আমার চিন্তাধারা, কাজের অগ্রগতি সবই টমিকে জানিয়েছি। আমাদের আলোচনা থেকে মিসেস স্প্রট বরাবরই বাদ থেকেছে। টমি অপহৃত হবার আগে পর্যন্ত মিসেস স্প্রট সম্পর্কে আমার মন ছিল খোলা।
টমির অনুসন্ধানের ব্যাপারে অ্যালবার্টের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। সেই সময়ই দারুণ চটপটে যুবক এন্টনি মার্সর্ডনের সঙ্গে আলাপ হল। সে জানায় একসময় টমির কিছু কাজও করে দিয়েছে।
অবশ্য মার্সডন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেও আমি তাকে কখনওই পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি।
–কেন, বিশ্বাস করনি কেন? জানতে চাইল টমি।
–কারণ, মিঃ গ্রান্টের কাছে শুনেছিলাম, পঞ্চমবাহিনীর লোক সবদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের সার্ভিসেও যে তারা অনুপস্থিত নেই এ-বিষয়ে তিনি আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
মার্সর্ডনকে আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করবার আগে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। ফল পেতেও দেরি হল না। সে একটা সঙ্কেতপূর্ণ চিঠি আমার হাতে ধরিয়ে দিল। খবরটা যথাসময়েই আমি মিঃ গ্রান্টকে জানিয়ে দিলাম, তারপর মার্সডনের কৌশলে গিয়ে পড়লাম হেডকের আরেক আস্তানায়।
-কাজটা হয়েছিল দারুণ, হেসে বলে উঠলেন মিঃ গ্রান্ট, শত্রুরা ভাবতেই পারেনি আপনি যখন গ্রামের ভেতর দিয়ে পাঁচ মাইল পথ পায়ে হেঁটে চলেছেন, তখন আমরাও আপনাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে চলেছি।
–তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম, আপনি আসবেন। তাই ঝুঁকিটা নিতে ইতস্তত করিনি। যতক্ষণ পারা যায় আমি হেডকের সঙ্গে দরকষাকষি চালাতাম।
কিন্তু অদ্ভুত ঘটনাটা এমন আকস্মিকভাবে ঘটে গেল যে, মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত রহস্যটাই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।
–কী ঘটনা? উৎসুক হল টমি।
-বাচ্চাদের একটা ছড়া, বলল টুপেনস, ওরে বোকা চললে কোথা–কি জানি কেন মনে এলো, আমিও আবৃত্তি করে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গেই দেখি ছিটকে লাফিয়ে উঠল হেডক। প্রবল ক্রোধে তার চেহারাটাই সম্পূর্ণ পালটে গেল।
অপ্রাসঙ্গিকভাবে একটা শিশু পাঠ্য ছড়া বলে তাকে উপহাস করেছি–এই ভেবে একটা লোক এতটা ক্রুদ্ধ কখনওই হতে পারে না। বিশেষ করে হেডক সেই সময় আবেগমথিত গলায় কথা বলে আমাকে ভজাবার চেষ্টা করছিল।
স্বভাবতই ছড়ার বইটার কথা আমার মনে পড়ল। বুঝতে পারলাম, বইটার মধ্যেই এর রহস্য লুকিয়ে আছে।
এর পরের ব্যাপারটা পুরোপুরি হৃদয়বৃত্তি ঘটিত বলা যায়। হেডক অ্যানকে আমার প্রহরায় রেখে গিয়েছিল। তার মুখে আমি নিখাদ মাতৃত্বের ছায়া দেখতে পেলাম, যা দেখেছিলাম সেই পোলিশ স্ত্রীলোকটির মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল রাজা সলোমনের কথা বুঝতে আর কিছুই বাকি রইল না।
হঠাৎ এর মধ্যে আবার রাজা সলোমনকে টানলে কেন?
বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল টমি।
অনুকম্পার হাসি হাসল টুপেনস। একে একে অন্য দু-জনের মুখের ওপরেও তার দৃষ্টি ঘুরে গেল। সকলেই উগ্রীব নির্বাক।
টুপেনস বলল, কেন মনে পড়ল? মনে আছে সেই কাহিনি? একটি শিশুপুত্র নিয়ে দুই রমণী রাজার দরবারে উপস্থিত হয়েছিল। শিশুটির মাতৃত্বের দাবি জানিয়েছিল দু-জনেই।
রাজা সলোমন হুকুম করলেন, শিশুটিকে দুখণ্ড করে দু-জনকে দিয়ে দেওয়া হবে।
আসল মা আঁতকে উঠল। কিন্তু নকল মা তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল।
আসল মা রাজাকে বলল, শিশুটিকে কেটো না। ওই রমণীকেই শিশুটি দিয়ে দাও।
এ হল সেই চিরন্তন মায়ের বুলি। সে কখনওই নিজের সন্তানের মৃত্যুর কারণ হতে পারে না।
এবারে সেদিনের পাহাড়ের সেই ঘটনার কথা মনে করে রেখো।
হেডক গুলি ছুঁড়বার হুমকি দিতেই পোলিশ স্ত্রীলোকটি বেটিকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরল–পাছে না তার গায়ে গুলি লাগে।
কিন্তু মিসেস স্প্রট একটুও ইতস্তত না করে ট্রিগার টিপে বসলেন। স্ত্রীলোকটি নিহত হল। কিন্তু ভেবে দেখো, ওই গুলিতে ছোট্ট বেটিও বিদ্ধ হতে পারত। মিসেস স্প্রটের মনে তেমন আশঙ্কা থাকলে কখনওই সে এভাবে গুলি করতে পারত না–আর তার শঙ্কিত না হওয়ার কারণ হল, সে শিশুটির গর্ভধারিণী নয়।
আমার এ কথা বলার উদ্দেশ্য হল, ওই শিশুটি মিসেস স্প্রটের মেয়ে নয়, তবুও কেন সে অমনভাবে গুলি করে পোলিশ রমণীটিকে হত্যা করল?
টুপেনস এক মুহূর্ত নীরব রইল। পরে ভারি গলায় বলল, কারণ ওই মহিলাই ছিল বেটির জন্মদায়িনী মা।
সহায় সম্বলহীন উদ্বাস্তু মা কেবল তার সন্তান বেঁচে থাকবে, ভালো থাকবে এই আশায় তার সন্তানকে দত্তক দিয়েছিল। এমন ঘটনা-হৃদয় বিদীর্ণ করে।
–শিশুটিকে মিসেস স্প্রট দত্তক নিয়েছিল কেন? টমি জানতে চাইল।
–নিজের গুপ্তচরবৃত্তির কাজের সুবিধার জন্য–সান্স সৌচিতে নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখার জন্য। এমনটা কখনওই সম্ভব নয় যে একজন প্রথম শ্রেণির গুপ্তচরও তার শিশু সন্তানকে নিয়ে বিপজ্জনক খেলায় নামবে।
আমিও এই ধোঁকায় বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। শিশুটি সঙ্গে ছিল বলেই আমার সন্দেহের দৃষ্টি কখনও পড়েনি তার ওপরে।
কিন্তু দত্তক দিয়েও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি বেটির জননী। যেভাবেই হোক সে মিসেস স্প্রটের ঠিকানা সংগ্রহ করেছিল আর ঘুরে ঘুরে আসত যদি মেয়েটিকে একপলক দেখতে পায়।
এভাবেই একদিন সুযোগ পেয়ে সে বেটিকে তুলে নিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। আমরা সকলেই শিশুটির কথা ভেবে অস্থির হয়ে পড়লাম।
মিসেস স্প্রট কিন্তু সেই অবস্থাতেও পুলিশে খবর দেবার ব্যাপারে প্রবলভাবে বাধা দিতে থাকে। এমনকি পুলিশে খবর দেবার পথ বন্ধ করার জন্য নিজের হাতে ভুয়ো হুঁশিয়ারিপত্র লিখে সকলকে ধোঁকা দেয়। পরে হেডককে খবর দেয় সাহায্যের জন্য।