মিসেস পেরিনা, মিস মিল্টন, মিসেস ও রুরকি, মেজর ক্লে দম্পতি, কার্ল ভন দিনিম, শীলা, ও সকন্যা মিসেস স্প্রট–এদের সকলের সম্পর্কে নিজেদের ধারণার কথা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা চলে তাদের।
মেলামেশা, কথাবার্তা এসবের মধ্যে কী করে আসল মানুষ দুটিকে চিহ্নিত করা যায় এ নিয়ে দু-জনেরই নিজস্ব চিন্তাভাবনা রয়েছে। সেই মতোই এগিয়ে চলতে থাকে টমি ও টুপেনস।
সান্স সৌচিতে ফেরার পথে টুপেনস ডাকঘরে ঢুকে কিছু ডাকটিকিট কিনল। তারপর একটা বুথ থেকে টেলিফোন সারল। ওখান থেকে বেরিয়ে কয়েকটা উলের গোলা কিনে পথে নামল।
টুপেনসের ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসির রেখা। বেলা শেষের মৃদুমন্দ হাওয়ার ছোঁয়া গাছের পাতায় পাতায়।
সান্স সৌচিতে নিজের ভূমিকার কথা ভেবে নিজেকেই বাহবা দেয় টুপেনস।
সকলেই জানে মিসেস ব্লেনকিনসপ তার প্রবাসী সন্তানদের জন্য উদ্বেগে আকুল হয়ে আছে। মনের ভার লাঘব করবার জন্য দুদিন অন্তর ছেলেদের নামে চিঠি পাঠায়। আর একাকিত্বের একঘেয়েমি কাটাবার সঙ্গী উল কাটা।
পাহাড়ি নির্জন পথ। পথের পাশের বাড়িগুলির দিকে তাকাতে তাকাতে সান্স সৌচির দিকে এগিয়ে চলতে থাকে টুপেনস। নামফলকগুলির ওপরও চোখ বোলায়।
স্মাগলার্স রেস্ট–বিচিত্র নামের বাড়িটি এখানেই আছে। কামাণ্ডার হেডকের আবাস। তার পাশাপাশি রয়েছে বেল ভিক্টা, শ্ৰেলি টাওয়ার, সী ভিউ, ক্যাসেল কার। এই সারির সব শেষের বাড়িটিই হল সান্স সৌচি।
কাছাকাছি এসে চলার গতি মন্থর করে টুপেনস। তার চোখে পড়ে পথের ধারে দাঁড়িয়ে এক মহিলা সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সান্স সৌচির দিকে।
কৌতূহলী টুপেনস কাছাকাছি এসে পড়লে মহিলা চমকে মুখ ঘুরিয়ে তাকান।
দীর্ঘাঙ্গী, প্রশস্ত কাঁধ, মুখে মলিনতা থাকলেও বনেদিয়ানার ছাপ। কিন্তু বসনে দারিদ্র্যর চিহ্ন। বয়স চল্লিশের কোঠায়।
অপরিচিতা মহিলাকে চোখে পড়ামাত্র টুপেনসের মনে হল, এই মুখ তার চেনা, আগে কোথায় দেখেছে, কিন্তু সেই মুহূর্তে স্মরণে আনতে পারল না।
টুপেনসই প্রথম কথা বলল, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?
মহিলা ইতস্তত করে বললেন, মাফ করবেন, এই বাড়িটা কি সান্স সৌচি?
কথায় বিদেশী টান কান এড়াল না টুপেনসের। মৃদু কণ্ঠে সে বলল, হ্যাঁ। কাকে খুঁজছেন আপনি?
-আপনি এই বাড়িতেই থাকেন?
–হ্যাঁ।
–আচ্ছা, বলতে পারেন, মিঃ রোসেনস্টাইন নামে কেউ থাকেন?
–মিঃ রোসেনস্টাইন, চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল টুপেনস, না, এই নামে তো কেউ এখানে নেই। আগে ছিলেন কিনা বলতে পারব না। খোঁজ নিয়ে বলতে পারি।
–তার আর দরকার হবে না, মাফ করবেন, আমারই ভুল হয়েছে।
বলে এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না ভদ্রমহিলা। দ্রুত বিপরীত দিকে ফিরে চললেন।
অপরিচিতা মহিলার ব্যবহার টুপেনসের মনে সন্দেহ উসকে দেয়। সে রহস্যের আভাস পায়। কাকে খুঁজতে এসেছিলেন মহিলা? নাকি সবটাই ধোঁকা?
মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করে নেয় টুপেনস। স্বভাবসুলভ ক্ষিপ্রতায় ঘুরে দাঁড়িয়ে অপসৃয়মান মহিলাকে অনুসরণ করতে থাকে।
কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়ায়। কাজটা কি সঙ্গত হচ্ছে? তার মনোভাব প্রকাশ হয়ে পড়ছে।
কারোর নজরে পড়ে গেলে সন্দেহ করতে পারে। তাহলে মিসেস ব্লেনকিনসপের ভূমিকাটা বিঘ্নিত হবে। উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।
আর এগলো না টুপেনস। দ্রুতপায়ে ফিরে এল সান্স সৌচিতে।
অবাক হলো টুপেনস, গোটা হলঘর ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। ওপর থেকে কেবল বেটির আধো আধো কথার স্বর ভেসে আসছে।
টুপেনস ভাবল, ওপরে যে যার ঘরে চলে গেছে না বাইরে বেড়াতে বেরিয়েছে? একজনও কেন নিচে নেই?
নিস্তব্ধ হলঘরের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল টুপেনস। নিঃঝুম বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বাইরে থেকে কী দেখবার চেষ্টা করছিলেন মহিলা? কাউকে খুঁজছিলেন নিশ্চয়? টুপেনস ভাবে, কী হতে পারে? কিছু কি ঘটতে চলেছে এই বাড়িতে?
ঠিক এই সময় চারপাশের নিথরতা যেন খানখান হয়ে যায়। টেলিফোন বাজছে।
এ বাড়ির টেলিফোনটা হলঘরে। একমাত্র এক্সটেনশন লাইন রয়েছে মিসেস পেরিনার কক্ষে।
এই মুহূর্তে আশপাশে কেউ নেই। টুপেনস কোনোরকম দ্বিধা না করে এগিয়ে গেল। সাবধানে রিসিভার তুলে আড়ি পাতল।
বোঝা গেল, এ বাড়ির এক্সটেনশনটি কেউ ব্যবহার করছে। পুরুষ কণ্ঠ শোনা যায়–সব কিছুই ঠিক ঠিক চলছে…সুযোগ বুঝে, মনে আছে তো, চার নম্বরে
এপাশ থেকে নারীকণ্ঠ কানে আসে–ঠিক আছে, চালিয়ে যাও…
এটা যান্ত্রিক শব্দ…রিসিভার নামিয়ে রাখার। ধীর পায়ে সরে আসে টুপেনস…তার মনে প্রচণ্ড আলোড়ন…সান্স সৌচির মহিলাদের মধ্যে কোনো একজন ধরেছিল টেলিফোন। কিন্তু কার কণ্ঠস্বর হতে পারে? কয়েকটি মাত্র শব্দ শোনা গেছে…এ থেকে তা বোঝার উপায় নেই।
টুপেনস পরক্ষণে ভাবে, মিথ্যাই উতলা হচ্ছে সে। কথাগুলোর মধ্যে আদৌ কোনো রহস্যই নেই। নিতান্তই সাধারণ ব্যক্তিগত আলোচনার খণ্ডাংশ…মূল্যহীন।
যা শুনবে মনে করে সে আড়ি পেতেছিল আসলে এসব কথা তা নয়।
তবে এটা বোঝা গেল, ফোনটা মিসেস পেরিনা ধরেননি। টুপেনস রিসিভার নামিয়ে রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল মিসেস পেরিনা ঘরে ঢুকছে।
-মিসেস ব্লেনকিনসপ, আপনি কি ঘুরে এলেন না বেরচ্ছেন?
টুপেনস তার বৈকালিক ভ্রমণের কথা জানিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। মিসেস পেরিনাও চললেন তার পেছনে।