সাবানে পা পিছলে ছোট্ট কেবিনে ধাক্কা খেয়ে মিনিটখানেকের মধ্যেই টমির মনে এতসব কথা বিজবিজ করে উঠল।
সোজা হয়ে সামলে দাঁড়াবার পরেই খেয়াল হল শত্রুর শিবিরে মাথা গলিয়ে দিয়েছে সে, সামলে চলতে না পারলে মহা বিপদ।
সে বুঝতে পারল…তাকে এখান থেকে নিরাপদে বাইরে বেরুতে হলে মোটা মাথার এক ইংরেজের অভিনয় বজায় রাখতে হবে। এছাড়া বাঁচার পথ নেই। সে যে কিছু দেখতে পেয়েছে তা বুঝতে দেওয়া চলবে না।
টমি মাথা তুলে দেখতে পেল বাথরুমের দরজার মাথায় যেন শূন্যে ঝুলছে হেডকের হিংস্র মুখ… নিষ্পলক চোখ জোড়া তার ওপরে নিবদ্ধ।
গোবেচরার মতো হেসে উঠল টমি। হেডক পালটা অট্টহাসি হেসে বলে উঠলেন, আরে আরে মিয়াদো, আপনি দেখছি বাথরুমে একেবারে ব্যালে নাচ জুড়েছেন। হায় হায়…চলে আসুন…অন্য ঘরে যাওয়া যাক।
টমি সামলেসুমলে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে। তার শরীরের সমস্ত পেশী টানটান হয়ে উঠেছে। ইন্দ্রিয়গ্রাম সজাগ। শত্ৰুপুরী থেকে যেভাবেই হোক তাকে নিরাপদে বাইরে যেতে হবে।
হেডক স্বাভাবিক স্বরেই কথা বলছেন। নিজের বসার ঘরে নিয়ে এলেন টমিকে। তারপর নিজের হাতে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
শুনুন মিয়াদো, অন্তরঙ্গ সুরে বললেন হেডক, বসুন এখানে, আপনাকে নিভৃতে কয়েকটা কথা বলবার আছে।
টমির পাশে আসন নিয়ে ফের বলতে থাকেন, এসব কথা বাইরের কাউকে বলা চলে না…তবু…আপনাকে বিশ্বাস করি বলে বলছি…আশা করি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন।
–অবশ্যই, টমি সতর্ক কণ্ঠে বলে, আপনি নির্ভয়ে বলুন।
-হ্যাঁ, বলছি। আমার আসল পরিচয় এখানে কেউই জানে না। আসলে আমি হচ্ছি সিক্রেট সার্ভিসের লোক। ডিপার্টমেন্টে আমার গোপন নাম M. I. 42B. x… এমন নাম আগে শুনেছেন?
–শুনিনি। এখন আগ্রহ হচ্ছে…
–বলছি শুনুন। কিন্তু হুঁশিয়ার…কেউ যেন ঘুণাক্ষরে টের না পায়। তাহলে গোটা পরিকল্পনাটাই ভণ্ডুল হয়ে যাবে।
বুঝতে পারছি। আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন…
এরপর হেডক ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগের অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানার বিবরণ শোনাতে লাগলেন। আর এক বোকা ইংরেজের ভূমিকা নিয়ে টমি শুনে যেতে লাগল মুখ হাঁ করে।
হাবভাবে এখন হেডক পুরোদস্তুর একজন ব্রিটিশ নাবিক…কিন্তু তার জোরালো চোয়াল, কপালের গড়ন, নাক, গলার স্বর সবেতেই জার্মানসুলভ ছাপ লক্ষ করতে লাগল টমি।
.
রোমাঞ্চকর সব তথ্যের বিবরণ শুনে হাঁপিয়ে উঠল টমি। একসময় উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, আজ এখানেই থাক কমাণ্ডার, অনেক দেরি হয়ে গেল। কাল না হয় বাকিটা শোনা যাবে।
আর মনে মনে জপছে টমি, একবার এখান থেকে বেরুতে পারলে হয়।
টমি শুভরাত্রি জানিয়ে নিজেই দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো…হলঘরে এসে এপেলডোরের সঙ্গে চোখাচোখি হল। আগামী দিনের প্রাতঃরাশ গোছগাছ করছে ট্রের ওপর।
.
নিঃঝুম চারপাশ। স্মাগলার্স রেস্ট-এর আওতা ছেড়ে নিরাপদেই বেরিয়ে এলো টমি। রাস্তায় কাদের কথা বলার শব্দ কানে এলো।
মুখোমুখি হতে চিনতে পারল টমি। পথচারী দু-জনই পরিচিত। হেডকেরও আলাপ আছে এদের সঙ্গে। টমি কথা বলতে বলতে চলতে লাগল তাদের সঙ্গে।
মুক্তির নিঃশ্বাস যে কত আরামপ্রদ বুঝতে পারছে এতক্ষণে টমি।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়েছেন হেডক। তার দরজা বন্ধ করার শব্দও কানে এসেছে। জার্মান স্পাইরা যে এত বোকা হয় জানা ছিল না টমির। স্রেফ বোকা বানিয়ে সে বেরিয়ে এসেছে।
যুদ্ধ নিয়েই এখন আলোচনা সর্বত্র। ওরা তিনজনও জার্মানির ইংলন্ড আক্রমণের সম্ভাব্যতা নিয়ে মতামত বিনিময় করছে। ব্রিটিশ নৌবহর প্রস্তুত হয়েই রয়েছে…জার্মানরা চ্যানেল পার হবার সময়ই বুঝতে পারবে যুদ্ধ কাকে বলে। তবে এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাশিয়ার ওপর।…
সান্স সৌচির বাগানের দরজার সামনে পৌঁছে গেল সে। গোটা পরিবেশটা যেন ঘুমে ঢলে পড়েছে।
সঙ্গীদের শুভরাত্রি জানিয়ে দরজা ঠেলে বাগানে ঢুকল টমি। মনে মুক্তির আনন্দ…অনাবিল স্ফূর্তি।
রডোডেনড্রন ঝোপটাকে পাশ কাটাতে গিয়ে ঈষৎ মাথা হেঁট করল টমি। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আচমকা ভারি কিছু একটা তার মাথার পেছন দিকে প্রচণ্ড আঘাত করল।
অস্ফুট আর্তনাদ করে শূন্যে লাফিয়ে উঠল টমি। তারপরই টাল খেয়ে দেহটা সশব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ল।
চোখের ওপর যেন কেউ এক বোতল কালি ঢেলে দিল। যন্ত্রণায় মুখ কুঞ্চিত হল।
সংজ্ঞা হারাল টমি।
.
সান্স সৌচির হলঘরে ব্রিজ খেলায় মজে গেছেন চার মহিলা। মিসেস স্প্রট, মিসেস ব্লেনকিনসপ, মিসেস ক্লে এবং মিস মিল্টন।
ইতিমধ্যে খেলা ছেড়ে মিসেস ম্প্রটকে কয়েক মিনিটের জন্য টেলিফোন ধরবার জন্য উঠতে হয়েছিল। ফিরে এসেছিলেন একরকম দৌড়ে। আসনে বসে ঘন ঘন শ্বাস টেনেছেন।
এর কিছুক্ষণ পরেই উসখুস করে উঠলেন মিসেস ক্লে।
–আমায় একটু উঠতে হবে ভাই। মিঃ ক্লে বাগানে পায়চারি করেছেন…ঠান্ডা লাগিয়ে বসবেন…একপলক দেখে আসি…কিছু মনে করবেন না…বাগান থেকে কেমন একটা বিশ্রী আওয়াজ পেলাম…কী করছেন কে জানে…।
বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
এই সময় মিস মিল্টন বলে উঠলেন, শীলাকে দেখতে পেলাম না এবেলা
মিসেস স্প্রট জবাব দিলেন, সিনেমায় গেছে।
–মিসেস পেরিনাও কি সঙ্গে গেছেন? জানতে চাইল টুপেনস।
–ঘরেই তো থাকবেন বলেছিলেন, বললেন মিস মিল্টন, কী সব হিসেবপত্র ঠিক করতে হবে। বেচারি…টাকার হিসেব-নিকেশ নিয়ে জীবনের আমোদআহ্লাদ খুইয়ে বসে আছেন…