-তাই নাকি? অবাক হওয়ার ভান করে টমি।
বেশ সরস হয়ে ওঠেন মেজর। টমির পিঠে থাবা বসিয়ে বলেন, আপনার যদিও বয়স ঢলে পড়েছে, তবু বিধবা বলে কথা। বুঝতেই তো পারেন ওরা কোনো শ্রেণির জীব। ইতিমধ্যেই মহিলা দু-জন স্বামীকে পার করেছে, তৃতীয় শিকারের সন্ধানে আছে বলেই সন্দেহ হয়। অতএব সাবধান–এ আমার উপদেশ।
কথা বলতে বলতে সান্স সৌচির গেটের কাছে পৌঁছে গেলেন তারা।
.
ওদিকে টুপেনস চলার গতি মন্থর করে। উৎকর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে আলাপরত কপোতক পোতিকে অতিক্রম করে যায়। যুবতীর চাপা স্বর তার কানে আসে…সাবধান থেকো কার্ল…কোনোরকম সন্দেহ…
আর শোনা গেল না। আরও কয়েক পা এগোল টুপেনস। তারপর আবার ঘুরল। যুবতীর গলার স্বর কানে এলো–নিজের অবস্থার কথা ভুলে যেয়ো না…জঘন্য ইংরেজরা–
কিছুদূর গিয়েই টুপেনস আবার ফিরল। যুবক-যুবতী এখন আর একসঙ্গে নেই। মেয়েটি দ্রুতপায়ে পথে নেমে পড়েছে।
যুবকটি অন্যমনস্কভাবে টুপেনসের দিকেই এগিয়ে আসছে।
দু-জনে চোখাচোখি হল। মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাল যুবকটি।
–সুপ্রভাত মিঃ কার্ল ভন দিনিম, প্রতিঅভিবাদন করল টুপেনস। ভারী মনোরম আজকের সকালটা।
-হ্যাঁ, চমৎকার আবহাওয়া। স্মিত হাসল দিনিম, ম্যাডাম, আপনি কি সান্স সৌচিতে ফিরছেন? তাহলে আপত্তি না থাকলে আমরা একসঙ্গেই যেতে পারি।
ওরা দু-জনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। চলতে চলতে টুপেনস জিজ্ঞেস করল, প্রাতঃরাশ করেছেন, না বাকি আছে?
–ওই পাট চুকিয়েই বেরিয়েছি। এখন কাজে যাচ্ছি।
–কী কাজ? জানতে চাইল টুপেনস।
-কেমিস্ট্রি নিয়ে রিসার্চ করছি। কিছু একটা করে এই বিদেশে পেট চালাতে হবে তো। তাই যেটা জানি তাই নিয়েই লেগে পড়েছি।
–বিদেশে দুঃসময়ে বিদ্যেই পরম সহায়। আপনি ঠিকই করেছেন। বলল টুপেনস।
কথা বলতে বলতে দিনিমের মুখাভাবে একটা কাঠিন্য ফুটে ওঠে। তিনি বলতে থাকেন, দুই ভাই এখনও পচছে অত্যাচারী নাৎসীদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ওইরকম একটি ক্যাম্পেই বাবা প্রাণ হারান।
সেই শোক সইতে না পেরে মাও আতঙ্কে আর ভয়ে অকালে মারা যান। একা আমিই কোনোক্রমে পালিয়ে এসে নড়েচড়ে বাঁচবার চেষ্টা করছি।
দিনিম কেমন উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। কথা শেষ হলে সশব্দে পা ফেলে নীরবে হাঁটল কিছুক্ষণ। টুপেনসের মনে তার কথাগুলোই গভীর বেদনা মথিত করে তুলছিল।
দু-জন পথচারী ওদের অতিক্রম করে চলেছে। হঠাৎ একজন তার সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ওই শয়তানকে চিনে রাখ, একটা বজ্জাত জার্মান।
প্রবল ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত মন্তব্যগুলো উত্তপ্ত শলাকার মতো দিনিমের কানে প্রবেশ করল। মুহূর্তের মধ্যে তার শান্ত চেহারা ক্ষোভে উত্তেজনায় ভয়ানক হয়ে ওঠে। কপালের শিরা ফুলে ওঠে। সে উত্তেজিত ভাবে বলে ওঠে, শুনলেন তো এরকম মন্তব্যই পথেঘাটে আমাকে শুনতে হয়। আমি এখুনি ওদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারি।
মারমুখী জার্মান যুবককে শান্ত করতে টুপেনস বলে উঠল, মাথা গরম করবেন না, শান্ত হোন। এই সময়ে বিবেচনাশক্তি হারালেই বিপদ।
-কী বলতে চাইছেন আপনি। গনগনে স্বরে জিজ্ঞাসা করে দিনিম।
ধীর কণ্ঠে টুপেনস বলল, দুটো দিকই আপনার ভেবে দেখা উচিত। এই দেশ এখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় আপনি একজন জার্মান উদ্বাস্তু, স্থানীয় সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই আপনার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকাবে। তবু এটা তো সত্যিকথা আপনি বেঁচে আছেন, এবং স্বাধীন ভাবেই বেঁচে আছেন।
জার্মানদের মধ্যে যারা ভালো মন্দ চিনতে পারেন তেমন শিক্ষিত মানুষ পথেঘাটে সচরাচর ঘুরে বেড়ান না, এরা সব সাধারণ শ্রেণির মানুষ। সব জার্মানই এদের কাছে সমান। এদের মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
টুপেনসের কথায় দিনিম সংযত হয়। ধীর পদক্ষেপে সে সান্স সৌচি পর্যন্ত টুপেনসকে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেয়।
.
ডাইনিংরুমের দরজায় পৌঁছেই মিসেস পেরিনার গলা শুনতে পেল টুপেনস। তিনি তার মেয়ে শীলার গল্প শোনাচ্ছিলেন অতিথিদের।
-শীলার সঙ্গে আলাপ হলে আপনারা খুশি হবেন। কাল রাতে এসেছিল, আজই সকালে আবার ফিরে গেল।
টুপেনসকে দেখতে পেয়ে সুপ্রভাত জানিয়ে অভিবাদন করলেন। জানালেন, ডাইনিংরুমে তার ব্রেকফাস্ট দেওয়া আছে।
মিসেস স্প্রট, তার ছোট্ট মেয়ে এবং মিসেস ওরুরকি তখন ব্রেকফাস্ট সারছিলেন। টুপেনস সকলের সঙ্গে প্রাতঃকালীন অভিবাদন বিনিময় করল।
মিসেস স্প্রটের শিশুটি টুপেনসকে দেখতে পেয়েই আনন্দ করে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আধো-আধো স্বরে বলতে লাগল, গা-গা-ব (Ga-Ga-Bouch)।
মিসেস স্প্রট বললেন, সবে দু-বছর পার হল, ভালো করে কিছুই বলতে পারে না। বাব ওসবই আওড়াচ্ছে সারাক্ষণ।
বিপুল দেহী মিসেস ও রুরকি শিশুটির দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন। তার বিকট আকৃতি দেখে শিশুটি ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠে–Nazar
শিশুটির বিরাগ বুঝতে পেরে মিসেস ওরুরকি অপ্রতিভ হলেন। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
মিসেস স্প্রট বললেন, কোনো কিছুতেই ভয় পেলেই ও এমনি ভাষায় চিৎকার করে ওঠে।
মিসেস ওরুরকি বাচ্চাদের ভালোইবাসেন, কিন্তু তার অমন অদ্ভুত চেহারাই বাচ্চাদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়।
এইসময় টুপেনস দেখতে পেল, মেজর ব্লেচলি ও টমি ডাইনিংরুমে ঢুকছেন। উৎসাহিত হয়ে সে বলে ওঠে, আসুন আসুন মিঃ মিয়াদো। কখন থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছি–