টুপেনসের গায়ে-পড়া অতি-উৎসাহে থতমত খেল টমি। বলার চেষ্টা করল, ধন্যবাদ সত্যিই একটু দেরি হয়ে গেল।
মেজর ব্লেচলি ও টমি আসনগ্রহণ করলেন। ছোট্ট বেটি অমনি মায়ের কোলে হুটোপাটা করে হাত বাড়িয়ে দেয় মেজরের দিকে। মুখে আওয়াজ তোলে-পুচপুচ
মেজর হাসিমুখে শিশুর দিকে তাকান। আদুরে গলায় বলেন—আ–পুঁচকে মিস পিপ–সকালটা কেমন কাটল
ছোট্ট বেটি মজা পেয়ে লাফিয়ে উঠে খিলখিল শব্দে হেসে উঠল।
শিশুর হাসির শব্দটি হঠাৎ কেমন অর্থবহ বোধহয় টুপেনসের। দুর্বোধ্য একটা সন্দেহের দোলা লাগে মনে।
মেজর আর শিশুটির আন্তরিক সম্পর্কের মধ্যে কিছু একটা অস্বাভাবিকতার ছায়া যেন দেখতে পায় সে। চমকিত হয়ে তাকায় ওদের দুজনের দিকে।
.
মিস মিল্টন সান্স সৌচির বাগানে চেয়ারে বসে আপন মনে উল বুনে চলেছেন। টুপেনস এগিয়ে এসে প্রাতঃকালীন অভিবাদন বিনিময় করে পাশের চেয়ারে বসল।
উলবোনা নিয়ে দুজনের মধ্যে কথাবার্তা চলতে থাকে। কথায় কথায় মিস মিল্টন হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন, আপনার এক ছেলে নেভিতে আছে বলেছিলেন, তাই না?
টুপেনস সাগ্রহে বলে উঠল, হা বড়টি। পরেরটি রয়েছে বিমানবাহিনীতে। কোলেরটিকে ফ্রান্সেই রেখে আসতে হয়েছে।
–আহা, তাহলে তো বড়ই কষ্টে দিন কাটছে আপনার।
–দেশের এই সঙ্কট সময়ে ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্টের কথা বড়ো করে দেখা উচিত নয় আমাদের। আমাদের এখন সাহসী হতে হবে, তাই নয়?
তবে জার্মানদের দাপট শীঘ্রই কমে আসবে। আমার ধারণা, মাস দুয়েকের মধ্যেই ওরা ঝিমিয়ে আসতে বাধ্য।
মিস মিল্টন উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলেন, আমারও তাই ধারণা।
তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন, আমি শুনেছি হিটলার এক মারাত্মক অসুখে ভুগছেন। অনেকেই অনুমান করেছেন, আগস্ট মাসের মধ্যেই সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যাবেন।
টুপেনস বলল, জার্মানির ভেতরের অবস্থাও ভালো নয়। শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে। ক্রমশ। রসদেও টান পড়েছে।
-দুজনে বেশ জমে গেছেন মনে হচ্ছে।
মিঃ ও মিসেস ক্লে এসে উপস্থিত হলেন।
মিঃ ক্লে-এর কথার উত্তরে মিস মিল্টন বললেন, আমরা যুদ্ধের কথা বলছিলাম। এই শরতেই শেষ হয়ে যাবে, তাই নয়?
-বাজে কথা, বললেন মিঃ ক্লে, অত সহজ নয়। আরও দু-বছর এই রকমই চলবে।
চমকে ওঠার ভান করল টুপেনস। বলল, সর্বনাশ! আপনার কি ওরকমই মনে হচ্ছে মিঃ ক্লে?
নিজের আসনে নড়েচড়ে বসলেন মিঃ ক্লে। তিনি যে আগ্রহ সঞ্চার করতে পেরেছেন একথা ভেবে বেশ আত্মপ্রসাদের সঙ্গে হাসলেন।
-আমার তাই ধারণা–যুদ্ধের এই ডামাডোল আরও বছর দুই চলবে নির্ঘাৎ।
টুপেনস ও মিস মিল্টন দু-জনেই প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করেন।
জার্মানিকে আমি ভালোভাবেই চিনি, বললেন মিঃ ক্লে, একসময়ে নিজের কাজে ওই দেশের কোথায় না গেছি। বার্লিন, হামবুর্গ, মিউনিক বাদ নেই কোথাও। ওদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। ওই ব্লিটসীগ–ওতেই এরা আমাদের কাবু করার মতলব এঁটেছে। তার ওপর যদি রাশিয়া পাশে এসে দাঁড়ায় তাহলে তো আর কথাই নেই।
এইসময় ছোট্ট বেটিকে নিয়ে তার মা মিসেস স্প্রট এসে হাজির হলেন। শিশুটির হাতে ধরা একটা পুতুল। নিজের মনেই সে বকবক করে চলেছে।
ওদের দিকে তাকিয়ে সকলেই কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হলেন। বেটি মায়ের কোল থেকে নেমে ছোটাছুটি আরম্ভ করল।
টুপেনস প্রসঙ্গের খেই ধরিয়ে দিয়ে বলল, তারপর বলুন মিঃ ক্লে।
মিস মিল্টনও সাগ্রহে তাকাল মিঃ ক্লে-এর দিকে। টুপেনসকে আচমকা মিসেস ক্লে-এর দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল, আপনারও কি একই অভিমত মিসেস ক্লে? আমাদের বিপন্নতা আর দীর্ঘস্থায়ী হবে?
আকস্মিক এই প্রশ্নে হকচকিয়ে যান মিসেস ক্লে। তিনি আমতা-আমতা করে বলেন, আমাকে বলছেন? আমি কি বলব? তবে দু-বছর চলবে বলে মনে হয় না।
-হ্যাঁ, সময়টা বড়ো বেশি। বলল টুপেনস।
-কিন্তু আলফ্রেড তো বলছে আরও দু-বছর চলবে। নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না আমি।
উপস্থিত সকলেই নীরব থেকে মিসেস ক্লে-এর মতামত শুনল। টুপেনস দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে আশা করেছিল, এই আলোচনার সুযোগে তাদের মধ্যে সে একজনকে চিহ্নিত করতে পারবে।
কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল টুপেনস। সম্বিৎ ফিরে পেল মিসেস পেরিনার আবির্ভাবে।
নিঃশব্দে তিনি পেছন থেকে আলোচনারত নারী-পুরুষদের মধ্যে এসে দাঁড়ান। তার মুখের দিকে তাকিয়ে টুপেনসের অনুভূতিগুলি সজাগ হয়ে উঠল। পলকের জন্য তার মনে একটা সন্দেহের ছায়াপাত হল। সে ভাবল, ওই মহিলা সম্পর্কে নজর খোলা রাখা দরকার।
.
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই টমির সঙ্গে মেজর ব্লেচলি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। দুই বন্ধু তখন বেশির ভাগ সময়ই একসঙ্গে থাকেন।
গলফ খেলার মাঠের দিকে চলতে চলতে কার্ল দিনিম সম্পর্কে মেজর বলতে লাগলেন, ওই জার্মান ছোকরাকে কিন্তু আমি সন্দেহ না করে পারছি না, যাই বলুন। যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার একমাস আগেই এখানে এসে গেড়ে বসেছে। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে-বুঝলেন কাজটা নির্ঘাত গুপ্তচরবৃত্তি।
টমি কৌতূহলী হয়ে বলল, কিন্তু এখানে তো কোনো সামরিক ঘাঁটি নেই
–নেই তো কী, ঈষৎ উত্তেজনা মিশল মেজরের কণ্ঠস্বরে। এই সময়ে এমন নিরিবিলি জায়গায় থেকে কাজ করাই নিরাপদ। প্লাইমাউথ বা পোর্টসমাউথে থাকলে সদাসতর্ক পুলিশের নজরে পড়ে যাবার ষোলআনা সম্ভাবনা।