পোলিশ মহিলাটিকে যে আবিষ্কার করা যাবে–এমনটা নিশ্চয় ভাবতে পারেনি তারা। কিন্তু সত্যি সত্যি যখন আমরা সেই হতভাগিনীর নাগাল পেয়ে গেলাম–স্পট হুঁশিয়ার হয়ে গেল। সে আর ঝুঁকি নিতে চায়নি।
অব্যর্থ গুলিতে লক্ষ্যভেদ করে সে। এমন নির্ভুল লক্ষ্যভেদ কি কখনও এমন কারো দ্বারা সম্ভব–যে কোনো দিন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেনি।
অথচ আনাড়ি হাতে লক্ষ্যভেদ করেছে বলে আমরা বাহবা দিলাম মিসেস স্প্রটকে। সামান্য সহানুভূতিও পেল না হতভাগিনী। ভান্দা পলোনস্কা।
একটু থামল টুপেনস। পরে আবার বলতে শুরু করল, বেটির একটা ছেলেমানুষি খেলার মধ্যেও রহস্যের ইঙ্গিত ছিল। ব্যাপারটা আমাকে খুবই ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল।
উল লেস নিয়ে বেটি জলের গ্লাসে ঘোরাচ্ছিল। আসলে ওরকম একটা ব্যাপার বারবার তার চোখে পড়েছিল। তাই অনুকরণ করার চেষ্টা করেছিল।
সে রাসায়নিকের সাহায্যে অদৃশ্য লেখা উদ্ধার করতে দেখেছিল মিসেস টকে-কার্ল ভন দিনিমকে কিন্তু নয়।
কার্ল এসবের সঙ্গে জড়িত নয় জেনে আমার আনন্দ হচ্ছে। ওকে আমি পছন্দ করি। বলল টমি।
টুপেনস আকুল স্বরে জানতে চাইল, দিনিমের কী খবর? তাকে নিশ্চয় গুলি করে মারা হয়নি?
মৃদু হেসে মিঃ গ্রান্ট জানালেন, না, সে নিরাপদেই আছে। আমার আশ্চর্য লাগছে, তার জন্য আপনারা এতটাই আগ্রহী ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন।
টুপেনসের মুখে ভারমুক্ত উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠল। বলল, শীলার কথা ভেবে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। …নিজেদের বোকামির জন্য এখন লজ্জা হচ্ছে, মিসেস পেরিনাকেই আমরা চক্রের নায়িকা ভেবে নাকাল হয়েছি।
মিসেস ওরুরকি এবং নিরীহ ক্লে দম্পতিকেও সন্দেহের তালিকায় রেখেছি বোকার মতন।
টমি সশব্দে হেসে উঠল। বলল, আর মেজর ব্লেচলিকে তো আমি নজরের বাইরে যেতে দিতাম না।
–অথচ অতি সাদামাটা অস্থিরমতি এক মহিলার অভিনয় করে বেটির তথাকথিত মা আমাদের চোখের আড়ালে নিজের কাজ করে গেছে, ভাবা যায়? বলল টুপেনস।
–নিপুণ অভিনেত্রী বলতে হবে, বললেন গ্রান্ট, কিন্তু লজ্জা ও অনুতাপের ব্যাপার হল, এই ভয়ঙ্কর স্ত্রলোকটি জন্মসূত্রে ইংরেজ।
-একজন দেশপ্রেমী–সে যে জাতেরই হোক না কেন, সে শ্রদ্ধার পাত্র। এই মহিলা জার্মান হলে আমি তাকে সম্মান জানাতাম। কিন্তু এই দেশদ্রোহিণীর প্রাপ্য একমাত্র ঘৃণা।
-ভালো কথা, মিঃ গ্রান্টকে উদ্দেশ্য করে বলল টুপেনস, আপনি যা খুঁজছিলেন, সেটা পাওয়া গেছে?
–হ্যাঁ। বললেন মিঃ গ্রান্ট, সেই পুরোনো ছড়ার বইটাতেই ছিল।
–পুরোনো বই নোংরা বলে ধরতে চাইত না বেটি। মিসেস স্প্রট তাকে ওই ভাবে শিখিয়েছিল। ওই ভাবেই সে আসল জিনিস শিশুটির নাগালের বাইরে রাখতে চেয়েছে।
-বইটা সত্যিই সাংঘাতিক, বললেন মিঃ গ্রান্ট, আমাদের সামরিক পরিস্থিতি ও পরিকল্পনা হুবহু ছক আঁকা রয়েছে ওই ছড়ার বইয়ের পাতায় পাতায়। সব অদৃশ্য কালিতে লেখা।
শুনে খুশি হবেন যে পঞ্চমবাহিনীর দায়িত্ব পালন করছিল যে-সব ব্যক্তি, তাদের প্রত্যেকের নাম আমরা উদ্ধার করেছি ওই বই থেকে। বহু জাঁদরেল ব্যক্তিও রয়েছে তাদের মধ্যে। এরা কাজ করে গেছে আমাদের সামরিক বিভাগ, গোয়েন্দা দপ্তর, ডাক বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ ও রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে থেকে।
টুপেনস উজ্জ্বল চোখে তাকাল মিঃ গ্রান্টের দিকে। বলল, ওরা তাহলে আসবে
–হ্যাঁ, এবারে আসতে দিন, মৃদু হাসলেন মিঃ গ্রান্ট।
আসরে উপস্থিত হল টমি ও টুপেনসের দুই ছেলেমেয়ে ড্রেক ও ডেরক।
তাদের সঙ্গে এসেছে কাল ভন দিনিম ও শীলা পেরিনা।
কার্লকে কাছে পেয়ে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে শীলা, আমি জানতাম তুমি কোনো অন্যায় কাজ করতে পার না। কিন্তু ওরা কি তোমাকে এখনও নজরবন্দি করে রেখেছে?
কার্ল ভন দিনিম হেসে বলল, আমাকে কেন বন্দি থাকতে হবে?
একটু থেমে আবার বলল, শীলা, তুমি আমাকে ক্ষমা করো, তোমার কাছে আমার পরিচয় গোপন করেছিলাম। কার্ল ভন দিনিম আমার আসল নাম নয়-কাজের প্রয়োজনে ওই নামটা নিতে হয়েছিল।
টুপেনসের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় দিনিম।
টুপেনস হেসে বলে, থামলে কেন, ওকে সবকথা এখন খুলে বল।
-কার্ল ভন দিনিম আমার এক বন্ধুর নাম, বলে দিনিম, বছর কয়েক আগে ইংলন্ডে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।
যুদ্ধ শুরু হবার কিছুদিন আগে তার সঙ্গে আবার আমার দেখা হয়েছিল জার্মানিতে। সেই সময় দেশের হয়ে কাজ করার জন্য আমাকে জার্মানিতেই থাকতে হয়েছিল।
তার মানে–তার মানে তুমিও ব্রিটিশ গোয়েন্দা।
বিস্ময়ে চোখ কপালে তোলে শীলা।
-হ্যাঁ, শীলা, জন্মভূমির স্বার্থে। ওই সময় অনেক ঝড় গেছে আমার ওপর দিয়ে। দুবার আমাকে খুনের চেষ্টা হয়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই।
তখন বুঝতে পারি, আমাদেরই গোয়েন্দা দপ্তরের কোনো কর্মী নাৎসীদের আমার আসল পরিচয় জানিয়ে দিয়েছে।
কার্ল আর আমার চেহারার মধ্যে কিছুটা মিল ছিল। তার কারণও অবশ্য ছিল। আমার ঠাকুমা ছিলেন জার্মান। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ এই চেহারার সুবিধা বিবেচনা করেই আমাকে জার্মানিতে পাঠিয়েছিল।
কার্ল জার্মান হলেও নাত্সী ছিল না। বরং অত্যাচারী গেস্টাপোদের অন্তর থেকে ঘৃণা করত সে। নাৎসীদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় কার্লের বাবাকে তারা খুন করেছিল, দুই ভাইকে কারাগারে পাঠিয়েছে। কার্লেরও অব্যাহতি পাবার কথা নয়। একই পরিবারের লোকের প্রতি তাদের ব্যবহারে ব্যতিক্রম ঘটবে কেন? দেশ ছেড়ে ইংলন্ডে পালিয়ে আসার কোনো সুযোগই কার্লের ছিল না।