–তাহলে তো দিনিম ইংলন্ডের বন্ধু, তাকে সন্দেহ করা বৃথা।
–ওই ভুলটি করবেন না, বললেন মিঃ গ্রান্ট, আপনি গোয়েন্দা, আবেগের প্রশ্রয় দেবেন না। জার্মান ভাইয়ের কাজ অতি নিখুঁত। ভন দিনিমের ক্ষেত্রে এমন হতে পারে, ওই নামটা আদৌ তার নিজের নয়-নাম ভাঁড়িয়ে আছে।
তবে আমাদের শত্রুদের মধ্যে মারাত্মক হল সেই পঞ্চমবাহিনী মনে রাখবেন, যারা দেশের সন্তান হয়েও বিদেশী শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
এই ঘৃণ্য জীবগুলোর জন্যই আমাদের যাবতীয় প্রয়াস বৃথা হয়ে যাচ্ছে। মুশকিল হল এই ঘরশত্রুরা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে। শত্রুর জয় হলে এদেরও পদোন্নতি হবে।
টমি দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করল, ঘৃণ্য শয়তানের দল
–এই শয়তানদেরই কবজায় আনতে হবে আমাদের।
এক মুহূর্ত নীরব থাকলেন মিঃ গ্রান্ট। পরে বললেন, ওখানকার মহিলাদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
–একজন মহিলাকেই আমার অন্যরকম মনে হয়েছে।
–মিসেস পেরিনার কথা বলছেন?
–হ্যাঁ। ওর সম্পর্কে আপনার কিছু জানা আছে?
–সন্ধান নিতে হবে।
–আর একটা খবর আছে স্যার।
–বলুন।
–মিসেস ব্লেনকিনসপ নামে এক মহিলা সম্প্রতি এসে জুটেছেন।
বেশ তো, নজর রাখবেন।
–স্যার, ইনি আমার স্ত্রী।
বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে পড়ে মিঃ গ্রান্টের। প্রায় চিৎকার করে বলে ওঠেন, কী বলছেন? স্ত্রীর কাছে ব্যাপারটা গোপন রাখার কথা আপনাকে বলেছিলাম।
–আমি স্যার কিছুই ফাস করিনি। এর পর টমি টুপেনসের কায়দা-কৌশল সব খুলে জানাল। শুনে মিঃ গ্রান্ট প্রথমে গুম হয়ে রইলেন। পরে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠে বললেন, অদ্ভুত, সত্যিই অদ্ভুত। এমন মহিলা বুঝতে পারছি এজন্যেই এস্থাম্পটন এই মিশনে আপনার স্ত্রীকেও নিতে বলেছিলেন। আমিই রাজি হতে পারিনি।
এখন দেখছি বুদ্ধির দৌড়ে তিনি সকলকে টেক্কা দিতে পারেন। এস্থাম্পটন শুনলে নিঃসন্দেহে খুশি হবেন।
যাইহোক, ডিপার্টমেন্ট আপনাদের দুজনকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে–তাঁকে জানাবেন। আপনাদের যৌথ অভিযান সফল হোক।
.
ডিনার শুরু হতে তখনও কিছু সময় বাকি। টুপেনস লাউঞ্জে ঢুকে দেখতে পেলেন মিসেস ওরুরকি একাই বসে আছেন। জানালার বাইরে তাকিয়ে আপন মনে কী ভাবছেন।
টুপেনসকে দেখতে পেয়েই সোল্লাসে চিৎকার করে আহ্বান জানালেন।
বিশাল বপু ওরুরকিকে দেখলে কারোরই পছন্দ করবার কথা নয়। স্তূপীকৃত চর্বির মস্ত বাণ্ডিল যেন। বিশাল মাথা, গোল গোল পাকানো চোখ, গালে কুচিকুচি দাড়ি আর গোঁফের রেখা। তবু তার আহ্বান শুনে টুপেনসের মনে হল, তার প্রতি ভদ্রমহিলার কিছুটা টান আছে।
হাসিমুখে এগিয়ে এসে টুপেনস বলল, লিহাম্পটন জায়গাটার গুণ আছে বলতে হবে। মনের ভার সহজেই লাঘব করে দিতে পারে।
মিসেস ওরুরকি বললেন, অত ভাববেন না, আপনার ছেলেরা নিরাপদেই আপনার কাছে ফিরে আসবে। একজন তো বিমানবাহিনীতে আছে, তাই না?
টুপেনস মাথা ঝাঁকালো। মুখে দুশ্চিন্তার ভাব ফুটিয়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
–এখন কি ফ্রান্সে আছে?
মিশরে আছে। চিঠিতে তো ওসব জানাতে পারে না–সংকেতে লেখা আমাকে বুঝে নিতে হয়।
–মা আর ছেলের ব্যাপার–আর এক ছেলে তো নৌবাহিনীতে?
নিজের ছেলে ডগলাসের কথা মনে পড়ে যায় টুপেনসের। নীরবে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। পরে বলে, তিনজনকেই ছেড়ে দূরে এসে আছি।
লন্ডনের বাড়িটা লিজ নেওয়া–ওটা নিয়েও ভাবনা হচ্ছে। ভাবছি লিজের মেয়াদ বাড়িয়ে আর কাজ নেই।
লন্ডনের কথা বলবেন না, বললেন মিসেস ওরুরকি, ওখানে আমাদের বহুকালের বাস, ছোটখাট একটা ব্যাবসাও আছে, কিন্তু এই যুদ্ধ আমাদের সর্বনাশ করেছে।
একটু থেমে তিনি আবার বলতে থাকেন, অবশ্য এই পরিণতি নিয়ে কাউকেই দোষারোপ করার কিছু নেই। রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে আমাদের। এখানে তো দেখছি সবারই নানান অভিযোগ। মিসেস স্প্রট তো তার স্বামীর ওপরেই দেখছি যত ঝাল ঝাড়েন।
–ওর স্বামী কি সীমান্তের যুদ্ধে আছেন? জানতে চাইল টুপেনস।
–না যুদ্ধে যাননি। জীবনবীমা অফিসের সামান্য চাকুরে। বোমার ভয়ে বউ মেয়েকে এখানে রেখে গেছেন। সময় সুযোগ করে এসে এদের দেখে যান। বেচারির কি হয়রানি বলুন।
-হ্যাঁ, খরচের ব্যাপারটা তো কম নয়।
–তবু তো বলব, মিসেস পেরিনা কম খরচে যথেষ্ট সুবন্দোবস্ত করেছেন। মহিলার তুলনা হয় না। কিন্তু কী জানেন, ওকে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।
-কেন? অবাক হয়ে তাকায় টুপেনস, তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে। আপনার?
সবার ওপরেই চোখ রয়েছে আমার। ভাববেন না, আমি বকবক করছি। নজরে পড়ে তাই বলছি। কে কোথায় যান, কী করেন, দেখতে পাই সবই তাই বলছি, মিসেস পেরিনা এক বিচিত্র ধরনের মহিলা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই।
–আপনার এরকমই মনে হয়?
–আজকাল হচ্ছে। নিজেকে একটা রহস্যোর জালে জড়িয়ে রেখেছেন মহিলা। তাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, আয়ারল্যান্ডের মেয়ে। কিন্তু জিজ্ঞেস করলে বেমালুম বলে দিলেন, তিনি আইরিশ নন।
–সত্যিই কি উনি তাই?
–আমি আমার দেশের মেয়েদের চিনতে পারব না? উনি আয়ারল্যান্ডের কোন অঞ্চলের মেয়ে তা-ও আমি বলে দিতে পারি। অথচ উনি সকলকে বলে বেড়ান তিনি ইংরেজ। তার স্বামী ছিলেন স্প্যানিশ।
বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন ওরুরকি। টুপেনস তাকিয়ে দেখল লাউঞ্জে প্রবেশ করছেন মিসেস স্প্রট আর তার পেছনে টমি।