন সপ্তাহের মধ্যে আমি তোমার বাজী ধরার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। তখন আমি তিন ধরনের ভয়ঙ্কর বিষের নমুনা তুলে ধরব তোমাদের সামনে। আর লেন বেটসন তখন বলে, সে যদি জয়ী হয়ে ফিরতে পারে, তাহলে সে তখন পাঁচগুণ বেশি অর্থ দেবে।
ভালো কথা, আমি মনে করি এর থেকে বেশি ভালো আর কিছু আশা করা যায় না। নিজেল বলে, তাহলে ব্যস, এখন দেখো আমার কথামতোই আমিও লোকটা ভালো। এই বলে সে টেবিলের উপর তিনটি জিনিস ছুঁড়ে দিল। আর সেই তিনটি জিনিস যথাক্রমে : হিসিন ট্যাবলেট, টিনচার ডিজিটালিসের বোতল ওমরফিন টারট্রেটের বোতল।
সঙ্গে সঙ্গে ইনসপেক্টর শার্প বলল : মরফিন টারট্রেট? বোতলের ওপর কোনো কোবেল ছিল না?
হা সেন্ট ক্যাথেরিন হাসপাতালের লেবেল।
আর অন্যগুলোয়?
আমি লক্ষ্য করিনি। তবে বলতে পারি, ওগুলো হাসপাতালের ছিল না।
তারপর কি ঘটলো?
তারপর অনেক কথা, অনেক তর্ক চললো তাদের মধ্যে। লেন বেটসন বলে : এখন তুমি যদি খুন করো, ধরা পড়ে যাবে। উত্তরে নিজেল বলে, একদমই নয়। আমি অতি সাধারণ লোক। ক্লিনিক বা হাসপাতালের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। তাই কেউ আমার টিকিও স্পর্শ করতে পারবে না, আর ওগুলো কোনো ফার্মেসির কাউন্টার থেকেও কিনিনি।
কলিন ম্যাকনার বলে, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওগুলো তুমি কোনো কেমিস্ট-এর কাছ থেকেও কিনতে পার না, শেষে অনেক তর্কের পর লেন বলে, আমি এর মধ্যে নেই। আমার হাতে টাকা নেই। আমি ওগুলো তার বক্তব্যের প্রমাণ রেখেছি। তারপর সে বলে, আমরা ওই ভয়ঙ্কর জিনিসগুলো নিয়ে কি করব? দাঁত বার করে হেসে নিজেল বলে, দুর্ঘটনা ঘটার আগেই ওগুলোর হাত থেকে আমাদের রেহাই পেতে হবে। তাই তারা টিউব থেকে ট্যাবলেটগুলো বার করে আগুনে ফেলে দেয়। আর মরফিন টারট্রেটের বোতল থেকে পাউডার বার করে আগুনে ফেলে দেয়। তবে টিনচার ডিজিটালিস ল্যাবেটারিতে ফেলে দেয়।
আর বোতলগুলো?
জানি না। তবে মনে হয় বোতলগুলো ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দেয়।
এ ঘটনা কবেকার?
মনে হয় ঠিক এক পক্ষকাল আগে।
তাই বুঝি। ধন্যবাদ মিস টমকিনসন।
জিন চলে যাওয়ার পর শার্প কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। তারপর নিজেল চ্যাপম্যানকে ডেকে পাঠায়।
নিজেল ঘরে ঢুকতেই সে বলে ওঠে, এইমাত্র মিস টমকিনসনের কাছ থেকে একটা জরুরী তথ্য পেলাম মিঃ চ্যাপম্যান।
ওঃ। তা সে আমার বিরুদ্ধে কিভাবে আপনার মনটাকে বিষাক্ত করে তোলে?
বিষের প্রসঙ্গে আলোচনা করছিল সে। আর তা আপনাকে কেন্দ্র করে।
বিষের ব্যাপারে আমাকে কেন্দ্র করে? কেন কি ব্যাপার?
যেভাবেই হোক আপনি কয়েকটা মারাত্মক বিষ সংগ্রহ করেন। কিন্তু কেউ তার হদিশ পায় না–এ ব্যাপারে কয়েকদিন আগে মিঃ বেটসনের সঙ্গে আপনি বাজী ধরেছিলেন, তা আপনি অস্বীকার করতে পারেন?
ওহো, একথা? হঠাৎ নিজেলের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
হা। অবশ্যই। আশ্চর্য, আমি ভাবতেও পারিনি জিন সেখানে উপস্থিত থাকতে পারে।
আড়াল থেকে শুনলে কেউ জানতেও পারে না। সেকথা থাক, এখন আপনি বলুন, ঘটনাটা আপনি স্বীকার করে নিচ্ছেন তো?
ওহো, হা। আমরা এবিষয়ে আলোচনা করেছিলাম বৈকি। আমাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল, কাউকে না জানিয়ে, কিংবা সবার অলক্ষ্যে বিষ সংগ্রহ করা যায় কিনা। কলিন আর লেনের ধারণা ছিল, সেটা অসম্ভব। কেউ না কেউ জানতে পারবে। তখন আমি তাদের প্রমাণ করে দেখিয়ে দিই, উদ্ভাবনী দক্ষতা দিয়ে সবার অজান্তে অবশ্যই বিষ সংগ্রহ করা যায়।
তারপর আপনি বিষ সংগ্রহ করে তিনটি উপায়ের কথা ওদের বলেন, সেগুলো কি কি জানতে পারি কি মিঃ চ্যাপম্যান?
নিজেকে অপরাধী করার জন্য জিজ্ঞাসা করছেন না তো? বললো নিজেল, নিশ্চয়ই আমাকে হুমকি দিচ্ছেন।
আপনাকে হুমকি বা সতর্ক করার সময় এখনো আসেনি মিঃ চ্যাপম্যান। তবে নিজেকে দোষী মনে করার কোনো কারণ নেই। সত্যি বলতে কি অনায়াসে আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অস্বীকার করতে পারতেন
জানি না, আমি অস্বীকার করতে চাই কি? কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবল নিজেল, তার ঠোঁটে সামান্য হাসিও দেখা গেল। অবশ্যই। তারপর অকপটে সে স্বীকার করল, আমি যা করেছি অবশ্যই আইন-বিরুদ্ধ কাজ, এর জন্য আপনি আমার কাছ থেকে কৈফিয়ৎ চাইতে পারেন। আর সিলিয়ার মৃত্যু একটা খুনের কেস। এ ঘটনার সঙ্গে যদি কোনো সম্পর্ক থাকে, তাহলে আমার মনে হয় আপনাকে সব খুলে বলা উচিত।
এ খুবই বিচক্ষণতার পরিচয়।
ঠিক আছে, আমি বলছি।
সেই উপায় তিনটি কি কি?
নিজেল তার চেয়ারে আরাম করে বসে বলতে শুরু করল। প্রত্যেকেই সব সময় কাগজ পড়ে তাই না? তাহলে কোনো দিন কাগজে খবর থাকে, কোনো ডাক্তারের গাড়ি থেকে মারাত্মক ধরনের ড্রাগ খোয়া গেছে। এ সম্পর্কে জনসাধারণকে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি
হ্যাঁ।
ভালো কথা। এর থেকে একটা অতি সহজ উপায় আমার মাথায় আসে। মফঃস্বলের দিকে কোনো ডাক্তারের অনুসরণ করা–তারপর সুযোগ মতো সেই ডাক্তারের গাড়ি খোলা, ডাক্তারের অ্যাটাচিকেস খুলে দেখা, তারপর আপনার প্রয়োজন মতো বিষাক্ত ড্রাগ বার করে নেওয়া। জানেন ডাক্তাররা মফঃস্বলে রোগী দেখতে গেলে অনেকরকম ড্রাগ নিয়ে যায়। কারণ কোনো রোগীর কোনো ড্রাগের প্রয়োজন হয় এ ভেবে তারা সব রকম ড্রাগ মজুত রাখে। এ হল একনম্বর উপায়। এভাবে তিনতিনটি ডাক্তারকে অনুসরণ করার পর আমার প্রয়োজনীয় বিষ, হিসিন হাইড্রোব্রোমাইডের সন্ধান পাই।
ওঃ! দু নম্বর উপায়টা কি শুনি?
ওহো! সেটা খুব একটা দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। সিলিয়াকে একটু পাম্প দিয়েই কাজটা হাসিল করি। আমি আপনাকে আগেই বলেছি মেয়েটি সরল ও বোকা। তাই সে বুঝতেই পারেনি তাকে দিয়ে আমি কি করাতে যাচ্ছি। তাকে আমি বলি ডাক্তারদের হিজিবিজি হাতের লেখার কথা, আমি তাকে বলি ডাক্তারদের মতো হিজিবিজি করে আমার জন্য টিনচার ডিজিটালিসের একটা প্রেসক্রিপশন লিখে দিতে। সে কোনো সন্দেহ না করেই লিখে দেয়। তারপর আমি ক্লাসিফারে ডঃ ডাইরেক্টরি দেখে লন্ডনের বহুদূরের ডিস্ট্রিক্ট-এর একজন ডাক্তারের নাম দেখে একটা সই করে দিই। বলতে পারেন বেআইনী সই। তারপর লন্ডনের সবচেয়ে ব্যস্ত দোকান থেকে তা সংগ্রহ করি। মফঃস্বলের সেই ডাক্তার সম্বন্ধে তারা হয়তো বেশি পরিচিত ছিলো না।
হ্যাঁ, এটা অত্যন্ত উদ্ভাবনী দক্ষতার পরিচয়, শুকনো গলায় বললো শার্প। আপনার কথা শুনেই আমি বুঝতে পারছি আমি নিজেকে অভিযুক্ত করলাম। আর তৃতীয় উপায়টা কি জানতে পারি?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না নিজেল। অনেকক্ষণ পরে মুখ খুললো : দেখুন উপায়টা কি ভাবে বর্ণনা দেব বুঝতে পারছি না!
গাড়ির দজা খুলে ড্রাগ চুরি করা, বললো ইনসপেক্টর শার্প। প্রেসক্রিপশন নকল করে।
না, এটা প্রেসক্রিপশন নকল করা নয়। বাধা দিয়ে বললো নিজেল, তখন আমার কাছে যথেষ্ট টাকা ছিল না। তাই এবার ডাক্তারের সই নকল করা নয়। এবার সম্পূর্ণ নতুন এক পন্থায় কাজ করতে হবে।
তা সেটা কি মিঃ চ্যাপম্যান? হঠাৎ আবেগ বিজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলো নিজেল, খুন আমি পছন্দ করি না। একাজ জানোয়ারসুলভ, ভয়ঙ্কর। বেচারী সিলিয়া খুন হওয়া তার প্রাপ্য নয়। বরং আমি তাকে সাহায্য করতে চাই। কিন্তু তাতে কি তার কোনো সাহায্য হল। আমি তো তার কোনো লক্ষণ দেখতে চাই না। মানে, আমি আপনাকে আমার দোষ বা ত্রুটির কথা বলছি।
দেখুন মিঃ চ্যাপম্যান, পুলিসের সহৃদয়তা আছে। তারা সব দিক দিয়ে ভালো ভাবে বিচার-বিবেচনা করে তবেই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে থাকে। আপনি যে এই মেয়েটির খুনের একটা সমাধান করতে চাইছেন, আপনার এই আশ্বাসবাণী আমি অবশ্যই বিশ্বাস করি। এখন আপনি দয়া করে সেই তৃতীয় উদ্ভাবনী দক্ষতার কথাটা বলুন।
ঠিক আছে, নিজেল বললো, আমরা সেটার প্রায় শেষ প্রান্তে এসে গেছি। আগের দুটোর থেকে এটার ঝুঁকি বেশি ছিল। তবে এক সঙ্গে একটা মজার ব্যাপারও ছিল। দেখুন সিলিয়ার ডিসপেনসারিতে মাত্র একবার কি দুবার আমি যাই। সেখানকার সব আঁটঘাঁট আমার জানা ছিল!
তার মানে আপনি কাপবোর্ড থেকে বোতলটা চুরি করেন?
না, না অত সহজ ছিল না। তাছাড়া ওটা ভালো দেখায় না। তাছাড়া যদি কেউ দেখে ফেলে তো আমাকে ধরে ফেলবে। যদিও কাউকে খুন করার মোটিভ নিয়ে আমি সেখানে যাইনি। আসলে ছয় মাস আগে সিলিয়ার ডিসপেনসারিতে যাই। আমি জানতাম, রোজ এগারোটা পনেরোতে সে ও আরো দুটো মেয়ে পিছনের ঘরে চলে যায় টিফিন করতে। আর একটি মেয়ে ছিল, সে ছিল নতুন। আমাকে চিনত না। সে তখন বাইরে রুগী দেখছিল। আমি তখন ডিসপেনসারিতে ঢুকে পড়ি। পরণে সাদা কোট আর গলায় স্টেথোস্কোপ। আমি সিজেনবিষের কাপবোর্ডের কাছে যাই। একটা বোতল বের করে একেবারে শেষ প্রান্তে পার্টিসনের কাছে চলে যাই। সেখান থেকে পিছন ফিরে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করি, তুমি আমাকে কয়েকটা ভেগানিন ট্যাবলেট দিতে পারো? ভীষণ মাথা ধরেছে। মেয়েটি ভেগানিন ট্যাবলেট হাতে নিয়ে এসে আমার কাছে দাঁড়ায়, পিছন ফিরেই ট্যাবলেটগুলো আমি তার হাত থেকে নিই এবং গলাধঃকরণ করে ফেলি তার সামনেই। তার কখনো সন্দেহই হলো না, আমি সেখানকার কোনো ডাক্তার কিংবা মেডিক্যাল ছাত্র নই এ যেন এক শিশুসুলভ খেলা। এমনকি সিলিয়াও জানতে পারল না, আমি সেখানে গিয়েছিলাম, অথচ কাজ আমার হাসিল হয়ে গেলো।
সেই স্টেথোস্কোপটা, কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো ইনসপেক্টর শার্প, আপনি পেলেন কোথা থেকে?
হঠাৎ দাঁত বার করে হাসলো নিজেল, সেটা ছিলো লেন বেটসনের, বললো সে, আমি সেটা চুরি করেছিলাম।
এর থেকে বোঝা গেলো সিলিয়া সেটা চুরি করেনি।
হা তারপরেই একদিন সন্ধ্যায় আমি তাদের সঙ্গে মিলিত হই এবং সেই তিন-তিনটি বিষ তাদের সামনে মেলে ধরি।
তার মানে কাউকে বিষপ্রয়োগ করার জন্য তিনটি ভিন্ন ধরনের বিষ সংগ্রহের জন্য আপনাকে তিন-তিনটি উপায় বার করতে হয়েছিল, ইনসপেক্টর বলে উঠলো, আপনি তাই বলতে চাইছেন?
মাথা নাড়ল নিজেল।
যথেষ্ট ভালো পথগুলো, বললো সে, তবে এটা ঠিক মেনে নেওয়া যায় না অন্তত বর্তমান পরিস্থিতিতে, তবে কথা হচ্ছে সে সব বিষগুলোই নষ্ট করে ফেলা হয় আজ থেকে দিন পনেরো কিংবা তারও কিছুদিন আগে হবে হয়তো। হ্যাঁ আপনি যেটা চিন্তা করছেন মিঃ চ্যাপমান, কিন্তু সত্যি সেটা নাও হতে পারে।
স্থির চোখে তার দিকে তাকালো নিজেল, আপনি কি বলতে চাইছেন?
এই বিষগুলো আপনার কাছেই ছিলো, কতদিন ধরে?
চিন্তা করলো নিজেল।
তা প্রায় দশদিন। মরফিন টারট্রেট প্রায় বারদিন। আর টিনচার ডিজিটালিন সেই দিনই বিকেলে পেয়েছিলাম।
আর সেগুলো কোথায় আপনি রেখেছিলেন? মানে সেই হিসিন হাইড্রোব্রোমাইড আর মরফিন টারট্রেট।
আমার আলমারির ড্রয়ারে।
ওগুলো যে সেখানে ছিলো অন্য কেউ জানতো?
না, না, আমি এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত, তা কেউ জানতো না, বললো সে, তবে তার কথার মধ্যে একটু ইতস্ততঃ ভাব লক্ষ্য করলো ইনসপেক্টর শার্প। তবে ঠিক তখনি এ বিষয়ে চাপ দিতে চাইলো না।
আপনি কি করতে যাচ্ছেন, কাউকে সে কথা বলেছিলেন, মানে আপনার সেই উপায়গুলোর কথা? যেভাবে আপনি সেই বিষগুলো সংগ্রহ করেছিলেন?
না অন্তত নয়, আমি বলিনি।
আপনি অন্তত বলছেন কেন মিঃ চ্যাপম্যান?
আসলে আমি বলিইনি, সত্যিকথা বলতে কি জানেন, আমি প্যাটকেই কেবল বলতে যাচ্ছিলাম–ডাক্তারের গাড়ি থেকে, প্রেসক্রিপশন নকল করে কিংবা হাসপাতাল থেকে মরফিয়া চুরি করবার কথা। কিন্তু পরক্ষণেই আবার পিছিয়ে যাই আমি এই ভেবে যে, সে হয়তো মেনে নেবে না। খুব কঠোর প্রকৃতির সে। তাই
তার মানে আপনি তাকে এমন কিছুই বলেননি?
হা বলেছিলাম, পরে তবে গাড়ি থেকে বিষ চুরির কথা তার কাছে চেপে যাই, ভাবলাম, আমার সম্পর্কে তার একটা খুব খারাপ ধারণা হয়ে যেতে পারে।
বাজী জেতার পর আপনি যে সেই বিষগুলো নষ্ট করতে যাচ্ছেন, বলেছিলেন তাকে?
হ্যাঁ, তাকে খুব চিন্তিত বলে মনে হয়েছিল, তবে কোনো ক্ষতি হয়নি।
মিঃ চ্যাপম্যান আপনি বলেছেন বটে, কিন্তু ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
কি করে তা সম্ভব, আমি তো বলেছি, সেগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।
মিঃ চ্যাপম্যান আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, সেগুলো আপনি যেখানে রেখেছিলেন, কেউ হয়ত দেখে থাকবে। পরে সম্ভবত মরফিয়ার বোতল খালি করে অন্য কোনো পাউডার রেখে থাকতে পারে।
হায় ঈশ্বর! তার দিকে স্থির চোখে তাকালো নিজেল, একথা আমি তো আগে কখনো ভাবিনি। বিশ্বাসও করি না।
কিন্তু মিঃ চ্যাপম্যান, সম্ভাবনা থেকেই যায়। ইনসপেক্টর শার্প এবার জিজ্ঞেস করলো, ছাত্রদের মধ্যে সাধারণত আপনার ঘরে কার যাতায়াত বেশি?
লেন বেটসন আমার রুমপার্টনার, তাছাড়া বেশিরভাগ ছেলে আমার ঘরে মাঝে মধ্যে এসে থাকে। অবশ্য কোনো মেয়ে আসে না। পুরুষদের শয়নকক্ষে তাদের আসতে মানা আছে। পবিত্রতা রক্ষা করার জন্যই বটে।
হয়তো তাদের আসতে নিষেধ আছে, কিন্তু আমার ধারণা গোপনে তারা তো আসতে পারে। যেমন ধরুন মিস লেন, কখনো আপনার ঘরে এসেছে?
ইনসপেক্টর আপনি যে সুরে কথা বলেছেন আশা করি আপনি সেরকম কোনো অর্থ করছেন না। হ্যাঁ প্যাট আমার ঘরে মাঝে মাঝে আসে, আমার জন্য ও একটা উলের মোজা, বুনছে, আমার পায়ের মাপ নেওয়ার জন্য তার আসা। এর বেশি কিছুই নয়।
মিঃ চ্যাপম্যান আপনার বোঝা উচিত যে লোকটি খুব সহজেই বোতল থেকে মরফিয়া বদল করে অন্য কোনো পাউডার রেখেছিল সে আর কেউ নয়, আপনারই লোক সে।
তার দিকে তাকালো নিজেল, হয়তো তার মুখটা কঠিন এবং কৃশ হয়ে উঠলো।
হ্যাঁ, বললো সে, মাত্র এক কি দেড় মিনিট আগে আমি তা দেখেছি। আমি ঠিক সেটাই করতে পারতাম, কিন্তু বিশ্বাস করুন ইনসপেক্টর, মেয়েটিকে পৃথিবী থেকে সরানোর কোনো কারণই আমার নেই। আমি তা করিওনি। তবু এর পরে একটা কিন্তু থেকে যায়, তাই না? যাহোক আমি বুঝতে পারছি এর জন্য আপনি আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন।
.
০৯.
বাজী ধরা এবং বিষ নষ্ট করে ফেলার কাহিনী লেন বেটসন, কলিন ম্যাকনার দুজনেই সমর্থন করলো। কলিন ম্যাকনারকে রেখে দিলো শার্প। অন্য দুজন চলে গেলো।
আপনাকে আমি আর দুঃখ দিতে চাই না মিঃ ম্যাকনার, বললো ইনসপেক্টর শাপ। আমি বুঝতে পারি বাগদানের রাত্রেই আপনার প্রেমিকার বিষপ্রয়োগে খুন হওয়াটা আপনার কাছে কত বেদনাদায়ক।
আমার দুঃখের জন্য আপনাকে অহেতুক চিন্তা করতে হবে না, বরং আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, যার উত্তর কাজে লাগাতে পারে বলে আপনি মনে করেন, করতে পারেন মিঃ শাপ।
সিলিয়া অস্টিনের ব্যবহারে মনস্তত্ত্বের ছাপ আছে, এটাই আপনার সুচিন্তিত মতামত তাই না?
হ্যাঁ, বিশেষ করে ওর ছেলেবেলাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ভাবলে আমিই
তা ঠিক, তা ঠিক, আর একটা অখুশি ছেলেবেলার কাহিনি এড়ানোর জন্য ইনসপেক্টর শার্প অন্য প্রসঙ্গে এলো, কিছুদিন আপনি তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছিলেন, তাই না?
আপনি হয়তো শুনলে অবাক হবেন, নিঃশব্দে অবচেতন মনে হঠাৎ আমি ওর প্রতি আকৃষ্ট হই, কিন্তু ব্যাপারটা আমি ঠিক জানতাম না। অল্প বয়সে বিয়ে করার ইচ্ছে আমার একেবারেই ছিলো না। তাই ওভাবে নিজেকে সংযত করতে পেরেছিলাম। অবচেতনে মনে হয়তো ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম, কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত গড়াতে দিইনি।
হ্যাঁ, তাই হবে, আপনার সাথে বাগদানে খুশিই হয়েছিল সিলিয়া অস্টিন। তার মধ্যে কোনো অনিশ্চয়তা ছিলো না, থাকলে নিশ্চয়ই বলতো সে। আর আপনি তাকে বিয়ে করার পরিকল্পনা করেছিলেন–তা কখন?
খুব শিগগীর নয়, স্ত্রীর ভার নেওয়ার মতো ক্ষমতা এই মুহূর্তে আমার নেই।
সিলিয়ার কোনো শত্রু ছিলো বলে আপনার কি মনে হয়? মানে কেউ তাকে পছন্দ করতো না, এমন কেউ?
আমি বিশ্বাস করি না। কারণ এখানে সবাই তার মিত্র ছিলো, এটা কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়।
ব্যক্তিগত ব্যাপার বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?
একটা অনুমান মাত্র। ব্যাপারটা আমার নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়।
সেদিক থেকে তাকে এর বেশি নাড়াচাড়া করতে পারে না, ইনসপেক্টর শার্প, শেষ যে দুজন ছাত্রীর জবানবন্দী নেওয়া বাকী ছিলো তারা হলো সেলী ফ্রিঞ্চ এবং এলিজাবেথ জনস্টন। প্রথমে সেলী ফ্রিঞ্চকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করলো ইনসপেক্টর।
সেলী বেশ আকর্ষণীয়া, তবে মাথার চুলগুলো তার রূপ যেন আরো বেশি খুলে দিয়েছিল। চোখদুটো উজ্জ্বল এবং বুদ্ধিদীপ্ত। রুটিন মাফিক জিজ্ঞাসাবাদের পরেই সেলী নিজেই প্রশ্নকর ভূমিকা নিলো।
আমি কি করতে চাই জানেন ইনসপেক্টর? আমি যা ভেবেছি তাই আপনাকে বলতে চাই। এ আমার ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা। জানেন, এ বাড়ির সবকিছুই কেমন যেন গোলমেলে। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
সিলিয়া অস্টিনকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে বলে?
না, আমি বলতে চাই তার আগে থেকেই। এখানে যেসব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, আমার একেবারেই পছন্দ নয়। ঝোলানো ব্যাগ কেটে কুচি কুচি করাটা আমি পছন্দ করি না, পছন্দ করি না অনুরূপ ভাবে ভ্যালেরির স্কার্ফটা ছিঁড়ে ফেলা। ব্ল্যাক বেকের নোটের ওপর কালি ছিটনোও আমার পছন্দ নয়। তাই আমি এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে চাই।
ফিঞ্চ, তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, কোনো ব্যাপারে আপনি ভয় পাচ্ছেন?
হ্যাঁ, আমি ভীত কোনো কিছু কিংবা কেউ এমন এখানে অত্যন্ত নিষ্ঠুর। এখানকার সমস্ত জায়গাটা দুষিত–কে জানে আপনাকে ঠিক কি ভাবে যে বোঝাবো। না, না, ইনসপেক্টর আমি কমিউনিস্টদের কথা বলছি না। আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনার ঠোঁট কাঁপছে। আবার বলছি কমিউনিস্টদের ভয়ে নয়, এমন কি কোনো তাপরাধীর ভয়েও নয়। তবে আপনাকে বাজী ধরে বলতে পারি যে এই ভয়ঙ্কর বয়স্ক মহিলা এ ব্যাপারে সবকিছুই জানেন।
কোনো বয়স্কা মহিলা? আপনি মিসেস হার্বার্ডের কথা বলছেন না তো?
না, না, উনি আমাদের অতিপ্রিয়, আমি বলতে চাইছি মিসেস নিকোলেটিসের কথা। সেই বৃদ্ধা মেয়ে নেকড়ে বাঘিনীর কথা।
মিস ফিঞ্চ এতে খুবই আগ্রহের ব্যাপার, মিস নিকোলেটিসের ব্যাপারে একটু বিশদ ভাবে বলতে পারে না?
সেলী মাথা নাড়লো, সঠিক ব্যাপারটা আমি জানি না। মনে হয় সিলিয়া কিছু জানতো। শেষদিন আমাকে এরকম একটা আভাও দিয়েছিল। এখানকার সেই সব অশুভ ঘটনা ঘটে যাওয়ার ব্যাপারে। পুরো খুলে না বললেও ভয়ে সে আমাকে বলেছিল, এমন কিছু একটা সে জানে যা সে আমার কাছে প্রকাশ করতে চায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার বলা হয়ে ওঠেনি। তাই বলছি ইনসপেক্টর কারোর ব্যাপারে সে নিশ্চয়ই কিছু জানত, আর আমার মনে হয়, সেই কারণেই খুন হয়েছিল সে।
কিন্তু ফল সেরকম কিছু ভয়ঙ্কর হবে সেটা—
তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠলো সেলী-সেটা যে কতো ভয়ঙ্কর এ সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিলো না। জানেন খুব একটা চটপটে মেয়ে সে ছিলো না। নেহাতই বোকা বোকা গোছের মেয়ে ছিলো সে, এমন একটা কিছু সে জানতো, যার বিপদের সম্ভাবনা তার আদৌ জানা ছিল না। সে যাহোক, এই হলো আমার পর্যবেক্ষণ, এটা যে কতো মূল্যবান তা আমার জানা নেই।
তাই বুঝি। ধন্যবাদ–এখন বলুন রাতে নৈশভোজের পরে শেষবারের মতো সিলিয়াকে আপনি কমনরুমে দেখেছিলেন, এই তো?
হ্যাঁ ঠিক তাই। তবে আসলে তার পরেও আমি তাকে দেখেছিলাম।
তারপরেও আপনি তাকে দেখেছিলেন! কোথায়? তার ঘরে?
না, আমি যখন শুতে যাই, তখন কমনরুম থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। তখন ওকে সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখি।
সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে, মানে আপনি বলতে চাইছেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলেন তাকে?
হ্যাঁ।
খুব আশ্চর্যের ব্যাপার তো কেউ তো একথা বলেনি।
মনে হয় তারা জানে না। সিলিয়া নিশ্চয়ই তাদের শুভরাত্রি জানিয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে থাকবে, তাই তারা ধরে নিয়েছিল ও শুতে যাচ্ছে। আর আমি যদি ওকে দেখতে না পেতাম, আমিও সেইরকম ভেবে নিতাম। মনে হয় বাইরে কারোর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো ও।
বাইরের কারোর সঙ্গে, নাকি কোনো ছাত্রের সঙ্গে?
হ্যাঁ আমার ধারণা, বোধহয় কোনো ছাত্রের সঙ্গে। দেখুন, ও যদি গোপনে কোনো ছাত্রের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল, সেতো এই বাড়িতেই করতে পারতো, হয়তো কেউ ওকে বলে থাকবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কোথাও দেখা করার জন্য।
কখন সে আবার ফিরে এসেছিল, এ ব্যাপারে আপনার কোনো ধারণা আছে?
না, কোনো ধারণাই নেই।
পরিচারক গেরানিমো জানতে পারে?
কারণ এগারোটার পর দরজায় চেন লাগিয়ে তালা দিয়ে দেয় সে। এগারোটা পর্যন্ত যে কেউ তার নিজের চাবি দিয়ে দরজায় তালা খুলতে পারে।
ঠিক কখন সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল মনে আছে?
মনে হয় রাত দশটা কিংবা দু-চার মিনিট পরে হবে তার বেশি নয়।
আপনি যা বললেন, তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ মিস ফিঞ্চ, ইনসপেক্টর শার্প শেষ জবানবন্দী নিলো এলিজাবেথ জনস্টনের। মেয়েটিকে দেখা মাত্র তার দক্ষতা সম্পর্কে বেশ ভালোরকমই উপলব্ধি করলো সে। মেয়েটি তার প্রশ্নের উত্তর দিলো বেশ বুদ্ধিমতীর মতো।
শুনেছি সিলিয়া অস্টিন আপনার কাজ নষ্ট করার ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তীব্রভাবে করেছিল। মিস জনস্টন আপনি কি তা বিশ্বাস করেন?
আমার বিশ্বাসই হয় না, এ কাজ সিলিয়া করতে পারে না, না, অসম্ভব।
কিন্তু কে সে কাজ করেছিল, আপনি জানেন না?
এর স্পষ্ট উত্তর হলো, নিজেল চ্যাপম্যান, কিন্তু আমার কাছে আবার এও স্পষ্ট যে, নিজেল অত্যন্ত বুদ্ধিমান, সে কি নিজের কালি ব্যবহার করতে পারে?
বেশ তো নিজেল যদি না হয়, তাহলে অন্য কে সে?
সে তো আরো কঠিন ব্যাপার, তবে আমার ধারণা, কে এ কাজ রাতে করতে পারে? সিলিয়া জানতো, কিংবা অন্তত অনুমান করেছিল।
সেরকম কিছু কি সে বলেছিল আপনাকে?
ও বলেছিল, একটু থেমে জনস্টন বলল, ও বলেছিল আমি ঠিক নিশ্চিত নই, এর কারণ আমি জানি না-হয়তো সেটা একটা ক্ষণিকের ভুল কিংবা দুর্ঘটনা হতেও পারে–তবে আমি নিশ্চিত যেই সে কাজ করে থাকুক না কেন, সুখী নয় সে, আর সত্যিই সে তার কৃতকর্ম স্বীকার করবেই একদিন না একদিন। সিলিয়া বলে চলে, তবে যেদিন পুলিস এখানে আসে ইলেকট্রিক বাল্ব উধাও হওয়ার ঘটনাটা আমার ঠিক বোধগম্য হয় না।
বাধা দিলো শার্প, এই ইলেকট্রিক বাল্ব উধাও হওয়া পুলিস আসার ব্যাপারটা কিরকম?
আমি জানি না। তবে সিলিয়া যা বলেছিল তা এইরকম : আমি সেগুলো নিইনি, তারপর সে আরো বলে কিন্তু পাসপোর্টের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে কিনা জানি না। আমি তখন ওকে জিজ্ঞেস করি, কোনো পাসপোর্টের কথা তুমি বলছো? উত্তরে বলে, আমার মনে হয় কেউ হয়তো পাসপোর্ট নকল করে থাকবে।
কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে ইনসপেক্টর জিজ্ঞেস করলো, আর কি বলেছিল সে?
এর বেশি কিছু নয়। এই রকমই বলেছিল সে, যাহোক এ সম্পর্কে আরো বেশি কিছু আমি জানতে পারবো আগামীকাল।
এরকম কথা বলেছিল সে? সেটা খুবই অর্থপূর্ণ মিস জনস্টন।
হা।
আবার নীরব হলো ইনসপেক্টর শার্প, সে তখন পুলিসের রেকর্ডের কথা ভাবছিল।–এ বাড়িতে পুলিস আসার কথা–হিকরি রোডে আসার আগে বেশ সতর্কতার সঙ্গেই ফাইল দেখছিল সে। এই বাড়িতেই বেশ কিছু বিদেশী ছাত্রছাত্রী থাকত, তাই পুলিসের বিশেষ নজর ছিলো এ বাড়িতে। তবে ২৬নং হিকরি রোড ভালো, একজন মহিলার অর্জিত আয়ে একজন ওয়েস্ট আফ্রিকান ছাত্রের খরচ চলে, সেলী ফিঞ্চ পুলিস তাকে খুঁজছিল। এই ছাত্রটি কিছুদিন হিকরি রোডে ছিলো, তারপর সে এখান থেকে অবশ্যই কোথাও চলে গিয়ে থাকবে। পুলিসকে সাহায্য করার জন্য রুটিন মাফিক সমস্ত হোস্টেলে এবং বোর্ডিং হাউসে পুলিস গিয়ে থাকে–বিশেষ করে একটি সরাইখানার মালিকের স্ত্রীর খুন হওয়ার কেসে কেমব্রিজ পুলিস একটি ইউরোপীয় ছাত্রকে খুঁজছিল। তবে সংশ্লিষ্ট সেই যুবকটি কোনো পুলিস স্টেশনে গিয়ে স্বেচ্ছায় ধরা দিতে সেই কেসটার সমাধান হয়ে যায়। তারপর বিদেশী ছাত্রদের কিছু আপত্তিকর প্যামপ্লেট বিতরণ করার ব্যাপারে অনুসন্ধান কাজ চালায় পুলিস। এসব ঘটনা ঘটে কিছুদিন আগে কিন্তু সিলিয়া অস্টিনের মৃত্যুর সঙ্গে এ সবের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে এলিজাবেথ জনস্টনের গভীর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটির দিকে তাকালো সে, তাকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করার জন্য, আবেগে বলে উঠল সে, মিস জনস্টন এখানকার কোনো ঘটনার ব্যাপারে কখনো গোলমেলে বলে আপনার কি মনে হয়েছে?
বিস্মিত হয়ে তাকালো সে। গোলমেলে কিভাবে?
আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না। আমি ভাবছি মিস সেলী ফিঞ্চ এর কথা সে আমাকে বলেছিল
ওহো সেলী ফিঞ্চ! এলিজাবেথের কণ্ঠস্বরে এমন একটা ভাব ছিলো যা তার কানে বাজলো, তার আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো, তাই ইনসপেক্টর বলে চলে :–আমার মনে হয়েছে, মিস ফিঞ্চ একজন ভালো পর্যবেক্ষক। এখানে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে, তবে সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি সে।
তীক্ষ্ণস্বরে এলিজাবেথ বলে উঠলো, আমেরিকানদের চিন্তাধারা ঐরকম, তারা সবাই সমান। এই সব আমেরিকানদের স্নায়ুকোষগুলো অত্যন্ত দুর্বল, বোকার মতো সবকিছুই তারা সন্দেহের চোখে দেখে। তাদের বোকামোর বহর দেখুন–তারা সব অপরাধীকেই ডাইনীর চোখে দেখে থাকে, সমাজতান্ত্রিক দেশের সবাইকে তারা কমিউনিস্ট বলে ভেবে থাকে। এক অদ্ভুত ধরনের মেয়ে ওই সেলী ফিঞ্চ।
ইনসপেক্টরের আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো, তার মানে সেলী ফিঞ্চকে অপছন্দ করে এলিজাবেথ। কিন্তু কেন? কারণ কি? সেলী একজন আমেরিকান বলে? কিংবা সেলী আমেরিকান বলেই কি সব আমেরিকানদের অপছন্দ করে এলিজাবেথ? অথবা কারোর লালচুল দেখলেই তাকে অপছন্দ করার পিছনে তার নিজস্ব একটা কারণ আছে? সম্ভবত স্রেফ একটা মেয়েলী ঈর্ষার জন্য। যাহোক সেটা সে প্রয়োজনীয় মনে করলো এবং নরম সুরে বললো, মিস জনস্টন এতো বড় একটা প্রতিষ্ঠানে একজনের সঙ্গে অপরজনের বিচারবুদ্ধির বিরাট ফারাক যে থাকতে পারে, আপনি নিশ্চয় স্বীকার করেন, তবে আমরা যখন প্রচণ্ড বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো লোকের সংস্পর্শে আসি
এখানে একটু থামলো সে। যেন একটু বেশি তোষামোদ হয়ে যাচ্ছে, ভাবলো সে মেয়েটি কি সাড়া দেবে?
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো সে : আপনি কি বলতে চান, বুঝেছি ইনসপেক্টর। এখানে সাধারণ মানের বুদ্ধি কারোর নয়, যেমন আপনি বললেন, কেউ কেউ অত্যন্ত বুদ্ধিমান। যেমন নিজেল চ্যাপম্যান, বুদ্ধি এতোই প্রখর যে, খুব দ্রুত যে কোনো ব্যাপার সে ধরে নিতে পারে, কিন্তু তার মনটা খুবই ভালো, তবে তার নজরটা ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে। আর সে স্নায়ুকোষগুলো কাজে লাগাতে অত্যন্ত অলস। আপনি আলোকপ্রাপ্ত মনের খোঁজ করছেন, অন্যদের থেকে সেইরকম মনোভাবাপন্ন মানুষের সন্ধান করতে চাইছেন।
যেমন আপনার বেলায় প্রযোজ্য মিসেস জনস্টন, কোনোরকম আপত্তি না করেই তার সেই প্রশংসা মেনে নিলো এলিজাবেথ, তার উপলব্ধি হলো মেয়েটি সত্যিই মিষ্টি স্বভাবের। এই তরুণীটির গর্বিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। নিজের গুণাগুণ জাহির করার ঔদ্ধত্য বেমানান নয়। মিস জনস্টন আপনার সঙ্গী ছাত্রবন্ধুদের সম্পর্কে আপনার বিশ্লেষণ আমি সমর্থন করি। সত্যি চ্যাপম্যান চালাক বটে, তবে ছেলেমানুষ সে। ভ্যালেরি জনহাউসের বুদ্ধি আছে বটে কিন্তু জীবনটাকে উপভোগ করার মতো মনোভাব তার নেই। আপনি আলোকপ্রাপ্ত মনের কথা বলছেন। আমি আপনাকে সেই জাতের মেয়ে বলে গণ্য করি। আর সেই কারণেই আপনার মতামতের আমি গুরুত্ব দিচ্ছি আলাদা এক শক্তিধর বুদ্ধিমতীর মতামত।
জানেন ইনসপেক্টর এই জায়গাটার ক্ষেত্রে কোনো গোলমালই নেই। সেলী ফিঞ্চ-এর কথায় কোনো কান দেবেন না। খুব ভালো হোস্টেল এটা। এখানে কোনোরকম খারাপ চালচলন আপনি দেখতে পাবেন না। একটু বিস্মিত হলো ইনসপেক্টর শার্প। সত্যি কথা বলতে কি খারাপ চালচলনের কথা আদৌ ভাবছি না।
ওহো, তাই বুঝি–একটু পিছু হটলো সে। পাসপোর্টের ব্যাপারে সিলিয়া যা বলেছে, আমি তার সঙ্গে একটা যোগাযোগ খুঁজে বার করার চেষ্টা করছিলাম। তবে কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব না করেই আর সবরকম প্রমাণ অনুধাবন করে আমার মনে হয়েছে সিলিয়ার মৃত্যুর কারণ স্রেফ ব্যক্তিগত ব্যাপার-মনে হয় যৌন জটিলতার ব্যাপার আর কি। তবে তাই হলে এই বলবো না যে, এই হোস্টেলে এরকম ঘটনাই ঘটে চলেছে। আমি নিশ্চিত, এখানে সেরকম ঘটনার চল নেই। থাকলে আমি ঠিক জানতে পারতাম। আমার উপলব্ধি খুবই সূক্ষ্ম।
তাই বুঝি, তাহলে সেজন্য আপনাকে তত বাড়তি ধন্যবাদ দিতে হয় মিস জনস্টন। আপনার বদান্যতা আর সাহায্য সত্যিই প্রশসংনীয়।
এলিজাবেথ জনস্টন চলে যাওয়ার পর স্থির দৃষ্টিতে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো ইনসপেক্টর শার্প। তার তন্ময়তা ভাঙাবার জন্য সার্জেন্ট কব দুদুবার চেষ্টা করেছিল।
ওহো, তুমি! সম্বিৎ ফিরে পেয়ে শার্প বলে, হ্যাঁ আরাম এখানে কি পেলাম? খুবই অল্প। কিন্তু আমি তোমাকে একটা কথা বলে রাখছি কব, সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে আগামীকালই আমি এখানে ফিরে আসছি, ওরা হয়তো ভাবছে সবকিছুই বুঝি শেষ হয়ে গেছে, ভাবতে দাও ওদের। ওখানে যে একটা বড়রকম কিছু ঘটতে যাচ্ছে, আমি নিশ্চিত। আগামীকাল এ কেসের ভোল আমি পাল্টে দেব।-তবে কাজটা খুব সহজ হবে না, কিন্তু আমার বিশ্বাস, আমি আমার একটা ক্লু ঠিক খুঁজে পাবোই। মিস জনস্টনের কথাবার্তা শুনে দারুণ আগ্রহ বোধ করছি। মেয়েটির মধ্যে নেপোলিয়নের অহংভাব আছে, আমার সন্দেহ মেয়েটি অবশ্যই কিছু জানে।
৩. মিস লেমনকে নোট দিতে
১০.
মিস লেমনকে নোট দিতে গিয়ে থামলো এরকুল পোয়ারো। মিস লেমন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। হা এরপর কি লিখবো বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার মনটা খুবই বিক্ষিপ্ত। হাত তুলে বললো পোয়ারো, এ চিঠিটা তেমন জরুরী নয়, মিস লেমন দয়া করে সেখানে তোমার বোনের সঙ্গে যোগাযোগ করবে একবার।
হ্যাঁ এখুনি ফোন করছি মঁসিয়ে পোয়ারো। কয়েক মিনিট পরে পোয়ারো তার সেক্রেটারির হাত থেকে রিসিভারটা তুলে নেয়।
হ্যালো, বললো সে।
বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, কি খবর? মিসেস হার্বার্ড এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো যেন।
ওখানে এখন নিশ্চয়ই বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো পোয়ারো।
না মঁসিয়ে বেশ সুষ্ঠ ভাবেই ইনসপেক্টর শার্প সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদের কাজ শেষ করেছেন। আজ তিনি সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছিলেন। মিসেস নিকোলেটিসের অবস্থা হিস্টিরিয়া রোগিণীর মতো তখন, আমাকে সামলাতে হয়েছে।
আহা। সহানুভূতি দেখালো পোয়ারো। তারপর সে বললো, একটা ছোট্ট প্রশ্ন করতে চাই। উধাও হওয়া সেই জিনিসগুলোর একটা ছোট্ট তালিকা তুমি আমাকে দিয়েছিলে মনে আছে? আচ্ছা সেগুলো কি তুমি পরপর সাজিয়েছিলে? মানে যেদিন যে জিনিসটা উধাও হয়েছিল সেই সব তারিখ অনুযায়ী লিখেছিলে।
না, ঠিক তা নয়। আমি দুঃখিত, যখন যেটা খেয়াল হয়েছে সেই ভাবে লিখেছিলাম। এ ব্যাপারে তখন আমার খেয়াল হয়নি। কিন্তু এখন দেখছি সেটার খুবই প্রয়োজন। তোমার সেই তালিকাটা আমার কাছে রয়েছে। বলল পোয়ারো। যেমন ধরা যাক প্রথমেই সান্ধ্যজুতো, তারপর ব্রেসলেট, হীরের আংটি, পাউডার কমপ্যাক্ট, লিপস্টিক, স্টেথোস্কোপ এবং আরো কিছু। কিন্তু তুমি এখন বলছে, এগুলো কালক্রমে সাজানো হয়নি।
না।
এখন তুমি কি মনে করতে পারো, নাকি সেগুলো পরপর সাজাতে তোমার খুব অসুবিধে হবে?
দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো, ঠিক এই মুহূর্তে আমি বলতে পারছি না। বুঝতেই তো পারছেন, ঘটনাগুলো অনেকদিন আগের তাই আমাকে একটু ভাবতে হবে। আমার বোনকে আমি বলেছি, আসলে আপনি ফোন করার আগেই আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাবো। আর তখনই কালক্রমে সাজানো নতুন একটা তালিকা নিয়ে যাবো আপনার জন্য। আজ সন্ধ্যায় আপনার কাছে যাচ্ছি, তার আগে সম্ভব নয়, কারণ মনে করে তালিকাটা ঠিক করতে হবে তো? তাছাড়া প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যাচাই করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় জিনিস বলতে যেমন বোরিক পাউডার, ইলেকট্রিক বাল্ব, ঝোলানো ব্যাগ–এগুলো সত্যিই জরুরী কিছু নয়, ভেবে দেখেছি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এগুলোর ব্যাপারে চিন্তা করা হয়েছিল।
তাই বুঝি! বললো পোয়ারো, হা দেখেছি আমি কি করতে পারিম্যাডাম প্রচুর সময় নিয়ে এসো অনেক কথা আছে তোমার সাথে। উধাও হওয়া জিনিসগুলো কালো ড্রেসে সাজিয়ে এনো।
নিশ্চয়ই মঁসিয়ে পোয়ারো, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটাই প্রথম উধাও হয় বলেই আমার বিশ্বাস, তারপর ইলেকট্রিক বাল্ব, যা আমার মনে হয়েছিল অন্য হারানো জিনিসগুলোর সাথে সম্পর্ক নেই–তারপর ব্রেসলেট এবং পাউডার কমপ্যাক্ট, না, না-সান্ধ্যজুতো। কিন্তু এরপর এখনি যেন আমাকে অনুমান করতে বলবেন না। কালক্রমে এরপর কি কি হতে পারে। ঠিক ঠিক ভাবে পরের জিনিসগুলো আমি সাজিয়ে আনবো।
ধন্যবাদ ম্যাডাম, তোমার কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। রিসিভারটা নামিয়ে রাখলো পোয়ারো।
শনিবার সকাল, হিকরি রোডে সার্চ ওয়ারেন্ট সঙ্গে নিয়ে এসে মিসেস নিকোলেটিসের সাক্ষাৎকার নেওয়ার দাবি করলো ইনসপেক্টর শার্প।
প্রচণ্ড ভাবে আপত্তি জানালেন মিসেস নিকোলেটিস, কিন্তু এতো এক ধরনের অপমান, আমার ছাত্র-ছাত্রীরা এরপর এখানে আর থাকবে ভেবেছো? সবাই চলে যাবে। তারা সবাই চলে যাবে। আমি তখন ধ্বংস হয়ে যাবো।
না, না ম্যাডাম। আমি ওদের চিনি, ওরা বোঝদার, ওরা ভুল বুঝবে না। হাজার হোক এটা তো খুনের কেস।
না, এ কখনোই খুনের নয়, আত্মহত্যার কেস।
আপনাকে তো আমি আগেই বলেছি, কেউ আপত্তি করবে না-নরম সুরে বললো মিসেস হার্বার্ড। এ আমি হলফ করে বলতে পারি কেবল–কেবল মিঃ আহমেদ আলি আর মিঃ চন্দ্রলাল ছাড়া।
ফুঃ! ফুঁ দিয়ে দেওয়ার মতো করে মিসেস নিকোলেটিস বললেন কে ওদের তোয়াক্কা করে?
ধন্যবাদ ম্যাডাম! বললো ইনসপেক্টর, তাহলে আপনার এই বসবার ঘরেই শুরু করা যাক কি বলেন?
ইনসপেক্টরের উদ্দেশ্যটা জানার পরেই প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়লেন মিসেস নিকোলেটিস, যেখানে খুশী আপনি সার্চ করতে পারেন, বললেন তিনি, কিন্তু এখানে নয়, আমি আপত্তি জানাচ্ছি।
আমি দুঃখিত মিসেস নিকোলেটিস, আমাকে পুরো বাড়ি সার্চ করতেই হবে।
তা ঠিক, কিন্তু আমার ঘরে নয়, আমি আইনের ঊর্ধ্বে।
কেউ আইনের ঊর্ধ্বে হতে পারে না, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি একপাশে সরে দাঁড়ান।
এ আমার সাংঘাতিক ক্ষতি, প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়লেন মিসেস নিকোলেটিস। আপনারা ব্যস্ত অফিসার। আপনাদের এই অন্যায় জুলুমের ব্যাপারে আমি সবাইকে চিঠি লিখবো। আমি আমার পার্লামেন্টের সদস্যদের কাছে লিখবো। আমি কাগজেও লিখবো।
মাদাম, আপনি আপনার খুশিমতো যাকে মনে করেন লিখতে পারেন। বললো ইনসপেক্টর শার্প। যেভাবেই হোক, এ ঘর আমি সার্চ করবোই।
শার্প তার অনুসন্ধানের কাজ শুরু করলো টেবিল দিয়ে। কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটির পর ঘরের এক কোণায় কাপবোর্ডের দিকে এগোল সে। এটা তো দেখছি চাবি দেওয়া। চাবিটা পেতে পারি?
কখখনো নয়, চিৎকার করে উঠলো মিসেস নিকোলেটিস। চাবি আপনি পাবেন না। কখখনো নয়, কখখনো নয়। আর ইউ ব্লাডি বাস্টার্ড, থু! থু! থু!
আমি আবার বলছি, চাবিটা আপনি আমাকে দিন, তীক্ষ্ণস্বরে বললো ইনসপেক্টর। তা না হলে কাপবোর্ডের ডালা আমি ভাঙতে বাধ্য হবো।
না, আমি আপনাকে চাবি কিছুতেই দেবো না। চাবি পাওয়ার আগে আপনাকে আমার পোশাক ছিঁড়ে ফেলতে হবে। আর সেটা-সেটা হবে একটা স্ক্যান্ডাল।
একটা বাটালি নিয়ে এসো করব, শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বললো শার্প।
রাগে উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলেন মিসেস নিকোলেটিস।
তাতে কোনো গুরুত্ব দিলো না শার্প। বাটালি দিয়ে কাপবোর্ডের ডালা খোলা হলো। ডালা খুলতেই অনেকগুলো খালি ব্ল্যান্ডির বোতল বেরিয়ে এলো কাপবোর্ড থেকে।
জানোয়ার! শুয়োরের বাচ্চা! শয়তান! চিৎকার করে উঠলেন মিসেস নিকোলেটিস।
ধন্যবাদ ম্যাডাম, নম্রভাবে বললো ইনসপেক্টর। এখানে আমাদের কাজ শেষ। বুদ্ধি করে বোতলগুলো কাপবোর্ডে আবার সাজিয়ে রাখলো মিসেস হার্বার্ড। ওদিকে মিসেস নিকোলেটিস তখন হিস্টিরিয়া রোগিণীর মতো ছটফট করছিলেন। রহস্য, একটা রহস্য মিসেস নিকোলেটিসের মেজাজের রহস্য এখন পরিষ্কার হয়ে গেলো। সবেমাত্র মিসেস নিকোলেটিসের যন্ত্রণা উপশম করার জন্য তাকে ওষুধ খাইয়ে তার পাশে বসবার উপক্রম করেছিল মিসেস হার্বার্ড, ঠিক সেই সময় পোয়ারোর ফোন এলো। রিসিভারটা নামিয়ে রেখে সে আবার ফিরে গেলো মিসেস নিকোলেটিসের কাছে। তখনো তিনি সোফার উপর হাত-পা ছুঁড়ছিলেন তার বসবার ঘরে। বুঝতেই পারছেন ওরা ওদের কর্তব্য তো করবেই, তাকে বোঝাবার চেষ্টা করেন মিসেস হার্বার্ড।
তাই বলে আমার ব্যক্তিগত কাপবোর্ড খুলবে? আমি ওদের বললাম, ওটা আপনাদের জন্য নয়। এটা আমি চাবি দিয়ে রেখেছিলাম। চাবিটা আমি আমার বুকের মধ্যে রেখেছিলাম। তুমি যদি সাক্ষী হিসাবে না থাকতে ওরা তাহলে নির্লজ্জের মতো আমার পোশাক টেনে ছিঁড়ে ফেলতো।
ওহো না, ওরা ও কাজ কখনোই করতো না, বললো মিসেস হার্বার্ড।
তুমি যে বলছো। বাটালি না পেলে ওরা তাই করত। এটা আমার বাড়ির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর, এর জন্য আমি দায়ী হবো।
কিন্তু মিসেস নিকোলেটিস, মনে রাখবেন এখানে একজন খুন হয়েছে। আর খুন হলে পুলিস এমন কিছু কাজ করতে পারে যা অন্য সময় হলে মোটেই সুখকর হতো না।
খুনের ব্যাপারে আমি থুথু ফেলি। বললেন উত্তেজিত নিকোলেটিস। এই বাচ্চা মেয়ে সিলিয়া আত্মহত্যা করেছে, বিশ্রী প্রেমের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিল ও, তাই তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বিষ খেতে বাধ্য হয়েছিল ও, এরকম ঘটনা তো আকছারই ঘটছে আজকাল, এই সব মেয়েরা প্রেমের ব্যাপারে এতো বোকা, প্রেমের জন্য ওরা নিজেদের জীবনকেও তুচ্ছ বলে ভাবতে পারে।
ভালোবাসা, বললো মিসেস হার্বার্ড। তারপর যেখান থেকে আলোচনা শুরু হয়েছিল তার জের টেনে সে আবার বললো, এমন সব ব্যাপারে আমার চিন্তা করা উচিত নয়।
তোমার পক্ষে সেটা হয়তো ভালো কথা, কিন্তু আমাকে চিন্তা করতেই হবে, আমার পক্ষে এটা আর নিরাপদ নয়।
নিরাপদ? অবাক চোখে তাকাল মিসেস হার্বার্ড।
এটা আমার ব্যক্তিগত কাপবোর্ড, জোর দিয়ে বললেন মিসেস নিকোলেটিস। আমার কাপবোর্ডে কি আছে কেউ জানতো না, আমি কাউকে জানতেও দিতে চাইনি। কিন্তু এখন ওরা জেনে গেল, আমি এখন অস্বস্তি বোধ করছি। ওরা হয়তো ভাবতে পারে–ওরা কি ভাবতে পারে?
ওরা বলতে আপনি কাদের বোঝাতে চাইছেন? বললে ভালো হতো, তাহলে আমি হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারতাম।
কেন বুঝতে পারছে না তুমি, আমার এখানে ঘুম হবে না, বললেন মিসেস নিকোলেটিস, এই চাবিগুলো একইরকমের। যে কোনো চাবি যে কোনো তালায় লাগতে পারে। তাহলে বুঝতেই পারছো ব্যাপারটা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন আমার চোখে আর ঘুম আসবে না।
মিসেস নিকোলেটিস আমি আবার বলছি, আপনি যদি কোনো কিছুর জন্য ভয় পেয়ে থাকেন তাহলে আমাকে সব কথা খুলে বলতে পারেন।
মিসেস নিকোলেটিসের কালো গভীর চোখ থেকে যেন একঝলক আগুন ঝরে পড়লো, তুমি তো তোমার নিজের কথাই বললে, কৌশলে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলেন তিনি। তুমি বললে এ বাড়িতে খুন হওয়ার দরুন যে কেউ অস্বস্তি বোধ করবে। পরবর্তী শিকার কে হবে? এমনকি কেউ এখনো পর্যন্ত জানে না খুনী কে? এই কারণেই পুলিশকে আমার খুব বোকা মনে হয়েছে। কাজের কাজটা তারা এখনো পর্যন্ত করতে পারেনি কিংবা এও হতে পারে, তারা ঘুষ খেয়ে বসে আছে।
ঘুষ খাওয়ার কথা বলবেন না, একথা বলা বোকামো, আর আপনি সেটা ভালোই জানেন, একটু কড়া সুরেই বললো মিসেস হার্বার্ড। বরং আপনি আমাকে বিশ্বাস করে বলুন, আপনার প্রকৃত উদ্বেগের কারণটা কি।
আহ আমার চিন্তার কোনো কারণ আছে বলে মনে করো না। আছে কি নেই সে তুমি ভালোই জানো, সব কিছুই তুমি জানো! চমৎকার মেয়ে তুমি। ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো ভালো খাবার খাওয়ানোর জন্য জলের মতো অর্থ ব্যয় করছো তুমি, তোমার লক্ষ্য ওদের প্রিয় হওয়া আর এখন তুমি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইছে, কিন্তু তা হবে না। আমার সমস্যাটা আমি নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই, কেউ তার মধ্যে নাক গলাতে পারবে না। শুনতে পাচ্ছ তুমি? না মিসেস, বন্ধু সেজে কৌশলে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারটা জেনে নিতে দেবো না আমি তোমাকে।
দয়া করে আপনি
না, বলবো না, আমি জানতাম, তুমি একজন গুপ্তচর।
কিসের গুপ্তচর?
কিছুই নয়, বললো মিসেস নিকোলেটিস, এখানে গুপ্তচরগিরি করার কিছুই নেই। তুমি ধরে নিয়েছে এখানে গোপন কিছু আছে, আর সেই ভেবে তুমি যদি পুলিসের কাছে মিথ্যে করে কিছু বলল, আমি ধরে নেবো কে বলতে পারে, বুঝলে?
এভাবে বলছেন কেন? বললো মিসেস হার্বার্ড, এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য আপনি আমাকে সোজাসুজিই তো বলতে পারেন।
না, তোমাকে যেতে হবে না। আমি নিষেধ করছি, এখন নয় যতদিন এই পুলিসী ঝামেলা চলবে, যতদিন না খুনী ধরা পড়বে তোমাকে আমার হাতের মুঠোর মধ্যে থাকতে হবে।
আমাকে ত্যাগ করে চলে যেতে দেবো না তোমাকে।
ঠিক আছে, নিরাশ হয়ে বললো মিসেস হার্বার্ড। কিন্তু আপনি সত্যি সত্যি কি যে চান বোঝা মুশকিল। এক এক সময় আমার কি মনে হয় জানেন, আপনি আসলে কি চান, নিজেই হয়তো তা জানেন না। আপনি বরং আমার বিছানায় শুয়ে থাকুন–আর ঘুমোবার চেষ্টা করুন
.
২৬ নম্বর হিকরি রোডে এসে ট্যাক্সি থেকে নামলো এরকুল পোয়ারো। দরজা খুলে দিলো গেরোনিমো। পুরানো বন্ধুর মতো তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো সে, এখানে পুলিস এসেছিল। উঃ! সে কি ভয়ঙ্কর অবস্থা। সার্চ ওয়ারেন্ট নামে বাড়ি তছনছ করে দিয়ে গেছে। রান্নাঘর তল্লাসি করতে গেলে মারিয়া তো ক্ষেপে লাল। রাগের মাথায় বলেই ফেলে সে পুলিসকে পেটাবে। আমি তাকে বোঝাই, অমন কাজ করো না, করলে আমরা সবাই আরো বেশি ঝামেলায় পড়ে যাবো।
তোমার দেখছি ভালো বোধশক্তি আছে, পোয়ারো তার কাজের প্রশংসা করে জিজ্ঞেস করলো, মিসেস হার্বার্ড কোথায়?
উপরতলায় চলুন, ওর কাছে নিয়ে যাচ্ছি।
এক মিনিট, পোয়ারো তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এখান থেকে কিছু ইলেকট্রিক বাল্ব ঠিক কবে উধাও হয়েছিল বলতে পারো?
সে তো অনেক, অনেকদিন আগে, তা প্রায় এক দুই কিংবা তিনমাস আগের ঘটনা হবে।
ঠিক কোনো বাল্ব উধাও হয়েছিল বলো তো?
একটা হলঘরের একটা কমনরুমের আর বাড়তি বাল্বগুলো উধাও হয়।
তাহলে ঠিক কোনো তারিখে সেগুলো উধাও হয়েছিল তুমি খেয়াল করতে পারছো না?
নির্দিষ্ট তারিখ বলতে না পারলেও মাসটা আমার মনে আছে–ফেব্রুয়ারী, কারণ ওই মাসেই পুলিস এসেছিল এখানে।
পুলিস? এখানে পুলিস এসেছিল কেন।
মিসেস নিকোলেটিসের সাথে দেখা করতে এসেছিল, একজন ছাত্রের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে। আফ্রিকা থেকে এসেছিল ছাত্রটি, খুবই বাজে ছেলে, কোনো কাজকর্ম করতো না, নারীসঙ্গ ছিলো তার। তার জন্য মেয়েটি অন্য পুরুষদের সঙ্গদান করত। খুবই খারাপ ব্যাপার। পুলিস সেটা পছন্দ করতে পারেনি এসব ঘটনা ম্যাঞ্চেস্টার, না আমার মনে হয় শেফিল্ডের। তাই সে সেখান থেকে পালিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নেয়। কিন্তু পুলিস ঠিক তাকে খুঁজে পেয়ে মিস, হার্বার্ডের সাথে তার ব্যাপারে আলোচনা করে, কিন্তু পাখি তখন উড়ে গেছে এখান থেকে। তবে পরে পুলিস তাকে অন্য এক জায়গা থেকে আটক করে জেলে পুরে দেয়।
আর পুলিস যেদিন এখানে আসে সেইদিনই বাল্বগুলো চুরি গেছিল এই তো?
হা, সুইচ অন করতে গিয়ে দেখি আলো জ্বলছিল না। তখন কমনরুমে গিয়ে দেখি সেখানকার বাল্বও উধাও। এখানে ড্রয়ারে বাড়তি বান্ধ রাখা ছিল সেগুলোও উধাও।
গেরোনিমোর সঙ্গে মিসেস হার্বার্ডের ঘরে যেতে গিয়ে তার কাহিনিটা হজম করতে হলো পোয়ারোকে।
পোয়ারোকে উষ্ণ সম্বর্ধনা জানিয়ে তার হাতে একটা তালিকা তুলে দিয়ে মিসেস হার্বার্ড ক্লান্ত স্বরে বললো, এই জিনিসগুলো একেকটা উধাও হওয়ার দিনক্ষণ আমি আমার সাধ্যমতো লেখার চেষ্টা করেছি মঁসিয়ে পোয়ারো। তবে এটা একশো ভাগ নির্ভুল বলে ধরে নিতে পারেন আপনি।
ম্যাডাম, আমি তোমার প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ, এখন বলো মিসেস নিকোলেটিস কেমন আছেন?
আমি ওঁকে ঘুমের ট্যাবলেট দিয়েছি, মনে হয় তিনি এখন ঘুমুচ্ছেন। সার্চ ওয়ারেন্টের ব্যাপারে উনি দারুণ ঝামেলা করেছিলেন। ওর ঘরের কাপবোর্ডের চাবি দিতে অস্বীকার করেন উনি। তখন ইনসপেক্টর তালা ভেঙে কাপবোর্ডের ডালা খুলতেই অনেকগুলো ব্র্যান্ডির খালি বোতল বেরিয়ে আসে।
আহ। পোয়ারো মুখে অমন একটা শব্দ করলে যেন সে মিসেস নিকোলেটিসের মনের ঠিকানা পেয়ে গেছে।
ব্ল্যান্ডির খালি বোতলগুলো সত্যি যেন অনেক কিছু ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে। বললো মিসেস হার্বার্ড। সত্যি এ দিকটার কথা আমি চিন্তাই করিনি। কিছুদিন আমি সিঙ্গাপুরে চলে যাই। এরই মধ্যে এতগুলো ব্র্যান্ডির বোতল খালি করা হয়েছিল কিন্তু তা যাহোক–
এগুলো আপনার কৌতূহল উদ্রেক করে না, সবকিছুই আমাকে আগ্রহ জাগায়, বললো পোয়ারো।
চেয়ারে বসে সে আবার সেই তালিকার উপর দৃষ্টি ফেললো। কিছুক্ষণ পরেই সে আবার বলে উঠলো, আহ্, দেখছি ঝোলানো ব্যাগটাই তালিকার প্রথমেই হয়েছে।
হ্যাঁ, ওটা খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়। কিন্তু এখন আমি মনে করতে পারছি, গহনাগুলো আর কিছু দামী জিনিস উধাও হওয়ার আগে, যেন সেটা আগে সরানো হয়েছিল। সেই কালো চামড়ার ছেলেটির জন্য আমাদের খুবই অসুবিধায় পড়তে হয়, মনে হয় এগুলোর সঙ্গে সেই ঘটনাটা হয়তো মিশে গিয়ে থাকতে পারে। এ ঘটনায় একদিন কি দুদিন আগে এখান থেকে চলে যায় সে। তাই মনে হয় এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে এই রকম একটা হিংসাপূর্ণ কাজ করে যায় সে, যাতে করে আমাদের অসুবিধায় পড়তে হয়।
আহ্! সেরকম কিছু একটা বলতে চাইছিল গেরোনিমো। এখানে পুলিস এসেছিল, খবরটা ঠিক?
হা। মনে হয় শেফিল্ড কিংবা বার্মিংহ্যাম থেকে তারা তদন্ত করার হুকুম পেয়ে থাকবে। এ সবই স্ক্যান্ডাল। অসৎ উপায়ে উপার্জন এইরকম আর কি।
আর তারপরেই ছেঁড়া ঝোলা ব্যাগের সন্ধান পাও তোমরা?
হ্যাঁ আমার তাই মনে হয়-মনে রাখা খুবই কঠিন। লেন বেটসন তার সেই ঝোলা ব্যাগ হারানোর ব্যাপার নিয়ে খুব ঝামেলা করেছিল। তখন খোঁজ খোঁজ। সব শেষে গেরোনিমো বয়লারের পিছন থেকে টুকরো টুকরো অবস্থায় সেটা আবিষ্কার করে। এমন একটা অদ্ভুত ঘটনা–এতো কৌতূহল, কিন্তু মিঃ পোয়ারো, এর কোনো মানে হয় না, তাই না?
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে কি যেন ভাবলো সে।
সেই বাল্বগুলো আর ঝোলানো ব্যাগ, তেমনি চিন্তিতভাবে আস্তে করে বললো পোয়ারো।
কিন্তু এখনো আমি মনে করি, বললো মিসেস হার্বার্ড, সেই জিনিসগুলো হারানোর সঙ্গে সিলিয়ার দোষত্রুটির কোনো সম্পর্ক নেই। আপনার মনে আছে, ঝোলানো ব্যাগ যে সে ছোঁয়নি, তা সে তীব্রভাবে অস্বীকার করেছিল।
হ্যাঁ সেটা সত্যি, এর কতদিন পরে চুরিগুলো ঘটতে শুরু করে বলো তো?
ওহে প্রিয় মঁসিয়ে পোয়ারো, এ সব কথা মনে রাখা যে কতো কষ্টকর, আপনার কোনো ধারণা নেই, দাঁড়ান, আমাকে খেয়াল করতে দিন–মার্চ না ফেব্রুয়ারি-ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে। হ্যাঁ আমার মনে হয়, তার এক সপ্তাহ পরে জেনেভিভও বলেছিল তার ব্রেসলেটটা হারিয়েছে। হা কুড়ি এবং পঁচিশ ফেব্রুয়ারির মধ্যে।
আর তারপর থেকে মোটামুটি ভাবে চুরি হতে থাকে, তাই না।
হ্যাঁ, মিসেস হার্বার্ড বলে, ঝোলা ব্যাগটা ছিলো লেন বেটসনের। সে তো দারুণ খাপ্পা, এমনিতেই ছেলেটি একটি রগচটা ধরনের।
ব্যাগটা কি বিশেষ ধরনের?
ওহো তা নয়, নেহাতই মামুলি ধরনের।
ঐরকম একটা ব্যাগ আমাকে দেখাতে পারো?
নিশ্চয়ই। কলিনের ঐরকম একটা ব্যাগ আছে, নিজেলের এরকম একটা ব্যাগ আছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি লেন ঠিক ঐরকম একটা ব্যাগ আবার কিনেছে এই রাস্তারই শেষ প্রান্তের একটা দোকান থেকে। যে কোনো বড় বড় দোকানের থেকে সেখানকার জিনিস খুবই সস্তা।
ম্যাডাম, আমি কি সেইরকম একটা ব্যাগ দেখতে পারি?
কলিন ম্যাকনারের ঘরে তাকে নিয়ে গেলো মিসেস হার্বার্ড, কলিন ঘরে ছিলো না, তবে তার কাপবোর্ড খুলে তার ঝোলানো ব্যাগটা বার করে পোয়ারোর হাতে তুলে দিলো। ঠিক এই রকমই একটা হারিয়ে যাওয়া ব্যাগ টুকরো টুকরো অবস্থায় পাওয়া যায়।
এমব্রয়ডারি কাঁচি দিয়ে কেউ কাটতে পারবে না, বিড়বিড়িয়ে বললো পোয়ারো।
না, আপনি যা মনে করছেন তা নয়–যদিও এর জন্য যথেষ্ট শক্তির দরকার তাও আমি বলবো, উদাহরণস্বরূপ যে মেয়ের মনে অপরের অপকার করার স্পৃহা থাকে, অনায়াসে সে এটা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে। এখানে একটু থেমে মিসেস হার্বার্ড বলে, ভ্যালেরির স্কার্ফের দশা এইরকমই করা হয়, ভালো কথা দেখেশুনে মনে হয়–কি বলবো-এ যেন অসামঞ্জস্যহীন।
আহ! বললো পোয়ারো, কিন্তু ম্যাডাম, আমার মনে হয় তুমি বোধহয় কোথাও ভুল করছো, এ ব্যাপারে আমার মনে হয় না এর মধ্যে কোনো অসামঞ্জস্যহীন নেই। আমার আরো মনে হয় এর মধ্যে একটা উদ্দেশ্য আর প্রয়োজন আছে, যাকে আমরা বলতে পারি একটা বিশেষ ধরনের নিয়ম।
ঠিক আছে আমি সাহস করে বলতে পারি, এসব ব্যাপারে আপনি অনেককিছুই জানেন, বললো মিসেস হার্বার্ড, আমার যা বলার তা হলো, এসব আমি অপছন্দ করি। আমার বিচারে এখানকার সব ছাত্র-ছাত্রীই চমৎকার। ওদের মধ্যে কোনো ছাত্র কিংবা ছাত্রী যদি
পোয়ারো তখন ব্যালকনি পেরিয়ে আর একটা ঘরে এসে দাঁড়ালো। বাড়ির পিছন দিকের ঘরের মতো দেখাচ্ছিল। নিচে ছোট্ট একটা বাগান, পরিত্যক্ত ঝুল আর ভূষায় ভর্তি।
আমার ধারণা, বাড়ির সামনের থেকে পিছনটা অনেক বেশি শান্ত নির্জন, বললো সে।
বয়লার-হাউসটা কোথায় বলো তো?
ঐ যে দরজা দেখছেন, কোল-হাউসের ঠিক পাশেই?
এই পথের মুখে কার কার ঘর আছে জানতে পারি?
নিজেল চ্যাপম্যান আর লেন বেটসনের।
তাদের ঘরের পরে কাদের?
তারপরের ঘরগুলো মেয়েদের, প্রথম ঘরটা সিলিয়া, তারপর এলিজাবেথ জনস্টন আর প্যাট্রিসিয়া লেনের, সামনের দিকে ভ্যালেরি আর জন টমকিনসনের। মাথা নেড়ে ঘরে ফিরে এলো পোয়ারো।
ঝোলানো ব্যাগগুলো কোনো দোকান থেকে কেনা হয়েছিল?
দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো নামটা ঠিক এখনি মনে করতে পারছি না, তবে যতদূর মনে হয় মেবারলি কিংবা কেলসো ঐরকমই কিছু একটা হবে।
আহ! বললো পোয়ারো, অদেখা সূত্র! এই কারণেই ঠিক এ ধরনের জিনিসের প্রতি আমার খুব লোভ আছে। জানালার ওপারে আর একবার তাকালো সে, নিচে ঝুল ও ভূষায় ভরা বাগানের দিকে। তারপর মিসেস হার্বার্ডের কাছ থেকে বিদায় নিল সে।
হিকরি রোডের শেষ ভাগের দোকানে এসে দাঁড়ালো সে, তবে মিসেস হার্বার্ডের বর্ণনা মতো দোকানটার নামে মেবারলি কিংবা কেলসো কোনোটাই নয়। তবে তার নাম বিক্স, সেই দোকানে ঢুকে পোয়ারো তার ভাইপোর জন্য একটা ঝোলানো বাগ কেনার ভান করল, কলিনের ঝোলাব্যাগের মতো একটা ব্যাগ কিনে নিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে দোকানীর কাছ থেকে জানতে পারল, তার দোকানের দাম অন্যসব বড় বড় দোকানের থেকে কম বলে ২৬নং হিকরি রোডের অনেক ছাত্রছাত্রীই তার দোকান থেকে জিনিস কিনে থাকে। পোয়ারো বুঝতে পারল মিসেস হাবার্ডের কথাই ঠিক।
তারপর সেখান থেকে বেরোতে যাবে হঠাৎ প্রবেশ পথে তার কাঁধের উপর একটা ভারি হাত পড়তেই পিছনের দিকে তাকালো সে।
ইনসপেক্টর শার্প, আরে আমি তো আপনার খোঁজই করছিলাম, বললো সে।
হিকরি রোডের হোস্টেলের তদন্ত শেষ?
হ্যাঁ তবে তদন্তের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছ বলে আমি মনে করি না, ইনসপেক্টর শার্প বলে, চলুন না একটা রেস্তোরাঁয় বসে আপনার প্রিয় স্যান্ডউইচ আর কফি খাওয়া যাক। আপনার সাথে কিছু কথা আছে।
স্যান্ডউইচ বার প্রায় কঁকা, একেবারে একপ্রান্তে তারা দুজন গিয়ে বসলো নিরিবিলিতে, হোস্টেলের ছাত্র-ছাত্রীদের জবানবন্দী সংক্ষেপে বলতে লাগল ইনসপেক্টর। একবার তরুণ চ্যাপম্যানের বিরুদ্ধেই আমরা কিছু প্রমাণ জোগাড় করেছি, বললো শার্প। তিনধরনের বিষ সেই এনেছিল, কিন্তু সিলিয়া অস্টিনের সাথে তার কোনো শত্রুতা ছিলো বলে আমার বিশ্বাস হয় না।
তার মানে আর একটা সম্ভাবনার দরজা খুলে গেছে যদিও
হা–সবকিছুর মূলেই ছিলো সেই ড্রয়ারটা। বিশ্রীরকমের লোক, তরুণ গর্দভ। এরপর সে আসে এলিজাবেথ জনস্টনের প্রসঙ্গে। আর সিলিয়া তাকে কি বলেছিল সে কথাও উঠলো। সে যা বলেছে তা যদি সত্য হয় তাহলে সেটা অর্থপূর্ণ।
অত্যন্ত অর্থপূর্ণ, তাকে সমর্থন করলো পোয়ারো।
আগামীকাল এ ব্যাপারে আরো কিছু জানতে পারবো, বললো ইনসপেক্টর।
আপনার তদন্তের আর ফলাফল কি?
হ্যাঁ আছে, সম্ভবত আরো দু-একটা অভাবনীয় ঘটনা। যেমন এলিজাবেথ কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য। আমরা তার পার্টির কার্ড দেখেছি।
হ্যাঁ, বললো পোয়ারো, এটা একটা আগ্রহের ব্যাপার বটে। তবে আমার মনে হয় পার্টিতে তার প্রবেশ একটা মূল্যবান অ্যাসেট। আমি বলবো বয়সে তরুণী, আর অস্বাভাবিক বুদ্ধিমতী সে, সে যাই হোক, পোয়ারো জিজ্ঞেস করলো, এ ছাড়া আর কি দেখলেন?
ইনসপেক্টর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, মিস প্যাট্রিসিয়া লেনের ড্রয়ারে সবুজ কালিমাখানো রুমাল পাওয়া গেছে।
পোয়ারোর ভ্রূ উঁচু হলো।
সবুজ কালি? প্যাট্রিসিয়া লেন, মনে হয় সে কালি নিয়েছিল, আর এলিজাবেথ জনস্টনের কাগজের উপর সেই কালি ছিটিয়েছিল। তারপর সেই রুমাল দিয়ে হাত মুছেছিল সে। কিন্তু নিশ্চয়ই সে চাইবে না তার প্রিয়তম নিজেল সন্দেহভাজন হোক, তার হয়ে কথাটা শেষ করলো শার্প।
কেউ তা ভাবতে পারে না। নিশ্চয়ই অন্য কেউ সেই রুমালটা তার ড্রয়ারে রেখে থাকবে।
আর কিছু?
হা লিওনার্ড বেটসনের বাবা লংউইথ ডেল, মেন্টাল হাসপাতালে রয়েছে। আমার মনে হয় এটা তেমন আকর্ষণীয় কিছু নয়, কিন্তু
কিন্তু বেটসনের বাবা বিকৃত মাথার লোক। আপনি যেমন বললেন এর মধ্যে কোনো ইঙ্গিত থাকতে পারে না, তা ঠিক, কিন্তু এটা মনে রাখার মতো ঘটনা। আরো জানার ইচ্ছা হলো, তার সেই উন্মত্তটা কোনোদিকে বাঁক নেয়–তার ছেলের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলে কিনা সেটা দেখার বিষয়।
খুব ভালো ছেলে বেটসন, বললো শার্প, তবে একটু বদমেজাজী, অসংযমী এই যা। আর আহমেদ আলির ঘর থেকে কতকগুলো পর্নোগ্রাফির বই পাওয়া গেছে, এর থেকে বোঝা যায়, সার্চ করার কথা শুনে কেনই বা সে অমন রেগে গিয়েছিল। তারপর সেই ফরাসী মেয়েটি তো হিস্টিরিয়া রোগগ্রস্ত। আর সেই ভারতীয় মিঃ চন্দ্রলাল এটা একটা আন্তর্জাতিক ইস্যু করবে বলে হুমকি দিয়েছে। তার কাছ থেকে আপত্তিকর প্যামপ্লেট পাওয়া গেছে–আর একজন আফ্রিকানের কাছে ভয়ঙ্কর ধরনের স্যুভেনির ছিলো। অনুসন্ধান করতে গিয়ে মানুষের অদ্ভুত অদ্ভুত স্বভাবের পরিচয় পাওয়া গেছে–মিসেস নিকোলেটিস ও তার ব্যক্তিগত কাপবোর্ডের খবর শুনেছেন?
হা শুনেছি বৈকি!
দাঁত বার করে হাসলো ইনসপেক্টর শার্প। আমার জীবনে অভোগুলো খালি ব্র্যান্ডির বোতলের কথা কখনো শুনিনি। আর তিনি তো আমাদের ওপর পাগলের মতো খাপ্পা হয়ে উঠেছিলেন। হাসলো সে, তারপর ভীষণ গম্ভীর হয়ে বললো, কিন্তু আমরা যা খুঁজছিলাম পেলাম না সেটা। বৈধ ছাড়া অন্য কোনো পাসপোর্টের খোঁজ পেলাম না।
আপনি কি ভেবেছেন, আপনার কাছে সমর্পণ করার জন্য সেখানে নকল পাসপোর্ট রেখে দেওয়া হবে? আচ্ছা আপনি কি আগে কখনো পাসপোর্টের ব্যাপারে ২৬ নং হিকরি রোডে গিয়েছিলেন? ধরুন বছর ছয়েক আগে?
মাথা নাড়লো শার্প, তারপর সাবধানে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করলো এসবের কোনো মানে হয় না, সব শেষে বললো সে।
একেবারে শুরু থেকে আমরা যদি শুরু করি, তাহলেই এ সব কিছুর মানে খুঁজে পাওয়া যাবে।
শুরু থেকে বলতে আপনি কি বোঝাচ্ছেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
বন্ধু সেই ঝোলানো ব্যাগটা, নরমসুরে বললো পোয়ারো। একটা ঝোলানো ব্যাগ দিয়েই সব কিছু শুরু।
.
১১.
মিসেস নিকোলেটিস রাগে উত্তেজনায় চিৎকার করে বলে উঠলেন, আমি এখান থেকে চলে যাবো, যেখানেই যাই না কেন সেই জায়গাটা অন্তত এখান থেকে নিরাপদ হবে, সে আমি জোর গলায় বলতে পারি।
কিন্তু আপনার ভয় কিসের? আমি যদি জানতে পারতাম, সম্ভবতঃ আমি–
সেটা তোমার জানার কথা নয়। আমি তোমাকে কিছুই বলবো না। তুমি যেভাবে একনাগাড়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছে, সেটা আমি মানতে পারছি না।
আমি দুঃখিত।
এখন তুমি অপমানিত আমার রূঢ় ব্যবহারের জন্য। কিন্তু আমি কি সাধ করে এমন উত্তেজিত হয়েছি? ঐ পুলিসের লোকগুলো সার্চের নাম করে আমার বাড়ি তছনছ করে দিয়েছে। আমার বুকটা ভেঙ গেছে। এখন একটু ব্র্যান্ডি পেলে ভালো হয়–চলি, উইক এন্ডটা যেন তোমার ভালো ভাবে কাটে। শুভরাত্রি।
হিকরি রোডটা বেশ বড়, লন্ডনের বড় বড় রাস্তাগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম। রাস্তার শেষ প্রান্তে ট্রাফিক লাইট এবং একটা পাবলিক হাউস, দি কুইন্স নেকলেস। পথ চলতে চলতে পিছন ফিরে তাকাচ্ছিলেন মিসেস নিকোলেটিস। না পরিচিত কাউকে চোখে পড়ল না। দি কুইন্স নেকলেসের কাছে গিয়ে আর একবার অপরাধীর মতো ভয়ে ভয়ে চারদিক দেখে নিয়ে একা মেলুন বারে ঢুকে পড়লেন তিনি।
দ্রুত কয়েক ঢোক ব্র্যান্ডি গলাধঃকরণ করার পর একটু ধাতস্থ হলেন তিনি। তাকে আর ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে না। তবে পুলিসের উপর তার রাগ কমলো না। আজ পুলিস যেভাবে বাড়াবাড়ি করলে তাতে ছাত্রছাত্রীদের কাছে আর মুখ দেখাতে পারবেন না তিনি। মিসেস হার্বার্ডের একটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো। কেউঁকি কাউকে বিশ্বাস করতে পারে? ব্যাপারটা গেরোনিমোও জেনে গেছে। সম্ভবত সে তার বউকে বলবে, তার বৌ আবার ঝাড়ুদারনিকে বলবে, এই ভাবে পাঁচকান হতে হতে তার গোপন কথাটি সবাই জেনে যাবে শেষ পর্যন্ত। উঃ অসহ্য। তার মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো, তিনি আবার ব্র্যান্ডির ফরমাস করলেন। আজ তিনি আকণ্ঠ ব্র্যান্ডি পান করলেন। চোখ বুজে আসছিল তার আর চোখ বন্ধ করলেই তিনি যেন তার ভবিষ্যৎ দেখতে পান, অন্ধকারাচ্ছন্ন। তার গোপন পরিচয়টা পেয়ে সবাই যেন ঘৃণার চোখে দেখবে। অবশ্য এখানেই শেষ নয়, তারপর যখন তারা জানতে পারবে–তিনি আর চিন্তা করতে পারছেন না। দম বন্ধ হয়ে আসছিল মেলুন বারের বদ্ধ আবহাওয়ায়। তা তিনি এবার কোননারকমে উঠে দাঁড়ালেন, পা দুটো টলছিল। তবু সেই অবস্থায় তিনি বেরিয়ে এলেন, দি কুইন্স নেকলেস থেকে, তারপর খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে রাস্তায় নামলেন, দেওয়াল ঘেঁষে চলতে থাকলেন, একটু সময়ের জন্য যদি তিনি চোখ বন্ধ করেন
এই সময় সেইপথ দিয়ে পুলিস কনস্টেবল বটকে হেঁটে যেতে দেখা গেলো। একটু এগোতেই তাকে থামতে হলো একটা জটলা দেখে। অফিসার এখানে একজন মহিলা অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছেন–মনে হয় তিনি অসুস্থ কিংবা–ভীড়ের মধ্যে কে যেন বললো।
পুলিস কনস্টেবল বট ঝুঁকে পড়ে বৃদ্ধাকে পরীক্ষা করতে গিয়ে তার নাকে তীব্র ব্র্যান্ডির গন্ধ এসে লাগলো, আর তখনি সে বুঝলো, তার সন্দেহ ঠিকই।
বললো সে, মাতাল, চিন্তার কিছু নেই, আমরা দেখছি
.
এরকুল পোয়ারো রবিবারের প্রাতঃরাশ সেরে তার বসার ঘরে এসে বসল। টেবিলের উপর পরিষ্কার করে সাজানো চারটি ঝোলা ব্যাগ। মিঃ হিক-এর দোকান থেকে কেনা ঝোলানো ব্যাগের সঙ্গে জর্জের কিনে আনা বাকি ব্যাগগুলো থেকে কোনো অংশেই খারাপ নয়। কিন্তু তার কিনে আনা ব্যাগটা অনেক সস্তা।
মজার ব্যাপার তো, বলল পোয়ারো। স্থির চোখে তাকিয়ে রইল সে ঐ ব্যাগগুলোর দিকে। তারপর সেই ব্যাগগুলো পরীক্ষা করে দেখতে থাকলো। বাথরুম থেকে একটা ধানকাটার ছুরি নিয়ে এসে মিঃ হিক-এর দোকানে ঝোলানো ব্যাগটা কাটবার চেষ্টা করলো। ভালো করে পরীক্ষা করে সে দেখলল ব্যাগের ভেতরে লাইনিং-এর তলায় করোগেটেড কাগজের একটা আস্তরণ। ব্যাগের টুকরো টুকরো অংশগুলো আগ্রহ সহকারে দেখতে থাকলো পোয়ারো। এরপর সে অন্য ব্যাগগুলোর উপর ছুরি চালিয়ে অপারেশনের কাজ শেষ করে তার কাজ পর্যালোচনা করে দেখতে থাকল। তারপর রিসিভারটা তুলে ডায়াল করলো, সামান্য একটু দেরি হওয়ার পর দূরভাষে ইনসপেক্টর শার্পের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, পোয়ারো তখন তাকে বললো, দুটো জিনিস আমি জানতে চাই।
হোহো করে হেসে উঠল ইনসপেক্টর শার্প।
গতকাল আপনি বলেছিলেন গত তিনমাসে পুলিসি তদন্তের কাজে আপনি হিকরি রোডে গিয়েছিলেন। আপনি তারিখ আর সময়গুলো বলতে পারেন?
হাঁ, সে তো খুবই সোজা, ফাইল দেখে এখনি বলছি। কিছুক্ষণ পরে উত্তরভাষে তার কণ্ঠস্বর আবার আসে, গত ১৮ই ডিসেম্বর বেলা সাড়ে তিনটের সময় একজন ভারতীয় ছাত্রের আপত্তিকর কিছু প্রচার করার জন্য পুলিস সেখানে তদন্ত করতে যায়।
সে তো অনেকদিন আগে।
একজন ইউরোপীয় মোন্টাও জোনসকে পুলিস খুঁজছিল। কেমব্রিজে মিসেস এ্যালিস কমবকে হত্যা করার অপরাধে। অরিখ ২৪শে ফেব্রুয়ারি–তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা হবে। আবার ৬ই মার্চ সকাল এগারোটার সময় পুলিস সেখানে যায় ওয়েস্ট আফ্রিকার বাসিন্দা উইলিয়াম রবিনসনের খোঁজে। শেফিল্ড পুলিস তাকে খুঁজছিল।
আহ্! ধন্যবাদ।
তবে আপনি কি মনে করেন, সেই কেসগুলো এই কেসের সঙ্গে সম্পর্ক
পোয়ারো তার কথায় বাধা দিয়ে বললো, না, সেগুলোর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তদন্তের তারিখ আর সময় সম্পর্কে আমার আগ্রহ ছিলো।
আপনার কিরকম মনে হচ্ছে পোয়ারো।
শুনুন বন্ধু ঝোলা ব্যাগগুলো আমি কেটে টুকরো করে ফেলেছি। এটা খুবই মজার ব্যাপার, তারপর শান্ত ভাবে রিসিভার নামিয়ে রাখে সে, তারপর সে তার পকেটবুক থেকে গত পরশু মিসেস হার্বার্ডের দেওয়া পরিবর্তিত তালিকাটি হাতে নিয়ে তার উপর চোখ বোলাতে থাকলো। তালিকাটা ছিলো এইরকম :
একটা ঝোলানো ব্যাগ (লেন বেটসনের) ইলেকট্রিক বাল্বগুলো। ব্রেসলেট (জেনেভিভের) হীরের আংটি (প্যাট্রিসিয়ার) পাউডার কমপ্যাক্ট (জেনেভিভের) সান্ধ্যজুতো (সেলীর)। লিপস্টিক (এলিজাবেথ জনস্টনের) কানের দুল (ভ্যালেরির)। স্টেথোস্কোপ (লেন বেটসনের) বাথ সল্ট (?)। ছিন্নবিচ্ছিন্ন স্কার্ফ (ভ্যালেরির) ট্রাউজার (কলিনের) রান্নার বই (?)। বোরিক (চন্দ্রলালের)। কস্টিউম ব্রোচ (সেলীর) এলিজাবেথের নোটের উপর কালি ছিটানোর ঘটনা। (আমার সাধ্যমত এই তালিকা আমি তৈরি করেছি। এটা সম্পূর্ণ নির্ভুল নয়। হার্বার্ড)
এখন এই তালিকা থেকে অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বাদ দিতে হবে। এ ব্যাপারে তার কোনো ধারণা ছিলো না, ভাবল পোয়ারো। কে তাকে সাহায্য করতে পারে? আজ রবিবার, সম্ভবত বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী হোস্টেলে আছে। ২৬নং হিরি রোডে ফোন করলো সে। ফোনে মিস ভ্যালেরি জনহাউসের খোঁজ করতেই একটু পরে তার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো দূরভাষে। ভ্যালেরি জনহাউস কথা বলছি।
এ প্রান্ত থেকে এরকুল পোয়ারো। আমাকে তোমার মনে আছে?
নিশ্চয়ই মঁসিয়ে পোয়ারো, বলুন আপনার জন্য আমি কি করতে পারি?
তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে। এখুনি আমি হিকরি রোডে যাচ্ছি।
বেশ তো, আমি আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকবো, চলে আসুন।
কিছুক্ষণ পর গেরোনিমো পোয়ারোকে ভ্যালেরি জনহাউসের ঘরে নিয়ে এলো। ভ্যালেরি দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল তাকে স্বাগত জানানোর জন্য। খুব ক্লান্ত ভ্যালেরি, চোখের কোণে কালিমা পড়ে গেছে।
কথায় কথায় পোয়ারো তাকে জিজ্ঞেস করলো, মাদমোয়াজেল তুমি তো ছাত্রী নও, তাই না?
ওহো না। আমি চাকরীয়া। একটা বাসমেটিক ফার্মে?
পোয়ারো বললো, মাঝে মাঝে প্যারিসে আর কন্টিনেন্টে যাও।
ও হ্যাঁ, মাসে একবার বটেই, মাঝে মাঝে একবারের বেশিও হয়ে যায়।
মাফ করো আমাকে, হয়তো একটু বাড়তি কৌতূহল প্রকাশ করে ফেলেছি। কিছু মনে করলে না তো?
না, না, আপনি স্বচ্ছন্দে আপনার কৌতূহল প্রকাশ করতে পারেন।
ধন্যবাদ, এখানে একটু থেমে পোয়ারো জিজ্ঞেস করলো, তোমার ব্যাপারে ইনসপেক্টর জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন?
হা তাতো বটেই।
আর তুমি যা জানো সব তাকে বলেছিলে? আমার আশঙ্কা যদি সেটা সত্য হয়। পোয়ারোর দিকে তাকালো ভ্যালেরি, তার দুচোখ থেকে বিদ্রূপ ঝরে পড়ছিল। ইনসপেক্টর শার্পের প্রশ্নের উত্তরে আমি কি বলেছিলাম সেটা আপনি শোনেননি বলেই আপনার ধারণা যথাযথ নয়।
আহ, তা নয়, এ আমার একটা সামান্য অনুমান মাত্র। আমি এখানে এসেছি, বললো পোয়ারো, মিস প্যাট্রিসিয়া লেনের আংটি চুরির ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্ন করার জন্য।
প্যাট্রিসিয়ার বাগদানের আংটি? মানে তার মার বাগদানের আংটি? কিন্তু আপনি সেটা নিলেন কেন?
দু-এক দিনের জন্য ধার নিয়েছিলাম, এই আংটিটার প্রতি আমার খুব আগ্রহ ছিলো, বললো পোয়ারো। আগ্রহের কারণ–হঠাৎ সেটা উধাও হয়ে যাওয়া, আবার তেমনি হঠাৎ সেটা ফিরে আসা এবং আরো কিছু কারণ রয়েছে এর পিছনে। আংটিটা প্যাট্রিসিয়ার কাছ থেকে ধার নিয়ে আমি সোজা চলে যাই আমার এক বন্ধুর জুয়েলারির দোকানে, আমি তাকে হীরের ব্যাপারে রিপোর্ট দিতে বলি, তোমার মনে আছে মাদমোয়াজেল, আংটিটার দুপাশে দুটি পাথর ছিলো?
আমার তাই মনে হয়, তবে খুব ভালো ভাবে আমার মনে নেই।
কিন্তু সেটা তুমি নাড়াচাড়া করেছিলে। সেটা তোমার স্যুপের প্লেটে ছিলো। ঐভাবেই সেটা ফেরৎ এসেছিল।
ও হ্যাঁ এখন আমার মনে পড়েছে, আংটিটা আমি প্রায় গিলেই ফেলেছিলাম, মৃদু হাসলো ভ্যালেরি।
হ্যাঁ একটু আগে যা বলছিলাম, তা আমার সেই বন্ধু জুয়েলার কি বলেছিল জানো? তার উত্তর হলো পরের দুটো আদৌ হীরে ছিলো না। আসলে পরের দুটো ছিলো গোমেদ, সাদা গোমেদ।
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, অনিশ্চিতভাবে বললো, ভ্যালেরি সেগুলো প্যাট্রিসিয়া। হীরে বলেই মনে করতো, কিন্তু সেগুলো শুধু গোমেদ কি?
দ্রুত মাথা নাড়লো পোয়ারো, না, আমি তা ভাবিনি। তাংটিটি ছিলো বাগদানের, প্যাট্রিসিয়ার মা ছিলেন ভালো পরিবারের। তার স্বামীও ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের। কেউ কাউকে ঠকাতে পারে না, অতএব শেষে পোয়ারো বলে ফেললো, আমার মনে হয়, আসল হীরে দুটো বদল করা হয়েছিল, আর সেই সঙ্গে গোমেদ জাতীয় পাথর সেট করে দেওয়া হয় আংটিটাতে। এখানে একটু থেমে পোয়ারো বলল, সেই আংটিটা মাদমোয়াজেল মিলিয়ে নিয়েছিল আর তখনি ইচ্ছাকৃত ভাবে হীরের বদলে গোমেদ পাথর লাগিয়ে দেওয়া হয় তাতে।
তাহলে আপনি কি মনে করেন, সিলিয়াই ইচ্ছাকৃত ভাবে হীরে চুরি করেছিল।
না, বললো সে, আমার কি মনে হয় জানো তুমি, হ্যাঁ তুমিই সেই হীরে চুরি করেছিলে মাদমোয়াজেল।
জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো ভ্যালেরি জনহাউস, সত্যিই, মৃদু চিৎকার করে উঠলো সে, কিন্তু এর কোনো প্রমাণ আপনার কাছে নেই।
হ্যাঁ আছে বৈকি, তাকে বাধা দিয়ে পোয়ারো বললো, আমার কাছে প্রমাণ অবশ্যই আছে, একদিন সন্ধ্যায় আমি এখানে নৈশভোজ সারি। আমি লক্ষ্য করেছি যেভাবে এখানে স্যুপ দেওয়া হচ্ছিল, হয় সে তোমার প্লেটে সেই আংটি ফেলে রেখে থাকবে সবার অজান্তে, তা না হলে তুমি নিজেই তোমার এ কাজের মাধ্যমে নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
আপনার বলা শেষ? অবজ্ঞার সঙ্গে বললো ভ্যালেরি।
না, না একেবারেই নয়। পোয়রো বলে উঠলো, সেদিন সন্ধ্যায় সিলিয়া যখন স্বীকার করলো চুরির ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী তখন, কয়েকটা ছোট ছোট পয়েন্ট আমার নজরে পড়ে, যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, আংটিটার ব্যাপারে সে বলেছিল, সত্যি আমি বুঝতে পারিনি, আংটিটার দাম কতো হতে পারে জেনেই আমি তখন সেটা ফিরিয়ে দিই। মিস ভ্যালেরি, আংটির দাম সে কি করে জানবে? কে তাকে দামটা বলেছিল? তারপর আবার ছিন্নবিচ্ছিন্ন সিল্কের স্কার্ফের কথায় আসা যাক।
সিলিয়া বলেছিল, তাতে ভ্যালেরি কিছু মনে করব না–একটা ভালো স্কার্ফ নষ্ট হলে কেনই বা তুমি কিছু মনে করবে না? এর থেকে আমার ধারণা হলো, এ চুরির সব ঘটনাগুলো সিলিয়াকে ক্লিপ্টোম্যানিয়াক প্রতিপন্ন করা, কলিন ম্যাকনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, এ সবই কেউ হয়তো ভেবে থাকবে সিলিয়ার জন্য আর সে তুমি, হ্যাঁ তুমিই, তুমিই তাকে হীরের দাম বলেছিলে, তুমিই তার কাছ থেকে আংটিটা নিয়ে বুদ্ধি করে ফিরিয়ে দিয়েছিলে। আর তুমিই তাকে তোমার স্কার্ফটা দিয়েছিলে কেটে টুকরো করার জন্য।
আপনার কথাই ঠিক, ইনসপেক্টর শাপের কাছে যা করেনি ভ্যালেরি; পোয়ারোর কাছে শেষ অবধি তাই করলো। অকপটে স্বীকার করে বললো আমিই তাকে এসব ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিলাম।
কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করতে পারি?
অধৈর্য হয়ে ভ্যালেরি বললো, লক্ষ্য করেছিলাম, বেচারী সিলিয়া দারুণ ভালোবাসত কলিন ম্যাকনারকে, ছায়ার মতো অনুসরণ করতো তাকে, কিন্তু কলিন ভুলেও ওর দিকে তাকাত না। তবে কলিনকে আমি জানতাম ভাবপ্রবণ যুবক, মানুষের মনঃস্তত্ব ভালো বোঝে। যাহোক সিলিয়ার মানসিক যন্ত্রণা আমি সহ্য করতে পারলাম না। তাই একদিন গোপনে তার সাথে দেখা করে আমার পরিকল্পনার কথা তাকে বলি, এখানকার কিছু জিনিস তাকে দিয়ে চুরি করিয়ে আমি তাকে ক্লিপ্টোম্যানিয়াক প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম, সিলিয়া একটু নার্ভাস • হয়ে পড়ে, তবে পরে সেটার রূপরেখা দিতে গিয়ে রীতিমতো রোমাঞ্চ অনুভব করে, অবশ্য সিলিয়া বোকার মতো একটা কাজ করে বসে-বাথরুমে প্যাটের হীরের আংটিটা পড়ে; থাকতে দেখে সেটা তুলে নেয়। দামী আংটি সেটা চুরি গেলে দারুণ হৈচৈ পড়ে যাবে, পুলিস। আসবে, এসব কথা ভেবেই সেই আংটিটা আমি ওর কাছ থেকে নিয়ে নিই, পরে যেভাবেই হোক প্যাটের কাছে সেটা ফিরিয়ে দিতে হবে এই ভেবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পোয়ারো বললো, ঠিক এই রকমই আমি ভেবেছিলাম। কিন্তু আংটিটা ফেরৎ দেওয়ার আগে কি ঘটেছিল, তাই বলো। পোয়ারো তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে থাকে। হঠাৎ ভ্যালেরিকে অস্বস্তিবোধ করতে দেখা গেল।
পোয়ারোর দিকে না তাকিয়েই মাথা নিচু করে ভ্যালেরি উত্তরে বলতে শুরু করলো, আমি আপনাকে বলেছিলাম, আপনার কাছে আমি নিজেকে পরিষ্কার করে তুলতে চাই। তাই অকপটে স্বীকার করছি মঁসিয়ে পোয়ারো। আমি একজন জুয়ারী। ইদানীং জুয়ায় আমি কেবল হেরেই যাচ্ছিলাম, প্রচণ্ড অর্থাভাবে ভুগছিলাম। তাই প্যাটের সেই হীরের আংটির লোভটা সামলাতে পারলাম না, দামী হীরে মোটা টাকায় বিক্রি করে তার বদলে কম দামের গোমেদ সেট করিয়ে নিই তার আংটিতে একটা জুয়েলারী থেকে। তার পরের ঘটনা তো আপনি জানেনই, মানে কি ভাবে সেটা আমার স্যুপের প্লেটে রেখে দিই। কিন্তু সতোর সাথে আমি বলছি, এর জন্য সিলিয়া কখনোই দোষী হতে পারে না।
না, না, আমি বুঝি, পোয়ারো মাথা নেড়ে বলে, এটা খুবই সহজ স্রেফ একটা সুযোগ মাত্র, আর তুমি সেটা গ্রহণ করেছিলে, কিন্তু মাদমোয়াজেল একটা বিরাট ভুল তুমি করেছিলে।
আমি সেটা বুঝতে পারি, শুকনো গলায় বললো ভ্যালেরি, তারপরেই সে ভেঙ্গে পড়লো, কিন্তু তাতে কি হয়েছে? আমার অপরাধের কথা বলে দিন প্যাটকে, বলে দিন পুলিসকে, জানিয়ে দিন সারা বিশ্বকে, কিন্তু তাতে কি লাভ? এখন কিছু করলে সিলিয়ার হত্যাকারীর সন্ধান কি পাওয়া যাবে?
উঠে দাঁড়ালো পোয়ারো, কেউ তা জানে না, বললো সে, তবে প্রত্যেককেই খোলাখুলিভাবে আলোচনা করতে হবে। আমার জানার উদ্দেশ্য ছিলো, এই চুরির ব্যাপারে সিলিয়াকে কে অনুপ্রাণিত করেছিল। তুমি সেটা অকপটে স্বীকার করে আমার উদ্দেশ্য সফল করে তুলেছো, এখন বলছি প্যাটের কাছে গিয়ে তার আংটির ব্যাপারে তুমি তাকে সব খুলে বলো। এবং তোমার মানসিক যন্ত্রণার কথা প্রকাশ করো তার কাছে।
ঠিক আছে তাই করবো, প্যাটের কাছে সব কথা স্বীকার করে বলবো তাকে, আমার আর্থিক সচ্ছলতা এলে আমি তার আংটিতে হীরে বসিয়ে দেবো, সঁসিয়ে পোয়ারো আপনি কি তাই চান?
আমি ঠিক এটা চাই না, তবে এটাই পরামর্শ দেওয়ার মতন।
এই সময় হঠাৎ দরজা খুলে যেতে দেখা যায় এবং মিসেস হার্বার্ড ঘরে এসে ঢুকলো। তার মুখ দেখে মনে হলো শ্বাস নিতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। তার ওরকম অবস্থা দেখে মৃদু চিৎকার করে উঠলো ভ্যালেরি : কি ব্যাপার মা? কি হয়েছে?
একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে ভয়ার্ত গলায় বললো মিসেস হার্বার্ড, ওঃ প্রিয় ভ্যালেরি জানো মিসেস নিকোলেটিস আর আমাদের মধ্যে নেই। তিনি মারা গেছেন। গতরাত্রে তাকে রাস্তা থেকে পুলিস স্টেশনে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের ধারণা তিনি, তিনি–আমার মনে হয় মত্ত অবস্থায় ছিলেন
হা তিনি মদ খাচ্ছিলেন। যাই হোক, তিনি মৃত—
বেচারী বৃদ্ধা মিসেস নিক, কঁপা কাঁপা গলায় বললো ভ্যালেরি।
মাদমোয়াজেল, তুমি ওঁর খুব প্রিয় ছিলে, তাই না? নম্র গলায় বললো পোয়ারো।
হা, ওর সঙ্গে সবারই ভালোলাগার কথা। তিন বছর হলো আমি এখানে আছি। শুরুতে তিনি অতো বদমেজাজী ছিলেন না। মিসেস হার্বার্ড বলে উঠলো, গত একবছর থেকে তিনি যেন কোনো কিছুর আতঙ্কে ভুগছিলেন।
আতঙ্ক? পোয়ারো এবং ভ্যালেরি দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠলো! হতাশ সুরে বললো মিসেস হার্বার্ড, হ্যাঁ তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি এখানে নিরাপদ বোধ করছেন না। আমি তার কাছে তার ভয়ের কারণটা কি, জানতে চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে পাত্তা দেননি, বলতে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু এখন আমি অবাক হচ্ছি
পুলিস ওঁর মৃত্যুর কারণ কি বলেছে? জিজ্ঞেস করলো পোয়ারো বিমর্ষ গলায়।
মিসেস হার্বার্ড বললো, না, তারা কিছু বলেনি। মঙ্গলবার তদন্ত হবে
.
১২.
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের শান্ত একটা ঘর, একটা টেবিলের চারপাশে বসেছিল তারা চারজন, নারকোটিকস্ স্কোয়াডের সুপারিনটেন্ডেন্ট উইন্ডিং, কনফারেন্সের সভাপতি। তার পাশে বসে ছিল গ্ৰেহাউন্ডের সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে তরুণ ও আশাবাদী সার্জেন্ট বেল। ইনসপেক্টর শার্প হেলান দিয়ে বসেছিল। চতুর্থ ব্যক্তি হলো এরকুল পোয়ারো। টেবিলের উপর রাখা ছিলো একটা ঝোলানো ব্যাগ।
প্রথমে সুপারিনটেন্ডেন্ট উইন্ডিং মুখ খুললেন, সব সময়ই চোরাচালানের কারবার চলে আসছে, বিশেষ করে গত দেড় বছর ধরে তো বটেই। চোরাই জিনিসের মধ্যে হেরোইন সব থেকে বেশি উল্লেখযোগ্য। কন্টিনেন্টের সর্বত্র এর ঘাঁটি রয়েছে, ফরাসী পুলিস তো বোকা বনে গেছে কি করে এসব জিনিস ফ্রান্সে আসছে। আবার কি ভাবেই বা সেগুলো ফ্রান্সের বাইরে চলে যাচ্ছে।
আমার বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। পোয়ারো তার কথার জের টেনে বললো, যদি বলি আপনার সমস্যাটাকে মোটামুটি ভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম সমস্যা সাদা দ্রব্যগুলো কিভাবে এদেশে বিতরণ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো কিভাবে সেগুলো এদেশে চোরাচালান হয়ে আসছে আর তৃতীয় ও শেষ সমস্যা হলো কে এই ব্যবসা চালাচ্ছে আর আসল মুনাফাঁকে লুঠছে তা খুঁজে বার করা। আমি বলবো মোটামুটি ভাবে ঠিক এইরকমই, আমরা জানি এইসব মাদক দ্রব্য ছোট ছোট বিতরণকারীদের দ্বারা বিভিন্ন উপায়ে নাইটকারপাল ড্রাগ স্টোর্স এবং অন্য ডাক্তারদের কাছে বিতরণ করা হয় কিংবা ফ্যাশনপ্রিয় মহিলা, পোশাক প্রস্তুতকারক এবং হেয়ার ড্রেসারদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
তাতো হলো, কিন্তু কি ভাবে সেগুলো এদেশে চোরাচালান হয়ে আসছে সেটা জানতেই আমার আগ্রহ বেশি।
আহ! আমরা তো একটা দ্বীপে বাস করি। তাই এখানে সেই পুরানো পদ্ধতি অর্থাৎ সমুদ্রপথে হেরোইন পাচার হয়ে আসছে। কিন্তু অন্য জিনিসগুলোে? যেমন, ধরা যাক হীরে-জহরত।
এবার মুখ খুললো সার্জেন্ট বেল। স্যার এখানে এর রমরমা ব্যবসা চলছে। এই সব অবৈধ হীরে আর দামী পাথরগুলো চোরাপথে বেশির ভাগ আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়া থেকে এবং কিছু দূরপ্রাচ্য থেকে। সুপারিনটেন্ডেন্ট উইন্ডিং পোয়ারোর দিকে ফিরে বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, এইসব মাদকদ্রব্য আর হীরে-জহরত চোরাচালানের ব্যাপারে আপনার কি অভিমত?
দেখুন, বললো পোয়ারো, স্মাগলারদের দুর্বলতা চিরন্তনী, আজ না হয় কাল আপনার সব সন্দেহ অবশ্যই গিয়ে পড়বে এয়ারলাইন স্টুয়ার্ড, ছোট ছোট কেবিন সমেত উৎসাহী নৌ-বাইকের চালক, ফ্রান্সে যেসব মহিলারা নিয়মিত ভাবে ফ্রান্সে যাতায়াত করছে, যে সব আমদানীকারক আশাতিরিক্ত মুনাফা করে থাকে, যে সব লোক মূল আয়ের থেকে ব্যয় বেশি করে–এদের উপর। কিন্তু এই সব চোরাই জিনিস যদি একজন নিরীহ নির্দোষ লোককে দিয়ে আনানো হয়, সেক্ষেত্রে এদের চিহ্নিত করা খুবই কষ্টের ব্যাপার। ঝোলানো ব্যাগের দিকে উইন্ডিং হাত বাড়িয়ে বললেন, এটাই কি আপনার অভিমত?
হ্যাঁ। এখন আপনার শেষ সমস্যার প্রসঙ্গে আসা যাক। আজকের দিনে সেই সন্দেহজনক ব্যক্তিটি কে হতে পারে? ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কেউ একজন তো হতে পারে খুবই খাঁটি সত্য। বললেন উইন্ডিং। বেল ঝোলানো ব্যাগটা পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে নিরীক্ষণ করে তিনি আবার বললেন, এর মধ্যে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে অনায়াসে পাঁচহাজার পাউন্ড আনতে পারেন বলে?
হ্যাঁ, ঠিক তাই, বললো এরকুল পোয়ারো। এই ঝোলানো ব্যাগগুলো বাজারে বিক্রি হয় সম্ভবত একের অধিক দোকানে, দোকানের মালিক সম্ভবত এই র্যাকেটের সঙ্গে যুক্ত কিংবা নাও হতে পারে। হয়তো সস্তায় এইসব ব্যাগ বিক্রি করে শুধুই লাভ করে থাকে। অন্য বড় দোকানের থেকে এই দোকানের ব্যাগগুলো অনেক সস্তা আর মজবুতও বটে। এর পিছনে একটা বিরাট চক্র যে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লন্ডন ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল ছাত্রদের কিংবা ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকায় কাজ করে যাচ্ছে যারা তাদের একটা তালিকার উপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। এই সব ছাত্র-ছাত্রীরা দেশের বাইরে যায়, ফিরে আসে আসল ঝোলানো ব্যাগের পরিবর্তে ডুপ্লিকেট ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে। ছাত্রছাত্রীরা ইংল্যান্ডে ফিরে এলে তাদের ঝোলানো ব্যাগ হয় কাপবোর্ডে কিংবা ঘরের এক কোণায় ফেলে রাখে। এখানেও আবার এই ব্যাগগুলো হাত বদল হয়ে যায়।
আর আপনি মনে করেন, হিকরি রোডে এইরকমই কিছু ঘটেছিল?
মাথা নাড়লো পোয়ারো। হ্যাঁ আমার সেই রকমই সন্দেহ।
কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো এরকম সন্দেহ আপনার কি করে হলো?
সেখানে এইরকম একটা ঝোলানো ব্যাগ টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়, পোয়ারো বললো, তখনি আমার সন্দেহ হয়। কিছুদিন ধরে হিকরি রোডে পরপর কয়েকটা চুরির ঘটনা ঘটে যায়। সেই ঝোলানো ব্যাগটা অন্যতম। পরে সেটা টুকরো টুকরো অবস্থায় পাওয়া যায়। এইসব চুরির জন্য দায়ী মেয়েটি কয়েকটি জিনিস চুরির ব্যাপারে স্বীকার করলেও সে কিন্তু সেই ঝোলা ব্যাগ টুকরো টুকরো করার পিছনে নিশ্চয় অন্য কারণ আছে। আপনাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, চুরির ঘটনা প্রথম শুরু হয় যেদিন প্রথম হিকরি রোডে স্মাগলিং-এর খোঁজে পুলিস তদন্ত করতে যায়। আর সেইদিনই হয়তো সেখানে হেরোইন কিংবা দামী পাথর চোরাই চালান হয়ে এসে থাকবে সেখানে। মনে হয় বাইরে পুলিসের কেউ হিকরি রোডের উপর নজর রেখে থাকবে। তাই সেই ঝোলা ব্যাগটা কোথাও লুকনো কিংবা বদলে ফেলার উপায় ছিলো না। এখন কেবল একটা জিনিসই আপনি চিন্তা করতে পারেন, ব্যাগটা টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা, তারপর বয়লার হাউসের আবর্জনার মধ্যে লুকিয়ে রাখা। ওই বাড়িতেই সাদা দ্রব্য কিংবা দামী পাথর থাকলে সেগুলো সাময়িকভাবে বাথ সল্টের মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায়। কিন্তু খালি ঝোলা ব্যাগের লাইনিং-এর নিচে যদি সাদাদ্রব্য কিংবা হীরে জহরত লুকনো থাকতো, আর সেটা যদি পুলিসের নজর কাড়ত কঠোর পরীক্ষা কিংবা বিশ্লেষণ করা হলে অবশ্যই ধরা পড়ার আশা থাকতো, সুতরাং ঝোলা ব্যাগটা নষ্ট করার একান্ত দরকার ছিলো। সেটা যে সম্ভব আপনি একমত তো।
হা আগে যেমন বলেছিলাম, এ একটা পরিকল্পনা বটে, বললেন সুপারিনটেন্ডেন্ট উইন্ডিং।
এদিক ওদিক ছোটখাটো আরো কয়েকটা ঘটনা পর্যালোচনা করলে আরো সম্ভব হবে বলে মনে হবে। যেমন ধরুন হিকরি রোডের ইতালীয় চাকর গেরোনিমোর কথা অনুযায়ী পুলিস প্রথম যেদিন সেখানে যায়, সেখানকার হলঘরের বাল্বগুলো এমনকি বাড়তি বাল্বগুলোও সরিয়ে ফেলা হয়। এর থেকে মনে করা যেতে পারে যে সেখানে এমন কোনো অপরাধী ছিলো যার ভয় হয়েছিল, উজ্জ্বল আলোয় পুলিস তার মুখ দেখলে তাকে চিনে ফেলতে পারে, তাই সে আগেভাগে বাল্বগুলো সরিয়ে রেখেছিল। তবে এসবই আমার অনুমান মাত্র।
এ এক চতুর পরিকল্পনা, বললেন উইন্ডিং, আর তাই যদি হয়, তাহলে মনে হয় হিকরি রোডে আরো অনেক চমক অপেক্ষা করছে।
পোয়ারো মাথা নেড়ে তাকে সমর্থন করলো।
ও হ্যাঁ, ঐ সংস্থা বহু স্টুডেন্টস ক্লাব চালায়, পোয়ারো বলে, আর ঐ হোস্টেলের মালকিন মিসেস নিকোলেটিস সেই সব ক্লাবগুলো পরিচালনা করতেন।
চকিতে পোয়ারোর দিকে তাকালেন উইন্ডিং।
হ্যাঁ, বললো পোয়ারো, মিসেস নিকোলেটিসের অর্থের প্রতি খুব লোভ ছিলো, তবে তিনি নিজে স্বনামে সেই ক্লাবগুলো পরিচালনা করতেন না।
হুম! বললেন উইন্ডিং। আমার ধারণা মিসেস নিকোলেটিসের সম্পর্কে আরো বিশদ ভাবে জানতে হবে।
মাথা নাড়লো ইনসপেক্টর শার্প। আমরা তাঁর সম্পর্কে আরো খোঁজখবর নিচ্ছি স্যার। তবে একটা কথা বলতে পারি, আমরা সেদিন সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে গেলে দারুণ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন তিনি। শুধু তাই নয়, তিনি তার ঘরের কাপবোর্ডের চাবি কিছুতেই দিলেন না, তাই বাধ্য হয়েই তালা ভাঙতে হলো। শেষ পর্যন্ত তার সেই কাপবোর্ডের ভেতর থেকে গাদা গাদা খালি ব্র্যান্ডির বোতল বেরিয়ে আসে।
ব্র্যান্ডির বোতল? বললেন উইন্ডিং। তার মানে তিনি মদ্যপ ছিলেন? তাহলে ব্যাপারটা এখন বেশ সহজেই হয়ে গেলো। এখন তার খবর কি? তা তিনি কি এখন ফাঁদে পড়েছেন?
না স্যার, তিনি মৃত।
মৃত? উইন্ডিং-এর স্র উঁচু হলো। বুঝলে এ হলো বাঁদরের কারবার।
হ্যাঁ আমাদেরও তাই মনে হয়। বায়োপসি রিপোর্টের পর সব জানা যাবে। আমার মনে হয় তিনি বোধহয় মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন, হয়তো তিনি খুন নিয়ে দরদস্তুর করতে চাননি। তাই
আপনারা সিলিয়া অস্টিনের কেসের কথা বলছিলেন। এই মেয়েটি কি কিছু জানতো?
কিছু জানতো বৈকি সে, বললো পোয়ারো, কিন্তু সেভাবে দেখলে আমার মনে হয় না। তার সব জানার দরকার ছিলো, জানেন তো মেয়েটি সরল ও বোকা প্রকৃতির মেয়ে ছিল। সে যা দেখেছিলো কিংবা শুনেছিল সে কথা অন্য কাউকে বোকার মতো হয়তো বলে থাকবে।
তা সে কি দেখেছিল কিংবা শুনেছিল, এ ব্যাপারে আপনার কি ধারণা মঁসিয়ে পোয়ারো?
আমি আন্দাজ করতে পারি, বলল, তবে এর বেশি কিছু নয়, মনে হয় পাসপোর্টের ব্যাপারে। সে হয়ত শুনে থাকবে হিকরি রোডের কারোর নকল পাসপোর্ট ছিলো, অন্য নামে কন্টিনেন্টে যাতায়াত করবার জন্য। তাছাড়া সে হয়তো কাউকে সেই ঝোলা ব্যাগ নষ্ট কতে দেখে থাকবে কিংবা কাউকে সেটার নকল বোতাম অপসারণ করতে দেখে থাকবে, কিংবা কাউকে বাল্বগুলো সরাতে দেখে থাকবে। আর এসব ঘটনার গুরুত্ব তেমন উপলব্ধি না করে কোনো ছেলে কিংবা মেয়েকে বলে থাকবে।
ভালো কথা, শার্প বলে, এখন মিসেস নিকোলেটিসের অতীত জীবন সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে। মনে হয় তাহলেই অনেক তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে, তবে আমার মনে হয় না সত্যিই তিনি র্যাকেট চালাতেন।
মাথা নাড়ল পোয়ারো, না, আমিও তা মনে করি না, অবশ্য তিনি এই র্যাকেটের খবর জানতেন, কিন্তু তাই বলে এই নয় যে, এর পিছনে ব্রেন ছিলো। না একেবারেই নয়।
কার ব্রেন থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
আমি আন্দাজ করতে পারি–হয়তো আমি ভুলও করতে পারি। হ্যাঁ আমার ভুলও হতে পারে।
.
হিকরি ডিকরি ডক, বললো নিজেল, ঘড়ির উপর ছুটে যায় নেংটি ইঁদুর, পুলিস বলেছে, ছিঃ ছিঃ। আমার আশঙ্কা, প্রসঙ্গক্রমে কে ডকে গিয়ে দাঁড়াবে? সে আরো বলে, বলা কিংবা না বলা সেটা একটা প্রশ্ন।
কি বলবে? জানতে চাইলো লেন বেটসন।
মানে আমরা যা জানি, বললো নিজেল, আমাদের পরস্পরের সম্পর্কে হাজার হোক, আমরা পরস্পরের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। জানি না? একই বাড়িতে আমরা সবাই যখন বাস করি, জানতে বাধ্য।
কলিন ম্যাকনার গলা পরিষ্কার করে বললো, আমার মতে, বর্তমান অবস্থা আমাদের কাছে পরিষ্কার হওয়া উচিত, নিক এর মৃত্যুর আসল কারণ কি হতে পারে?
আমার মনে হয় ভ্যালেরি বলে, পুলিসী তদন্তের পর সব কিছু জানা যেতে পারে।
তাতে আমার সন্দেহ আছে, কলিন বলে, আমার মতে তারা পুলিসী তদন্ত মুলতুবি রাখবে।
আমার মনে হয় মিঃ অ্যাকিমবো বলে হয়তো কেউ তাকে খুন করে থাকবে, তাই নয় কি? প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকালো সে সপ্রশ্ন চোখে।
কিন্তু কেই বা তাকে খুন করতে যাবে? জানতে চাইলো জেনেভিভ, তিনি কি প্রচুর অর্থসম্পত্তি রেখে গেছেন? তিনি যদি বিত্তবান হতেন, আমার ধারণা সেটা সম্ভব।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত বদমেজাজী মহিলা, বললো নিজেল, আমি নিশ্চিত প্রত্যেকেই তাকে খুন করতে চাইবে। আমাদের প্রায়ই তাই মনে হতো। রিজেন্ট পার্কের মুক্তাঙ্গনে সেলী এবং অ্যাকিমবো মধ্যাহ্নভোজ করতে গিয়ে চন্দ্রলালের বোরিক পাউডার উধাও হওয়ার ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছিল।
বোরিক? আরে এতো মোটেই ক্ষতিকারক নয়। বলে উঠলো সেলী। এমনকি বোরিক তুমি চোখেও দিতে পার, চন্দ্রলাল বোরিক দিয়ে তার চোখ পরিষ্কার করতো। বোরিকের বোতল সে বাথরুমে রাখত। সেখান থেকেই সেটা উধাও হয়ে যায়। তাতে খুব রেগে যায় সে। তার এ বোরিকের ব্যাপারে তোমার কি মন্তব্য শুনি?
এক এক করে আমি তোমাকে বলব, কিন্তু দয়া করে এখনি জানতে চেও না। আমাকে আরো চিন্তা করতে দাও।
ভালো কথা। কিন্তু এ ব্যাপারে তুমি নাক গলাতে যেও না।
বলল সেলী, অ্যাকিমবো, আমি চাই না তুমি পরবর্তী সন্দেহে পরিণত হও।
ভ্যালেরি তোমার কি মনে হয় একটা ব্যাপারে তুমি আমাকে উপদেশ দিতে পারো? এ আমার বিবেকের প্রশ্ন, আর আজ ব্রেকফাস্টের টেবিলে নিজেল বলছিল, আমরা সবাই যখন কারোর ব্যাপারে কিছু জানি, আশা করি, তুমি নিশ্চয়ই বলতে পারবে, মানে আমি পাসপোর্টে কথা বলছি, বললো জিন।
পাসপোর্ট? বিস্মিত হয়ে ভ্যালেরি জিজ্ঞেস করলো, কার পাসপোর্ট?
নিজেলের, ওর একটা নকল পাসপোর্ট আছে।
আমি বিশ্বাস করি না, ভ্যালেরি বলে, দুর্ভাগ্য জিন, আসলে আমার বিশ্বাস এর একটা সহজ ব্যাখ্যা আছে, প্যাট আমাকে বলেছিল, নিজেল এখানে এসেছিল টাকা রোজগারের জন্য, একটা শর্তে তার নাম বদল করতে হবে, তবে আইনসম্মত ভাবেই সে তার নাম বদল করেছিল। আমার বিশ্বাস তার আসল নাম ছিলো স্ট্যানফিল্ড কিংবা স্ট্যানলি, এ ধরনের কিছু হবে।
উত্তেজিত অবস্থায় কমনরুমে ঢুকলো জেনেভিভ, সমবেত ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে তেমনি উত্তেজিত অবস্থায় বললো সে, আমি এখন নিশ্চিত, সম্পূর্ণ নিশ্চিত আমাদের প্রিয় বন্ধু সিলিয়াকে কে খুন করেছে আমি জানি।
কে সে জেনেভিভ? জিজ্ঞেস করলো জিন, তোমার এতো নিশ্চিত হওয়ার কারণ?
কমনরুমের দরজা বন্ধ আছে কিনা দেখে নিলো জেনেভিভ, তারপর গলার স্বর নিচে নামিয়ে এনে বললো সে, খুনী, খুনী হলো নিজেল চ্যাপম্যান।
নিজেল চ্যাপম্যান, কিন্তু কেন, কেন সে তাকে খুন করতে গেলো?
শোনো করিডোর দিয়ে যাচ্ছিলাম, প্যাট্রিসিয়ার ঘর থেকে নিজেলকে বলতে শুনলাম, তার বাবা নাকি তার মাকে খুন করেছিল। ওর বাবা স্যার আর্থার স্ট্যানলি, বিখ্যাত রিসার্চ কেমিস্ট এখন মৃত্যুশয্যায়। এই কারণেই সে তার নাম বদল করেছিল, ওর বাবা একজন অভিযুক্ত খুনী, আর বংশপরম্পরায় ওর বাবার চরিত্রের গুণই বলো বা দোষই বলো, সবই পেয়েছে নিজেল–
হ্যাঁ এটা সম্ভব, মিঃ চন্দ্রলাল তাকে সমর্থন করে বললো, অবশ্যই সম্ভব। নিজেল যেরকম ভয়ঙ্কর ছেলে, যেমন অসংযমী, সব পারে ও। নিজের উপর ওর যে আস্থা নেই, স্বীকার করো তো? তারপর অ্যাকিমবোর দিকে ফিরে তাকালো সে। উৎসাহ সহকারে মাথা নাড়ল সে, ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো বার করে খুশির হাসি হাসলো সে।
আমি সবসময়েই ভেবে এসেছি, বললো জিন, নৈতিকবোধ ছিলো না নিজেদের। একেবারে অধঃপতিত চরিত্র যাকে বলে।
হ্যাঁ এটা সেক্স মার্ডার। বললো মিঃ আহমেদ আলি। এই মেয়েটির সাথে শুতো সে। তারপর একদিন সে তাকে খুন করে, কারণ চমৎকার মেয়ে ছিলো সে, সম্মানিতা, বিয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল মেয়েটি
বাজে কথা, চিৎকার করে বলে উঠলো লিওনার্ড বেটসন।
.
১৩.
পুলিস স্টেশনে ইনসপেক্টর শার্পের কঠোর দৃষ্টির সামনে নিজেলকে ভীষণ নার্ভাস দেখাচ্ছিল।
আপনি বলছেন, বাইকারবোনেট বোতল যার মধ্যে মরফিন ছিলো, সেটা শেষ কখন মিস লেন দেখেছিল, ঠিক মনে নেই তার? ইনসপেক্টর শার্প দৃঢ়স্বরে বললো, মিঃ চ্যাপম্যান, আপনি যা বললেন, জানেন সেটা কি সাংঘাতিক হতে পারে?
অবশ্যই আমি বুঝতে পারছি, ব্যাপারটা জরুরী মনে না করলে আমি কখনোই এখানে আসতাম না।
তাহলে এখুনি একবার হিকরি রোডে যাওয়া উচিত। কথাটা ইনসপেক্টর শার্প শেষ করা মাত্র টেলিফোন বেজে উঠলো। রিসিভারটা তুলে নিলো শার্প।
মিস লেন কথা বলছি, দূরভাষে মেয়েলী কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। মিঃ চ্যাপম্যানের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
শার্প ইশারা করতেই এগিয়ে এসে রিসিভারটা তার হাত থেকে তুলে নিলো নিজেল। প্যাট? আমি নিজেল কথা বলছি।
শোনো নিজেল, আমার মনে হয়, আমি সেটা পেয়ে গেছি। মানে, আমি জানি আমার রুমালের ড্রয়ার থেকে কে সেটা নিয়েছিল। দেখো, এখানে মাত্র একজনাই–সেই মুহূর্তে মেয়েটির কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যায়। সে আর কথা শেষ করতে পারে না তার।
হ্যালো, হ্যালো প্যাট? কে, কে সে?
এখুনি তার নাম আমি বলতে পারবো না। পরে বলবো, তুমি এখানে ফিরে এলে বলবখন। আমি আমার ঘরে অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।
রিসিভারটা নামিয়ে রাখলো নিজেল। শার্প তার সব কথাই শুনেছিল কাছ থেকে, চলুন এখুনি ২৬নং হিকরি রোডের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া যাক। বললো শার্প।
হিকরি রোডের বাড়িতে পৌঁছেই নিজেল তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো প্যাটের ঘরে। তাকে অনুসরণ করলো ইনসপেক্টর শার্প।
হ্যালো প্যাট, আমরা এসে গেছি–নিজেলের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে গেলো ঘরে ঢোকা মাত্র।
মেঝের উপর প্যাট্রিসিয়া লেনের রক্তাক্ত দেহটা পড়েছিল, তার মাথা থেকে রক্ত তখনো ঝরে পড়ছিল ফোঁটা ফোঁটা
না? আঁতকে উঠলো নিজেল, না, না, না, এ হতে পারে না।
হ্যাঁ, মিঃ চ্যাপম্যান, মিস লেন মৃত।
না, না, প্যাট মরতে পারে না, বোকা মেয়ে প্যাট, কিন্তু কেমন করে খুন হলো
এটা দিয়ে।
সহজ, অতি সহজ, আধুনিক প্রথায় খুন, উন্নত ধরনের অস্ত্র, উলের মোজায় জড়ানো পেপারওয়েটের আঘাতে-মাথার পিছনে ওই অস্ত্রটা দিয়ে আঘাত করে ওকে হত্যা করা হয়েছে, অত্যন্ত কার্যকরী অস্ত্র, মেয়েটি জানতেও পারেনি, তার জীবনে কি ঘটতে যাচ্ছে।
নিজেল তার বিছানায় বসে পড়ে বলে উঠলো, ঐ উলের মোজাটা আমার জন্য বুনেছিল প্যাট-হঠাৎ শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।
শার্প তখন ঘটনাটা এইভাবে সাজাচ্ছিল : কেউ হয়তো ব্যাপারটা ভালো ভাবেই জানতো, তার নামটা প্যাট্রিসিয়া নিজেলের কাছে প্রচার করে দেওয়ার আগেই সে তাকে সরিয়ে দিয়ে থাকবে। যেই এমন নিষ্ঠুর কাজ করে থাকুক না কেন, আমি তার সন্ধান পেলে খুন করে ফেলবো তাকে। শুয়োরের বাচ্চা, খুনী।
শান্ত হোন মিঃ চ্যাপম্যান। শার্প তাকে বোঝায়, হা হা আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝি, এ এক ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। তাকে শান্ত করে শার্প এবার নিচু হয়ে মৃত প্যাট্রিসিয়ার হাতের দু আঙুলের ফাঁক থেকে কি যেন সংগ্রহ করে রাখলো।
.
ভয়ার্ত চোখে একের পর একটা মুখের দিকে তাকালো গেরোনিমো। আমি কিছুই দেখিনি। আমি কিছুই শুনিনি। আমি আপনাদের বলছি, আমি এসবের কিছুই জানি না। রান্নাঘরে মারিয়ার সঙ্গে ছিলাম
কেউ তোমাকে দোষী করছে না, বললো শার্প, আমরা শুধু জানতে চাই এক ঘণ্টার মধ্যে কে কে এ বাড়িতে এসেছিল, আর কারা কারা বাড়ির বাইরে গিয়েছিল? মানে সকাল ছটা থেকে ছটা পঁয়তিরিশ পর্যন্ত।
সবাই বাড়িতেই ছিলো, কেবল মিঃ নিজেল, মিসেস হার্বার্ড আর মিস জনহাউস ছাড়া, এঁরা সবাই ছটার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
এদের মধ্যে কে কখন ফিরে আসে? জিজ্ঞেস করলো শার্প।
মিসেস হার্বার্ড এখনো ফেরেননি, মিঃ চ্যাপম্যান তো আপনার সঙ্গেই ফিরে এলেন, আর মিস সেলী ফিরে আসেন ছটার একটু পরে। তখন খবর হচ্ছিল। খবরের কোনো অংশ হচ্ছিল তখন?
ঠিক মনে নেই। তবে খেলার খবরের ঠিক আগে কারণ খেলার খবর হতেই আমি টিভির সুইচ অফ করে দিই।
হাসলো শার্প, তার মানে, কেবল নিজেল চ্যাপম্যান, ভ্যালেরি জনহাউস এবং মিসেস হার্বার্ডকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। এর অর্থ হলো দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ। কে কে তখন কমনরুমে ছিলো? কে কে সেখান থেকে চলে যায়। আর কখন? কে কার হয়েই বা সাক্ষ্য দেবে, সেটাও একটা প্রশ্ন। বিশেষ করে এখানে যখন নানান দেশের ছাত্রছাত্রীরা রয়েছে, তার মধ্যে এশিয়া এবং আফ্রিকার ছাত্র-ছাত্রীরা অন্যতম।
মিসেস হার্বার্ডের ফেরার অপেক্ষা করছিল ইনসপেক্টর শার্প, একমাত্র সে-ই এখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃত গতিবিধির একটা নিখুঁত চিত্র তুলে ধরতে পারে। একটু পরেই হিকরি রোডের হোস্টেলে ফিরে এসে সেই বেদনাদায়ক ঘটনার কথা জেনে ভীষণ ভেঙ্গে পড়লো সে। শার্প তাকে শান্ত হতে বলে বললো, মিসেস হার্বার্ড, এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না, মনটা শক্ত করে আমার কয়েকটা প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিন।
বেশ বলুন, কি জানতে চান?
মৃত মিস প্যাট্রিসিয়ার ঘরের দুপাশের ঘর দুটোর বাসিন্দা কারা কারা?
একপাশে থাকে জেনেভিভ–কিন্তু তার আর প্যাটের ঘরের মাঝে পাকা দেওয়াল তোলা আছে। অপরদিকের ঘরটা এলিজাবেথ জনস্টনের মাঝখানে শুধুই একটা পার্টিশান ওয়াল।
তাহলে এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ওদের দুজনের মধ্যে একমাত্র এলিজাবেথই পার্টিশন ওয়ালের এপার থেকে ফোনে মিঃ চ্যাপম্যানের সঙ্গে প্যাট্রিসিয়ার আলোচনার কথা শোনার সম্ভাবনা রয়ে গেছে, অবশ্য সে যদি তার শয়নকক্ষে তখন থেকে থাকে। কিন্তু সেলী ফিঞ্চ তার চিঠি পোস্ট করতে যাবার সময় তাকে কমনরুমে দেখে গিয়েছিল বলে বলেছে সে, সবসময়েই যে কমনরুমে ছিলো সে, তা নাও হতে পারে।
হা একসময় সে তার বই আনতে উপরে উঠে গিয়েছিল, তবে ঠিক কোনো সময়ে কেউ খেয়াল করতে পারে না।
সে যাই হোক, মিসেস হার্বার্ড বলে, ওদের দুজনের মধ্যে কেউ একজনই সন্দেহভাজন ব্যক্তি বলে মনে হয়।
ওদের জবানবন্দী মতো বলবো-হা, কিন্তু আমরা যে একটা বাড়তি প্রমাণ হাতে পেয়েছি-শার্প তার পকেট থেকে একটা খাম বার করলো।
ওটা কি?
হাসলো শার্প, কয়েকগাছা চুল, মৃত প্যাট্রিসিয়া লেনের আঙুলের ফাঁক থেকে এগুলো আমি সংগ্রহ করেছি।
তার মানে আপনি বলতে চান–
এই সময় দরজায় নক করার শব্দ হলো, ভেতরে আসুন, সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো ইনসপেক্টর।
দরজা ঠেলে হাস্যরত অবস্থায় মিঃ অ্যাকিমবোকে ঘরে ঢুকতে দেখা গেলো, কি ব্যাপার কিমিস্টার?
আমার মনে হলো আপনাকে কিছু বলা দরকার। এই বেদনাদায়ক নিষ্ঠুর রহস্যজনক ঘটনার ব্যাপারে হয়তো আমি কিছু আলোকপাত করতে পারি।
.
১৪.
হ্যাঁ, বলুন মিঃ অ্যাকিমবো, আপনি কি বলতে চান?
দেখুন মিঃ শার্প আমি প্রায়ই পেটের অসুখে ভুগে থাকি, হঠাৎ একদিন রাতে পেটের যন্ত্রণায় কমনরুমে ছুটে যাই, কেবল এলিজাবেথই সেখানে ছিলো, আমি ওকে বলি তোমার কাছে বাইকারবোনেট কিংবা স্টমাক পাউডার আছে? আমারটা ফুরিয়ে গেছে, উত্তরে সে বলে, আমার কাছে তো নেই, তবে রুমাল ফেরত দিতে গিয়ে সেই ওষুধ প্যাটের ড্রয়ারে দেখেছিলাম। ঠিক আছে। আমি তোমার জন্য একটু বাইকারবোনেট এনে দিচ্ছি। ও তখন উপরতলায় গিয়ে বাইকারবোনেটের বোতল এনে আমার হাতে তুলে দিল। আমি তখন পুরো এক চামচ বাইকারবোনেট পাউডার খেয়ে নিই, কিন্তু তারপর থেকে পেটের যন্ত্রণার উপশম হওয়া দূরে থাক, আমার তখন নতুন এক শারীরিক যন্ত্রণা দেখা দিলো। তখন আমি সেই বাইকারবোনেটের বোতলটা একজন কেমিস্টকে পরীক্ষা করতে বলি। সেটা পরীক্ষা করে সে আমাকে জানিয়ে দেয়, বোতলের পাউডার বাইকারবোনেট ছিলো না, তার বদলে সেটার মধ্যে বোরিক পাউডার রাখা হয়েছিল।
বোরিক? হতভম্বের মতো স্থির চোখে তাকালো ইনসপেক্টর শার্প। কিন্তু সেই বোতলে বোরিক পাউডার স্থান পেলো কি করে? আর মরফিয়া পাউডারই বা গেলো কোথায়? চিৎকার করে উঠলো সে। এ সবই বিক্ষিপ্ত ঘটনা। আমি তাই মিস সিলিয়ার কথা ভাবছি, কি করে তার জবানীতে লেখা সেই চিরকুটটা রেখে গিয়ে থাকবে–যাতে করে মনে হতে পারে আত্মহত্যা করেছে সে।
তার কথায় সায় দিলো ইনসপেক্টর শার্প।
কিন্তু কে, কে এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে? নিশ্চয়ই এ কাজ কোনো মেয়ের? কারণ মেয়েদের ব্লকে কোনো ছাত্র কিংবা পুরুষ তো ঢুকতে পারে না, অ্যাকিমবো বলে, তবে সিলিয়ার ঘরের পাশে একটা ভোলা ব্যালকনি আছে। সুতরাং কোনো পুরুষ আর সে যদি ভালো এ্যাথলিট হয়, অনায়াসে সেই ব্যালকনি টপকে সিলিয়ার ঘরে প্রবেশ করতে পারে। সিলিয়ার ঘরের ঠিক সামনে অন্য কারুর ঘর, মিসেস হার্বার্ড একটু চিন্তা করে বললো, নিজেলের আর-আর
লেন বেটসনের, বললো ইনসপেক্টর। তার হাতের সেই খামের ভেতরে সযত্নে রাখা দুগাছা লাল চুলের কথা মনে পড়ে গেলো তার–লেন বেটসন তার মাথার চুলও লাল, কোঁকড়ানো।
না, না, লেন বেটসন খুব ভালো ছেলে আমার খুব প্রিয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলো মিসেস হার্বার্ড। হয়তো ও একটু বদমেজাজী ছেলে, কিন্তু এ কাজ ও কিছুতেই করতে পারে না, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
হ্যাঁ তা ঠিক, শার্পের চোখ দুটো ঝলসে উঠলো, আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সাধারণত সব খুনীই একটা না একটা ঠিক ভুল করবেই।
ম্যাকরিনা ফেয়ার সাইনবোর্ড টাঙ্গানো দোকানের সামনে এসে থামলো ডিটেকটিভ কনস্টেবল ম্যাকরে এবং সার্জেন্ট কব। আমরা বোধহয় ঠিক জায়গাতেই এসেছি, বললো সার্জেন্ট কব। কাউন্টারে একজন মহিলাকে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো সার্জেন্ট কব। সুপ্রভাত ম্যাডাম। সম্ভাষণ জানিয়ে সার্জেন্ট কব তার পরিচয় পত্রটা এগিয়ে দিলো মেয়েটির দিকে। সেই সঙ্গে একটা সার্চ ওয়ারেন্ট।
আমি মিসেস লুকাস, এই দোকানের মালকিন। সে আরো বলে, আজ আমার পার্টনার মিস জনহাউস আসেনি।
না, ম্যাডাম, বললো সার্জেন্ট কব, তার কাছে এটা কোনো খবরই নয়।
আপনার এই সার্চ ওয়ারেন্ট মনে হচ্ছে একেবারে উঁচুতলার হুকুম, বললো মিসেস লুকাস। এটা মিস জনহাউসের প্রাইভেট অফিস। আমি আন্তরিক ভাবেই আশা করি, আমাদের খদ্দেরদের অযথা হয়রানি করবেন না।
আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই, বললো কব, আমরা যেটা খুঁজছি সেটা পাবলিক রুমে থাকার কথা নয়।
মিনিট পনেরো মিস জনহাউসের অফিসের টেবিল ড্রয়ার ঘাঁটাঘাঁটির পর সার্জেন্ট কবের চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ম্যাকরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো সে, পেয়েছি বস্।
একেবারে নিচের ড্রয়ার খুলতেই আধডজন গাঢ় নীল রং-এর বই বেরিয়ে এলো, বইগুলোর উপর সোনালী অক্ষরে লেখা।
পাসপোর্ট, বললো সার্জেন্ট কব। পাসপোর্টগুলো বার করে ফটোগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেললো সে, ম্যাকরে ঝুঁকে পড়লো তার কাঁধের উপর দিয়ে দৃষ্টি ফেলে।
একই মহিলা বলে চলে মুশকিল, পারবে তুমি চিনতে? বললো ম্যাকরে। সেই পাসপোর্টগুলো ভিন্ন ভিন্ন নামের–মিসেস দ্য সিলভিয়া, মিস আইরিস ফ্রেঞ্চ, মিসেস ভলগা কোহন, মিয়লিনা লে মেজারিয়ার, মিসেস গ্লেডিস থমাস এবং মিস ময়রা ওনীল। তাদের বয়স পঁচিশ থেকে চল্লিশ। প্রত্যেকের হেয়ার স্টাইল আলাদা ধরনের বললো কব। এখানে আরো দুটো বিদেশী পাসপোর্ট রয়েছে–ম্যাডাম মাদমৌদি, আলজিরিয়; শীলা ডোনাভান, আইরিশ, আমি বলবো, এইসব বিভিন্ন নামের ব্যাঙ্ক একাউন্ট আছে তার।
বেশ জটিল ব্যাপার, তাই না?
জটিল হতে বাধ্য, চোরই চালান করে অর্থ উপার্জন তেমন কষ্টকর ব্যাপার নয়। কিন্তু সেইসব অবৈধ উপার্জনের টাকার হিসেব রাখাটাই ঝামেলার ব্যাপার। আমি বাজি ধরে বলতে পারি এই কারণেই ঐ মহিলা মেফেয়ারে এই গ্যাম্বলিং ক্লাব খুলে বসেছে। জুয়ায় উপার্জিত অর্থের উপর ইনকামট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের কিছু করার নেই। আর আমার মনে হয় এ ধরনের একটা নকল পাসপোর্ট বেচারী সিলিয়া হয়তো হিকরি রোডে দেখে থাকবে। সেই কারণেই তাকে অসময়ে চলে যেতে হলো এই পৃথিবী থেকে।
মিস জনহাউসের এটা একটা চতুর পরিকল্পনা, বললো ইনসপেক্টর শার্প। তাস খেলার মতো পাসপোর্টগুলো সাফল করলো সে। হ্যাঁ অবশ্যই এটা তার চতুর পরিকল্পনা। এটা আবিষ্কারের মূলে মঁসিয়ে পোয়ারো। ধন্যবাদ তাকে। তিনি এখানে আমাদের মধ্যেই রয়েছেন। এখন সেই মহিলার সম্বন্ধে তার অভিমত শোনা যাক।
.
হাসছিল পোয়ারো। প্রশংসার চোখে তার দিকে তাকালো মিসেস হার্বার্ড। আলোচনা হচ্ছিল তার বসবারঘরে।
মিস ভ্যালেরি জনহাউস দারুণ লোভাতুর হয়ে উঠেছিল প্যাট্রিসিয়ার সেই হীরের আংটিটা দেখে। লোভ সামলাতে পারেনি। তার সেই আংটি থেকে আসল হীরে সরিয়ে সাদা গোমেদ পাথর বসিয়ে দেয়। অথচ চুরির দায়ে অভিযুক্ত হয় সিলিয়া। মিস জনহাউসের সেই কাজ দেখে তখনি আমার মনে হয়েছিল, কি সাংঘাতিক চতুর এই মহিলাটি।
কিন্তু খুন, বললো মিসেস হার্বার্ড।
ঠান্ডা মাথায় খুন, সত্যি আমি এখনই বিশ্বাসই করতে পারছি না।
বিমর্ষ দেখায় ইনসপেক্টর শার্পকে।
এখনো পর্যন্ত সিলিয়া অস্টিনকে খুন করার মতো নির্দিষ্ট প্রমাণ আমরা পাইনি তার বিরুদ্ধে, বললো শার্প। অবশ্য সে যে স্মাগলিং-এর কারবারে যুক্ত তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। হয়তো সে নিজেলের বাজিধরা আর তার কাছে মরফিয়া থাকার কথা সে জানতো। কিন্তু এ ব্যাপারে সত্যিকারের কোনো প্রমাণ নেই। তাছাড়া আরো দুটি মৃত্যু ঘটে গেছে। এখানে, মিসেস নিকোলেটিকে সে বিষ খাইয়েছিল মেনে নিলাম–কিন্তু অপর পক্ষে প্যাট্রিসিয়া লেনকে সে নিশ্চয়ই খুন করেনি। আসলে একমাত্র সেই–এ সব ব্যাপারে একেবারে সন্দেহ মুক্ত, গেরোনিমো বলেছিল মিস জনহাউস ঠিক ছটার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। জানি না ঐ মেয়েটি তাকে ঘুষ দিয়েছিল কিনা–
না, মাথা দুলিয়ে পোয়ারো বলে, সে তাকে ঘুষ দেয়নি।
হিকরি রোডের একেবারে শেষ প্রান্তের একটা কেমিস্টের দোকান থেকে মিস জনহাউস ফেস পাউডার আর এ্যাসপিরিন কিনে তাদের ফোন ব্যবহার করেছিল, এর প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। ছটা পনেরোয় কেমিস্টের দোকান ছেড়ে চলে আসে সে।
পোয়ারো আবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। হ্যাঁ এই খবরটাই তো চমৎকার। বলে সে, আমরা তো এই খবরটাই চাইছিলাম। মানে বাইরে কোথা থেকে ফোন সে করেছিল কিনা। তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো ইনসপেক্টর শার্প।
মঁসিয়ে পোয়ারো, এখন আমাদের জ্ঞাত ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা যাক। দেখা যাচ্ছে, ছটা আট মিনিটের সময় প্যাট্রিসিয়া লেন বেঁচে ছিলো, কারণ ঠিক ঐ সময় এই ঘর থেকে পুলিস স্টেশনে ফোন করেছিল সে।
এ ব্যাপারে আপনি একমত? আমার মনে হয় না, এই ঘর থেকে ফোন করেছিল সে। এমনকি হলঘর থেকে নয়।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইনসপেক্টর শার্প। আমার ধারণা ফোনটা এসেছিল পুলিস স্টেশন মারফৎ। আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন না। আমি আমার সার্জেন্ট, পুলিস কনস্টেবল আর নিজেল চ্যাপম্যান সবাই অলীক অস্তিত্বের বিশ্বাসের শিকার হয়ে পড়েছিলাম?
অতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে বলতে পারি না। ফোনটা এসেছিল কেমিস্টের দোকানের কলবক্স থেকে।
সঙ্গে সঙ্গে ইনসপেক্টর শপের চোয়াল ঝুলে পড়তে দেখা গেলো। তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, ফোনটা করেছিল ভ্যালেরি জনহাউস? অর্থাৎ প্যাট্রিসিয়া লেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল সে, আর প্যাট্রিসিয়া লেন আগেই মারা গিয়েছিল?
হ্যাঁ আমি সেটাই বোঝাতে চেয়েছি?
এক মুহূর্ত নীরব থেকে টেবিল চাপড়ে মৃদু চিৎকার করে বলে উঠলো ইনসপেক্টর, এ আমি বিশ্বাস করি না। আমি নিজের কানে মেয়েটির কণ্ঠস্বর শুনেছিলাম।
হ্যাঁ আপনি একটা মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন, এক নিঃশ্বাসে বলা উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। কিন্তু প্যাট্রিসিয়া লেনের কণ্ঠস্বর আপনার ভালো করে অবশ্যই জানা নেই।
সম্ভবত আমার জানা নেই। কিন্তু নিজেল চ্যাপম্যান? সেও তো ফোনটা ধরেছিল, নিজেলও যে প্রতারিত হয়েছিল একথা বলতে পারেন না। সেই কণ্ঠস্বর প্যাটের না হলে তিনি ঠিক ধরে ফেলতে পারেন।
হা, বললো পোয়ারে, নিজেল চ্যাপম্যান জেনে থাকতে পারেন। নিজেল বেশ ভালোভাবেই জানতেন যে সেই কণ্ঠস্বর প্যাট্রিসিয়ার ছিলো না। তার থেকে ভালো আর কেই বা জানতে পারে বলুন। কারণ নিজের হাতে পিছন থেকে পেপারওয়েটটা দিয়ে প্যাট্রিসিয়ার মাথায় আঘাত করে এসেছিল সে, পুলিস স্টেশনে যাওয়ার খানিক আগে।
চুপ হলেন শার্প। সম্বিৎ ফিরে পেতে তার বেশ কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো। নিজেল চ্যাপম্যান? প্যাট্রিসিয়া লেনের খুনী নিজেল চ্যাপম্যান? কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, কেন, কেনই বা সে তাকে হত্যা করতে গেলো? হয়তো সিলিয়া অস্টিন খুন করতে পারে প্যাট্রিসিয়া লেনকে, কিন্তু কেন?
.
সেটা, বললো পোয়ারো, কারণটা আমাদের খুঁজে বার করতে হবে।
আপনাকে অনেকদিন দেখিনি, বৃদ্ধ উকিল মিঃ এন্ডিকট বললো এরকুল পোয়ারোকে। তা এসেছেন ভালোই করেছেন। সেঁতো হাসি হাসল সে। আমি তো ভেবেছিলাম, আপনি বুঝি অবসর নিয়েছেন।
আজ আমি এখানে এসেছিলাম একজন অত্যন্ত পুরানো মক্কেলের সাথে দেখা করার জন্য, এখনো আমি দু-একজন পুরানো বন্ধুর কেস নিয়ে থাকি। স্যার আর্থার স্ট্যানলি আমাদের একজন পুরানো বন্ধু এবং মক্কেল, তাই না?
হ্যাঁ, আমার পর আইন সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ শেষ করেছিলাম, সে ছিলো অত্যন্ত বুদ্ধিমান তার স্নায়ুকোষগুলো সবার থেকে আলাদা ছিলো। আমার বিশ্বাস, তার মৃত্যুর খবরটা গতকাল ছটার সময় ঘোষিত হয়েছিল।
হ্যাঁ, শুক্রবার তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হবে। কিছুদিন ধরে কঠিন অসুখে ভুগছিল সে। লেডী স্ট্যানলি তো বছর আড়াই আগে মারা যায়। তার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল বলতে পারেন?
সঙ্গে সঙ্গে উকিল ভদ্রলোক উত্তর দেয়, অতিরিক্ত ঘুমের পিল খেয়ে। পুলিসী তদন্ত হয়েছিল। তাদের রিপোর্টেও সেই একই কথা লেখা হয়েছিল দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু।
তার মৃত্যু সত্যি সত্যি কি সেইভাবে হয়েছিল?
এক মিনিট নীরব থেকে বললো মিঃ এন্ডিকট, আমি আপনাকে অপমান করব না। আপনার এরকম প্রশ্ন করার ভালোরকম যুক্তিই যে আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এন্ডিকট বলে চলে কিন্তু তার স্বামী তার সাক্ষ্যে বলে। তার স্ত্রী অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়ে পড়তো। এমনিতে অতিমাত্রায় ঘুমের পিল খেতো, সে বিনিদ্র রজনীর অবসান করার জন্য। তার উপর খেয়েছে কিনা বুঝতে না পেরে দ্বিতীয় দফায় ঘুমের পিল খেয়ে নিতো। মনে হয় ঘটনার দিন সে এই ভাবে দু-তিনবার ঘুমের পিল খেয়ে থাকবে। আর তাতেই তার মৃত্যু ঘটে থাকবে। পুলিসের কাছে এইরকম একটা জবানবন্দী গিয়েছিল স্যার আর্থার স্ট্যানলি।
মিথ্যে বলেনি তো সে?
সত্যি পোয়ারো। অবান্তর প্রশ্ন। আপনি একথা ভাবতে পারলেন কি করে?
হাসলো পোয়ারো। ভাববার কারণ আছে বলেই তো বলছি, পোয়ারো বলে, এমনো তো হতে পারে, অন্য কোনো নারীকে বিয়ে করার জন্য সে তার স্ত্রীকে সরিয়ে দিয়েছিল?
না, তার জীবনে অন্য আর কোনো নারী ছিল না। সে তার স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত ছিলো।
হ্যাঁ তা বটে আমিও তাই মনে করি, বললো পোয়ারো, এখন যে কারণে আসা সেটা বলি–আপনি একজন সলিসিটর, আর্থার স্ট্যানলির উইল তো আপনি তৈরি করেছিলেন? আর সম্ভবত আপনিই তার একজিকিউটর?
হ্যাঁ ঠিক তাই।
আর্থার স্ট্যানলির একটি ছেলে ছিলো, শুনেছি সেই ছেলেটি তার মার মৃত্যুর পর বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে চলে আসে। এতোই সে তার বাবার উপর রেগে যায় যে, সে তার নাম অব্দি বদলে ফেলে!
তা আমার অজানা, অন্য কি নামে সে তার পরিচয় দিয়েছিল?
সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। আমার মনে হয় আর্থার স্ট্যানলি আপনার কাছে সীলমোহর করা চিঠি রেখে গেছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে কিংবা তার মৃত্যুর পর সেটা ভোলা যেতে পারে।
সত্যি পোয়ারো, বয়সের এই মধ্যগগনে আজও আপনি জ্বলজ্বল করছেন। চিঠির ব্যাপারটা আপনি জানলেন কি করে?
তাহলে আমার অনুমান ঠিক? আমার আরো মনে হয়, সেই চিঠিতে একটা বিকল্প ব্যবস্থাও ছিলো। হয় সেই চিঠিটা নষ্ট করে ফেলতে হবে কিংবা প্রয়োজনে আপনাকে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
আপনি যখন সবই জানেন, বললো এন্ডিকট, আপনি যা যা জানতে চাইবেন সবই বলবো আপনাকে। আমি জানতাম যে আপনার পেশাগতভাবে তরুণ নিজেল সম্পর্কে আপনি অনেক কিছুই জেনে ফেলেছেন। তা এই শয়তানটা এখন কি করছে জানতে পারি?
আমার মনে হয় তার কাহিনি এই রকম : বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর সে তার নাম বদলে পরিচয় দেয় নিজেল চ্যাপম্যান হিসাবে তারপর সে এক স্মাগলিং র্যাকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ড্রাগ আর জুয়েলারীর চোরাচালান। অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের স্মাগলিং-এর কাজে লাগায় সে। নিজেল চ্যাপম্যান আর এক তরুণী মিস ভ্যালেরি জনহাউস এই র্যাকেটের অংশীদার। চোরাচালানের ব্যবসা তাদের বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু মাঝপথে যে হোস্টেলে তারা এই পাপব্যবসা চালাতে সেখানকার দুজন ছাত্রী আর হোস্টেলের একজন পার্টনার মিসেস নিকোলেটিসের কাছে কোনো ব্যাপারে ধরা পড়ে যায়। তখন সে পুলিসের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তাদের তিনজনকে হত্যা করে। তার খুনের মোটিভও আমাদের কাছে এখন আর অজানা নয়। তবে তার বিরুদ্ধে খুনের নির্দিষ্ট চার্জ আনার জন্য তার অতীত ইতিহাস আমাদের জানা দরকার। আমার ধারণা তার বাবা আর্থার স্ট্যানলি তার সেই চিঠিতে নিশ্চয়ই নিজেল সম্পর্কে কটাক্ষ করে গেছেন। তাই আপনাকে আমার একান্ত অনুরোধ আপনি যদি সেই চিঠিটা আমাকে একবার দেখান
বেশ তো, এখনি দেখাচ্ছি। মিঃ এন্ডিকট উঠে দাঁড়ালো। ঘরের শেষ প্রান্তে একটা আলমারি থেকে একটা লম্বা খাম বার করে এনে পোয়ারোর হাতে তুলে দিলো। আর্থার স্ট্যানলি মৃত। তার আগেই সেই খামের সীলমোহর ভেঙ্গে রেখেছিল সে। খামের ভেতর থেকে দুটি চিঠি বেরিয়ে এলো। প্রথম চিঠিটার ভাষা এইরকম : প্রিয় এন্ডিকট,
আমার মৃত্যুর পর তুমি চিঠিটা খুলবে, আমার ইচ্ছে আমার পুত্র নিজেলের খোঁজ করবে তুমি। খবর নিও, সে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছে কিনা, এখানে যে ঘটনার কথা বলতে যাচ্ছি সেটা কেবল আমি একাই জানি। নিজেলের চরিত্র কোনো সময়েই সন্তোষজনক ছিলো না। দু-দুবার সে আমার সই জাল করে আমার ব্যাঙ্ক থেকে চেক ভাঙ্গায়। কিন্তু আমি তাকে সাবধান করে দিই, তৃতীয়বার এরকম অপরাধ সে যেন আর না করে।
তৃতীয়বার সে তার মায়ের সই জাল করে আমার ব্যাঙ্ক থেকে চেক ভাঙ্গায়। নিজেকে এর জন্য চার্জ করে। আমি তাকে নীরব থাকার জন্য অনুরোধ করি। সে আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে নিজেলের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে যায়। প্রতি সন্ধ্যায় আমার স্ত্রীকে ঘুমের পিল খাওয়ানোর দায়িত্ব ছিলো নিজেলের। ঘুমের পিলের প্রতিক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে আমার স্ত্রী আমার কাছে এসে সব খুলে বলে পরদিন সে নিজেলের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। কিন্তু পরদিন সকালে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, আমি বেশ ভালো করেই জানি, তার মৃত্যুর জন্য কে দায়ী।
নিজেলকে তার মায়ের হঠাৎ মৃত্যুর জন্য অভিযুক্ত করে আমি বলি, পুলিসের কাছে তার নামে আমি অভিযোগ করবো। সে তখন বেপরোয়া ভাবে আমাকে অনুরোধ করে পুলিসকে না জানানোর জন্য। এন্ডিকট, আমার মতো অবস্থায় পড়লে তুমি কি করতে? আমার অপরাধী ছেলের জন্য আমার কোনো মোহ নেই। তাকে বাঁচানোর কোনো কারণও দেখতে পাচ্ছি না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কেউ একবার খুন হলে বার বার খুনী হতে বাধ্য সে। ভবিষ্যতে আরো অনেকে তার শিকার হতে পারে। আমি আমার ছেলের সঙ্গে দরদস্তুর করলাম, জানি না ঠিক করলাম, নাকি ভুল করলাম। তাকে তার দোষ স্বীকার করতেই হবে। আর তার সেই স্বীকারোক্তি আমি রেখে যাবো। তখনকার মতো তাকে ক্ষমা করার শর্ত ছিলো, তাকে আমার বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে, আর কোনোদিনও সে ফিরে আসতে পারবে না। তবে যেখানেই সে থাক না কেন, নতুন করে জীবন শুরু যেন সে করে। আমি তাকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেবো। স্বাভাবিকভাবেই সে তার মার টাকা পাবে, তার ভালো শিক্ষাদীক্ষা আছে, ভালো হওয়ার সবরকম সুযোগ তার আছে। কিন্তু সে যদি কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়। যে স্বীকারোক্তি সে আমাকে দিয়ে গেছে, সেটা পুলিসের কাছে যাওয়া উচিত। আমি মনে করি, আমার মৃত্যু দিয়ে এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তুমি আমার সব থেকে পুরানো বন্ধু। আমি তোমার কাঁধে একটা বোঝা চাপিয়ে যাচ্ছি। তবে আমার স্ত্রীর নাম নিয়ে তোমাকে এই অনুরোধ করছি আর সেও তো তোমার বন্ধু ছিলো। নিজেলের খোঁজ কোরো। তার রেকর্ড যদি পরিষ্কার হয়, এই চিঠিটা আর নিজেলের স্বীকারোক্তি নষ্ট করে ফেলো। আর যদি না হয় তাহলে তার বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত।
তোমার স্নেহের বন্ধু
আর্থার স্ট্যানলি
আহ! বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো পোয়ারো, তারপর নিজেলের স্বীকারোক্তির উপর চোখ রাখলো সে।
আমি এখানে স্বীকার করছি ১৫ই-১৮ই নভেম্বর অতিরিক্ত ঘুমের পিল খাইয়ে আমি আমার মাকে হত্যা করেছি–
নিজেল স্ট্যানলি।
মিস লেমনের রেখে যাওয়া চিঠিটা সই করলো এরকুল পোয়ারো, একটাও ভুল হয়নি, গম্ভীর ভাবে বলল সে।
আশা করি আমি প্রায়ই ভুল করি না। বললো মিস লেমন। প্রায়শই নয় তবে এটা ঘটেছিল। ভালো কথা তোমার বোন কেমন আছে?
জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো জাহাজে চড়ে এখন ঘোরবার কথা ভাবছে। দক্ষিণের রাজধানীগুলোতে।
আহ অস্ফুটে বললো পোয়ারো, তার বিস্ময় জাগে যদি–সম্ভবত–জাহাজে চড়ে ঘুরতে? তাই বলে এই নয় যে, সে নিজে সমুদ্রযাত্রার ব্যবস্থা করবে–এমনকি কাউকে কোনো পরামর্শ দিতে যাওয়ার জন্যও নয়।
তার পিছনের ঘড়িতে একবার শব্দ হলো।
ঘড়িটা একটা বাজার সময় ঘোষণা করলো।
নেংটি ইঁদুরটা নিচে নেমে এলো।
হিকরি ডিকরি ডক্।
ঘোষণা করলো এরকুল পোয়ারো।
মাফ করবেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
কিছুই নয়, বললো এরকুল পোয়ারো।