সন্ধ্যার পর তো মনে হল একবার বেরিয়েছিলেন, বললেন মিসেস স্প্রট, আমি ফোন করতে গেলাম যখন, সেইমাত্র ফিরলেন।
মিস মিল্টন বলে উঠলেন, তাহলে গিয়েছিলেন কোথাও। সিনেমায় যাননি নিশ্চয়ই.. তাহলে এত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারতেন না।
মিসেস স্প্রট বললেন, মাথায় তো টুপি চোখে পড়ল না। মাথার চুল সব কেমন এলোমেলো হয়ে ছিল। খুব হাঁপাচ্ছিলেন।
দেখে মনে হল কোথাও থেকে ছুটে আসছেন। আমাকে দেখেও কোনো কথা বললেন না, সরাসরি ওপরে উঠে গেলেন।
এই সময় মিসেস ক্লে ফিরে এলেন। নিজের আসনে বসতে বসতে বললেন, মিঃ ক্লে ঠিকই আছেন, বাগানে ঘুরে বেড়োচ্ছেন।
আবার তাস বাটা হল। আর ঠিক সেই সময়েই ঘরে এসে ঢুকলেন মিসেস পেরিনা।
–বেরিয়ে ফিরলেন? হাসিমুখে জানতে চাইলেন মিস মিল্টন।
–আমি বেড়োতে যাইনি তো? তীক্ষ্ণস্বরে বললেন মিস পেরিনা।
–না, মিসেস স্প্রট বলছিলেন কিনা, আপনি সন্ধ্যাবেলা বেরিয়েছিলেন—
ও, মিনিটখানেকের জন্য বেরিয়েছিলাম। আবহাওয়াটা কেমন দেখতে।
মেজাজ যে সরিফ নেই মিসেস পেরিনার রুক্ষস্বরের জবাব থেকেই পরিষ্কার বোঝা গেল।
–আজ আবহাওয়া চমৎকার, বললেন মিসেস ক্লে, মিঃ ক্লে আজ মনের আনন্দে গোটা বাগান ঘুরে বেড়োচ্ছন।
–এ সময়ে বাগানে এত ঘোরাঘুরি কেন, তীব্রস্বরে বললেন মিসেস পেরিনা, যুদ্ধের সময়, যে কোনো মুহূর্তে একটা বোঝা এসে পড়তে পারে। বলতে বলতে তিনি ক্ষিপ্রগতিতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
আচমকা অমন বোমার কথা শুনে সকলেই হকচকিয়ে গেলেন। ভদ্রমহিলার মেজাজ হঠাৎ এমন চড়ে গেল কেন কেউই বুঝতে পারলেন না।
–একেবারে মিলিটারি মেজাজ। বললেন মিসেস ক্লে।
নেশা করে এসেছেন নিশ্চয়। মন্তব্য করলেন মিসেস স্প্রট।
–ব্রিজ নিয়ে বসেছেন…ওঃ দারুণ!
মুখময় হাসি ছড়িয়ে আবির্ভূত হলেন মিসেস ওরুরকি।
–আপনার হাতে ওটা কী? সাগ্রহে জানতে চাইলেন মিসেস স্প্রট।
-ও এটা, হাতুড়ি, বাগানে পড়েছিল। কেউ নিশ্চয় ভুল করে ফেলে রেখে এসেছিল, তাই নিয়ে এলাম।
-বাগানে আবার হাতুড়ি ফেলে রেখে এলো কে? অবাক হলেন মিসেস স্প্রট।
–আমিও তাই ভাবছি। বললেন মিসেস ওরুরকি।
মেজর ব্লেচলি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। তিনিও একটু পরেই ফিরলেন। তার প্রায় পেছনেই ঘরে ঢুকলেন মিঃ ক্লে।
হলঘর আবার জমজমাট হয়ে উঠল।
.
খবরটা একসময় সকলেই জেনে গেল…সাল সৌচির অন্যতম বাসিন্দা মিঃ মিয়াদো সন্ধ্যা থেকেই রহস্যজনক ভাবে উধাও।
ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত টুপেনস। তবে টমির এই আকস্মিক অন্তর্ধানে আশান্বিত সে। টমি নিশ্চয় মিসেস পেরিনা কিংবা সমগোত্রের কাউকে অনুসরণ করতে গিয়ে মূল ঘাঁটির সন্ধান পেয়ে গেছে। কাজ সমাধা হলে যথাসময়ে ফিরে আসবে।
মিসেস পেরিনা যারপরনাই বিব্রত। দিন কয়েক আগেই ঘটে গেছে বেটিকে নিয়ে একটা দুঃখজনক ঘটনা।
সান্স সৌচির বাসিন্দাদের চাপে পড়ে পুলিশে ফোন করলেন মিসেস পেরিনা।
মেজর ব্লেচলি কৌতুকের হাসি মুখে মেখে ঘন ঘন আড়চোখে তাকাতে লাগলেন বিধবা মিসেস ব্লেনকিনসপের মুখের দিকে। মহিলার ভাবান্তরটা উপভোগ করতে উন্মুখ তিনি।
একটা অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের সম্ভাবনার আশা দেখতে পেলেও টুপেনস কিন্তু নিশ্চেষ্ট থাকল না। তড়িঘড়ি দেখা করল মিঃ গ্রান্টের সঙ্গে।
টমির কোনো খবর রাখেন না মিঃ গ্রান্ট। বললেন, অস্থির হবেন না। পরবর্তী ঘটনার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে।
তবে মিসেস পেরিনা যে এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত নন সেই আভাস তিনি দিলেন। তবে এটা জানালেন যে, টুপেনস সেদিন দুপুরে টেলিফোনে আড়ি পেতে যে চতুর্থ কথাটি উদ্ধার করেছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ তিনি খবর পেয়েছেন, আগামী মাসের চার তারিখে যাতে ইংলন্ড আক্রমণ করা যায় সেভাবে নাৎসীরা প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এরপর অ্যালবার্টকেও টমির নিখোঁজ হবার সংবাদটা জানিয়ে দিল টুপেনস।
এই সময় অভাবিত ভাবেই এন্টনি মার্সর্ডন নামে এক তরুণের সঙ্গে তার আলাপ হয়ে গেল। ছেলেটি বেরেসফোর্ড দম্পতিকে চেনে বলে জানাল।
এক সময় টমির কাছ থেকে কিছু কাজও নাকি পেয়েছিল। টুপেনসের কাছেও করবার মতো কাজ চাইল সে।
টুপেনস তাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে দিয়ে চারদিকে সতর্ক নজর রাখার কথা বলে দিল। আরও বলল, জরুরি কোনো সংবাদ থাকলে যেন সান্স সৌচির ঠিকানায় সংকেত-পূর্ণ চিঠি লিখে জানায়।
.
জ্ঞান ফিরলেও সঙ্গে সঙ্গেই চোখ খুলতে পারল না টমি। চোখের পাতা অসম্ভব ভারি হয়ে আছে। সমস্ত শরীরে অসহ্য ব্যথা।
নড়াচড়া করবার ক্ষমতাও নেই, হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। ঠোঁটের ওপর ব্যাণ্ডেজ সাঁটা–কোনো আওয়াজ বের করবার উপায় নেই।
একসময়-চোখ তুলে ঘন নিরেট অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না টমি। বুঝতে পারল, পাথুরে মেঝেতে পড়ে আছে।
নিজের মনেই হাসল টমি। হাবাগোবার অভিনয় করেও পার পাওয়া গেল না। বিপদের গ্রাসে পড়ে গেছে। এখন ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধি হাতড়ে বার করতে হবে।
শরীরে ব্যথা…পেটে খিদের মোচড়…হাত-পা বাঁধা…নিজের অবস্থার কথা ভাবতে ভাবতে
মনে পড়ে গেল ধুরন্ধর হেডক…বাথরুম…ওয়ারলেস..জার্মান ওয়েটার…তারপর সান্স সৌচির বাগানে মাথার পেছনে প্রচণ্ড আঘাত…
হ্যাঁ আঘাত, অসম্ভব নিরেট কিছুর আঘাত…কিন্তু এই আঘাত কার পক্ষে করা সম্ভব? হেডক তো স্মাগলার্স রেস্ট-এই রয়ে গেল…তার দরজা বন্ধ করার শব্দ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।