তিন মিনিট সময় আমি তোমাকে দিলাম। এর মধ্যে তোমাকে বলতে হবে বইটা কোথায় রেখেছ?
কথা শেষ করে হাতঘড়িটা খুলে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলেন হেডক।
-মিসেস বেরেসফোর্ড, মাত্র তিন মিনিট সময়
টুপেনসের মুখে অদ্ভুত আত্মতৃপ্তির হাসির আভা। সমস্ত অঙ্কের হিসেব মিলে গেছে তার–মুহূর্তের ভাবনায় সকলের পরিচয়ই পরিষ্কার হয়ে গেছে তার কাছে।
এক দুই তিন চার করে মুহূর্ত গুণে চলেছেন হেডক। কিন্তু আট অবধি গুনে আর এগুতে পারলেন না।
একটা পিস্তলের শব্দের সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ল হেডকের বিশাল দেহ। একরাশ বিস্ময় তার মৃত্যুকাতর দৃষ্টিতে।
হেডক নিজের হিসেবে এমনই তন্ময় হয়ে ছিলেন যে, পেছনের খোলা দরজা দিয়ে সাক্ষাৎ শমন এসে কখন এই ঘরে পা দিয়েছে, বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেননি।
বিভ্রান্ত টুপেনস চোখ তুলেই দেখতে পায় পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে মিঃ গ্রান্ট। পরক্ষণেই দু-জনে ঘর ছেড়ে লাফিয়ে বাইরে নেমে আসে। লাফিয়ে উঠে পড়ে অপেক্ষামান পুলিশের গাড়িতে।
এখুনি সান্স সৌচিতে পৌঁছতে হবে–একটা মুহূর্ত যেন নষ্ট না হয়। ওখানে একবার খবর পৌঁছে গেলে চক্রান্তের নায়িকাকে আর পাওয়া যাবে না। বলে উঠলেন গ্রান্ট।
মত্ত বেগে গাড়ি ছুটিয়েছেন মিঃ গ্রান্ট। একটা গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। তার মধ্যেই একসময় টুপেনস প্রশ্ন করল, টমি কোথায়?
–মুক্ত। আধঘণ্টা আগে তাকে উদ্ধার করেছি।
উঁচু নিচু পাহাড়ি পথে ঝড়ের গতিতে ছুটছে গাড়ি। ওই তো সান্স সৌচি দেখা যাচ্ছে বাগানের প্রবেশ পথ
গাড়ি থামতেই লাফিয়ে নেমে পড়ল টুপেনস। তাকে অনুসরণ করলেন মিঃ গ্রান্ট।
হলঘরের দরজা যেমন থাকে বরাবর তেমনিই খোলা। ঘর জনশূন্য।
নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে থাকে টুপেনস। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে একপলক তাকাল নিজের ঘরের দিকে।
সমস্ত ঘর লণ্ডভণ্ড। বিছানা বালিশ, ফালা ফালা কাগজপত্রে ছয়লাপ-ড্রয়ারগুলো খোলা। যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে ঘরের ভেতরে।
টুপেনস ঝট করে ক্লে দম্পতির খালি ঘরে ঢুকে পড়ল। একটানে বিছানার চাদর সরিয়ে ফেলতেই বাচ্চাদের পুরোনো ছড়ার বইটা বেরিয়ে পড়ল। ছোঁ মেরে সেটা তুলে নিল টুপেনস। ঘুরে দাঁড়িয়ে বাড়িয়ে দিল মিঃ গ্রান্টের দিকে।
-এটাই খুঁজছিল হেডক-এরই মধ্যে সব আছে। অদৃশ্য কালিতে লেখা। সামান্য অসাবধানতার সুযোগে বাচ্চাটা খেলতে খেলতে বইটা ওখানে রেখে যায়–
হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ। ঝট করে ঘুরে তাকায় টুপেনস। দরজার সামনে দণ্ডায়মান মিসেস স্প্রট।
–কি ব্যাপার–আপনারা এখানে–
–মিঃ গ্রান্ট, টুপেনস আঙুল তুলে বলতে থাকে, ওই যে–আপনি যাকে খুঁজছিলেন বিখ্যাত নাৎসী-মহিলা স্পাই M–সান্স সৌচিতে ইনিই মিসেস স্প্রট।
.
টেবিল ঘিরে বসেছেন মিঃ গ্রান্ট, টমি এবং অ্যালবার্ট। সকলেরই সাগ্রহ দৃষ্টি টুপেনসের দিকে।
টুপেনস নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করে নিয়েছে আগেই। সে-ও সবকিছু খুলে বলতে উৎসুক।
–নাও, এবার শুরু করো।
টমি অনুরোধ জানাল।
–তুমিই শুরু করো না, আমি পরে বলছি। বলল টুপেনস।
-আমার কথা তো যৎসামান্য। নেহাত দৈবক্রমেই বলা যায় আমি হেডকের ঘরের ট্রান্সমিটারের সন্ধান জেনে গিয়েছিলাম।
ওই সময় যেভাবে হেডক বাথরুমের দরজা ফাঁক করে তাকিয়ে ছিল, ভয় হয়েছিল, বুঝি এবারই আমাকে শেষ করে দেবে।
কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, হেডক নিপুণ অভিনেতার মতো নিজেকে সংযত করে রাখল–আমাকে তার অভিসন্ধির আভাস মাত্র পেতে দেয়নি।
–ওই অভিনয় করেই তো সে সময়টা কাজে লাগিয়েছিল। একটু দেরি না করে সে ফোনে মিসেস টকে খবরটা জানিয়ে দিয়েছিল।
আর মিসেস স্প্রটও সঙ্গে সঙ্গেই বাগানে ঢুকে তোমার অপেক্ষা করতে থাকে। তোমার মাথায় হাতুড়িটা ঠুকেছিল সেই।
ব্রিজ খেলার আসর ছেড়ে এসে মাত্র তিন মিনিটের মধ্যেই সে কাজ হাসিল করেছিল। সে যখন ফিরে এলো, তাকে সন্দেহ করার কোনো সুযোগ ছিল না। তাকে কেবল ঘন ঘন শ্বাস নিতে দেখা গিয়েছিল।
–আমার বন্দিত্ব মোচনের কৃতিত্বটুকু অ্যালবার্টের প্রাপ্য। বলল টমি।
–হ্যাঁ, বললেন মিঃ গ্রান্ট, যথাসময়েই সে আমাকে খবরটা পৌঁছে দেয়।
আমরা যখন স্মাগলার্স রেস্টে পৌঁছই, তখন হেডক সেখানে ছিল না, কিছুক্ষণ আগেই গলফ ময়দানে বেরিয়ে গিয়েছিল। কটেজের দখল নিতে আমাদের বেগ পেতে হয়নি। পরে নৌকোটাও আমরা কবজা করে নিই।
-তোমার কথা এবারে বলো, টুপেনস। বলল টমি।
–আমার কথা বলতে হলে স্বীকার করতেই হয়, টুপেনস বলতে শুরু করে, আমার সামনে কোনো আলো ছিল না।
সকলকেই সন্দেহ করছি–সকলের চলন বলন অর্থপূর্ণ মনে হচ্ছে। তবে মিসেস স্প্রট ছিল বরাবরই আমার সন্দেহের বাইরে।
সেদিন দুপুরে আকস্মিকভাবেই টেলিফোনে আড়ি পাতার সুযোগ পেয়েছিলাম। ওই চতুর্থ, শব্দটা শুনেই খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
দুপুরে সান্স সৌচি ছিল একেবারে ফাঁকা। কেবল মিসেস ওরুরকি আর মিসেস স্প্রট এই দু-জনই উপস্থিত ছিল।
অদ্ভুত ব্যাপার, মিসেস স্প্রটকে বাদ রেখে আমার সন্দেহ পড়ল মিসেস পেরিনা আর মিসেস ওরুরকির ওপর।
ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে সবকিছুর নায়িকা হচ্ছে মিসেস স্প্রট।
মহিলা এত সাদাসিদে থাকত যে সে এমন একটা চক্রান্তের মধ্যে থাকতে পারে সন্দেহ করবার কোনো অবকাশই ছিল না।