- বইয়ের নামঃ হ্যালুইন পার্টি
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
হ্যালুইন পার্টি
১. মিসেস আরিয়াদে অলিভার
হ্যালুইন পার্টি (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি
০১.
মিসেস আরিয়াদে অলিভার তার এক বান্ধবীর কাছেই থাকে। আজ সে এক সন্ধ্যা অনুষ্ঠানে শিশুদের পার্টিতে গেছে বান্ধবীর সাথে সাজানো-গোছানোতে সাহায্য করার জন্য। এই পার্টির নাম হলো হ্যালুইন পার্টি। এখানে নিমন্ত্রিতরা হলো দশ থেকে সতের বছরের ছেলেমেয়েরা।
এসে দেখলো চারিদিকে বিশৃঙ্খল অবস্থা। সাজাবার বড় আকৃতির রংবেরং-এর কুমড়ো এক জায়গায় এনে রাখা হচ্ছে। মিসেস অলিভার কপালের ওপর থেকে পাকা চুলের গুচ্ছ সরিয়ে দিয়ে বললো, গত বছর আমেরিকায় এই রকম কুমড়ো এক সঙ্গে অনেকগুলো দেখেছিলাম। সারা বাড়িতে সাজানো হয়েছিলো। ভেতরে হয় মোমবাতি নয়তো অনুজ্জ্বল আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছিলো। তবে হ্যালুইন পার্টির জন্য সাজানো হয়নি, সাজানো হয়েছিল ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের দিনে। এখন আমি প্রত্যেক বছর হ্যালুইন পার্টিতে যোগ দিই। বান্ধবী মিসেস বাটলার মিসেস অলিভারের কথাগুলি শুনতে লাগলো।
মাঝে মাঝে ব্যস্ত মহিলারা মিসেস অলিভারের কাছে এসে পড়লেও কিন্তু তার কথায় কর্ণপাত করছে না। সবাই নিজের নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত। এইসব মহিলাদের মধ্যে মায়েদের সংখ্যাই বেশি। দু-একজন বয়স্কা অবিবাহিতা স্ত্রীলোক আছে আর আছে কয়েকটি অল্পবয়স্কা মেয়ে, তাদের বয়স হবে তেরো থেকে উনিশ বছর। এছাড়া এগারো থেকে পনেরো বছরের কিছু ছেলেমেয়ে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গল্প করছে হাসাহাসি করছে।
এই পার্টির উদ্যোক্তা সুন্দরী মিসেস ড্রেক ঘোষণা করলো, আমি এই পার্টিকে হ্যালুইন পার্টি বলতে চাই না, আমি বলবো ইলেভেন প্লাস পার্টি। এই বয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে আজকের এই উৎসব। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী এই দি এলমস ছেড়ে অন্য স্কুলে চলে যাচ্ছে।
কিন্তু রোয়েনা তুমি ঠিক বলতে পারলে না ঝুলি পড়া চশমা নাকের উপর দিকে ঠেলে দিয়ে অনুমোদনের ভঙ্গিতে মিস ইউটেকার বললো, কারণ ইলেভেন প্লাস ক্লাস আমরা আগেই তুলে দিয়েছি।
মিসেস উইটেকার এই স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। কাউকে ভুল করতে দেখলে বা ভুলতে দেখলে চটে যাওয়া তার স্বভাব।
মিসেস অলিভার হঠাৎ সোফার ওপরে বসে মানুষের ভিড়ে ঠাসা ঘরটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। লেখিকার মন নিয়ে সে ভাবলো এখন যদি আমি এইসব মানুষদের নিয়ে কোনো বই লিখি তাহলে কি ভাবে লিখবো? এরা প্রত্যেকেই চমৎকার মানুষ। কিন্তু সত্যিই কি তাই? তার মনে হলো এই মানুষগুলো সম্পর্কে বেশি না জানাই ঠিক হবে। এরা প্রত্যেকেই উডলিফ কমন্স এ বাসা করে। জুডিথের কাছে যা শোনা গেছে তাতে বোঝা যায় এদের প্রত্যেকের মধ্যে বেশ বোঝাঁপড়া আছে।
এই মানুষগুলো মিসেস অলিভারের কাছে কেবল মাত্র নাম ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের মধ্যে আছে একজন নান, বেট্রিসা, ক্যাথি, জম্বলা আর জয়েসা। জয়েসা মেয়েটা দেখতে সুন্দরী, একটু ছটফটে আর প্রশ্ন করে প্রচুর। এ্যানা নামে মেয়েটি দীর্ঘাঙ্গী এবং বয়স জয়েসার চেয়ে একটু বেশি। সবেমাত্র যৌবনে পদার্পণ করেছে, এমন দুটি ছেলে আছে বিভিন্ন কায়দায় চুল আঁচড়ানো, কিন্তু যে জন্য এতো কায়দা করে চুল আঁচড়ায় তার কোনো সুফল ফলে না।
একটা ছোট ছেলে লাজুক ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে বললো, মা এই আয়নাগুলো পাঠিয়ে দিলেন এতে কাজ চলবে কি না দেখুন, মিসেস ড্রেক তার হাত থেকে আয়নাগুলো নিয়ে বললো, অনেক ধন্যবাদ, এডি।
এতো দেখছি সাধারণ হাত আয়না,
–এ্যানা বললো, এগুলোর ভেতরে কি সত্যিই আমাদের ভাবী স্বামীদের মুখ দেখতে পাব? জুডিথ বাটলার উত্তর দিলো– কেউ পাবে, কেউ পাবে না।
বয়সে অপেক্ষাকৃত বড় বেট্রিসা বললো, প্রত্যক্ষ করবার শক্তি থাকলেই দেখতে পাওয়া যায়।
লী একটি গামলা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। সঙ্গে সঙ্গে আলোচনার মোড় অন্যদিকে ঘুরে গেলো, আপেলের বোকা বানানোর খেলার জন্য গামলা উপযুক্ত হবে, না বালতি উপযুক্ত হবে এই আলোচনায় সবাই মেতে উঠলো, বেশিরভাগ কর্মী লাইব্রেরীতে গেল জায়গাটা ভালো করে দেখার উদ্দেশ্যে। কয়েকজন অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়ে আপেলের বোকা বানানোর খেলা হাতেকলমে করে দেখলো ঠিক হচ্ছে কি না। কারো মাথার চুল ভিজে গেলো আর গামলা থেকে জল উপছে পড়ল কার্পেটের ওপর। টাওয়েল দেওয়া হলো তাদের জল মোছার জন্য। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো প্লাস্টিক বালতির চেয়ে গ্যালভানাইজড গামলাই ব্যবহার করা হবে।
ভেতরে বয়ে আনা গামলা ভরা আপেল একপাশে রাখলো মিসেস অলিভার। তারপর একটু একা থাকার উদ্দেশ্যে একটা নির্জন ঘরের খোঁজে বেরিয়ে পড়লো। সিঁড়ি দিয়ে ওপর দিকে উঠতে লাগলো। ল্যাণ্ডিংয়ের সামনে তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। এখানে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে জড়াজড়ি করে একটা বদ্ধ ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে বসে আছে। মিসেস অলিভার এই ঘরেই ঢুকতে চান। তাকে দেখে যুগলমূর্তি একটুও বিচলিত হলো না, বরং আরো ঘনিষ্ঠ ভাবে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলো। ছেলেটির বয়স হবে পনেরো আর মেয়েটির বয়স হবে বারো।
অ্যাপেল ট্রি বাড়িটা বেশ বড়ো। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে কারো নজর পৌঁছায় না। মিসেস অলিভার ভাবলো, মানুষ কত স্বার্থপর আজকালকার ছেলেমেয়েরা অন্যের তোয়াক্কা করে না।
মিসেস অলিভারের অনুরোধে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলে আর মেয়েটি ছাড়াছাড়ি হলো, বিরক্তি মেশানো দৃষ্টিতে তারা মিসেস অলিভারের দিকে তাকালো। মিসেস অলিভার ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
.
০২.
কিশোর কিশোরীদের পার্টি সম্বন্ধে কোনো ধারণা আছে কি না জানতে চাইলো জুডিথ মিস অলিভারের কাছে।
মিসেস অলিভার জানালো বিশেষ কিছুই জানা নেই।
জুডিথ বললো, খুব ঝামেলা হয় বড়দের এড়িয়ে নিজেরাই সব করতে চায়। কাঁচের গ্লাস বা ওই ধরনের জিনিস ভেঙে একাকার করে। অবাঞ্ছিত মানুষজন ভেতরে ঢুকে পড়ে, কেউ হয়তো অনাহূত কাউকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো। সেই সঙ্গে আনে অদ্ভুত সব ওষুধপত্র–এল এস-ডি না কি যেন নাম, দেখতে ঠিক টাকার মতো কিন্তু আসলে টাকা নয়, তাই নাকি?
দামী হলেও ওগুলো খুব বাজে। খুব বাজেও-জুডিথ বললো, তবে এই পার্টি নির্বিঘ্নে শেষ হবে। রোয়েনা ড্রেকের ওপর আস্থা রাখতে পার। ব্যবস্থাপনার কাজে খুব দক্ষ। হাতে নাতে পারে। জান, মিরান্দা পার্টিতে আসতে পারলো না বলে খুব খারাপ লাগছে।
মিসেস অলিভার বললো, জ্বর যখন নেই তখন তো আনতে পারতে।
ভরসা হল না…ভাগ্য খারাপ আর কি।
রাত সাড়ে সাতটার সময় পার্টি শুরু হলো। প্রত্যেকেই যথাসময়ে এসে হাজির হলো। ঘড়ি ধরে সব কিছু চলতে লাগলোলা। সিঁড়িতে লাল নীল আলো দেওয়া হয়েছে, আর প্রচুর সংখ্যক হলুদ কুমড়ো ঝুলিয়ে চারিদিক সাজানো হয়েছে। রোয়েনা ড্রেক রাতের কর্মসূচী ঘোষণা করলো, প্রথমে হাতল ওয়ালা ঝাড়ুর প্রতিযোগিতা হবে। পুরস্কার আছে তিনটে–প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয়। তারপর কাটা হবে ময়দার কেক। অনুষ্ঠানটা হবে ছোট আকারের। তারপর হবে আপেলের বোকা বানানোর খেলা। দেওয়ালে সহযোগী প্রতিযোগীদের নাম টাঙ্গিয়ে দেওয়া হবে। তারপর হবে না। একবার করে আলো নিভে যাবে আর তোমরা সঙ্গী বদল করবে। এরপর স্টাডিরুমে মেয়েদের আয়না দেওয়া হবে–আয়নার খেলা। এই অনুষ্ঠানের পরে হবে ভোজ, ভোজের পর হবে স্ন্যাপড্রাগনের খেলা। আর অবশেষে পুরস্কার বিতরনী।
আরিয়াদে অলিভার জিজ্ঞাসা করলো-আচ্ছা ময়দার খেলাটা কি রকম?
প্রথমে ময়দা ঠেসে একটা গামলায় ভরতে হবে, তারপর একটা ট্রের উপর চাপ বাঁধা ময়দা উপুড় করে ঢালতে হবে। সেই চাপ-বাঁধা ময়দার ওপর একটা ছ পেন্সের মুদ্রা রাখতে হবে। প্রতিযোগীরা ছুরি দিয়ে চাপ বাঁধা ময়দা কাটতে থাকবে এমনভাবে যেমন মুদ্রাটা উপর থেকে নিচে না পড়ে যায়। যদি কেউ নিচে ফেলে দেয় তাহলে সেই খেলায় সে আর অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এইভাবে একজন করে খেলা থেকে সরে যেতে থাকবে। শেষ পর্যন্ত যে টিকে থাকতে পারবে সে পাবে ছ পেন্সের সেই মুদ্রাটা।
খেলা শুরু হয়ে গেছে। হাতলওয়ালা ঝাড়ুর খেলা দেখে সবাই খুব প্রশংসা করলো।
লাইব্রেরীর ঘর থেকে উত্তেজিত চীৎকার ভেসে আসছে। এই ঘরে আপেলের খেলা চলছে। জলে ভেজা প্রতিযোগীরা পরস্পরকে জড়াজড়ি করে বাইরে বেরিয়ে আসছে।
মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হলো হ্যালুইন ডাইনীর আবির্ভাব। এই ডাইনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে মিসেস গুডবডি। বাসন মাজার কাজ করে। তার নাক সূচাল আর বাঁকান এবং থুতনি সরু। তার কণ্ঠস্বর শুনলে মনে হয় যেন শয়তানের কণ্ঠস্বর বেশ খনখনে।
ডাইনি খনখনে গলায় কথা বলে চলেছে: তুমি বেট্রিসা না কি যেন তোমার নাম? বেশ মজার নাম, আকর্ষণীয় নাম। তুমি জানতে চাও তোমার ভাবী স্বামী কেমন দেখতে হবে? তাহলে এখানে বসো। হ্যাঁ আলোর ঠিক নিচে। এই আয়নাতে হাত দাও, এটা হাতে নিয়ে আলোর নিচে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়নার দিকে তাকাও দেখতে পাবে ভাবী স্বামীর মুখ, ঠিক যেন তোমার পিছন থেকে উঁকি দিচ্ছে। আয়নাটা শক্ত হাতে চেপে ধর। অর্থহীন যাদুমন্ত্র পড়তে থাকো… যার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে, তাকেই তুমি দেখতে পাবে।
পর্দার আড়ালে রাখা একটা মই থেকে হঠাৎ এক ঝলক আলো এসে পড়লো ঘরের মধ্যে, সেই আলো প্রতিফলিত হলো উত্তেজিত বেট্রিসার হাতে ধরা আয়নার উপর ওহো। সবিস্ময়ে চীৎকার করে উঠল বেট্রিসা ওকে দেখেছি–আয়নায় দেখেছি ওকে।
নীল আলোর ঝলক নিভে গিয়ে সাধারণ আলো জ্বলে উঠলো। সারা ঘর আলোকিত হয়ে উঠলো। ছাদের নিচে ঝুলন্ত একটা কার্ডের উপর আঠা দিয়ে আটকানো একটা রঙীন ফটোগ্রাফ বাতাসে আন্দোলিত হতে দেখা গেলো। বেট্রিসা উত্তেজিতভাবে সারা ঘরে এলোমেলো ভাবে নাচতে লাগলো।
মিসেস অলিভারকে বেট্রিসা বললো, ওকে দেখতে গায়ক এডি প্রেসাওয়েটের মতো, ওকে দেখেছি আমি।
খবরের কাগজে পপ গায়ক এডি প্রেসাওয়েটের ছবি মিসেস অলিভার অনেকবার দেখেছেন কিন্তু তার একবারও মনে হলো না মুখখানা তার মতো দেখতে। সে জিজ্ঞাসা করলো এসব কিভাবে করা হয়?
এসব রোয়েনাই ব্যবস্থা করে নিকিকে বলে। নিকির বন্ধু ডেসমণ্ড ওকে সাহায্য করে।
অলিভার বললো, আমি ভাবতেই পারছি না আজকালকার মেয়েরা অসভ্য হয়ে যাচ্ছে।
যাই হোক ভোজ পর্ব বেশ ভালো ভাবেই মিটে গেলো। সবাই বেশ পেট ভরে খেল।
এবার রোয়েনা বললো, আজ রাতের খেলা স্ন্যাপড্রাগন। তার আগে পুরস্কার বিতরণ করা হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ শেষ হলো। তারপর ভেসে আসতে লাগলো বাস্তু পরীর আর্তবিলাপের সুর। ছেলেমেয়েরা ডাইনিং হলের পিছন দিকে ছুটে গেলো।
টেবিলের ওপর থেকে খাবার সরিয়ে ফেলে সবুজ মোটা কাপড় পেতে দেওয়া হয়েছে। একটা বড়ো ডিসের ওপর রাখা হয়েছে স্তূপীকৃত আঙ্গুর, মনাক্কা, কিসমিস, বাদাম, পেস্তা ইত্যাদি। প্রত্যেকে সেইদিক ছুটে গিয়ে প্লেটে রাখা ফলগুলি ধরে টানাটানি করতে লাগলো, অবশ্য আগুন বাঁচিয়ে।
সবাই চীৎকার করছে : ওঃ পুড়ে গেলো। কি সুন্দর তাই না? ধীরে ধীরে স্ন্যাপড্রাগন ফুল পুড়তে পুড়তে একেবারে নেতিয়ে পড়লো। সব আলোগুলো একসাথে জ্বলে উঠলো। উৎসবের সমাপ্তি হলো– হ্যালুইন পার্টি শেষ।
প্রত্যেকেই বললো, পার্টি খুবই সফল হয়েছে, চমৎকার হয়েছে।
.
০৩.
লণ্ডনের একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে টেলিফোন বেজে উঠলো। চেয়ারে বসে আছে এরকুল পোয়ারো। সে নড়ে চড়ে বসলো, সে হতাশায় ভুগতে লাগলো। সে ভালো করেই জানে কে ফোন করেছে, নিশ্চয়ই আজ সন্ধ্যায় যার সঙ্গে ক্যানিং রোডের মিউনিসিপ্যাল বাথরুমে খুন হওয়া লোকটির প্রকৃত আততায়ী কে সে ব্যাপারে আলোচনা করার কথা ছিলো এখন ফোনে সে সেইগুলি জানাবে, সে এখানে আসতে পারবে না।
হতাশ হলো পোয়ারো কারণ খুনের সপক্ষে কিছু প্রমাণ সে সংগ্রহ করে রেখেছে। ভদ্রলোকের না আসতে পারবার সপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে, কারণ আজ রাস্তায় দেখা হতে লক্ষ্য করা গেছে বেশ অসুস্থ।
পোয়ারোর চাকর জর্জ ঘরে ঢুকে জানালো যে, মিঃ লোগলির ফোন ছিল উনি জানিয়েছেন যে আজ সন্ধ্যায় তার পক্ষে আসা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ তিনি ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে বিছানা নিয়েছেন।
টেলিফোনটা আবার বেজে উঠলো। পোয়ারো হাত বাড়িয়ে ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে নিয়ে বলললো, এরকুল পোয়ারো বলছি।
আমার সৌভাগ্য বলতে হবে–
একটা ঝাঁঝালো মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ভেবেছিলাম বেরিয়ে গেছ। শোন, এই মুহূর্তে তোমাকে আমার খুব দরকার। এক্ষুনি তোমার সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি?
মেয়েটি হলো পোয়ারোর বান্ধবী– আরিয়াদে।
উত্তর দেওয়ার আগে পোয়ারো কিছু সময় চুপ করে রইলো। বোধহয় তার বান্ধবীকে দুঃখ, হতাশা বা এই ধরনের কিছু বিচলিত করে তুলেছে। কোনো কারণে উতলা হয়ে পড়েছ নাকি?
– পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল।
হা। ভেবে পাচ্ছি না এখন কি করব। একমাত্র তুমিই আমাকে সঠিক পথ বলতে পারবে। তাহলে কি আমি যাব? — অলিভার জিজ্ঞাসা করল।
নিশ্চয়ই! এলে খুশী হব। অপর প্রান্তে রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ হলো।
জর্জকে ডেকে পোয়ারো বললো, মিনিট দশেকের মধ্যে মিসেস অলিভার এসে পড়বেন।
জর্জ চলে গেলো।
একটা ঘন্টা বাজলো ফ্ল্যাটের বাইরের দরজায়। জর্জের দরজা খোলার শব্দ ভেসে এলো। কোনো সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হওয়ার আগেই বসবার ঘরের দরজা খুলে গেলো। আরিয়াদে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করলো তার ঠিক পিছনেই জর্জ। তার মাথায় জেলেদের টুপি আর গায়ে পিচ্ছিল চামড়ার তৈরি জামা।
এসব কি পরেছ?–পোয়ারো বললো, জর্জের হাতে ওগুলো খুলে দাও। বেশ ভিজে বলেই মনে হচ্ছে।
হা বেশ ভিজে–মিসেস অলিভার অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললো, জলে ডুবিয়ে ভেজানো হয়েছে। জান, জল নিয়ে আগে কখনও এতো মাথা ঘামাইনি, সাংঘাতিক জিনিস।
পোয়ারো বললো, আচ্ছা সব শুনছি আগে বসো।
অলিভার বসে বলতে শুরু করলো, একটা হ্যালুইন পার্টিতে গিয়েছিলাম। এটা ছিল ছোটদের পার্টি। বুক ভরে হাওয়া গ্রহণ করে মিসেস অলিভার বললো, শুরু হয় আপেল দিয়ে। আপেল দিয়ে বোকা বানানোর খেলা। যে কোনো হ্যালুইন পার্টিতে এই খেলাটা হয়ে থাকে।
আরো নানারকম খেলার শেষে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয় স্ন্যাপড্রাগন খেলা দিয়ে। আমার ধারণা সেই সময় ঘটনাটা ঘটে। স্ন্যাপড্রাগন খেলার পর নিমন্ত্রিতরা একে একে বাড়ি চলে যায়। ওর খোঁজ কেউ করেনি।
কার খোঁজ করেনি?
একটা মেয়ের নাম জয়েসা। প্রত্যেকে তার নাম ধরে ডাকাডাকি করেছে, এদিক ওদিক খোঁজ করেছে এবং জিজ্ঞাসা করেছে কারো সঙ্গে বাড়ি চলে গেছে কি না। ওর মা বিরক্ত হয়ে ভেবেছিল জয়েসা ক্লান্ত বা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বলে একাই বাড়ি চলে গেছে। যাই হোক অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
একা একাই বাড়ি ফিরে গিয়েছিল?
না বাড়ি ফেরেনি– মিসেস অলিভারের কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল। শেষ পর্যন্ত ওকে পাওয়া গেলো লাইব্রেরীতে। ওখানে কেউ ওকে খুন করে রেখে গেছে। আপেলের খেলায় খেলার ভঙ্গিমায় ওকে পাওয়া যায়। মাথাটা গামলার জলের মধ্যে ডোবানো।
পোয়ারোর কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণশোনালো, ঠিক কি ঘটেছিল?
মেয়েটাকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করা হলো। কেউ যেন তার মাথাটা গামলার জলের মধ্যে চেপে ধরেছিল। মেরে ফেলার উদ্দেশেই কাজটা করা হয়। জয়েসা হাঁটু ভেঙে বসে আছে তার মাথাটা জলের ভেতর ডোবান।… আমি আপেলকে ঘৃণা করি, আপেলকে সহ্য করতে পারছি না, কোনোদিন পারবও না…
পোয়ারো চুপচাপ তাকিয়ে রইল উত্তেজিত মিসেস অলিভারের দিকে। হাত বাড়িয়ে কোনিয়াক মদ ঢাললো গ্লাসে তারপর মৃদুকণ্ঠে বললো, এইটুকু খেয়ে নাও অলিভার, খারাপ লাগবে না।
.
০৪.
মিসেস অলিভার গ্লাস নামিয়ে রেখে বললো, এখন বেশ ভালোই লাগছে, কেমন যেন হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
পোয়ারো বললো, বুঝতে পারছি তুমি অত্যন্ত মানসিক আঘাত পেয়েছ। ঘটনাটা কবে ঘটেছে।
গত রাতেই ঘটেছে ঘটনাটা।
কিন্তু বুঝতে পারছি না আমার কাছে এসেছো কেন তুমি? মনে হলো একমাত্র তুমিই আমায় সাহায্য করতে পারো। একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে যে ব্যাপারটা সাধারণ নয়।
তুমি আমায় সব খুলে বলতে পারো। বুঝতে পারছি কেসটা এখন পুলিসের হাতে। ডাক্তারের মতামত কি?
অনুসন্ধান চলবে–মিসেস অলিভার বলল।
চলাটাই স্বাভাবিক। ওই মেয়েটা মানে জয়েসার বয়স কত হবে?
সঠিক বলতে পারবো না। তবে তেরো কি চোদ্দ হরে।
শোন, আমার মনে হচ্ছে সব কথা তুমি আমায় খুলে বলোনি, জয়েসা তোমার পরিচিত?
না ওকে একেবারেই চিনতাম না। আমার মনে হচ্ছে তোমাকে খুলে বলা দরকার ওখানে কেন গিয়েছিলাম।
ওখানে মানে– কোথায়?
উডলিফ কমন্সে।
উডলিফ কমন্স।–চিন্তিত মনে পোয়ারো বললো, এখন সেখানে
এখানে এক বান্ধবীর সঙ্গে আমি থাকি। জুডিথ বাটলার ওর নাম। বিধবা। একবার হেলেনিতে জাহাজে করে বেড়াতে গিয়েছিলাম, সেই জাহাজে জুডিথও ছিলো। সেখানেই আমাদের পরিচয় আর বন্ধুত্ব। ওর এক মেয়ে আছে নাম মিরান্দা। বয়স বার কি তেরো। জুডিথের আমন্ত্রণেই এই হ্যালুইন পার্টিতে গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি পার্টিটা সম্পর্কে আমার মনে যথেষ্ট আগ্রহ জেগেছিল। তাই বুঝি! পোয়ারো বললো, আচ্ছা, মনে করে দেখোত উনি বলেছিলেন কিনা পার্টিতে খুন হয়েছে, এই ধরনের কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে।
তাছাড়া পার্টিতে কি এমন কোনো লোক ছিল যে তোমার পরিচয় জানতো?
হ্যাঁ, ছিল। ছোটদের মধ্যে কে একজন আমার লেখা বই সম্পর্কে মন্তব্য করছিল আর বলছিল খুন জখম ওদের ভালো লাগে।
আমাকে কিন্তু এসব কথা এখনও বলোনি।
দেখ, প্রথমে ব্যাপারটা নিয়ে আমি মাথা খামাইনি, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা তো মাঝে মাঝে কত প্রশ্নই করে, সে সব নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না।
আচ্ছা কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পড়েছে এমন কোনো ছেলে ওখানে ছিল? দুজন। বয়স হবে ষোল থেকে আঠার।
আমার ধারণা ওদের দুজনের মধ্যে কেউ করতে পারে। পোয়ারো বলল পুলিসের ধারণা কি তাই?
কিছু প্রকাশ না করলেও ওদের কথাবার্তা আর আচরণ দেখে তাই মনে হয়েছে।
জয়েসা দেখতে কি খুব আকর্ষণীয় ছিল?
না, তেমন কিছু নয়। তবে মেয়েটাকে আমার খুব ভালো বলে মনে হয়নি। আসলে বয়সটা খারাপ বুঝলে না? শুনতে খারাপ লাগলেও কথাগুলো সত্যি।
আচ্ছা সেই সময় পার্টিতে কতো লোক উপস্থিত ছিল?
পাঁচ ছজন মহিলা, কয়েকজন মা, একজন স্কুল শিক্ষয়িত্রী, একজন ডাক্তারের স্ত্রী কিম্বা বোন ষোল থেকে আঠারো বছর বয়সী দুটি ছেলে, পনের বছরের একটা মেয়ে আর দু-তিনটে এগারো বছরের মেয়ে এই পার্টিতে উপস্থিত ছিল। সব মিলিয়ে কুড়ি পঁচিশ কিম্বা ত্রিশজন।
একে অপরকে চিনতো। কাজের লোকের জন্য কাজ ফেলে রাখা হবে না এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরাই ঘরগুলো পরিষ্কার করে ফেলেছিলাম, সেই সময়ে আমরা লাইব্রেরীর ঘরে মৃত জয়েসাকে আবিষ্কার করি। সঙ্গে তার বলা কথাগুলো আমার মনে পড়ে যায়।
কি কথা– কি কথা বলেছিলো?
বলেছিল, আমি একটা খুন হতে দেখেছি মিসেস অলিভার সমস্ত ঘটনা খুলে বললো, কিন্তু কেউ ওর কথা বিশ্বাস না করে হেসে উড়িয়ে দিচ্ছিল বলে খুব রেগে গিয়েছিল।
মেয়েটি বিস্তারিত ভাবে কিছু বলেনি! যেমন কোনো নাম?
না। জয়েসাকে যখন বিস্তারিতভাবে বলবার জন্য সবাই পীড়াপীড়ি করতে লাগলো ও বলেছিল, অনেকদিন আগের ঘটনা তো আমার কিছু মনে নেই। তবে বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা।
একটা ব্যাপার ভাববার আছে-পোয়ারো বললো, এখন নিশ্চয় ওর বোঝার মতো বয়স হয়েছিল।
মিসেস অলিভার বললো, একজন ওকে প্রশ্ন করেছিলো, কেন তুমি পুলিসে খবর দিলে না?
উত্তরে মেয়েটা কি বলল?
বলল, তখন আমার মনেই হয়নি যে ওটা খুন।
পোয়ারো নড়েচড়ে বসলো তারপর বললো, চমৎকার উত্তর দিয়েছে তো!
মেয়েটাকে সবাই মিলে ঠাট্টা করছিল বলেই বোধহয় বিরক্ত হয়ে এ ধরনের উত্তর দিয়েছিল। কিন্তু কেউ ওর কথা বিশ্বাস করেনি। তবে মৃতদেহ আবিষ্কার করবার পর আমার মনে হলো, ও সত্যি কথা বললেও বলতে পারে। তারপর তোমার কথা মনে পড়লো।
কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বললো না। তারপর নড়েচড়ে বসে প্রথম নিরবতা ভঙ্গ করলো পোয়ারো, তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করবো। ভেবে চিন্তে উত্তর দেবে। আচ্ছা মেয়েটা কি সত্যি কোনো খুন হতে দেখেছিল বলে তোমার মনে হয়?
সত্যি করে বলা কঠিন, তবে আমার মন বলছে মেয়েটা হয়তো সত্যিই খুন হতে দেখেছিলো। এর থেকে কয়েকটা সিদ্ধান্তে আসা যায়। পার্টিতে উপস্থিত নিমন্ত্রিতদের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন একজন ছিল যে এই খুনটা করেছে আর এই খুনী জয়েসাকে আগেই বলতে শুনেছে অতীতের খুনের কথা।
জয়েসাকে যে খুন করেছে, মাথাটা জলের মধ্যে চেপে ধরে রাখার মতো শক্তি তার ছিল। খুনটা করা হয়েছে চোখের নিমেষে। খুন হতে দেখার কথা শুনে খুনী ভয় পেয়েছিল তাই সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজটা সেরে ফেলেছে।
তার মানে জয়েসা জানবার সুযোগ পায়নি যে, ওকে যে খুন করেছে সে আগের খুনটা করেছে কিনা।–মিসেস অলিভার বললো তাছাড়া ও জানতোই না যে খুনী ঘরের মধ্যেই ওৎ পেতে বসে আছে।
না জানতো না। সম্ভবতঃ জয়েসা খুন হতে দেখেছিল, কিন্তু খুনীর চেহারা দেখতে পায়নি। আমাদের আরও আগে চলে যেতে হবে।
তোমার কথা বুঝতে পারছি না। এমনও হতে পারে এমন একজন লোক পার্টিতে উপস্থিত ছিল যে জানতো খুনটা কে করেছে। হয়তো খুনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এমনও কেউ হতে পারে। সে নিশ্চয়ই ভেবেছিল সে ছাড়া আর কেউ কিছু জানে না। সহসা জয়েসা মুখে খুন হতে দেখার কথা শুনে…
পোয়ারো বললো, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে কেন উডলিফ কমন্স নামটা আমার কাছে এতো পরিচিত।
.
০৫.
আধুনিক প্যাটার্নের চমৎকার রংয়ের আর সুন্দরভাবে তৈরি বাড়িটা হলো পাইন ক্রেষ্ট। এরকুল পোয়ারো বাড়ির গেটের দিকে তাকালো। বাড়িটা একটা পাহাড়ী টিলার ওপর তৈরি। বাড়িটা ঘিরে লাগানো হয়েছে পাইন গাছ। সামনে একটা ছোটো ফুল বাগান, একজন বয়স্ক লোক ফুলগাছে জল দিচ্ছে।
সুপারিন্টেন্টে স্পেনস আগুন্তুকের দিকে তাকিয়েই চিনতে পারলো, এরকুল পোয়ারো না?
চমৎকার! পোয়ারো বললো, তুমি যে চিনতে পেরেছো এতেই আমি সন্তুষ্ট।
হেমন্তের রোদ ঝলমল করছে সামনের বারান্দায়। একটা গোল টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার পাতা আছে। ওরা মুখোমুখি বসলো। স্পেনস বললো সে তার বোন এলস্পেথকে নিয়ে এখানে থাকে।
বাড়ির ভেতরে চলে গেলো স্পেনস তারপর কিছু সময় পরে বিয়ার হাতে ফিরে এলো। গ্লাস দুটো টেবিলের উপর রেখে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। তারপর বললল, এবার বল আমাকে স্মরণ করেছ কেন? কোনো খুনের ব্যাপারে কি?.মনে হচ্ছে জলে মাথা গুঁজে ধরা মেয়েটাকে খুন করার কেসের ব্যাপারে এসেছ?
ঠিক ধরেছ।
দেখ খুনের ব্যাপারে কোনো সাহায্য আর করতে পারবো না। আজকাল পুলিসের সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ নেই।
দেখ যে একবার পুলিসে নাম লেখায় সে চিরকাল পুলিসেই থাকে।
তা আমাকে কি করতে হবে?
তুমি মুখে মুখে সব শুনেছ… পোয়ারো বলল, এই কাজ করে এমন বন্ধু তোমার আছে। এই খুনের ব্যাপারে পুলিস কি ভাবছে বা কাকে সন্দেহ করছে তোমার পক্ষে জানা সম্ভব।
স্পেনস জিজ্ঞাসা করলো আচ্ছা এর মধ্যে তুমি নিজেকে জড়ালে কি করে? এখানে তো তুমি থাক না?
নিজেকে জড়িয়েছি এক বান্ধবীর অনুরোধে। মিসেস অলিভার।
আরিয়াদে এখানে থাকে?
না এখানে থাকে না। কদিনের জন্য ওর বান্ধবী মিসেস বাটলারের কাছে উঠেছে। মিসেস অলিভার লণ্ডনে আমার কাছে গিয়েছিল। ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। এ ব্যাপারে আমার সাহায্য চেয়েছে।
সামান্য এক চিলতে হাসি সুপারিন্টেন্টে স্পেনসের দুঠোঁটের ফাঁকে জেগে উঠে মিলিয়ে গেল। সে বললো, সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, তোমার কাছেও আমি একই আর্জি নিয়ে কতবার গেছি। পোয়ারো বললো, এবার ব্যতিক্রম ঘটেছে, আমি এসেছি তোমার কাছে। আচ্ছা এখানকার আজেবাজে লোক কারা নিশ্চয়ই জানা?
জানি বৈকি। আমি এখানে মাত্র কয়েক বছর হলো আছি। বসবাস করতে এসে মানুষ এইসবই তো আগে দেখে।
এই খুনের ব্যাপারে সন্দেহ করা যেতে পারে এমন লোককে তোমার জানা আছে?
দুটো ছেলে তো পার্টিতেই ছিল, নিকোলাস র্যামসাম, সুদর্শন, বয়স হবে সতের আঠার। আর একজন ডেসম বয়স হবে ষোল। এই বয়সে এধরনের অপরাধ করা এমন কিছু অসম্ভব নয়। তাছাড়া বাইরে থেকে কোনো লোক পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে খুন করে যেতে পারে। শোন, মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে জয়েসা একটা কথা খুব জোর দিয়ে বলেছিল–পোয়ারো বলল কি কথা?
মিসেস অলিভার তাকে যে গল্প শুনিয়েছিল পোয়ারো হুবহু তাই শোনালো স্পেনসকে। সে আরো বললো, মেয়েটা খুন হতে দেখার কথা বললো আর তার কয়েকঘন্টা পরে সে নিজেই খুন হয়ে গেল। এর থেকে একটা ধারণাই হয় যে মেয়েটার কথা সত্যি হলেও হতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে বুঝতে হবে খুনী সুসময়ের অপচয় করেনি।
ঠিক তাই। স্পেনস বলল, মেয়েটা যখন খুন হতে দেখার কথা বলেছে তখন ঠিক কতজন সেখানে উপস্থিত ছিল?
চোদ্দ কি পনের জন। পাঁচ ছজন শিশু, পাঁচ ছজন কিশোর কিশোরী তবে ঠিক তথ্যের জন্য তোমার ওপর নির্ভর করতে হবে আমায়।
এটা তেমন কঠিন কাজ হবে না। স্পেনস বলল, তবে এক্ষুনি বলা সম্ভব হবে না।
পার্টিতে যারা উপস্থিত ছিল তাদের একটা নামের লিস্ট আমার কাছে আছে।
ওদের মধ্যে যারা এ কাজ করতে পারে তাদের একটা লিস্ট দিতে পারবে?
সে কাজটা এক্ষুনি করা সম্ভব হবে না।
পোয়ারো বললো, তুমি আমায় এখানকার বাসিন্দাদের সম্পর্কে কিছু খবর দাও। এখানকার লোকজন তোমার পরিচিত।
স্পেনস বললো,–যথাসম্ভব চেষ্টা করবো। এ ব্যাপারে আমার বোন এলস্পেথের সাহায্য নিতে হবে। এখানে এমন কোনো লোক নেই যার সম্পর্কে ও জানে না।
.
০৬.
পোয়ারোর কোনো সন্দেহ রইলো না যে, প্রয়োজনীয় খবর সে নিশ্চয়ই পাবে। কেসটাতে স্পেনসকে উৎসাহিত করা গেছে। উচ্চপদস্থ রিটায়ার্ড সি-আই-ডি অফিসার হিসাবে তার খ্যাতি স্থানীয় পুলিস অফিসে খুব কম নয়। এই ডিপার্টমেন্টে তার কয়েকজন বন্ধু আছে।
এখন দশ মিনিটের মধ্যে দি অ্যাপেল ট্রিজ নামে বাড়ির সামনে মিসেস অলিভারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। সত্যি খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ নাম। এখানে আপেলের সঙ্গে যাদুদণ্ড আর ডাইনী এবং পুরাতন গ্রাম্য গাথা এবং শিশুহত্যা সংঘটিত হয়েছিল।
নির্দেশ মতো পোয়ারো একটা পুরোনো টাইপের লাল ইটের তৈরি বাড়ির সামনে উপস্থিত হলো। বাড়িটাকে ঘিরে আছে ঝোঁপ জঙ্গল। পিছনের দিকে একটা সুন্দর বাগান আছে।
গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো মিসেস অলিভার। বললো তোমার অপেক্ষায় জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যাক্ কার কার সঙ্গে দেখা করলে আজ পর্যন্ত?
আমার বন্ধু সুপারিন্টেন্টে স্পেনস এর সঙ্গে।
এই কেস সম্পর্কে ওর মতামত কি? তোমরা দুজনে মিলে কি করবে ঠিক করেছ?
তুমি এতো ব্যস্ত হয়ো না। আমার প্রোগ্রাম তৈরি করে ফেলেছি। প্রথমে আমার বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে ফেলেছি। তাকে বলেছি কিছু খবর যোগাড় করে দিতে। ম্যাডাম এরপর তোমাকে সঙ্গে নিয়ে অকুস্থল পরিদর্শন করতে যাব।
মিসেস অলিভার ঘাড় ফিরিয়ে বাড়িটার দিকে তাকাল, তারপর সে বললো, আচ্ছা এই বাড়িটা দেখে কি মনে হচ্ছে এখানে কোনো খুন হতে পারে?
না।–পোয়ারো বললো বাড়িটা দেখে তেমন মনে হয় না। অকুস্থল দেখার পর আমি মৃত মেয়েটির মায়ের সঙ্গে দেখা করবো। আজ বিকেলে একসময় স্পেনসের সঙ্গে যাব স্থানীয় ইনসপেক্টরের সাথে কথা বলতে। স্থানীয় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে চাই। তারপর কথা বলবো স্কুলের হেড মিস্ট্রেসের সঙ্গে, সন্ধ্যা ছটার সময় বন্ধু স্পেনস আর তার বোনের সঙ্গে একটু বসবো কিছু আলোচনা করার জন্যে।
তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে তুমি একটি কম্পিউটার।
হ্যাঁ আমি কম্পিউটারের মত কাজই করে থাকি–পোয়ারো বললো, অন্য লোক খবর ভরে দেয়। কম্পিউটারে কোনো ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
মিসেস অলিভার বললো, ভেতরে চল মিসেস ড্রেকের সঙ্গে দেখা কর।
মিসেস ড্রেকের দেখবার মতো চেহারা বটে। পোয়ারো ভাবল। বেশ দীর্ঘাঙ্গী এবং সুন্দরী। বয়স হবে চল্লিশের মতো। একমাথা সোনালী চুল ধূসরতার সামান্য ছাপ চোখে পড়ে নীল চোখ দুটি উজ্জ্বল। মহিলাটি যখন কোনো পার্টির দায়িত্ব নেয় তখন তা সফল হবেই।
অ্যাপেল ট্রিজ বাড়ির ভেতরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর ভাবে সাজানো। মূল্যবান মেহগনি কাঠের তৈরি আসবাব পত্র। জানালা দরজার পর্দার কাপড় এবং বিছানা বা অন্যান্য জিনিসের ঢাকা দেখতে চমৎকার কিন্তু খুব যে মূল্যবান তা নয়।
মিসেস অলিভার আর পোয়ারোকে অভ্যর্থনা জানালো মিসেস ড্রেক। ঘুমের চেহারায় তার মনের কথা বোঝা যায় না। একটা দুঃখবোধ তাকে সবসময় ঘিরে আছে।
মঁসিয়ে পোয়ারো চমৎকার সুরেলা গলায় মিসেস ড্রেক বললো, আপনি কষ্ট করে আমার কাছেই এসেছেন বলে আমি খুশি হয়েছি। মিসেস অলিভারের কাছে শুনেছি, আপনি আমাদের সাহায্য করতে রাজী হয়েছেন খুনের ব্যাপারে।
নিশ্চিন্ত থাকুন মাদাম, আমার ক্ষমতা মতো আমি সাহায্য করবো তবে কেসটা সহজ বলে মনে হয় না।
মিসেস ড্রেক বললো, আমার ধারণা মানসিক রোগগ্রস্ত কোনো ব্যক্তি সকলের অলক্ষ্যে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, সেই লোকই মেয়েটাকে প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। আপনি যা কল্পনাও করতে পারবেন না তেমন ঘটনা ঘটে গেছে।
অকুস্থলটা আমায় দেখাবেন?
নিশ্চয়ই। মিসেস ড্রেক উঠে দাঁড়ালো। সে বললো, পুলিসের ধারণা যখন স্ন্যাপড্রাগন অনুষ্ঠান চলছিল তখনই কাজটা চুকিয়ে ফেলা হয়েছে। অনুষ্ঠানটা চলছিল ডাইনিংরুমে।
হলঘর পেরিয়ে একটা বন্ধ দরজা খুলে ফেললো। প্রথমেই নজর পড়লো বড় ডাইনিং টেবিল আর ভেলভেটের মোটা পর্দা। অনুষ্ঠান চলার সময় ঘর অন্ধকার ছিল।
এবার হলের ওপাশে একটা বন্ধ দরজা খোলা হলো। একটা ছোট ঘর নজরে পড়লো। ভেতরে রয়েছে কয়েকটা আর্মচেয়ার, খেলাধুলার সরঞ্জাম আর বইয়ের তাক। একটা লাইব্রেরী। মিসেস ড্রেক যেন সামান্য কেঁপে উঠে বললো, গামলাটা ছিল এখানে অবশ্য একটা প্লাসটিক শিটের উপর– আমি যেতে পারবো না, দৃশ্যটা যেন আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এখন অবশ্য ভেতরে দেখার মত কিছুই নেই। গামলায় জল ছিল-মিসেস ড্রেক বললো, প্লাস্টিক শিটের উপর জল থাকার কথা। মেয়েটার মাথা যদি জলে চেপে ধরা হয়ে থাকে তাহলে প্রচুর জল উপচে নিচে পড়ার কথা।
তা ঠিক আপেলের খেলা তখন চলছিল। একবার না দুবার গামলায় ঢেলে ভর্তি করতে হয়েছিল।
তাহলে যে ব্যক্তি খুন করেছে তারও পোশাক ভিজে যাওয়ার কথা।
পোয়ারো বললো, মেয়েটাই একমাত্র সূত্র। আশা করছি মেয়েটা সম্পর্কে যা জানেন আমায় বলবেন। তারা আবার ড্রয়িংরুমে ফিরে এলো।
মিসেস ড্রেক বললো, আমি বুঝতে পারছি না আমার কাছে কি শুনতে চাইছেন, সব কিছু পুলিসের কাছে কিম্বা জয়েসার মায়ের কাছে জানতে পারেন।
কিন্তু আমি জানতে চাই এমন জিনিস যা সন্তান খুন হওয়া কোনো মায়ের কাছ থেকে জানা যাবে না। মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে যার ধ্যান ধারণা আছে এমন একজন লোকের কাছে আমি স্পষ্ট এবং পক্ষপাতহীন মতামত জানতে চাই।
শুনেছি জয়েসা বলেছিল সে একটা খুন হতে দেখেছে। কথাটার কোনো গুরুত্ব দেননি?
না দিইনি। একটা বাজে ব্যাপার। এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না। জয়েসার মা বলেছেন তা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।
আচ্ছা উপস্থিত অন্যান্য ছেলেমেয়েরা কি ওর কথা বিশ্বাস করেছিল?
উপহাস করেছিল এই জন্যই তো রেগে গিয়েছিল।
আচ্ছা চলি মাদাম, আমার প্রশ্নের যেটুকু উত্তর দিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ।
জয়েসা কি যে একটা বাজে কথা বলে গোটা ব্যাপারটা ঘোরালো করে রেখে গেলো। মিসেস ড্রেক বিড় বিড় করলো। আচ্ছা উডলিফ কমন্সে আগে কখনও কেউ খুন হয়েছে?
মনে করতে পারছি না।
এমন কোনো খুন হয়েছে যা একটা তেরো বছরের মেয়ের পক্ষেদেখা সম্ভব?
না হয়নি। আমি আবার বলছি মঁসিয়ে পোয়ারো, নিজেকে একজন বিখ্যাত মানুষের কাছে জাহির করবার জন্য কথাগুলো বলেছিলো। মিসেস অলিভারের দিকে মিসেস ড্রেক তাকালো।
আসলে সব দোষ আমারই–মিসেস অলিভার বললো পার্টিতে যাওয়া আমার উচিত হয়নি। না, ভাই না আমি সেই অর্থে বলিনি। মিসেস অলিভারের সঙ্গে বাড়ির বাইরে এসে পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর হাঁটতে হাঁটতে বলল, খুন হওয়ার পক্ষে জয়েসা মোটেই উপযুক্ত নয়। কেউ মিসেস ড্রেককে খুন করে যেতে পারে এমন পরিবেশ এখানে নেই।
যে ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, জয়েসার মায়ের কথা বলছি উনি মানুষ হিসাবে কেমন?
চমৎকার মহিলা, তবে একটু বোকা ধরনের ওর জন্য দুঃখ হয়। সবচেয়ে দুঃখের কথা হলো ওর মেয়ের খুন হওয়াকে সবাই মনে করছে যৌন অপরাধ।
ধর্ষণের কোনো প্রমাণ পাওয়া না গেলেও স্থানীয় লোকজন তাই ভাবছে। মিসেস অলিভার বললো, আচ্ছা আমার বান্ধবী জুডিথ বাটলার যদি তোমায় মিসেস রেনল্ড এর কাছে নিয়ে যায় কেমন হবে? মিসেস রেনল্ড এক ও খুব ভালো করে জানে আমি তো নতুন এসেছি।
পরিকল্পনা মতো কাজ করবো আমরা।
.
০৭.
মিসেস ড্রেকের ঠিক বিপরীত হলো মিসেস রেনল্ড এর চরিত্র। দেখে মনে হয় না মনে কোনো ছল চাতুরী আছে। পরনে কালো পোশাক। চোখে জল।
মিসেস রেনল্ডস মিসেস অলিভারকে বললো, আপনার অসীম করুণা আমাদের সাহায্য করার জন্য আপনার বন্ধুকে ডেকে এনেছেন, উনি যদি সাহায্য করতে পারেন তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। কি করে যে এই বয়সের একটা মেয়েকে খুন করতে পারলো। যদি মেয়েটা চীৎকার করতে পারতো–কিন্তু তাকে তো জলের মধ্যে চেপে ধরা হয়েছিল।
পোয়ারো বললো, আপনাকে কষ্ট দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, আমি কেবল আপনার কাছে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানতে এসেছি। যাতে আপনার মেয়ের খুনীকে ধরতে অসুবিধা না হয়। আচ্ছা কে খুন করতে পারে বলে আপনার সন্দেহ হয়?
কি করে বলব বলুন? ভাবতেই পারছি না, এ ধরনের নোক এখানে বাস করে। এই জায়গাটা খুব ভালো, আরও ভালো এখানকার লোকজন। আমার ধারণা উত্তেজক ওষুধ খেয়ে কোনো লোক জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকেছিল।
আপনার কি স্থির বিশ্বাস যে খুনী একজন পুরুষ?
কোনো মেয়েলোকের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব?
মেয়েলোকেরও গায়ে যথেষ্ট শক্তি থাকতে পারে।
আপনি কি বলতে চাইছেন বুঝেছি কিন্তু একজন মেয়েলোকের পক্ষে এধরনের কাজ… জয়েসা যে একেবারেই শিশু–মাত্র তের বছরের মেয়ে ছিল মঁসিয়ে পোয়ারো।
আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো, আপনার মেয়ে পার্টিতে একটা মন্তব্য করেছিলো, ও একটা খুন হতে দেখেছে। আমার ধারণা আপনি তখন ওখানে উপস্থিত ছিলেন না।
আমার তিন ছেলেমেয়েকে গাড়ী করে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাই, তারপর তাদের নিয়ে আসতে গিয়েছিলাম। একথা কেউ বিশ্বাস করেছে বলে আমার মনে হয়নি। মিসেস রেনল্ড বললো, মিথ্যে কথা বলা জয়েসার স্বভাব।
পোয়ারো বললো মনে করবার চেষ্টা করুন, তিন সপ্তাহ আগে কিম্বা তিনবছর আগে হয়ত বলেছিল, জয়েসা বলেছিলো, সেই সময় সে বেশ বড়। উত্তেজনামূলক কোনো ঘটনা কি ঘটেছিলো এখানে।
না মনে পড়ছে না।
আচ্ছা আপনার আর দুজন ছেলেমেয়ে তো পার্টিতে উপস্থিত ছিল ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারি?
নিশ্চয়ই।
পোয়ারো লিওপোল্ড এর সঙ্গে কথা বলে তেমন কিছু কিনারা পেলো না।
এবারে তারা এলো উপর তলার এ্যানার কাছে। এ্যানাকে বয়সের তুলনায় একটু বড়ো দেখায়।
এ্যান এর সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো নিজেকে জাহির করা জয়েসার একটা স্বভাব ছিল। কেউ জয়েসাকে খুন করতে পারে একথা ভাবাই যায় না। সুযোগ সন্ধানী ছাড়া এ কাজ আর কেউ করেনি।
এ্যানা আরো একটি কথা জানালো যে জয়েসা ছিল ভীষণ ভাবে মিথ্যেবাদী।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মিসেস অলিভার বললো, আমরা কি কিছুটা এগোতে পেরেছি?
একটুও নয়–এরকুল পোয়ারো চিন্তিত মনে বললো, কেসটা খুব ইন্টারেস্টিং।
মিসেস অলিভার এমন ভাবে চোখ তুলে তাকালো যেন সে তার মতের সঙ্গে একবারেই একমত হতে পারছে না।
.
০৮.
ঘড়িতে এখন ছটা বাজে। পাইন ক্রেস্টে বসে এরকুল পোয়ারো এক টুকরো সসেজ মুখে পুরে এক ঢোক চা পান করলো। তারপর সামনে বসা মিসেস এলস্পেথ ম্যাকের দিকে তাকালো। মিসেস ম্যাকের মুখ মেদহীন এবং লম্বাটে কিন্তু চোখ তীক্ষ্ণ বদমেজাজী স্ত্রীলোক বলেই মনে হয়। রোগাটে চেহারা।
জয়েসা রেনল্ড কি প্রকৃতির মেয়ে ছিল তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে–দু চোখে প্রশ্ন নিয়ে স্পেনসার দিকে তাকালো পোয়ারো, এদিকটা আমায় বিভ্রান্ত করে তুলেছে। পোয়ারো ম্যাকের দিকে তাকালো। মহিলার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে।
এলস্পেথ বললো, আমার মতে মেয়েটা ছিল প্রকৃত মিথ্যেবাদী, চমৎকারভাবে গুছিয়ে বানিয়ে গল্প বলতো। লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও ছিল ওস্তাদ। আমি কোনোদিন মেয়েটাকে বিশ্বাস করিনি।
আচ্ছা জয়েসা কাকে খুন হতে দেখতে পারে?– পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলো।
কাউকে না– এলস্পেথ তাড়াতাড়ি জবাব দিল।
এখানে নিশ্চয়ই গত তিনবছরে কারো মৃত্যু হয়েছে? অস্বাভাবিক আর অনভিপ্রেত মৃত্যু কারো হয়ে থাকলে তাদের একটা তালিকা পেলে সুবিধা হতো।
হা মানে–এলস্পেথ ইতস্ততঃ করলো।
স্পেনস একটা কাগজ পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দিলো, এদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে তোমার সুবিধা হবে।
এদের সন্দেহজনক ভাবে মৃত্যু হয়েছে?
ওই রকমই বলতে পারো।
লেখা নামগুলো পোয়ারো চেঁচিয়ে পড়তে লাগলো–মিসেস লেওয়েলিন স্মিথ কার্লোট বেনফিল্ড, জেনেট হোয়াইট, লেসলি ফেরিয়ার হঠাৎ থেমে গিয়ে মিসেস লেওয়েলিন স্মিথের নাম পুনরাবৃত্তি করলো।
সন্দেহজনক মৃত্যু হয়েছে বলে ধরা যেতে পারে–মিসেস ম্যাককে বলল কি যেন ঘটেছিল শুনেছি। তার কথার শেষে যাত্রা কথাটা উচ্চারণ করতে শোনা গেলো।
যাত্রা? –পোয়ারোকে বিস্মিত দেখালো।
একরাতে পালিয়ে গেলো। এলস্পেথ বললো আর ফিরেছে বলে শুনিনি। মিসেস লেওয়েলিন স্মিথের কথা বলছ? না, না। যাত্রাদলের মেয়েটার কথা বলছি। তার পক্ষে ওষুধের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে দেওয়ার সুযোগ যথেষ্ট ছিল। শেষ পর্যন্ত অনেক টাকার মালিক হয়েছিল, কিম্বা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। তারপর আর তার কথা শোনা যায়নি। যাত্রা কথাটা পোয়ারোর মাথায় ঘুরছে। কেউ মিসেস লেওয়েলিন স্মিথের মৃত্যু সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল?- পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলো।
না, ভদ্রমহিলা হার্টের অসুখে ভুগছিলেন, নিয়মিত চিকিৎসাধীন ছিলেন।
কিন্তু সন্দেহজনক ভাবে যারা মারা গেছে তাদের নামের তালিকার প্রথমেই ওর নাম কেন রেখেছ বন্ধু?– স্পেনসকে পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল।
বুঝিয়ে বললো স্পেনস, ভদ্রমহিলা ছিলেন ধনী। তার মৃত্যু যে অপ্রত্যাশিত তা নয়, তবে হঠাৎ হয়েছে। চিকিৎসা করছিলেন যে ডাক্তার সেই ডাঃ ফার্গুসন খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আমার ধারণা তিনি ভেবেছিলেন আরো কিছুদিন ভদ্রমহিলা বাঁচবেন। তবে তাকে ডাক্তার যা নিষেধ করতেন তিনি সেইগুলোই করতেন। এসব তার হার্টের পক্ষে ক্ষতিকারক ছিল। ভদ্রমহিলা ছিলেন জাহাজ কোম্পানীর মালিকের বিধ্বা স্ত্রী। প্রচুর টাকা ছিলো।
আচ্ছা এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অনুসন্ধান করার প্রশ্ন ওঠেনি?
না, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল স্বাভাবিক ভাবে।
এলস্পেথ বললো, যাত্রাদলের মেয়েটা ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী।
কেন?
কারণ মেয়েটা উইল জাল করেছিলো।
পোয়ারো বললো, আমাকে এই উইল জালের ব্যাপারটা খুলে বলো।
আগে অনেকগুলো উইল করেন। প্রত্যেকটা প্রায় একই ধরনের। তার শেষ ইচ্ছাপত্রে সবকিছু যাত্রাদলের মেয়েটাকে দিয়ে গেছেন, এলস্পেথ বলল, তার সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে। মেয়েটা মধ্য ইউরোপের কোনো দেশ থেকে এসেছিল, এক বছরের কিছু বেশি সময় বৃদ্ধার কাছে ছিল। আইনবিদ্রা সরাসরি উইল জালের অভিযোগ আনলো।
সবাই ধরে নিলো যে যাত্রাদলের মেয়েটাই এই উইল জাল করেছে।
মিসেস লিওয়েলিনের নিজের উকিলরা এই জালিয়াতি ধরেছিল?
হ্যাঁ, ফুলার্টন হ্যারিমান আর লিডবেটার। মেনচেস্টারের একটা নামী ফার্ম। ভদ্রমহিলার আইন সংক্রান্ত কাজ তারাই করত। যাত্রা দলের মেয়েটার বিরুদ্ধে আদালতে যাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই সে গা ঢাকা দিল। সম্ভবত নিজের দেশেই পালিয়ে যায় কিম্বা নিজের পরিচয় পরিবর্তন করে নিজেকে গোপন করে আছে।
কিন্তু প্রত্যেকের ধারণা মিসেস লেওয়েলিন স্মিথের মৃত্যু স্বাভাবিক।
পোয়ারো জানতে চাইলো, ভদ্রমহিলা কিরকম সময়ে মারা গেছে কোথায়?
নিজের বাড়িতেই মারা গেছেন।
কি একটা কাজে একদিন বাগানে গেলেন। তাকে ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করতে দেখা গেল, জানালেন শরীরটা খুব ক্লান্ত। বাংলোয় ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। আর উঠলেন না। ডাক্তারী মতে সবই স্বাভাবিক। পকেট থেকে একটা নোটবুক বের করল পোয়ারো। একটা পাতার ওপর দিকে লেখা আছে যারা স্বাভাবিক ভাবে মারা গেছে। তলায় লিখলোএক নম্বর। মিসেস লেওয়েলিন সম্পর্কে আলোচনা হলো। পরের পাতায় স্পেনসর নামগুলো একে একে লিখলো। তারপর জিজ্ঞাসা করলো, কার্লোট বেনফিল্ড?
স্পেনস সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ষোল বছর বয়স। একটা দোকানে সহকারীর কাজ করতো। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করা হয়েছিল। কোম্বারী উডের কাছে রাস্তার পাশে ফুটপাতের ওপর পড়ে থাকতে দেখা যায়। দুজন যুবককে সন্দেহ করা হয়। তারা মাঝে মাঝে মেয়েটার সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
পিটার গার্ডনের বয়স হবে একুশ। অল্পবয়সী অপরাধীদের সঙ্গে মিশতো, কিন্তু নিজেকে কোনোদিন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলেনি।
আর একজন যুবক টমাস হুড এর বয়স একুশ। একটু লাজুক প্রকৃতির। একটু খেপাটে। মানসিক বিকারগ্রস্ত অবস্থায় কোনো অপরাধ করে ফেলা অসম্ভব কিছু ছিল না। মেয়েটা তাকে নাচাত, হিংসার বশবর্তী হয়ে খুন করা অসম্ভব ছিল না। তবে সে ধরনের কোনো প্রমাণ পুলিস পায়নি।
পোয়ারো আর একটা নাম পড়ল, লেসলি কেরিয়ার। স্পেনস বলল, উকিলের কেরানী, বয়স আঠাশ। কে বা কারা ছুরি মেরে খুন করে। ঘটনাটা ঘটে গ্রীন সোয়ান পাবের কাছাকাছি।
এই বাড়ির মালিক হ্যারী গ্রিফিনের স্ত্রীর সঙ্গে লেসলির একটা হৃদয় ঘটিত ব্যাপার ছিল। মহিলাটির দেখবার মতো রূপ ছিল। বয়সে লেসলির চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়ই ছিল। স্ত্রীর পক্ষেই কাজটা করা সম্ভব। চলনে বলনে সে ছিল জিপসিদের মত আর মেজাজ ছিল খুব উগ্র। তবে দোষ লেসলিরও অনেক ছিল। কুড়ি বছর বয়সে জালিয়াতি করার অপরাধে অল্পদিনের জেল খাটে। জেল থেকে বের হওয়ার পর ফুলার্টন হ্যারিসন আর নিউরেটার কোম্পানী তাকে চাকরীতে বহাল করে।
চাকরীর পর একটা বাজে দলের সঙ্গে মেলামেশা করতো। অনেকের ধারণা এই দলের কেউ তাকে খুন করেছে। তার নামে ব্যাঙ্কের এ্যাকাউন্টে মোটা অংকের টাকা ছিল। নগদে জমা দেওয়া হয়েছিল। কোথা থেকে সেই টাকা পেয়েছিল তার কোনো হদিশ মেলেনি। ব্যাপারটা সন্দেহজনক।
পুলিস ধারণা করতে পারেনি কোথা থেকে এই টাকা পেয়েছিল?
না।
তাহলে এই খুন হতে দেখা জয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। পোয়ারো।
শ্বাসরোধ হয়ে খুন হওয়া অবস্থায় পায়ে হাঁটা পথ স্কুল থেকে তার বাড়ির মাঝামাঝি জায়গায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ওখানে নোরা এমব্রোজ নামে একজন মহিলার সঙ্গে থাকতো। নোরার বিবৃতি অনুসারে জানা যায়, বছরখানেক আগে একটি পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করবার পর থেকে তাকে ভয় পেতে থাকে। কারণ মাঝে মাঝে সে জেনেটকে ভয় দেখিয়ে চিঠিপত্র লিখতো। নোরা লোকটার নাম না জানলেও কোথায় থাকতো সেটা জানতো।
আহ!– পোয়ারো বললো বেশ ভালোই লাগছে শুনতে। সে জেনেট বোয়াইটের নামের পাশে একটা দাগ দিল। কারণ এই ধরনের খুন জয়েসার মত কোনো মেয়ের পক্ষে দেখা সম্ভব। নিহত স্কুল শিক্ষককে সে চিনতে পেরেছিল।
কিন্তু আততায়ী তার অপরিচিত ছিল। দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি করতে দেখেছিল। কিন্তু তখন তার মনে কোনো দাগ কাটেনি। পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জয়েসা বুঝতে পারলো লোকটার গলা চেপে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছিল।
পোয়ারো বললো, আমরা আড়াই বছর আগে থেকে তিন দিন আগের ঘটনায় এসেছি। এখন দেখতে হবে উডলিফ কমন্সে কে আছে এমন ব্যক্তি যে একজন পুরোন অপরাধী।
পার্টিতে যারা উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে কেউ সুযোগ বুঝে খুন পর্ব শেষ করেছে বলে মনে হয়।
কাজের সুবিধার জন্য স্পেনস একটা নামের তালিকা পোয়ারার দিকে এগিয়ে দিলো যাতে আঠারোটা নাম লেখা আছে।
তুমি নিশ্চিত এই সব নাম? না। স্পেনস বলল, অনেকে বিভিন্ন কাজে এসেছে আবার চলে গেছে। পোয়ারো জানালো, ডাঃ ফাগুসনের কাছে যাওয়ার কথা আছে। এখন ওখানে যাব।
নাম লেখা কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রাখলো পোয়ারো।
.
০৯.
ডাঃ ফার্গুসন স্কটিশ। বয়স প্রায় ষাট। কথাবার্তা অমার্জিত। পোয়ারোর আপাদমস্তক বারকয়েক দেখে নিলেন ভদ্রলোক। তারপর জানতে চাইলেন পোয়ারোর আগমনের হেতু।
পোয়ারো কোনো ভনিতা না করে খুনের ব্যাপারটা জানালো। তারপর বললল, স্পেনস। আর ইনসপেক্টর রাগলাস-এর প্রতিশ্রুতি পেয়েছি, আশা করছি আপনার দয়াও পাবো।
দয়ার কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না।-ফার্গুসন বললেন, ঠিক কি ঘটেছে তা জানি না, তবে শুনেছি পাটির্তে একটা ছোট মেয়ে এক গামলা জলে মাথা গোঁজা অবস্থায় মারা গেছে। নিশ্চয়ই কোনো পাগলের কাণ্ড। জানেন মানসিক রোগগ্রস্ত অনেক নারী পুরুষ আমাদের মধ্যে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। তাদের কথাবার্তা আর চালচলন দেখে ধরতেই পারবেন না। কিন্তু সুযোগ পেলে তারাই খুন করে নিতান্ত প্রবৃত্তির তাড়নায়। তিনি আরও বললেন, মেয়েটা আমার চিকিৎসাধীন ছিল। মেয়েটি অতিরিক্ত কথা বলতো কিছু জনশ্রুতিও আমার কানে এসেছে। ডাঃ ফার্গুসন বললেন, ওই খুন হতে দেখা–তাই তো? এরজন্যে কারো মনে খুন করবার মোটিভ তৈরি করতে পারে।
অন্য কারণও হতে পারে, যেমন মানসিক অস্থিরতা। খুনীর মানসিক অস্থিতি এর কারণ হতে পারে। একজন মনোবিজ্ঞানীই ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারবেন।
তাহলে আপনি মনোবিজ্ঞানীর মতামত নেওয়ার সপক্ষে?
নিশ্চয়ই ধরুন যে ছেলেটা জয়েসাকে খুন করেছে তার বাবা-মা সুন্দর মানুষ, স্বাভাবিক মনের মানুষ। কিন্তু কেউ কোনোদিন কল্পনাও করেনি ছেলেটা অপ্রকৃতিস্থ।
তেমন কেউ আপনার চোখে পড়েছে?
উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া শুধু লক্ষ্মণ দেখে আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
তাহলে আপনার বিশ্বাস পার্টিতে এধরনের কোনো লোক ছিল?
পোয়ারো বললো, থাকবে নাই বা কেন, খুনী উপস্থিত না থাকলে খুন হবে কেন?
হ্যাঁ, খুনী পার্টিতে ছিল একজন অতিথি রূপে।
ডাঃ ফার্গুসন বললেন, আমি নিজেও পার্টিতে উপস্থিত ছিলাম, অবশ্য একটু দেরী হয়েছিল পৌঁছুতে। শুধু দেখতে গিয়েছিলাম কি ঘটছে সেখানে।
খবরের কাগজে সামাজিক বিজ্ঞপ্তি ছাপা হওয়ার মতো ছাপা হলো : উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে ছিল–একজন খুনী।
.
১০.
পোয়ারো দি এলমস বাড়িটার দিকে তাকিয়ে প্রশংসা করল। সম্ভবতঃ প্রধান শিক্ষিকার সেক্রেটারী তার স্টাডিতে তাকে নিয়ে এল।
মিস এমলিন বলল, বসুন, মঁসিয়ে পোয়ারো। শুনলাম আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, জয়েসার মৃত্যু সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। আপনি কি ওকে ওর পরিবারকে ব্যক্তিগতভাবে জানেন?
না-পোয়ারো বলল, আমার বান্ধবী মিসেস আরিয়াদের অনুরোধে এই কেসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি, ভদ্রমহিলা এখানেই থাকেন আর এই পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন।
পোয়ারো বললো, আমার ধারণা আরও অনেক হত্যাকাণ্ডের মতো এটাও একটা। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো মোটিভ আছে। মোটিভটা হল প্রবৃত্তি সম্পন্ন হতে পারে।
কারণ? জয়েসার উক্তি সেই খুন হতে দেখা–শুনেছি ওর কথা কেউ বিশ্বাস করেনি।
সেটাই স্বাভাবিক। আপনাকে খোলাখুলি বলতে চাই মঁসিয়ে পোয়ারো, জয়েসা ছিল মাঝামাঝি ধরনের মেয়ে, বুদ্ধিমতী তো ছিল না, আবার বোকাও ছিল না। কোনো দোষ ত্রুটির মধ্যে নিজেকে জড়াত না। তবে দাম্ভিক প্রকৃতির ছিল। যেসব ঘটনা ঘটেনি তাই নিয়ে দম্ভোক্তি করতে ছাড়ত না। শেষ পর্যন্ত দাঁড়াল এই যে তার কথা কেউ বিশ্বাস করত না।
তার মানে জয়েসা মোটেই খুন হতে দেখেনি?
আমার যথেষ্ট সন্দেহ হয়।
এমলিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বেল বাজাল তারপর সে বলল, মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার মতে মিস এলিজাবেথ উইটেকার-এর সঙ্গে কথা বললে আপনি লাভবান হবেন।
মিস এমলিন ঘর থেকে চলে যাওয়ার পাঁচ মিনিট পরে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো একজন চল্লিশ বছরের মহিলা। মাথার চুলের রঙ পিঙ্গল, ছোট করে ছাঁটা।
আপনি মঁসিয়ে পোয়ারো –মিস উইটেকার জিজ্ঞাসা করল। আপনি নাকি আমার সাহায্য চান? মিস এমলিন এই ধরনের কথাই বললেন।
মিস এমলিন যখন বলেছেন আপনি নিশ্চয়ই সাহায্য করতে পারবেন। বসুন, মিস ইউটেকার।
এলিজাবেথের বুক তোলপাড় করা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। সে বলল, আমার অনুমান আপনি জয়েসা রেনল্ড এর ব্যাপারে এসেছেন।
পোয়ারো বলল, ঠিক ধরেছেন।
বলুন কি জানতে চান?
দেখুন, সেদিন সন্ধ্যায় পার্টিতে যা ঘটেছিল আমার জানা দরকার। আপনি পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন।
ছিলাম। চমৎকার পার্টি হয়েছিল। নানা বয়সের প্রায় ত্রিশজন উপস্থিত ছিল। আপনি বোধ হয় জানতে চান আমার চোখে বিশেষ কিছু পড়েছে কিনা বা কোনো ঘটনার উপর গুরুত্ব দিয়েছি কিনা?
হ্যাঁ, পোয়ারো বললো, যা বলবার নিঃসংকোচে বলুন।
যেমন আশা করা গিয়েছিল বিভিন্ন অনুষ্ঠান ভালোভাবেই শেষ হয়। শেষ অনুষ্ঠান ছিল স্ন্যাপড্রাগন ফুল পোড়ান। ছেলেমেয়েরা চিৎকার করছিল আর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছিল সারা ডাইনিং হলে। ঘরের মধ্যে তখন ভীষণ গরম। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে হলঘরে এলাম। হল ঘরে এসেই আমার নজরে পড়ল দোতলায় যে সিঁড়ি উঠে গেছে তার ল্যাণ্ডিংয়ে এসে দাঁড়ালেন মিসেস ড্রেক। হাতে ফুল আর পাতা ভর্তি একটা বড় ফুলদানী। ঘুরে যাওয়া সিঁড়ির কোণে দাঁড়ালেন কি যেন চিন্তা করলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর লাইব্রেরীর ঘরের দিকে তাকালেন।
তারপর–পোয়ারো নড়ে চড়ে বসল।
নেমে আসার আগে নিশ্চল অবস্থায় লাইব্রেরীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। হাতে ধরা ফুলদানী হাত থেকে মেঝেয় পড়ে গুঁড়িয়ে গেলো।
আপনি নিশ্চিত যে মিসেস ড্রেক কিছু দেখে চমকে উঠেছিলেন।
হ্যাঁ। সম্ভবত আশা করেননি এমন কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেখে চমকে উঠেছিলেন। হাত থেকে ফুলদানী পড়ে যায়।
মিসেস ড্রেক তারপর কি করলেন?
বিচলিত হয়ে কিছু যেন বলতে চাইলেন।
আপনি নিশ্চিত যে উনি চমকে উঠেছিলেন?–পোয়ারো জানতে চাইলো।
আমার তো তাই মনে হয়েছে, মঁসিয়ে পোয়ারো।
তাহলে এখন প্রশ্ন হলো, একটু আগে ওই লাইব্রেরী ঘর থেকে বেরিয়ে মানুষের উপস্থিতি বুঝতে পেরে আবার ভিতরে ঢুকে যে দরজা বন্ধ করে দিল, সে কে? তারপর ধরা যাক অতিথিরা যখন খুব ব্যস্ত, সে তখন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে অবশ্য মৃতদেহ আবিষ্কারের আগেই। আপনাকে আর একটা প্রশ্ন করতে চাই। নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন পার্টিতে কোনো খেলার পর কোনো খেলা হয়?
মনে হচ্ছে পারব–এলিজাবেথ সামান্য সময় চিন্তা করে বলল, প্রথমে হয় বঁটার প্রতিযোগিতা, তারপর হয় বেলুনের খেলা, এরপর হয় আয়নার খেলা। সব খেলার শেষে হয় স্ন্যাপড্রাগনের খেলা। জয়েসাকে শেষ দেখা যায় ময়দার খেলায়।
আচ্ছা আপনি তো স্কুলে পড়ান। বছর দুই আগে এই স্কুলে জেনেট হোয়াইট নামে একটি মেয়ে পড়তো তাকে আপনি চেনেন?
এলিজাবেথ সহসা আড়ষ্ট হয়ে পড়লো। একটু বিব্রত বোধ করে বললো, এই সব ঘটনার সঙ্গে জেনেটের সম্পর্ক কোথায়?
পোয়ারো বললো, থাকতেও তো পারে। আচ্ছা জয়েসা জোর দিয়ে বলছে যে কয়েক বছর আগে সে একটা খুন হতে দেখেছো, এটা কি জেনেটের খুন হওয়ার ব্যাপার বলে আপনার মনে হয়? জেনেট হোয়াইট কিভাবে মারা যায়?
তাকে শ্বাসরোধ করে মারা হয়। একরাতে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল– সম্ভবত একা নয়।
আচ্ছা, জয়েসা কিভাবে এই ঘটনা দেখতে পারে বা জানতে পারে?
কোয়ারী উডের কাছে একটা সরু গলিতে ঘটনাটা ঘটেছে। তখন তার বয়স নিশ্চয়ই দশ এগারো হবে।
পুলিস এই কেসটার কোনো কিনারা করতে পারেনি?
এলিজাবেথ মাথা নাড়ল। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতে বাঁধা ঘড়িতে সময় দেখল। তারপর সে বলল, এখন আমায় যেতে হবে।
পোয়ারো বললো, কষ্ট করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
২. কোয়ারী হাউসের দিকে
১১.
এরকুল পোয়ারো কোয়ারী হাউসের দিকে মুখ তুলে তাকালো। রানী ভিক্টোরিয়া যুগের বাড়ি, প্রত্যেকটি ঘর মূল্যবান আসবাবপত্রে সাজানো।
সদর দরজার কলিং বেল বাজাতেই এক বৃদ্ধা মহিলা দরজা খুলে দিয়ে জানালো যে কর্নেল আর মিসেস ওয়েস্টন লণ্ডনে গেছেন, ফিরতে পরের সপ্তাহ হবে। কোয়ারী উড সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেই সে জানালো বাগানটা জনসাধারণের জন্য বিনামূল্যে খুলে দেওয়া হয়েছে। রাস্তা ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটলে প্রবেশ পথ পড়বে। লোহার গেট-এর গায়ে একটা নোটিশ বোর্ড আছে।
পোয়ারো সহজেই রাস্তার সন্ধান পেয়ে গেল। রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে গাছ আর ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে সে নিচের দিকে নেমে এল।
এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। মনটা আনমনা হয়ে গেল। তার মনে পড়তে লাগলো একটা জাল উইল আর একটা মেয়ের কথা। সেই মেয়েটার নামে উইলটা জাল করা হয়েছিল। তারপর মেয়েটা বলা নেই কওয়া হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। একজন পেশাদার শিল্পী এখানে এসেছিল অবিন্যস্ত পাথরের কোয়ারীতে একটা মনোমুগ্ধকর বাগানের রূপ দিতে। সেই শিল্পীর নাম মাইকেল গারফিল্ড।
কোয়ারী হাউসের লোকগুলোর কথা মনে পড়ল পোয়ারোর, নামগুলো জেনে নিয়েছে। বৃদ্ধ কর্নেল আর তার স্ত্রী থাকেন। এই বাড়িতে বর্তমানে যেই বাস করুন না কেন মিসেস লেওয়েলিন স্মিথের মতো ভালোবাসতে কেউ পারবে না। রাস্তায় হাঁটতে লাগলো পোয়ারো। কিছুদূর গিয়ে দেখা হলো স্থপতি-শিল্পী মাইকেল গারফিল্ড-এর সঙ্গে। বিচিত্র হাসি হেসে মাইকেল বললো, আপনাকে আমি চিনি। একজন কৃতি মানুষের অনুরোধে আপনি এখানে এসেছেন। রক্তের দাগ অনুসরণ করে আপনি এগোচ্ছেন।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছো। পোয়ারো মাইকেলকে জয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে তেমন কিছু খবর সংগ্রহ করতে পারলে না।
পোয়ারো সতর্ক পদে এগিয়ে চললো। কিছুদূর এসে দেখলো পথ তিনভাগে ভাগ হয়ে গেছে। সে মাঝের পথটা ধরে কিছুদূর এগিয়ে দেখলো একটা গাছের ডালের ওপরে তার অপেক্ষায় বসে আছে একটা মেয়ে।
মেয়েটা বললো, তুমি এরকুল পোয়ারো, তাই না?
হ্যাঁ, ওটাই আমার নাম।
মেয়েটার নাম মিরান্দা। মেয়েটি বললো, এখানে মানুষ খুব একটা আসে না, বোধ হয় ভয় পায়।
কেন ভয় পাবে কেন?
অনেকদিন আগে এখানে একজন মহিলা খুন হয়েছিলেন, তখন অবশ্য বাগান তৈরি হয়নি। পথেরের কোয়ারী ছিল, মৃত অবস্থায় তাকে সেখানে পাওয়া যায়। সেই পুরোন প্রবাদ বাক্য তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই–তুমি জন্মেছ ফাঁসিতে ঝোলার জন্য অথবা জলে ডোবার জন্য।
জয়েসাও জলে ডুবে মরেছে, মা আমাকে বলতে চায়নি, তবে ব্যাপারটা একেবারে বাজে। তোমারও কি তাই মনে হয় না।
জয়েসা তোমার বান্ধবী ছিল? জয়েসার খুন হওয়ার কথা তুমি কার কাছে শুনলে?
মিসেস পেরিংএর কাছে আমাদের রান্নার লোক। ঘর পরিষ্কার করতে আসে মিসেস মিনে, সে বলেছিল কে যেন জয়েসার মাথা এক গামলা জলের মধ্যে চেপে ধরেছিল।
কে ধরেছিল আন্দাজ করতে পার?
অত ভেবে দেখিনি, আমি তো পার্টিতে যাইনি। আমার জ্বর হয়েছিল বলে মা আমায় নিয়ে যায়নি। তবে চেষ্টা করলে জানতে পারি।
মিরান্দাকে অনুসরণ করে পোয়ারো একটা বাগানে ঢুকলো। একটা গোলাপ বাগান। পেছনের একটা দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। মেয়ের সঙ্গে মায়ের চেহারার যথেষ্ট মিল আছে। জুডিথ বাটলারের বয়স হবে পঁচিশের মতো। মেয়ের চেয়েও সুন্দরী।
জুডিথ হাসিমুখে বললো-মঁসিয়ে পোয়ারো, আরিয়াদের কথামতো এখানে এসেছেন। বলে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
মিসেস অলিভার কিছু করতে বললে অস্বীকার করতে পারি না-পোয়ারো বললো।
কি বাজে কথা বলছ!–মিসেস অলিভার প্রতিবাদের সুরে বলল।
ওঁর ধারণা যে নৃশংস ঘটনা ঘটেছে আপনি তার সমাধান করতে পারবেন।
জয়েসা যে খুন হয়েছে সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না।-পোয়ারো বলল।
মিসেস অলিভার বলল, তুমি ইতিমধ্যেই হয়তো অনেক কিছু জেনেছে।
জুডিথ চা তৈরি করতে বসলো, মিরান্দা প্রত্যেকের প্লেটে কেক আর স্যাণ্ডউইচ পরিবেশন করলো।
চা পান করতে করতে নানাধরনের গল্প এবং আলোচনা চললো। কথায় কথায় জুডিথ বললো, আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে মঁসিয়ে পোয়ারো কেন জয়েসার নৃশংস পরিণতি ঘটলো। যতক্ষণ না জানতে পারা যাচ্ছে আমার বাচ্চার কথা ভেবে এক মুহূর্তের জন্য শান্তি পাব না।
বিদায় দেবার আগে পোয়ারো জানালো মেয়েকে সাবধানে রাখতে আর ও জানালো আগামী কাল মেলচেস্টারের মেসার্স ফুলার্টন হ্যারিসন আর লিডবেটার কোম্পানীর সঙ্গে সাক্ষাতের দিন ধার্য করা হয়েছে উইল জাল আর কয়েকটা বিষয়ে কথা বলার জন্য।
.
১২.
একটা পুরো বাড়িতে ফুলার্টন হ্যারিসন আর লিডবেটার কোম্পানী অবস্থিত ছিল। হ্যারিসন আর মিঃ আইকিনসন এবং যুবক মিঃ কোল আর আছে পুরোন পার্টনার মিঃ জেরেমি ফুলার্টন।
রোগা আর বয়স্ক ব্যক্তি এই ফুলার্টনের কথাবার্তা ধূর্তামিতে ভরা একেবারে খাঁটি আইনবিদের মত।
আপনিই মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো?–মিঃ ফুলার্টন জিজ্ঞাসা করল। তার হাতে রয়েছে নোট লেখা একটুকরো কাগজ। পোয়ারো ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।
মিঃ ফুলার্টনকে তার পরিচিতি দিয়ে চিঠি দিয়েছে পুলিস ইনসপেক্টর হেনরী র্যাগলান আর স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের অবসর প্রাপ্ত পুলিস সুপার স্পেনস। ধাতস্ত হতে মিঃ ফুলার্টনের মিনিট চারেক সময় লাগলো। তারপর সে বললো, বলুন আপনাকে কি ভাবে সাহায্য করতে পারি? দেখেশুনে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা জয়েসা রেনল্ড নামে সেই মেয়েটা সম্পর্কে। বুঝতে পারছি না আপনাকে কিভাবে সাহায্য করবো। ভালো করে কিছুই জানি না।
কিন্তু আমি শুনেছি আপনারা ড্রেক পরিবারের আইন বিষয়ক পরামর্শদাতা?
হা এবার মনে পড়েছে হতভাগ্য হুগো ড্রেক।
আপনারা তো মিসেস লেওয়েলিন স্মিথের আইন বিষয়ক পরামর্শদাতা ছিলেন?
হা বছর দুয়েক আগে মারা গেছেন।
তার মৃত্যু এসেছে অপ্রত্যাশিতভাবে।
ফুলাৰ্টন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকালো। সে বলল, ওকথা আমি বলব না। ওঁর হার্টের অবস্থা খারাপ ছিল, তাছাড়া স্নায়বিক রোগেও ভূগছিলেন–অমূলকভাবে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়তেন।
পোয়ারো বললো, অন্য বিষয়ে আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। আপনার কর্মচারী ছিল লেসলি ফেরিয়ার তার সম্পর্কে কিছু খবর জানতে চাই।
মিঃ ফুলার্টনের দুচোখে বিস্ময় পুঞ্জীভূত হল। ওর সম্পর্কে বেশি কিছু বলতে পারবো না। ওকে ছুরি মারা হয়েছিল, যতদূর মনে পড়ছে পুলিস সন্দেহ করেছিল কাজটা কার, কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারেনি। গ্রীন সোয়ানের কাছে বাইচ প্রতিযোগিতা দেখতে গিয়ে ফেরার পথে আততায়ীর হাতে ছুরিকাহত হয়।
কেউ ওকে ছুরি মারতে দেখেনি। যেমন ধরুন কোনো বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে?
গভীর রাতে? অসম্ভব।
আমার কাছে কিন্তু অবাস্তব মনে হচ্ছে না। শিশুরা অনেক সময় এ ধরনের দৃশ্য দেখে ফেলে। যে দৃশ্য দেখে শিশুরা ভয় পায় সেই দৃশ্যের কথা তারা সাধারণতঃ বলে না।
মিঃ পোয়ারো, আমার কাছে আপনার আসার উদ্দেশ্য এখনও পরিষ্কার নয়। আপনি কি জয়েসা রেনল্ড আর লেসলি ফেরিয়ারের মৃত্যুর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে বলে সন্দেহ পোষণ করেছেন?
যে কেউ যা খুশী সন্দেহ করতে পারে।–পোয়ারো বললো, প্রয়োজনে আরও কিছু খোঁজার চেষ্টা করতে পারি। আপনি শুনেছেন বোধ হয়। মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে জয়েসা জোর দিয়ে বলেছে যে সে একটা খুন হতে স্বচক্ষে দেখেছে এবং এই কথা অনেকে শুনেছে।
এধরনের জায়গায় নানা ধরনের কানাঘুষা শোনা যায়। এই ধরনের কোনো কথা যদি কেউ রঙ চড়িয়ে বলে
আচ্ছা আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই একটি বিদেশী মেয়ের অদৃশ্য হওয়ার ঘটনা, ওর নাম ছিল খুব সম্ভব ওলগা কিম্বা সোনিয়া। মিসেস লেওয়েলিনের সঙ্গদান কিম্বা নার্সের কাজ করত।
হা আগেও কটা মেয়ে ওঁর কাছে কাজ করেছে, তাদের মধ্যে দুজন ছিল বিদেশী। একজন বিদেশী মেয়ের সঙ্গে চাকরীতে ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একদিন তুমুল ঝগড়া হয়, অপর মেয়েটা ছিল একটু বোকা ধরনের। মিসেস স্মিথ তার জীবন এমন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন যে চাকরী করতে পারেনি। তবে ওলগার সঙ্গে ওর বনিবনা ভালই হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ছে মেয়েটা দেখতে তেমন ভালো ছিল না। প্রতিবেশীরা তাকে সুনজরে দেখতো না।
কিন্তু মিসেস লেওয়েলিন ওকে বেশ পছন্দ করতেন–পোয়ারো বলল, ভদ্রমহিলা তার উইলে অনেক অর্থ মেয়েটিকে দিয়ে যান।
হ্যাঁ, এটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। একদিন জানা গেল, উইলটা জাল, সইয়ের সঙ্গে মিসেস লেওয়েলিনের সইয়ের মিল নেই। জানা গিয়েছিল ওলগা মাঝে মাঝে মালিকানার হাতের লেখা নকল করে মিসেস লেওয়েলিনের চিঠির জবাব দিত। ভদ্রমহিলার মৃত্যুর পর ওলগা ভেবেছিল সবাই জাল উইলটা মেনে নেবে, কিন্তু হাতের লেখা বিশেষজ্ঞরা শেষ পর্যন্ত মেনে নেয়নি।
আইনের সাহায্য নেওয়া হলে ও প্রথম শুনানীর তারিখ পড়বার আগেই মেয়েটা ভয়ে আত্মগোপন করে।
.
১৩.
এরকুল পোয়ারো বিদায় নেওয়ার পর জেরেমি ফুলার্টন ডেস্কের পিছনে বসে দূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। মনটা অতীতের ঘটনায় ফিরে যাচ্ছে। ঠিক দুবছর আগেকার ঘটনা।
তার চোখের সামনে ফুটে উঠলো একটা দৃশ্য। একটা মেয়ে সামনের চেয়ারে বসে আছে। বেঁটে আর মোটাসোটা চেহারা। শ্যামবর্ণা। চাহনিতে জড়ান দারিদ্রের ছাপ। মেয়েটা ছিল সেই ধরনের যার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সংগ্রাম করে আর প্রতিবাদ করে যায় সত্য রক্ষার্থে। কে জানে এখন মেয়েটা কোথায় আছে? ভাবল ফুলার্টন।
ওলগা হয়তো মধ্য ইউরোপে ফিরে গেছে। সেখান থেকেই এসেছিল। নিজের নিরাপত্তার জন্য ফিরে যাওয়া ছাড়া তার সামনে অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না।
জেরেমি ফুলার্টন আইনের পূজারী, বিচারকের দুর্বল রায় তার কাছে ঘৃণ্য। তবে তার মনে যে সমবেদনা বা দুঃখবোধ নেই তা নয়। ওলগা সেমিলোফের জন্য ও সে দুঃখ করেছে। ওলগা বলেছিল–আমি বিদেশী মেয়ে, কোনোভাবেই প্রমাণ করতে পারবো না যে উইলটা জাল নয়। আমাকে জেলে পোরা হবে। আতঙ্কিত স্বরে ওলগা বলেছিল, আর কখনও বেরিয়ে আসতে দেবে না।
অনেকে বলছে আমি নাকি উইল জাল করেছি, হাতের লেখা নাকি আমার নিজের। উইলে ঝিয়ের সই আছে, সই আছে মলির।
অবিশ্বাস করছি না। তবে তোমার হয়ে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তাহলে দেখছি লুকিয়ে থাকাই ঠিক হবে–ওলগা বলেছিল, আমাকে খুঁজে না পেলে আমার ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। ইংল্যাণ্ড থেকে পালিয়ে যাবো। একজন চেনা লোক আছে যে পাশপোর্ট আর ভিসা জাল করতে পারে।
শোন!–ফুলার্টন বলেছিল, তোমার জন্যে দুঃখবোধ হচ্ছে। একজন উকিলের কাছে তোমায় পাঠাচ্ছি সে সাহায্য করতে পারে। পালাবার কথা ভেবো না।
ওলগা বলেছিল, কেউ নিশ্চয়ই আমায় সাহায্য করবে। তার সাহায্যে আমি আত্মগোপন করব, কেউ খুঁজে পাবে না আমায়।
সত্যিই তাই, কেউ ওলগার দেখা পায়নি সেই থেকে, মেয়েটা যেন হাওয়ায় উবে গেলো।
.
১৪.
এ্যাপল ট্রীজ পৌঁছে এরকুল পোয়ারো মিসেস ড্রেকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। সে খবর দিয়েছে আসতে বেশি দেরী হবে না। বেশ কয়েকজন মহিলার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। ড্রয়িং রুমের ওপাশ থেকে।
শেষ পর্যন্ত দরজা খুলে প্রবেশ করলো মিসেস ড্রেক। সে সবিনয়ে বললো, বসিয়ে রাখার জন্য দুঃখিত মঁসিয়ে পোয়ারো। বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি? মিসেস অলিভার কি এখন জুডিথ বাটলারের কাছে আছেন?
হ্যাঁ, আছেন পোয়ারো জানালো, তবে দুএকদিনের মধ্যেই লণ্ডনে ফিরে যাবে।
বেশ আমুদে। আচ্ছা এই নৃশংস ঘটনা সম্পর্কে উনি কি ধারণা পোষণ করেছেন?
কিছুই না- পোয়ারো বলল, আপনি কি ধারণা পোষণ করেছেন তাই বলুন। ধরুন, এমন কিছু দেখেছেন তখন কোনো গুরুত্ব দেননি কিন্তু পরে সেই ঘটনা নিয়ে চিন্তা করেছেন আর অর্থও খুঁজে পেয়েছেন। এলিজাবেথ উইটেকারের ধারণা আপনি কিছু দেখে ছিলেন পার্টিতে।
রোয়েনা সবিস্ময়ে মাথা কঁকালো। সে অস্ফুট কণ্ঠে বললো, কই তেমন কিছু তো মনে পড়ছে না। পোয়ারো বললো–একটা ফুলদানী নিয়ে ঘটনা।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সিঁড়ির কোণে ফুল দিয়ে সাজানো একটা কাঁচের বড় ফুলদানী রাখা ছিল। সন্দেহ হওয়ায় ভেতরে আঙুল ডুবিয়ে দেখি এক ফোঁটাও জল নেই। তাই বাথরুমে ঢুকে জল ভরে নিয়ে আসি।
পোয়ারো বললো, ইউটেকারের ধারণা, কোনো কিছু দেখে আপনি চমকে উঠেছিলেন। কাউকে লাইব্রেরী ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে দেখেছিলেন?
চমকে ওঠার মতো কিছুই দেখিনি, কাউকে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতেও দেখিনি কাউকে না….
অবাক হল পোয়ারো। এমন ভাবে রোয়েনা বলছে যেন সব সত্যি বলছে। হয়তো সেই লাইব্রেরী ঘরের দরজা সামান্য ফাঁক হতে দেখেছিল, কারো আবছা শরীর নজরে পড়েছিল।
এতো জোর দিয়ে বলছে কি করে? হয়তো যে লোককে দেখেছিল, কল্পনাও করতে পারেনি তার দ্বারা এমন নৃশংস অপরাধ সংগঠিত হতে পারে। নাকি কাউকে বাঁচাতে চাইছে? হয়তো এমন একজনকে বাঁচাতে চাইছে যার বয়স খুব বেশি নয়। পোয়ারোর মনে হলো মহিলাটির মন বেশ কঠিন, তবে মাৎ। কাউকে বাঁচাবার প্রবণতা তাকে পেয়ে বসেছে।
কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে এরকুল পোয়ারো কোনো সমঝোতা করে না। সে চিরকাল আইনকে সম্মান দিয়ে এসেছে। যার উপর একবার সন্দেহ পুঞ্জীভূত হয়, সেই সন্দেহ শেষ পর্যন্ত দানা বেঁধে থাকে। তার মনে দয়া থাকলেও অপরাধীকে দয়া দেখালে তাকে আরো অপরাধী করে তোলা হয়।
মাদাম আপনার কি মনে হয় এ অপরাধ কোনো বাচ্চা কিংবা কিশোর কিশোরী কিংবা কোনো যুবক যুবতী করেছে?
করতে পারে। আজকাল উঠতি ছেলেমেয়েদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। বয়সের দোষ বলতে পারেন।
পুলিসের উচিত হবে এই কেসের সমাধান করা। কিন্তু প্রমাণ সংগ্রহ করা খুব সোজা হবে, মাদাম।
না, হবে না। আমার স্বামী যখন মারা গেলেন–উনি খোঁড়া ছিলেন, রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা গাড়ি ওঁকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। যে গাড়ি ধাক্কা মেরেছিল পুলিস তার হদিশ। করতে পারেনি।
চাপা দিয়ে পালান গাড়িটা পুলিস হদিশ করতে পারল না? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল।।
না রোয়েনা বলল, সুস্থ মনে কেউ অপরাধ করে না।
তাহলে জয়েসার পরিণতি এমন হল কেন?– পোয়ারো বললো, কারো শক্ত দুটি হাতে ইচ্ছা করে মেয়েটার মাথা জলের মধ্যে চেপে ধরে রেখেছিল যাতে তার জীবন-দীপ নিভে যায়।
আমি জানি, আমি জানি– রোয়েনা চীৎকার করে উঠলো, আমাকে আর মনে করিয়ে দেবেন না। –উঠে দাঁড়িয়ে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলো।
পোয়ারো কঠিন কণ্ঠে বললো, আমাদের এখন জানতে হবে খুনীর কি ধরনের মোটিভ এখানে কাজ করেছে।
এধরনের অপরাধে কোনো মোটিভ থাকে না।
তবে কি ধরনের মানসিক রোগী এই খুন করে আনন্দ পেতে চেয়েছে?
আসল কারণ খুঁজে বের করা সহজ হবে না। এমন কি কোনো মনোবিজ্ঞানীও বলতে পারবে না।
জয়েসা সেইদিনই কয়ে ঘন্টা আগে জোর দিয়ে বলেছিল একটা খুন হতে দেখেছে।
প্রত্যেকে একই কথা বলছে।— উঠে দাঁড়িয়ে পোয়ারো বললো, যে কথা প্রত্যেকে বলছে সেটাই সঠিক বলে আমি মনে করি। তবে মিস উইটেকার আমায় বলেছেন –তাহলে ওর কাছে সব জানতে চাইছেন না কেন? উনি একজন মনস্তাত্বিক।
পোয়ারো রোয়েনার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার মাসীমা মিসেস লিওয়েলিন স্মিথকে দেখাশোনা করবার জন্য মাইনে করা একটি বিদেশী মেয়ে ছিল?
হ্যাঁ, ছিল। উনি মারা যাওয়ার পর কাউকে কিছু না বলে কোথায় যেন চলে গেছে।
নিজের ভালোর জন্যই হয়তো চলে গেছে।
তা জানি না। তবে মেয়েটা মাসীমার উইল জাল করেছিল কিম্বা কেউ তাকে জাল করতে সাহায্য করেছিল।
একজন যুবকের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব ছিল। সে মেলচেস্টারে একটা সলিসিটার অফিসে চাকরী করত। অতীতে কিছু জাল করবার অপরাধে তার জেল হয়েছিল।
পোয়ারো বললো, মেয়েটা নাকি একটা ভাঙা সংসার থেকে এসেছিল?
রোয়েনা ড্রেক মুখ তুলে মিটমিট হাসা পোয়ারোর দিকে তাকাল। কোনো কথা বললো না।
আমাকে যেসব কথা বললেন তার জন্য ধন্যবাদ, মাদাম।
পোয়ারো বিদায় নিয়ে রাস্তায় নামল। লেসলি সিমেন্ট্রি যাওয়ার রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল কিছুদূর। কবরস্থানে পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না। বছর দশেক আগে তৈরি হয়েছে। উডলিফ কমন্সে মানুষজন বাড়ার সঙ্গে এই কবরস্থানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। চারদিক কাটা তার দিয়ে ঘেরা।
কবরস্থানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পোয়ারো একটা কবরের সামনে এসে দাঁড়াল। কবরের উপর দাঁড় করানো একটা পাথরে লেখা আছে রোয়েনা আর বেলা ড্রেকের প্রিয়তম স্বামী হুগো এডমণ্ড ড্রেকের স্মৃতির উদ্দেশ্য। ইনি আমাদের ছেড়ে গেছেন ৩০শে মার্চ, ১এ–
বিচিত্র চরিত্রের রোয়েনা ড্রেকের কথা থেকে পোয়ারোর মনে হয়েছে মিঃ ড্রেকের জীবনে মৃত্যু নেমে এসেছে আশীর্বাদের মতো।
পোয়ারো, এই কবরস্থান পরিচ্ছন্ন রাখে যে মালী তার কাছ থেকে জানতে পারল যে মিঃ ড্রেক চমৎকার মানুষ ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন খোঁড়া।
দুর্ঘটনার মারা গেছেন, তাই না?
হ্যাঁ, গোধূলি বেলায় রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করছিলেন একটা মোটর গাড়ী ধাক্কা মেরে পালায়। মিঃ আর মিসেস ড্রেক আদর্শ দম্পতি।
ভদ্রমহিলা এখানে আর বেশিদিন থাকবেন না। এখানে সামাজিক কাজও অনেক করেছেন। সবাই ওঁকে শ্রদ্ধা ভক্তি করে।
এখন উনি এমন কোনো জায়গায় বাকি জীবন কাটাতে চান যেখানকার মানুষের জন্য কিছু করতে পারবেন।
কোথায় যেতে পারেন? ঠিক জানি না। তবে স্পেন, পতুর্গাল কিম্বা গ্রীসের কোনো দ্বীপে যেতে পারেন।
পোয়ারো হাসল। সে বলল, এখন চলি…আচ্ছা, বলতে পারবে নিকোলাস র্যানসাম আর ডেসমণ্ড হল্যাণ্ড কোথায় থাকে?
চার্চ পেরিয়ে গিয়ে বাঁহাতের তৃতীয় বাড়িটায়। প্রত্যেকদিন মেলচেস্টারে যায় কারিগরি ব্যাপারে শিক্ষা লাভ করতে। এতক্ষণে বাড়ি ফিরে আসে।
বিদায় নিয়ে পোয়ারো হাঁটতে শুরু করল।
.
১৫.
পোয়ারো ছেলে দুটিকে খুটিয়ে দেখল। অস্বস্তিতে ভরা দুজোড়া চোখ পোয়ারোকে দেখল। ছেলে দুটির কথাবার্তা আর আচার আচরণ বয়স্কদের মতো। নিকোলাসের বয়স হবে আঠারো আর ডেসমণ্ডের সোল।
যারা সেই পার্টিতে উপস্থিত ছিল তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি –
আচ্ছা এখানে ডাইনী বলে কাউকে চেন?
আপনি মাদাম গুডবডির কথা বলছেন? উনি পার্টিতে ডাইনীর ভূমিকায় ছিলেন।
তোমারা সেখানে কি ধরনের কাজ করেছো?
একটা খেলায় লাইটের কাজ।
মইয়ে উঠতে হয়েছিল?
হ্যাঁ। কিছু ছবি ছাদের তলা থেকে ঝোলাতে হয়েছিল।
ডেসমণ্ড পকেট থেকে একটা খাম বের করে ভেতর থেকে অনেকগুলো ছবি বের করে বলল, মেয়েদের ভাবী স্বামীর ফটো।
পোয়ারো কার্ডগুলি খুঁটিয়ে দেখলো।
এসবের জন্য মডেল আছে না? সবাই আমাদের লোক। মেকআপ করে ফটো তোলা হয়েছে। নিক আমার কয়েকটা ছবি তুলেছে। আর আমি নিকের ছবি তুলেছি। এগুলো আলোর আড়ালে ঝোলানো হয়েছিল যাতে ভৌতিক ব্যাপার মনে হয়, ডেসমণ্ড বললো।
নিকোলাস বললো, এগুলো দেখে মিসেস ড্রেক খুব খুশী হয়েছিলেন।
পার্টিতে বিকেলে কারা ছিল? মিসেস ড্রেক আর মিসেস বাটলার। তাছাড়া ছিলেন –একটার পর একটা পার্টিতে উপস্থিত মহিলাদের নাম বলে গেল ডেসম।
কোনো পুরুষ ছিল না?
যদি পল্লী যাজককে ধরেন তো একজন পুরুষ ছিল বৈকি।
আচ্ছা ওই মেয়েটাকে বলতে শুনেছ –জয়েসা রেনল্ডের কথা বলছি– একটা খুন হতে নাকি নিজের চোখে দেখেছে।
না, আমরা কেউ শুনিনি।
আচ্ছা পার্টিতে হয়ত এমন কিছু ঘটেছে যা অন্য কারো চোখে পড়েনি, কিন্তু তোমাদের চোখে পড়েছে।
নিকোলাস আর ডেসম স্মরণ করবার চেষ্টা করল, কিন্তু তেমন কোনো ঘটনা দেখেছে বলে মনে করতে পারল না।
তবে সকালের দিকে অধিকাংশ সময় উইটেকার ড্রইংরুমে ছিলেন, পোয়ারো বললো, উনি নিশ্চয়ই জয়েসাকে কথাগুলো বলতে শুনছিলেন, নিশ্চয়ই ওর মনে আছে কি বলেন?
নিকোলাস বললো, সম্ভবত উনি বিশ্বস্ত থাকবার আর মিস উইটেকারের দোষ ঢাকবার চেষ্টা করবেন।
আমার মনে হয় উনি সেরকম কিছু করবেন না। যদি এলিজাবেথ উইটেকার মাথা খারাপ করবার চেষ্টা করেন তাহলে স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের প্রচুর ক্ষতি হবে।
সেই ধর্মযাজকের খবর কি?– ডেসমণ্ড বলল, লোকটার নিশ্চয়ই মাথার গণ্ডগোল আছে। একটু যেন অস্থির প্রকৃতির, এখানে বেশিদিন আসেনি।
ওর সম্পর্কে কেউ বিশেষ কিছু জানে না। হয়তো স্ন্যাপড্রাগন উৎসবের আগুন দেখে অস্থির হয়ে পড়েছিল। সেই সময় জয়েসার হাত চেপে ধরে বলেছিল আমার সঙ্গে এস, তোমাকে একটা জিনিস দেখাব। তারপর তাকে লাইব্রেরীতে নিয়ে গিয়ে বলেছে হাঁটু ভেঙে গামলার সামনে বস। একে বলে ধর্মান্তকরণ। তার পরেই গামলার জলে মাথা চেপে ধরে বলেছে, দেখছ?
সম্ভবত সেই প্রথমবার মেয়েটার কাছে নিজেকে ব্যক্ত করে নিকোলাস বলল, এই সব ঘটনার আড়ালে যৌন আকর্ষণ কাজ করেছে।
আনন্দে উজ্জ্বল হওয়া দুটি চোখ সাগ্রহে পোয়ারোর দিকে তাকাল।
পোয়ারো বললো, আমি খুশী হয়েছি তোমাদের কথায়। এছাড়াও তোমাদের কাছ থেকে ভেবে দেখার মতো অনেক কিছু জানতে পারলাম।
.
১৬.
এরকুল পোয়ারো আগ্রহভরা চোখে মিসেস গুডবডির দিকে তাকাল। ডাইনী সাজবার মতোই চেহারা বটে। খুশীভরা গলায় কথা বলতে লাগল।
হ্যাঁ, আমি ওখানে ঠিক সময়েই পৌঁছেছিলাম। এসব ব্যাপারে ডাক এলেই আমি ডাইনীর ভূমিকায় নামি।
কারো ভবিষ্যৎ আপনি বলে দিতে পারেন? আপনার যাদু গোলকের দিকে তাকিয়ে বলতে পারবেন কে জয়েসাকে খুন করেছে?
বলা হয়তো যাবে, কিন্তু কে করেছে বললে আপনি মেনে দিতে পারবেন না– গুডবডি বলল, বলবেন প্রকৃতি বিরুদ্ধ কথা, কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়ম না মেনে তো কত কি ঘটে যাচ্ছে।
পার্টিতে নিশ্চয়ই কিছু আপনার চোখে পড়েছে?
দেখুন শয়তানের অস্তিত্ব সব জায়গাতেই মেলে। তাদের আমরা জন্ম দিই এবং বেড়ে উঠতেও সাহায্য করি।
আপনি ডাইনী বিদ্যার কথা বলছেন?
না, আমাদের সমাজেই অনেক শয়তান আছে। এদের চেনা যায় না। তাদের সংস্পর্শে যে যায় সেও শয়তানে পরিণত হয়।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে পোয়ারো বললো, আচ্ছা জয়েসা কি সত্যিই খুন হতে দেখেছিল?
কে বলেছে ও দেখেছে? বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। মেয়েটা খুব মিথ্যা কথা বলতো। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল গুডবডি, আমার ধারণা আপনি বিশ্বাস করেননি?
বিশ্বাস করেছি। পোয়ারো বলল, যদিও আমাকে অনেকে বিশ্বাস করতে নিষেধ করেছে।
জয়েসা মেয়েটা দিদির মতো বা ভাইয়ের মতো চালাক ছিল না, কিন্তু চালাক হতে চাইতো এমন ভাব দেখাত যেন সব জানে। অপরের চোখে পড়বার জন্য যে কোনো কথা অতিরঞ্জিত করে বলত। ফলে দেখা যেত সে যা বলছে একটা কথাও সত্যি নয়।
পোয়ারো জানতে চাইলো –তার ছেলেটা কেমন? লিওপোল্ড? –গুডবডি বলতে লাগল মাত্র নয় কি দশ বছর বয়স। তবে ভীষণ চালাক। ভবিষ্যতে বিজ্ঞানী হবার আশা। ছেলেটা প্রত্যেকের সাথে চালাকি করে। কোনো বাছ-বিচার নেই, তাদের গোপনীয় খবর শুনে তাদের কাছে থেকে হাত খরচা আদায় করে সেই গোপনীয় কথা কাউকে না বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
মিসেস গুডবডি একসঙ্গে অনেকগুলো কথা বলে চুপ করল, তারপর সে বলল, দেখুন এ ব্যাপারে আমি কোনো সাহায্য করতে পারব না। আমার ভয় করছে।
পোয়ারো বলল, আচ্ছা সেই বিদেশী মেয়েটার কি হলো বলুন তো? লোকে যে বলে পালিয়ে গেছে?
আমার মতে আর বেশি এগোনো ঠিক হবে না, মিসেস গুডবডি চাপা কণ্ঠে বললো। পোয়ারো বললো, ঠিক আছে আপনি অনেক সাহায্য করেছেন ধন্যবাদ।
.
১৭.
ক্ষমা করবেন মাদাম, ভাবছি আপনার সঙ্গে মিনিটখানেক কথা বলবো।
মিসেস অলিভার বান্ধবীর বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে পথের দিকে তাকিয়ে ছিল। একটু আগে এরকুল পোয়ারো টেলিফোনে জানিয়েছে কিছুক্ষণের মধ্যে তার কাছে আসবে।
দেখা গেল ধোপদুরস্ত পোষাক পরনে একজন ভদ্রমহিলা বারান্দার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
ভদ্রমহিলা কেমন যেন ঘাবড়ে গেছে।
মিসেস অলিভার ভেবে পেল না ভদ্রমহিলা এতো ঘাবড়ে গেছে কেন?
আপনিই তো সেই লেখিকা? অপরাধ আর খুন-জখম নিয়ে যিনি গল্প লেখেন?
হ্যাঁ, মিসেস অলিভার বলল। আমার ধারণা একমাত্র আপনিই আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবেন– অপরিচিতা বলল।
এখানে আসুন, বসে কথা বলুন।
— মিসেস অলিভার বলল।
অপরিচিতা মহিলা বারান্দায় উঠে একটা চেয়ার অধিকার করে বসল।
মিসেস অলিভার লক্ষ্য করল আঙ্গুলে বিয়ের আংটি রয়েছে সুতরাং সে যে বিবাহিতা সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। সে বলল, কোনো কারণে আপনাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।
একটা ব্যাপারে আপনার কাছে পরামর্শ চাইতে এসেছি। অপরিচিতা মহিলা বলল, অনেকদিন আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু তখন আমি এত দুশ্চিন্তা করিনি।
কোনো ঘটনার কথা বলছেন? হ্যালুইন পার্টিতে যে ঘটনাটা ঘটে গেছে।
মিসেস অলিভার নড়েচড়ে বসে বললো, আচ্ছা আপনার নামটা জানতে পারি?
লীম্যান, মিসেস লীম্যান। পাঁচবছর আগে আমার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে আমি লোকের বাড়িতে ঘর পরিষ্কারের কাজ করি। কোয়ারী হাউসে থাকতেন মিসেস লেওয়েলিন স্মিথ ওঁর কাছেও কাজ করেছি। তখন কর্নেল আর মিসেস ওয়েস্ট আসেননি। জানি না ভদ্রমহিলার সাথে আপনার পরিচয় ছিল কি না।
মিসেস অলিভার বললো, না, ছিল না। এই প্রথম উডলিফ কমন্সে এসেছি। তাহলে সেই সময় যা ঘটেছিল তা আপনার জানবার কথা নয়।
মিসেস অলিভার জানাল — এখানে আসার পর এ ব্যাপারে কিছু কিছু শুনেছি বটে।
উইল সম্পর্কে পুলিসের বক্তব্যে তো শুনেছেন
–শুনেছি।
সেই উইলে মিসেস স্মিথ তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি একটা বিদেশী মেয়েকে দিয়ে যান। মেয়েটাকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার নিজের নিকট আত্মীয় কাছে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি কিনা একজন বিদেশীকে উইল করে সব কিছু দিয়ে গেছেন — কেউ ব্যাপারটা মেনে নিতে পারল না। খোঁজ খবর নিয়ে দেখা গেল মেয়েটাই উইল জাল করেছে। মিসেস ড্রেক মানে, মিসেস স্মিথের আত্মীয়া আইনের সাহায্য নিতে তৎপর হলেন।
মিসেস লীম্যান বলল, সেই সময় আমি সঠিক কিছু জানতাম না। কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা যেন বিচিত্র বলে মনে হলো, ভাবলাম এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো সত্যি লুকিয়ে আছে।
আমি যা বলবো শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন যে কোনো ভুল আমি করিনি।
বেশ বলুন –মিসেস অলিভার বলল, নিশ্চয় বুঝতে পারব।
লীম্যান বলতে শুরু করল, একদিন মিসেস লেওয়েলিন হঠাৎ অসুস্থ বোধ করে আমাদের কাছে ডেকে পাঠালেন। আমি আর জিম কাছে গেলাম, তিনি ডেস্কের পিছনে কাগজ আর কলম নিয়ে বসেছিলেন। বিদেশী মেয়েটার দিকে ঘুরে বসে বললেন, তুমি এর মধ্যে থাকবে না, ঘরের বাইরে যাও। মিস ওলগা তার আদেশ পালন করল। মিসেস লেওয়েলিন স্মিথের সামনে যে কাগজ ছিল সেটা একটা উইল। শেষের দিকে তার নিজের সই ছিল। আমাদের দুজনকে নিচে সই করতে বললেন, আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু আমার মনটা কৌতূহলে ভরে গেল, দরজা সম্পূর্ণ বন্ধ না করে ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতরে চোখ রাখলাম।
কি দেখলেন?
দেখলাম উইলটা খামে ভরে মিসেস লেওয়েলিন স্মিথ উঠে বুক কেসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, তারপর একটা বই বের করে তার ভাঁজে উইলটা রেখে সেটা যথাস্থানে রেখে দিলেন।
যাতে সই করলাম তাতে কি লেখা আছে জানবার কৌতূহল আমাকে পেয়ে বসল।
পরদিন মিসেস লেওয়েলিন স্মিথ যখন গাড়ীতে চেপে মেলচেস্টারের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন, আমি তার ঘরে ঢুকলাম ঘর পরিষ্কার করতে। বুক সেল থেকে বইখানা বের করে দেখলাম, মিসেস লেওয়েলিন তাঁর সমস্ত অর্থ দিয়ে যাচ্ছেন মিস ওলগাকে, নিচে তার সই, তার নিচে আমার আর জিমের সই। তারপর উইলটা যেভাবে ছিল সেইভাবেই রেখে দিলাম।
মিসেস অলিভার কিছু বলল না, আর মিসেস লীম্যানও চুপ করে রইল।
কিন্তু পরে উইলের সত্যতা নিয়ে যখন কথা উঠল, তখন আমার সব মনে পড়ে গেল। মিসেস অলিভার জিজ্ঞাসা করলো, আপনি তখন কি করলেন?
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন লীম্যান, যা করা উচিত ছিল করিনি। আইনের ভয়ে মিস ওলগা পালিয়ে গেল। এমনও তো হতে পারে মেয়েটা সত্যই উইলটা জাল করেছিল, কিম্বা বৃদ্ধাকে প্রাণের ভয় দেখিয়ে নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছিল। সম্মোহনশক্তির সাহয্যে নাকি এরকম করা যায়।
এঘটনা কত বছর আগের? মিসেস স্মিথ মারা গেছেন দুবছর হল।
এতোদিন ব্যাপারটা আপনাকে ভাবায়নি এখন অন্যরকম ভাবছেন কেন?
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড মানে আপেল ভর্তি গামলার মধ্যে মাথা গুঁজে ধরে হত্যা করা আমাকে অন্যরকম ভাবতে বাধ্য করছে। মেয়েটা নাকি একটা খুন হতে দেখার ব্যাপারে কিছু বলেছে। মনে হল মিস ওলগা হয়তো বৃদ্ধা মহিলাকে খুন করছে সম্পত্তি পাওয়ার লোভে। নিতান্ত আইনের ঝামেলা হওয়ায় পালিয়েছে। লীম্যান থামলো।
কিন্তু আপনি আমার কাছে এসেছেন বুঝতে পারছি না– মিসেস অলিভার জিজ্ঞাসা করল। সেই উইলের ব্যাপারে।
আমি ওটা নিয়ে যাইনি, কোর্টে আর পুলিস মহলে আপনার চেনা জানা লোক আছে, দেখবেন আমি যেন ঝামেলায় পড়ে না যাই। এখন আমাকে বলুন এ ব্যাপারে আমার তরফ থেকে কাউকে কিছু জানানোর প্রয়োজন আছে কিনা।
আপনার আর জিমের পুরো নামটা কি?
আমার নাম হ্যারিয়েট লীম্যান। আর জিমের পুরো নাম হলো জেমস জেনকিন্স।
আমার মতে আপনার উচিত হবে মিসেস লেওয়েলিন স্মিথের উকিলকে প্রকৃত ঘটনা খুলে বলা, মিসেস অলিভার বলল, একজন ভালো উকিল নিশ্চয়ই মোটিভ আর অনুভূতি বুঝতে পারবে।
আমার হয়ে আপনি যদি ওদের বুঝিয়ে বলেন তাহলে বড় ভালো হয়।
আপনি যা করেছেন তার মধ্যে কোনো গলদ নেই। আপনার দেওয়া কৈফিয়তে যথেষ্ট যুক্তি আছে। মিসেস অলিভার বললো, আমার দিক থেকে যা করবার করব।
মিসেস লীম্যান বিদায় নিয়ে চলে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যে এরকুল পোয়ারো এসে প্রবেশ করল।
মিসেস অলিভার বললো, বসো, বল কি বলতে এসেছো, তারপর আমি এমন কিছু শোনাবো যা শুনে রীতিমতো অবাক হয়ে যাবে।
.
১৮.
পোয়ারো চেয়ারে বসে পা দুটোকে টান টান করে দিল। মিসেস অলিভার বললে, জুতো খুলে ফেলো পা দুটোকে বিশ্রাম দাও।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পোয়ারো বললো, ঠিক চারদিন আগে জয়েসা খুন হয়েছে। শুধু মনে হচ্ছে মেয়েটাকে কে খুন করলো। বোধহয় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা কোনো মানুষের কাজ হবে। কাউকে এভাবে মারা তার কাছে এক ধরনের খেলা। তাকেই খুঁজে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি।
আমার মনে হচ্ছে তোমার জানার ফলাফল তোমাকে পিছিয়ে এনেছে। সামনে এগোতে সাহায্য করেনি।
কোনো সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে পারছি না। উইল জালের ব্যাপারটাই ধরনা কেন? তোমায় যদি জানাই যে উইল জালিয়াতের ব্যাপারটা মোটেই জালিয়াত ছিল না, তাহলে?
কি বলতে চাইছো?
আসলে দুজন লোক মিসেস স্মিথ কি যেন তার নাম, তারা উইলে সাক্ষী হিসাবে সই করেছিল। পরস্পরের সামনেই তারা সই করে।
.
১৯.
মিসেস লীম্যান পোয়ারো নামটা লিখে নিল। অন্য জনের নাম জেমস জেনকিন্স, শেষ শোনা গেছে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে আর মিসেস ওলগা সেমিনোস চলে গেছে চেকোশ্লোভেকিয়ায়।
মিসেস লীম্যান কতটা বিশ্বস্ত বলে তোমার মনে হল?
তুমি যদি মনে করে থাক উইল জালের ব্যাপারে জড়িত তাহলে ভুল করবে। আমার অনুমান ও উইলের সই করেছিল কিছু না জেনেই।
ধরলাম ওটা আসল উইল– পোয়ারো বলল, তাহলে একটা জাল উইলও ছিল।
কে বলেছে?
আইনজ্ঞরা।
সম্ভবত উইলটা মোটেই জাল করা হয়নি এসব ব্যাপারে উকিলরা কিন্তু খুবই খুঁতখুঁতে। তারা সাক্ষী জোগাড় করে আদালত পর্যন্ত যেতে প্রস্তুত।
তাহলে যা ঘটেছে খুঁটিয়ে দেখা সোজা হবে।
কি ঘটেছে?
ধর পরদিন অথবা কয়েকদিন পরে কিম্বা এক সপ্তাহ পরে হয় মিসেস স্মিথ আর তার প্রিয় চাকরানীর মধ্যে তর্কবিতর্ক হয় অথবা তার ভাইপো হুগো আর তার বৌয়ের সঙ্গে কোনো কারণে সম্পর্ক মধুর হয়ে যায়, ফলে তিনি উইল ছিঁড়ে ফেলেন বা পুড়িয়ে ফেলেন।
এই ঘটনার পর মিসেস লেওয়েলিন স্মিথ মারা যান। মেয়েটি সেই সুযোগের অপচয় না করে একটা নতুন উইল লিখে ফেলে মালিকের হাতের লেখা নকল করে। তাতে দুজন সাক্ষী হিসাবে সইও করে। মেয়েটা ভেবেছিল কেউ হয়তো স্বীকার করবে উইলটা দেখার কথা কিন্তু জালিয়াতির কাজ নিখুঁত না হওয়ার ঝামেলা শুরু হয়ে যায়।
সম্ভবতঃ আসল উইলটা কোয়ারী হাউসের লাইব্রেরীতে সেই বইটার ভেতরে এখনও আছে।
নাও থাকতে পারে। যতদূর জানি মিসেস স্মিথের মৃত্যুর পর কিছু আসবাবপত্র আর অন্যান্য জিনিস বিক্রি করে দেওয়া হয়।
মিসেস অলিভার অন্য প্রসঙ্গে গেল। স্কুল শিক্ষয়িত্রীর কি খবর?
কোনো স্কুল শিক্ষয়িত্রীর কথা বলছেন? যাকে গলা টিপে মারা হয়েছিল; এই মেয়েটাকে আমার একটুও ভালো লাগে না। বিরক্তিকর কিন্তু যথেষ্ট চালাক ওকে আর কাউকে খুন করতে দিতে রাজি নই।
অন্য কোনো শিক্ষয়িত্রীকে?
অসম্ভব কিছু নয়।
তোমার স্বতঃলব্ধ জ্ঞানের ওপর আমার বিশ্বাস আছে।
.
২০.
পোয়ারো মিসেস বাটলারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিরান্দার চিনিয়ে দেওয়া রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল।
কিছুদূর এগিয়ে যেতেই সুন্দর দৃশ্য ঘেরা একটা জায়গায় সে এসে পৌঁছল। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই একটা ছোট নদীর ধারে দুজন মানুষের শরীর নজরে পড়ল। ঢালু পাহাড়ের গায়ে বসে আছে মাইকেল গারফিল্ড। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে মিরান্দা বাটলার।
সহসা মাইকেল মুখ তুলে তাকাল। পোয়ারোকে দেখে বলল, এই যে মঁসিয়ে পোয়ারো? শুভ অপরাহ্ন, স্যার।
নদীরধার থেকে মিরান্দার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো– মঁসিয়ে পোয়ারো।
পোয়ারো সামনের দিকে এগিয়ে গেল। মিরান্দার কথা শুনতে পায় এমন একটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি এখানে!
মিরান্দা বললো, হা কুয়োটা খুঁজছিলাম। এদিকের কুয়ো? জঙ্গলের ভেতরে একটা কামনা পূরণের কুয়ো ছিল।
আগে যেখানে কোয়ারী ছিল, বরাবর কোয়ারী ঘিরে জঙ্গল ছিল। বুড়ি মিসেস গুডবডি জানে-মিরান্দা বলল, ও ডাইনী।
ঠিক বলেছ।
মিসেস গুডবডি বলেছে, বছরখানেক আগে নাকি কুয়োটার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
পোয়ারো বললো, কেন?
খুব বিপজ্জনক বলে–মিরান্দা বলল, বছরখানেক আগে একটা বাচ্চা ভেতরে পড়ে গিয়েছিল যে… লোকে ওখানে আর যায় না।
লোকের বিশ্বাস বছর দুয়েক আগে এর উপর বাজ পড়ে, ফলে কুয়োটা ফেটে দুভাগ হয়ে যায়।
সেই গল্পটা এখনও প্রচলিত। পোয়ারোকে চিন্তিত দেখালো, বললো–আচ্ছা, আমার কাজ আছে চলি। মাইকেল জিজ্ঞাসা করল, পুলিস বন্ধুদের কাছে যাচ্ছেন নাকি? আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
হ্যাঁ, আমি ক্লান্ত সত্যই খুব ক্লান্ত, পোয়ারো জানালো।
মাইকেলের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বললো, আচ্ছা মাইকেল তুমি তো এখানে আছো, লেসলি ফেরিয়ার নামে কোনো যুবককে চিনতে?
হঠাৎ মারা যায় তাই না?
হ্যাঁ, কে বা কারা ছুরি মেরে হত্যা করে। মান্দ্রা নামে একটা মেয়ের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ছিল। তারপর অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে লেসলি মেলামেশা শুরু করে। এটা নিছক গল্পও হতে পারে।
এদিকে মাঝে মাঝে বিদেশী মেয়েরাও আসতো।
ওলগার মতো মেয়েরাও আসতো?
হা।
লেসলির সঙ্গে ওলগার বন্ধুত্ব ছিল?
ছিল। তবে মিসেস লেওয়েলিন স্মিথ এ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেন না। মাইকেল বললো, মেয়েটা খুব চাপা স্বভাবের ছিল। মাঝে মাঝে দু একজনের কাছে খুব গম্ভীরভাবে বলতো দেশে ফিরে কাউকে বিয়ে করে সংসার পাতবে।
পোয়ারো বললো– আমি জানতে চাই ওলগা সেমিনোস আর লেসলি ফেরিয়ার মেলামেশা করত কি মিসেস লেওয়েলিন স্মিথকে পোপন করে?
বেশি কিছু বলতে পারবো না। মাঝে মাঝে দুজনের মধ্যে দেখা হত। ওলগা কোনোদিন আমাকে বিশ্বাস করে কিছু বলেনি। আর লেসলি ফেরিয়ারকে তো তেমন চিনতামই না।
পোয়ারো বললো, শুনেছি ছোকরার অতীত ইতিহাস তেমন সুবিধার ছিল না। আমারও তাই বিশ্বাস ওর বিরুদ্ধে জালিয়তের চার্জ ছিল। মিসেস লেওয়েলিন মারা যাওয়ার পর তার উইল আসল কি না পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেল সবই জাল।
মাইকেল পোয়ারো দিকে তাকিয়ে বললো আমি বুঝতে পারছি না আমার সাথে আপনি এ সমস্ত আলোচনা করছেন কেন?
আমি কিছু জানতে চাই। আমি সত্যের পূজারী– সত্যকে জানতে চাই। মাইকেল হেসে বললো আপনার পুলিস বন্ধুর বাড়ি যান। আমাকে একা থাকতে দিন।
৩. পাহাড়ের মাথায় উঠে
২১.
পোয়ারো পাহাড়ের মাথায় উঠে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ তার মনে হল পায়ে আর যন্ত্রণা নেই। একটা বিপদের আঁচ পাচ্ছে খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে, সুতরাং যাতে বিপদ না আসতে পারে সে চেষ্টা করা দরকার।
এলস্পেথ দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। পোয়ারোর কাছে এসে তার হাতে একটা চিঠি দিল খামের উপর বিদেশী ডাক টিকিট মারা।
ভাঁজ খুলে চিঠিটা পড়তে লাগলো পোয়ারো।
ইংল্যাণ্ডে মিঃ গোবির উপর খবর সংগ্রহের যে দায়িত্ব পোয়ারো দিয়েছিল তার উত্তরে সে এই চিঠি লিখেছে। সে ভাবতেই পারেনি এতো অল্প সময়ে খবর পাঠাতে পারবে।
ওলগা সেমিনোস নিজের বাড়িতে ফিরে যায়নি। তার পরিবারের কেউ জীবিত নেই। ওলগার এক সুধীজন বৃদ্ধা মহিলা আছে। এর কাছে সে মাঝে মাঝে চিঠিপত্র লিখতো। চিঠির বিষয়বস্তু থাকতো ইংল্যাণ্ডের জীবনযাত্রা নিয়ে। মনিবের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল না। তবু ওলগা তার কাছে টাকা পয়সা চাইলে উনি দিতেন। একেবারে খারাপ লোক ছিলেন না।
ওলগা শেষ চিঠি লিখেছিল বছর দেড়েক আগে। সেই চিঠিতে একজন যুবকের কথা লেখা আছে।
ওলগা তাহলে মাঝে মাঝে টাকা পয়সা চাইতো মনিবের কাছে। পোয়ারো ভাবলো সে টাকা কেন চাইতো কার জন্য চাইতো? তবে কি লেসলিকে মাঝে মাঝে টাকা দিত? এই টাকা কি উইল জাল করবার পারিশ্রমিক?
পোয়ারো এলস্পেথ-এর সঙ্গে ওলগা আর লেসলির অংশীদারীর কথা নিয়ে অলোচনা করল। তারপর চিঠিটা ভাজ করে পকেটে রাখলো। পোয়ারো নিজের আস্তানায় ফিরে চললো। বাড়ি ফিরে দেখলো মিসেস ড্রেক তার জন্য অপেক্ষা করছে। পোয়ারো বললো আপনাকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে মেসেস ড্রেক।
আপনি খবরটা শোনেননি, সেই ভয়ঙ্কর খবর?
কি খবর?
লিওপোল্ড রেনল্ড মারা গেছে, কেউ ওকে খুন করেছে। স্কুল থেকে ফিরছিল কেউ ওকে নদীতে নিয়ে গিয়ে জলের মধ্যে মাথা চেপে ধরে খুন করেছে।
জয়েসার জীবনে যা ঘটেছে ওর জীবনেও তাই ঘটল। নিশ্চয়ই কোনো পাগলের কাজ। আপনাকে আগেই বলা উচিত ছিল। আপনি প্রশ্ন করেছিলেন কিন্তু আমি বলিনি। নিজেকে ভীষণ ভাবে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। মঁসিয়ে পোয়ারো– কান্নায় ভেঙে পড়লো রোয়েনা।
পোয়ারো বলল, আমাকে সব খুলে বলুন মাদাম।
হাঁ, আপনাকে সব খুলে বলার জন্যই এখানে এসেছি।
এলিজাবেথ আপনাকে বলেছিল আমি কিছু দেখে চমকে উঠেছিলাম।, সত্যি দেখেছিলাম, কিন্তু অস্বীকার করেছিলাম আপনার কাছে। কি দেখেছিলেন?
লাইব্রেরী ঘরের দরজা খুলে গিয়েছিল– খুব সাবধানে ভোলা হয়েছিল, তারপরেই সে বেরিয়ে এসেছিল। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসেনি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, তারপর ক্ষিপ্র হাতে দরজা ঠেলে খুলে ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল।
লোকটা কে?
লিওপোল্ড–এ ছেলেটাই তো খুন হয়েছে।
ভাবলাম লিওপোল্ট তার দিদিকে খুন করেছে তার চোখে মুখে একটা বিচিত্র অভিব্যক্তির ছাপ। ভাবলাম ছেলেটা স্ন্যাপড্রাগন অনুষ্ঠানের ঘর থেকে না বেরিয়ে কেন লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে এল?
আপনি ভেবেছিলেন, একাজ লিওপোল্ডের?
হ্যাঁ, চেহারা দেখে তাই মনে হয়।
তবে ছেলেটা নিজে খুন হয়ে যাওয়ায় বুঝলাম আমার অনুমান একেবারে ভুল। ও লাইব্রেরীতে ঢুকে দিদিকে মৃত অবস্থায় দেখে মনে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে।
বাইরে বেরিয়ে এসে আমার মুখোমুখি পড়ে যায়। তারপর হল ঘর নির্জন না হওয়া পর্যন্ত ভেতরেই অপেক্ষা করে।
তবুও আপনি মুখ খোলেননি?
না। আমি –ওঃ, আমি পারিনি।
পোয়ারোর মনে হল, কথাগুলো এই দুঃখভরা পৃথিবীতে যত দুঃখ আছে এগুলো তাদের অন্যতম।
রোয়েনা বলল, আমি ভালো চেয়েছিলাম, হয়তো ছেলেটার ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার কারণ সে খুনীকে চেনা যাবে। কোনো কারণে খুনীর মনে হয়েছিল সে গাড্ডায় পড়ে গেছে, তাই ছেলেটাকে কবে নির্জনে পাবে এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তারপর একা পাওয়ার পরই –মিসেস ড্রেক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
শুনেছিলাম লিওপোল্ড টাকা পয়সা যথেষ্ট খরচ করতো, কোথায় পেত? নিশ্চয়ই কেউ তার মুখ বন্ধ করবার জন্য টাকা পয়সা দিত।
কিন্তু কে, কে সেই লোক?
খুঁজে বের করতে হবে –পোয়ারো জানালো আর বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না।
.
২২.
এরকুল পোয়ারো তার নিজের মতামতের ওপরই বেশি আস্থা রাখে। পোয়ারো আর স্পেনস কিছু সময় কথাবার্তা বলবার পর, গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় এমন এক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করল। তারপর বন্ধুর সঙ্গে তার ইনসপেক্টর র্যাগলানের সঙ্গে সামান্য সময় আলোচনা করার পর গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। কথা বলে ঠিক করে নেওয়া হয়েছে যে এ পথে যাওয়ার সময় এক জায়গায় কিছু সময়ের জন্য নামবে তারপর তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে লণ্ডনে। গাড়ি করে এল এলমস এ। ড্রাইভারকে জানাল ঘন্টাখানেকের মত দেরী হতে পারে তারপর দেখা করল মিস এমলি এর সঙ্গে।
পোয়ারো বললো, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। যা বলতে চাই খুলেই বলি, আপনার সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে চাই।
জয়েসা রেনল্ড-এর আততায়ী কে আমি জেনেছি– পোয়ারো বললো, আমার বিশ্বাস আপনিও জানেন। আপনার কোনো মতামত থাকলে জানান।
স্বীকার করছি আমার মতামত আছে তার অর্থ এই নয় যে আমাকে পুনরাবৃত্তি করতে হবে।
পোয়ারো বললো, শুনুন একটা ছেলে জলে ডুবে মারা গেছে।
শুনেছেন?
হ্যাঁ একজন ফোন করে জানিয়েছে। জয়েসার ভাই। কি করে ছেলেটা এর মধ্যে এল?
পোয়ারো বললো– অর্থ দাবী করে ছিল। ওকে নিয়মিত পয়সা দিতে হতো। খুনী সুযোগের সন্ধানে ছিল, সুযোগ পেয়েই জলে ডুবিয়ে মেরেছে। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে এ ধরনের কেসে আমি প্রথমে কি করি?
এমলিন বললো –প্রথমে বিচার চাইবেন। করুণার প্রশ্ন আসবে পরে।
ঠিক বলেছেন। শুনুন আমি লণ্ডনে যাচ্ছি। পথে কয়েকজন লোকের সঙ্গে দেখা করে কেসটা নিয়ে আলোচনা করব। তাদেরকে আমার নিজের মতামত বোঝাতে চাই।
যাওয়ার আগে কয়েকটা বিষয়ে আপনার মতামত জেনে নিতে চাই। নিকোলাস র্যানসাম আর ডেসমণ্ড হল্যাণ্ড সম্পর্কে আপনার মত কি? ওদের উপর আস্থা রাখতে পারি?
অবশ্যই আস্থা রাখা যায়। পোয়ারো বিদায় নিয়ে গাড়ীতে গিয়ে উঠলো।
.
২৩.
কোয়ারী উডে কি ঘটেছে শুনেছ?–
মিসেস বাটরাইট বাজারের ব্যাগে জিনিস ভরতে ভরতে বললো।
এলস্পেথ বললো, কোয়ারী উডে? কই আমি তো কিছু শুনিনি। দুজন মহিলা নতুন তৈরি সুপার মার্কেটে সকালের বাজার করতে বেরিয়েছে।
লোকে বলাবলি করছে ওখানকার গাছগুলো পাহাড়ের গায়ে খুবই বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। কয়েকজন পুলিশ এসেছে ওরা কাউকে ধারে কাছে যেতে দিচ্ছে না।
এলস্পেথ বিস্ময় প্রকাশ করে বলল –ওমা তাই বুঝি?
অরিয়াদে অলিভার একটা টেলিগ্রাম পেল। তাতে লেখা আছে: দয়া করে মিসেস বাটলার আর মিরান্দাকে তোমার ফ্ল্যাটে নিয়ে এস। একটুও বিলম্ব করবে না।
ডাক্তারের সঙ্গে অপারেশনের জন্য দেখা কর।
মিসেস অলিভার রান্নাঘরে এল, জুডিথ বাটলার কুইন্স ফল দিয়ে জেলি তৈরি করতে ব্যস্ত। জুডিথ –মিসেস অলিভার বললো, যাও প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও গে। আমি লণ্ডনে ফিরে যাচ্ছি, তুমি আর মিরান্দা আমার সঙ্গে যাবে। আজই যেতে হবে নাকি?
হাঁ, আমাকে তাই বলা হয়েছে।
কে বলেছে তোমার বাড়িওয়ালা?
না অন্য একজন যার কথা আমি ফেলতে পারি না। যে টেলিগ্রামটা পেয়েছি তাতে লিখিত নির্দেশ মতো কাজ করছি।
তুমি কি পাগল হয়ে গেছ অরিয়াঁদে?
খুব সম্ভব একেবারে বন্ধ পাগল। যাও প্রস্তুত হয়ে নাও। জুডিথ আর মিসেস অলিভার সুটকেস গুছিয়ে গাড়িতে তুলল। মিরান্দাও এসে গেল।
এরকুল পোয়ারো লন্ডনে চারজন লোকের সঙ্গে বসে আছে। একজন ইনসপেক্টর টিমোথি র্যাগলান, দ্বিতীয়জন সুপিরিন্টেন্টে স্পেনস, তৃতীয়জন চীফ কনস্টেবল আলফ্রেড রিচমণ্ড আর চতুর্থজন পাবলিক প্রসিকিউটার অফিসের একজন প্রতিনিধি। তারা সবাই পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে মুখে বিভিন্ন ধরনের অভিব্যক্তি।
আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি একেবারে নিশ্চিন্ত মঁসিয়ে পোয়ারো।
পোয়ারো বললো, আমি সত্যি নিশ্চিন্ত।
আমার মতে উদ্দেশ্য খুবই জটিল। না, প্রকৃতপক্ষে জটিল মোটেই নয়। এতো সরল যে সহজে ধরা যায় না।
পাবলিক প্রসিকিউটার অফিস থেকে আসা লোকটি অবিশ্বাস ভরা চোখে তার দিকে তাকাল। আমরা প্রমাণ শীঘ্র পাব।
ইনসপেক্টর র্যাগলান বলল, অবশ্য যদি এ ব্যাপারে ভুল না হয়ে থাকে….
এর স্বপক্ষে প্রমাণ আছে। কোনো মেয়ে যখন অদৃশ্য হয় তার পেছনে বেশি কারণ থাকে না। প্রথম কারণ, কোনো পুরুষের সঙ্গে পালান। দ্বিতীয় কারণ মারা যাওয়া। এছাড়া অন্য কারণ থাকতে দেখা যায় না।
পোয়ারো বললো, সম্ভবতঃ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আপনাদের সামনে এমন কিছু উপস্থিত করতে পারব যা ঘটনাগুলো অনেকখানি পরিষ্কার করে দিতে পারবে।
সেটা কি?
স্বচক্ষে দেখা একজন সাক্ষী। আইনের লোকটি প্রচণ্ড অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকাল। সেই স্বচক্ষ দেখা সাক্ষী এখন কোথায়?
আমার বিশ্বাস লণ্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।
আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে আপনার মন বিক্ষিপ্ত।
কথাটা সত্যি যতটা সম্ভব, সাবধানতা অবলম্বন করেছি, তবু স্বীকার করতেই হবে আমি ভীত হয়ে পড়েছি।
এরকুল পোয়ারো উঠে দাঁড়াল। সে বলল, এখন আমায় যেতে হবে। যা জানতাম সব বলেছি এখন যা ভালো বুঝবেন করবেন। আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলব।– সকলের সঙ্গে করমর্দন করে সে চলে গেল।
চীফ কনস্টেবল বলল, স্পেনস তোমাকে অনেক বছর ধরে জানি, তুমি মঁসিয়ে পোয়ারোর বন্ধু। তোমার কি মনে হয় ওর ভীমরতি হয়েছে?
আমার তা মনে হয় না। স্পেনস বলল, তোমার মতামত কি র্যাগলান?
ওর সঙ্গে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয় স্যার। প্রথম দিকে আমার মনে হয়েছিল ওর কথাবার্তা আইডিয়া সব অদ্ভুত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে মত পরিবর্তন করতে হয়েছে। আমার ধারণা উনি অবশ্যই প্রমাণ করবেন।
.
২৪.
মিসেস অলিভার দি ব্ল্যাক বয় হোটেলের ডাইনিং হলের খোলা জানালার ধারে পাতা টেবিলের সামনে চেয়ারে বসল। জুডিথ এসে বসলো, তারপর মেনু খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।
মিরান্দার কোনো খাবার পছন্দ? –মিসেস অলিভার জানতে চাইল ওর পছন্দমতো খাবার দিতে বলব। মিনিট খানেকের মধ্যে এসে পড়বে।
চিকেন রোস্ট ওর খুব পছন্দ, তাহলে তো ঝামেলাই থাকলো না।
তোমার কি পছন্দ?
আমার তো তাই।
তিনটে চিকেন রোস্ট –মিসেস অলিভার অর্ডার দিল। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে জুডিথের দিকে তাকিয়ে রইল।
তুমি ওভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?
ভাবছি –মিসেস অলিভার বলল।
কি ভাবছো?
ভাবছি তোমার সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না।
প্রত্যেকের সম্বন্ধে প্রায় একথা বলা যায়।
তার মানে বলতে চাইছো কারো সম্পর্কে জানা যায় না?
এরকম ভাবা উচিত নয়।
দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। একজন পরিচারিকা ট্রের উপর খাবার সাজিয়ে নিয়ে এসে পরিবেশন করে গেল।
মিরান্দার আসতে দেরী হচ্ছে বলে জুডিথ অধৈর্য হয়ে পড়ল। একটু পরে উঠে গেলো। তারপর কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলো গম্ভীর মুখে। ওকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। লেডিস টয়লেটেও নেই।
হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল, আমি সার্জেন্ট গুডবডি কথা বলছি। একটা পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো। আপনার দাদা আছেন?
না, আজ লণ্ডনে আছেন। ওখানে ফোন করেছিলাম, শুনলাম ওখানে থেকে রওনা হয়েছে। উনি ফিরলে বলে দেবেন আমরা পজিটিভ রেজাল্ট পেয়েছি।
তার মানে কুয়োর মধ্যে মৃতদেহ পেয়েছেন? পাঁচকান করবেন না। ইতিমধ্যে খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।
মৃতদেহ কি সেই কাজের মেয়ে ওলগা সেলিলোফের?
হ্যাঁ তাই মনে হচ্ছে।
ব্যাপারটা মনে হচ্ছে খুন, ওকে ছুরি মারা হয়েছিল।
মেয়েদের টয়লেট থেকে মা চলে যাওয়ার পর মিরান্দা মিনিট খানেক কি মিনিট দুই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সে পিছনের দরজা খুলে সাবধানে বাইরে উঁকি দিল। বাইরে বাগান। সে দরজা পেরিয়ে বাইরে এসে দৌড়াতে লাগল। একটা গ্যারেজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।
পাশের রাস্তা ধরে যেতে গিয়ে দেখলো রাস্তার উপর একটা মোটর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একটা লোক চালকের আসনে বসে খবরের কাগজ পড়েছে। মিরান্দা দরজা খুলে চালকের আসনের পাশে বসে হাসতে লাগলো। গাড়ী ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো। পাশের দাড়িওয়ালা লোকটা বলল, এখন আমরা ঠিক সময়ে ঠিক জায়ায় এসে পড়ছি। হঠাৎ পাশ ঘেঁষে একটা গাড়ি সামনের দিকে এমনভাবে বেরিয়ে গেল যে তাদের গাড়ি প্রায় ঝোঁপের মধ্যে এসে পড়ল। বেরিয়ে যাওয়া গাড়ির মধ্যে দুটি যুবক বসে। একজনের চুল কাধ পর্যন্ত লম্বা। তার চোখে প্যাঁচার চোখের মতো দেখতে চশমা। অন্য যুবকটি দেখতে স্পেনদেশীয় আর মুখের একটা পাশে বিশ্রী পোড়া দাগ।
মিরান্দা জিজ্ঞাসা করল– তোমার কি মনে হয়, মা আমার জন্য খুব চিন্তা করবে?
তোমার মায়ের চিন্তা করার সময় কোথায়? যখন চিন্তা করবে তার আগেই তুমি যথাস্থানে পৌঁছে যাবে।
লণ্ডনে এরকুল পোয়ারো ফোন কানের পাশে তুলে ধরতেই মিসেস অলিভারের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
মিরান্দা হারিয়ে গেছে। বলছ কি! কি ভাবে হারাল? আমরা দি ব্ল্যাক বয় হোটেলের লাঞ্চ খাচ্ছিলাম। মিরান্দা মেয়েদের টয়লেটে ঢুকেছিল, কিন্তু আর ফেরেনি। কেউ কেউ বলছে একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে গাড়ীতে চেপে কোথায় যেন গেছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, অন্য মেয়েও হতে পারে।
তোমাদের উচিত হয়নি চোখের আড়াল করা। আমি তো আগেই তোমাকে বিপদের আভাস দিয়েছিলাম। মিসেস বাটলারের কি অবস্থা? তিনি কি ভেঙে পড়েছেন?
হ্যাঁ তিনি খুবই ভেঙে পড়েছেন কান্নাকাটি করছেন। তিনি চাইছেন পুলিসে খবর দিতে। তিনি আর দেরী করতে চাইছেন না। এখন কি করবো বুঝতে পারছি না।
পোয়ারো বললো, আর দেরী না করে পুলিসে খবর দেওয়াটাই উচিত হবে।
আমিও ওদের সঙ্গে ফোনে যোগযোগ করছি। দেখছি কি করা যায়।
কিন্তু মিরান্দা কেন বিপদে পড়ল? তুমি জান না? তুমি জান না? জানা উচিত ছিল। — পোয়ারো বলল, মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এইমাত্র খবর পাওয়া গেল।
কার মৃতদেহের কথা বলছ?
কুয়ো থেকে একটা মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
মিসেস অলিভারের মুখে আর কোনো কথা সরল না। সে টেলিফোনের রিসিভার হাতে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইল।
.
২৫.
কিলটারবারি রিং। মিরান্দা দুচোখ মেলে তাকিয়ে বললো, বাঃ কি সুন্দর! কিলটারবারি রিং হল স্থানীয় অতীব সৌন্দর্যপূর্ণ অংশ, কিন্তু বাকি অংশ তেমন বিখ্যাত নয়। এই সৌন্দর্যপূর্ণ জায়গাটা কয়েক শ বছর আগে ধ্বংস হয়ে গেছে। ইতস্ততঃ উঁচু পাথর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। পুরাকালে নানা শাস্ত্রীয় পূজা অর্চনার কথা মনে করিয়ে দেয়।
মিরান্দা নানা ধরনের প্রশ্ন করতে লাগলো।
এইসব পাথর এখানে ছড়িয়ে রেখেছ কেন?
শাস্ত্রীয় প্রয়োজনে। শাস্ত্রীয় ত্যাগ স্বীকারের জন্য।
মিরান্দা তোমাকেও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে বুঝলে?
তোমার কি মনে হয় না এ এক ধরনের শাস্তি? না অন্য কিছু?
হ্যাঁ অন্য কিছু, অন্যরা যাতে বাঁচতে পারে সেই কারণে তোমাকে মরতে হবে। তুমি মরবে যাতে সৌন্দর্য বেঁচে থাকে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে এই হল আসল উদ্দেশ্য।
সম্ভবতঃ বুঝতে পেরেছি– বল মিরান্দা, থামলে কেন? বুঝেছি তোমাকে মরতে হবে কারণ তোমার কৃতকর্মের জন্য একজন খুন হয়েছে।
বুঝলে কি করে?
জয়েসার কথা মনে পড়ে। যদি কিছু না বলতাম তাহলে ওকে মরতে হত না বোধ হয়।
সম্ভবতঃ নয়।
জয়েসা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। ওকে কথাটা বলা উচিত হয়নি, কি বল? ওকে বলেছিলাম দামী কিছু পাওয়ার আশায়। জয়েসা ভারত ভ্রমণের গল্প করতো, বলতো সোনায় মুড়ে হাতাঁকে কিভাবে সাজানো হয় আর তাদের ধরা হয়। হঠাৎ আমারও মনে হল ওকে কিছু শোনাতে কিন্তু বিশ্বাস কর আমি ওকে বলব আগে কখনও ভাবিনি। আচ্ছা একি ধরনের আত্মত্যাগ?
মিরান্দা কিছু সময় গভীরভাবে চিন্তা করল। তারপর বলল, সূর্য এখনও ঠিক জায়গায় পৌঁছায়নি। আর মিনিট পাঁচেক পরে সূর্যকিরণ সোজাসুজি পাথরের উপর পড়বে। তখনি হবে আমাদের ত্যাগস্বীকার উপযুক্ত সময়।
মনে হচ্ছে সেই বিস্ময়কর মুহূর্ত উপস্থিত। মিরান্দার সঙ্গী আকাশের দিকে তাকাল।
তোমাকে প্রথম দেখাব পাহাড়ের গায়ে একজোড়া কুঠার। কয়েকশো বছর আগে সিসিলি ক্রীট থেকে লোক এসে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে। দেখ, মিরান্দা কেমন চমৎকার তাই না?
একটা উঁচু পাথরের মাথায় তারা উঠল। এই পাথরের পাশে আর একটা পাথর পড়ে আছে, সমান্য দূরে পাথরের ঢালে কোণাকুণি অবস্থায় পড়ে আছে আর একটা পাথর।
তুমি খুশী হয়েছ মিরান্দা? হ্যাঁ খুব খুশী হয়েছি। দেখ, চিহ্নটা ফুটে উঠেছে। মিরান্দা সাগ্রহে দেখতে লাগল। জিজ্ঞাসা করল, সত্যি কি জোড়া কুঠার?
হ্যাঁ সময়ের আবর্তে ক্ষয়ে গেছে কুঠারের প্রতীক। এর উপর হাত রাখ। এখন আমরা পান করব অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ আর সৌন্দর্য।
আঃ কি সুন্দর –মিরান্দা অস্ফুট কণ্ঠে বলল।
একটা সোনালী পানপাত্র মিরান্দার হাতে ঢেলে দিল লোকটি। ফ্লাস্ক থেকে সেই কাপে সোনালী তরল পদার্থ ঢেলে পূর্ণ করল।
পাঁচ ফলের স্বাদ পার। পান কর মিরান্দা। দেখবে সুখ তোমার মনকে ভরিয়ে তুলবে। কাপ তুলে ধরে চুমুক দাও।
বাধ্য মেয়ের মতো মিরান্দা কাপটা তুলে ধরল। তার একটা হাত সেই পাথরের গায়ে রয়েছে ফলে কুঠারের চিহ্ন সামান্য মুছে গেছে। তার সঙ্গী ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে। কাৎ হয়ে থাকা পাথরটার তলা থেকে দুটি লোক বেরিয়ে এল, পাথরের উপরের লোকটি পিছন ফিরতেই তাদের দেখতে পেল না। তারা ক্ষিপ্র পদে চুপিসারে পাহাড়ের উপরে উঠে এল।
সৌন্দর্য পান কর মিরান্দা। যা বলছে মেয়েটা তাই করছে –পিছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
একটা লাল কোট এসে পড়ল লোকটার মাথার উপর, তার হাতের উদ্যত ছুরিটা ছিটকে নিচে পড়ে গেল। নিকোলাস র্যানসান মিরান্দার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। বাকি লোক দুটি হাতাহাতি করতে লাগলো।
অসভ্য মেয়ে। –নিকোলাস ধমকের সুরে বলল, একটা খুনীর সঙ্গে এখানে এসেছ? কিছু করার আগে ভাবা উচিত ছিল।
মিরান্দা বলল –ঠিকই করেছি। ভাবছিলাম আত্মাহুতি দিচ্ছি। সমস্ত দোষ আমারই, আমার জন্যই জয়েসা খুন হয়েছে। সেই কারণে আমার উচিত আত্মাহুতি দেওয়া। আমার মৃত্যু হতো শাস্ত্রসম্মত।
বোকার মতো তুমি কথা বলো না মিরান্দা, মেয়েটাকে ওরা খুঁজে পেয়েছে। ব্যাপারটা তুমিও তো জানো, সেই যে কাজের মেয়েটাকে অনেক দিন যাবৎ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই ভেবেছে উইল জাল করার অপরাধে ভয় পেয়ে পালিয়েছে, আসলে মেয়েটি পালিয়ে যায়নি। ও নিষ্ঠুর ভাবে খুন হয়েছিল। ওর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে কুয়োর মধ্যে।
হঠাৎ মিরান্দা আর্তনাদ করে উঠলো, মনোবাসনা পূরণের কুয়োতে নয় তো? এই কুয়োটা আমি কুঁজে বের করতে চেয়েছিলাম। কে– ওখানে কে ওকে ফেলেছে?
মিরান্দা আত্মবিস্মৃতের মতো চীৎকার করে উঠলো –আহ!
.
২৬.
চারজন তারা তাকিয়ে আছে পোয়ারোর দিকে। টিমোটি র্যাগলান সুপারিন্টেন্টে স্পেনস আর চীফ কনস্টেবল এর চোখে মুখে আনন্দের ছায়া। চতুর্থজনের চোখ এখনও সন্দেহের ছায়া দুলছে।
ইনসপেক্টর র্যাগলান ঘর ছেড়ে বাইরে গিয়ে ফিরে এল বছর ত্রিশেক বয়সের একজন ভদ্রমহিলা, একটি বাচ্চা মেয়ে আর দুজন যুবককে সঙ্গে নিয়ে। সে চীফ কনস্টেবলের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিল, মিসেস বাটলার, মিস মিরান্দা বাটলার, মিঃ নিকোলাস র্যানসান আর মিঃ ডেসম হল্যাণ্ড।
পোয়ারো উঠে মিরান্দার হাত ধরে বলল, মায়ের পাশে বস মিরান্দা –চীফ কনস্টেবল, মিঃ রিচম তোমায় কয়েকটা প্রশ্ন করবেন। তুমি উত্তর দেবে।
মিরান্দা মাথা নাড়ল।
মিরান্দাকে জিজ্ঞাসা করা হল এক কিম্বা দুবছর আগে জয়েসাকে সে কিছু বলেছিল কিনা। মিরান্দা বললে হ্যাঁ জয়েসাকে সে একটা খুন হওয়ার কথা বলেছিল। সে কথাটি লিওপোল্ট দরজার আড়াল থেকে শুনেছিল। ও মানুষের গোপন খবর শুনতে ভালোবাসতো।
জয়েসা রেনল্ড হ্যালুইন পার্টিতে বলেছিল সে নিজে একটা খুন হতে দেখেছে। কথাটা সত্যি?
না আমি যা বলেছিলাম ও তাই পুনরাবৃত্তি করেছিল মাত্র।
প্রথমে বুঝতে পারিনি ওটা খুন। ভেবেছিলাম দুর্ঘটনা। মেয়েটা হয়তো উপর থেকে পড়ে গেছে।
কোথায় ঘটেছিল?
কোয়ারী গার্ডেনে, যেখানে জলের ধার উপর থেকে নিচে এসে পড়ছে। একজন লোক আর একজন মেয়েছেলে একটা মেয়েকে তুলে আনল রাস্তায়, ভেবেছিলাম ওরা ওকে হাসপাতালে কিম্বা কোয়ারী হাউসে বুঝি নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মেয়েটা দাঁড়িয়ে পড়ে বললো, কেউ আমাদের উপর লক্ষ্য রাখছে। লোকটা বললো, বোকামি কর না। ওরা চলে গেল।
আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমার চোখে পড়ল স্কার্ফে জড়িয়ে থাকা রক্ত। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয়েছিল কেউ মেয়েটাকে খুন করবার চেষ্টা করেছে।
পরের দিন ঠিক ঐ জায়গায় একটা ঝোঁপের আড়ালে বসে আমি লক্ষ্য রাখছিলাম। সেই ঝোঁপের ওপাশে সেই লোকটা আর মেয়েটা বসে একটা দ্বীপের কথা– মানে গ্রীস দ্বীপের কথা আলোচনা করছিল। মেয়েটা বলছিল, সইসাবুদ হয়ে গেছে দ্বীপটা আমাদের, দ্বীপের যে কোনো জায়গায় আমরা যেতে আসতে পারি। তবে যা করবার ধীরে ধীরে করতে হবে তাড়াহুড়ো করা চলবে না।
ঠিক তখনি আমার মনে হল সেদিন যা দেখেছি সেটা খুন ছাড়া আর কিছু নয়, মৃতদেহ কোথাও লুকিয়ে রাখার জন্য ওরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। মিরান্দা তুমি বলতে পারবে ওরা কারা?
নিশ্চয়ই পারবো। ওরা হল মিসেস ড্রেক আর মাইকেল….
তুমি কাউকে বলনি কেন? আমার মনে হয়েছিল, ঘটনাটা আত্মাহুতি। মাইকেল আমায় বলেছিল আত্মাহুতি দেওয়ার দরকার ছিল।
পোয়ারো মৃদু হেসে বলল, তুমি মাইকেলকে ভালোবাস।
হ্যাঁ, ভীষণ ভালোবাসি।
.
২৭.
পোয়ারোকে দেখে মিসেস অলিভার বললো– যাক শেষ পর্যন্ত তোমায় এখানে পাওয়া গেল। তাড়াতাড়ি ফিরলে না কেন?
মাপ করে দাও মাদাম।– পোয়ারো বলল, পুলিসকে তাদের তদন্তে সাহায্য করতে ব্যস্ত ছিলাম।
আসল সূত্রটা কি?
জল। এমন একজন মানুষের খোঁজ করি যে পার্টিতে ছিল এবং পোশাক ছিল জলে ভেজা, কিন্তু তার পোশাক জলে ভেজার কোনো কারণ ছিল না। যে জয়েসাকে খুন করেছে তার পোশাক জলে ভিজে যাওয়ার কথা। তুমি একটা শক্ত সামর্থ মেয়ের মাথা যদি জলভর্তি গামলার মধ্যে চেপে ধর তাহলে মেয়েটা ছাড়া পাওয়ার জন্য ঝাঁপটি করবে আর চারিদিক জল ছিটোবে। সুতরাং খুনীকে পোশাক ভিজার একটা অজুহাত দেখাতে হবে, নাহলে অন্যদের চোখে ধূলো দেওয়া যাবে না।
সবাই যখন স্ন্যাপড্রাগন উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য ডাইনিং হলে গেল, মিসেস ড্রেক জয়েসাকে ডেকে নিয়ে গেলেন লাইব্রেরীতে। জয়েসা কিন্তু মিসেস ড্রেককে কোনো রকম সন্দেহ করেনি। মিরান্দা শুধু বলেছিল একটা খুন হতে সে দেখেছে। তাই জয়েসাকে মিসেস ড্রেক খুন করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে তার পোশাক ছিটিয়ে পড়া জলে ভিজে গেল।
ভিজে যাওয়ার কারণ তৈরি করতে হল তাকে এবং একজন সাক্ষী রাখার দরকার হল কি করে ভিজেছে দেখানোর জন্য।
তিনি সিঁড়ির ল্যাণ্ডিংয়ের উপর অপেক্ষা করতে লাগলেন জল ভর্তি ফুলদানি হাতে নিয়ে। একসময় মিস উইটেকার ডাইনিংরুম থেকে বেরিয়ে হলে আসতেই মিসেস ড্রেক এমন ভাব করলেন যেন কিছু দেখে ফুলদানিটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল।
মিসেস উইটেকারের মনে এমন একটা ধারণা জন্মিয়ে দিলেন যেন কাউকে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে আসতে এবং ঢুকে যেতে দেখেছেন, কারণ এই ঘরেই জয়েসাকে খুন করা হয়েছিল।
প্রথমে মিস উইটেকার কোনো গুরুত্ব দেননি, কিন্তু মিস এমলিন ব্যাপরটার স্বরূপ এবং গুরুত্ব বুঝতে পেরে আমায় সব খুলে বলেলেন।
কিছুসময় চুপ করে থেকে পোয়ারো বলল, আর তারপরেই আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল জয়েসার খুনী কে।
মিসেস অলিভার বললো– তাহলে বোঝা যাচ্ছে জয়েসা কখনো কাউকে খুন হতে মোটেই দেখেনি।
কখন তুমি জানলে খুন হতে দেখেনি, খুন হতে দেখেনি, খুন হতে দেখেছে মিরান্দা।
যখন বুঝতে পারলাম সে জয়েসা সত্যিই মিথ্যাবাদী, তাছাড়া মিরান্দার কথাবার্তার মধ্যেও এ সম্পর্কে যথেষ্ট ইঙ্গিত ছিল। ঠিক তখনই আমার ওই ধারণা হয়।
শেষ পর্যন্ত রোয়েনা ড্রেক!– অস্ফুট কণ্ঠে মিসেস অলিভার বলল, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না।
জালিয়াতি সম্পর্কে তোমার মত কি? অলিভার জানতে চাইলো। আমার ধারণা মাইকেল আর রোয়েনা ড্রেকের অবৈধ সম্পর্কের কথা মিসেস স্মিথ জানতে পেরেছিলেন। খুব সম্ভব তিনি বিধবা হওয়ার আগেই সেই কারণে রেগে গিয়ে উইল পাল্টে সবকিছু ওলগাকে দিয়ে যান।
সম্ভবতঃ ওলগা এ কথা মাইকেলকে জানায়– কারণ তার আশা ছিল একদিন মাইকেলের সঙ্গে তার বিয়ে হবে।
আমি ভেবেছিলাম লোকটা লেসলি ফেরিয়ার। মাইকেল সেই রকমই একটা গল্প আমায় শুনিয়েছিল বটে কিন্তু সেই গল্পের উপর কারো সমর্থন পাইনি। গল্পটা শুনিয়ে আমাকে ভ্রান্ত পথে চালাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যদি সে আসল উইলের কথা জানতই তাহলে ওলগাকে কেন বিয়ে করে সব হাতিয়ে নিল না?
কারণ মাইকেলের তখনও সন্দেহ ছিল সত্যিই ওলগা সব পাবে কিনা।
আর রোয়েনা ড্রেক?
মিসেস ড্রেক মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। অনেক বছর ধরে স্বামী খোঁড়া হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ছিলেন মধ্যবয়সী এবং আবেগপ্রবণা নারী। তাঁর জীবন পরিক্রমায় ঢুকে পড়ল একজন সুদর্শন চেহারার যুবক নাম মাইকেল। অবশ্য মেয়েদের রূপের দিকে মাইকেলের নজর ছিল না- ছিল রূপের দিকে। লোকটা কেবল ভালোবাসতো নিজেকে– যাকে বলে একজন নার্সিসাস।
গ্রীস দ্বিপে শুধু একটা বাগান করবার জন্য খুন করা — আমি যেন বিশ্বাস করতে পারছি না –মিসেস অলিভার বললো।
বাগান করতে গেলে তো অর্থের প্রয়োজন। মাইকেল সেই অর্থের অন্বেষণে উঠে পড়ে লেগে পড়ল। উপোসী রোয়েনা ড্রেককে সে হাতের কাছে পেল যার অর্থ আছে, সেই অর্থের উপর নির্ভর করে সৌন্দর্যময় এক জগৎ সৃষ্টি করতে পারবে।
কিন্তু রোয়েনার মত মেয়ের সঙ্গে বনিবনা করতে পারত?
না পারলে আর একটা দুর্ঘটনা ঘটত।
তার মানে আর একটা খুন?
হ্যাঁ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অলিভার জানতে চাইল, মাইকেলকে পোয়ারো কিভাবে সন্দেহ করলো?
শেষ যে বার মাইকেলের সঙ্গে কথা বলি, তখন থেকেই সন্দেহ হয়। ও আমাকে হেসে বলেছিল, আমার কাছ থেকে দূরে থাক শয়তান। পুলিস বন্ধুর কাছে যাও। আমি মনে মনে বলেছিলাম তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি শয়তান।
পোয়ারো আরো বললো, মাইকেল ভালোবাসতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, হয়ত সেই কারণে মিরান্দাকে ভালোবাসতো। কিন্তু নিজেকে বাঁচাবার জন্য মিরান্দাকে হারাতে প্রস্তুত ছিল। মেয়েটাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছিল সুন্দর ভাবে।
মাদাম, আপনার মেয়ে এখন নিরাপদ। পোয়ারো বলল, কিন্তু আমি একটা কথা জানতে চাই। সত্যি উত্তর দেবেন?
জুডিথ বললো, নিশ্চয়ই উত্তর দেব।
মিরান্দা আপনার মেয়ে ও কি মাইকেলেরও মেয়ে?
জুডিথ স্তব্ধ হয়ে গেল, কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো, হ্যাঁ।
মিরান্দা জানতো?
না, ওর সঙ্গে আমার পরিচয় যৌবনে। ওকে ভালোবাসতাম। কিন্তু তারপরেই একটা ভয় মনে বাসা বাঁধে।
ভয়?
হা, ওর আচার-আচরণ আমাকে ভীত করে তুলতো। ভদ্র, কিন্তু অন্তরে ছিল একটা পাকা। শয়তান। ওকে কোনোদিন জানাইনি যে আমি মা হতে চলেছি। একদিন ওকে ছেড়ে চলে গেলাম, আমার সন্তান জন্ম নিল। জানতে পারলাম একটা প্লেন দুর্ঘটনায় একজন পাইলটের মৃত্যু হয়েছে। রটিয়ে দিলাম আমার পাইলট স্বামী প্লেন দুর্ঘটনায় মারা গেছে।
তারপর অস্থির মনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে উডলিফ কমন্সে এসে পড়লাম।
একদিন মাইকেল এই কোয়ারী উড়ে এল চাকরী পেয়ে।
মিরান্দার সঙ্গে মাইকেলের এক প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠলো। পোয়ারো একটা কাগজ নিয়ে জুডিথের সামনে মেলে ধরলো– নিচে সই করা আছে: মাইকেল গারফিল্ড।
ছবিটা এঁকেছিল কোয়ারী উড়ে নদীর ধারে বসে। সে চেয়েছিল মিরান্দাকে ভুলে যেতে। মাইকেল তার মেয়েকে আহুতি দিতে চেয়েছিল যাতে সে ইডেনের মত নতুন একটা বাগানের প্রতিষ্ঠা করতে পারে।, যা করবার মাইকেল সজ্ঞানেই করেছে। জুডিথ বলল, জানিনা, দুঃখপ্রকাশ করবে কিনা।
পোয়ারো কিছু সময় চুপ করে রইলো। একটা ছবি তার মনের পর্দায় ক্রমশঃ আকার নিচ্ছে। একজন সুদর্শন যুবকের মৃতদেহ নিচে পাথরের পাশে পড়ে আছে হাতে ধরা একটা পান পাত্র। মাইকেল গারফিল্ড মারা গেছে। আর কোনোদিন সমুদ্রঘেরা গ্রীসের কোনো দ্বীপে ফুল ফোঁটাবার স্বপ্ন সে দেখবে না। তবে মাইকেল নেই বটে কিন্তু রয়ে গেছে মিরান্দা–জীবিত প্রস্ফুটিত আর সৌন্দর্যের আকর।
জুডিথের একটা হাত তুলে নিয়ে চুম্বন করল পোয়ারো। সে বলল, বিদায় মাদাম। আপনার মেয়ের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে থাকতে চাই। পোয়ারো মিসেস অলিভারের কাছে এসে বলল, বিদায় সুন্দরী মাদাম, লেডি ম্যাকবেথ আর নার্সিসাস।
সব মিলিয়ে ব্যাপারটা বেশ মজার। মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে আসার জন্য তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ। আশা করি লণ্ডনে আমাদের আবার দেখা হবে। বিদায়!