সেই জার্মান পরিচারকটি কী? কিন্তু সে তো বাড়ির মধ্যেই ছিল। হলঘরে খাবারের ট্রে সাজাচ্ছিল।…কোনো সূত্রই উদ্ধার করতে সমর্থ হল না টমি।
অন্ধকারের বুক চিরে একফালি আলো চোখে পড়ল। ছোট্ট কোনো ঘুলঘুলিই হবে নিশ্চয়…ভাবল টমি।…ঘরের মেঝেয় পড়ে আছে সে…কিন্তু ঘরটা কোথায়?
আচমকা এক ঝটকায় কপাট খুলে গেল। একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল এপেলডোর। সেটা একপাশে বসিয়ে দিয়ে একে একে নিয়ে এলো জলের জাগ, গ্লাস আর চিজ সহ কিছু রুটি।
রুটিন কাজের মতো জিনিসগুলো যথাস্থানে রেখে টমির ঠোঁটের ব্যাণ্ডেজ খুলতে লাগল।
–মুখে টু শব্দ না করে খাবারটা খেয়ে নাও। চেল্লাবার চেষ্টা করলে আবার ব্যাণ্ডেজ সেঁটে দেব।
লোকটা খাবার তুলে তুলে টমিকে খাইয়ে দিল। যথারীতি নীরবে।
খাওয়া শেষ হলে টমি বলল, তোমাদের ব্যাপার স্যাপার কি বলো তো?
এপেলভোর নীরব।
-আমি হেডকের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
লোকটা টমির মুখে আবার প্লাস্টার এঁটে দিল। তারপর উঠে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
কয়েক মিনিট পরেই হেডক উপস্থিত হল। পেছনে সহচর এপেলডোর।
টমির মুখ থেকে প্লাস্টার ব্যাণ্ডেজ খুলে নেওয়া হল। হাতপায়ের বাঁধনও আলগা হল। ধীরে ধীরে উঠে বসল টমি।
-চেঁচাবার চেষ্টা করলে খুলি উড়িয়ে দেব।
উদ্যত পিস্তল হাতে চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল হেডক।
টমি কিন্তু সুর চড়িয়েই প্রথম কথাটা বলল, মতলবটা কী শুনি, আমাকে এভাবে অপহরণ করা হল কেন?
–অযথা বকবক করো না। আমার সঙ্গে চালাকি করে পার পাবে না, তোমার আসল পরিচয় আমি জানি…
টমি কিছু বলতে চায়। কিন্তু ধমকে তাকে থামিয়ে দেয় হেডক।
-একদম চুপ। তোমার মিথ্যের ঝুরি শোনার মতো সময় আমাদের নেই। তোমাকে নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই…এখান থেকে তুমি বাইরে বেরুতে পারছ না।
পুলিশ কিন্তু বসে থাকবে না–আমি যখন নিরুদ্দেশ
হিংস্র হয়ে ওঠে হেডকের মুখ। চোখ জ্বলে ওঠে।
–পুলিশ তো আজ বিকেলেই এসেছিল। অফিসার দু-জন আমার ঘনিষ্ঠ। তাদের দূরতম কল্পনাতেও ছিল না যে তুমি এ বাড়িতেই অন্ধকুঠুরিতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছ।
–পুলিশ আমাকে ঠিক এখান থেকে খুঁজে বার করবে।
-পুলিশ আর তোমার নাগাল পাচ্ছে না, আজ রাতের মধ্যেই হাপিস হয়ে যাচ্ছ তুমি। একটা ছোট্ট বোট এসে পৌঁছবার কথা আছে, তোমার প্রাণহীন দেহটা তার মধ্যে করেই সাগরে পাচার হয়ে যাবে। কাকপক্ষীতেও তোমার হদিশ পাবে না।
টমি বিলক্ষণ বুঝতে পারল দুর্ভেদ্য ফাঁদেই আটকা পড়েছে সে। নির্বিঘ্নেই এরা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করবে। কিন্তু টুপেনস যদি নিরাপদ থাকে তাহলে এরা বেশিদূর এগুবার সুযোগ পাবে না।…কিন্তু তার কী হবে? গোয়েন্দা বিভাগ কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? টুপেনস নিশ্চয়ই এতক্ষণে বেরিয়ে পড়েছে তার সন্ধানে।
সান্স সৌচি থেকে নিরাপদেই বেরিয়ে গিয়েছিল সে। দু-জন পরিচিত পথচারী তার সাক্ষী রয়েছে। এর পরও কি হেডক আর তার স্মাগলার্স রেস্ট নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে না?
হেডক একসময় বিদায় নিল। তবে যাবার আগে ফের আগের মতোই টমিকে বেঁধে রেখে গেছে। বন্ধন দশায় না থাকলে ঘুলঘুলির ক্ষীণ আলোর উৎস লক্ষ্য করে চিৎকার করতে পারত টমি।
সে অনুমান করতে পেরেছিল রাস্তার ধারে কোনো চোর-কুঠুরিতেই তাকে আটকে রাখা হয়েছে। চিৎকার করতে পারলে বাইরে কারো না কারো কানে ঠিক পৌঁছত। কিন্তু মুখে প্লাস্টার ব্যাণ্ডেজ নিয়ে এখন নিরুপায় পড়ে থাকতে হবে তাকে।
কিন্তু নিশ্চেষ্ট থাকলে চলবে না। টমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল যদি দড়ি বা ব্যাণ্ডেজ আলগা করা যায়।
আধঘণ্টা ধরে হাঁচড়পাঁচড় করেও ব্যর্থ হল টমি। হাঁপিয়ে গেল সে। অন্ধকার প্রকোষ্ঠের বাইরের অবস্থাটা ধারণায় আনবার চেষ্টা করতে লাগল।
এতক্ষণে বেলা পড়ে এসেছে সম্ভবত। হেডক হয়তো গলফ ময়দানে ভিড়েছে। হয়তো তার জন্য কাঁদুনি গাইছে সকলের কাছে। ছদ্ম উদ্বেগ মুখে মেখে প্রতারিত করছে সকলকে।
উৎকর্ণ হয়েছিল টমি। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়েছিল। সহসা তার কানে ধরা পড়ে কারো কণ্ঠস্বর। কে যেন এই ঘরের সংলগ্ন পথে গান গাইছে। ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে কণ্ঠস্বর। গান গাইতে গাইতে লোকটি পথ বেয়ে চলে যাচ্ছে।
বহুকালের পরিচিত গান-গলার স্বরও যেন চেনা মনে হল টমির।
তার মনে পড়ল ১৯১৪ সালে টুপেনসকে খুঁজে বার করার জন্য এই গান সে নিজেই গেয়েছিল। তার সেই অভিযান ব্যর্থ হয়নি।
কার পক্ষে এই ইঙ্গিতপূর্ণ গান গাওয়া সম্ভব হতে পারে?…একমাত্র অ্যালবার্টের পক্ষেই সম্ভব। এ কৌশল তাদের বহুচর্চিত।
টমি সজাগ হল। অ্যালবার্ট তাহলে হাতের নাগালেই তো রয়েছে।
কিন্তু আওয়াজ করে তার মনোযোগ আকর্ষণ করবে সে পথ বন্ধ …কিন্তু অ্যালবার্টকে তার উপস্থিতি তো জানানো দরকার।
এক মুহূর্ত চিন্তা করল টমি। পরক্ষণেই প্রবল বেগে নাসিকা গর্জন আরম্ভ হল তার। মুখ বন্ধ হলেও নাসিকা সক্রিয় হতে তো বাধা নেই। অ্যালবার্ট নিশ্চয়ই এই সংকেতের অর্থ উদ্ধার করতে পারবে।
.
জার্মান এজেন্টদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল ছিল অ্যালবার্ট। তাই টমির নিরুদ্দেশের সংবাদ পেয়েই সে তার পরিকল্পনা ছকে ফেলল।
জার্মান সিক্রেট সার্ভিসকে যে ভাবে তোক ঠেকাতে হবে। নাৎসীদের সাফল্য মানেই তো ফ্রান্সের বিপর্যয়।