–একথার অর্থ?
-বুঝলে না, টমাস বেরেসফোর্ডের কথা জানতে চাইছি। সে-ও তো সান্স সৌচিতে ছিল। এখন অবশ্য আমার ঘরের মেঝেয় গড়াগড়ি যাচ্ছে।
-টমি–
-হ্যাঁ, টমি, উল্লাসে ফেটে পড়েন হেডক, সে এখন আমার থাবার মধ্যে। তবে তোমার ওপরেই নির্ভর করছে তার ভাগ্য। উলটো-পালটা কিছু বললেই টমির মাথা আঁঝরা হয়ে যাবে বুলেটে
চোখ নত করল টুপেনস। এক মিনিট নীরব রইল। পরে বলল, বলুন, কী জানতে চান?
–পথে এসো। আমাকে আগে বলল, এখানে তোমাদের নিয়োগ করেছে কে? তার সঙ্গে। তোমরা যোগাযোগ রাখ কীভাবে?
মৃদু হাসল টুপেনস। বলল, এসব কথার জবাব তো আমি মিথ্যাও বলতে পারি।
-তোমার প্রতিটি কথার সত্যতা আমি যাচাই করে দেখব।
এক মুহূর্ত নীরব থাকেন হেডক। তারপর চেয়ারটা টেনে টুপেনসের কাছাকাছি এনে বসলেন। তার মুখভাবের পরিবর্তন হল। নরম সুরে বলতে লাগলেন, তুমি কী ভাবছ আমি। জানি। শোন, সত্যিকথা বলতে, কর্মী হিসেবে তোমাকে ও তোমার স্বামীকে আমি শ্রদ্ধা করি। তোমাদের মতো সাহসী নরনারী যে কোনো রাষ্ট্রের সম্পদ। আগামী দিনে আমরা যে নতুন রাষ্ট্র গড়ে তুলব, সেখানে তোমাদের খুবই প্রয়োজন।
যাইহোক, আমাদের নেতার আদৌ ইচ্ছে নেই এ দেশকে তার সাম্রাজ্যভুক্ত করা। তিনি চান, জার্মান শাসনের বাইরে থেকেই নিজের বলে বলীয়ান হয়ে উঠুক ব্রিটেন।
এই দেশেরই মহান সন্তানদের দ্বারা পরিচালিত হোক। দূর হোক সমস্ত দুর্নীতি, ঘুষ, নোংরামি ও মানসিক ব্যাধির।
দেশে দেশে এই পরিবর্তন আমরা আনতে চাই–গড়ে তুলতে চাই এক নতুন ইউরোপ। সেখানে বিরাজ করবে অবিচ্ছিন্ন শান্তি ও প্রগতি। মিসেস বেরেসফোর্ড, আমার অনুরোধ, তুমি এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের বিচার করে দেখো।
কমাণ্ডার হেডকের আবেগতপ্ত কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল টুপেনস। তার মনে হচ্ছিল, উষ্ণ আদর্শে উদ্বুদ্ধ যেন একজন খাঁটি ব্রিটিশ নাবিকের যাদুময় কথা শুনছে। মনে মনে হেডকের প্রশংসা করল সে।
একটা ফুরফুরে আবেগ যেন চঞ্চল হয়ে উঠল ভেতরে। কিছু না ভেবেই মনের খেয়ালে হালকা কণ্ঠে আবৃত্তি করে উঠল টুপেনস–
ওরে বোকা, চললে কোথা
সর, ওপাশে সর,
উঁচু নিচু ধাপ পেরিয়ে
ঢুকলে রানির ঘর।
শিশুপাঠ্য কৌতুক-ছড়ার এমন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া যে হেডকের মধ্যে ঘটতে পারে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি টুপেনস।
সে হতভম্ব হয়ে দেখল, মুহূর্তের মধ্যে হেডকের কোমল মুখভাব পালটে গেল। চেয়ার থেকে ছিটকে উঠে দাঁড়ালেন হেডক, দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করলেন, বটে! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।
গলা চড়িয়ে হাঁক দিলেন, অ্যান?
যে জার্মান মহিলা টুপেনসকে দরজা খুলে দিয়েছিল, ডাক শুনে সে ঘরে ঢুকল। হেডক তার হাতে পিস্তলটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আমি ভেতর থেকে আসছি–তুমি একটু নজর রাখো। দরকার মনে করলে গুলি করবে।
কথা শেষ করে ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন হেডক।
টুপেনস নির্বিকার। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করতে থাকে সামনের মহিলাটিকে।
–কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করো না, টুপেনসকে উদ্দেশ্য করে বলল জার্মান মহিলাটি, ইংরাজদের আমি অন্তর থেকে ঘৃণা করি।
গত যুদ্ধে আমার একমাত্র ছেলে ইংরেজদের হাতে প্রাণ দিয়েছে। পুত্রশোকের আগুন আমার বুকে দিনরাত জ্বলছে।
সেই পোলিশ মহিলাটির কথা মনে পড়ে গেল টুপেনসের। আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে বেটিকে বুকের সঙ্গে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছিল।
গুলির মুখে প্রস্তুত তবু বেটিকে কোলছাড়া করবে না। এই অকৃত্রিম মাতৃস্নেহই সে দেখতে পাচ্ছে এখানেও।
চমকে ওঠে টুপেনস। অদ্ভুত এক আলো যেন সে দেখতে পায় চোখের সামনে। মাতৃস্নেহের সেই চিরন্তন আলোতে যেন সত্য উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে অভাবিতভাবে।
…মিসেস স্প্রট ইতস্তত করলেন না গুলি ছুঁড়তে আর বেটিকে আড়াল করে ধরে সেই গুলিতে প্রাণ দিলেন পোলিশ মহিলা। এ যেন রাজা সলেমানের সেই বিখ্যাত বিচার-কাহিনি। টুপেনসের মনে হল, সেই পোলিশ মহিলার মুখে সেদিন সে চিরন্তন মায়ের মুখের ছবিই দেখতে পেয়েছিল।
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন হেডক। উদ্ভ্রান্তের মতো গর্জন করে উঠলেন, কোথায় লুকিয়েছ সেটা, কোথায়, বলো।
টুপেনস হতবাক। কী লুকোবার কথা বলছেন হেডক সে বুঝতে পারছে না।
-তুমি এখন যাও।
অ্যানের হাত থেকে রিভলবারটা নিজের হাতে নিয়ে হুকুম করলেন হেডক।
উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছেন হেডক। চেয়ারে বসে পড়লেন থপ করে।
–আমার হাত থেকে পার পাবে না তুমি, তোমার স্বামীও। আমি জানি কীভাবে কথা বার করতে হয়। বলো, কোথায় রেখেছ সেই বইটা?
চমকে ওঠে টুপেনস। হেডক তাহলে একটা বইয়ের সন্ধান করছেন। তাহলে একটা অস্ত্র পাওয়া গেল। খেলানো যাবে অন্তত কিছুক্ষণ।
টুপেনস ধীরে ধীরে বলল, সেটা যে আমি পেয়েছি জানলেন কী করে?
–আমাকে বোকা বানাবার বৃথা চেষ্টা করো না। ছড়াটা শিখলে কোত্থেকে?
-কিন্তু ভাবলেন কী করে সেটা আমি এখনও গোয়েন্দা দপ্তরে পোস্ট না করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছি?
-না তুমি পাঠাওনি। গতকাল থেকে যা যা ডাকঘরে দিয়েছ, সবই আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। আর বইটা তো পাওয়া যাচ্ছে না আজই। আমি বুঝতে পারছি, সকালে সান্স সৌচি থেকে বেরুবার আগে ওখানেই তুমি সেটা কোথাও লুকিয়ে রেখে এসেছ। আমাকে এত সহজে ফাঁকি দিতে পারবে না তুমি।