আমরা তার আগেই বোট সমেত সবকিছু দখল করে নেব। তাই শেষ মুহূর্তটি না আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
টুপেনস জিজ্ঞেস করল, পারবে তো?
–নিশ্চয়, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তার কোনো বিপদ হবে না। জবাব দিল মার্সডন।
কাছেই স্তূপ করে রাখা ছিল একটা প্যারাস্যুট, কিছু জামাকাপড় আর এক খণ্ড ক্যানভাস। ওগুলোর দিকে আঙুল তুলে টুপেনস জিজ্ঞেস করল, এসব কী?
প্যারাসুট আর নার্সের পোশাক।
–এসব এখানে কেন?
–প্যারাসুট করে নেমে এসেছিল এক জার্মান নার্স। সে আপাতত আমাদের হাতে বন্দি। স্থানীয় এক চিকিৎসক ডাঃ বিনিয়নের চেম্বারে উপস্থিত হবার কথা ছিল তার।
–সাংঘাতিক ব্যাপার! তারপর?
–ডাঃ বিনিয়ন শত্রুপক্ষের লোক। আপনাকে নার্স সেজে তার চেম্বারে যেতে হবে।
–খাসা পরিকল্পনা। তাহলে মেকআপ
–সব বন্দোবস্ত আমরা করে রেখেছি–তবে খুবই ঝুঁকির কাজ।
–কিছু যায় আসে না, তোমরা প্রস্তুত থাকবে।
–আপনার নির্দেশ পেলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব। বলল মার্সডন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নিখুঁত জার্মান নারীর ছদ্মবেশ নিয়ে নিল টুপেনস। এখন তার নাক সামান্য চ্যাপ্টা, ঠোঁট পুরু। কিছু চুল কপালের ওপর আলগা হয়ে আছে।
মেকআপ শেষ করে নার্সের পোশাক পরে নিল টুপেনস। তারপর ঠিকানা নিয়ে গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চলল। নির্জন রাস্তায় এভাবে পাঁচ মাইল পথ যেতে হবে তাকে।
১৪ নং এলসফা রোডে ডাঃ বিনিয়নের চেম্বার। বাড়ির সামনে পৌঁছে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশটা একবার দেখে নিল টুপেনস। তারপর কলিংবেল টিপল।
মধ্যবয়স্ক এক মহিলা দরজা খুলে দাঁড়াল। দেখেই বোঝা যায় ইংরেজ নয়।
–ডাঃ বিনিয়ন? বলল টুপেনস।
–তুমি নার্স এন্টন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
–তাহলে অপারেশন থিয়েটারে চল।
মহিলা দরজা বন্ধ করে টুপেনসকে সঙ্গে করে দোতলায় উঠে এলো। ছোট্ট সার্জিকেল চেম্বার। স্ত্রীলোকটি টুপেনসকে বলল, এখানে বসো, ডাক্তার বিনিয়ন আসছেন।
টুপেনস অপেক্ষা করে থাকে। কাকে দেখতে পাবে বুঝতে পারছে না।
এক মিনিট পরেই দরজা খুলে গেল। কিন্তু ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়েই টুপেনসের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল।
কমাণ্ডার হেডক।
.
ছদ্মবেশী টুপেনসকে চিনতেও এক মুহূর্ত বিলম্ব হল না কমাণ্ডার হেডকের। কিন্তু অটল তার গাম্ভীর্য। জার্মান কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে ইংরাজিতে বললেন, তুমি তাহলে এসে গেছ?
-হ্যাঁ, স্যার, অকম্পিত কণ্ঠে বলল টুপেনস, আমি নার্স এন্টনি।
–নার্স, সকৌতুক হাসি ফুটল হেডকের ঠোঁটে, হ্যাঁ, এই পোশাকে নিখুঁত মানিয়েছে, তোমাকে। দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো।
টুপেনস সসম্ভ্রমে আসন নিল। অপেক্ষা করতে লাগল।
-তাহলে আমাদের এদিককার খবর তুমি জান সব…আঁ…আক্রমণের তারিখ কবে স্থির হয়েছে বলো তো?
–চার তারিখ।
সর্বসত্তায় কেঁপে উঠলেন হেডক। কপালের রেখায় দ্রুত ভাজ পড়ে।
–তাহলে দেখছি জেনে গেছ?
এক মুহূর্ত নীরব থেকে টুপেনস বলে, বলুন, আমাকে কী করতে হবে?
ভেতরের প্রচণ্ড উত্তেজনা চাপতে গিয়ে মুখ বিকৃত হয়ে উঠছিল হেডকের। কোনো রকমে বললেন, যথাসময়ে সবই জানতে পাবে। সান্স সৌচির নাম নিশ্চয় জানা আছে তোমার?
–ওই নাম আগে কখনও শুনিনি।
–শোননি বলছ?
–না। তীব্র স্বরে বলল টুপেনস।
হিংস্র হাসিতে মুখ বিকৃত হল হেডকের। চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করলেন, আশ্চর্য কাণ্ড, সান্স সৌচির নামই তুমি বলছ আগে শোননি। অথচ আমি জানি, গত একমাস ধরে ওখানেই তুমি আস্তানা গেড়ে আছ।
টুপেনসের হৃদপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে।
বিদ্রুপের স্বরে হেডক বলে ওঠেন, মিসেস ব্লেনকিনসপ, তাহলে ভালোই আছে বলা যায়, কী বলে?
সংযতকণ্ঠে জবাব দেয় টুপেনস, ডাঃ বিনিয়ন, আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আজই সকালে আমি এখানে প্যারাসুটে করে নেমেছি।
হা-হা অট্টহাসি হেসে উঠলেন হেডক।
–কত বোকা তোমরা ভেবে দেখ। ছেঁড়াফাটা একটা প্যারাস্যুট আর ক্যানভাসে কিছু জার্মান হরফ দেখেই ফাঁদে পা দিয়ে বসলে। হা-হা-শোন, আমি ডাঃ বিনিয়ন নই। বিনিয়ন হলেন আমার দাঁতের ডাক্তার। তার চেম্বারটি আমি কেবল মাঝে মাঝে নিজের কাজে ব্যবহার করে থাকি।
-তাই বুঝি! টুপেনসও সকৌতুকে মন্তব্য করে।
-হ্যাঁ, মিসেস ব্লেনকিনসপ। না, আমি তোমাকে আসল নাম মিসেস বেরেসফোর্ড বলেই বরং সম্বোধন করব।
এবারে আর চঞ্চল হল না টুপেনস। নিজেকে সে প্রস্তুত করে নিয়েছে। পরিণতি তার জানা। সে এখন মাকড়সার জালে বন্দি।
কোটের পকেট থেকে রিভলবার বার করে আনেন হেডক।
–কাজের কথা শোন। এখানে চেঁচামেচি জুড়বার চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে না। তোমাকে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসবে না।
টুপেনস নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দেয়, আপনাকে জানিয়ে দিই, আমরা বন্ধুরা এ বাড়ির আশপাশেই ওঁত পেতে আছে।
আর এক দফা অট্টহাসি হেডকের। উল্লাসে ফেটে পড়ছেন যেন।
–তোমার পুরোনো দোস্ত মার্সড়নের ওপর দেখছি অগাধ আস্থা তোমার। আমি দুঃখিত মিসেস বেরোসফোর্ড, এন্টনি মার্সডন আমাদেরই লোক।
তোমাদের সিক্রেট সার্ভিসে ঢুকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে…তোমার এই সাহসিকতার প্রশংসা করলেও পরিণতির জন্য সত্যিই আমার আক্ষেপ হচ্ছে। যাইহোক, এবার বলো, সান্স সৌচি থেকে কতটা কী আবিষ্কার করলে?
টুপেনস নীরব। চোখে পলকহীন দৃষ্টি।
হেডক আবার বললেন, বুঝতে পারছি অনেক কিছুই জেনে গেছ। …বাকি অর্ধেকের খবর কী?