টুপেনস মুহূর্তে চঞ্চল হয়ে উঠল। টমির দিকে তাকিয়ে সোল্লাসে বলে উঠল, মিঃ মিয়াদো, আপনাকে দারুণ সতেজ লাগছে।
টমি হাসল। বলল, অনেক কসরত করে এলাম যে। গলফের মাঠ থেকে আসছি।
মিসেস ওরুরকি হঠাৎ টুপেনসের সোয়েটারের দিকে মনোযোগী হয়ে পড়েন। হাতে টেনে পরীক্ষা করে বলেন, এটা নিজের হাতে বোনা?
টুপেনস জবাব দেয়, আজ্ঞে হ্যাঁ।
–দারুণ বোনা হয়েছে। কিন্তু মিস মিল্টন বলছিলেন, আপনি নাকি উল বোনায় তেমন দক্ষ নন।
কথাটা শুনে কেমন চমকে উঠল টুপেনস। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল মিসেস ওরুরকির দিকে। পরে হেসে বলল, উল যথেষ্টই বুনেছি আমি। তবে মিস মিল্টন অন্য কারুকে স্বীকার করতে চান না
সকলে একসঙ্গে হেসে উঠল টুপেনসের কথা শুনে।
.
ডাইনিং টেবিলে নানা প্রসঙ্গের অবতারণা হয়। আজ আলোচনা চলছিল জার্মান গুপ্তচরদের নিয়ে। তারা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চতুর্দিকে।
কোনো এক গির্জার পাদ্রী শত্রুপক্ষের স্পাই। এক অস্ট্রিয়ান পাচিৎকার ঘরে ওয়ারলেসের যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হয়েছে। এবার স্পাইদের সঙ্গে যোগ হয়েছে ঘরশত্রু পঞ্চমবাহিনী এভাবেই আলোচনা এগিয়ে চলেছে।
টুপেনস চোখ কান খোলা রেখে সজাগ হয়ে রয়েছে। যদি কোথাও গন্ধ পাওয়া যায়। তার মাথা জুড়ে রয়েছে এম ও এন।
মিসেস পেরিনার মেয়ে শীলা একপাশে চুপচাপ বসে রয়েছে। এককথায় তাকে সুন্দরী বলা চলে, মনে হল টুপেনসের। কিন্তু বিশেষ কথা বলছিল না সে।
মিসেস স্প্রট বলছিলেন, জার্মানরা বড় নৃশংস, গতযুদ্ধে তারা ক্যাভেল নামে একজন নার্সকে গুলি করে মেরেছিল। এমন অমানবিক কাজ ভাবা যায়?
শীলা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়ে সুরেলা কণ্ঠে বলে উঠল, একজন গুপ্তচরকে হত্যা করা কিছু অমানবিক কাজ হতে পারে না। ক্যাভেল অনেক ইংরেজ বন্দিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।
-না, না, উনি স্পাই ছিলেন না।
সমবেতভাবে প্রতিবাদ জানাল সকলে।
শীলা তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে বলল, স্পাই ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জার্মানরা কিছু অন্যায় কাজ করেনি।
তেজের সঙ্গে উঠে দাঁড়াল শীলা। তারপর সকলকে অবাক করে ড্রইংরুম ছেড়ে বাগানে চলে গেল।
কয়েকমুহূর্ত সকলেই নীরব হয়ে রইলেন। সামনের খাবারের প্লেটে মনোযোগী হয়ে ধীরে ধীরে আবার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
টমি এক ফাঁকে উঠে ধীরে ধীরে ডাইনিংরুম থেকে বেরিয়ে বাগানে নেমে গেল।
শীলা বাগানের একদিকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দূর সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিল। নিঃশব্দ পায়ে টমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। প্রবল উত্তেজনায় শীলার হাত মুঠো করে পাকানো।
–বড় মনোরম রাত।
প্রথম কথা বলল টমি।
শীলা চকিতে টমিকে দেখে নিল। মৃদু স্বরে বলল, না, রাতের সেই সৌন্দর্য আর নেই।
টমি সংযত কণ্ঠে বলল, যুদ্ধের জন্য বলছেন?
-না, তা আমি বলিনি, তবে যুদ্ধকে আমি ঘৃণা করি।
–যুদ্ধ কেউ মেনে নিতে পারে না।
–কিন্তু আমার দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম। ক্ষিপ্ত দেশাত্মবোধ আমি বরদাস্ত করতে পারি না।
–দেশাত্মবোধ-কেন? বিস্মিত হয় টমি।
তীব্র দেশাত্মবোধ বড় মারাত্মক। কেবল দেশ দেশ করা–দেশকে সেবা করা। দেশের জন্য আত্মত্যাগ, দেশের সঙ্গে শত্রুতা করা–সব ভাঁওতা। একজনের দেশ বলতে এই যে বিশেষ কিছু একটা বোঝনো, এটাই অসহ্য, কেন এমন হবে?
-ঠিক বলেছেন, আমি তা মনে করি না। মৃদুস্বরে বলতে চাইল টমি।
-আমি কি বলছি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদে বিশ্বাসী আপনারা, দেশের জন্য প্রাণত্যাগ করতেও কুণ্ঠিত নন।
–কিন্তু দেশের স্বার্থে আত্মত্যাগ করতে চাইবে প্রতিটি দেশপ্রেমী মানুষ।
–এ আমি বিশ্বাস করি না। আমি অনেক দেখেছি–অনেক আঘাত পেয়েই একথা বলছি। বলতে বলতে সহসা টমির দিকে ঘুরে দাঁড়ায় শীলা। আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলতে থাকে, আমার বাবা প্যাট্রিক মেগুয়ির পরিণতির কথা আপনি জানেন?
-না।
–গতযুদ্ধের সময় তাকে বিশ্বাসঘাতক অপবাদ দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। অথচ বাবার কোনো অপরাধ ছিল না। কিন্তু একজন জাতীয়তাবাদী আইরিশ হিসেবে স্বাধীন আয়ারল্যান্ডের কথা তিনি ভাবতেন, উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। এই অপরাধেই তাকে কয়েদ থাকতে হয়, পরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মরতে হয়।
তাহলে দেখুন, এক পক্ষের কাছে তিনি হলেন বিশ্বাসঘাতক, অপরপক্ষের কাছে তিনি দেশপ্রেমী শহীদ বলে বন্দিত।
কিন্তু আমি মনে করি, আমার বাবা ছিলেন একজন নিপাট মূর্খ। তার পরিণতি আমাদেরও স্পর্শ করেছে।
–খুবই স্বাভাবিক। বলল টমি।
-কিন্তু আমি সবকিছু মুছে ফেলতে চাই। আমার মাও তাই চায়। তিনি তার নাম বদলে ফেলেছেন। পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি সর্বত্র বলেন আমার বাবা ছিলেন একজন স্প্যানিয়ার্ড। আমরা কিছুদিন স্পেনে ছিলাম।
তারপর ইউরোপের নানা স্থান ঘুরে শেষ পর্যন্ত এখানে এসে থিতু হয়েছি। একটা নিচু শ্রেণির ব্যবসা অবলম্বন করতে হয়েছে।
কথা শেষ করে নীরব হয়ে থাকে শীলা। পরে চকিতে মুখ তুলে বলে, আপনাকে কেন এতসব কথা বলে ফেললাম, জানি না। কিন্তু দেশাত্মবোধকে আমি ঘৃণা করি।
বলেই আর দাঁড়াল না সে। দ্রুত সরে গিয়ে গাছপালার ছায়ায় মিলিয়ে গেল।
২. দুজনের দেখাসাক্ষাৎ
ওদের দুজনের দেখাসাক্ষাৎ হয় গোপনে, সকলের চোখের আড়ালে। নিজেদের মধ্যে মতামত বিনিময় করে তারা।